ফুকুশিমা বিস্ফোরণ এবং বাংলাদেশ প্রসঙ্গ by তারেক শামসুর রেহমান

জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিস্ফোরণ ঘটেছিল প্রায় এক মাস আগে, ১১ মার্চ। ওই বিস্ফোরণে শুধু জাপানের জ্বালানিনীতিতেই এখন পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে না, বরং বিশ্ব পরমাণুনীতির সংস্কারের কথাও বলা হচ্ছে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন বাংলাদেশ কী করবে? বাংলাদেশ কি তার পরমাণু জ্বালানি প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাবে?


নাকি প্রকল্পটি আপাতত স্থগিত করে দেবে? ফুকুশিমার পারমাণবিক বিপর্যয়ের পর এমন প্রশ্ন ব্যাপকভাবে আলোচিত। বলা দরকার, এ অঞ্চলে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল আজ থেকে ৫০ বছর আগে, ১৯৬১ সালে। পাবনার রূপপুরে ওই সময় যে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, সেই জমি এখনো সেভাবেই পড়ে আছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রথম এ ব্যাপারে বড় ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে রাশিয়ার সঙ্গে প্রাথমিক একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে ২০০৯ সালের ১৩ মে। এক হাজার মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার। ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশ তার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে নতুন করে কোনো চিন্তাভাবনা করেনি। বরং বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াসেফ ওসমান জানিয়ে দিয়েছেন, দেশের বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে পারমাণবিক বিদ্যুতের বিকল্প নেই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত সপ্তাহে মস্কো গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি রাশিয়ার কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। সব ঠিক থাকলে প্রধানমন্ত্রী আগামী জুলাইয়ে রাশিয়া সফর করলে, সেখানে চূড়ান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হতে পারে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশের এখন পারমাণবিক জ্বালানি নিয়ে ভাবতে হবে। এক. ফুকুশিমার দুর্ঘটনার পর বিশ্ব জনমত এখন পারমাণবিক জ্বালানির বিপক্ষে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি যে পারমাণবিক কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না, জাপানের ফুকুশিমার দুর্ঘটনা এর বড় প্রমাণ। জার্মানি তাদের নিজস্ব সাতটি পারমাণবিক জ্বালানিকেন্দ্র আপাত বন্ধ ঘোষণা করলেও ক্ষমতাসীন সিডিইউ সরকারের পতন ঘটেছে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে। সেখানে পরমাণু জ্বালানির বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখে গ্রিন পার্টি বিজয়ী হয়েছে। দক্ষিণপন্থীরা সেখানে ৫৮ বছর ক্ষমতায় ছিল। আর প্রথমবারের মতো গ্রিন পার্টির নেতৃত্বে ও এসপিডির সহযোগিতা দিয়ে সেখানে একটি সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে। ফুকুশিমার দুর্ঘটনা গ্রিন পার্টিকে বিজয়ী হতে সাহায্য করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, আবার একটি প্রদেশ রাইনল্যান্ডে পরবর্তী যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেখানেও গ্রিন পার্টি বিজয়ী হবে। জার্মান রাজনীতির জন্য এটা বড় পরিবর্তন। এর পেছনে কাজ করছে জার্মানির পরমাণু শক্তিবিরোধী মানসিকতা। দুই. ফুকুশিমার ঘটনার পর এর ভয়াবহতা ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে। জাপানের পরমাণুকেন্দ্র থেকে নিম্নমাত্রার তেজস্ক্রিয়া চীনের ঘনবসিতপূর্ণ পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলে পেঁৗছেছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলে দুধে তেজস্ক্রিয় আয়োডিন শনাক্ত হয়েছে। মাত্র তিন সপ্তাহের ব্যবধানে প্রশান্ত মহাসাগরের অপর পাড়ে তথা যুক্তরাষ্ট্রে তেজস্ক্রিয়া পাওয়া চিন্তার কারণ। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পরমাণু শক্তিনির্ভর দেশ ফ্রান্স ফুকুশিমার দুর্ঘটনার পর বিশ্বের পরমাণুনীতির সংস্কার দাবি করেছে। আর জাপানের প্রধানমন্ত্রী নাওতা কান মন্তব্য করেছেন, জাপানের পরমাণুকেন্দ্র ধ্বংস করে ফেলা উচিত। ভারতের মতো দেশ থেকে আমরা প্রতিক্রিয়া পেয়েছি।
ভারতের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী ও সরকারের উপদেষ্টা মি. বলরাম দেশটির ভবিষ্যৎ সব পরমাণু প্রকল্প বন্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। মি. বলরাম প্রধানমন্ত্রীর বিজ্ঞানবিষয়ক উপদেষ্টা। তিনি এক খোলা চিঠিতে জাপানের ঘটনাকে ভারতের জন্য সতর্কবাণী হিসেবে উল্লেখ করে বর্তমান পরমাণুনীতি গভীরভাবে পুনর্মূল্যায়নের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি যে খোলা চিঠি লেখেন তাতে ভারতের শীর্ষস্থানীয় ৫০ বিজ্ঞানী স্বাক্ষর করেছেন। বিশ্বব্যাপী এই যে উৎকণ্ঠা, বাংলাদেশ তা উপেক্ষা করতে পারে না। তিন. সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত চেরনোবিল (বর্তমান ইউক্রেনে) পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিস্ফোরণ ঘটেছিল ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল। সেই থেকে ওই শহরটি (প্রিপিয়াত) পরিত্যক্ত। দীর্ঘ ২৫ বছর পর লস অ্যাঞ্জেলস টাইমসে একটি প্রবন্ধ লিখে (৩ এপ্রিল, ২০১১) হেনরি শুকম্যান আমাদের জানিয়েছেন, চেরানোবিল থেকে (যা কংক্রিট দিয়ে ঢেকে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে) এখনো তেজস্ক্রিয়া বেরোচ্ছে। এখন ফুকুশিমা থেকেও এই তেজস্ক্রিয়া বেরোতে থাকবে বছরের পর বছর। ফুকুশিমা থেকে প্রায় এক লাখ মানুষ ও এক লাখ ৩৫ হাজার গরু অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য এটা এক ধরনের সতর্কবার্তা, চিন্তার বিষয়। চার. একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দরকার একটি দক্ষ জনশক্তি। সেই জনশক্তি আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। ফলে রাশিয়ার কারিগর আর ইঞ্জিনিয়ারদের দিয়ে কেন্দ্রটি পরিচালনা করতে হবে, যা আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট নয়। কেননা বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। লোকজনকে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে সরিয়ে নেওয়া সহজ কাজ নয়। পাঁচ. পারমাণবিক বর্জ্য বিশ্বব্যাপীই একটি সমস্যা। 'গ্রিন পিচ' দুনিয়াজুড়েই পারমাণবিক বর্জ্য পরিবহনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র এত দিন ণঁপপধ (লাস ভেগাস থেকে ১০০ মাইল দূরে) পাহাড়ের গভীরে এই পারমাণবিক বর্জ্য পুঁতে রাখত। ২০১০ সালে ণঁপপধ পাহাড়ে পুঁতে রাখার কর্মসূচি পরিত্যক্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি ফান্ড রয়েছে, যার পরিমাণ ২৪ বিলিয়ন ডলার।
পারমাণবিক বর্জ্য হাজার বছর থাকে, নষ্ট হয় না, মাটিতে মিশেও যায় না। এখন বাংলাদেশে আমরা এই পারমাণবিক বর্জ্য পুঁতে রাখব কোথায়? আমাদের সেই পাহাড় নেই, নেই পরিত্যক্ত অঞ্চল। ফলে অন্য কোনো দেশে তা পাঠাতে হবে, যা শুধু বাংলাদেশকে অর্থ সংকটেই ফেলবে না, বরং বর্জ্য পরিবহন নিয়ে নানা জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। ছয়. বিশ্বের যে জ্বালানি চাহিদা, তার মাত্র ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ মেটায় পারমাণবিক জ্বালানি। জ্বালানির অন্যতম উৎস কয়লা (৪০ দশমিক ৯ শতাংশ)। গ্যাস চাহিদা মেটায় ২১ দশমিক ৩ শতাংশ আর তেল মেটায় মাত্র ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এ থেকে বলা যায়, পারমাণবিক জ্বালানি একমাত্র জ্বালানির উৎস নয়। বাংলাদেশ তার জ্বালানির চাহিদা পারমাণবিক দিয়ে নয়, বরং ভূগর্ভে রক্ষিত কয়লা সম্পদ (পাঁচটি আবিষ্কৃত কয়লা খনিতে মজুদের পরিমাণ দুই হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন, যা ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য) দিয়ে মেটাতে পারে। সাত. অস্ট্রেলিয়ায় কোনো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নেই। কিন্তু কয়লা ব্যবহার করে বিপুল জ্বালানি চাহিদা মেটাচ্ছে দেশটি। অস্ট্রেলিয়া কি আমাদের জন্য কোনো দৃষ্টান্ত হতে পারে না? আট. বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু হলে তা রাশিয়ার ওপর এক ধরনের নির্ভরশীলতা তৈরি করে দিতে পারে। কেননা শুধু রাশিয়ার ইঞ্জিনিয়ারই নয়, বরং বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনার জন্য যে কাঁচামাল দরকার হবে (ইউরেনিয়াম), তার সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য রাশিয়ার সঙ্গে সব সময় আমাদের সম্পর্ক ভালো রাখতে হবে। তা যদি আমাদের জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে, তাহলেও। ৯. পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে ইদানীং যে আশঙ্কা বড় হয় দেখা দিয়েছে, তা হলো 'সাইবার ওয়ার'। অতীতে, আশির দশকে ইসরায়েলি বিমান হাজার মাইল উড়ে গিয়ে ইরাকের পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে বোমা ফেলে তা ধ্বংস করে দিয়েছিল। আজ যুদ্ধবিমানের প্রয়োজন নেই। 'সাইবার ওয়ার' যেকোনো পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র ধ্বংস তথা অকার্যকর করার জন্য যথেষ্ট। ইসরায়েলি গোয়েন্দারা ইরানি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে এ রকম একটি উদ্যোগ নিয়েছিল গত বছর, যা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। দশ. বংলাদেশ যে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে, তার প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা (এ খাতে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং আইএমএফের বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া যায় না)। এই ব্যয় আরো বাড়বে, যা শেষ পর্যন্ত ২০ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়াবে। এই বিপুল অর্থের একটা অংশ বাংলাদেশ বহন করবে, যা দিয়ে খুব সহজেই গ্রামে গ্রামে ছোট ছোট সৌর বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট তৈরি করা যায়। বাংলাদেশে সৌর বিদ্যুতের সম্ভাবনা প্রচুর। এটা কাজে লাগানো দরকার। মোদ্দাকথা, জাপানের মতো দেশ প্রযুক্তি বিদ্যার সর্বোচ্চ সীমায় পেঁৗছেও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। ফুকুশিমার দুর্ঘটনা অবশ্যই আমাদের জন্য একটি শিক্ষা।
লেখক : আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক এবং অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, tsrahmanbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.