নদী যেন অশ্রুধারাঃ সুরক্ষার কাজ লাগসই হচ্ছে না
‘সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা’—এতসব বিশেষণ দিয়ে সোনার বাংলার প্রশস্তি গেয়েছিলেন কবি। উজান থেকে নেমে আসা অজস্র জলধারা ক্রমাগত পলি বয়ে এনে এই ভূখণ্ডকে দিয়েছিল অফুরন্ত উর্বরাশক্তি। সে অর্থেই বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ।
কিন্তু আজ কবির নদী-বন্দনা দৃশ্যত মিথ্যায় পরিণত হয়েছে। নদী আর এ ভূখণ্ডের শুশ্রূষার দায় নিতে পারছে না। হাজার নদীর দেশে এখন আর সেই প্রাণের প্রবাহ নেই; শ্যামল মাঠ, সাজানো নিসর্গ পরিণত হচ্ছে বিরাম প্রান্তরে। ‘নদী নিরবধি’ বলে একটা কথা আছে। নদীর জন্য খ্যাত বাংলাদেশে সে অমোঘ উচ্চারণ প্রায় কুহকে পর্যবসিত। এদেশে এখন অসংখ্য নদী দুর্গন্ধ ছড়ায়, তরল বিষ বহন করে, দেখতে দেখতে টলমলে স্রোত পরিণত হয় বদ্ধ ভাগাড়ে। কারণ-অকারণে অযাচিত নদী-শাসন, বাঁধ-ব্যারাজ নির্মাণ, নদীদখল ইত্যাদি অবিমৃশ্যকারিতার কবলে পড়ে এরই মধ্যে অনেক নদী নিশ্চিহ্ন হয়েছে, অসংখ্য নদী মৃতপ্রায়। কোনোটি ধুঁকে ধুঁকে বয়ে চলছে চিকন স্রোতের মতো। যেন অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে মুষূর্ষু নদীর চোখ বেয়ে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শতাধিক নদী সম্পূর্ণ বিলীন অথবা বিলীন হওয়ার অপেক্ষায়। সেই দীর্ঘ তালিকায় এবার যোগ হয়েছে নীলফামারীর আরও ৩০টি নদী। গঙ্গা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, বুড়িগঙ্গা, করতোয়া, তিস্তা ইত্যাদি নদীর মতোই নদীত্ব হারাতে বসেছে এ জেলার যমুনেশ্বরী, চরালকাটা, শলকী, দেওনাই, বুড়িতিস্তাসহ অন্যান্য ছোটবড় নদী। এর মধ্যে দু’একটি পরিণত হয়েছে মরা খালে। এগুলোর তীর ও তলভূমির বিপুল অংশ করায়ত্ত করেছে দখলদাররা। প্রমত্তা নদী বলে খ্যাত যেসব নদী এখন মৃতপ্রায়, তার প্রধান কারণ উজানে নির্মিত বাঁধ এবং ব্যারাজ। ফারাক্কা বাঁধ দেয়ায় পদ্মার নাব্য এখন শুধুই স্মৃতি। তিস্তাসহ অনেক শাখা-উপনদীর অবস্থাও তাই। উজানে পানি অন্যদিকে গড়িয়ে নিচ্ছে ভারত। ফলে বাংলাদেশ অংশে নদী পর্যাপ্ত পানির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে। কোনোটির বুকজুড়ে জেগে উঠছে নতুন নতুন চর। এসব নদী এখন সেচের পানি জোগান দেয়ার ক্ষমতা হারাচ্ছে। নীলফামারীর তিরিশ নদীর বেহালদশার কারণও প্রায় একই রকম। তিস্তার উজানে ভারত গজলডোবা বাঁধ দিয়েছে। ফলে তিস্তা পরিণত হয়েছে মরা খালে। এরই মধ্যে এখানকার বুড়িতিস্তায় যে সেচ প্রকল্প নেয়া হয়েছিল সেটি পড়ে আছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। জীববৈচিত্র্য বিনাশ হওয়ার পাশাপাশি হুমকির মুখে পড়েছে চাষাবাদ। একই সঙ্গে নদীকে কেন্দ্র করে জীবন-জীবিকার যে পরিবেশ গড়ে উঠেছিল প্রাচীনকাল থেকে, তার ওপরও পড়েছে খড়গাঘাত। তিস্তা ও নীলফামারীর অন্য নদীগুলোর নাব্য না থাকায় ঘোর বিপাকের মুখোমুখি হয়েছে লাখো জেলে পরিবার। নদী তো একা মরে না, সঙ্গে মরে খাল-বিল, হাওড়-বাঁওর। নিচে নেমে যায় তীরবর্তী অঞ্চলের পানির স্তর। সব মিলিয়ে সর্বনাশ। এদিকে সম্প্রতি মেঘনা ও কুশিয়ারা নদীর নৌ-চ্যানেলে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। এমনিতেই নাব্যসঙ্কট তার ওপর প্রভাবশালীদের বহুমুখী উত্পাত এবং যেটুকু নাব্য আছে তাতে মাছ ধরার ঘের বানিয়ে নৌ-চলাচলে বাধার সৃষ্টি। অনেক জায়গায় জাল পেতে ও ঘের দিয়ে চ্যানেল প্রায় অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। অর্থাত্ পানির অভাবে জেগে ওঠা চর এবং দখলদারিত্বের উপদ্রবে নদীর চিরায়ত ভূমিকার কিছুই বাকি থাকছে না। নদীকে কখনও শাসন করতে হয়। পৃথিবীর বিখ্যাত অনেক নদীকে সংশ্লিষ্ট নদীর স্বার্থেই শাসন করা হয়েছে তার নাব্যের কোনো ক্ষতি না করেই। নদীর তীরে প্রতিরক্ষা বাঁধ দিলেই নদী ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই এসব উদ্যোগের ফলাফল হয়েছে উল্টো। নদী শাসনের নামে যা হয়েছে, তা চলে গেছে শোষণের পর্যায়ে। বিচিত্র দুর্নীতি, অদক্ষতা, পরিকল্পনাহীনতার জন্য প্রতিরক্ষা বাঁধের কোনোটিই বিজ্ঞানসম্মত হচ্ছে না। ফি-বছর বর্ষায় ভাঙছে আবার বিপুল টাকা খরচ করে জোড়াতালি দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি গোমতী নদীর বাঁধটির অবস্থা দাঁড়িয়েছে অনেকটা সে রকম। গোমতীর দু’তীরে রয়েছে প্রায় ১৪১ কি.মি. বাঁধ। সেখান থেকে অবৈধভাবে মাটি কেটে নেয়া হচ্ছে, মাটি বোঝাই ট্রাক চলছে অবাধে। ফলে বাঁধের অবস্থা এখন করুণ। বাঁধের পাকা অংশের পিচ উঠে যাচ্ছে ট্রাক্টরের অবৈধ চলাচলে। অথচ কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ড নানা অজুহাত সৃষ্টি করে দোষ স্খলন করছে।
আলোচ্য তিনটি ঘটনা আমাদের সার্বিক রাজনৈতিক প্রশাসনিক দুর্বলতাকেই প্রমাণ করে। সরকার ভারতের সঙ্গে সম্প্রতি আলাপ-আলোচনা করে আশাব্যঞ্জক তেমন কিছুই করতে পারেনি। এদিকে নদী সুরক্ষা ও প্রতিরক্ষা বাঁধ ব্যবস্থা ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে না ঠিকমত। অর্থাত্ নদী সুরক্ষার কার্যক্রম লাগসই হচ্ছে না, কাজের চেয়ে কথা হচ্ছে বেশি। সরকারের উচিত কোমরকষে এর উল্টো ভূমিকায় নামা। নইলে নদীই প্রতিশোধ নেবে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শতাধিক নদী সম্পূর্ণ বিলীন অথবা বিলীন হওয়ার অপেক্ষায়। সেই দীর্ঘ তালিকায় এবার যোগ হয়েছে নীলফামারীর আরও ৩০টি নদী। গঙ্গা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, বুড়িগঙ্গা, করতোয়া, তিস্তা ইত্যাদি নদীর মতোই নদীত্ব হারাতে বসেছে এ জেলার যমুনেশ্বরী, চরালকাটা, শলকী, দেওনাই, বুড়িতিস্তাসহ অন্যান্য ছোটবড় নদী। এর মধ্যে দু’একটি পরিণত হয়েছে মরা খালে। এগুলোর তীর ও তলভূমির বিপুল অংশ করায়ত্ত করেছে দখলদাররা। প্রমত্তা নদী বলে খ্যাত যেসব নদী এখন মৃতপ্রায়, তার প্রধান কারণ উজানে নির্মিত বাঁধ এবং ব্যারাজ। ফারাক্কা বাঁধ দেয়ায় পদ্মার নাব্য এখন শুধুই স্মৃতি। তিস্তাসহ অনেক শাখা-উপনদীর অবস্থাও তাই। উজানে পানি অন্যদিকে গড়িয়ে নিচ্ছে ভারত। ফলে বাংলাদেশ অংশে নদী পর্যাপ্ত পানির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে। কোনোটির বুকজুড়ে জেগে উঠছে নতুন নতুন চর। এসব নদী এখন সেচের পানি জোগান দেয়ার ক্ষমতা হারাচ্ছে। নীলফামারীর তিরিশ নদীর বেহালদশার কারণও প্রায় একই রকম। তিস্তার উজানে ভারত গজলডোবা বাঁধ দিয়েছে। ফলে তিস্তা পরিণত হয়েছে মরা খালে। এরই মধ্যে এখানকার বুড়িতিস্তায় যে সেচ প্রকল্প নেয়া হয়েছিল সেটি পড়ে আছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। জীববৈচিত্র্য বিনাশ হওয়ার পাশাপাশি হুমকির মুখে পড়েছে চাষাবাদ। একই সঙ্গে নদীকে কেন্দ্র করে জীবন-জীবিকার যে পরিবেশ গড়ে উঠেছিল প্রাচীনকাল থেকে, তার ওপরও পড়েছে খড়গাঘাত। তিস্তা ও নীলফামারীর অন্য নদীগুলোর নাব্য না থাকায় ঘোর বিপাকের মুখোমুখি হয়েছে লাখো জেলে পরিবার। নদী তো একা মরে না, সঙ্গে মরে খাল-বিল, হাওড়-বাঁওর। নিচে নেমে যায় তীরবর্তী অঞ্চলের পানির স্তর। সব মিলিয়ে সর্বনাশ। এদিকে সম্প্রতি মেঘনা ও কুশিয়ারা নদীর নৌ-চ্যানেলে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। এমনিতেই নাব্যসঙ্কট তার ওপর প্রভাবশালীদের বহুমুখী উত্পাত এবং যেটুকু নাব্য আছে তাতে মাছ ধরার ঘের বানিয়ে নৌ-চলাচলে বাধার সৃষ্টি। অনেক জায়গায় জাল পেতে ও ঘের দিয়ে চ্যানেল প্রায় অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। অর্থাত্ পানির অভাবে জেগে ওঠা চর এবং দখলদারিত্বের উপদ্রবে নদীর চিরায়ত ভূমিকার কিছুই বাকি থাকছে না। নদীকে কখনও শাসন করতে হয়। পৃথিবীর বিখ্যাত অনেক নদীকে সংশ্লিষ্ট নদীর স্বার্থেই শাসন করা হয়েছে তার নাব্যের কোনো ক্ষতি না করেই। নদীর তীরে প্রতিরক্ষা বাঁধ দিলেই নদী ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই এসব উদ্যোগের ফলাফল হয়েছে উল্টো। নদী শাসনের নামে যা হয়েছে, তা চলে গেছে শোষণের পর্যায়ে। বিচিত্র দুর্নীতি, অদক্ষতা, পরিকল্পনাহীনতার জন্য প্রতিরক্ষা বাঁধের কোনোটিই বিজ্ঞানসম্মত হচ্ছে না। ফি-বছর বর্ষায় ভাঙছে আবার বিপুল টাকা খরচ করে জোড়াতালি দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি গোমতী নদীর বাঁধটির অবস্থা দাঁড়িয়েছে অনেকটা সে রকম। গোমতীর দু’তীরে রয়েছে প্রায় ১৪১ কি.মি. বাঁধ। সেখান থেকে অবৈধভাবে মাটি কেটে নেয়া হচ্ছে, মাটি বোঝাই ট্রাক চলছে অবাধে। ফলে বাঁধের অবস্থা এখন করুণ। বাঁধের পাকা অংশের পিচ উঠে যাচ্ছে ট্রাক্টরের অবৈধ চলাচলে। অথচ কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ড নানা অজুহাত সৃষ্টি করে দোষ স্খলন করছে।
আলোচ্য তিনটি ঘটনা আমাদের সার্বিক রাজনৈতিক প্রশাসনিক দুর্বলতাকেই প্রমাণ করে। সরকার ভারতের সঙ্গে সম্প্রতি আলাপ-আলোচনা করে আশাব্যঞ্জক তেমন কিছুই করতে পারেনি। এদিকে নদী সুরক্ষা ও প্রতিরক্ষা বাঁধ ব্যবস্থা ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে না ঠিকমত। অর্থাত্ নদী সুরক্ষার কার্যক্রম লাগসই হচ্ছে না, কাজের চেয়ে কথা হচ্ছে বেশি। সরকারের উচিত কোমরকষে এর উল্টো ভূমিকায় নামা। নইলে নদীই প্রতিশোধ নেবে।
No comments