নদীর এ কেমন সীমানা নির্ধারণ?

অবশেষে ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর সীমানা নির্ধারণের কাজ শুরু হয়েছে। অনেকেই একে নদীগুলো সংরক্ষণের বদলে মেরে ফেলার অপচেষ্টা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কারণ ২০০৯ সালের জুন মাসে হাইকোর্ট যে রায় ও নির্দেশনা দিয়েছিলেন, এই সীমানা পিলার স্থাপনের কাজটি তার সঙ্গে মোটেও সংগতিপূর্ণ নয়।


গতকাল মঙ্গলবার তুরাগ নদে সীমানা পিলার স্থাপনের কাজ উদ্বোধন করেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খান। সীমানা পিলার স্থাপনের এই প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৯ কোটি টাকা। সীমানা পিলারগুলো স্থাপন করা হচ্ছে নদীর ঢাল ও তীর বাদ দিয়ে শুষ্ক মৌসুমে যতটুকু স্থানে পানি আছে তার কাছাকাছি। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছিল ১৯১৩ সাল থেকে পরিচালিত ক্যাডেস্ট্রাল সার্ভে বা সিএস এবং ১৯৮৩ সালে পরিচালিত রিভাইজড সার্ভে বা আরএস মানচিত্র সমন্বয় করে নদীগুলোর সীমানা নির্ধারণ করার জন্য। তাতে 'ফোরশোর' বা নদীর ঢালসহ তীর পর্যন্ত নদীর সীমানা নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছিল। ফোরশোর বলতে বোঝায়, শুষ্ক মৌসুমে যে পর্যন্ত পানি থাকে এবং বর্ষা মৌসুমে যে পর্যন্ত পানি ওঠে_দুটির মধ্যবর্তী স্থান। এ ছাড়া নির্দেশনায় নদীর তীরে হাঁটার পথ নির্মাণ এবং পর্যাপ্ত বৃক্ষ রোপণের কথা বলা হয়েছিল। এখন যেখানে পিলার স্থাপন করা হচ্ছে সেই পিলারগুলো ভরা বর্ষায় পানির নিচে চলে যাবে এবং নৌচলাচলে ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। কাজেই সেখানে হাঁটার পথ তৈরি কিংবা বৃক্ষ রোপণ করা_কোনোটাই সম্ভব হবে না। তা ছাড়া পিলার বরাবর নদীগুলোতে মাটি ভরাট করে যদি নতুন করে তীর বানানো হয়, তাহলে নদীগুলো অনেক সংকুচিত হয়ে যাবে এবং নদীখেকোদের স্থায়ীভাবে পুনর্বাসন করা হবে। এর ফলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ৯৯ কোটি টাকা অপচয় তো হবেই, পাশাপাশি নদীগুলোর মৃত্যু ত্বরান্বিত হবে।
ঢাকার চারপাশের নদীগুলো মারা গেলে যে সঙ্গে সঙ্গে ঢাকারও মৃত্যু হবে_এই সত্যটি আমরা অনেকেই বুঝতে চাই না। ঢাকা মহানগরীতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিবছর তিন থেকে পাঁচ মিটার পর্যন্ত নিচে নেমে যাচ্ছে। প্রতিবছরই অনেক গভীর নলকূপ অকেজো হয়ে পড়ছে। সেগুলো তুলে আরো গভীরে নলকূপ স্থাপনের প্রয়োজন হচ্ছে। তার পরও ঢাকায় সরবরাহ করা পানির ৮৫ শতাংশই উত্তোলিত হচ্ছে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। ঢাকার চারপাশের নদীগুলো অত্যধিক দূষিত হয়ে পড়ায় সে পানি শোধন করে সরবরাহ করারও অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। নদীর তলদেশ পলিথিন জাতীয় দ্রব্যে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে বর্ষার পানি ভূগর্ভে প্রবেশ করতে পারছে না। তাই ভূগর্ভে পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। সে অবস্থায় যদি পরিকল্পিতভাবে নদীগুলো মেরে ফেলা হয়, তাহলে একই সঙ্গে ঢাকার মৃত্যুও অবধারিত হয়ে পড়বে। তাই ঢাকা শহরকে বাঁচাতে হলে হাইকোর্টের রায় শতভাগ মেনে সীমানা নির্ধারণ এবং নদীগুলো খননের মাধ্যমে নাব্যতা ফিরিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি নদীদূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। নদীর পানি শোধনের মাধ্যমে সরবরাহ বাড়িয়ে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার ৫০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর যত নিচে নেমে যাবে, বড় ধরনের ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও ততটাই বৃদ্ধি পাবে।
জনগণের বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসা মহাজোট সরকারের কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ কোনোক্রমেই প্রত্যাশিত নয়। হাইকোর্টের রায়ের পর প্রায় দুই বছর হতে চলল। রায় ও নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নের যে ধীরগতি আমরা দেখেছি, তা মোটেও কাম্য ছিল না। তার ওপর নদীকে সংকীর্ণ করার এ ধরনের অপচেষ্টা অত্যন্ত নিন্দনীয়। আমরা চাই, হাইকোর্টের রায় ও নির্দেশনা শতভাগ বাস্তবায়ন করা হোক।

No comments

Powered by Blogger.