মমতা, ক্ষমতা ও ফতোয়া by ফখরুজ্জামান চৌধুরী

সবচেয়ে বন্ধুভাবাপন্ন ও হিতকরী দেশ হিসেবে ভারতের অবস্থান বাংলাদেশের কাছে যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে, তা নিয়ে বিতর্ক কিছুকাল আগেও তেমন একটা ছিল না। বাংলাদেশ যখন পাকিস্তান নামক দুই অংশে বিভক্ত এক অভূতপূর্ব রাষ্ট্র ব্যবস্থার আওতায় ছিল, তখন ভারতকে মিত্ররাষ্ট্র বলে গণ্য করা হতো না।


বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের আগে দুই দেশ একাধিক নিষ্ফল যুদ্ধেও লিপ্ত হয়েছে।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং ভারতের সর্বাত্মক সহায়তায় বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মের পর চার দশক অতিক্রান্ত। সম্প্রতি বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিদেশি বন্ধুদের সংবর্ধনা জানিয়েছে, যা এক ধরনের জাতীয় দায়মুক্তি হিসেবেই অনেকে মনে করেন। এর আগে অবশ্য ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে সর্বোচ্চ উপাধিতে ভূষিত করে বাংলাদেশ সরকার। বর্তমানে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারকে ভারতবান্ধব সরকার হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এমন কিছু ঘটনা মাঝেমধ্যে ঘটে যায়, যার ফলে নির্দ্বিধায় অতিশয় আশাবাদীও বলতে পারবেন না সম্পর্ক সমসৃণ এবং মধুময়।
সীমান্তে বিএসএফের প্রায়ই অমানবিক আচরণের ফলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলতে বাধ্য হন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে রক্তাক্ত সীমান্ত। কাঁটাতারের বেড়াও নিরীহ বাংলাদেশীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
বন্ধুদেশের মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া অকল্পনীয়। বিশ্বে কাঁটাতারের বেড়া আছে ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন, যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো, উত্তর কোরিয়া-দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে। তবে শেষোক্ত দুই দেশের মধ্যে মিলিটারি প্রহরার কড়াকড়ির কারণে দুই দেশের নাগরিকরা সীমান্ত অতিক্রম করার কথা দুঃস্বপ্নেও চিন্তা করেন না।
বাংলাদেশের সীমান্তের আশপাশে যাঁরা বসবাস করেন, তাঁরা সীমান্ত রেখা অতিক্রম করেন অনেক সমেয় বেখেয়ালে। অনেক সময় জীবিকার প্রয়োজনে, যার পুরো দায় রেডক্লিফ নামক এক ইংরেজ রাজ কর্মচারীর। অবিবেচনা ও অদূরদর্শিতা প্রসূত সীমারেখা নির্ধারণের ফলে সীমান্তবর্তী মানুষগুলো সীমারেখার কথা বিস্তৃত হয়ে অন্যদেশে চলে যান। অপঘাতে মৃত প্রতিটি মানুষের বিদেহী আত্মার অভিশাপ প্রাগুক্ত ব্যক্তিকে দংশন করে, এমন বিশ্বাস অনেকের।
সম্প্রতি আরো কিছু বিষয় নিয়ে বন্ধুপ্রতিম দুই দেশের সম্পর্কে যে টানাপড়েন দেখা দিয়েছে, তা অস্বীকার করলে বাস্তবতা বিবর্জিত কাজ করা হবে।
আমাদের নেতৃস্থানীয় অনেকেই আতিশয্যের সঙ্গে যখন বলেন, বাংলাদেশ ভারতের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ ও চিরঋণী স্বাধীনতার যুদ্ধে তার অবদানের জন্য, তখন কবিগুরুর সেই উক্তিটি মনে পড়ে চিরঋণের মতো মন্দ আর কিছু হতে পারে না। (বক্তব্যটি হুবহু উদ্ধৃত করা গেল না, তবে অন্তর্নিহিত বক্তব্য এমনটাই)। এ প্রসঙ্গে চেয়ারম্যান মাওসেতুং ও হোচি মিনের মধ্যে ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষে পত্রালাপের উল্লেখ করি শুধুই ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে।
মার্কিন আগ্রাসনের কারণে ১০টি বছর ভিয়েতনাম যুদ্ধে লিপ্ত থেকে শেষ পর্যন্ত জয়ী হলো। আজকের একমাত্র সুপার পাওয়ারের গ্লানিময় পরাজয়ের পর ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট হোচি মিন চীনের চেয়ারম্যান মাওকে ধন্যবাদ জানিয়ে যুদ্ধকালীন সময়ে সাহায্য দানের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। জবাবে চেয়ারম্যান মাও বলেছিলেন, প্রিয় চেয়ারম্যান, কৃতজ্ঞতা আপনাদের প্রতি আমাদেরও। কারণ এই ১০টি বছর আপনারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে লিপ্ত রাখার কারণে চীন অনেক সহজে বর্তমান উন্নত পর্যায়ে উন্নীত হতে পেরেছে। যে সাহায্য ও সহায়তা পারস্পরিক প্রয়োজনের ভিত্তির ওপর স্থাপিত হয় না, তা হয় দয়া, নয় দাক্ষিণ্য। এবং তার ফলে দাতা ও গ্রহীতার মধ্যকার সম্পর্ক পারস্পরিক শ্রদ্ধাভিত্তিক হয় না।

।। ২।।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক মধুরতর হওয়ার প্রত্যাশায় দেশবাসী খুব আশাবাদী হয়েছিলেন গত বছরের অক্টোবর মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময়। রাজনীতিতে আকস্মিকভাবে প্রবেশ লাভকারী ড. সিং প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ হিসেবে আঙ্কটাডে কর্মরত অবস্থায় (১৯৬৬-১৯৬৯) আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন।
বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের গাহু গ্রামে জন্মগ্রহণকারী মনমোহন সিংয়ের পরিবার ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় ভারতে চলে আসেন। পাঞ্জাব, ক্যামব্রিজ ও অঙ্ফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া সমাপ্ত করে আঙ্কটাডে চাকরির মেয়াদ শেষ হলে ভারতে ফিরে এসে ড. সিং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে দায়িত্ব পালন করে ১৯৯১ সালের রাজ্যসভায় নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসীমা রাওয়ের মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রীর পদ লাভ করেন। তাঁর মন্ত্রিত্বকালে তিনি অর্থনীতিতে এমন কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, যার ফলে ভারতের অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্তভাবে দাঁড়ায় এবং তিনি ভারতীয় অর্থনৈতিক মুক্তবাজারের সঙ্গে সংযুক্ত করেন, যা ছিল তখন যুগান্তকারী এক দুঃসাহসিক পদক্ষেপ।
স্পষ্টভাষী এবং সাধারণের মধ্যে শ্রদ্ধাভাজন ড. সিং বর্তমানে ভারতের ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ এলায়েন্স (ইউপিএ) কোয়ালিশন সরকারের প্রধান হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করছেন। ইউপিএর শরিক দলের অন্য শরিকদের মধ্যে রয়েছে পশ্চিম বঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস, যার প্রধান পশ্চিম বঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি যিনি শুধু ভারতীয় রাজনীতিতেই নয়, প্রতিবেশী বাংলাদেশের জন্যও এক গুরুতর সমস্যা হিসেবে ইতিমধ্যে যথেষ্ট বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। ১৯৬০ সালের ৫ অক্টোবর কলকাতায় জন্মগ্রহণকারী মমতা ব্যানার্জি যুব কংগ্রেসের একনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে ১৯৭০ সালে কংগ্রেসে যোগদান করেন এবং ১৯৭৬-৮০ সাল পর্যন্ত চার বছর পশ্চিমবঙ্গ মহিলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদিকার দায়িত্ব পালন করেন।
মমতা ব্যানার্জি তৎকালীন ক্ষমতাসীন বামপন্থী রাজ্য সরকারের সঙ্গে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন যখন ২০০৭ সালে ইন্দোনেশিয়ার সালেম গ্রুপকে রাসায়নিক কারখানা প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নন্দিগ্রামে জমি বরাদ্দ দেন। মমতা ব্যানার্জি ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললেন। বলা হয়, এই বিরোধিতাই বামফ্রন্ট সরকারের দীর্ঘদিনের শাসনের ভিত্তিতে প্রথম চিড় ধরায়। এরপর আর এক প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুললেন মমতা, যার নাম সিঙ্গুর। টাটা কম্পানি ক্ষুদ্রাকৃতির স্বল্পমূল্যের ন্যানো গাড়ি তৈরি করার কারখানার জন্য পশ্চিম বঙ্গের সিঙ্গুরকে নির্বাচন করে। মমতা ব্যানার্জি জমির মালিকানা টাটাকে হস্তান্তরের বিরুদ্ধে জোর আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং টাটা সিঙ্গুরে তাদের প্রস্তাবিত প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলো। মমতার এই বিরোধিতাকে অনেকে মনে করেন এক ধরনের হঠকারিতা। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গ বঞ্চিত হলো শিল্পায়ন থেকে। টাটা কম্পানি অধিগ্রহণ করা জমির ন্যায্য মূল্য পরিশোধ করত এবং ভূমিচ্যুত পরিবারের সদস্যদের কারখানায় চাকরি ও রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা করতো।
মমতার রাজনীতির বিপরীতে বাম ফ্রন্টের রাজনীতিতেও এমন কিছু ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল সরকার যে ২০১১ সালের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যসভা নির্বাচনে ৩৪ বছরের একটানা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বামফ্রন্ট সরকারের চরম ভরাডুবি হলো। বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে ২২৭ আসনে জয়ী হলো মমতা-নেতৃত্বাধীন ফ্রন্ট। মমতার তৃণমূল কংগ্রেস একাই পেল ১৮৪টি আসন। তিনি পশ্চিম বঙ্গের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন ২০১১ সালের ২০ মে।

।। ৩।।
মমতা ব্যানার্জির ক্ষমতার দাপট ইতিমধ্যে দৃশ্যমান হতে শুরু হলো। বাংলাদেশ অসহায় ভাবে দেখল, পশ্চিম বঙ্গের 'দিদির' আপত্তির কারণে 'প্রায় হয়ে গেছে'- এমন পর্যায়ে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর না করে ঢাকা ছাড়লেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. সিং। আমাদের রাজনীতিতে এখন যাঁরা ক্ষমতার শীর্ষে তাঁরা তো চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য কলমের ক্যাপ খুলে তৈরি হয়েই বসেছিলেন। সেসব দিনের দৃশ্যপট এখন মনে পড়লে এক ধরনের কৌতুক বোধ করা ছাড়া আর করার কিছু থাকে না।
ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারও স্বীকার করে নিল, মমতার অমতে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর হবে না। সব দলের সম্মতিতেই হবে চুক্তি। সব দলের সম্মতির প্রয়োজন বোধ করি, একমাত্র বাংলাদেশেই অপ্রয়োজনীয়।
মমতা ব্যানার্জি শুধু তিস্তার চুক্তিতেই বাগড়া দিলেন না, অভিযোগ করলেন, ফারাক্কার পানিও বাংলাদেশ ন্যায্য হিস্যার চেয়ে বেশি পাচ্ছে বাঁধে ফাটল থাকার কারণে। ফাটল কেন হলো, কতো বড় ফাটল, কতো পানি ফাটলের কারণে বাংলাদেশ বেশি পেয়েছে, তার হিসাবনিকাশ কেন্দ্রীয় সরকারকে দিয়ে করিয়ে ছেড়েছেন মমতা। এমনি মমতা ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয় কোয়ালিশন সরকারের একজন অংশীদার। মমতা ব্যানার্জি ভারতের একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মাত্র। তাঁর বর্তমান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখে ওয়ালস্ট্রিট জর্নালের মতো বনেদি দৈনিক তাদের প্রিন্ট এডিশনে (মার্চ ১৬, ২০১২) পাঁচ কলামব্যাপী সচিত্র এক বিশেষ প্রতিবেদন ছেপেছে, যার শিরোনাম 'ইন্ডিয়া'স স্পয়লার ইন চিফ অ্যাপয়েন্ডস পলিসি- যার সহজ অনুবাদ হলো : ভারতের প্রধান-ধ্বংসকারী পলিসির বারোটা বাজাচ্ছেন। প্রতিবেদনের সঙ্গে ছাপা হয়েছে চার কলামব্যাপী রঙিন এক আলোকচিত্র, যেখানে শাল-আবৃত দিদিকে ঘিরে আছেন তাঁর গুণমুগ্ধ হাস্যোজ্জ্বল সমর্থকরা।
দিদির ক্ষমতার উত্তাপে তিস্তার পানি বাংলাদেশের জন্য বাষ্প হয়ে উবে যাবে, এটা কোনো গ্রহণযোগ্য বিষয় হতে পারে না। চুক্তি করার দায় সার্বভৌম দুই দেশের এবং দুই দেশের মধ্যকার যা ঝুটঝামেলা থাকে, চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে তা মেটানোর দায়িত্বও দেশ দুটির। যারা মমতা ব্যানার্জির ঝগড়াকে চুক্তি স্বাক্ষরের অন্তরাল মনে করেন, তাঁরা হয় আন্তর্জাতিক সম্পর্কে অবুঝ অথবা বুঝেও অবুঝের ভান করেন। আর মমতা ব্যানার্জির নির্বাচনপূর্ব স্লোগান 'বদলা নয়, বদল চাই'- কে এখন পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ লোক রসিকতা করে বলেন, বদলা চাই, বদল পরে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.