অথ কালো বিড়াল সমাচার by তারেক শামসুর রেহমানঅথ কালো বিড়াল সমাচার by তারেক শামসুর রেহমান

দুর্নীতির 'কালো বিড়াল' খুঁজতে গিয়ে নিজেই দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। যদিও সুরঞ্জিত সেন দুর্নীতির সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং তাঁকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার পরও কথা থেকে যায়। ইতিহাস এখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে কিভাবে মূল্যায়ন করবে?


একজন দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ? গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধ সাচ্চা একনিষ্ঠ রাজনীতিবিদ? নাকি একজন সুবিধাভোগী ব্যক্তি, যিনি রাজনীতিকে ব্যবহার করেছেন তাঁর স্বার্থে? আমরা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারছি না দুদক সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিষয়ে তদন্ত করবে কি না? একটি কাগজ লিখেছে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে। যদি তা-ই হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তা এক চিন্তার কারণ। তিনি তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের প্রতি সুবিচার করেননি। যেখানে তিনি বরাবর দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, সেখানে দিরাইয়ে 'সেন মার্কেট' তৈরি করা কিংবা 'সেন কমিউনিকেশন' (ছেলে সৌমেন সেনগুপ্ত স্বত্বাধিকারী)-এর নামে পাঁচ কোটি টাকা দিয়ে ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ লাইসেন্স প্রাপ্তি তাঁর ভূমিকাকে একটি প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। তাঁর নিজ এলাকায় 'শত্রু সম্পত্তি' দখল করার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। দুদক বলছে, তারা সৌমেন সেনগুপ্তের ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট তদন্ত করে দেখবে। তবে দুদক এ ক্ষেত্রে কতটুকু সফল হবে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়। কিন্তু যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে রেলের 'কালো বিড়াল'দের এখন কী হবে? সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেলের দায়িত্ব নিয়ে দুর্নীতিবাজ 'কালো বিড়াল' খুঁজে বের করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এখন মনে হচ্ছে সেটা ছিল তাঁর লোকদেখানো এবং সংবাদপত্রে কভারেজ পাওয়ার একটা কৌশল মাত্র। তিনি নিজেই 'কালো বিড়াল' বনে গেলেন। রেলের প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে দুর্নীতি। একজন ইউসুফ আলী মৃধা, কিংবা একজন এনামুল হক ঘটনাক্রমে 'ধরা খেয়েছেন'। মৃধারা সদ্য গজিয়ে ওঠা দুর্নীতিবাজ নন। তিনি একদিনে সৃষ্টি হননি। প্রশাসনের অনেক ঊর্ধ্বতন ব্যক্তির এখন মৃধাদের 'সৃষ্টি' করেছেন শুধু তাঁদের স্বার্থে। তাঁদের স্বার্থেই তাঁরা মৃধাদের বাঁচিয়ে রাখবেন। না হলে কোন সাহসে মৃধা সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর নামে অবৈধ কোনো সম্পদ নেই। অথচ সংবাদপত্রেই ছাপা হয়েছে ঢাকা শহরে তাঁর একাধিক ফ্ল্যাটের খবর। কিছুদিন আগেও তাঁর চট্টগ্রামের ফ্ল্যাট থেকে ২৪ লাখ টাকা ডাকাতি হয়েছিল। ধৃত ডাকাতরা ২৪ লাখ টাকা ডাকাতির কথা বললেও, মৃধা তখন স্বীকার করেছিলেন মাত্র দুই লাখ টাকার কথা। সেদিন রেলের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হলেও, মৃধার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। আজও যখন রেলের কর্মচারীরা মিছিল করে সংবাদ সম্মেলন করে মৃধার বিচার দাবি করেন, আমি তখন আস্থাটা রাখতে পারি না। মৃধারা এভাবেই পার পেয়ে যান। এবারও পার পেয়ে যাবেন কি না আমরা জানি না। এত বড় একটা অপরাধ, যেখানে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো একজন সিনিয়র রাজনীতিবিদ 'ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে' পদত্যাগ করতে বাধ্য হন, সেখানে আমলাদের নিয়ে গঠিত কমিটি দিয়ে প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন করা যাবে না। এ জন্য দরকার বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি। স্বচ্ছতার স্বার্থেই সরকারের উচিত একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা। 'কালো বিড়াল'দের কোনো ষড়যন্ত্র ছিল কি না, এটাও উদ্ঘাটন করা জরুরি। কেননা 'কালো বিড়াল'রা দীর্ঘদিন ধরেই রেলে সক্রিয়। এরা যে কোনো 'ষড়যন্ত্র' করবে না, এটা দিব্যি দিয়ে বলা যায় না। যিনি আগে রেল মন্ত্রণালয়ে ছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিল বিশ্বব্যাংক। তাই প্রধানমন্ত্রীকে এখন সতর্ক হতে হবে। একজন মন্ত্রীকে এখানে নিয়োগ দিতে হবে সত্য, কিন্তু তাঁকে হতে হবে যোগ্য ও সৎ। তবে এই মুহূর্তে মন্ত্রিসভার কলেবর বাড়ানোর আমি পক্ষপাতী নই। অর্থনীতির অবস্থা খুব ভালো নয়। বিশ্ব অর্থনীতিতেও মন্দাভাব চলছে। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রীর সংখ্যা বাড়িয়ে রাষ্ট্রীয় খরচ না বাড়িয়ে মন্ত্রিসভার একজন সদস্যকে রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়াটাই উত্তম। প্রধানমন্ত্রী সেই সঙ্গে মন্ত্রিসভার রদবদলের কাজটিও সেরে ফেলতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর হাতে মন্ত্রীদের 'পারফরম্যান্স' রিপোর্ট নিশ্চই আছে। স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীদের দক্ষতা নিয়ে বাজারে নানা কথা চালু রয়েছে। দু-একজন 'ছোট' মন্ত্রীর অতিকথন সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে না। অদক্ষ মন্ত্রীদের বাদ দিয়ে যোগ্য লোকদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করে পরবর্তী নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারেন সরকারপ্রধান।
আমার কাছে আরো একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ আর তা হচ্ছে ড্রাইভার আলী আজমের নিরাপত্তা। আলী আজম কোথায় আছেন, কিভাবে আছেন, তাঁর খবর গণমাধ্যমগুলো আমাদের দিতে পারেনি। এত বড় একটা 'ঘটনার' যিনি জন্ম দিলেন, তাঁর সম্পর্কে গণমাধ্যমেরই যে আগ্রহ থাকবে, তা নয়। বরং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরও আগ্রহ থাকবে। কিন্তু তাঁর কোনো হদিস নেই। বিজিবি বলেছে, তাদের হাতে নেই আলী আজম। তাহলে কি তিনি 'গুম' এর শিকার হলেন? মানবাধিকার কমিশন কি বিষয়টি তদন্ত করে দেখবে? যিনি আলোচনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু, তিনি হঠাৎ করে 'উধাও' হয়ে যাবেন, বিষয়টি সহজভাবে মেনে নেওয়া যায় না। পুলিশের ভূমিকাও রহস্যজনক। পুলিশও বলছে, তাদের কাছে আলী আজম নেই। তাহলে? এত বড় একটা ঘটনা। তাঁকে বাদ দিয়ে তো তদন্তকাজ সম্পন্ন হবে না? তথাকথিত ৭০ লাখ টাকার রহস্য উদ্ঘাটনের স্বার্থেই প্রয়োজন আলী আজমকে জেরা করা। র‌্যাব কি আবারও তাদের কর্মদক্ষতার প্রমাণ রাখবে?
বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত একটি দেশের বদনাম এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মার্কিন কংগ্রেসম্যান জোসেফ ক্রাউলির একটি বক্তব্যও এক কাগজে ছাপা হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক তাঁদের অর্থায়ন বন্ধ রেখেছে। এখন রেলওয়ের এই অর্থ কেলেঙ্কারি ও তাতে রেলমন্ত্রীর পদত্যাগ বহির্বিশ্বে আমাদের সম্মানকে উজ্জ্বল করবে না। আরো একটি কথা মনে রাখতে হবে। এসব কালো বিড়ালরা যে শুধু রেল মন্ত্রণালয়েই আছে, তা নয়। সেই বিখ্যাত 'বনখেকোর' কথা আমাদের নিশ্চই মনে আছে, যিনি ভয়ে ব্যাংকে টাকা রাখতেন না। রাখতেন বালিশের ভেতরে, তোষকের ভেতরে। আমরা কী সেই 'বনখেকো'র নাম মনে রাখতে পেরেছি। কী শাস্তি হয়েছিল ওই 'বনখেকো'র? এই সমাজ ওই 'বনখেকো'কে হয়তো ইতিমধ্যে পুনর্বাসন করেছে! সেদিন আগারগাঁওয়ের বন বিভাগের অফিসে গিয়েছিলাম। অভিযুক্ত একজন 'বনখেকো'র নেমপ্লেট তামার প্লেটে খোদাই করে বসানো হয়েছে। তিনি 'পুরস্কৃত' হয়েছেন। এই সমাজ ওই সব 'বনখেকো'দের সামাজিকভাবে উৎখাত করতে পারেনি। এদের হাত অনেক লম্বা। রেল, বন, গণপূর্তসহ প্রায় প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে 'কালো বিড়াল' রয়েছে। একজন স্পষ্টবাদী ওবায়দুল কাদের সরকারের মাঝামাঝি সময়ে এসে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন। মন্ত্রণালয়টি খুব ভালো নয়। পদ্মা সেতু নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। মালয়েশিয়ার সঙ্গে একটি এমওইউ হয়েছে। বাজারে নানা কথা। আমি শুধু ভাবছি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের 'কালো বিড়াল'রা না আবার ওবায়দুল কাদেরকে আঁচড় দেয়। গভীর সমুদ্রে আমাদের অধিকার স্বীকৃত হওয়ায় বিদেশি তেল কম্পানিগুলো বিনা টেন্ডারেই সেখানে জরিপ চালাতে চায়। এই মন্ত্রণালয়ে 'কালো বিড়াল'রা তৎপর। আবার 'একজন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত' যেন সৃষ্টি না হয় এই মন্ত্রণালয়ে। প্রধানমন্ত্রী একটি সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্তটি বলা অত সহজ ছিল না। 'রাজনীতির অনেক অঙ্ক' এর সঙ্গে জড়িত। এখন আইন তার নিজ নিয়মেই চলুক। বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ যদি 'অভিযুক্ত' হন, তাঁর শাস্তি হওয়া উচিত। '৫৫ বছরের রাজনৈতিক জীবন' তাঁকে সব অভিযোগ থেকে মুক্তি দিতে পারে না। সব রাজনীতিবিদের জন্যই এটা একটা দৃষ্টান্ত। রাজনীতিবিদরা নিজেরা 'কালো বিড়াল' হবেন না, আমাদের প্রত্যাশা এতটুকুই।
লেখক : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.