যে কথা বলতে চাইঃ এবার খড়গহস্ত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত by মাহফুজ উল্লাহ
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই গণমাধ্যমের সঙ্গে প্রতিপক্ষের বিরোধ লেগে আছে। এই বিরোধের তালিকার শীর্ষে অবস্থান সরকারের এবং সর্বনিম্নে অবস্থান ব্যক্তির। এই দ্বন্দ্ব অন্তহীন। কেননা তত্ত্বগতভাবে গণমাধ্যম যে ভূমিকা পালন করে তাতে বিভিন্ন সময়ে প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিভিন্ন দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক।
অবশ্য এই দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে অবস্থান করে খবর বা সংবাদ। কারণ খবর প্রকাশ বা প্রচার করে গণমাধ্যম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এমন একটি অবস্থান গ্রহণ করে, যা সর্বজনীনভাবে সুখকর হয় না। এ রকম অসংখ্য উদাহরণ আছে, যেখানে এই ভূমিকার কারণে গণমাধ্যম প্রতিপক্ষের হাতে বিভিন্ন রকমের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এই নির্যাতনের তালিকাও বেশ দীর্ঘ। অস্তিত্বের লাইসেন্স বাতিল থেকে শুরু করে জীবন দান—সবকিছুই এর অন্তর্ভুক্ত। উন্নত, উন্নয়নশীল অথবা স্বল্পন্নোত কোনো রাষ্ট্রই গণমাধ্যম দলনের অভিযোগ থেকে মুক্ত নয়। পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রগুলো বর্তমানে উচ্চকণ্ঠে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা প্রচার করলেও প্রয়োজনে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। প্রায় প্রতিটি সরকার তথ্যের জন্য গণমাধ্যমের প্রয়োজনীয়তার কথা বললেও সে প্রয়োজনীয়তা শর্তের বেড়াজালে বন্দি করে রাখে। বাংলাদেশ এ অবস্থা থেকে মুক্ত নয়।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, বাংলাদেশের গণমাধ্যম প্রচুর স্বাধীনতা ভোগ করে। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে এ জন্য গণমাধ্যমকে বিভিন্ন সরকারের আমলে বিভিন্ন রকমের অধিকারহীনতার শিকার হতে হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ ধারার দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংগঠনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং (খ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ এই সাংবিধানিক অধিকার সত্ত্বেও সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অপকৌশল প্রয়োগ করে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। অথচ একই ধারার প্রথম অংশে শর্তহীনভাবে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে। দুটি বিষয় যে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে এটা সংবিধান প্রণেতারা সে সময় গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেননি। কারণ চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা আছে অথচ তা প্রকাশ করার মাধ্যমের স্বাধীনতা থাকল না—এটা এক ধরনের বৈপরীত্য।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকে এ পর্যন্ত গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সংগ্রামকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। তবে এই স্বাধীনতাহীনতার সূত্রপাত ঘটে স্বাধীনতার পর পর আওয়ামী লীগের প্রথম শাসনামলে—১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত সময়ে। তখন যে বৈশিষ্ট্যটি উল্লেখ করার মতো তা হচ্ছে, যে কোনো ধরনের সমালোচনা বা বিরোধিতার কণ্ঠরোধ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর অনেকেই ভেবেছিলেন, যেহেতু শেখ মুজিবুর রহমান জীবনের দীর্ঘসময় গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য লড়াই করেছেন তাই মুক্ত স্বদেশে তিনি সব ধরনের গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতাকে মেনে নেবেন। কিন্তু সে আমলে সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতি, পত্রিকা অফিসে হামলা, পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া এবং সাংবাদিকের গ্রেফতারসহ অনেক ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার তালিকা অনেক দীর্ঘ। তবে যে দুটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হচ্ছে—সে সময় প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স এবং স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট জারি করে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের পুরো ব্যবস্থা সরকারের করায়ত্ত হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বাধীন অথচ সমালোচক সংবাদপত্র সহ্য করতে পারেননি তার প্রমাণ জাতীয় সামজতান্ত্রিক দলের মুখপাত্র গণকণ্ঠ সম্পর্কে তার সেই উক্তি। তিনি এতটাই বিক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে, প্রকাশ্যেই মন্তব্য করেছিলেন, তিনি তার দীর্ঘ রাজনীতির জীবনে একটি সংবাদপত্রও প্রকাশ করতে পারেননি; অথচ গণকণ্ঠ কী করে পত্রিকা প্রকাশের ব্যয় মেটায় তা তিনি জানেন।
সে আমলে প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স যখন অনুমোদনের জন্য সংসদে উত্থাপিত হয় তখন হাতেগোনা বিরোধীদলীয় সদস্যরা অনেক কথাই বলেছিলেন, কিন্তু সরকার তাতে কান দেয়নি। ১৯৭৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তত্কালীন ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিক ইউনিয়ন মন্তব্য করেছিল, এই অর্ডিন্যান্স আইয়ুব খানের কালাকানুনকে বদলে দিতে পারেনি। অপরদিকে এই সম্পর্কে সংসদে দাঁড়িয়ে সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ সরকার মন্তব্য করেছিলেন, এই অর্ডিন্যান্স হচ্ছে নতুন বোতলে পুরনো মদ। অর্ডিন্যান্সটি সংসদে উত্থাপন করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মালেক উকিল মন্তব্য করেছিলেন, রাষ্ট্রীয় নীতিমালার কোনো বিরোধিতা সহ্য করা হবে না। মুখে রাষ্ট্রীয় নীতিমালার কথা বলা হলেও আসলে তা ছিল সরকারি নীতিমালার বিরোধিতা। কথাটি অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সোজাসুজি বলার প্রয়োজনবোধ করেননি। পরবর্তী পর্যায়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর বড় আঘাত আসে ১৯৭৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট প্রবর্তনের ফলে। স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্টের ১৬ ধারায় যে কোনো রকমের রাষ্ট্রবিরোধী রিপোর্ট প্রকাশকে নিষেধ করে দেয়া হয় এবং ১৭, ১৮, ১৯ ও ২০ নম্বর ধারায় সংবাদপত্র ও সভা-সমিতি করার অধিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এই আইন গৃহীত হওয়ার পর সাংবাদিক ইউনিয়ন মন্তব্য করেছিল যে, এর ফলে সংবাদপত্রের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। অন্যদিকে ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট (আইপিআই) মন্তব্য করেছিল, এর ফলে মত প্রকাশের সব স্বাধীনতাই খর্ব করা হয়েছে।
স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট চালু হওয়ার পর সে বছর গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকমের নির্যাতন ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রয়োগ করা হয়। এই ধারার সর্বশেষ পরিণতি হচ্ছে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন; যার পরিণতিতে ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন চারটি ব্যতীত সব সংবাদপত্রের অস্তিত্ব বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। চেষ্টা চলে গণমাধ্যমকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের। কিন্তু এই প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে গণমাধ্যম তার অস্তিত্বের স্বাধীনতা ফিরে পায়। এরশাদ সরকারের শাসনামলে রাতের বেলায় টেলিফোনে খবর ও ছবি প্রকাশের মাপকাঠি নির্ধারণ করে দেয়া হলেও অবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটেনি, গণমাধ্যমকে সামরিক শাসনের নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই কাজ করতে হয়েছে। গণমাধ্যম বুদ্ধিমান বলেই কনফুসিয়াসের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘একটি বাঘের চেয়ে নির্যাতক সরকার অনেক বেশি ভয়ঙ্কর’ এই কথা মনে রেখে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সুবাতাস আসে ১৯৯১ সালে যখন বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের সরকার স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্টের কয়েকটি ধারা বাতিল করে দেয়। এর ফলে সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ করার যে হাতিয়ার সরকারের কাছে ছিল তা ভোঁতা হয়ে যায়। সরকার এখন যতই বিক্ষুব্ধ হোক না কেন, একটি সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বাতিল করার ক্ষমতা তার হাতে নেই। একই সঙ্গে ১৯৯১ সময়ে প্রতিষ্ঠিত বিএনপি সরকার তথ্য প্রবাহকে নিশ্চিত করার জন্য আকাশকে উন্মুক্ত করে দেয়।
এদেশে গণমাধ্যম বিভিন্ন সময়ে যেসব প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে তার একটি প্রধান কারণ মানহানি সংক্রান্ত আইনের বিধান। ইংরেজ আমলে চালু করা এই বিধানের অধীনে মানহানির অভিযোগে গণমাধ্যম কর্মীকে গ্রেফতারের বিধান রয়েছে। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৫০০, ৫০১ ও ৫০২ ধারায় মানহানির যে বিধান রাখা হয়েছে তাতে মানহানির মামলা করার পর আদালত ইচ্ছা করলে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যম কর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে পারে এবং স্বল্প সময়ের জন্য কয়েদখানায়ও ঢোকাতে পারে।
মানহানির মামলার এই বিধান সম্পর্কে সাংবাদিকরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন। তারই ফলে আইন সংশোধন করে গণমাধ্যম কর্মীকে গ্রেফতারের পরিবর্তে সমন দিয়ে আদালতে হাজির হওয়ার বিধানের প্রস্তাব করা হয়েছে। আইন, সংসদ ও বিচার মন্ত্রণালয় থেকে এমন একটি খসড়া আইন অনুমোদনের জন্য জাতীয় সংসদে পাঠানো হলে তা এ সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির রোষানলে পতিত হয়। স্থায়ী কমিটির সভাপতি, বামপন্থী থেকে ধর্মান্তরিত গণতন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়েছেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের আপত্তির কারণ হচ্ছে, এই ব্যবস্থা চালু হলে মানহানির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি কোনো প্রতিকার পাবে না। এমন কি, রাজনীতিবিদরাও অসহায় বোধ করবেন। তিনি দাবি করেছেন, এই সংশোধনীর জন্য নাগরিক সমাজ বা গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে কোনো দাবি উত্থাপিত হয়নি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের প্রায় অনুরূপ অবস্থান গ্রহণ করেছেন পরিকল্পণা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি অলি আহমেদ। এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ—এটি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে উত্থাপিত হয়েছিল। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং তার দল সেনাসমর্থিত সরকারের অনেক আইনকে বৈধতা দিয়েছে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে গণমাধ্যমের কর্মীদের স্বার্থ সংরক্ষণের প্রশ্নে। গণতন্ত্র ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কাছে গণমাধ্যম এ আচরণ প্রত্যাশা করে না। এটা অন্য কারও আচরণ হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকত না। কিন্তু প্রতিটি রাষ্ট্রেই ক্ষমতাসীনরা শাসনকে নিশ্চিত করার জন্য গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। আবার গণমাধ্যম তার প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা ও জনজীবনে প্রভাবের কারণে সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার পর থেকেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রকাশ্যে অনেক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু আজকে এই অবস্থানের ফলে নতুন করে তার সম্পর্কে ভাবতে হচ্ছে। তিনি কি ভাবছেন এই আইন সংশোধন না করে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন? সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ সমাজের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না। এসব কথা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত জানেন; কিন্তু ক্ষমতাসীন হওয়ার কারণে কাঙ্ক্ষিত ঔদার্য দেখাতে পারেননি। হয়তো বিরোধী দলে থাকলে এই প্রস্তাবিত সংশোধনীর পক্ষে সোচ্চার হতে পারতেন। কারণ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘স্বাধীনতাকে হত্যা করার জন্য নির্যাতকরা স্বাধীনতার কথা বলে।’
লেখক : পরিবেশবিদ ও সাংবাদিক
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, বাংলাদেশের গণমাধ্যম প্রচুর স্বাধীনতা ভোগ করে। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে এ জন্য গণমাধ্যমকে বিভিন্ন সরকারের আমলে বিভিন্ন রকমের অধিকারহীনতার শিকার হতে হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ ধারার দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংগঠনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং (খ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ এই সাংবিধানিক অধিকার সত্ত্বেও সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অপকৌশল প্রয়োগ করে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। অথচ একই ধারার প্রথম অংশে শর্তহীনভাবে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে। দুটি বিষয় যে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে এটা সংবিধান প্রণেতারা সে সময় গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেননি। কারণ চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা আছে অথচ তা প্রকাশ করার মাধ্যমের স্বাধীনতা থাকল না—এটা এক ধরনের বৈপরীত্য।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকে এ পর্যন্ত গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সংগ্রামকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। তবে এই স্বাধীনতাহীনতার সূত্রপাত ঘটে স্বাধীনতার পর পর আওয়ামী লীগের প্রথম শাসনামলে—১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত সময়ে। তখন যে বৈশিষ্ট্যটি উল্লেখ করার মতো তা হচ্ছে, যে কোনো ধরনের সমালোচনা বা বিরোধিতার কণ্ঠরোধ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর অনেকেই ভেবেছিলেন, যেহেতু শেখ মুজিবুর রহমান জীবনের দীর্ঘসময় গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য লড়াই করেছেন তাই মুক্ত স্বদেশে তিনি সব ধরনের গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতাকে মেনে নেবেন। কিন্তু সে আমলে সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতি, পত্রিকা অফিসে হামলা, পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া এবং সাংবাদিকের গ্রেফতারসহ অনেক ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার তালিকা অনেক দীর্ঘ। তবে যে দুটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হচ্ছে—সে সময় প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স এবং স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট জারি করে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের পুরো ব্যবস্থা সরকারের করায়ত্ত হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বাধীন অথচ সমালোচক সংবাদপত্র সহ্য করতে পারেননি তার প্রমাণ জাতীয় সামজতান্ত্রিক দলের মুখপাত্র গণকণ্ঠ সম্পর্কে তার সেই উক্তি। তিনি এতটাই বিক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে, প্রকাশ্যেই মন্তব্য করেছিলেন, তিনি তার দীর্ঘ রাজনীতির জীবনে একটি সংবাদপত্রও প্রকাশ করতে পারেননি; অথচ গণকণ্ঠ কী করে পত্রিকা প্রকাশের ব্যয় মেটায় তা তিনি জানেন।
সে আমলে প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স যখন অনুমোদনের জন্য সংসদে উত্থাপিত হয় তখন হাতেগোনা বিরোধীদলীয় সদস্যরা অনেক কথাই বলেছিলেন, কিন্তু সরকার তাতে কান দেয়নি। ১৯৭৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তত্কালীন ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিক ইউনিয়ন মন্তব্য করেছিল, এই অর্ডিন্যান্স আইয়ুব খানের কালাকানুনকে বদলে দিতে পারেনি। অপরদিকে এই সম্পর্কে সংসদে দাঁড়িয়ে সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ সরকার মন্তব্য করেছিলেন, এই অর্ডিন্যান্স হচ্ছে নতুন বোতলে পুরনো মদ। অর্ডিন্যান্সটি সংসদে উত্থাপন করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মালেক উকিল মন্তব্য করেছিলেন, রাষ্ট্রীয় নীতিমালার কোনো বিরোধিতা সহ্য করা হবে না। মুখে রাষ্ট্রীয় নীতিমালার কথা বলা হলেও আসলে তা ছিল সরকারি নীতিমালার বিরোধিতা। কথাটি অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সোজাসুজি বলার প্রয়োজনবোধ করেননি। পরবর্তী পর্যায়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর বড় আঘাত আসে ১৯৭৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট প্রবর্তনের ফলে। স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্টের ১৬ ধারায় যে কোনো রকমের রাষ্ট্রবিরোধী রিপোর্ট প্রকাশকে নিষেধ করে দেয়া হয় এবং ১৭, ১৮, ১৯ ও ২০ নম্বর ধারায় সংবাদপত্র ও সভা-সমিতি করার অধিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এই আইন গৃহীত হওয়ার পর সাংবাদিক ইউনিয়ন মন্তব্য করেছিল যে, এর ফলে সংবাদপত্রের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। অন্যদিকে ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট (আইপিআই) মন্তব্য করেছিল, এর ফলে মত প্রকাশের সব স্বাধীনতাই খর্ব করা হয়েছে।
স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট চালু হওয়ার পর সে বছর গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকমের নির্যাতন ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রয়োগ করা হয়। এই ধারার সর্বশেষ পরিণতি হচ্ছে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন; যার পরিণতিতে ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন চারটি ব্যতীত সব সংবাদপত্রের অস্তিত্ব বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। চেষ্টা চলে গণমাধ্যমকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের। কিন্তু এই প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে গণমাধ্যম তার অস্তিত্বের স্বাধীনতা ফিরে পায়। এরশাদ সরকারের শাসনামলে রাতের বেলায় টেলিফোনে খবর ও ছবি প্রকাশের মাপকাঠি নির্ধারণ করে দেয়া হলেও অবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটেনি, গণমাধ্যমকে সামরিক শাসনের নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই কাজ করতে হয়েছে। গণমাধ্যম বুদ্ধিমান বলেই কনফুসিয়াসের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘একটি বাঘের চেয়ে নির্যাতক সরকার অনেক বেশি ভয়ঙ্কর’ এই কথা মনে রেখে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সুবাতাস আসে ১৯৯১ সালে যখন বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের সরকার স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্টের কয়েকটি ধারা বাতিল করে দেয়। এর ফলে সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ করার যে হাতিয়ার সরকারের কাছে ছিল তা ভোঁতা হয়ে যায়। সরকার এখন যতই বিক্ষুব্ধ হোক না কেন, একটি সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বাতিল করার ক্ষমতা তার হাতে নেই। একই সঙ্গে ১৯৯১ সময়ে প্রতিষ্ঠিত বিএনপি সরকার তথ্য প্রবাহকে নিশ্চিত করার জন্য আকাশকে উন্মুক্ত করে দেয়।
এদেশে গণমাধ্যম বিভিন্ন সময়ে যেসব প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে তার একটি প্রধান কারণ মানহানি সংক্রান্ত আইনের বিধান। ইংরেজ আমলে চালু করা এই বিধানের অধীনে মানহানির অভিযোগে গণমাধ্যম কর্মীকে গ্রেফতারের বিধান রয়েছে। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৫০০, ৫০১ ও ৫০২ ধারায় মানহানির যে বিধান রাখা হয়েছে তাতে মানহানির মামলা করার পর আদালত ইচ্ছা করলে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যম কর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে পারে এবং স্বল্প সময়ের জন্য কয়েদখানায়ও ঢোকাতে পারে।
মানহানির মামলার এই বিধান সম্পর্কে সাংবাদিকরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন। তারই ফলে আইন সংশোধন করে গণমাধ্যম কর্মীকে গ্রেফতারের পরিবর্তে সমন দিয়ে আদালতে হাজির হওয়ার বিধানের প্রস্তাব করা হয়েছে। আইন, সংসদ ও বিচার মন্ত্রণালয় থেকে এমন একটি খসড়া আইন অনুমোদনের জন্য জাতীয় সংসদে পাঠানো হলে তা এ সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির রোষানলে পতিত হয়। স্থায়ী কমিটির সভাপতি, বামপন্থী থেকে ধর্মান্তরিত গণতন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়েছেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের আপত্তির কারণ হচ্ছে, এই ব্যবস্থা চালু হলে মানহানির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি কোনো প্রতিকার পাবে না। এমন কি, রাজনীতিবিদরাও অসহায় বোধ করবেন। তিনি দাবি করেছেন, এই সংশোধনীর জন্য নাগরিক সমাজ বা গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে কোনো দাবি উত্থাপিত হয়নি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের প্রায় অনুরূপ অবস্থান গ্রহণ করেছেন পরিকল্পণা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি অলি আহমেদ। এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ—এটি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে উত্থাপিত হয়েছিল। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং তার দল সেনাসমর্থিত সরকারের অনেক আইনকে বৈধতা দিয়েছে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে গণমাধ্যমের কর্মীদের স্বার্থ সংরক্ষণের প্রশ্নে। গণতন্ত্র ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কাছে গণমাধ্যম এ আচরণ প্রত্যাশা করে না। এটা অন্য কারও আচরণ হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকত না। কিন্তু প্রতিটি রাষ্ট্রেই ক্ষমতাসীনরা শাসনকে নিশ্চিত করার জন্য গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। আবার গণমাধ্যম তার প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা ও জনজীবনে প্রভাবের কারণে সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার পর থেকেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রকাশ্যে অনেক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু আজকে এই অবস্থানের ফলে নতুন করে তার সম্পর্কে ভাবতে হচ্ছে। তিনি কি ভাবছেন এই আইন সংশোধন না করে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন? সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ সমাজের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না। এসব কথা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত জানেন; কিন্তু ক্ষমতাসীন হওয়ার কারণে কাঙ্ক্ষিত ঔদার্য দেখাতে পারেননি। হয়তো বিরোধী দলে থাকলে এই প্রস্তাবিত সংশোধনীর পক্ষে সোচ্চার হতে পারতেন। কারণ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘স্বাধীনতাকে হত্যা করার জন্য নির্যাতকরা স্বাধীনতার কথা বলে।’
লেখক : পরিবেশবিদ ও সাংবাদিক
No comments