রঙ্গব্যঙ্গ-পাত্র ভয়ংকর by মোস্তফা কামাল
রওশন আলী ও জিনাত আরার একমাত্র সন্তান হৃদিতা। রওশন আলী সরকারি চাকরি করতেন। সারা জীবন তিনি দ্বিতীয় গ্রেডে চাকরি করেছেন। একটা পদোন্নতির জন্য চেষ্টা-তদবির করেও পাননি। সরকারি কোয়ার্টারে একটা বাসা পেয়েছিলেন বলে রক্ষা। তা না হলে কী যে হতো! হৃদিতা অসম্ভব মেধাবী মেয়ে।
মেধার গুণেই সে নিজের অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। তার কোনো প্রাইভেট টিউটর ছিল না। কোনো দিন কোচিংও করতে পারেনি। তার পরও হৃদিতা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে অত্যন্ত ভালো রেজাল্ট করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় সে। অনার্সে পড়া অবস্থায়ই ওকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন ওর মা-বাবা। কিন্তু হৃদিতা কিছুতেই রাজি হলো না। তার কথা, পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে যোগ দেবে। তারপর বিয়ের কথা ভাববে।
অথচ রওশন আলীর চোখে ঘুম নেই। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মতোই তিনি পাগলের মতো ছেলে খুঁজতে থাকলেন। একটা ভালো পাত্র যদি পাওয়া যায়! পাত্র ভালো হলে হয়তো তাঁদের একটা গতি হবে। তা না হলে অবসরে যাওয়ার পর রওশন আলীকে গ্রামে চলে যেতে হবে। একে বলেন, ওকে বলেন। মেয়েটাকে নিয়ে তিনি যেন মহাবিপদে আছেন। একেক সময় তিনি একেকটি পাত্র খুঁজে আনলেও হৃদিতার সম্মতি মেলে না। তার এক কথা, পড়াশোনা শেষ করার পর চাকরি, তারপর বিয়ে।
হৃদিতা ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছে। তারপর বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে এক চান্সেই চাকরি পেয়ে গেল সে। প্রশাসনিক ক্যাডারের চাকরি।
রওশন আলী এবার দ্বারে দ্বারে ঘুরতে শুরু করলেন। মেয়ের বয়স হয়ে গেছে। এখন আর বিয়ে দিতে না পারলে বিয়েই হবে না। আবার শুরু হলো তাঁর গরু খোঁজার মতো পাত্র খোঁজা। কোথায় ভালো পাত্র পাবেন তিনি! অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাঁর এক বন্ধু একটি ছেলের সন্ধান দিলেন। ছেলেটি এক মন্ত্রীর এপিএস। স্নাতক ডিগ্রিতে তৃতীয় শ্রেণী। রাজনীতিতে ব্যস্ত ছিল বলে আর পড়তে পারেনি। মন্ত্রীর এপিএস মানে তো বিশাল ব্যাপার! অনেক ক্ষমতা রাখে সে! তার ইশারায় অনেক কিছুই হয়। ইনকামও নাকি মাশাল্লাহ ভালো! বেতনের চেয়ে উপরি বেশি!
রওশন আলী তো ভীষণ খুশি। অনেক দিন পর তিনি একটা ভালো পাত্রের সন্ধান পেলেন। এই পাত্র কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না। একেবারে আইকা দিয়ে ধরতে হবে। তিনি আবেগে গদগদ। বাড়িতে এসে পাত্রের বয়ান দিলেন স্ত্রীর কাছে। তাঁর স্ত্রী জিনাত আরাও পাত্রের ক্ষমতা, টাকা-পয়সার কথা শুনে রাজি হয়ে গেলেন। কাজেই মেয়েকে রাজি করানোর দায়িত্ব পড়ল জিনাত আরার ওপর। তিনি একদিন বিকেলে মেয়েকে নিয়ে বসলেন। তারপর জিনাত আরা মেয়েকে বললেন, 'হৃদিতা, তোর জন্য একটা সুখবর আছে।'
হৃদিতা বলল, 'কী সুখবর?'
'তোর জন্য তোর বাবা একটা ভালো পাত্র ঠিক করেছেন।'
'ভালো পাত্র? তুমি দেখেছ?'
'না, দেখিনি। তোর বাবা বললেন।'
ও আচ্ছা! পাত্র কী করে? তার পড়াশোনা কী?'
'ডিগ্রি পাস করেছে। এখন মন্ত্রীর এপিএস।'
হৃদিতা বিস্ময়ের সঙ্গে বলে, 'ডিগ্রি পাস! মন্ত্রীর এপিএস!'
'তুই বিস্মিত হয়েছিস মনে হয়?'
'মা, তুমি কি জানো তোমার মেয়ে কী পাস? কোন পদে চাকরি করে?'
'জানব না কেন? জানি। বিএ, এমএ কোনো ব্যাপার না। গ্র্যাজুয়েট হলেই হলো।'
'ঠিক আছে, মানলাম। কিন্তু চাকরিতে আমার পজিশন জানো?
'আরে মা, অত কিছু হিসাব করলে কি চলে? পাত্র ভালো। আয়-রোজগার ভালো। ব্যস! আমরা তো এটাই চাই।'
'ছেলের বেতন কত, জানো?'
'আরে বেতন দিয়ে কী করবি? তার যে বাড়তি আয়ের কথা শুনলাম! সেটাই তো বিশাল। ছয় মাসের মধ্যে ঢাকা শহরে বাড়ি-গাড়ি করা কোনো ব্যাপারই না!'
'মা, এই বুড়ো বয়সে তোমার বাড়ি-গাড়ি লাগবে, তাই না?'
'আরে! আমি কি আমার জন্য ভাবছি নাকি! আমি তো তোর সুখ-শান্তির কথা চিন্তা করছি।'
'আর সে জন্যই বুঝি দুই নম্বর পথে ইনকাম করা একজন পাত্র খুঁজে বের করেছ, তাই না?'
'কী যে বলিস তুই! ছেলেটা ভালো তাই...'
'প্লিজ মা! এমন ভালো ছেলের প্রয়োজন নেই আমার।'
'কেন রে! সমস্যা কী বলবি তো!'
'মা, তোমরা কেন বুঝতে পারছ না! আমি এখন সহকারী সচিব। আমার এই পজিশনের মূল্য যদি তোমরা না দাও তাহলে অন্যরা দেবে? দেবে না। আমার ওপরের কাউকে দরকার নেই। কিন্তু আমার সমপর্যায়ের কোনো পাত্রের সন্ধান করো। তা না হলে তো মিস-ম্যাস হয়ে যাবে, তাই না? তা ছাড়া এপিএস-টেপিএস আমার একদম পছন্দ নয়। দুই নম্বর পথে ইনকাম! ওরে বাবা! ওসব ছেলেপেলে তো ভয়ংকর হয়!'
হৃদিতার কথা শুনে ওর বাবা রওশন আলী ওর ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, 'কোন ছেলেরা ভয়ংকর হয়, মা?'
হৃদিতা কোনো কথা বলে না। সে চুপচাপ বসে আছে। কী বলবে তা নিয়ে ভাবে। রওশন আলী মেয়ের দিকে তাকিয়ে আবারও বললেন, 'কী হলো, বল!'
হৃদিতা আমতা আমতা করে বলল, 'এই ধরেন, যারা মন্ত্রীর এপিএসের চাকরি করে।'
রওশন আলী বুঝতে পারলেন তাঁর মেয়ে কী বলতে চায়। তার পরও তিনি বললেন, 'কেন ভয়ংকর হয়, একটু ব্যাখ্যা করে বল তো!'
'বাবা, আপনি সরকারি চাকরি করেছেন। আপনি দেখেননি এপিএসরা কী করে? তাদের ভাবখানা এমন যেন, তারাই মন্ত্রীকে চালায়। কথায় কথায় তারা মন্ত্রীকে বেচাবিক্রি করে। মন্ত্রীর নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। তা ছাড়া ইদানীং পত্রপত্রিকায় যা দেখছি, তা সত্যিই ভয়াবহ। জেনেশুনে এ ধরনের পাত্রকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, বাবা।'
'হৃদিতা, তুমি বোধ হয় ভুল করছ। এই ছেলেটা এপিএসগিরি করলেও সে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তুমি দেখো, সে একসময় মন্ত্রী হবে।'
'কী যা-তা বলছেন, বাবা! আপনার বোধ হয় মাথা খারাপ হয়ে গেছে! এসব দুর্নীতিবাজ ছেলে মন্ত্রী হলে দেশ টিকবে? আর সে যা-ই হোক, ওতে আমার কোনো আগ্রহ নেই।'
রওশন আলী মেয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর কী বলা উচিত, তা তিনি বুঝতে পারছেন না।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
অথচ রওশন আলীর চোখে ঘুম নেই। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মতোই তিনি পাগলের মতো ছেলে খুঁজতে থাকলেন। একটা ভালো পাত্র যদি পাওয়া যায়! পাত্র ভালো হলে হয়তো তাঁদের একটা গতি হবে। তা না হলে অবসরে যাওয়ার পর রওশন আলীকে গ্রামে চলে যেতে হবে। একে বলেন, ওকে বলেন। মেয়েটাকে নিয়ে তিনি যেন মহাবিপদে আছেন। একেক সময় তিনি একেকটি পাত্র খুঁজে আনলেও হৃদিতার সম্মতি মেলে না। তার এক কথা, পড়াশোনা শেষ করার পর চাকরি, তারপর বিয়ে।
হৃদিতা ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছে। তারপর বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে এক চান্সেই চাকরি পেয়ে গেল সে। প্রশাসনিক ক্যাডারের চাকরি।
রওশন আলী এবার দ্বারে দ্বারে ঘুরতে শুরু করলেন। মেয়ের বয়স হয়ে গেছে। এখন আর বিয়ে দিতে না পারলে বিয়েই হবে না। আবার শুরু হলো তাঁর গরু খোঁজার মতো পাত্র খোঁজা। কোথায় ভালো পাত্র পাবেন তিনি! অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাঁর এক বন্ধু একটি ছেলের সন্ধান দিলেন। ছেলেটি এক মন্ত্রীর এপিএস। স্নাতক ডিগ্রিতে তৃতীয় শ্রেণী। রাজনীতিতে ব্যস্ত ছিল বলে আর পড়তে পারেনি। মন্ত্রীর এপিএস মানে তো বিশাল ব্যাপার! অনেক ক্ষমতা রাখে সে! তার ইশারায় অনেক কিছুই হয়। ইনকামও নাকি মাশাল্লাহ ভালো! বেতনের চেয়ে উপরি বেশি!
রওশন আলী তো ভীষণ খুশি। অনেক দিন পর তিনি একটা ভালো পাত্রের সন্ধান পেলেন। এই পাত্র কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না। একেবারে আইকা দিয়ে ধরতে হবে। তিনি আবেগে গদগদ। বাড়িতে এসে পাত্রের বয়ান দিলেন স্ত্রীর কাছে। তাঁর স্ত্রী জিনাত আরাও পাত্রের ক্ষমতা, টাকা-পয়সার কথা শুনে রাজি হয়ে গেলেন। কাজেই মেয়েকে রাজি করানোর দায়িত্ব পড়ল জিনাত আরার ওপর। তিনি একদিন বিকেলে মেয়েকে নিয়ে বসলেন। তারপর জিনাত আরা মেয়েকে বললেন, 'হৃদিতা, তোর জন্য একটা সুখবর আছে।'
হৃদিতা বলল, 'কী সুখবর?'
'তোর জন্য তোর বাবা একটা ভালো পাত্র ঠিক করেছেন।'
'ভালো পাত্র? তুমি দেখেছ?'
'না, দেখিনি। তোর বাবা বললেন।'
ও আচ্ছা! পাত্র কী করে? তার পড়াশোনা কী?'
'ডিগ্রি পাস করেছে। এখন মন্ত্রীর এপিএস।'
হৃদিতা বিস্ময়ের সঙ্গে বলে, 'ডিগ্রি পাস! মন্ত্রীর এপিএস!'
'তুই বিস্মিত হয়েছিস মনে হয়?'
'মা, তুমি কি জানো তোমার মেয়ে কী পাস? কোন পদে চাকরি করে?'
'জানব না কেন? জানি। বিএ, এমএ কোনো ব্যাপার না। গ্র্যাজুয়েট হলেই হলো।'
'ঠিক আছে, মানলাম। কিন্তু চাকরিতে আমার পজিশন জানো?
'আরে মা, অত কিছু হিসাব করলে কি চলে? পাত্র ভালো। আয়-রোজগার ভালো। ব্যস! আমরা তো এটাই চাই।'
'ছেলের বেতন কত, জানো?'
'আরে বেতন দিয়ে কী করবি? তার যে বাড়তি আয়ের কথা শুনলাম! সেটাই তো বিশাল। ছয় মাসের মধ্যে ঢাকা শহরে বাড়ি-গাড়ি করা কোনো ব্যাপারই না!'
'মা, এই বুড়ো বয়সে তোমার বাড়ি-গাড়ি লাগবে, তাই না?'
'আরে! আমি কি আমার জন্য ভাবছি নাকি! আমি তো তোর সুখ-শান্তির কথা চিন্তা করছি।'
'আর সে জন্যই বুঝি দুই নম্বর পথে ইনকাম করা একজন পাত্র খুঁজে বের করেছ, তাই না?'
'কী যে বলিস তুই! ছেলেটা ভালো তাই...'
'প্লিজ মা! এমন ভালো ছেলের প্রয়োজন নেই আমার।'
'কেন রে! সমস্যা কী বলবি তো!'
'মা, তোমরা কেন বুঝতে পারছ না! আমি এখন সহকারী সচিব। আমার এই পজিশনের মূল্য যদি তোমরা না দাও তাহলে অন্যরা দেবে? দেবে না। আমার ওপরের কাউকে দরকার নেই। কিন্তু আমার সমপর্যায়ের কোনো পাত্রের সন্ধান করো। তা না হলে তো মিস-ম্যাস হয়ে যাবে, তাই না? তা ছাড়া এপিএস-টেপিএস আমার একদম পছন্দ নয়। দুই নম্বর পথে ইনকাম! ওরে বাবা! ওসব ছেলেপেলে তো ভয়ংকর হয়!'
হৃদিতার কথা শুনে ওর বাবা রওশন আলী ওর ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, 'কোন ছেলেরা ভয়ংকর হয়, মা?'
হৃদিতা কোনো কথা বলে না। সে চুপচাপ বসে আছে। কী বলবে তা নিয়ে ভাবে। রওশন আলী মেয়ের দিকে তাকিয়ে আবারও বললেন, 'কী হলো, বল!'
হৃদিতা আমতা আমতা করে বলল, 'এই ধরেন, যারা মন্ত্রীর এপিএসের চাকরি করে।'
রওশন আলী বুঝতে পারলেন তাঁর মেয়ে কী বলতে চায়। তার পরও তিনি বললেন, 'কেন ভয়ংকর হয়, একটু ব্যাখ্যা করে বল তো!'
'বাবা, আপনি সরকারি চাকরি করেছেন। আপনি দেখেননি এপিএসরা কী করে? তাদের ভাবখানা এমন যেন, তারাই মন্ত্রীকে চালায়। কথায় কথায় তারা মন্ত্রীকে বেচাবিক্রি করে। মন্ত্রীর নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। তা ছাড়া ইদানীং পত্রপত্রিকায় যা দেখছি, তা সত্যিই ভয়াবহ। জেনেশুনে এ ধরনের পাত্রকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, বাবা।'
'হৃদিতা, তুমি বোধ হয় ভুল করছ। এই ছেলেটা এপিএসগিরি করলেও সে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তুমি দেখো, সে একসময় মন্ত্রী হবে।'
'কী যা-তা বলছেন, বাবা! আপনার বোধ হয় মাথা খারাপ হয়ে গেছে! এসব দুর্নীতিবাজ ছেলে মন্ত্রী হলে দেশ টিকবে? আর সে যা-ই হোক, ওতে আমার কোনো আগ্রহ নেই।'
রওশন আলী মেয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর কী বলা উচিত, তা তিনি বুঝতে পারছেন না।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments