সমুদ্রসীমার বিরোধ মীমাংসায় নৌবাহিনীর অবদান by মিল্টন বিশ্বাস

চলতি মাসের ১১ তারিখে চট্টগ্রামস্থ নেভাল একাডেমীতে পরীক্ষাসংক্রান্ত কাজে গিয়েছিলাম। সেখানে সমুদ্রসীমা মীমাংসা নিয়ে কথা বলার সুযোগ হয়। যিনি দিনের পর দিন উত্তাল সমুদ্রে জরিপ পরিচালনা করেছিলেন, নৌবাহিনীর সেই কৃতী সন্তানের সঙ্গে আলাপ হলে তিনি তাঁর কাছে থাকা প্রেজেন্টেশনের পুরো বিবরণ আমাকে বুঝিয়ে দেন।


রীতিমতো এক ঘণ্টার একটি ক্লাস করতে হয়েছে আমাকে। আর দেশের পত্রপত্রিকায় লিখিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও টিভির টক শো নিয়ে প্রশ্ন করায় তাঁর কাছে শুনতে হয়েছে নেতিবাচক মন্তব্য। কিছু ব্যতিক্রম বাদে, তাঁর মতে, অধিকাংশ ব্যক্তি বিষয়টি সম্পর্কে না জেনে লিখেছেন এবং বলেছেন। কিন্তু অনেক কথা বলা হলেও নৌবাহিনীর অবদানকে আলোকপাত করা হয়নি আর ফরাসি সরকারের সাহায্যের কথা না বললেই নয়। আসলে আমাদের সমুদ্র নিয়ে ভাবনার ঘাটতি রয়েছে। পর্যাপ্ত সম্পদের আধার আর বাণিজ্যের প্রধান পথের এই জলরাশি নিয়ে স্বাধীনতার পরে এই প্রথম মানুষের দৃষ্টি সেদিকে ফিরেছে। হরহামেশাই ভারতের সঙ্গে সীমান্ত এলাকায় নিন্দনীয় ঘটনা ঘটছে। স্থল সীমানার সেসব ঘটনা নিয়ে এত দিন আমাদের দৃষ্টি ছিল আটকে। অন্যভাবে বললে বলা চলে, ভারত ইচ্ছা করেই সেদিকে আমাদের দৃষ্টি ফিরিয়ে রেখেছিল। কারণ সমুদ্রের গুরুত্ব তারা বহু আগেই উপলব্ধি করেছে।
১৪ মার্চ ২০১২ জার্মানির হামবুর্গ শহরে অবস্থিত International Tribunal for the Law Of the Seas (ITLOS) বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সমুদ্রসীমাবিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তির রায় প্রদান করেছে। সমুদ্রসৈকতের দৈর্ঘ্য, দেশের অবস্থান, সমুদ্র তলদেশের ভূতাত্তি্বক অবস্থা প্রভৃতি বিষয় পর্যালোচনা করে দুই দেশের সীমানা দিয়েছে 'ইটলস'। সমুদ্রসীমাবিষয়ক আন্তর্জাতিক আইন (UNCLOS II) অনুযায়ী, সমুদ্রতট থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে Continental Shelf-এর সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের (ITLOS) এখতিয়ারে ছিল। যদিও মিয়ানমার ITLOS-এর এখতিয়ার সম্পর্কে সম্মতি জানালেও বলেছিল, বর্তমান ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করা ঠিক হবে না। ট্রাইব্যুনাল উভয় দেশের কথা শুনে ২০০ নটিক্যাল মাইলের (nm) মধ্যে Exclusive Economic Zone (EEZ)-এর সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়। বিভিন্ন সূত্র থেকে আমরা জানতে পেরেছি, বঙ্গোপসাগরে পশ্চিম-দক্ষিণ ও পূর্ব-দক্ষিণ থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত ২৮টি ব্লকে ভাগ করেছিল বাংলাদেশ। এই ২৮টির মধ্যে ১৭টিতে মিয়ানমার এবং ১০টিতে ভারত তাদের অংশ রয়েছে বলে দাবি করে। শুধু ১০ নম্বর ব্লকটি সম্পূর্ণ এবং ১১ নম্বর ব্লকের অংশবিশেষ ওই দুই দেশের দাবিবহির্ভূত ছিল। রায় হওয়ার পর ১৭টির মধ্যে পাঁচটি ব্লক মিয়ানমার পেয়েছে; বাকি ১১টি পেয়েছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে বলা হচ্ছে, সমুদ্রসীমাবিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের রায়ে বাংলাদেশ সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম বরাবর তার বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা (EEZ) হারিয়েছে। সমুদ্রসীমা নির্ধারণে Natural Prolongation নীতির বদলে সমদূরত্ব নীতি প্রয়োগ হওয়ায় বাংলাদেশ ২০০ নটিক্যাল মাইল দক্ষিণে ১৫০ নটিক্যাল মাইল মহীসোপানের (CS)-এর বেশ কিছু এলাকা হারিয়েছে। এই এলাকায় বাংলাদেশের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ২০টি গভীর সমুদ্র ব্লকের মধ্যে ১০টি ব্লক আংশিক বা পুরো হাতছাড়া হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের তটরেখা থেকে মহীসোপানের আগ পর্যন্ত মোট দুই লাখ ৮৩ হাজার ৪৬৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ দাবি করেছিল এক লাখ ৭৫ হাজার ৩২৬ দশমিক ৮ বর্গকিলোমিটার এবং মিয়ানমার দুই লাখ ১৪ হাজার ৩০০ বর্গকিলোমিটার। রায়ের পর বাংলাদেশ পেয়েছে এক লাখ ১১ হাজার ৬৩১ বর্গকিলোমিটার এবং মিয়ানমার পেয়েছে এক লাখ ৭১ হাজার ৮৩২ বর্গকিলোমিটার। ১৫১ পৃষ্ঠাব্যাপী ৫০৬টি অনুচ্ছেদের এই রায়ে বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রসীমা নিয়ে অনেক ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রাপ্তি মিয়ানমারের চেয়ে কম হলেও অর্জনও রয়েছে বেশ। সীমানা মীমাংসা হওয়ায় মিয়ানমার ও বাংলাদেশ উভয়েই লাভবান হয়েছে। এত দিনের বিরোধ চুকে গেছে। নির্ধারিত সীমায় নিজেদের কর্তৃত্ব জাহির ও অর্থনৈতিক কাজে বারিধির ওপর-নিচের ব্যবহার সহজসাধ্য হয়েছে।
সমুদ্রসীমাবিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তির রায় প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নৌবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রিয়াল অ্যাডমিরাল মো. খুরশেদ আলমও নেভির একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তিনিই আন্তর্জাতিক আদালতের এই সালিসের নেতৃত্বদানকারী। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, 'আমরা ন্যায্য সমাধান চেয়েছিলাম। তা-ই পেয়েছি। সেন্ট মার্টিন চেয়েছিলাম ১২ নটিক্যাল মাইল, তা-ই পেয়েছি। মিয়ানমার সেন্ট মার্টিনের ছয় নটিক্যাল মাইল দিতে চেয়েছিল। অর্থনৈতিক এলাকায় ১৩০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলাম। এখন ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত যেতে পারছি। এই ২০০ নটিক্যাল মাইল ছাড়াও যে আরো ১৫০ নটিক্যাল মাইল মহীসোপান, আমাদের সেই দাবিও পেয়েছি। ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে মীমাংসা হওয়ার পর পুরো সীমানা ঠিক হবে। মিয়ানমারের সঙ্গে মীমাংসা হওয়ায় আমাদের দেশের একটি নির্দিষ্ট সীমানা হলো। এত দিন আমরা আমাদের সীমানা ঠিক করতে পারিনি।' ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে মহীসোপান দাবি করার জন্য জরিপ করে তথ্য-উপাত্তসহ জাতিসংঘের কাছে দাবি জানানোর শেষ দিন ছিল ২০১১ সালের ২৬ আগস্ট। নৌবাহিনীর জরিপ ছাড়া দাবি উপস্থাপন করে কোনো লাভও ছিল না। ফলে তিন হাজার কিলোমিটার জরিপ করতে সরকার ৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। কিন্তু নৌবাহিনী জরিপ শেষ করে মাত্র ২৫ কোটি টাকা ব্যয় করে। তাদের 'অগ্রদূত' ও 'শৈবাল' পুরো সাজিয়ে দিয়েছিল ফরাসি সরকার। বিশেষত হাইড্রোগ্রাফিক যন্ত্রপাতি এবং এক বছর ধরে প্রশিক্ষণ দিয়েছে সেই সরকার। নৌবাহিনীর 'দর্শক' ও 'তল্লাশি' ছিল এর আগে সেই কাজের জন্য। ফলে মামলা পরিচালনার জন্য সমুদ্র সম্পর্কে সব তথ্য-উপাত্ত প্রাপ্তি ঘটে নৌবাহিনীর কাছ থেকে। উল্লেখ্য, ২০০০ সালে ফরাসি সরকারের সহায়তায় নৌবাহিনী চট্টগ্রামে 'হাইড্রোগ্রাফি ও ওশানগ্রাফি সেন্টার' প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমান রাষ্ট্রপতি ও তখনকার এলজিইডিমন্ত্রী মো. জিল্লুর রহমান সেটির উদ্বোধন করেছিলেন। মূলত সমুদ্রে গমনাগমনসহ নৌবাহিনী সব উপাত্ত সরবরাহ করেছে। জাহাজ, জনবল, নিরাপত্তা দিয়ে কাজ সহজ করে তুলেছে। অবশ্য এর আগেই তারা অনেক তথ্য আহরণ করেছিল। এর পরই তথ্যগুলো বিশ্লেষণ শুরু হয়। তখন যাবতীয় কাজ পররাষ্ট্র দপ্তরে চলেছে; সেখানে নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক সহায়তা দিয়েছেন। কারণ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ফুলটাইম লোক দিতে পারেনি। এ জন্য কাজগুলো নৌবাহিনীর ঘাড়ে পড়ে। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে কাজের গতি মন্থর হয়ে পড়েছিল। ২০০৮ থেকে পুনরায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। তবে ফলপ্রসূ আলোচনার সূচনা হয় ২০০৯-এ মহাজোট সরকার গঠনের পর। এ সময় নতুন তথ্য-উপাত্ত দরকার হয়। দেশের কোনো প্রতিষ্ঠানে সেসব ছিল না। তবে সমুদ্রে যাওয়ার মতো একমাত্র জাহাজ ছিল নৌবাহিনীতে। তখন থেকে তারাই তথ্য সংগ্রহে সহায়তা দিতে থাকে। ২০০৯ সালে হাইড্রোগ্রাফি জাহাজ দিয়ে সহায়তা করে ব্রিটেন।
আইন অনুযায়ী তটরেখা থেকে ৩৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত দাবি করা যায়। কিন্তু তটরেখায় সমস্যা থাকায় অন্য একটি পদ্ধতিতে আরো বেশি দাবি করা হয়। সেটি হলো, সমুদ্রের দুই হাজার ৫০০ মিটার গভীরতা থেকে ১০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত দাবি করা যায়। আর এই গভীরতা নিরূপণের জন্য জাহাজ ছিল না। তবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নৌবাহিনীকে একটি জরিপ জাহাজ কেনার অনুমতি দেন। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাহাজটি বাংলাদেশে আসে। এটিই নৌবাহিনীর 'অনুসন্ধান' জাহাজ নামে পরিচিত। এটি অত্যাধুনিক হাইড্রোগ্রাফার জাহাজ। অনেক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও দ্রুততম সময়ের মধ্যে দুই হাজার ৫০০ মিটার জরিপ করা হয়। এ জন্য আমাদের আরো ১০০ নটিক্যাল মাইল বেশি দাবি করার সুযোগ তৈরি হয়। জরিপের তথ্য-উপাত্ত দিয়ে ২০১১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ৩৮০ থেকে ৪৬০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অর্থাৎ ২৫০ মাইলের বেশি বাংলাদেশ মহীসোপানের দাবি উপস্থাপন করে। অথচ মিয়ানমার পুরো অঞ্চল দাবি করে নথিপত্র জমা দিয়েছিল ২০০৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর এবং ভারত জমা দেয় ২০০৯ সালের ১১ মে। ২০১০ সালে যদি জরিপের কাজটি করা না হতো তাহলে আজকের অর্জন সম্ভব ছিল না। সে সময় প্রতিবেশী দেশের প্রবল বাধার মধ্যে পড়তে হয় আমাদের নৌবাহিনীর জাহাজকে। আকাশে অন্য দেশের জেট প্লেনের নজরদারির মধ্যেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উত্তাল সমুদ্রে কাজ করতে হয়েছে নৌবাহিনীর সদস্যদের। আগেই বলা হয়েছে, তথ্য সংগ্রহের কাজটি ছিল ভীষণ জরুরি। এই ডেটার জন্যই ৪৬০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত দাবি করতে পারা গেছে।
সমুদ্রসীমা মীমাংসার ফলে আমরা নৌবাহিনীর গুরুত্ব বেশি করে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছি। আবার সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ায় নৌবাহিনীর দায়িত্বও বেড়েছে। মূলত সংঘর্ষ নয়, শান্তির সময় তাদের কাজ বেড়ে যায়। নিরাপত্তা দিতে হয় সমগ্র দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলকে। এ জন্য নৌবাহিনীর সহায়তায় সরকার অর্থনৈতিক শক্তি দেখাতে পারে। মিয়ানমার ও ভারতের সাবমেরিন রয়েছে, এ জন্য বাংলাদেশকে বেশি সতর্ক থাকতে হবে। দেশের সমুদ্রসম্পদকে দেশ-বিদেশে সেমিনারের মাধ্যমে তুলে ধরতে হবে। হাইড্রোগ্রাফি স্টাডিতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। অন্যদিকে সমুদ্রের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্বিঘ্ন ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে দাবি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ভূমিকা সর্বাগ্রে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.