দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-সংশোধনী প্রস্তাব জনগণকে জানানো হবে না কেন? by মশিউল আলম
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছিল, তাতে এই প্রতিশ্রুতি ছিল যে ‘দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে সংস্থাটিকে আরও শক্তিশালী করা হবে’। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই এমন উদ্যোগ নিতে শুরু করে যাতে দুদক একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালে যে দুর্নীতি দমন অধ্যাদেশ জারি করেছিল, এই সরকার তা আইন হিসেবে গ্রহণ করেনি। ফলে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন আইনটিই রয়ে যায়। সে আইনটি সংশোধনীর জন্য সরকার ঊর্ধ্বতন আমলাদের সমন্বয়ে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি যেসব সংশোধনী আনার সুপারিশ করে, সেগুলো বাস্তবায়িত হলে দুদক শক্তিশালী হওয়ার বদলে আরও দুর্বল হয়ে পড়বে—এমন উদ্বেগের কথা জানা গিয়েছিল খোদ দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষ থেকে। তখন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবিসহ) সংবাদমাধ্যম প্রবল প্রতিবাদ জানায়। টিআইবি জনমত জরিপ করে, চার-পাঁচ লাখ মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে প্রধানমন্ত্রীর সমীপে স্মারকলিপি দেয়। সংবাদমাধ্যমে লেখালেখি চলে। পরে তিন মন্ত্রীর সমন্বয়ে আরেকটি উচ্চতর কমিটি গঠন করা হয়, কিন্তু সে কমিটির বৈঠক বা সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কিছু জানা যায় না।
সম্প্রতি খবর বেরিয়েছে, সেই বিতর্কিত সংশোধনী প্রস্তাবগুলোই মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেয়েছে; সংসদের চলতি অধিবেশনেই সংশোধনীর বিলটি উত্থাপিত হবে, হয়তো আইন আকারে পাসও হয়ে যাবে। দুঃখের বিষয়, সরকারের গঠিত পাঁচ সদস্যের ওই কমিটি দুদক আইন সংশোধনের জন্য কতগুলো সুপারিশ পেশ করেছিল, সেগুলো কী কী, নাগরিক সমাজ বা সংবাদমাধ্যম তা কখনোই বিশদভাবে জানতে পারেনি। আমরা সংবাদমাধ্যমের পক্ষ থেকে লিখেছিলাম, কমিটির সুপারিশগুলো দুদকের ওয়েবসাইটসহ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা হোক; সেগুলো সম্পর্কে জনগণের মতামত চাওয়া হোক। খোলা ফোরামে, সভা-সেমিনার-গোলটেবিল বৈঠকে, বেতার-টিভিতে আলোচনা-পর্যালোচনা হোক। দুদককে আরও শক্তিশালী করার জন্য বিদ্যমান আইনে যদি সংশোধন, সংযোজন-বিয়োজনের প্রয়োজন হয়, তবে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সেইভাবে সংশোধনীর উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
কিন্তু সংশোধনী প্রস্তাবগুলো ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়নি, সংবাদমাধ্যমকেও দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে আমাদের যেটুকু ধারণা হয়েছে, তার উৎস মূলত দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের বক্তব্য। বিভিন্ন উপলক্ষে তিনি সংবাদমাধ্যমকে এ বিষয়ে যেসব কথা বলেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: দুদক এমনিতেই একটি দন্তহীন সংস্থা; তবে এর থাবা আছে, সেই থাবায় নখও আছে, কিন্তু আইন সংশোধনের মধ্য দিয়ে সেই নখগুলো কেটে নেওয়ার উদ্যোগ চলছে। এ রকম কথা তিনি বলেছিলেন ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে। তাঁর কথার সূত্র ধরে সংবাদমাধ্যমে লেখালেখি হয়েছে, দুদক আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলোর একটি হলো: প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনতে হলে দুদককে সরকারের পূর্বানুমতি নিতে হবে। সরকার অনুমতি না দিলে দুদকের ক্ষমতা থাকবে না কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে কিছু করার—না তদন্ত, না মামলা দায়ের। আসলে এ রকম বিধান চালু ছিল দুর্নীতি দমন ব্যুরোর সময়, যখন ওই সংস্থাটি পরিচালিত হতো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দুর্নীতি দমন ব্যুরো বস্তুত দুর্নীতি বিষয়ে কিছুই করার ক্ষমতা রাখত না। ফলে ব্যুরো ছিল কার্যত একটি অকার্যকর সংস্থা। অর্থাৎ দুদককে আবার দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মতো অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার লক্ষ্যে আইন সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে।
সংশোধনীর আরেকটি সুপারিশ এ রকম: বর্তমান আইনের বলে দুদক তদন্তের স্বার্থে সরকারের গোপনীয় নথিপত্র দেখার যে ক্ষমতা রাখে, আইন সংশোধনের পর দুদকের সে ক্ষমতা আর থাকবে না। এভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, দুদক আইন সংশোধনের এই উদ্যোগ আসলে এই স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের সামনে সত্যিই এক বিপদ হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। নির্বাহী ক্ষমতার পক্ষ থেকে এসেছে এই বিপদ। গোটা আমলাতন্ত্র, যাদের হাতে ক্ষমতা আছে, যারা ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার করে জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থেকে যেতে চায়—তারা সবাই মিলে দুদককে অকার্যকর একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার লক্ষ্যে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে।
এ রকম পরিস্থিতিতে আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তাঁর মন্ত্রিসভা ও পুরো সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিতে পারি নির্বাচনের আগে জনগণের কাছে দেওয়া তাঁদের প্রতিশ্রুতির কথা। আমরা আরও বলতে পারি, জনগণ ভোট দিয়ে আপনাদের নির্বাচিত করেছে বলেই সবকিছুর ম্যান্ডেট আপনাদের দিয়ে রেখেছে—অনুগ্রহ করে এমন ধারণা পোষণ করবেন না। জনগণের মঙ্গল হয়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটি আরও মজবুত হয়, স্বচ্ছ হয়, জবাবদিহিপূর্ণ হয়—এমন কার্যক্রম আপনারা গ্রহণ করবেন আশা করেই জনগণ আপনাদের নির্বাচিত করেছে। দুর্নীতিবাজদের উল্লাসের নৃত্য জনগণ আর দেখতে চায় না। দুর্নীতি করে কেউ পার পাবেন না—এই নিশ্চয়তা চায়। ২০১০ সালের জুলাই মাসে টিআইবির করা এক জনমত জরিপে ৯৬ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছিলেন, তাঁরা স্বাধীন ও শক্তিশালী দুদক চান; আর ৭৩ শতাংশ উত্তরদাতা মত দিয়েছিলেন, দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের ক্ষেত্রে পূর্বানুমতির বিধান থাকা উচিত নয়। সরকারের উচিত জনমতকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা, আমলে নেওয়া। শাস্তির ভয় ব্যতিরেকে দুর্নীতি করার সুযোগ যাতে বন্ধ করা যায় সে লক্ষ্যেই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
২০০৯ সালের ২৫ অক্টোবর প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি, দুর্নীতি নির্মূলে তাঁর (শেখ হাসিনার) স্পষ্ট অঙ্গীকার রয়েছে। তাঁর তরফে আন্তরিকতার কোনো অভাব রয়েছে বলে আমার মনে হয়নি। তাই আমার বিশ্বাস, দুদককে দুর্বল করতে এ পর্যন্ত যত প্রস্তাব এসেছে তা তিনি যত দিন প্রধানমন্ত্রী আছেন, তত দিন অনুমোদন পাবে না।’
কিন্তু সংশোধনী প্রস্তাব মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেয়ে গেছে, এখন তা সংসদে উপস্থাপিত হবে। এ অবস্থায় আমাদের অনুরোধ, সংশোধনীর খসড়াটি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হোক। রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশন সুপারিশ করেছিল, সব আইনের খসড়া বিল আকারে যখন সংসদে উপস্থাপন করা হবে, তখন মুদ্রিত আকারে গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পাশাপাশি তা ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করতে হবে। ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা না হলে কোনো গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে বলে গণ্য হবে না। এটি একটি উত্তম সুপারিশ। গণতান্ত্রিক সরকারের সময়ই এ ধরনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা উচিত। এখন দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের সংশোধনীর খসড়া বিলটি সংসদে উপস্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে এ নিয়ে সমাজের বিভিন্ন অংশে আলোচনা-পর্যালোচনার উদ্যোগ নেওয়া হোক। সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নিয়ে সংসদেও আলোচনা হোক; এ আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য বিরোধী দলের উচিত সংসদে যোগ দেওয়া। তারা এই সুবাদে সংসদে তুমুল তর্ক-বিতর্ক শুরু করতে পারে। পক্ষে-বিপক্ষে সেসব আলোচনা টিভিতে সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা হোক, জনসাধারণ তা দেখুক। সেই সঙ্গে ওয়েবসাইট ও সংবাদমাধ্যমে সংশোধনী প্রস্তাব প্রকাশ করে জনসাধারণের মতামত চাওয়া হোক।
যেহেতু দুদক আইন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আইন, এবং যেহেতু এর সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে বেশ প্রতিবাদ ও সমালোচনা লক্ষ করা গেছে, তাই সরকারের উচিত হবে বিষয়টি সম্পর্কে জনসাধারণের মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ রাখা এবং সেসব মতামতের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া। জনমতকে উপেক্ষা করা মোটেও উচিত হবে না।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
সম্প্রতি খবর বেরিয়েছে, সেই বিতর্কিত সংশোধনী প্রস্তাবগুলোই মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেয়েছে; সংসদের চলতি অধিবেশনেই সংশোধনীর বিলটি উত্থাপিত হবে, হয়তো আইন আকারে পাসও হয়ে যাবে। দুঃখের বিষয়, সরকারের গঠিত পাঁচ সদস্যের ওই কমিটি দুদক আইন সংশোধনের জন্য কতগুলো সুপারিশ পেশ করেছিল, সেগুলো কী কী, নাগরিক সমাজ বা সংবাদমাধ্যম তা কখনোই বিশদভাবে জানতে পারেনি। আমরা সংবাদমাধ্যমের পক্ষ থেকে লিখেছিলাম, কমিটির সুপারিশগুলো দুদকের ওয়েবসাইটসহ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা হোক; সেগুলো সম্পর্কে জনগণের মতামত চাওয়া হোক। খোলা ফোরামে, সভা-সেমিনার-গোলটেবিল বৈঠকে, বেতার-টিভিতে আলোচনা-পর্যালোচনা হোক। দুদককে আরও শক্তিশালী করার জন্য বিদ্যমান আইনে যদি সংশোধন, সংযোজন-বিয়োজনের প্রয়োজন হয়, তবে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সেইভাবে সংশোধনীর উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
কিন্তু সংশোধনী প্রস্তাবগুলো ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়নি, সংবাদমাধ্যমকেও দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে আমাদের যেটুকু ধারণা হয়েছে, তার উৎস মূলত দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের বক্তব্য। বিভিন্ন উপলক্ষে তিনি সংবাদমাধ্যমকে এ বিষয়ে যেসব কথা বলেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: দুদক এমনিতেই একটি দন্তহীন সংস্থা; তবে এর থাবা আছে, সেই থাবায় নখও আছে, কিন্তু আইন সংশোধনের মধ্য দিয়ে সেই নখগুলো কেটে নেওয়ার উদ্যোগ চলছে। এ রকম কথা তিনি বলেছিলেন ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে। তাঁর কথার সূত্র ধরে সংবাদমাধ্যমে লেখালেখি হয়েছে, দুদক আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলোর একটি হলো: প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনতে হলে দুদককে সরকারের পূর্বানুমতি নিতে হবে। সরকার অনুমতি না দিলে দুদকের ক্ষমতা থাকবে না কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে কিছু করার—না তদন্ত, না মামলা দায়ের। আসলে এ রকম বিধান চালু ছিল দুর্নীতি দমন ব্যুরোর সময়, যখন ওই সংস্থাটি পরিচালিত হতো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দুর্নীতি দমন ব্যুরো বস্তুত দুর্নীতি বিষয়ে কিছুই করার ক্ষমতা রাখত না। ফলে ব্যুরো ছিল কার্যত একটি অকার্যকর সংস্থা। অর্থাৎ দুদককে আবার দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মতো অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার লক্ষ্যে আইন সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে।
সংশোধনীর আরেকটি সুপারিশ এ রকম: বর্তমান আইনের বলে দুদক তদন্তের স্বার্থে সরকারের গোপনীয় নথিপত্র দেখার যে ক্ষমতা রাখে, আইন সংশোধনের পর দুদকের সে ক্ষমতা আর থাকবে না। এভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, দুদক আইন সংশোধনের এই উদ্যোগ আসলে এই স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের সামনে সত্যিই এক বিপদ হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। নির্বাহী ক্ষমতার পক্ষ থেকে এসেছে এই বিপদ। গোটা আমলাতন্ত্র, যাদের হাতে ক্ষমতা আছে, যারা ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার করে জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থেকে যেতে চায়—তারা সবাই মিলে দুদককে অকার্যকর একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার লক্ষ্যে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে।
এ রকম পরিস্থিতিতে আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তাঁর মন্ত্রিসভা ও পুরো সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিতে পারি নির্বাচনের আগে জনগণের কাছে দেওয়া তাঁদের প্রতিশ্রুতির কথা। আমরা আরও বলতে পারি, জনগণ ভোট দিয়ে আপনাদের নির্বাচিত করেছে বলেই সবকিছুর ম্যান্ডেট আপনাদের দিয়ে রেখেছে—অনুগ্রহ করে এমন ধারণা পোষণ করবেন না। জনগণের মঙ্গল হয়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটি আরও মজবুত হয়, স্বচ্ছ হয়, জবাবদিহিপূর্ণ হয়—এমন কার্যক্রম আপনারা গ্রহণ করবেন আশা করেই জনগণ আপনাদের নির্বাচিত করেছে। দুর্নীতিবাজদের উল্লাসের নৃত্য জনগণ আর দেখতে চায় না। দুর্নীতি করে কেউ পার পাবেন না—এই নিশ্চয়তা চায়। ২০১০ সালের জুলাই মাসে টিআইবির করা এক জনমত জরিপে ৯৬ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছিলেন, তাঁরা স্বাধীন ও শক্তিশালী দুদক চান; আর ৭৩ শতাংশ উত্তরদাতা মত দিয়েছিলেন, দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের ক্ষেত্রে পূর্বানুমতির বিধান থাকা উচিত নয়। সরকারের উচিত জনমতকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা, আমলে নেওয়া। শাস্তির ভয় ব্যতিরেকে দুর্নীতি করার সুযোগ যাতে বন্ধ করা যায় সে লক্ষ্যেই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
২০০৯ সালের ২৫ অক্টোবর প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি, দুর্নীতি নির্মূলে তাঁর (শেখ হাসিনার) স্পষ্ট অঙ্গীকার রয়েছে। তাঁর তরফে আন্তরিকতার কোনো অভাব রয়েছে বলে আমার মনে হয়নি। তাই আমার বিশ্বাস, দুদককে দুর্বল করতে এ পর্যন্ত যত প্রস্তাব এসেছে তা তিনি যত দিন প্রধানমন্ত্রী আছেন, তত দিন অনুমোদন পাবে না।’
কিন্তু সংশোধনী প্রস্তাব মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেয়ে গেছে, এখন তা সংসদে উপস্থাপিত হবে। এ অবস্থায় আমাদের অনুরোধ, সংশোধনীর খসড়াটি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হোক। রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশন সুপারিশ করেছিল, সব আইনের খসড়া বিল আকারে যখন সংসদে উপস্থাপন করা হবে, তখন মুদ্রিত আকারে গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পাশাপাশি তা ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করতে হবে। ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা না হলে কোনো গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে বলে গণ্য হবে না। এটি একটি উত্তম সুপারিশ। গণতান্ত্রিক সরকারের সময়ই এ ধরনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা উচিত। এখন দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের সংশোধনীর খসড়া বিলটি সংসদে উপস্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে এ নিয়ে সমাজের বিভিন্ন অংশে আলোচনা-পর্যালোচনার উদ্যোগ নেওয়া হোক। সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নিয়ে সংসদেও আলোচনা হোক; এ আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য বিরোধী দলের উচিত সংসদে যোগ দেওয়া। তারা এই সুবাদে সংসদে তুমুল তর্ক-বিতর্ক শুরু করতে পারে। পক্ষে-বিপক্ষে সেসব আলোচনা টিভিতে সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা হোক, জনসাধারণ তা দেখুক। সেই সঙ্গে ওয়েবসাইট ও সংবাদমাধ্যমে সংশোধনী প্রস্তাব প্রকাশ করে জনসাধারণের মতামত চাওয়া হোক।
যেহেতু দুদক আইন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আইন, এবং যেহেতু এর সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে বেশ প্রতিবাদ ও সমালোচনা লক্ষ করা গেছে, তাই সরকারের উচিত হবে বিষয়টি সম্পর্কে জনসাধারণের মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ রাখা এবং সেসব মতামতের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া। জনমতকে উপেক্ষা করা মোটেও উচিত হবে না।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
No comments