বাংলাদেশে জৈব সারের ব্যবহার by এ এম এম শওকত আলী
বাংলাদেশে জৈব সারের ব্যবহার আবহমানকাল ধরে কৃষক পর্যায়ে পরিলক্ষিত হয়। তবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদিত জৈব সারের ব্যবহার ২০০০ সাল পরবর্তী সময়ে শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রে জৈব সারের উৎপাদন ও ব্যবহার শুরু ১৯৪০ সালে। এরপর জৈব সার উৎপাদন শিল্প ক্রমান্বয়ে বিকশিত হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় জৈব সার ব্যবহারের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন কাঠামোও গড়ে ওঠে। ১৯৯০ সালে জৈব সার ব্যবহৃত খাদ্য সংক্রান্ত আইন যুক্তরাষ্ট্র প্রণয়ন করে। কিন্তু জৈব সার ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদিত খাদ্যপণ্যকে জৈব খাদ্য (Organic Food) বলা যাবে না। এটা বলা যাবে তখন, যখন উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় কোনো কীটনাশক ব্যবহৃত হবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নেও জৈব সার এবং জৈব খাদ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা প্রচলিত। সাম্প্রতিককালে এ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করা হয়েছে। মূল কারণ উৎপাদিত খাদ্য অত্যন্ত স্বাস্থ্যসম্মত।
বাংলাদেশে স্বল্পসংখ্যক কিছু এনজিওর উদ্যোগের মাধ্যমে জৈব সার উৎপাদন ও বিপণন প্রক্রিয়া শুরু হয়। এদের মধ্যে রয়েছে উবিনীগ, গ্রামীণ শক্তি, সুহৃদ বাংলাদেশ, ওয়েস্ট কনসার্ন, উর্বরাশক্তি জৈব সার, উত্তরবঙ্গ জৈব সার ইত্যাদি। জানা গেছে, উবিনীগ জৈব খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন করছে। এর পাশাপাশি কিছু বেসরকারি কম্পানিও জৈব সার উৎপাদনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পক্ষান্তরে ২০০০ সাল পরবর্তী সময়ে খোলা বাজার থেকে গৃহীত জৈব সারের প্রকৃত গুণাগুণ পরীক্ষারও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পরীক্ষান্তে দেখা যায় যে গৃহীত নমুনার কোনোটিই মানসম্পন্ন নয়। এ কারণে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে জৈব সারের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করার জন্য এর মান নির্ধারণ করা হয় ২০০৮ সালে। মান নির্ধারণের প্রক্রিয়ার দুটি স্তর রয়েছে। এক, সরকার কর্তৃক নির্ধারিত গবেষণাগারে প্রদত্ত নমুনার বিশ্লেষণ। দুই, মাঠপর্যায়ে এর পরীক্ষা নিরীক্ষা। সরকারি এ উদ্যোগের দুটি উদ্দেশ্য। এক, জৈব সার ব্যবহারকারীরা যাতে প্রতারিত না হয় এবং দুই, জৈব সার ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যবহৃত সারে যেন কোনো ক্ষতিকর দ্রব্য জমির ক্ষতি না করতে পারে।
উলি্লখিত দুই পর্যায়ের পরীক্ষা ইতিবাচক হলে এ বিষয়ে আবেদনকারীকে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করে থাকে। একে সাধারণত বলা হয় লাইসেসিং পদ্ধতি। বাস্তবতা হলো উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অনিবন্ধিত বা অননুমোদিত জৈব সার উৎপাদনকারক বাজারে জৈব সার বিপণন করছে। লাইসেন্সের মেয়াদ পাঁচ বছর, যা এশীয় কিছু দেশের তুলনায় অধিকতর। যেমন থাইল্যান্ড ও ভারতে এর মেয়াদ যথাক্রমে তিন ও দুই বছর। তবে এসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অনুমোদন প্রক্রিয়া জটিলতর এবং দীর্ঘ সময় সম্পন্ন।
জৈব সার প্রচলন ও অধিকতর ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ক্যাটালিস্ট নামধারী এক সংস্থার একটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রথমে ২০০৯ সালে ও পরবর্তী পর্যায়ে ২০১০ সালে পরপর দুটি সমীক্ষা প্রণয়ন করা হয়। ভারতে নির্ধারিত পরীক্ষাগারে পরীক্ষান্তে নমুনা গ্রহণযোগ্য হলেই লাইসেন্স প্রদান করা হয়। থাইল্যান্ডেও মোটামুটি একই পদ্ধতি। থাইল্যান্ডের অনুরূপ ফিলিপাইনে একই পদ্ধতি তবে কিছুটা তারতম্য রয়েছে। ফিলিপাইনে নমুনা পরীক্ষার পর মানসম্পন্ন হলে একটি সাময়িক উৎপাদন ও ব্যবহারের অনুমতির বিধান রয়েছে। এর পর নমুনাটি মাঠপর্যায়ে পরীক্ষিত হয়। এক মৌসুমে পরীক্ষার পরই শর্তসাপেক্ষে অনুমতি দেওয়া হয়। পাকাপাকিভাবে নিবন্ধনের অনুমতি দেওয়া হয় পরবর্তী দুই মৌসুমে মাঠপর্যায়ের পরীক্ষার পর।
বাংলাদেশের বিদ্যমান পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্নতর। এর সর্বমোট ৯টি স্তর রয়েছে। এক, জৈব সারের নমুনা নির্ধারিত গবেষণাগারে প্রেরণ। দুই, এ জন্য সার-সংক্রান্ত কারিগরি সাব-কমিটিতে নমুনা দাখিল। এ আবেদনে নির্ধারিত কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়। তিন, এ কমিটি জৈব সার উৎপাদনের কারখানা পরিদর্শন ছাড়াও যেকোনো দুটি নির্ধারিত গবেষণাগারকে নমুনা পরীক্ষার জন্য অনুরোধ করবে। চার, নমুনা পরীক্ষা হবে। পাঁচ, মাঠপর্যায়ে হবে পরবর্তী পরীক্ষা। এ পরীক্ষার জন্য এক অথবা দুটি ফসল অন্তর্ভুক্ত থাকবে। পরীক্ষার ভিত্তিতে সাব-কমিটি পরবর্তী সময় চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার-সংক্রান্ত মান অনুমোদন কমিটির কাছে পাঠাবে যা গেজেটে প্রকাশিত হবে। সাত, উদ্যোক্তাকে আবার জেলার কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তার কাছে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে হবে। এর সঙ্গে মান অনুমোদন সংক্রান্ত প্রমাণ ও গেজেটে প্রকাশিত প্রজ্ঞাপন দাখিল করবে। আট, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা জৈব সার কারখানা পরিদর্শন করবে। নয়, চূড়ান্ত লাইসেন্স প্রদান।
উপর্যুক্ত বিশেষণের বিষয়ে আরো বলা যায় যে ভারতে কোনো মাঠপর্যায়ের পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। চূড়ান্ত লাইসেন্স প্রদানের সময়সীমা ৪৫ দিন অর্থাৎ দেড় মাস। থাইল্যান্ডেও কোনো মাঠপর্যায়ের পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। সাধারণত দুই মাসের মধ্যে লাইসেন্স প্রদান করা হয়। ফিলিপাইনে নির্ধারিত পরীক্ষাগারে নমুনা গ্রহণযোগ্য হলে প্রাথমিক অনুমতি। পরে দুই ধাপে চূড়ান্ত অনুমতি। প্রাথমিক, সাময়িক ও চূড়ান্ত অনুমোদন ছাড়াই উদ্যোক্তা জৈব সার উৎপাদন ও বিপণন করতে পারে। লাইসেন্স প্রদানের দীর্ঘসূত্রতার বিষয়টি উদ্যোক্তারা জৈব সার উৎপাদন ও বিপণনে নিরুৎসাহিত। এদের এবং অন্যদের মতে অনুমোদন প্রক্রিয়াটি ব্যবসায়ীবান্ধব নয়। এ কারণে এ প্রক্রিয়া সহজতর করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। ২০০৯ সালের সমীক্ষায় আরো কয়েকটি বিষয় দৃশ্যমান। এক, বিদ্যমান পদ্ধতিতে বছরে কতবার সাব-কমিটি সভা করবে তার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। পরপর দুই সভার সময়ের ব্যবধান কত হবে তাও উল্লেখ করা নেই। এ ছাড়া আরেকটি সমস্যার বিষয়ও সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে। তা হলো রাসায়নিক সার, বায়ো সার ও অন্যান্য সার জাতীয় দ্রব্য প্রক্রিয়াজাত একই সাব-কমিটি করে থাকে। ফলে দেখা গেছে, আহূত সভায় জৈব সারের বিষয়টি অনিষ্পন্ন থাকে। দুই, এ বিষয়টি স্পষ্ট নয় যে অন্যান্য দেশের মতো এ দেশেও অনুমোদন প্রক্রিয়া সহজতর নয় কেন। তিন, মাঠপর্যায়ে পরীক্ষারও কোনো সময়সীমা নির্ধারিত নেই। অনুমোদন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে উদ্যোক্তার বিনিয়োগকৃত অর্থ থেকে কোনো আয়ও সম্ভব হয় না।
এ সমীক্ষায় (২০০৯) নীতি সংক্রান্ত একটি ও পদ্ধতি সংক্রান্ত দুটি সুপারিশ করা হয়েছে। এতে নবায়নের কোনো অবকাশ থাকবে না। আবেদনকারীকে এ সময়ের মধ্যেই মাঠপর্যায়ের পরীক্ষা সম্পন্ন করতে হবে চূড়ান্ত অনুমতি পাওয়ার জন্য। শেষোক্ত বিষয়টির গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ, মাঠপর্যায়ের পরীক্ষার সময়সীমার ওপর আবেদনকারীর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এটা নির্ধারিত গবেষণা সংস্থাই করবে। সুপারিশটি বাস্তবসম্মত নয়। এ বিধানকে অধিকতর বাস্তবসম্মত করার লক্ষ্যে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। এক, যদি নির্ধারিত গবেষণা সংস্থা এক বছরের মধ্যে মাঠপর্যায়ের পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারে তাহলে উদ্যোক্তার উৎপাদন ও বিপণনের অধিকার পরবর্তী এক বছর পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে। এ সময়ে সাব-কমিটি দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা যাতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয় তা নিশ্চিত করবে। আলোচ্য সমীক্ষার একটি উপস্থাপনা ২০০৯ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রায় ৭৬ জন কৃষি বিজ্ঞানীসহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞ উপস্থিত ছিলেন। সভার প্রধান অতিথি ছিলেন বর্তমান কৃষিমন্ত্রী। উপস্থিত ৭৬ জনের মধ্যে ২০ জন তাদের মতামত প্রদান করেন। প্রদত্ত মতামত চার ভাগে শ্রেণীভুক্ত করা হয়। এক, কেবলমাত্র বিজ্ঞানভিত্তিক মতামত যাতে নীতি ও পদ্ধতিগত জটিলতার উল্লেখ ছিল না। দুই, নীতি ও পদ্ধতিগত জটিলতা সম্পর্কে কোনো রকমের সংস্কারের বিপক্ষে। তিন, মিশ্র প্রতিক্রিয়া, কোনো বিষয়ে সুদৃঢ় অবস্থান নয়। চার, বিদ্যমান জটিলতা সহজীকরণের পক্ষে। মিশ্র প্রতিক্রিয়া যাঁরা ব্যক্ত করেন তাঁরাই ছিলেন সর্বাধিক, ৯ জন। বিপক্ষে ছিলেন চারজন। জটিলতা দূর করার পক্ষে পাঁচজন। উল্লেখ্য, নীতিনির্ধারকরা অর্থাৎ তৎকালীন কৃষিসচিব ও বর্তমান মন্ত্রী সহজীকরণের পক্ষে ছিলেন। তবে কৃষিসচিবের মত ছিল অনেকটা মধ্যমপন্থী। অর্থাৎ সহজীকরণ এবং একই সঙ্গে জৈব সার যাতে মানসম্পন্ন হয় তা নিশ্চিত করা। প্রস্তাবিত সুপারিশ প্রত্যাখ্যান না করে তিনি আশার বাণী শুনিয়েছিলেন। তাঁর মতে কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষিবিজ্ঞানীরা পরবর্তী পর্যায়ে এসব প্রস্তাব আবার আলোচনা করে একটি গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত প্রদান করবেন। এ কাজটি তাঁর সময়ে যেকোনো কারণেই হোক করা সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত এখনো ঝুলে আছে। বর্তমানে সম্পূর্ণ বিষয়টি আরো বস্তুনিষ্ঠভাবে পরীক্ষা করার জন্য আবার ক্যাটালিস্ট প্রকল্পের মাধ্যমে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আরো একটি সমীক্ষা বর্তমানে করা হচ্ছে। কাজটি করবে আন্তর্জাতিক সার গবেষণাকেন্দ্র। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের পর ২০১১ সালে যে সমীক্ষা হয় তার সুপারিশও ছিল নীতি ও পদ্ধতিগত জটিলতা দূরীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। এ সমীক্ষার ফলাফলও মূলত কৃষিবিজ্ঞানী পর্যায়েই বিবেচিত হয়। কিন্তু কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত হয়নি। মূল কারণ, ফলাফল বিবেচনা সভায় কোনো উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্র্ধারক উপস্থিত ছিলেন না। উল্লেখ্য, পূর্ববর্তী দুটি সমীক্ষায় কৃষক পর্যায়ের কোনো অভিমত গ্রহণ করা হয়নি। চলমান সমীক্ষায় এ বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে বলা যায়, সংস্কারের বিপক্ষে যাঁরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন তাঁদের যুক্তি মূলত দুটি। এক, ভেজাল বা নিম্নমানসম্পন্ন জৈব সার যেন বিপণন না করা হয়। দুই, জৈব সারে ব্যবহৃত কোনো উপাদানে যেন জমির জন্য ক্ষতিকর কোনো বস্তু না থাকে। বলা বাহুল্য, এ দুটি বিষয় পরীক্ষাগারে নমুনা বিশ্লেষণের মাধ্যমে নির্ণয় করা সম্ভব। এ বিষয়ে আরো উল্লেখ করা যায়, কোনো ভেজাল সার বিপণনের জন্য দায়ী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানকে প্রচলিত আইনের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে। এ বিষয়টিও এর সঙ্গে নিয়মিত কারখানা পরিদর্শন এবং নমুনা বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায়। এ ছাড়া প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াস, যা বর্তমানে করা হয় না।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক
উপদেষ্টা ও কলামিস্ট
বাংলাদেশে স্বল্পসংখ্যক কিছু এনজিওর উদ্যোগের মাধ্যমে জৈব সার উৎপাদন ও বিপণন প্রক্রিয়া শুরু হয়। এদের মধ্যে রয়েছে উবিনীগ, গ্রামীণ শক্তি, সুহৃদ বাংলাদেশ, ওয়েস্ট কনসার্ন, উর্বরাশক্তি জৈব সার, উত্তরবঙ্গ জৈব সার ইত্যাদি। জানা গেছে, উবিনীগ জৈব খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন করছে। এর পাশাপাশি কিছু বেসরকারি কম্পানিও জৈব সার উৎপাদনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পক্ষান্তরে ২০০০ সাল পরবর্তী সময়ে খোলা বাজার থেকে গৃহীত জৈব সারের প্রকৃত গুণাগুণ পরীক্ষারও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পরীক্ষান্তে দেখা যায় যে গৃহীত নমুনার কোনোটিই মানসম্পন্ন নয়। এ কারণে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে জৈব সারের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করার জন্য এর মান নির্ধারণ করা হয় ২০০৮ সালে। মান নির্ধারণের প্রক্রিয়ার দুটি স্তর রয়েছে। এক, সরকার কর্তৃক নির্ধারিত গবেষণাগারে প্রদত্ত নমুনার বিশ্লেষণ। দুই, মাঠপর্যায়ে এর পরীক্ষা নিরীক্ষা। সরকারি এ উদ্যোগের দুটি উদ্দেশ্য। এক, জৈব সার ব্যবহারকারীরা যাতে প্রতারিত না হয় এবং দুই, জৈব সার ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যবহৃত সারে যেন কোনো ক্ষতিকর দ্রব্য জমির ক্ষতি না করতে পারে।
উলি্লখিত দুই পর্যায়ের পরীক্ষা ইতিবাচক হলে এ বিষয়ে আবেদনকারীকে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করে থাকে। একে সাধারণত বলা হয় লাইসেসিং পদ্ধতি। বাস্তবতা হলো উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অনিবন্ধিত বা অননুমোদিত জৈব সার উৎপাদনকারক বাজারে জৈব সার বিপণন করছে। লাইসেন্সের মেয়াদ পাঁচ বছর, যা এশীয় কিছু দেশের তুলনায় অধিকতর। যেমন থাইল্যান্ড ও ভারতে এর মেয়াদ যথাক্রমে তিন ও দুই বছর। তবে এসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অনুমোদন প্রক্রিয়া জটিলতর এবং দীর্ঘ সময় সম্পন্ন।
জৈব সার প্রচলন ও অধিকতর ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ক্যাটালিস্ট নামধারী এক সংস্থার একটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রথমে ২০০৯ সালে ও পরবর্তী পর্যায়ে ২০১০ সালে পরপর দুটি সমীক্ষা প্রণয়ন করা হয়। ভারতে নির্ধারিত পরীক্ষাগারে পরীক্ষান্তে নমুনা গ্রহণযোগ্য হলেই লাইসেন্স প্রদান করা হয়। থাইল্যান্ডেও মোটামুটি একই পদ্ধতি। থাইল্যান্ডের অনুরূপ ফিলিপাইনে একই পদ্ধতি তবে কিছুটা তারতম্য রয়েছে। ফিলিপাইনে নমুনা পরীক্ষার পর মানসম্পন্ন হলে একটি সাময়িক উৎপাদন ও ব্যবহারের অনুমতির বিধান রয়েছে। এর পর নমুনাটি মাঠপর্যায়ে পরীক্ষিত হয়। এক মৌসুমে পরীক্ষার পরই শর্তসাপেক্ষে অনুমতি দেওয়া হয়। পাকাপাকিভাবে নিবন্ধনের অনুমতি দেওয়া হয় পরবর্তী দুই মৌসুমে মাঠপর্যায়ের পরীক্ষার পর।
বাংলাদেশের বিদ্যমান পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্নতর। এর সর্বমোট ৯টি স্তর রয়েছে। এক, জৈব সারের নমুনা নির্ধারিত গবেষণাগারে প্রেরণ। দুই, এ জন্য সার-সংক্রান্ত কারিগরি সাব-কমিটিতে নমুনা দাখিল। এ আবেদনে নির্ধারিত কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়। তিন, এ কমিটি জৈব সার উৎপাদনের কারখানা পরিদর্শন ছাড়াও যেকোনো দুটি নির্ধারিত গবেষণাগারকে নমুনা পরীক্ষার জন্য অনুরোধ করবে। চার, নমুনা পরীক্ষা হবে। পাঁচ, মাঠপর্যায়ে হবে পরবর্তী পরীক্ষা। এ পরীক্ষার জন্য এক অথবা দুটি ফসল অন্তর্ভুক্ত থাকবে। পরীক্ষার ভিত্তিতে সাব-কমিটি পরবর্তী সময় চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার-সংক্রান্ত মান অনুমোদন কমিটির কাছে পাঠাবে যা গেজেটে প্রকাশিত হবে। সাত, উদ্যোক্তাকে আবার জেলার কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তার কাছে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে হবে। এর সঙ্গে মান অনুমোদন সংক্রান্ত প্রমাণ ও গেজেটে প্রকাশিত প্রজ্ঞাপন দাখিল করবে। আট, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা জৈব সার কারখানা পরিদর্শন করবে। নয়, চূড়ান্ত লাইসেন্স প্রদান।
উপর্যুক্ত বিশেষণের বিষয়ে আরো বলা যায় যে ভারতে কোনো মাঠপর্যায়ের পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। চূড়ান্ত লাইসেন্স প্রদানের সময়সীমা ৪৫ দিন অর্থাৎ দেড় মাস। থাইল্যান্ডেও কোনো মাঠপর্যায়ের পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। সাধারণত দুই মাসের মধ্যে লাইসেন্স প্রদান করা হয়। ফিলিপাইনে নির্ধারিত পরীক্ষাগারে নমুনা গ্রহণযোগ্য হলে প্রাথমিক অনুমতি। পরে দুই ধাপে চূড়ান্ত অনুমতি। প্রাথমিক, সাময়িক ও চূড়ান্ত অনুমোদন ছাড়াই উদ্যোক্তা জৈব সার উৎপাদন ও বিপণন করতে পারে। লাইসেন্স প্রদানের দীর্ঘসূত্রতার বিষয়টি উদ্যোক্তারা জৈব সার উৎপাদন ও বিপণনে নিরুৎসাহিত। এদের এবং অন্যদের মতে অনুমোদন প্রক্রিয়াটি ব্যবসায়ীবান্ধব নয়। এ কারণে এ প্রক্রিয়া সহজতর করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। ২০০৯ সালের সমীক্ষায় আরো কয়েকটি বিষয় দৃশ্যমান। এক, বিদ্যমান পদ্ধতিতে বছরে কতবার সাব-কমিটি সভা করবে তার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। পরপর দুই সভার সময়ের ব্যবধান কত হবে তাও উল্লেখ করা নেই। এ ছাড়া আরেকটি সমস্যার বিষয়ও সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে। তা হলো রাসায়নিক সার, বায়ো সার ও অন্যান্য সার জাতীয় দ্রব্য প্রক্রিয়াজাত একই সাব-কমিটি করে থাকে। ফলে দেখা গেছে, আহূত সভায় জৈব সারের বিষয়টি অনিষ্পন্ন থাকে। দুই, এ বিষয়টি স্পষ্ট নয় যে অন্যান্য দেশের মতো এ দেশেও অনুমোদন প্রক্রিয়া সহজতর নয় কেন। তিন, মাঠপর্যায়ে পরীক্ষারও কোনো সময়সীমা নির্ধারিত নেই। অনুমোদন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে উদ্যোক্তার বিনিয়োগকৃত অর্থ থেকে কোনো আয়ও সম্ভব হয় না।
এ সমীক্ষায় (২০০৯) নীতি সংক্রান্ত একটি ও পদ্ধতি সংক্রান্ত দুটি সুপারিশ করা হয়েছে। এতে নবায়নের কোনো অবকাশ থাকবে না। আবেদনকারীকে এ সময়ের মধ্যেই মাঠপর্যায়ের পরীক্ষা সম্পন্ন করতে হবে চূড়ান্ত অনুমতি পাওয়ার জন্য। শেষোক্ত বিষয়টির গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ, মাঠপর্যায়ের পরীক্ষার সময়সীমার ওপর আবেদনকারীর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এটা নির্ধারিত গবেষণা সংস্থাই করবে। সুপারিশটি বাস্তবসম্মত নয়। এ বিধানকে অধিকতর বাস্তবসম্মত করার লক্ষ্যে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। এক, যদি নির্ধারিত গবেষণা সংস্থা এক বছরের মধ্যে মাঠপর্যায়ের পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারে তাহলে উদ্যোক্তার উৎপাদন ও বিপণনের অধিকার পরবর্তী এক বছর পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে। এ সময়ে সাব-কমিটি দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা যাতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয় তা নিশ্চিত করবে। আলোচ্য সমীক্ষার একটি উপস্থাপনা ২০০৯ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রায় ৭৬ জন কৃষি বিজ্ঞানীসহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞ উপস্থিত ছিলেন। সভার প্রধান অতিথি ছিলেন বর্তমান কৃষিমন্ত্রী। উপস্থিত ৭৬ জনের মধ্যে ২০ জন তাদের মতামত প্রদান করেন। প্রদত্ত মতামত চার ভাগে শ্রেণীভুক্ত করা হয়। এক, কেবলমাত্র বিজ্ঞানভিত্তিক মতামত যাতে নীতি ও পদ্ধতিগত জটিলতার উল্লেখ ছিল না। দুই, নীতি ও পদ্ধতিগত জটিলতা সম্পর্কে কোনো রকমের সংস্কারের বিপক্ষে। তিন, মিশ্র প্রতিক্রিয়া, কোনো বিষয়ে সুদৃঢ় অবস্থান নয়। চার, বিদ্যমান জটিলতা সহজীকরণের পক্ষে। মিশ্র প্রতিক্রিয়া যাঁরা ব্যক্ত করেন তাঁরাই ছিলেন সর্বাধিক, ৯ জন। বিপক্ষে ছিলেন চারজন। জটিলতা দূর করার পক্ষে পাঁচজন। উল্লেখ্য, নীতিনির্ধারকরা অর্থাৎ তৎকালীন কৃষিসচিব ও বর্তমান মন্ত্রী সহজীকরণের পক্ষে ছিলেন। তবে কৃষিসচিবের মত ছিল অনেকটা মধ্যমপন্থী। অর্থাৎ সহজীকরণ এবং একই সঙ্গে জৈব সার যাতে মানসম্পন্ন হয় তা নিশ্চিত করা। প্রস্তাবিত সুপারিশ প্রত্যাখ্যান না করে তিনি আশার বাণী শুনিয়েছিলেন। তাঁর মতে কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষিবিজ্ঞানীরা পরবর্তী পর্যায়ে এসব প্রস্তাব আবার আলোচনা করে একটি গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত প্রদান করবেন। এ কাজটি তাঁর সময়ে যেকোনো কারণেই হোক করা সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত এখনো ঝুলে আছে। বর্তমানে সম্পূর্ণ বিষয়টি আরো বস্তুনিষ্ঠভাবে পরীক্ষা করার জন্য আবার ক্যাটালিস্ট প্রকল্পের মাধ্যমে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আরো একটি সমীক্ষা বর্তমানে করা হচ্ছে। কাজটি করবে আন্তর্জাতিক সার গবেষণাকেন্দ্র। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের পর ২০১১ সালে যে সমীক্ষা হয় তার সুপারিশও ছিল নীতি ও পদ্ধতিগত জটিলতা দূরীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। এ সমীক্ষার ফলাফলও মূলত কৃষিবিজ্ঞানী পর্যায়েই বিবেচিত হয়। কিন্তু কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত হয়নি। মূল কারণ, ফলাফল বিবেচনা সভায় কোনো উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্র্ধারক উপস্থিত ছিলেন না। উল্লেখ্য, পূর্ববর্তী দুটি সমীক্ষায় কৃষক পর্যায়ের কোনো অভিমত গ্রহণ করা হয়নি। চলমান সমীক্ষায় এ বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে বলা যায়, সংস্কারের বিপক্ষে যাঁরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন তাঁদের যুক্তি মূলত দুটি। এক, ভেজাল বা নিম্নমানসম্পন্ন জৈব সার যেন বিপণন না করা হয়। দুই, জৈব সারে ব্যবহৃত কোনো উপাদানে যেন জমির জন্য ক্ষতিকর কোনো বস্তু না থাকে। বলা বাহুল্য, এ দুটি বিষয় পরীক্ষাগারে নমুনা বিশ্লেষণের মাধ্যমে নির্ণয় করা সম্ভব। এ বিষয়ে আরো উল্লেখ করা যায়, কোনো ভেজাল সার বিপণনের জন্য দায়ী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানকে প্রচলিত আইনের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে। এ বিষয়টিও এর সঙ্গে নিয়মিত কারখানা পরিদর্শন এবং নমুনা বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায়। এ ছাড়া প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াস, যা বর্তমানে করা হয় না।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক
উপদেষ্টা ও কলামিস্ট
No comments