হেনার মৃত্যু-ধর্ষিতকেই যখন দোররায় মরে যেতে হয় by কাবেরী গায়েন

এ কোন সমাজে বাস করছি আমরা? ধর্ষিতকেই যেখানে ফতোয়ার দোররায় মরে যেতে হয়? ১৪ বছরের মেয়ে ধর্ষিত হয়ে বিচার তো পায়ই নি, গ্রাম্য সালিসে তাকে দোররা মারার বিধান দেওয়া হলো ১০০টি। কারা দিলেন বিধান? ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, মসজিদের ইমাম আর মাদ্রাসার শিক্ষক। সবাই মান্যবর।


মান্যবরদের বিধান যতটা হিংস্র ছিল, সেই হিংস্রতা নেওয়ার মতো শারীরিক সক্ষমতা ছিল না ১৪ বছরের ধর্ষিত শিশুটির। মনে রাখা প্রয়োজন, জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ১৪ বছরের মেয়ে শিশু বৈকি! বিধান সম্পূর্ণ কার্যকর হওয়ার আগেই, ৭০ ঘা খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল মেয়েটি। জ্ঞান আর তার ফেরেনি। চিকিৎসার জন্য তাকে নড়িয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা তাকে বাঁচাতে পারেননি।
১৮ ডিসেম্বর ২০১০ রাজশাহীর তানোরে ভিক্ষুক ওমর আলী প্রামাণিকের স্ত্রী সুফিয়ার দোররায় মৃত্যু, ৩১ মে ২০১০ সিলেটের শ্রীমঙ্গল উপজেলার শাসন গ্রামের কমলা বেগমকে ১০১ দোররা, ২১ মে ২০১০ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তরুণীকে ১০১ দোররা মেরে গ্রামছাড়া করা, ১ অক্টোবর ২০০৯ ঢাকায় বাবা-চাচার ৫০০ দোররার শিকার আয়েশা, ১ সেপ্টেম্বর ২০০৯ দুপচাঁচিয়ায় গৃহবধূকে দোররা, পত্নীতলায় গ্রাম্য সালিসে ১০১ দোররা সাম্প্রতিক কালে ফতোয়া ও দোররা-তাণ্ডবের কয়েকটি উদাহরণ মাত্র।
অথচ ফতোয়ার বিধান আদালতে নিষিদ্ধ হয়েছে ২০০১ সালে। ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানি ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার হাইকোর্ট বেঞ্চ ফতোয়াকে অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করেন। রায়ে বলা হয়, একমাত্র আদালতই আইনসংক্রান্ত প্রশ্নে মতামত দিতে পারবেন। কেউ ফতোয়া দিলে তা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে। ওই রায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নয় বছর ধরে আটকে থাকলেও ৯ জুলাই ২০১০-এ বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন ও গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরকে নিয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ ফতোয়ার নামে বিচারবহির্ভূত কার্যক্রম এবং শাস্তি অবৈধ ঘোষণা করেন। দণ্ডবিধিসহ প্রচলিত অন্যান্য আইন অনুযায়ী ফতোয়াদানকারী ব্যক্তিই শুধু নন, তাঁদের সহযোগীদেরও শাস্তি বিধানের নির্দেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে ফতোয়া বন্ধে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। পৌরসভা ও ইউনিয়নে কোনো ফতোয়ার ঘটনা ঘটলে তা দ্রুত প্রশাসনকে জানানোর জন্য স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের বলা হয়েছে। ফতোয়ার ঘটনা অবহিত হওয়ার পরও যদি প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আদালতের এই স্পষ্ট রায় ও সরকারকে করণীয় সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট বিধান দেওয়া সত্ত্বেও কীভাবে এসব ফতোয়ার ঘটনা ঘটতে পারছে? ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যের উপস্থিতিতে গঠিত সালিসে কীভাবে দোররার বিধান দেওয়া সম্ভব হলো? তাই অপরাধের দায় শুধু মসজিদের ইমাম বা মাদ্রাসার শিক্ষকের ওপর ন্যস্ত করলেই হবে না। বাংলাদেশে শিক্ষকসমাজই যেখানে ক্ষমতাশালী নয়, সেখানে মাদ্রাসাশিক্ষক বা স্থানীয় ইমামের ক্ষমতা কতখানিই বা। প্রতিটি ফতোয়ার ঘটনার পেছনে রয়েছেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা, যেমন স্থানীয় সরকার সদস্য, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ কিংবা ধনী ব্যক্তি। আর প্রতিটি দোররার শিকার দরিদ্র নারী। শরীয়তপুরের ঘটনাটিও বিচ্ছিন্ন নয়। দিনমজুরকন্যা হেনাকে ফতোয়াদানকারী সাত সমাজপতির চারজনই ধর্ষক মাহবুবের আত্মীয়। (প্রথম আলো, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১০)। তবে তাঁরা ফতোয়াটি উচ্চারণ করান ধর্মীয় ব্যক্তিদের মুখ দিয়ে। ফলে দায়টি পড়ে আলেমদের ওপরই।
সরকার, বিশেষত স্থানীয় সরকার ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ফতোয়া বন্ধে ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারে না। দেশের হুজুর, ইমাম ও আলেম-সমাজ সরকারের যোগাযোগ কাঠামোর আওতায় রয়েছে। দেশে যে ফতোয়াবিরোধী রায় রয়েছে আদালতের, সেটি না মানা যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, এ তথ্য সরকার কতটুকু পৌঁছে দিতে পেরেছে ফতোয়াদানকারীদের কাছে? সাধারণ মানুষের কাছে? কতটুকু পর্যবেক্ষণ করেছে এসব আইন মানা হয় কি না! নির্যাতনে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত দোররা মারার ঘটনাকে অপরাধ মনে করেন না অনেকে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থারও টনক নড়ে কেবল মৃত্যু হলেই। সাধারণ মানুষ কিংবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সচেতনতা বাড়াতেই বা কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে? প্রশ্নগুলো অপরাধীদের অপরাধ লঘু করে দেখার জন্য নয় মোটেই, বরং একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছানোর জন্য সম্ভাব্য উপায়গুলো খতিয়ে দেখার আখ্যানভাগ তৈরির চেষ্টা মাত্র।
প্রথমত, ধর্ষক মামুনের বিচার করতে হবে। বাংলাদেশে ধর্ষণবিরোধী আইন রয়েছে। দ্বিতীয়ত, ফতোয়াদানকারী সালিসি বোর্ডকে এবং ফতোয়াদানকে পৃষ্ঠপোষকতাকারীদের হাইকোর্টের ফতোয়াবিরোধী রায় অমান্যের কারণে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। হাইকোর্টের রায়ের মধ্যেই বিধিব্যবস্থা লেখা আছে। তবে এসব শাস্তির পাশাপাশি জরুরি মনে হয় অন্য একটি প্রসঙ্গ। প্রথম আলোর (৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০) প্রতিবেদন অনুযায়ী, মামুনের স্ত্রীকেও মামুন বিয়ের আগে ধর্ষণ করেছিল বলে এলাকাবাসী তাদের বিয়ে দেন। মামুনকে বিচারের পাশাপাশি যে সংস্কৃতি ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষিতর বিয়ে নির্ধারণ করে, সেই সংস্কৃতিকে কীভাবে পাল্টানো যায়, আমার মূল মনোযোগ সেদিকে।
কোনো বিধানই নিজে কার্যকর হতে পারে না। শাস্তির বাইরেও কোনো নতুন বিধান বা মতাদর্শকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে কী করা যেতে পারে, সে বিষয়ে উন্নয়ন যোগাযোগবিদ এভারেট এম রজার্স একটি গুরুত্বপূর্ণ বই লিখে গেছেন, ডিফিউশন অব ইনোভেশন (১৯৮৫)। এই ধারায় পৃথিবীর হাজারো উন্নয়ন যোগাযোগবিদ কাজ করেছেন, করছেন। রজার্সের মতে, নতুন চিন্তাভাবনাকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হলে প্রথমে সেই বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হয় কেন, সে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা জানান দিয়ে। গণমাধ্যমের সম্ভাব্য সব পদ্ধতি ও প্রচলিত লোকজ মাধ্যম দিয়ে এই সচেতনতার কাজটি শুরু করা যেতে পারে। পরের স্তরে, সামাজিক সম্পর্ক নেটওয়ার্ক বিশ্লেষণের মাধ্যমে গ্রামের মোড়লদের চিহ্নিত করে তাঁদের এ বিষয়ে তথ্য ও ট্রেনিং দিয়ে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে, যাঁরা এ বিষয়ে গ্রামবাসীকে সচেতন করবেন। এ ক্ষেত্রে মাদ্রাসার শিক্ষক বা ইমামদেরই পরিবর্তনসহায়ক ব্যক্তি হিসেবে নিয়োগ করা যেতে পারে। এবং এ প্রসঙ্গে সফল উদাহরণ আমাদের দেশেই দেখেছি জনসংখ্যা পরিকল্পনার যোগাযোগ কৌশলে। গ্রামের ইমামদের শুক্রবার মসজিদে জুমার নামাজের পর জনসংখ্যা-বিষয়ক সচেতনতামূলক বক্তব্য দেওয়ার জন্য সবেতনে নিয়োগ করেছে সরকার। উদ্যোগটি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। কন্যাশিশু সম্পর্কে, নারী সম্পর্কে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্যও নিতে হবে ব্যাপক উদ্যোগ। এখানেও গণমাধ্যম, লোকমাধ্যম এবং মোড়লদের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। সাধারণ মানুষ এসব চিন্তাভাবনার সঙ্গে পরিচিত হলে, মনোভঙ্গিতে পরিবর্তন এলে, সেটি ধরে রাখতে হবে এবং অগ্রগামী করতে হবে। এসব ব্যবস্থাকে তদারক করবে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়। অগ্রগতি সাপেক্ষে পরবর্তী দিকনির্দেশনা দিতে হবে, সে জন্য চাই গবেষণা। কাজগুলো আসলেই কঠিন। জনগণের জন্য দৃঢ় রাজনৈতিক কমিটমেন্ট ছাড়া এসব কাজ করা সম্ভব নয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কমিটমেন্টও আদায় করতে হবে। কারণ, এসব সালিসের মূল উদ্যোক্তা প্রায়ই এলাকার প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। রয়েছে আরও দুরূহ কাজ। এসব ব্যবস্থা নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নারী-পুরুষের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানকে নিশ্চিত করতে না পারলে আংশিক সাফল্যেই খুশি থাকতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি সেসব দুরূহ কাজের দিকে মনোযোগী হতে পারব, নাকি সমাজের কোনো একটি অংশের ওপর দায় চাপিয়ে, তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করেই তৃপ্ত হব? প্রশ্নটি আসলে অন্য একটি সম্পূরক প্রশ্নের উত্তরের ওপরও বোধহয় নির্ভর করে। সেটি হলো, ঠিক কত মৃত্যু হলে যথেষ্ট হবে, ফতোয়া বন্ধের জন্য সরকার কিংবা আমাদের রাজনীতি এতটা দায়িত্ব নেবে? বা আমরা তাদের দায়িত্ব নিতে বাধ্য করতে পারব?
কাবেরী গায়েন: সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
kgayenbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.