ভারত বিভাগ এবং স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন by ডা. ফজল মোবারক

১৯৪৭ সালের প্রথম দিকে তদানীন্তন বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে বাংলার কয়েকজন প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতা সার্বভৌম বাংলার অভিন্ন দাবিতে মিলিত হন। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, তারা অবিভক্ত বা যুক্ত বাংলার এই দাবিটি গান্ধীর কাছে পেশ করবেন।

১৯৪৭ সালের ১১ মে শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখনকার বাংলা মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী এবং বাংলার মুসলীম লীগ সেক্রেটারি আবুল হাশেমকে সঙ্গে নিয়ে সার্বভৌম বাংলার প্রশ্ন নিয়ে আলোচনার জন্য মিঃ গান্ধীর কাছে যান। গান্ধীজি সোহরাওয়ার্দীকে বাংলার হিন্দুদের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত ব্যবহার এবং প্রশাসনের কার্যাবলীতে মুসলিম-পক্ষপাতিত্ব নিয়ে দোষারোপ করেন। সোহরাওয়ার্দী অভিযোগটি চ্যালেঞ্জ করেন। গান্ধী তখন সোহরাওয়ার্দীকে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা (রায়ট) ও খুন-খারাবির জন্য সরাসরি দায়ী করে কথা বলেন। তাতে করে সোহরাওয়ার্দী ক্ষুব্ধ হন এবং এসব গোলযোগের স্রষ্টা হিসেবে গান্ধীকেই দায়ী করেন। তিনি আহত মনে চলে আসেন।
ধৈর্য সহকারে মানসিক যন্ত্রণা দমন করে অবিভক্ত বাংলার হিন্দু-মুসলিমের সুখ-সমৃদ্ধির কথা চিন্তা করে পরের দিন ১২ মে তিনি আবার মিঃ গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন এবং সার্বভৌম বাংলা বাস্তবায়নের জন্য তার সহযোগিতা পাবার অনুরোধ জানান। গান্ধী বিষয়টি ভেবে দেখা ও বিবেচনার জন্য তাকে মৌখিক আশ্বাস দেন।
পরের দিন অর্থাত্ ১৩ মে ৪৭-এ হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি আসেন গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে। শ্যামাপ্রসাদ সার্বভৌম বাংলা ধারণাটির একগুঁয়ে বিরোধী ছিলেন। এর আগে ১৯ মার্চ ৪৭-এ তিনি সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দিয়ে ‘অবিভক্ত ভারতেও বঙ্গবিভক্তির দাবি’ জানিয়েছিলেন।
২৩ মে ৪৭-এ শরত্ বোস পাটনায় মিঃ গান্ধীকে রিপোর্ট করেন যে, গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তার বাসায় ‘সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ফজলুর রহমান, আবুল হাশেম, কিরণ শংকর রায়, আবদুল মালেক এবং সত্যরঞ্জন বকশী (সত্য বাবু) এবং আমি সম্মিলিতভাবে বিষয়টি আপনাকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং এ বিষয়ে আপনার সুবিবেচনা কামনা করছি।’
‘আজাদ হিন্দ’ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা বিখ্যাত স্বাধীনতা-সংগ্রামী নেতাজী সুভাষ বোসের অগ্রজ শরত্ বোস সার্বভৌম বাংলার দাবি সমর্থন করেন। মিঃ গান্ধী বাহ্যত এ প্রস্তাবে আগ্রহ দেখালেও ভেতরে ভেতরে ছিলেন এর ঘোর বিরোধী। ৯ জুন ৪৭-এ তার লেখা চিঠি থেকে জানা যায়—মিঃ জিন্নাহ সার্বভৌম বাংলা পরিকল্পনার বিরোধী ছিলেন না। জিন্নাহ ও শরত্ বোসের পত্র যোগাযোগের বিষয় জানতে পেরে গান্ধী তড়িঘড়ি করে এক অশুভ আঁতাতে মিলিত হন শ্যামাপ্রসাদ, প্যাটেল, নেহরু এবং আসামের মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলুইয়ের সঙ্গে; যাতে করে সোহরাওয়ার্দী উত্থাপিত এবং জিন্নাহ সমর্থিত পরিকল্পনাটি নস্যাত্ হয়। গান্ধীর মস্তিষ্কে জন্ম নিল এক অদ্ভুত প্রস্তাব; ‘সার্বভৌম বাংলার শাসন-ব্যবস্থা পরিচালিত হবে দুই-তৃতীয়াংশ হিন্দু সদস্যের সমর্থনে।’ কোনো সুস্থ বিবেকবান ব্যক্তিই এ ধরনের অবাস্তব সাম্প্রদায়িক ও উদ্ভট দাবি মানতে পারে না। এর পরেও মহাত্মা গান্ধী জানালেন—শ্যামা-প্যাটেল-নেহরু এ প্রস্তাবের ঘোর বিরোধী। ইতোপূর্বে ১৯ মার্চ ৪৭-এ শ্যামাপ্রাসাদ মুখার্জি তো ঘোষণাই দিয়েছেন—‘ভারত ভাগ না হলেও বাংলা অবশ্যই ভাগ হবে।’ কংগ্রেস নেতাদের এ কপটতার প্রতিবাদে শরত্ বোস কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন।
উল্লেখ্য, ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের পূর্ববাংলার অনুন্নত অঞ্চলের জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতির আংশিক পালন হিসেবে যখন বাংলা বিভক্ত হয়েছিল তখন সব বর্ণ ও মতের হিন্দু নেতৃবর্গ কালবিলম্ব না করে ‘বঙ্গভঙ্গ রদ’ আন্দোলনে মাঠে নেমে পড়েন। তাদের সম্মিলিত আক্রমণের লক্ষ্যে বিব্রত হন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির মতো উদারনৈতিক ব্যক্তিত্বও। আন্দোলনের জাতীয় সঙ্গীত ছিল—বঙ্কিম চাটুজ্যের ‘বন্দে মাতরম’ সাম্প্রদায়িক গানটি যেটি কংগ্রেসের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হওয়ার প্রাক্কালে রবীন্দ্রনাথের উদারতায় বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। মুসলমানরা দেখতে পেলেন এতকাল ধরে কলকাতার পশ্চাত্ভূমি (মাল যোগানোর ভূমি) হিসেবে ব্যবহৃত পূর্ববাংলার উন্নয়নের প্রথম পদক্ষেপ!
কয়েক বছরের মারমুখো হিন্দু নেতাদের চাপে ব্রিটিশ শাসকেরা ‘বঙ্গভঙ্গ রদ’ করে দিল এবং অনিশ্চিত হয়ে গেল একটি নিশ্চিত সত্য। ব্রিটিশের দেয়া মিথ্যা প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থা হারাল বাংলার মুসলমান। ফাটল ধরল হিন্দু-মুসলমান ঐক্যে। এই সঙ্কটময় সন্ধিক্ষণে মওলানা মোহাম্মদ আলীর পত্রিকা ‘কমরেড’-এ ৬ এপ্রিল ১২ সংখ্যায় তিনি এক জোর প্রবন্ধে উপদেশ দিলেন মুসলমানদের—
‘মুসলমানদের বলব—যা হয়ে গেছে যেতে দিন। শ্লেট থেকে পুরনো হিসেব মুছে ফেলুন আর তাতে লিখুন সম্পূর্ণ এক নতুন হিসেব। নির্ভর করুন, যাতে আপনাদেরও বিশ্বাস করা যেতে পারে। আজ প্রভাত হয়েছে এক নতুন যুগের। পুরনো যুগের তা কি উন্নততর হতে হবে অথবা নিকৃষ্টতর?’
হিন্দুদেরকে—
‘বাংলার হিন্দুদের কাছে সততা নিয়ে আমরা বলব—আপনাদের এত বেশি আছে যার অভাব রয়েছে মুসলমানদের। বাংলার জন্য আপনাদের এতসব জিনিস পেতে হবে যার জন্য প্রয়োজন প্রত্যেক সম্প্রদায় ও সব শ্রেণীর সহায়তা। মহানুভব হওয়া কি এতই অবিচক্ষণতা, পরার্থপর হওয়া কি এতই অসম্ভব?’
এ কথাগুলো এলো যেন এক ফেরেশতার মুখ থেকে। মহান মওলানার উপদেশ উভয় সম্প্রদায়ের শান্তি ও মৈত্রীতে বসবাস করার জন্য এক উপশমি মলমের মতো কাজ করল।
একই কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী দ্বারা কেন ১৯০৫ সালে বাংলা বিভক্তি বন্ধ হলো এবং ১৯৪৭ সালে তা কার্যকর হলো তার কার্যকারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়—তা হলো ১৯৩৫ সালের পূর্ব পর্যন্ত বাংলা শাসিত হতো হিন্দু সামন্তবাদী অভিজাত শ্রেণী দ্বারা, পূর্ববাংলায় ছিল তাদের জমিজমা ও জমিদারি। বাংলার রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা পরিচালিত হতো তাদের দ্বারা তাদের স্বার্থে। কাজেই বাংলাকে অবিভক্ত রাখতে পারলে অনাগত বহু বছর ধরে তারা শোষণ করতে পারবে পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত কৃষক প্রজা সাধারণকে। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন প্রবর্তনের পর রাজনৈতিক ক্ষমতার হাত বদল হয়ে চলে যায় হিন্দু জমিদার মহাজনদের কাছ থেকে মুসলমান মধ্যবিত্তের হাতে, যাদের অধিকাংশই পূর্ববাংলা থেকে আগত। ১৯৩৭ সালে গঠিত হয় ফজলুল হক মন্ত্রিসভা। একশ্রেণীর হাত থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা অন্য হাতে চলে যাওয়ায় তার সামনে খুলে যায় সুযোগ-সুবিধার অবারিত দরজা। পশ্চাত্পদ অঞ্চলে আসে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি।
১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল অবধি পূর্ববাংলার পশ্চাত্পদ অঞ্চলের কৃষিজীবী সমাজে ঘটে সৌভাগ্যের সূর্যোদয়। তাদের এতদিনের রক্ত ও ঘাম ঝরানো অর্থে গড়ে ওঠা কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের প্রাসাদ প্রকোষ্ঠে লক্ষিত হলো ভাঙনের চিড়। বাংলার শষ্য ভাণ্ডারের একচেটিয়া অধিকার ও আধিপত্য হারানোর ভয়ে তারা ভেঙে ফেলতে চাইল যুক্তবাংলার সুদৃঢ় দুর্গ। রাজনীতি ও অর্থনীতির অন্ধ অংশীদারিত্বের দাবিদারেরা পূর্ববাংলাকে এতদিনে গড়ে ওঠা কলকাতা নগরীর সুবিধাবঞ্চিত করার মানসে তারা খণ্ডিত করল ‘বাংলা মায়ের’ দু’বাহু দু’স্তন—সোনার শরীর। আর আমরা পূর্ববাংলার মেঠো মানুষেরা বঞ্চিত হলাম কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষা-সংস্কৃতি থেকে। পরিণত হলাম অশুভ ষড়যন্ত্রের অসহায় শিকারে। তাদের অঘোষিত সিদ্ধান্ত : বাংলাকে শাসন করতে শুরু করেছে পূর্ববাংলার ম্লেচ্ছ মানুষেরা। সুতরাং নস্যাত্ করতে হবে সার্বভৌম বাংলার সুখ স্বপ্নকে। যাতে করে সারা বাংলাকে শাসন করতে না পারে পূর্ববাংলার মধ্যবিত্তের সন্তানেরা। তাদের প্রভাব থেকে বাঁচাতে হবে উচ্চবিত্ত হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গকে। নীরদচন্দ্র চৌধুরী তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘An Auto-biography of an unknown Indian’-এ স্মরণীয় মন্তব্য করেছেন—‘হিন্দু বাঙালিদের সেই একই শ্রেণীটি যারা লর্ড কার্জনের ‘বঙ্গভঙ্গের’ বিরোধিতা করেছিল তারা নিজেরাই এবার সম্পন্ন করল তাদের দ্বিতীয় বিভক্তি।’
দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত এবং পাকিস্তান ভাগ হলেও অবিভক্ত সার্বভৌম বাংলা স্বাধীন হলে পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে আমরা উপ-মহাদেশের একটি ভারসাম্যপূর্ণ স্বাধীন সার্বভৌম প্রকৃতপক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষা-সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, জাতিগত বিভেদ বৈষম্যে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারতাম। অভিন্ন নদী সমস্যা, আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশের সামুদ্রিক বন্দর সুবিধায় এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে অসম বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় এবং নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর ভাষা ও শিক্ষাক্ষেত্রে অশেষ উন্নতি লাভ হতো।
কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত স্বপ্নই থেকে গেল। এভাবেই বিলীন হয়ে গেল তার সার্বভৌম স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন।

No comments

Powered by Blogger.