মিসর-স্বৈরাচার পতনের লগ্ন by রবার্ট ফিস্ক
বুড়ো লোকটার বিদায় ঘনিয়ে এসেছে। গত শনিবার মিসরের ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) শীর্ষ নেতৃত্ব (হোসনি মোবারকের ছেলে গামালসহ) পদত্যাগ করেছেন। মোবারকের পতনের দাবিতে বিক্ষোভরত মানুষ এতে শান্ত হবে না। হত্যা-নির্যাতনের দায় নেতারা এড়াতে পারবেন না।
এনডিপি যে বিরাট ক্ষমতা-কাঠামোর প্রতিনিধিত্ব করে, তা আজ শুধুই একটি খোলস, প্রোপাগান্ডা পোস্টার—পেছনে তার কিছুই নেই।
দি অটাম অব দ্য প্যাট্রিয়ার্ক উপন্যাসে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকিতে থাকা এক স্বৈরাচারের আচরণ এবং সব বিরোধিতা অস্বীকার করার মানসিকতার ওপর আলোকপাত করেন। গৌরবময় সময়ে তিনি নিজেকে ‘জাতীয় বীর’ ভাবতেন। বিদ্রোহের সম্মুখীন হয়ে তাঁর ‘প্রজাহিতৈষী নিরঙ্কুশ শাসনের বিরুদ্ধে ব্যাখ্যাতীত’ বিদ্রোহের জন্য ‘বিদেশের হাত’ আর ‘গোপন এজেন্ডা’কে দায়ী করেন। বিদ্রোহে ইন্ধনদাতারা ‘আমাদের দেশের প্রতি ঘৃণা পোষণকারী বিদেশি শক্তির দ্বারা ব্যবহূত হচ্ছে’। সেই স্বৈরাচারের যা করা উচিত, শুধু সেই কাজটি না করে বাকি সব চেষ্টাই তিনি চালান। ভয়ানক বিপজ্জনক চরিত্র হয়ে ওঠেন। তারপর বিদ্রোহীরা তাকে যা করতে বলে, তা-ই করতে তিনি রাজি। অবশেষে তার প্রস্থান ঘটে।
ওই স্বৈরাচারের মতো মিসরের হোসনি মোবারকও চতুর্থ পর্যায় অর্থাৎ চূড়ান্ত বিদায়ের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছেন বলে মনে হচ্ছে। ৩০ বছর ধরে তিনি ছিলেন ‘জাতীয় বীর’—১৯৭৩ সালের যুদ্ধে অংশ নেন, ছিলেন মিসরীয় বিমানবাহিনীর প্রধান—গামাল আবদেল নাসের ও আনোয়ার সাদাতের স্বাভাবিক উত্তরসূরি। আর যখন তাঁর স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে, তাঁর পুলিশি রাষ্ট্র, নির্যাতন বাহিনী এবং দুর্নীতিতে নিমজ্জিত শাসনের বিরুদ্ধে দেশের জনগণের রোষ বাড়তে থাকল, তখন তিনি দেশের কাল্পনিক শত্রুদের (আল-কায়েদা, মুসলিম ব্রাদারহুড, আল-জাজিরা, সিএনএন, আমেরিকা) কালো ছায়াকে দায়ী করলেন। আমরা হয়তো তাঁর ভয়ানক বিপজ্জনক পর্যায়টি পার হয়ে এলাম।
আহত এই বিপজ্জনক স্বৈরাচারের হাতে অবশিষ্ট হাতিয়ার হলো দাঙ্গাবিরোধী পুলিশ (১০ দিন আগে কায়রোর রাজপথ থেকে এদের বিতাড়িত করেছিল বিক্ষোভকারীরা) আর ভাড়াটে নেশাখোরের দল। এসব পান্ডা সরাসরি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে কাজ করে। এরাই এখন রাতের বেলা তাহরির ময়দানে গুলি চালায়। শুক্রবার রাতে এদের গুলিতে মারা গেছেন তিনজন আর আহত ৪০। গত সপ্তাহে ক্রিশ্চিয়ান আমানপোরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মোবারক কান্নাভেজা কণ্ঠে দাবি করলেন, তিনি প্রেসিডেন্ট থাকতে চান না, কিন্তু মিসরকে ‘বিশৃঙ্খলার’ হাত থেকে বাঁচাতে তাঁকে আরও সাত মাস ক্ষমতায় থাকতে হবে। মোবারকের এ কথায়ই তাঁর চতুর্থ পর্যায় চলার প্রথম ইঙ্গিত মেলে।
প্রখ্যাত মিসরীয় লেখক আলা আল-আশবানি বিপ্লবকে রোমান্টিসাইজ করতে ভালোবাসেন। বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার আগে সকালবেলা সাহিত্যের আসর জমানোর অভ্যাস ছিল তাঁর। গত সপ্তাহে তিনি বলেন, বিপ্লব মানুষকে আরও সম্মানিত করে—ঠিক যেমন প্রেমে পড়লে মানুষের মর্যাদা বেড়ে যায়। আমি তাঁকে বললাম, প্রেমে পড়ে বহু মানুষ প্রতিদ্বন্দ্বীকে নির্মূল করতে অপরিমেয় সময় পার করে দেয়। আরও বললাম, এমন কোনো বিপ্লব তো আমি দেখিনি, যেখানে এমন ঘটেনি। জবাবে তিনি বললেন, মোহাম্মদ আলী পাশার সময় থেকেই মিসরীয় সমাজ ছিল উদার, আর আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মিসরেই প্রথম দলীয় রাজনীতির প্রচলন ঘটে (উনিশ শতকে)। জোরালো প্রত্যয় ছিল তাঁর কথায়।
রোববারই কিংবা সপ্তাহ শেষে যেদিনই মোবারকের বিদায় ঘটুক না কেন, মিসরীয়দের তর্কের বিষয় হয়ে থাকবে এই নিম্নমানের স্বৈরাচারের হাত থেকে রেহাই পেতে কেন এত সময় লাগল, সে প্রশ্ন। সমস্যা হলো, স্বৈরাচারদের অধীনে মিসরের দুই প্রজন্ম সাবালক হওয়ার সুযোগবঞ্চিত থেকে গেছে। কেননা শুরুতেই স্বৈরাচারকে দেশের জনগণকে ‘নাবালেগ’ বানিয়ে দিতে হয়, যাদের রাজনৈতিক বয়স ছয় বছরের বেশি হয় না; হেডমাস্টারসুলভ মোড়লিপনার অনুগত করে গড়ে নিতে হয়। তাদের সামনে হাজির করা হয় সংবাদপত্রের নামে আবর্জনা, জালিয়াতির নির্বাচন, নামেমাত্র মন্ত্রী আর অজস্র মিথ্যা আশ্বাস। যারা সব মেনে নেয়, তারা এমনকি নামমাত্র মন্ত্রীও হয়ে যেতে পারে। আর না মানলে স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে বেধড়ক পিটুনি কিংবা তোরা জেলখানায় বন্দিত্ব জুটতে পারে কিংবা সহিংস অবস্থানে অনড় থাকলে ফাঁসিতেও ঝুলতে হতে পারে।
বশীভূত থাকা মিসরবাসীকে তারুণ্য ও প্রযুক্তির শক্তি যখন বালেগ হয়ে উঠতে এবং অনিবার্য বিদ্রোহে বাধ্য করল, তখন এত দিনের ‘নাবালেগ’ মানুষদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল, সরকার নিজেই নাবালেগদের দ্বারা গঠিত, আর সরকারের সবচেয়ে বয়সী শিশুটি ৮৩ বছরের। রাজনৈতিক আস্রবণের ভয়ংকর প্রক্রিয়ায় ৩০ বছর ধরে স্বৈরাচার তাঁর পশ্চিমা ‘বালেগ’ মিত্রদেরও নাবালেগ করে রেখেছে। মিসর ও বাকি আরব দুনিয়ায় ইসলামপন্থী ঢেউ ঠেকানোর একমাত্র লৌহকঠিন দেয়াল হয়ে আছেন মোবারক—এমন ভাষ্য পশ্চিম গিলছে। মুসলিম ব্রাদারহুডের ঐতিহাসিক ভিত্তিমূল মিসরেই প্রোথিত। স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে যাওয়ার সব অধিকার সংগঠনটির আছে। তবু সব সংবাদ পরিবেশকের মুখে মুখে মুসলিম ব্রাদারহুডের জুজু।
এখন অবশ্য নাবালেগ বানানোর প্রক্রিয়াটি আরও বিস্তৃত হয়েছে। লর্ড ব্লেয়ার অব ইসফাহান সিএনএনে হাজির হলেন পরশু রাতে। সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে মোবারক তুলনীয় কি না, জানতে চাইলে অতিশয় ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বললেন, একদম নয়। যে দেশের জীবনযাত্রার মান বেলজিয়ামের চেয়ে ভালো ছিল, সে দেশটির হীন দশার জন্য সাদ্দাম দায়ী। অন্যদিকে মোবারক ১০ বছরে মিসরের প্রবৃদ্ধি ৫০ শতাংশ বাড়িয়েছেন। ব্লেয়ার বলতে পারতেন, হাজার হাজার দেশবাসীকে হত্যা করেছেন সাদ্দাম, আর মোবারক মাত্র কয়েক হাজার দেশবাসীকে হত্যা, ফাঁসি, নির্যাতনের জন্য দায়ী। কিন্তু ব্লেয়ারের পোশাকে রক্তের ছোপ প্রায় সাদ্দামের মতোই। সুতরাং, স্বৈরাচারদের এখন থেকে অর্থনৈতিক রেকর্ড দিয়েই বিচার করতে হবে মনে হচ্ছে। আরেক প্রস্থ আগুয়ান ওবামা। শনিবার সকালে তিনি বললেন, ‘মোবারক একজন মর্যাদাবান মানুষ, একজন মহান দেশপ্রেমিক।’
অসাধারণ! এসব দাবি করতে গেলে বিশ্বাস করতে হয়, গত ৩০ বছরে মিসরের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পুলিশের বর্বরতার বিপুল সাক্ষ্য-প্রমাণ, গত ১৩ বছরে বিক্ষোভকারীদের প্রতি ভয়ানক আচরণ এবং নির্যাতনের কথা স্বৈরাচারের অজানা ছিল। বিশ্বাস করতে হয়, এই বুড়ো বয়সে মোবারক হয়তো দুর্নীতি এবং কিছু কিছু ‘বাড়াবাড়ি’র কথা জানতেন, কিন্তু নিয়মতান্ত্রিকভাবে মানবাধিকার দলন, আর প্রতিটি নির্বাচন নিয়ে মিথ্যাচারের ব্যাপারে অবগত ছিলেন না।
রাশিয়ায় পুরোনো একটি রূপকথা আছে। সেখানে জার এক মহান পিতৃতুল্য, শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ও দক্ষ নেতা। তাঁর অধীন রাজন্যবর্গ কী করে, তা-ই শুধু তিনি জানেন না। প্রজাদের প্রতি কতটা খারাপ আচরণ করা হচ্ছে, সে খবর জার মহাশয়ের কানে পৌঁছায় না। কেউ যদি একবার তাঁকে সে কথা বলত, তাহলেই সব অন্যায়-অবিচার বন্ধ করে দিতেন। যথারীতি তাঁর সব ভৃত্য এসব বিষয়ে মুখ বুজে থাকল। কিন্তু মোবারক তো তাঁর শাসনামলে ঘটা অন্যায়ের কথা জানতেন না, এমন নয়। দমন-পীড়ন, হুমকি-ধমকি আর জালিয়াতির নির্বাচনের মাধ্যমেই তিনি টিকে ছিলেন। সব সময় তা-ই করেছেন। সাদাতের মতো। নাসেরের মতো। ৩০ বছরের অধিককাল একের পর এক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মোবারককে বলেছেন, তাঁর নামে কী জঘন্য নির্যাতন চালানো হচ্ছে। এসব শুনে মাঝেমধ্যে মোবারক বিস্ময় প্রকাশ করতেন। একবার তিনি পুলিশি বর্বরতা বন্ধের অঙ্গীকার করেছিলেন, কিন্তু কোনো পরিবর্তন হয়নি। গুপ্ত পুলিশ বাহিনী যা করছিল, তার প্রতি এই জারের পূর্ণ অনুমোদন ছিল।
একইভাবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন যখন ঘোষণা দেন, মিসরের সহিংসতার পেছনে ‘যদি’ কর্তৃপক্ষই থেকে থাকে, তাহলে তা ‘একেবারেই অগ্রহণযোগ্য’। এখানে ‘যদি’ শব্দটির মধ্যে মিথ্যার বসবাস। ক্যামেরন যদি মোবারককে নিয়ে পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্রিফিং পড়ার তকলিফ না করে থাকেন, তবে তিনি ভালো করেই জানেন তৃতীয় শ্রেণীর স্বৈরাচার ওই লোকটা আসলে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতেই সহিংসতার আশ্রয় নিয়েছেন।
কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়া ও পোর্ট সাইদের বিক্ষোভকারীরা ভয়ানক আতঙ্কজনক সময়ে প্রবেশ করছে। তারা ভেবেছিল, জনতার কথা শুনে মোবারকের বিদায় নেওয়ার ইচ্ছা থাকলে শুক্রবারই চলে যেতেন। শুক্রবার তাদের ‘স্বৈরাচার বিদায়ের দিন’, ‘মোহমুক্তির দিন’-এ পর্যবসিত হয়েছে। তারা এখন অর্থনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, ‘সৎ’ রাজনীতিকদের নিয়ে একটি কমিটি তৈরি করছে, যারা ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সুলেইমানের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেবেন। তারা হয়তো আপাতত উপলব্ধি করতে পারছে না আমেরিকানদের কাছে গ্রহণযোগ্য পরবর্তী নিরাপদ ব্যক্তিটি এই সুলেইমান। মোবারকের মতো সুলেইমানও প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করতে সেই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পুলিশকেই ব্যবহার নির্দয়ভাবে করবেন।
সফল বিপ্লবের পরপরই আসে বিশ্বাসঘাতকতা। সেই পথ এখনো বহুদূর। এখনো আঁধার কাটেনি। গণতন্ত্রকামী অনেকে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে দেখেছেন। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার কয়েক মাস আগে কপটিক খ্রিষ্টানদের ওপর একনাগাড়ে কয়েক দফা হামলা হয়। মিসরের ১০ শতাংশ খ্রিষ্টানের নিরাপত্তা দেওয়ার আহ্বান জানান পোপ। পশ্চিমারা মর্মাহত হয়। তখন মোবারক চেনাজানা সেই ‘বিদেশি হাত’-এর ওপর দায় চাপান। কিন্তু ২৫ জানুয়ারি বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর কপটিক খ্রিষ্টানদের কারও কোনো কেশও ছিঁড়েনি কেউ। যারা এসব গর্হিত ঘটনা ঘটায়, তারাই কি এখন আরও সহিংস ঘটনা ঘটাতে ব্যস্ত?
মোবারকের বিদায়ের পরপরই ভয়ানক সব সত্য বেরিয়ে আসবে। সবাই বলছে, দুনিয়া সে পথের পানে চেয়ে। কিন্তু তাহরির ময়দানের সেই সব নারী-পুরুষদের মতো এতটা মনোযোগসহকারে, এতটা সাহস নিয়ে নিঃশঙ্কচিত্তে কে আছে অপেক্ষায়? সত্যিই যদি তারা বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়ে থাকে, তাহলে তারা নিরাপদ। আর যদি তা না হয়, মাঝরাতে বহু দরজায় কড়া নেড়ে উঠবে।
ব্রিটেনের দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক।
দি অটাম অব দ্য প্যাট্রিয়ার্ক উপন্যাসে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকিতে থাকা এক স্বৈরাচারের আচরণ এবং সব বিরোধিতা অস্বীকার করার মানসিকতার ওপর আলোকপাত করেন। গৌরবময় সময়ে তিনি নিজেকে ‘জাতীয় বীর’ ভাবতেন। বিদ্রোহের সম্মুখীন হয়ে তাঁর ‘প্রজাহিতৈষী নিরঙ্কুশ শাসনের বিরুদ্ধে ব্যাখ্যাতীত’ বিদ্রোহের জন্য ‘বিদেশের হাত’ আর ‘গোপন এজেন্ডা’কে দায়ী করেন। বিদ্রোহে ইন্ধনদাতারা ‘আমাদের দেশের প্রতি ঘৃণা পোষণকারী বিদেশি শক্তির দ্বারা ব্যবহূত হচ্ছে’। সেই স্বৈরাচারের যা করা উচিত, শুধু সেই কাজটি না করে বাকি সব চেষ্টাই তিনি চালান। ভয়ানক বিপজ্জনক চরিত্র হয়ে ওঠেন। তারপর বিদ্রোহীরা তাকে যা করতে বলে, তা-ই করতে তিনি রাজি। অবশেষে তার প্রস্থান ঘটে।
ওই স্বৈরাচারের মতো মিসরের হোসনি মোবারকও চতুর্থ পর্যায় অর্থাৎ চূড়ান্ত বিদায়ের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছেন বলে মনে হচ্ছে। ৩০ বছর ধরে তিনি ছিলেন ‘জাতীয় বীর’—১৯৭৩ সালের যুদ্ধে অংশ নেন, ছিলেন মিসরীয় বিমানবাহিনীর প্রধান—গামাল আবদেল নাসের ও আনোয়ার সাদাতের স্বাভাবিক উত্তরসূরি। আর যখন তাঁর স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে, তাঁর পুলিশি রাষ্ট্র, নির্যাতন বাহিনী এবং দুর্নীতিতে নিমজ্জিত শাসনের বিরুদ্ধে দেশের জনগণের রোষ বাড়তে থাকল, তখন তিনি দেশের কাল্পনিক শত্রুদের (আল-কায়েদা, মুসলিম ব্রাদারহুড, আল-জাজিরা, সিএনএন, আমেরিকা) কালো ছায়াকে দায়ী করলেন। আমরা হয়তো তাঁর ভয়ানক বিপজ্জনক পর্যায়টি পার হয়ে এলাম।
আহত এই বিপজ্জনক স্বৈরাচারের হাতে অবশিষ্ট হাতিয়ার হলো দাঙ্গাবিরোধী পুলিশ (১০ দিন আগে কায়রোর রাজপথ থেকে এদের বিতাড়িত করেছিল বিক্ষোভকারীরা) আর ভাড়াটে নেশাখোরের দল। এসব পান্ডা সরাসরি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে কাজ করে। এরাই এখন রাতের বেলা তাহরির ময়দানে গুলি চালায়। শুক্রবার রাতে এদের গুলিতে মারা গেছেন তিনজন আর আহত ৪০। গত সপ্তাহে ক্রিশ্চিয়ান আমানপোরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মোবারক কান্নাভেজা কণ্ঠে দাবি করলেন, তিনি প্রেসিডেন্ট থাকতে চান না, কিন্তু মিসরকে ‘বিশৃঙ্খলার’ হাত থেকে বাঁচাতে তাঁকে আরও সাত মাস ক্ষমতায় থাকতে হবে। মোবারকের এ কথায়ই তাঁর চতুর্থ পর্যায় চলার প্রথম ইঙ্গিত মেলে।
প্রখ্যাত মিসরীয় লেখক আলা আল-আশবানি বিপ্লবকে রোমান্টিসাইজ করতে ভালোবাসেন। বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার আগে সকালবেলা সাহিত্যের আসর জমানোর অভ্যাস ছিল তাঁর। গত সপ্তাহে তিনি বলেন, বিপ্লব মানুষকে আরও সম্মানিত করে—ঠিক যেমন প্রেমে পড়লে মানুষের মর্যাদা বেড়ে যায়। আমি তাঁকে বললাম, প্রেমে পড়ে বহু মানুষ প্রতিদ্বন্দ্বীকে নির্মূল করতে অপরিমেয় সময় পার করে দেয়। আরও বললাম, এমন কোনো বিপ্লব তো আমি দেখিনি, যেখানে এমন ঘটেনি। জবাবে তিনি বললেন, মোহাম্মদ আলী পাশার সময় থেকেই মিসরীয় সমাজ ছিল উদার, আর আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মিসরেই প্রথম দলীয় রাজনীতির প্রচলন ঘটে (উনিশ শতকে)। জোরালো প্রত্যয় ছিল তাঁর কথায়।
রোববারই কিংবা সপ্তাহ শেষে যেদিনই মোবারকের বিদায় ঘটুক না কেন, মিসরীয়দের তর্কের বিষয় হয়ে থাকবে এই নিম্নমানের স্বৈরাচারের হাত থেকে রেহাই পেতে কেন এত সময় লাগল, সে প্রশ্ন। সমস্যা হলো, স্বৈরাচারদের অধীনে মিসরের দুই প্রজন্ম সাবালক হওয়ার সুযোগবঞ্চিত থেকে গেছে। কেননা শুরুতেই স্বৈরাচারকে দেশের জনগণকে ‘নাবালেগ’ বানিয়ে দিতে হয়, যাদের রাজনৈতিক বয়স ছয় বছরের বেশি হয় না; হেডমাস্টারসুলভ মোড়লিপনার অনুগত করে গড়ে নিতে হয়। তাদের সামনে হাজির করা হয় সংবাদপত্রের নামে আবর্জনা, জালিয়াতির নির্বাচন, নামেমাত্র মন্ত্রী আর অজস্র মিথ্যা আশ্বাস। যারা সব মেনে নেয়, তারা এমনকি নামমাত্র মন্ত্রীও হয়ে যেতে পারে। আর না মানলে স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে বেধড়ক পিটুনি কিংবা তোরা জেলখানায় বন্দিত্ব জুটতে পারে কিংবা সহিংস অবস্থানে অনড় থাকলে ফাঁসিতেও ঝুলতে হতে পারে।
বশীভূত থাকা মিসরবাসীকে তারুণ্য ও প্রযুক্তির শক্তি যখন বালেগ হয়ে উঠতে এবং অনিবার্য বিদ্রোহে বাধ্য করল, তখন এত দিনের ‘নাবালেগ’ মানুষদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল, সরকার নিজেই নাবালেগদের দ্বারা গঠিত, আর সরকারের সবচেয়ে বয়সী শিশুটি ৮৩ বছরের। রাজনৈতিক আস্রবণের ভয়ংকর প্রক্রিয়ায় ৩০ বছর ধরে স্বৈরাচার তাঁর পশ্চিমা ‘বালেগ’ মিত্রদেরও নাবালেগ করে রেখেছে। মিসর ও বাকি আরব দুনিয়ায় ইসলামপন্থী ঢেউ ঠেকানোর একমাত্র লৌহকঠিন দেয়াল হয়ে আছেন মোবারক—এমন ভাষ্য পশ্চিম গিলছে। মুসলিম ব্রাদারহুডের ঐতিহাসিক ভিত্তিমূল মিসরেই প্রোথিত। স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে যাওয়ার সব অধিকার সংগঠনটির আছে। তবু সব সংবাদ পরিবেশকের মুখে মুখে মুসলিম ব্রাদারহুডের জুজু।
এখন অবশ্য নাবালেগ বানানোর প্রক্রিয়াটি আরও বিস্তৃত হয়েছে। লর্ড ব্লেয়ার অব ইসফাহান সিএনএনে হাজির হলেন পরশু রাতে। সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে মোবারক তুলনীয় কি না, জানতে চাইলে অতিশয় ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বললেন, একদম নয়। যে দেশের জীবনযাত্রার মান বেলজিয়ামের চেয়ে ভালো ছিল, সে দেশটির হীন দশার জন্য সাদ্দাম দায়ী। অন্যদিকে মোবারক ১০ বছরে মিসরের প্রবৃদ্ধি ৫০ শতাংশ বাড়িয়েছেন। ব্লেয়ার বলতে পারতেন, হাজার হাজার দেশবাসীকে হত্যা করেছেন সাদ্দাম, আর মোবারক মাত্র কয়েক হাজার দেশবাসীকে হত্যা, ফাঁসি, নির্যাতনের জন্য দায়ী। কিন্তু ব্লেয়ারের পোশাকে রক্তের ছোপ প্রায় সাদ্দামের মতোই। সুতরাং, স্বৈরাচারদের এখন থেকে অর্থনৈতিক রেকর্ড দিয়েই বিচার করতে হবে মনে হচ্ছে। আরেক প্রস্থ আগুয়ান ওবামা। শনিবার সকালে তিনি বললেন, ‘মোবারক একজন মর্যাদাবান মানুষ, একজন মহান দেশপ্রেমিক।’
অসাধারণ! এসব দাবি করতে গেলে বিশ্বাস করতে হয়, গত ৩০ বছরে মিসরের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পুলিশের বর্বরতার বিপুল সাক্ষ্য-প্রমাণ, গত ১৩ বছরে বিক্ষোভকারীদের প্রতি ভয়ানক আচরণ এবং নির্যাতনের কথা স্বৈরাচারের অজানা ছিল। বিশ্বাস করতে হয়, এই বুড়ো বয়সে মোবারক হয়তো দুর্নীতি এবং কিছু কিছু ‘বাড়াবাড়ি’র কথা জানতেন, কিন্তু নিয়মতান্ত্রিকভাবে মানবাধিকার দলন, আর প্রতিটি নির্বাচন নিয়ে মিথ্যাচারের ব্যাপারে অবগত ছিলেন না।
রাশিয়ায় পুরোনো একটি রূপকথা আছে। সেখানে জার এক মহান পিতৃতুল্য, শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ও দক্ষ নেতা। তাঁর অধীন রাজন্যবর্গ কী করে, তা-ই শুধু তিনি জানেন না। প্রজাদের প্রতি কতটা খারাপ আচরণ করা হচ্ছে, সে খবর জার মহাশয়ের কানে পৌঁছায় না। কেউ যদি একবার তাঁকে সে কথা বলত, তাহলেই সব অন্যায়-অবিচার বন্ধ করে দিতেন। যথারীতি তাঁর সব ভৃত্য এসব বিষয়ে মুখ বুজে থাকল। কিন্তু মোবারক তো তাঁর শাসনামলে ঘটা অন্যায়ের কথা জানতেন না, এমন নয়। দমন-পীড়ন, হুমকি-ধমকি আর জালিয়াতির নির্বাচনের মাধ্যমেই তিনি টিকে ছিলেন। সব সময় তা-ই করেছেন। সাদাতের মতো। নাসেরের মতো। ৩০ বছরের অধিককাল একের পর এক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মোবারককে বলেছেন, তাঁর নামে কী জঘন্য নির্যাতন চালানো হচ্ছে। এসব শুনে মাঝেমধ্যে মোবারক বিস্ময় প্রকাশ করতেন। একবার তিনি পুলিশি বর্বরতা বন্ধের অঙ্গীকার করেছিলেন, কিন্তু কোনো পরিবর্তন হয়নি। গুপ্ত পুলিশ বাহিনী যা করছিল, তার প্রতি এই জারের পূর্ণ অনুমোদন ছিল।
একইভাবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন যখন ঘোষণা দেন, মিসরের সহিংসতার পেছনে ‘যদি’ কর্তৃপক্ষই থেকে থাকে, তাহলে তা ‘একেবারেই অগ্রহণযোগ্য’। এখানে ‘যদি’ শব্দটির মধ্যে মিথ্যার বসবাস। ক্যামেরন যদি মোবারককে নিয়ে পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্রিফিং পড়ার তকলিফ না করে থাকেন, তবে তিনি ভালো করেই জানেন তৃতীয় শ্রেণীর স্বৈরাচার ওই লোকটা আসলে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতেই সহিংসতার আশ্রয় নিয়েছেন।
কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়া ও পোর্ট সাইদের বিক্ষোভকারীরা ভয়ানক আতঙ্কজনক সময়ে প্রবেশ করছে। তারা ভেবেছিল, জনতার কথা শুনে মোবারকের বিদায় নেওয়ার ইচ্ছা থাকলে শুক্রবারই চলে যেতেন। শুক্রবার তাদের ‘স্বৈরাচার বিদায়ের দিন’, ‘মোহমুক্তির দিন’-এ পর্যবসিত হয়েছে। তারা এখন অর্থনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, ‘সৎ’ রাজনীতিকদের নিয়ে একটি কমিটি তৈরি করছে, যারা ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সুলেইমানের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেবেন। তারা হয়তো আপাতত উপলব্ধি করতে পারছে না আমেরিকানদের কাছে গ্রহণযোগ্য পরবর্তী নিরাপদ ব্যক্তিটি এই সুলেইমান। মোবারকের মতো সুলেইমানও প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করতে সেই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পুলিশকেই ব্যবহার নির্দয়ভাবে করবেন।
সফল বিপ্লবের পরপরই আসে বিশ্বাসঘাতকতা। সেই পথ এখনো বহুদূর। এখনো আঁধার কাটেনি। গণতন্ত্রকামী অনেকে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে দেখেছেন। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার কয়েক মাস আগে কপটিক খ্রিষ্টানদের ওপর একনাগাড়ে কয়েক দফা হামলা হয়। মিসরের ১০ শতাংশ খ্রিষ্টানের নিরাপত্তা দেওয়ার আহ্বান জানান পোপ। পশ্চিমারা মর্মাহত হয়। তখন মোবারক চেনাজানা সেই ‘বিদেশি হাত’-এর ওপর দায় চাপান। কিন্তু ২৫ জানুয়ারি বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর কপটিক খ্রিষ্টানদের কারও কোনো কেশও ছিঁড়েনি কেউ। যারা এসব গর্হিত ঘটনা ঘটায়, তারাই কি এখন আরও সহিংস ঘটনা ঘটাতে ব্যস্ত?
মোবারকের বিদায়ের পরপরই ভয়ানক সব সত্য বেরিয়ে আসবে। সবাই বলছে, দুনিয়া সে পথের পানে চেয়ে। কিন্তু তাহরির ময়দানের সেই সব নারী-পুরুষদের মতো এতটা মনোযোগসহকারে, এতটা সাহস নিয়ে নিঃশঙ্কচিত্তে কে আছে অপেক্ষায়? সত্যিই যদি তারা বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়ে থাকে, তাহলে তারা নিরাপদ। আর যদি তা না হয়, মাঝরাতে বহু দরজায় কড়া নেড়ে উঠবে।
ব্রিটেনের দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক।
No comments