নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম-পুলিশ, কসবি ও হোটেলের জমা-খরচ by বিশ্বজিৎ চৌধুরী
কেঁচো খুঁড়তে গেলে সাপ বেরিয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকেই। কিন্তু তাই বলে কেঁচো খোঁড়া বন্ধ হয়ে যায় না। এ রকম সাপ বেরিয়ে পড়ার ঘটনাই ঘটল পুলিশি একটি অভিযানের সূত্রে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানার পুলিশ নগরের কয়েকটি হোটেলে অভিযান চালায়—এসব আবাসিক হোটেলে গোপনে দেহব্যবসা চলছে এ অভিযোগে।
এসব হোটেল থেকে কিছু যৌনকর্মী ও তাঁদের খদ্দের গ্রেপ্তার হওয়ার ফলে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। এ রকম অভিযান নতুন কিছু নয়, আগেও হয়েছে। বলা যায়, এটি পুলিশের প্রায় রুটিন-কাজের অংশ।
সবাই জানেন, এ ধরনের অভিযানের ফলে আসলে পতিতাবৃত্তি বন্ধ হবে না। জানেন যাঁরা আটক হয়েছেন তাঁরাও। দু-এক দিন জেলহাজতে কাটাবেন যৌনকর্মীরা, তারপর জরিমানা দিয়ে জামিনে বেরিয়ে আসবেন। আবার সেই একই দেহব্যবসায় জড়িয়ে পড়বেন সময়-সুযোগে। সব ব্যবসাতেই কিছু ঝক্কিঝামেলা থাকে, এই গ্রেপ্তার-প্রক্রিয়াও সে রকম ব্যবসায়িক ঝক্কিঝামেলার অংশ হিসেবেই ধরে নিয়েছেন এসব যৌনকর্মী।
পুলিশ যৌনকর্মী ও খদ্দেরদের আটক করার পাশাপাশি যেসব হোটেলে এসব তৎপরতা চলে, সেগুলোর কিছু কাগজপত্রও জব্দ করেছে। সেই কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে এমন তথ্য, যাকে তুলনা করেছিলাম সাপ বেরিয়ে আসার সঙ্গে। সন-তারিখসহ হোটেলের দৈনিক খরচের একটি হিসাবের খাতায় দেখা যাচ্ছে কর্মচারীর খরচ, দিনের বাজার ইত্যাদির পাশাপাশি টহল পুলিশ, উপপরিদর্শক বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দেওয়া অর্থের পরিমাণও লেখা আছে। এমনকি দেহব্যবসার অভিযোগে যে মেয়েদের আটক করা হয়েছে, সেই আঁখি, রোজি, রেশমা, সুমীদের (ছদ্মনাম) খরচের হিসাবেও পুলিশের জন্য বরাদ্দের উল্লেখ আছে। থানার কর্মকর্তার গাড়িচালকের হাতেও যে অর্থ তুলে দিতে হয়, সে তথ্যও আছে জমা-খরচের হিসাবের খাতায়।
বৈধ-অবৈধ প্রসঙ্গটি আপাতত তোলা থাক, কপটতা কোন পর্যায়ে পৌঁছালে যাঁদের কাছ থেকে নিয়মিত বখরা আদায় করা হয় তাঁদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালানো যেতে পারে, তা ভেবে দেখতে বলি সংশ্লিষ্ট সবাইকে।
এ কথা তো ঠিক, ক্ষুধা-দারিদ্র্য কিংবা প্রতারণা-বঞ্চনার মতো নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি না হলে দেহব্যবসার মতো গ্লানিকর পেশায় যেতে চায় না কোনো নারীই। আমাদের সমাজের অদ্ভুত কপটতা এই—না এ পেশার কোনো বৈধতা আছে, না একে উৎপাটন করা গেছে। অনেকটা চোর-পুলিশ খেলার মতো। যৌনকর্মীরা আজ খদ্দেরের মনোরঞ্জন করছেন, পুলিশ বা দালালের হাতে তুলে দিচ্ছেন উপার্জিত অর্থের অংশ, কালই তাঁদের দলবেঁধে চালান দেওয়া হচ্ছে জেলহাজতে।
শুনতে হয়তো ভালো লাগবে, চট্টগ্রাম শহরে কোনো পতিতালয় নেই। কিন্তু আশির দশকের প্রথম দিকে সদরঘাট এলাকার সাহেবপাড়া নামের পতিতাপাড়াটি ভেঙে দেওয়ার পর গণ্ডি ছাড়িয়ে এ পেশার বিস্তৃতি ঘটেছে প্রায় সারা শহরেই। ছোটখাটো আবাসিক হোটেল থেকে শুরু করে অভিজাত এলাকার অতিথিশালা পর্যন্ত এর বিস্তার। এমনকি নগরের নিউমার্কেট এলাকাসহ বড় বিপণিকেন্দ্রগুলোর আশপাশে সন্ধ্যা হলেই চটকদার সাজপোশাকে খদ্দের খুঁজতে থাকা যৌনকর্মীদের অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি ও আচরণ পথচারী নারী-শিশু-বৃদ্ধ সবার অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে। যাঁরা পতিতালয় ভেঙে দেওয়ার মহৎ আন্দোলনে নেমেছিলেন, তাঁরা অনুধাবন করতে পারছেন কি না জানি না, আন্দোলনের সুফল(!) আজ সাহেবপাড়া ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে পুরো চট্টগ্রামেই।
প্রথম আলোর বর্ষসেরা বইয়ের (দহনকাল) লেখক হিসেবে এ বছর পুরস্কার পাওয়া হরিশংকর জলদাস সম্প্রতি কসবি (এই আরবি শব্দের বাংলা অর্থ বেশ্যা) নামের একটি উপন্যাস লিখেছেন। এ উপন্যাসের পটভূমি গড়ে উঠেছে অধুনালুপ্ত সাহেবপাড়াকে নিয়ে। লেখক গবেষণা করে দেখেছেন, এই সাহেবপাড়া একসময় ছিল একটি জেলেপাড়া। ১৭৬১ সালে সদরঘাটের পুরোনো কাস্টমস হাউসের পাশে এ জেলেপাড়াটিই পর্যায়ক্রমে পতিতালয়ে পরিণত হয়। বন্দরনগরে বিদেশি জাহাজের আনাগোনার সূত্রে যেসব বিদেশি নাবিক আসতেন, তাঁদের অনেকেরই যাতায়াত ছিল এ পাড়ায়। সাদা চামড়ার বিদেশি পর্যটকদের ভিড় জমত বলেই এ এলাকার নাম হয়ে যায় সাহেবপাড়া। পতিতাপাড়া গড়ে ওঠার পেছনে যে গল্পটি প্রচলিত ছিল তাও উল্লেখ করেছেন হরিশংকর। জেলেপরিবারের একটি মেয়েকে ধর্ষণ করেছিলেন বিদেশি এক নাবিক (মতান্তরে মেয়েটিই প্রেমে পড়েছিল ওই নাবিকের)। জেলেসমাজ একঘরে করে মেয়েটিকে। জেলেসমাজের প্রথা অনুযায়ী মেয়েটিকে বলা হলো আগুন-জল-বন্দী, অর্থাৎ তার স্পর্শের জল যেমন অপবিত্র, তেমনি শ্মশানেও তার মৃতদেহ সৎকার নিষিদ্ধ। সমাজ-কুল হারিয়ে জেলেকন্যাটি শেষ পর্যন্ত পতিতাবৃত্তিই বেছে নিয়েছিলেন বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে। কালক্রমে অভাব-দারিদ্র্যের কারণে অনেক মেয়েই অনুসরণ করেছিলেন তাঁর পথ। এভাবেই গড়ে উঠেছিল সাহেবপাড়ার পতিতালয়।
মনে পড়ে, সাহেবপাড়া পতিতালয় তুলে দেওয়ার পক্ষে-বিপক্ষে যখন স্থানীয় পৌর কমিশনারের (বর্তমান ওয়ার্ড কাউন্সিলর) কার্যালয়ে সালিস-বিচার চলছিল, তখন সদরঘাটের বাসিন্দারা তাঁদের নানা দুর্ভোগের কথা তুলে ধরেছিলেন। মানসম্মান নিয়ে ওই এলাকায় বাস করা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে জানাতে গিয়ে বলেছিলেন, নিজেদের স্কুল-কলেজগামী ছেলেমেয়েদের নিয়মিত ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শিকার হতে হয়, তাদের বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা থাকে, এমনকি ওই এলাকায় বসবাসের কারণে মেয়ের বিয়ের সম্পর্ক পর্যন্ত ভেঙে যায় ইত্যাদি। এ বাস্তবতাও অস্বীকার করার উপায় নেই।
আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সুরাহা করা যায়নি। সাহেবপাড়ার যৌনকর্মীদের পুনর্বাসনের মতো সিদ্ধান্তও নিতে পারেনি কেউ। এসব ক্ষেত্রে যা হয়, অপেক্ষাকৃত দুর্বল অংশের ওপরই নেমে আসে খাঁড়া। অবশেষে পুলিশ প্রশাসনের (এরশাদ সরকার আমলে) মৌন সম্মতিতে একদল মানুষ অগ্নিসংযোগ করল সাহেবপাড়ার বস্তিতে। এক কাপড়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয় যৌনকর্মীদের।
শুরু করেছিলাম পুলিশের ভূমিকা নিয়ে। যৌনকর্মীদের কাছ থেকে নিয়মিত বখরা আদায় করে আবার তাদেরই গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা নিয়ে। তবে পুলিশের সব সদস্যেরই চরিত্র ও প্রবণতা এক রকমই, এ কথা বলতে চাই না আমরা। গত ৩১ জানুয়ারির প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘তিন পুলিশের দৃঢ়তা এবং এক প্রসূতি’। একটি চলন্ত বাসে প্রসবযন্ত্রণায় কাতর জনৈক করুণা বেগম তিন পুলিশের করুণায় কীভাবে পুত্রসন্তানের জন্ম দিল, তার মর্মছোঁয়া বিবরণ আছে এ সংবাদে। পুলিশের সেবার মনোবৃত্তি, সাহস ও ত্যাগের এ রকম বহু নজির আছে। গুটি কয়েকের লোভ ও চরিত্রহীনতার দায় এসে পড়ে পুরো বাহিনীর ওপর। আমাদের ধারণা, আসল গলদ আইন ও এর প্রয়োগ-পদ্ধতিতে। পুলিশও জানে, এ ব্যবসা বন্ধ করা অসম্ভব। ফলে এই আপাত অসম্ভব কাজটির জন্য অভিযান পরিচালনার মতো লোক দেখানো কাজে তাদের কাছ থেকে আন্তরিকতা বা একাগ্রতা আশা করা যায় না।
এ কথা তো ঠিক, পতিতাবৃত্তির মতো অবমাননাকর জীবিকা বন্ধ করতে পারলে তা হবে সমাজের জন্য যেমন স্বস্তিকর, তেমনি অসহায় মেয়েগুলোর জন্যও আশীর্বাদস্বরূপ। সাম্প্রতিক কালে দেশের কিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা যৌনকর্মীদের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা সৃষ্টির ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছে। এই মেয়েদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে তারা ভূমিকা রাখতে পারে কি না ভেবে দেখতে বলি। কিন্তু পুনর্বাসনের দুরূহ কাজটি যত দিন করা সম্ভব হচ্ছে না, তত দিন অন্তত একটি নির্দিষ্ট পরিসরে ও গণ্ডিতে একে সীমাবদ্ধ রাখতে পারলেই উপকৃত হবে সমাজ, নিয়মিত লাঞ্ছনা ও প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা পাবে যৌনকর্মীরা।
খ্যাতিমান লেখক শংকর তাঁর ‘বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকা’ নামের একটি গল্পে হিন্দু পুরাণের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছিলেন, বেশ্যাবাড়ির দরজার সামনের মাটি হচ্ছে সবচেয়ে পবিত্র। কারণ, পুরুষ এ বাড়িতে ঢোকার সময় দরজার বাইরে রেখে যায় তার সবটুকু মনুষ্যত্ব। আমরা চাই, এই ‘পবিত্র মাটি’ থাকুক শহর থেকে দূরে।
পৃথিবীর প্রায় সব বন্দরনগরই পতিতাবৃত্তির কেন্দ্র। চট্টগ্রামও বাঁধা পড়েছে সেই নিয়মের আবর্তে। শহরের জনবহুল এলাকা থেকে দূরে অন্যান্য বন্দরনগরের মতো একটি ‘রেডলাইট এরিয়া’ গড়ে তোলা যায় কি না ভেবে দেখতে বলি সংশ্লিষ্ট সবাইকে। তাহলে এই নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে শহরের কোথাও এ ধরনের কর্মকাণ্ড চললে কঠোর হাতে দমন করতে পারবে পুলিশ। অভিযান চালাতে পারবে নির্দ্বিধায়। নিয়মের ব্যত্যয় হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতার দিকে আঙুল তুলতে পারবে নাগরিক সমাজ। তা ছাড়া এতে যৌনকর্মীদের সম্পর্কে নির্দিষ্ট একটি পরিসংখ্যান প্রশাসনের কাছে থাকবে। তাদের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতার সৃষ্টি করে এইডসের মতো মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ রোগের বিস্তার রোধ সম্ভব হবে। সর্বোপরি দেহব্যবসার সঙ্গে মাদক-অস্ত্রসহ অবৈধ নানা ব্যবসার যে যোগাযোগ, তাও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com
সবাই জানেন, এ ধরনের অভিযানের ফলে আসলে পতিতাবৃত্তি বন্ধ হবে না। জানেন যাঁরা আটক হয়েছেন তাঁরাও। দু-এক দিন জেলহাজতে কাটাবেন যৌনকর্মীরা, তারপর জরিমানা দিয়ে জামিনে বেরিয়ে আসবেন। আবার সেই একই দেহব্যবসায় জড়িয়ে পড়বেন সময়-সুযোগে। সব ব্যবসাতেই কিছু ঝক্কিঝামেলা থাকে, এই গ্রেপ্তার-প্রক্রিয়াও সে রকম ব্যবসায়িক ঝক্কিঝামেলার অংশ হিসেবেই ধরে নিয়েছেন এসব যৌনকর্মী।
পুলিশ যৌনকর্মী ও খদ্দেরদের আটক করার পাশাপাশি যেসব হোটেলে এসব তৎপরতা চলে, সেগুলোর কিছু কাগজপত্রও জব্দ করেছে। সেই কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে এমন তথ্য, যাকে তুলনা করেছিলাম সাপ বেরিয়ে আসার সঙ্গে। সন-তারিখসহ হোটেলের দৈনিক খরচের একটি হিসাবের খাতায় দেখা যাচ্ছে কর্মচারীর খরচ, দিনের বাজার ইত্যাদির পাশাপাশি টহল পুলিশ, উপপরিদর্শক বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দেওয়া অর্থের পরিমাণও লেখা আছে। এমনকি দেহব্যবসার অভিযোগে যে মেয়েদের আটক করা হয়েছে, সেই আঁখি, রোজি, রেশমা, সুমীদের (ছদ্মনাম) খরচের হিসাবেও পুলিশের জন্য বরাদ্দের উল্লেখ আছে। থানার কর্মকর্তার গাড়িচালকের হাতেও যে অর্থ তুলে দিতে হয়, সে তথ্যও আছে জমা-খরচের হিসাবের খাতায়।
বৈধ-অবৈধ প্রসঙ্গটি আপাতত তোলা থাক, কপটতা কোন পর্যায়ে পৌঁছালে যাঁদের কাছ থেকে নিয়মিত বখরা আদায় করা হয় তাঁদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালানো যেতে পারে, তা ভেবে দেখতে বলি সংশ্লিষ্ট সবাইকে।
এ কথা তো ঠিক, ক্ষুধা-দারিদ্র্য কিংবা প্রতারণা-বঞ্চনার মতো নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি না হলে দেহব্যবসার মতো গ্লানিকর পেশায় যেতে চায় না কোনো নারীই। আমাদের সমাজের অদ্ভুত কপটতা এই—না এ পেশার কোনো বৈধতা আছে, না একে উৎপাটন করা গেছে। অনেকটা চোর-পুলিশ খেলার মতো। যৌনকর্মীরা আজ খদ্দেরের মনোরঞ্জন করছেন, পুলিশ বা দালালের হাতে তুলে দিচ্ছেন উপার্জিত অর্থের অংশ, কালই তাঁদের দলবেঁধে চালান দেওয়া হচ্ছে জেলহাজতে।
শুনতে হয়তো ভালো লাগবে, চট্টগ্রাম শহরে কোনো পতিতালয় নেই। কিন্তু আশির দশকের প্রথম দিকে সদরঘাট এলাকার সাহেবপাড়া নামের পতিতাপাড়াটি ভেঙে দেওয়ার পর গণ্ডি ছাড়িয়ে এ পেশার বিস্তৃতি ঘটেছে প্রায় সারা শহরেই। ছোটখাটো আবাসিক হোটেল থেকে শুরু করে অভিজাত এলাকার অতিথিশালা পর্যন্ত এর বিস্তার। এমনকি নগরের নিউমার্কেট এলাকাসহ বড় বিপণিকেন্দ্রগুলোর আশপাশে সন্ধ্যা হলেই চটকদার সাজপোশাকে খদ্দের খুঁজতে থাকা যৌনকর্মীদের অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি ও আচরণ পথচারী নারী-শিশু-বৃদ্ধ সবার অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে। যাঁরা পতিতালয় ভেঙে দেওয়ার মহৎ আন্দোলনে নেমেছিলেন, তাঁরা অনুধাবন করতে পারছেন কি না জানি না, আন্দোলনের সুফল(!) আজ সাহেবপাড়া ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে পুরো চট্টগ্রামেই।
প্রথম আলোর বর্ষসেরা বইয়ের (দহনকাল) লেখক হিসেবে এ বছর পুরস্কার পাওয়া হরিশংকর জলদাস সম্প্রতি কসবি (এই আরবি শব্দের বাংলা অর্থ বেশ্যা) নামের একটি উপন্যাস লিখেছেন। এ উপন্যাসের পটভূমি গড়ে উঠেছে অধুনালুপ্ত সাহেবপাড়াকে নিয়ে। লেখক গবেষণা করে দেখেছেন, এই সাহেবপাড়া একসময় ছিল একটি জেলেপাড়া। ১৭৬১ সালে সদরঘাটের পুরোনো কাস্টমস হাউসের পাশে এ জেলেপাড়াটিই পর্যায়ক্রমে পতিতালয়ে পরিণত হয়। বন্দরনগরে বিদেশি জাহাজের আনাগোনার সূত্রে যেসব বিদেশি নাবিক আসতেন, তাঁদের অনেকেরই যাতায়াত ছিল এ পাড়ায়। সাদা চামড়ার বিদেশি পর্যটকদের ভিড় জমত বলেই এ এলাকার নাম হয়ে যায় সাহেবপাড়া। পতিতাপাড়া গড়ে ওঠার পেছনে যে গল্পটি প্রচলিত ছিল তাও উল্লেখ করেছেন হরিশংকর। জেলেপরিবারের একটি মেয়েকে ধর্ষণ করেছিলেন বিদেশি এক নাবিক (মতান্তরে মেয়েটিই প্রেমে পড়েছিল ওই নাবিকের)। জেলেসমাজ একঘরে করে মেয়েটিকে। জেলেসমাজের প্রথা অনুযায়ী মেয়েটিকে বলা হলো আগুন-জল-বন্দী, অর্থাৎ তার স্পর্শের জল যেমন অপবিত্র, তেমনি শ্মশানেও তার মৃতদেহ সৎকার নিষিদ্ধ। সমাজ-কুল হারিয়ে জেলেকন্যাটি শেষ পর্যন্ত পতিতাবৃত্তিই বেছে নিয়েছিলেন বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে। কালক্রমে অভাব-দারিদ্র্যের কারণে অনেক মেয়েই অনুসরণ করেছিলেন তাঁর পথ। এভাবেই গড়ে উঠেছিল সাহেবপাড়ার পতিতালয়।
মনে পড়ে, সাহেবপাড়া পতিতালয় তুলে দেওয়ার পক্ষে-বিপক্ষে যখন স্থানীয় পৌর কমিশনারের (বর্তমান ওয়ার্ড কাউন্সিলর) কার্যালয়ে সালিস-বিচার চলছিল, তখন সদরঘাটের বাসিন্দারা তাঁদের নানা দুর্ভোগের কথা তুলে ধরেছিলেন। মানসম্মান নিয়ে ওই এলাকায় বাস করা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে জানাতে গিয়ে বলেছিলেন, নিজেদের স্কুল-কলেজগামী ছেলেমেয়েদের নিয়মিত ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শিকার হতে হয়, তাদের বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা থাকে, এমনকি ওই এলাকায় বসবাসের কারণে মেয়ের বিয়ের সম্পর্ক পর্যন্ত ভেঙে যায় ইত্যাদি। এ বাস্তবতাও অস্বীকার করার উপায় নেই।
আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সুরাহা করা যায়নি। সাহেবপাড়ার যৌনকর্মীদের পুনর্বাসনের মতো সিদ্ধান্তও নিতে পারেনি কেউ। এসব ক্ষেত্রে যা হয়, অপেক্ষাকৃত দুর্বল অংশের ওপরই নেমে আসে খাঁড়া। অবশেষে পুলিশ প্রশাসনের (এরশাদ সরকার আমলে) মৌন সম্মতিতে একদল মানুষ অগ্নিসংযোগ করল সাহেবপাড়ার বস্তিতে। এক কাপড়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয় যৌনকর্মীদের।
শুরু করেছিলাম পুলিশের ভূমিকা নিয়ে। যৌনকর্মীদের কাছ থেকে নিয়মিত বখরা আদায় করে আবার তাদেরই গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা নিয়ে। তবে পুলিশের সব সদস্যেরই চরিত্র ও প্রবণতা এক রকমই, এ কথা বলতে চাই না আমরা। গত ৩১ জানুয়ারির প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘তিন পুলিশের দৃঢ়তা এবং এক প্রসূতি’। একটি চলন্ত বাসে প্রসবযন্ত্রণায় কাতর জনৈক করুণা বেগম তিন পুলিশের করুণায় কীভাবে পুত্রসন্তানের জন্ম দিল, তার মর্মছোঁয়া বিবরণ আছে এ সংবাদে। পুলিশের সেবার মনোবৃত্তি, সাহস ও ত্যাগের এ রকম বহু নজির আছে। গুটি কয়েকের লোভ ও চরিত্রহীনতার দায় এসে পড়ে পুরো বাহিনীর ওপর। আমাদের ধারণা, আসল গলদ আইন ও এর প্রয়োগ-পদ্ধতিতে। পুলিশও জানে, এ ব্যবসা বন্ধ করা অসম্ভব। ফলে এই আপাত অসম্ভব কাজটির জন্য অভিযান পরিচালনার মতো লোক দেখানো কাজে তাদের কাছ থেকে আন্তরিকতা বা একাগ্রতা আশা করা যায় না।
এ কথা তো ঠিক, পতিতাবৃত্তির মতো অবমাননাকর জীবিকা বন্ধ করতে পারলে তা হবে সমাজের জন্য যেমন স্বস্তিকর, তেমনি অসহায় মেয়েগুলোর জন্যও আশীর্বাদস্বরূপ। সাম্প্রতিক কালে দেশের কিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা যৌনকর্মীদের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা সৃষ্টির ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছে। এই মেয়েদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে তারা ভূমিকা রাখতে পারে কি না ভেবে দেখতে বলি। কিন্তু পুনর্বাসনের দুরূহ কাজটি যত দিন করা সম্ভব হচ্ছে না, তত দিন অন্তত একটি নির্দিষ্ট পরিসরে ও গণ্ডিতে একে সীমাবদ্ধ রাখতে পারলেই উপকৃত হবে সমাজ, নিয়মিত লাঞ্ছনা ও প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা পাবে যৌনকর্মীরা।
খ্যাতিমান লেখক শংকর তাঁর ‘বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকা’ নামের একটি গল্পে হিন্দু পুরাণের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছিলেন, বেশ্যাবাড়ির দরজার সামনের মাটি হচ্ছে সবচেয়ে পবিত্র। কারণ, পুরুষ এ বাড়িতে ঢোকার সময় দরজার বাইরে রেখে যায় তার সবটুকু মনুষ্যত্ব। আমরা চাই, এই ‘পবিত্র মাটি’ থাকুক শহর থেকে দূরে।
পৃথিবীর প্রায় সব বন্দরনগরই পতিতাবৃত্তির কেন্দ্র। চট্টগ্রামও বাঁধা পড়েছে সেই নিয়মের আবর্তে। শহরের জনবহুল এলাকা থেকে দূরে অন্যান্য বন্দরনগরের মতো একটি ‘রেডলাইট এরিয়া’ গড়ে তোলা যায় কি না ভেবে দেখতে বলি সংশ্লিষ্ট সবাইকে। তাহলে এই নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে শহরের কোথাও এ ধরনের কর্মকাণ্ড চললে কঠোর হাতে দমন করতে পারবে পুলিশ। অভিযান চালাতে পারবে নির্দ্বিধায়। নিয়মের ব্যত্যয় হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতার দিকে আঙুল তুলতে পারবে নাগরিক সমাজ। তা ছাড়া এতে যৌনকর্মীদের সম্পর্কে নির্দিষ্ট একটি পরিসংখ্যান প্রশাসনের কাছে থাকবে। তাদের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতার সৃষ্টি করে এইডসের মতো মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ রোগের বিস্তার রোধ সম্ভব হবে। সর্বোপরি দেহব্যবসার সঙ্গে মাদক-অস্ত্রসহ অবৈধ নানা ব্যবসার যে যোগাযোগ, তাও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com
No comments