স্মরণ-বেতারের মানুষ by সৈয়দ জিয়াউর রহমান
চলে গেলেন ইশতিয়াক আহেমদ—দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীর বেশি সময়ের বাংলা বেতার জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ওয়াশিংটনের উপকণ্ঠে ভার্জিনিয়ায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি এবং তাঁর বাড়ির কাছে স্টার্লিং সিমেট্রিতে সমাহিত করা হয় তাঁকে। ইশতিয়াক আহেমদ রেখে গেছেন স্ত্রী ফরহাত আহেমদ, দুই ছেলে হাসনাইন ও নাদিম, দুই মেয়ে সামিনা ও রুবীনাকে।
অনন্য এক পরিশীলিত কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন ইশতিয়াক আহেমদ। বাংলা বেতারের দিকপাল নাজির আহেমদ ও ফতেহ লোহানীর সার্থক উত্তরসূরি হিসেবে তিনি ছিলেন অগণিত শ্রোতার কাছে তাঁর সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় বেতার সম্প্রচারক। ১৯৪৮ সালে স্বল্পকালের জন্য সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর তিনি প্রবেশ করেন বেতার জগতে এবং ১৯৫০-এর দশকের শুরু থেকে বেশ কিছুকাল রেডিও পাকিস্তানের করাচি কেন্দ্র থেকে জাতীয় বেতার সম্প্রচারে বাংলা সংবাদ পাঠ করেন। পরে তিনি ওয়াশিংটনে ভয়েস অব আমেরিকায় যোগ দেন। ১৯৫৮ সালের ১ জানুয়ারি শুরু হয় ভয়েস অব আমেরিকার নিয়মিত বাংলা অনুষ্ঠান সম্প্রচার। ইশতিয়াক আহেমদ শুরু থেকেই ভিওএর বাংলা বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ১৯৮৬ সালে অবসর নেওয়ার আগপর্যন্ত তিনি ভয়েস অব আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
ইশতিয়াক আহেমদ ছিলেন সুদর্শন। ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় তিনি কিছুকাল ভয়েস অব আমেরিকা ছেড়ে ঢাকায় ও পরে লাহোরে যান এবং সেখানে কয়েকটি উর্দু ছায়াছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন। পরে ফিরে আসেন ওয়াশিংটনে। ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে ওয়াশিংটনে ভয়েস অব আমেরিকায় এসেছিলেন কলকাতা থেকে প্রখ্যাত সাহিত্যিক গৌর কিশোর ঘোষ। তিনি বাংলা বিভাগে এসেই ইশতিয়াক আহেমদকে বলেছিলেন, ‘আপনি এই চেহারা আর কণ্ঠ নিয়ে আমেরিকায় বসে আছেন কেন? কলকাতায় আসুন, সিনেমা জগৎ আপনাকে লুফে নেবে।’ আমার এখনো মনে আছে, ইশতিয়াক আহেমদ গৌর কিশোর ঘোষকে বিনীতভাবে বলেছিলেন, ‘এককালে ছিলাম চলচ্চিত্রে, এখন আর ইচ্ছে নেই—এখন বেতারই আমার জগৎ।’
ইশতিয়াক আহেমদের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৭৬ সালের জুন মাসে আমি ভয়েস অব আমেরিকায় যোগ দেওয়ার সময়। ওয়াশিংটনের ডালাস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেই পেয়েছিলাম তাঁর সাক্ষাৎ। তিনি আমাকে নিতে এসেছিলেন। বলেছিলেন, কোনো অসুবিধা হলে কিংবা কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে তাঁকে জানাতে। প্রথম পরিচয়েই তাঁর আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম। ভয়েস অব আমেরিকায় যোগ দেওয়ার আগে আমার বেতারের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। আমি এসেছিলাম সংবাদপত্রের সাংবাদিক হিসেবে—আমেরিকায় বলা হয় ‘প্রিন্ট-জার্নালিস্ট’। বাকি সহকর্মীরা সবাই এসেছেন বেতারের অভিজ্ঞতা নিয়ে, ঢাকা কিংবা কলকাতা বেতার থেকে।
কাজে যোগ দেওয়ার প্রথম দিনেই ইশতিয়াক আহেমদ সাহস দিলেন আমাকে, বললেন, ‘বেতারের অভিজ্ঞতা নিয়ে কেউ জন্মগ্রহণ করে না। চেষ্টা আর আন্তরিকতা থাকলে বেতার সম্প্রচারে কুশলী হওয়া সম্ভব।’
ইশতিয়াক আহেমদ তাঁর দীর্ঘ বেতারজীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ, ঐতিহাসিক ও জনপ্রিয় অনুষ্ঠান পরিবেশন করেছেন। এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট জন কেনেডির আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার ঘটনা, আমেরিকান মহাকাশচারীদের চন্দ্রাবতরণ, প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি ও তাঁর পদত্যাগের ঘটনা এবং বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ওয়াশিংটন সফর নিয়ে তাঁর পরিবেশিত অনুষ্ঠান বাংলাদেশ ও ভারতের অগণিত শ্রোতার হূদয় স্পর্শ করে। ইশতিয়াক আহেমদ জাতিসংঘে বাংলাদেশর নেতার ভাষণ ও হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে তাঁর বৈঠক নিয়ে ভয়েস অব আমেরিকায় বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করেন এবং রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন ব্লেয়ার হাউসে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নেন। ১৯৭৪ সালে পরিবেশিত ভয়েস অব আমেরিকার এ অনুষ্ঠান ছিল ঐতিহাসিক ও শ্রোতানন্দিত।
কুশলী বেতার সম্প্রচারক ছাড়াও ইশতিয়াক আহেমদের অসামান্য দক্ষতা ছিল সার্বিক অনুষ্ঠান বিন্যাসের এবং অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু নির্বাচনের। এ ছাড়া তাঁর ছিল একটি আন্তর্জাতিক বেতার বিভাগ পরিচালনায় সুযোগ্য নেতৃত্বের দক্ষতা। ভদ্র, অমায়িক ও পরিশীলিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘকাল ভয়েস অব আমেরিকার কাজে নিয়োজিত থেকে দেখেছি, কখনো কারও বিরাগভাজন হননি তিনি এবং সহকর্মীদের যেকোনো বিরোধ, যেকোনো অসন্তোষ মিটিয়েছেন খুব সহজেই আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে।
২০১১ সালের ১ জানুয়ারি বাংলা বিভাগের ৫৩তম বার্ষিকী উপলক্ষে ইশতিয়াক আহেমদের একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করেছিলাম। ভয়েস অব আমেরিকা থেকে আমার অবসর নেওয়ার মাত্র তিন মাস আগে—এটি ছিল তাঁর শেষ সাক্ষাৎকার। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেছিলেন, দীর্ঘ অবসরজীবনে শ্রোতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকলেও তিনি তাদের ও সেই সঙ্গে পুরোনো সহকর্মীদের ভালোবাসা ভুলতে পারেন না। তাঁর অনুরাগী অগণিত শ্রোতা ও সহকর্মীও কখনোই ভুলতে পারবেন না তাঁদের প্রিয় ইশতিয়াক আহেমদকে।
সৈয়দ জিয়াউর রহমান
সাংবাদিক ও ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের সাবেক সিনিয়র এডিটর
ইশতিয়াক আহেমদ ছিলেন সুদর্শন। ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় তিনি কিছুকাল ভয়েস অব আমেরিকা ছেড়ে ঢাকায় ও পরে লাহোরে যান এবং সেখানে কয়েকটি উর্দু ছায়াছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন। পরে ফিরে আসেন ওয়াশিংটনে। ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে ওয়াশিংটনে ভয়েস অব আমেরিকায় এসেছিলেন কলকাতা থেকে প্রখ্যাত সাহিত্যিক গৌর কিশোর ঘোষ। তিনি বাংলা বিভাগে এসেই ইশতিয়াক আহেমদকে বলেছিলেন, ‘আপনি এই চেহারা আর কণ্ঠ নিয়ে আমেরিকায় বসে আছেন কেন? কলকাতায় আসুন, সিনেমা জগৎ আপনাকে লুফে নেবে।’ আমার এখনো মনে আছে, ইশতিয়াক আহেমদ গৌর কিশোর ঘোষকে বিনীতভাবে বলেছিলেন, ‘এককালে ছিলাম চলচ্চিত্রে, এখন আর ইচ্ছে নেই—এখন বেতারই আমার জগৎ।’
ইশতিয়াক আহেমদের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৭৬ সালের জুন মাসে আমি ভয়েস অব আমেরিকায় যোগ দেওয়ার সময়। ওয়াশিংটনের ডালাস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেই পেয়েছিলাম তাঁর সাক্ষাৎ। তিনি আমাকে নিতে এসেছিলেন। বলেছিলেন, কোনো অসুবিধা হলে কিংবা কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে তাঁকে জানাতে। প্রথম পরিচয়েই তাঁর আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম। ভয়েস অব আমেরিকায় যোগ দেওয়ার আগে আমার বেতারের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। আমি এসেছিলাম সংবাদপত্রের সাংবাদিক হিসেবে—আমেরিকায় বলা হয় ‘প্রিন্ট-জার্নালিস্ট’। বাকি সহকর্মীরা সবাই এসেছেন বেতারের অভিজ্ঞতা নিয়ে, ঢাকা কিংবা কলকাতা বেতার থেকে।
কাজে যোগ দেওয়ার প্রথম দিনেই ইশতিয়াক আহেমদ সাহস দিলেন আমাকে, বললেন, ‘বেতারের অভিজ্ঞতা নিয়ে কেউ জন্মগ্রহণ করে না। চেষ্টা আর আন্তরিকতা থাকলে বেতার সম্প্রচারে কুশলী হওয়া সম্ভব।’
ইশতিয়াক আহেমদ তাঁর দীর্ঘ বেতারজীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ, ঐতিহাসিক ও জনপ্রিয় অনুষ্ঠান পরিবেশন করেছেন। এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট জন কেনেডির আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার ঘটনা, আমেরিকান মহাকাশচারীদের চন্দ্রাবতরণ, প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি ও তাঁর পদত্যাগের ঘটনা এবং বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ওয়াশিংটন সফর নিয়ে তাঁর পরিবেশিত অনুষ্ঠান বাংলাদেশ ও ভারতের অগণিত শ্রোতার হূদয় স্পর্শ করে। ইশতিয়াক আহেমদ জাতিসংঘে বাংলাদেশর নেতার ভাষণ ও হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে তাঁর বৈঠক নিয়ে ভয়েস অব আমেরিকায় বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করেন এবং রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন ব্লেয়ার হাউসে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নেন। ১৯৭৪ সালে পরিবেশিত ভয়েস অব আমেরিকার এ অনুষ্ঠান ছিল ঐতিহাসিক ও শ্রোতানন্দিত।
কুশলী বেতার সম্প্রচারক ছাড়াও ইশতিয়াক আহেমদের অসামান্য দক্ষতা ছিল সার্বিক অনুষ্ঠান বিন্যাসের এবং অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু নির্বাচনের। এ ছাড়া তাঁর ছিল একটি আন্তর্জাতিক বেতার বিভাগ পরিচালনায় সুযোগ্য নেতৃত্বের দক্ষতা। ভদ্র, অমায়িক ও পরিশীলিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘকাল ভয়েস অব আমেরিকার কাজে নিয়োজিত থেকে দেখেছি, কখনো কারও বিরাগভাজন হননি তিনি এবং সহকর্মীদের যেকোনো বিরোধ, যেকোনো অসন্তোষ মিটিয়েছেন খুব সহজেই আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে।
২০১১ সালের ১ জানুয়ারি বাংলা বিভাগের ৫৩তম বার্ষিকী উপলক্ষে ইশতিয়াক আহেমদের একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করেছিলাম। ভয়েস অব আমেরিকা থেকে আমার অবসর নেওয়ার মাত্র তিন মাস আগে—এটি ছিল তাঁর শেষ সাক্ষাৎকার। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেছিলেন, দীর্ঘ অবসরজীবনে শ্রোতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকলেও তিনি তাদের ও সেই সঙ্গে পুরোনো সহকর্মীদের ভালোবাসা ভুলতে পারেন না। তাঁর অনুরাগী অগণিত শ্রোতা ও সহকর্মীও কখনোই ভুলতে পারবেন না তাঁদের প্রিয় ইশতিয়াক আহেমদকে।
সৈয়দ জিয়াউর রহমান
সাংবাদিক ও ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের সাবেক সিনিয়র এডিটর
No comments