সাবধান! সামনে বিপদ! by মাহবুব তালুকদার
গুরুদেব চক্ষু নিমীলিত করিয়া যোগাসনে উপবিষ্ট ছিলেন। তবে তিনি ধ্যানমগ্ন না ঘুমন্ত অবস্থায় আছেন, তাহা শিষ্যের বোধগম্য হইল না। তাহার মুখের ঔজ্জ্বল্য ততটা নাই বিধায় শিষ্যের ধারণা হইল, গুরুদেব নিদ্রা যাইতেছেন। ধ্যানে থাকিলে প্রভুর মুখমণ্ডলের বিভায় চতুর্দিক যেন আলোকিত হইয়া উঠে।
নিদ্রা হইতে জাগরিত হইয়া গুরুদেব কহিলেন, বত্স! আমি একটি স্বপ্ন দেখিতেছিলাম। তবে উহাকে স্বপ্ন না বলিয়া দুঃস্বপ্ন বলা উচিত।
শিষ্য জিজ্ঞাসিল, মহাত্মন! স্বপ্ন কি সর্বদা অর্থবোধক হয়?
—স্বপ্ন তিন প্রকার। গুরুদেব জানাইলেন, কোনো কোনো স্বপ্নের অর্থ নাই। কোনো কোনো স্বপ্নের সরাসরি অর্থ বোধগম্য না হইলেও স্বপ্ন বিশ্লেষকগণ উহার অর্থ বাহির করিতে পারেন। আবার কোনো কোনো স্বপ্নে সরাসরি ঘটনা ঘটিতে দেখা যায়।
—মহাত্মন! আমার কৌতূহল মার্জনা করিলে জানিতে ইচ্ছা করি আপনি কোন্ প্রকার স্বপ্ন দর্শন করিয়াছেন?
গুরুদেব কহিলেন, আমি যে স্বপ্ন দেখিয়াছি উহা মধ্য প্রকারের হইবেক। মধ্য প্রকার স্বপ্নের অর্থ বিশ্লেষণ করিয়া বাহির করিতে হয়। যাহা হউক, আমি উহা বর্ণনা করিতেছি।
—যথা আজ্ঞা প্রভু!
—স্বপ্নে দেখিতে পাইলাম, আমাদের দেশটি যেন একটি রেলগাড়ি। উহার চাকা স্থানচ্যুত হইয়াছিল। চাকাগুলি স্বস্থানে আনার পর রেলগাড়িটি তীব্র গতিতে সম্মুখে অগ্রসর হইল। গাড়ি একটি অন্ধকার সুড়ঙ্গের দিকে ধাবমান হইতেছিল। রেল সড়কের এক পাশে ক্রস চিহ্ন দিয়া লেখা : সাবধান! সামনে বিপদ!
শিষ্য উত্তেজিত হইয়া প্রশ্ন করিল, তাহার পর কি হইল?
—তাহার পর কি ঘটিবে উহা নিশ্চিত করিয়া বলা যায় না। রেলগাড়ির কামরা হইতে ওই সাবধানবাণী দেখিয়া আমার নিদ্রা ভঙ্গ হইল। এখন আমার ধারণা হইতেছে, মহাদুর্যোগ আসন্ন।
—মহাত্মন! উহা কি রূপ দুর্যোগ হইতে পারে? উহা হইতে পরিত্রাণ লাভের উপায়ই বা কি?
—বাছা! ইহা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নহে। ইহা মনুষ্যসৃজিত দুর্যোগ। দুর্যোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে এক্ষণে কোনো ধারণা করা যাইতেছে না। ইহার পরিত্রাণ কি প্রকারে হইবে তাহা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নহে। আমার মনে হইতেছে আমরা একটি কালো সুড়ঙ্গ ও তাহার পর একটি বিপজ্জনক সেতু অতিক্রমের সম্মুখীন হইতে যাইতেছি।
—গোস্তাকি মাফ করিলে জিজ্ঞাসিতে ইচ্ছা হয়, ইহা কি কোনো রাজনৈতিক বিপদের আশঙ্কা?
—তুমি সঠিক অনুমান করিয়াছ। বর্তমানে দেশের রাজনীতি যে পথ ধরিয়া অগ্রসর হইতেছে, তাহাতে সমূহ বিপদের আশঙ্কা রহিয়াছে।
—প্রভু! আমার অজ্ঞতা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখিলে বাধিত হইব। আমার কিছু জিজ্ঞাসা মনে জাগ্রত হইতেছে।
—তুমি নির্দ্বিধায় প্রশ্ন করিতে পার।
—ওই রাজনৈতিক বিপদের স্বরূপ কী?
—আমাদের প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দল জাতীয় স্বার্থে কোনোরূপ সমঝোতার পথে অগ্রসর হইতেছে না। তাহারা দৃশ্যমান ও অদৃশ্য রেষারেষিতে মগ্ন হইয়াছে। নিতান্ত মামুলি বিষয় লইয়া পচা শামুকে পা কাটার অবস্থা।
—ইহার কি কোনো আলামত আছে?
—অবশ্যই আছে। প্রথমত বিএনপি সংসদে যোগদানের জন্য সম্মুখ সারিতে একটি আসন দাবি করিয়াছিল। ওই দাবি মানা হয় নাই। বিরোধীদল হইতে ডেপুটি স্পিকার মনোনীত করার টালবাহানায় বিএনপিও জাতীয় সংসদ হইতে যোগদানে বিরত থাকে। সংসদে যোগদানের শর্ত হিসাবে ক্রমান্বয়ে তাহাদের দাবি বৃদ্ধি পাইতে থাকে। অবশেষে পরিলক্ষিত হয়, জাতীয় সংসদে যোগদান আর সংসদের বিষয় লইয়া নহে। উহার মূল কারণ সংসদের বাহিরে বিস্তৃত।
—কিন্তু স্যার! কারণে-অকারণে দুই দলের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি পাওয়াও দেশবাসী প্রত্যক্ষ করিয়াছে। যেমন সেনানিবাসের বাড়ি হইতে খালেদা জিয়াকে উত্খাতের প্রচেষ্টা। তাহার সরকারি নিরাপত্তা শিথিল করা।
উত্তরে গুরুদেব কহিলেন, তুমি যথার্থ বলিয়াছ। বিভিন্ন স্থাপনার নামবদল সরকার ও বিরোধীদলকে দুই মেরুতে ঠেলিয়া দিয়াছে। নামবদলের এই ধারায় উভয় রাজনৈতিক দলই সমান পারদর্শী। এইবার পাল্টাপাল্টিভাবে জিয়াউর রহমানের নামের কয়েকটি স্থাপনার নাম পরিবর্তিত হইতে যাইতেছে।
—এইসবের কোনোটাই জাতীয় ইস্যু নহে।
—হ্যাঁ। এতদিন টিপাইমুখ বাঁধ ও গ্যাস ব্লক ইজারা সম্ভবত এই দুইটি জাতীয় ইস্যু সামনে ছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর দুই দেশের সম্পাদিত তিনটি চুক্তি, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ভারতকে ব্যবহার করিতে দেওয়া ইত্যাদি কয়েকটি বিষয়ে জাতীয় ইস্যুর উদ্ভব ঘটিয়াছে, যাহা লইয়া বিরোধীদল আন্দোলনের পাঁয়তারা করিতেছে।
—প্রভু! জাতীয় কোনো বিষয় লইয়া দুই দল মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় না। তাহাদের যুদ্ধ শুরু হইয়াছে কিছু বক্তব্য লইয়া। উভয়পক্ষেরই বক্তব্যের পরিণতি দিনে দিনে দেশকে অন্ধকারের দিকে টানিয়া লইয়া যাইতেছে।
—তুমি তোমার কথার ব্যাখ্যা প্রদান করিতে পারিবে কি?
—আপনি অনুমতি দিলে অবশ্যই পারিব। শিষ্য বলিল, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলিয়াছেন, যে বাক্সটি আনা হইয়াছিল, তাহাতে আদৌ জিয়ার লাশ ছিল কিনা, উহাতে সন্দেহ আছে। কোনো প্রমাণ ব্যতিরেকে কেন প্রধানমন্ত্রী এইরূপ একটি অকারণ বক্তব্য প্রদান করিলেন তাহা বোধগম্য নহে। অন্যদিকে খালেদা জিয়া ভারতের সহিত সরকারের গোপন চুক্তি হইয়াছে বলিয়া যে উক্তি করিয়াছেন, উহার সমর্থনে তাহার কোনো জোরালো প্রমাণই নাই। এইসব আলগা কথাবার্তা উভয়ের পারস্পরিক অবস্থানকে আরও দূরে ঠেলিয়া দিয়াছে।
গুরুদেব কহিলেন, তোমার বক্তব্য ঠিক। ইতোপূর্বে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী বলিয়াছিলেন, ‘জোট সরকারের আমলে উলফা নেতা কারাবন্দি অনুপ চেটিয়ার সহিত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ বৈঠক করিয়াছিলেন, উহার প্রমাণ তাহার নিকট আছে।’ কিন্তু কোথায় সেই প্রমাণ? অনেকদিন তো পার হইল, এখনও কেন তিনি সেই প্রমাণ দাখিল করিলেন না?
—স্যার! প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমামের একটি বক্তব্য বিএনপি মহাসচিবের বিরুদ্ধে ঝড় তুলিয়াছে। এইচটি ইমাম বলিয়াছেন, ‘যারা সংসদের ক্যান্টিনের খাবার চুরি করে তারা প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে বড় বড় কথা বলছেন।’ এহেন বক্তব্যের কোনো রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা পাওয়া যায় না। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন এই বক্তব্যের কঠোর প্রতিবাদ করিয়া জানাইয়াছেন, ইমাম সাহেব তাহার বক্তব্য প্রমাণ করিতে না পারিলে তিনি তাহার বিরুদ্ধে মামলা করিবেন। মামলা হউক বা না হউক এই ধরনের কথাবার্তার ফলে উভয়পক্ষের পারস্পরিক সৌহার্দ্য অন্তর্হিত হইতেছে।
গুরুদেব কহিলেন, তোমার কথা ঠিক। মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তিগত আক্রমণ দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ নস্যাত্ করিতেছে। কথার পিঠে কথা ধীরে ধীরে শিষ্টাচারবহির্ভূত হইয়া পড়িতেছে। দেশের জন্য ইহা মোটেই মঙ্গলজনক হইতে পারে না। গুরুদেব আরও বলিলেন, কেবল কথা নয়, আমি সরকারিদল ও বিরোধীদলের কাজেও অশনি সঙ্কেতের আভাস পাইতেছি।
—উহা কি রূপ প্রভু?
—একজন সিনিয়র আইনজীবী বলিয়াছেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর যাহারা ইহার বিচার প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করিয়াছে, যাহারা খুনিদের চাকরি ও পদোন্নতি দিয়াছে, তাহাদিগকে বিচারের আওতায় আনিতে হইবে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারে বিএনপি কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে নাই বলিয়া অনেকে ক্ষুব্ধ হইয়াছেন। কৃষি মন্ত্রী বলিয়াছেন ইহাতে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করায় বিএনপি’র সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হইয়াছে। এক্ষণে জেলহত্যার বিচার, যুদ্ধ অপরাধীদের বিচারের নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করা হইতেছে। আমার ভয় হয়, এই সকল উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট না করিলেই হয়।
—কিন্তু অপরাধের বিচার হওয়া উচিত নহে কি?
—তাহা অবশ্যই উচিত। যে কোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ অন্যায়ের প্রতিকার চাহিবে। তবে বিচারের বিষয় হউক বা অন্য কোনো রাজনৈতিক বিষয় হউক, প্রধান বিরোধীদলকে টার্গেট না করিয়া উহাকে আস্থায় লইয়া করা উচিত।
—হুজুর! আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে ধারণা করি, উহা সম্ভব নহে।
—কেন সম্ভব নহে?
—পারস্পরিক রেষারেষি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলির প্রধান অবলম্বন। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জাতীয় স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়ে যতটা আগ্রহী, উহা হইতে অধিক আগ্রহী প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার প্রচেষ্টায়। এই ট্রাডিশন দীর্ঘদিন ধরিয়া চলিয়া আসিতেছে।
গুরুদেব বলিলেন, সাধু! আমি তোমার মুখ হইতে এই কথাটি শুনিতে চাহিতে ছিলাম। রাজনীতি যদি এই ধারা বহন করিয়া চলে, তাহা হইলে যে কোনো ছোটখাটো ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া বড় ধরনের অশুভ ঘটনা ঘটার আশঙ্কা আছে। আমার মনে হয় সকলেরই এই বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত।
—এই জন্যই কি আপনি স্বপ্নে দেখিতে পাইয়াছেন : ‘সাবধান! সামনে বিপদ!’
—বত্স! স্বপ্ন অর্থহীন বা অর্থপূর্ণ যাহাই হউক না কেন, উহা বাস্তবতাবিবর্জিত নহে। মানুষ এমন কিছু স্বপ্নে দেখে না যাহা তাহার বাস্তব জ্ঞান ধারণ করে না। কোনো কোনো স্বপ্ন বাস্তব অবস্থারই ভবিষ্যদ্বাণী। শিষ্য বলিল, সামনে অন্ধকার সুড়ঙ্গ ও বিপজ্জনক সেতুর দৃশ্যটি কেন আপনি স্বপ্নে দেখিয়াছেন, এতক্ষণে তাহা বুঝিলাম। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদগণ এইরূপ স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন দেখেন না কেন, তাহা বুঝি না। তাহা হইলে যে কোনো দুর্যোগের মোকাবিলায় তাহারা পূর্বেই সতর্ক হইতে পারেন।
গুরুদেব ঈষত্ হাস্য করিয়া কহিলেন, বিপদে না পড়িলে তাহাদের হুঁশ হয় না। সম্ভবত রাজনীতিবিদগণ বিপদে পড়িয়া জ্ঞানলাভ করিতে ভালোবাসেন। নিকট অতীতে উহার নজির আমরা দেখিয়াছি।
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক
ই-মেইল : mahbub_talukdar@yahoo.com
শিষ্য জিজ্ঞাসিল, মহাত্মন! স্বপ্ন কি সর্বদা অর্থবোধক হয়?
—স্বপ্ন তিন প্রকার। গুরুদেব জানাইলেন, কোনো কোনো স্বপ্নের অর্থ নাই। কোনো কোনো স্বপ্নের সরাসরি অর্থ বোধগম্য না হইলেও স্বপ্ন বিশ্লেষকগণ উহার অর্থ বাহির করিতে পারেন। আবার কোনো কোনো স্বপ্নে সরাসরি ঘটনা ঘটিতে দেখা যায়।
—মহাত্মন! আমার কৌতূহল মার্জনা করিলে জানিতে ইচ্ছা করি আপনি কোন্ প্রকার স্বপ্ন দর্শন করিয়াছেন?
গুরুদেব কহিলেন, আমি যে স্বপ্ন দেখিয়াছি উহা মধ্য প্রকারের হইবেক। মধ্য প্রকার স্বপ্নের অর্থ বিশ্লেষণ করিয়া বাহির করিতে হয়। যাহা হউক, আমি উহা বর্ণনা করিতেছি।
—যথা আজ্ঞা প্রভু!
—স্বপ্নে দেখিতে পাইলাম, আমাদের দেশটি যেন একটি রেলগাড়ি। উহার চাকা স্থানচ্যুত হইয়াছিল। চাকাগুলি স্বস্থানে আনার পর রেলগাড়িটি তীব্র গতিতে সম্মুখে অগ্রসর হইল। গাড়ি একটি অন্ধকার সুড়ঙ্গের দিকে ধাবমান হইতেছিল। রেল সড়কের এক পাশে ক্রস চিহ্ন দিয়া লেখা : সাবধান! সামনে বিপদ!
শিষ্য উত্তেজিত হইয়া প্রশ্ন করিল, তাহার পর কি হইল?
—তাহার পর কি ঘটিবে উহা নিশ্চিত করিয়া বলা যায় না। রেলগাড়ির কামরা হইতে ওই সাবধানবাণী দেখিয়া আমার নিদ্রা ভঙ্গ হইল। এখন আমার ধারণা হইতেছে, মহাদুর্যোগ আসন্ন।
—মহাত্মন! উহা কি রূপ দুর্যোগ হইতে পারে? উহা হইতে পরিত্রাণ লাভের উপায়ই বা কি?
—বাছা! ইহা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নহে। ইহা মনুষ্যসৃজিত দুর্যোগ। দুর্যোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে এক্ষণে কোনো ধারণা করা যাইতেছে না। ইহার পরিত্রাণ কি প্রকারে হইবে তাহা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নহে। আমার মনে হইতেছে আমরা একটি কালো সুড়ঙ্গ ও তাহার পর একটি বিপজ্জনক সেতু অতিক্রমের সম্মুখীন হইতে যাইতেছি।
—গোস্তাকি মাফ করিলে জিজ্ঞাসিতে ইচ্ছা হয়, ইহা কি কোনো রাজনৈতিক বিপদের আশঙ্কা?
—তুমি সঠিক অনুমান করিয়াছ। বর্তমানে দেশের রাজনীতি যে পথ ধরিয়া অগ্রসর হইতেছে, তাহাতে সমূহ বিপদের আশঙ্কা রহিয়াছে।
—প্রভু! আমার অজ্ঞতা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখিলে বাধিত হইব। আমার কিছু জিজ্ঞাসা মনে জাগ্রত হইতেছে।
—তুমি নির্দ্বিধায় প্রশ্ন করিতে পার।
—ওই রাজনৈতিক বিপদের স্বরূপ কী?
—আমাদের প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দল জাতীয় স্বার্থে কোনোরূপ সমঝোতার পথে অগ্রসর হইতেছে না। তাহারা দৃশ্যমান ও অদৃশ্য রেষারেষিতে মগ্ন হইয়াছে। নিতান্ত মামুলি বিষয় লইয়া পচা শামুকে পা কাটার অবস্থা।
—ইহার কি কোনো আলামত আছে?
—অবশ্যই আছে। প্রথমত বিএনপি সংসদে যোগদানের জন্য সম্মুখ সারিতে একটি আসন দাবি করিয়াছিল। ওই দাবি মানা হয় নাই। বিরোধীদল হইতে ডেপুটি স্পিকার মনোনীত করার টালবাহানায় বিএনপিও জাতীয় সংসদ হইতে যোগদানে বিরত থাকে। সংসদে যোগদানের শর্ত হিসাবে ক্রমান্বয়ে তাহাদের দাবি বৃদ্ধি পাইতে থাকে। অবশেষে পরিলক্ষিত হয়, জাতীয় সংসদে যোগদান আর সংসদের বিষয় লইয়া নহে। উহার মূল কারণ সংসদের বাহিরে বিস্তৃত।
—কিন্তু স্যার! কারণে-অকারণে দুই দলের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি পাওয়াও দেশবাসী প্রত্যক্ষ করিয়াছে। যেমন সেনানিবাসের বাড়ি হইতে খালেদা জিয়াকে উত্খাতের প্রচেষ্টা। তাহার সরকারি নিরাপত্তা শিথিল করা।
উত্তরে গুরুদেব কহিলেন, তুমি যথার্থ বলিয়াছ। বিভিন্ন স্থাপনার নামবদল সরকার ও বিরোধীদলকে দুই মেরুতে ঠেলিয়া দিয়াছে। নামবদলের এই ধারায় উভয় রাজনৈতিক দলই সমান পারদর্শী। এইবার পাল্টাপাল্টিভাবে জিয়াউর রহমানের নামের কয়েকটি স্থাপনার নাম পরিবর্তিত হইতে যাইতেছে।
—এইসবের কোনোটাই জাতীয় ইস্যু নহে।
—হ্যাঁ। এতদিন টিপাইমুখ বাঁধ ও গ্যাস ব্লক ইজারা সম্ভবত এই দুইটি জাতীয় ইস্যু সামনে ছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর দুই দেশের সম্পাদিত তিনটি চুক্তি, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ভারতকে ব্যবহার করিতে দেওয়া ইত্যাদি কয়েকটি বিষয়ে জাতীয় ইস্যুর উদ্ভব ঘটিয়াছে, যাহা লইয়া বিরোধীদল আন্দোলনের পাঁয়তারা করিতেছে।
—প্রভু! জাতীয় কোনো বিষয় লইয়া দুই দল মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় না। তাহাদের যুদ্ধ শুরু হইয়াছে কিছু বক্তব্য লইয়া। উভয়পক্ষেরই বক্তব্যের পরিণতি দিনে দিনে দেশকে অন্ধকারের দিকে টানিয়া লইয়া যাইতেছে।
—তুমি তোমার কথার ব্যাখ্যা প্রদান করিতে পারিবে কি?
—আপনি অনুমতি দিলে অবশ্যই পারিব। শিষ্য বলিল, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলিয়াছেন, যে বাক্সটি আনা হইয়াছিল, তাহাতে আদৌ জিয়ার লাশ ছিল কিনা, উহাতে সন্দেহ আছে। কোনো প্রমাণ ব্যতিরেকে কেন প্রধানমন্ত্রী এইরূপ একটি অকারণ বক্তব্য প্রদান করিলেন তাহা বোধগম্য নহে। অন্যদিকে খালেদা জিয়া ভারতের সহিত সরকারের গোপন চুক্তি হইয়াছে বলিয়া যে উক্তি করিয়াছেন, উহার সমর্থনে তাহার কোনো জোরালো প্রমাণই নাই। এইসব আলগা কথাবার্তা উভয়ের পারস্পরিক অবস্থানকে আরও দূরে ঠেলিয়া দিয়াছে।
গুরুদেব কহিলেন, তোমার বক্তব্য ঠিক। ইতোপূর্বে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী বলিয়াছিলেন, ‘জোট সরকারের আমলে উলফা নেতা কারাবন্দি অনুপ চেটিয়ার সহিত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ বৈঠক করিয়াছিলেন, উহার প্রমাণ তাহার নিকট আছে।’ কিন্তু কোথায় সেই প্রমাণ? অনেকদিন তো পার হইল, এখনও কেন তিনি সেই প্রমাণ দাখিল করিলেন না?
—স্যার! প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমামের একটি বক্তব্য বিএনপি মহাসচিবের বিরুদ্ধে ঝড় তুলিয়াছে। এইচটি ইমাম বলিয়াছেন, ‘যারা সংসদের ক্যান্টিনের খাবার চুরি করে তারা প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে বড় বড় কথা বলছেন।’ এহেন বক্তব্যের কোনো রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা পাওয়া যায় না। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন এই বক্তব্যের কঠোর প্রতিবাদ করিয়া জানাইয়াছেন, ইমাম সাহেব তাহার বক্তব্য প্রমাণ করিতে না পারিলে তিনি তাহার বিরুদ্ধে মামলা করিবেন। মামলা হউক বা না হউক এই ধরনের কথাবার্তার ফলে উভয়পক্ষের পারস্পরিক সৌহার্দ্য অন্তর্হিত হইতেছে।
গুরুদেব কহিলেন, তোমার কথা ঠিক। মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তিগত আক্রমণ দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ নস্যাত্ করিতেছে। কথার পিঠে কথা ধীরে ধীরে শিষ্টাচারবহির্ভূত হইয়া পড়িতেছে। দেশের জন্য ইহা মোটেই মঙ্গলজনক হইতে পারে না। গুরুদেব আরও বলিলেন, কেবল কথা নয়, আমি সরকারিদল ও বিরোধীদলের কাজেও অশনি সঙ্কেতের আভাস পাইতেছি।
—উহা কি রূপ প্রভু?
—একজন সিনিয়র আইনজীবী বলিয়াছেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর যাহারা ইহার বিচার প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করিয়াছে, যাহারা খুনিদের চাকরি ও পদোন্নতি দিয়াছে, তাহাদিগকে বিচারের আওতায় আনিতে হইবে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারে বিএনপি কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে নাই বলিয়া অনেকে ক্ষুব্ধ হইয়াছেন। কৃষি মন্ত্রী বলিয়াছেন ইহাতে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করায় বিএনপি’র সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হইয়াছে। এক্ষণে জেলহত্যার বিচার, যুদ্ধ অপরাধীদের বিচারের নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করা হইতেছে। আমার ভয় হয়, এই সকল উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট না করিলেই হয়।
—কিন্তু অপরাধের বিচার হওয়া উচিত নহে কি?
—তাহা অবশ্যই উচিত। যে কোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ অন্যায়ের প্রতিকার চাহিবে। তবে বিচারের বিষয় হউক বা অন্য কোনো রাজনৈতিক বিষয় হউক, প্রধান বিরোধীদলকে টার্গেট না করিয়া উহাকে আস্থায় লইয়া করা উচিত।
—হুজুর! আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে ধারণা করি, উহা সম্ভব নহে।
—কেন সম্ভব নহে?
—পারস্পরিক রেষারেষি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলির প্রধান অবলম্বন। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জাতীয় স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়ে যতটা আগ্রহী, উহা হইতে অধিক আগ্রহী প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার প্রচেষ্টায়। এই ট্রাডিশন দীর্ঘদিন ধরিয়া চলিয়া আসিতেছে।
গুরুদেব বলিলেন, সাধু! আমি তোমার মুখ হইতে এই কথাটি শুনিতে চাহিতে ছিলাম। রাজনীতি যদি এই ধারা বহন করিয়া চলে, তাহা হইলে যে কোনো ছোটখাটো ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া বড় ধরনের অশুভ ঘটনা ঘটার আশঙ্কা আছে। আমার মনে হয় সকলেরই এই বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত।
—এই জন্যই কি আপনি স্বপ্নে দেখিতে পাইয়াছেন : ‘সাবধান! সামনে বিপদ!’
—বত্স! স্বপ্ন অর্থহীন বা অর্থপূর্ণ যাহাই হউক না কেন, উহা বাস্তবতাবিবর্জিত নহে। মানুষ এমন কিছু স্বপ্নে দেখে না যাহা তাহার বাস্তব জ্ঞান ধারণ করে না। কোনো কোনো স্বপ্ন বাস্তব অবস্থারই ভবিষ্যদ্বাণী। শিষ্য বলিল, সামনে অন্ধকার সুড়ঙ্গ ও বিপজ্জনক সেতুর দৃশ্যটি কেন আপনি স্বপ্নে দেখিয়াছেন, এতক্ষণে তাহা বুঝিলাম। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদগণ এইরূপ স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন দেখেন না কেন, তাহা বুঝি না। তাহা হইলে যে কোনো দুর্যোগের মোকাবিলায় তাহারা পূর্বেই সতর্ক হইতে পারেন।
গুরুদেব ঈষত্ হাস্য করিয়া কহিলেন, বিপদে না পড়িলে তাহাদের হুঁশ হয় না। সম্ভবত রাজনীতিবিদগণ বিপদে পড়িয়া জ্ঞানলাভ করিতে ভালোবাসেন। নিকট অতীতে উহার নজির আমরা দেখিয়াছি।
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক
ই-মেইল : mahbub_talukdar@yahoo.com
No comments