উৎসব-বাগেদবী সরস্বতী by তারাপদ আচার্য্য

আজ ঢাক, ঢোল, শঙ্খ, উলুধ্বনিসহ নানা উপচারের মাধ্যমে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিদ্যা ও জ্ঞানের দেবী সরস্বতীর আরাধনা করছে। ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঘরে ঘরে বন্দিতা হচ্ছেন মা সরস্বতী। হাত জোড় করে সবাই মায়ের কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছে— ‘ত্বং সরস্বতী নির্মল বরণে রক্তে বিভূষিত কুন্দল করণে।


শিরে জটা গজমোতি হার
দেবী সরস্বতী বিদ্যা দাও ভার।’
সরস্বতী পূজা কবে কখন কে শুরু করেন, তা সঠিকভাবে জানা যায় না। পুরাণে বলা হয়েছে, ‘দেবী সরস্বতী আদ্যা প্রকৃতির তৃতীয় অংশজাত। তিনি বাক্য, বৃদ্ধি, জ্ঞান, বিদ্যা প্রভৃতির অধিষ্ঠাত্রী দেবী।’ ওই গ্রন্থের মতে, ‘সরস্বতী পূজার প্রবর্তক ব্রহ্মা এবং শ্রীকৃষ্ণ।’ তবে পণ্ডিতেরা অনেকেই মনে করেন, সরস্বতী প্রথমে ছিলেন নদী, পরে হলেন দেবী। রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেন, ‘আর্য্যাবর্তে সরস্বতী নামে যে নদী আছে, তা-ই প্রথমে দেবী বলে পূজিত হয়েছিলেন। বর্তমানে গঙ্গাকে যেমন হিন্দুরা উপাস্য দেবী হিসেবে পূজা করে থাকেন এবং ক্রমান্বয়ে সরস্বতী হলেন জ্ঞানের দেবী।’ কিন্তু সরস্বতীর প্রকৃত তাৎপর্য নিহিত রয়েছে সূর্যাগ্নির জ্যোতিতে। সূর্যাগ্নির তেজ, তাপ ও চৈতন্যরূপে জীবদেহে বিরাজ করায় চেতনা, জ্ঞানের প্রকৃতি কর্ত্রী তো দেবী সরস্বতী। সরস্বতী দেবীর রূপান্তর হয়েছে পৃথিবীতে নদীরূপে এবং সরস্বতীই অগ্নি-ইন্দ্র-মরুৎ অশ্বীদ্বয়ের সংস্পর্শে শত্রুঘাতিনী, ধনদাত্রী এবং বৃহস্পতি-ব্রহ্মাণস্পতির বিদ্যাবত্তার সংযোগে নদী সরস্বতীর সঙ্গে অভিন্নরূপে সরস্বতী তীরে উচ্চারিত বৈদিকমন্ত্রে সংশ্লিষ্ট হয়ে পুরাণে বিদ্যা ও জ্ঞান ভিন্ন অপর জ্ঞানগুলো অন্যত্র স্থাপন করে হলেন বিদ্যাধিষ্ঠাত্রী। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে গোলোকে বিষ্ণুর তিন পত্নী—লক্ষ্মী, সরস্বতী ও গঙ্গার মধ্যে বিবাদের ফলে গঙ্গার অভিশাপে সরস্বতীর নদীরূপ পাওয়াই হচ্ছে সরস্বতীর পৃথিবীতে সরস্বতী নদী ও সরস্বতী দেবীরূপে প্রতিষ্ঠাত্রী হওয়ার তত্ত্ব।
সরস্বতী যে পরমেষ্ঠী বা ব্রহ্মার পত্নী, তার ইঙ্গিত আমরা পাই। অবশ্য সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার আবির্ভাব তখনো হয়নি। কিন্তু বাগেদবী ও সরস্বতীর অভিন্নতা স্পষ্ট নয়। ব্রাহ্মণে স্পষ্টভাবেই সরস্বতীকে বাগ্ বা বাক্যদেবী বলা হয়েছে।
সরস্বতী মূলত বৈদিক দেবী। বেদে কিন্তু সরস্বতী প্রধানত নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সরস শব্দের অর্থ জল। সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হলো জলবর্তী অর্থাৎ নদী।
বৃহস্পতি হচ্ছেন জ্ঞানের দেবতা, তিনি বাক্পতিও। ইন্দ্রও বাক্পতি। বৃহস্পতি-পত্নী সরস্বতীও জ্ঞানের দেবী। সব জ্ঞানের ভান্ডার তো ব্রহ্মা-বিষ্ণু আর মহেশ্বরের। তাদেরই শক্তিতে সরস্বতী জ্ঞানের দেবী। সরস্বতী নদীর তীরে যজ্ঞের আগুন জ্বেলে সেখানেই ঋষি লাভ করেছিলেন বেদ, ঋগমন্ত্র। সুতরাং সরস্বতী জ্ঞানের দেবী হিসেবেই পরিচিত হয়েছিলেন ধরাতে। দিনে দিনে সরস্বতী তাঁর অন্যান্য বৈশিষ্ট্য হারিয়ে কেবল বিদ্যাদেবী অর্থাৎ জ্ঞান ও ললিতকলার দেবীতে পরিণত হলেন।
বৈদিক জ্যোতিরূপা সরস্বতী ও নদী সরস্বতী সম্মিলিতভাবে জ্ঞানের দেবীরূপে পুরাণতন্ত্র ও সাহিত্যে বিপুল শ্রদ্ধা ও ভক্তির অধিকারিণী হয়েছেন। তিনি হিন্দু সংস্কৃতির বেড়া ডিঙিয়ে জৈন ও বৌদ্ধধর্মের পূজার আসনে অধিষ্ঠিতা হয়েছেন। সরস্বতীর আরাধনার ক্রমবিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর রূপকল্পনাও বহু বৈচিত্র্য লাভ করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেবীর বাহুর সংখ্যা অধিকতর হলেও সাধারণত তিনি চতুর্ভুজা, পদ্মাসনা, শুক্লাবর্ণা, শুভ্রবর্ণা, বীণা-পুস্তক, জপমালা, সুধাকলস্বনা, চন্দ্রশেখরা, ত্রিলোচনা। কখনো দেবী দ্বিভুজা। তন্ত্রে সরস্বতী বাগীশ্বরী-বর্ণেশ্বরী সারদা।
পুরাণ ও পুরাণোত্তর আধুনিককালে দেবী সরস্বতী বাক্য বা শব্দে অধিষ্ঠাত্রী বাগেদবীরূপে প্রসিদ্ধা। বৈদিক দেবী সরস্বতীর অন্য পরিচয় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় তিনি কেবল বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপেই সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। বৈদিক সরস্বতী বাগাধিষ্ঠাত্রী বা বাগেদবীরূপেও বর্ণিতা হয়েছেন। ঋগবেদে সরস্বতীর সঙ্গে বিদ্যাধিষ্ঠাত্রীত্বেও কোনো সম্পর্ক না থাকলেও অথর্ববেদে এবং ব্রাহ্মণে সরস্বতী বাগেদবী।
বর্তমানে সরস্বতী প্রায় সব জায়গায়ই দ্বিভুজা, তাঁর হাতে বীণা অপরিহার্য। বীণা অবশ্যই সংগীত ও অন্যান্য কলাবিদ্যার প্রতীক। অক্ষরমালা বা জপমালাও অধ্যাত্মবিদ্যার প্রতীক। শুকপাখিও বিদ্যা বা বাক্যের প্রতীক হিসেবেই স্বরস্বতীর হাতে শোভা বাড়াচ্ছে। আচার্য যোগেশচন্দ্র রায়ের মতে, ‘দ্বিভুজা বীণাপাণি সরস্বতী প্রতিমা গত ১৫০ বছরের মধ্যে কল্পিতা হয়েছে।’
আধুনিককালের সরস্বতীর বাহন হলো হাঁস। কাশ্মীরি পণ্ডিত কলহন বলেছেন, ‘সরস্বতী দেবী হংসরূপে ভেড়গিরি শৃঙ্গে দেখা দিয়েছিলেন। এরূপ ধারণা অত্যন্ত সংগত। হংসবাহনা সরস্বতীর প্রস্তরমূর্তিও প্রচুর পাওয়া যায়। এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে দেবীর এই উভচর বাহনটি তিনি ব্রহ্মার শক্তি হিসেবে ব্রহ্মার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। কিন্তু ব্রহ্মা বা সরস্বতী দেবীর বাহনটি পাখিবিশেষ নয়। বেদে এবং উপনিষদে হংস শব্দের অর্থ সূর্য। সূর্যের সৃজনী শক্তির বিগ্রহান্বিত রূপ ব্রহ্মা এবং সূর্যাগ্নির গতিশীল কিরণরূপা ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব শক্তি সরস্বতী দেবীর বাহন হয়েছেন হংস বা সূর্য অত্যন্ত সংগত কারণেই। তবে সিংহ ও মেষ সরস্বতী দেবীর আদি বাহন ছিল, যা জানা যায় বৈদিক সাক্ষ্য থেকে। পরবর্তীকালে দেবী দুর্গা সরস্বতী দেবীর কাছ থেকে সিংহ ও কার্ত্তিক কেড়ে নিলেন ময়ূর, সিংহ ও ময়ূর ছেড়ে দিয়ে সরস্বতী দেবী ব্রহ্মার শক্তি ব্রাহ্মণী হিসেবে বাহনটিকে চিরস্থায়ী মর্যাদা দিলেন।’
শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে, শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পূজা সম্পন্ন করা হয়। সরস্বতীর পূজা সাধারণ পূজার নিয়মানুসারেই হয়। তবে এই পূজায় কয়েকটি বিশেষ উপচার বা সামগ্রীর প্রয়োজন হয়। যথা অভ্র-আবির, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম ও যবের শীষ। পূজার জন্য বাসন্তী রঙের গাঁদা ফুলও প্রয়োজন হয়। লোকাচার অনুসারে, ছাত্রছাত্রীরা পূজার আগে কুল ভক্ষণ করেন না। পূজার দিন লেখা ও পড়া নিষেধ থাকে। যথাবিহিত পূজার পর লক্ষ্মী, নারায়ণ, লেখনী-মস্যাধার (দোয়াত-কলম), পুস্তক ও বাদ্যযন্ত্রেরও পূজা করার প্রথা প্রচলিত আছে। পূজা শেষে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার প্রথাটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের দল বেঁধে অঞ্জলি দিতে দেখা যায়।
নানা বিবর্তনের মাধ্যমে সরস্বতী দেবী আজ জ্ঞান, বিদ্যা ও ললিতকলার দেবী হিসেবে অধিষ্ঠিতা হয়েছেন। জায়গা করে নিয়েছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মনের মণিকোঠায়। আজ জ্ঞানের আলোতে আলোকিত করতে মন ও পৃথিবী পূজিত হচ্ছেন শুভ্রবর্ণা সরস্বতী। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, সরস্বতী পূজা করলে মনের অন্ধকার কেটে গিয়ে দেখা দেবে আলোর দ্যুতি। আর দ্যুতিতেই কেটে যাবে পৃথিবীর অকল্যাণের সবকিছু।
তারাপদ আচার্য্য: সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ।

No comments

Powered by Blogger.