দেখার ভেতরে বাইরেঃ জনগণমন প্রতিক্রিয়া by মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান
আমি যে বাড়িটির ভাড়াটিয়া, সেই বাড়িটির সামনের স্বল্প পরিসর রাস্তায় প্রায়ই বেশকিছু সাইকেল রিকশা দাঁড়িয়ে থাকে। এর মধ্যে চারটি রিকশা অর্থাত্ চারজন রিকশাচালক নিয়মিত। তারা বেশ সকালেই তাদের রিকশা নিয়ে এখানে চলে আসেন।
এখান থেকে ভাড়ায় যাত্রী নিয়ে বিভিন্ন দিকে যান, আবার ঘুরেফিরে এখানেই এসে বিশ্রাম নেন। প্রতিদিনই ছয়-সাতটি রিকশা এখানে পাওয়া যায়। তবে, আমরা কোথাও যেতে হলে, ওই নিয়মিত রিকশাগুলোর কোনোটিকে পেলে তাকেই ডাকি। এটাও লক্ষ্য করেছি, ওদের কেউ থাকলে নিজেরাই এগিয়ে আসেন এবং যে দিকেই যেতে চাই অস্বীকার করেন না নিয়ে যেতে। এই বাড়িটির কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য কিনা, কিংবা নির্মাণজনিত কোনো কারণে কিনা জানি না, নিচের রাস্তার স্বাভাবিক কথাবার্তাও চারতলার উপর থেকে স্পষ্ট শোনা যায়। রাতে তো মনে হয় একেবারে জানালার পাশে কেউ বা কারা কথা বলছে। বেশ কয়েকদিন আগের কথা, সময়টা দুপুর, জন ও যান সমাগম-যাতায়াত একটু কম। দুপুরের খাবার খেয়ে শোবার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে শিস বাজিয়ে একটি গানের সুর ভাঁজার শব্দ এলো কানে। খুব চেনা চেনা লাগল সুরটা। হয়তো একেবারে সঠিক হচ্ছে না বলে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল। দাঁড়িয়ে সঠিক গানটি নির্ণয়ের চেষ্টা করলাম। হঠাত্ শিস বন্ধ হয়ে লা-লা ধ্বনিতে একই সুর ভেসে এলো। রাস্তার দিকের বারান্দায় বেরিয়ে গিয়ে উপর থেকে ঝুঁকে দেখতে চাইলাম। দেখলাম, তখন তিনটি রিকশা দাঁড়ানো। দুটির চালক নিজেদের রিকশা পরিষ্কার করছেন। অন্যটিতে চালক যাত্রী আসনে বসে চালকের সিটের উপর পা তুলে দিয়ে পিঠটা পেছনে এলিয়ে। কারও মুখই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। তাই কে যে সুর ভাঁজছেন বোঝা গেল না। এরপর মাঝে মাঝেই এরকম শুনতে পাই। একই সুর, কখনও শিস বাজিয়ে, কখনও লা-লা ধ্বনিতে, কখনওবা অস্পষ্ট গুন-গুনানিতে। হঠাত্ একদিন স্পষ্ট হলো—আরে! এটা তো ভারতের জাতীয় সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘জনগণ মন অধিনায়ক...’। সত্যিই অবাক হলাম। কারণ, অন্যান্য রবীন্দ্র সঙ্গীতের মতো এই গানটি কখনও আমাদের দেশে গাওয়া হয় না। একজন রিকশাচালকের পক্ষে এই গানটি শোনা এবং তার সুর রপ্ত করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। প্রায় বললাম এজন্য যে, বিভিন্ন বেসরকারি টিভি চ্যানেলে বিভিন্ন শ্রমজীবী মানুষের মুখে বিচিত্র-বিচিত্র গান শুনে এটুকু বিশ্বাস জন্মেছে যে, কোনো স্তরের কোনো মানুষের পক্ষে কোনো কিছু একেবারে অসম্ভব বলে রায় দেয়া নিজের বোকামি প্রকাশ করার শামিল। তারপরও এ গানটি এদেশে গীত না হওয়ার কারণে—একজন রিকশা চালকের মুখে শিস বাজিয়ে লা-লা করে বা গুনগুনিয়ে গাওয়াটা অবাক করার মতোই। পরদিনই গায়ককে আবিষ্কার করলাম। হ্যাঁ নিয়মিত নন, এমনই একজন রিকশাচালক। আমি বাইরে থেকে ঘরে ফেরার জন্য রিকশাযোগে এসে বাসার সামনে নামতে নামতে লক্ষ্য করলাম চার-পাঁচ হাত সামনে ওপাশের বাড়ি থেকে পাচিল ডিঙ্গিয়ে ঝুঁকে পড়া কামরাঙ্গা গাছের ডালের ছায়ায় রিকশা দাঁড় করিয়ে, যাত্রী আসনে বসে তার নিজের আসনে পা তুলে দিয়ে পেছনে শরীর হেলিয়ে দিব্যি শিস বাজিয়ে চলেছেন জন গণমন গানটির সুরে। আমার রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে একটু দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর কৌতূহল দমন করতে না পেরে এগিয়ে গেলাম। কাছে যেতেই আমাকে দেখে হুড়মুড়িয়ে গান বন্ধ করে আধোশোয়া অবস্থা থেকে একেবারে নিচে নেমে দাঁড়াল। অপ্রস্তুত হাসিতে প্রশ্ন করল—‘যাইবেন?’ ‘তুমি’ সম্বোধনেই কথা বললাম তার সঙ্গে—বয়সের কারণে। কত বয়স হবে ছেলেটির? আঠারো-বিশ! হ্যাঁ, তার চেয়ে বেশি হবে না। তার প্রশ্নের উত্তরে বললাম—না, এই তো এলাম। তুমি শিস দিয়ে যে গানটি গাইছিলে এটা কোন গান জান? জবাবে নির্দ্বিধায় সে বলল—‘জানি স্যার, রবীন্দ সঙ্গীত।’ বললাম, রবীন্দ না রবীন্দ্র। তাছাড়া এটা ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। সে নির্বিকার এবং সেভাবেই বললো, ‘জানি স্যার, আমি তো জাইনা-শুইনাই গানডা শিখছি। প্রশ্ন করলাম, কোথা থেকে শিখেছো?—‘আমাগো বস্তির পাশেই যে ফ্ল্যাটটা আছে, ঐডায় একজন শিল্পী থাকে। পরায়ই আমার রিকশায় যায়। হেরে ধইরা হের কাছ থাইকা শিখছি। কথাগুলান খুব কঠিন, ঠিকমত মুখে আহেনা তাই গুনগুনাইয়া নাইলে সিটি বাছাইয়া গাই।’ এমন একটি কঠিন গান—যা সে ঠিকমত উচ্চারণ করতে পারে না, তা শেখার বাসনা তার কেন হলো সেই প্রশ্ন করতেই যে উত্তর সে দিল, তা সংক্ষেপে এমন—সে যে বস্তিতে থাকে তার সামনের একটি দোকানে একটা কেবল লাইনযুক্ত টেলিভিশন আছে। সেখানে টিভি দেখতে—এক রাতে একটা ভারতীয় চ্যানেলে দেখতে পায় একজন শিল্পী বসে বসে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি পরিবেশন করছেন। অনুষ্ঠানে যন্ত্রী ও অন্য শিল্পীরাও বসে আছেন। এটি তার কাছে তার জাতীয় সঙ্গীতের অসম্মান বলে মনে হয়েছে। তার তরুণ রক্তে এসেছে উত্তেজনা। সেই মুহূর্তেই সে সিদ্ধান্ত নেয়, ভারতের জাতীয় সঙ্গীত সে শিখবে এবং কেবল ‘বইয়া বইয়া না, দরকার হইলে চিত্রাইয়া চিত্রাইয়া’ গাইবে। তাই সে অনুসন্ধান শুরু করে। আমাকেও নাকি জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিল—কিন্তু সাহস পায়নি। অবশেষে সে তার যাত্রী এক শিল্পীর কাছে জেনেছে—‘আমাগোডাও রবীন্দ সঙ্গীত’ হেগোডাও রবীন্দ সঙ্গীত’; হেরা বইয়া বইয়া আমাগোডা গাইতে পারলে আমরা হেগোডা গাইতে পারুম না কেন?’ যুবক রিকশাচালকের প্রতিশোধস্পৃহাটা ভালো লাগেনি আমার, কিন্তু তার গভীর দেশপ্রেম ও আত্মমর্যাদাবোধ দেখে মনে মনে তাকে একটা স্যালুট না ঠুকে পারিনি। তার মুখে আবিষ্কার করেছি আমাদের জনগণ মন-চেতনার প্রতিক্রিয়া। তাকে শুধু বলেছি, অন্যকে অপমান করার নীচতা পরিহার করতে।
লেখক : কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
লেখক : কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments