পাকিস্তান-দুঃখের সমাবেশই আমার দেশ by তারিক আলী

পাকিস্তানের কথা মনে এলে আমার মনে একরাশ বেদনা এসে জমে। ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের বিখ্যাত কবিতা ‘আজ কি নাম’ এর কথাই মনে পড়ে, ‘একরাশ দুঃখের সমাবেশই আমার দেশ’। দেশটা খারাপ থেকে অধিকতর খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো মনে হয়, এর থেকে আর কতটা খারাপ হতে পারে পরিস্থিতি?


পাকিস্তানের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন প্রথমে সামরিক স্বৈরাচারের কবলে ছিল এবং আছে। বাড়তি যোগ হয়েছে এমন এক বেসামরিক সরকার, সম্ভবত পাকিস্তানের ইতিহাসে এর তুল্য দুর্নীতিবাজ আর আসেনি। জারদারির নির্লজ্জতায় আমার বুদ্ধিনাশ হওয়ার অবস্থা। কৃতকর্মের জন্য কোনো অনুতাপের চিহ্ন আপনি তাঁর মুখে পাবেন না। যত দিন আমেরিকা তাঁকে ক্ষমতায় রাখে, এত দিন যা করে এসেছেন তত দিন সেটাই করে যাবেন। এই হলো আজ পাকিস্তানের অবস্থা।

ইমরান খান ও আমেরিকা
এযাবৎকালের পাকিস্তানের সব সরকারই মার্কিনিদের পুতুল ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের তরুণেরা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার পেতে চান। ইমরান খান সেটা করতে পারবেন কি না, আমি জানি না। তাঁর আন্দোলনের মূলনীতি হলো, ক্রীড়নকের ভূমিকা থেকে বেরিয়ে এসে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্বাধীন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা। তাঁর রাজনৈতিক প্রচারণাতেও তিনি বলেছেন, পাকিস্তানের ৭০ শতাংশ মানুষ যুক্তরাষ্ট্রকে শত্রু বলে জানে। আগে এই শত্রু ছিল ভারত, এখন হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
তাহলেও ইমরান খানের প্রতি আমার সমর্থন শর্তহীন নয়। পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট আমলে নিলে ইমরান খানকে গুরুত্ব দিতেই হবে। এই ব্যক্তি ১৫ বছর ধরে দল তৈরির কাজ করছেন। তাঁকে নিয়ে সবাই যখন হাসাহাসি করছিল, সে সময়ই তিনি পাকিস্তানের বিপুলসংখ্যক মানুষের সমর্থন পেতে লাগলেন। মূলত যেসব মানুষ রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, তাঁরা ইমরানকে সমর্থন করছেন। তাই আমি মনে করি, তাঁকে ইতিবাচকভাবেই নিতে হবে। এর মানে এই নয় যে আমি যেমন পাকিস্তান চাই, তিনি তেমন পাকিস্তানের পক্ষে। আমি চাই পাকিস্তান সম্পূর্ণ সমাজতান্ত্রিক হোক। এ লক্ষ্যে না হলেও ইমরানের আন্দোলন মানুষের অধিকার নিয়ে। আর মানুষও প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল দুর্বৃত্তের হাত থেকে মুক্তি চায়। এরা সংঘবদ্ধ অপরাধী। মুসলিম লিগের শরিফ ভাইয়েরাই হোক আর পিপলস পার্টির জারদারি গংই হোক, টাকা বানানো ছাড়া রাজনীতিতে তাঁদের আর কোনো ধান্ধাও নেই, আগ্রহও নেই।
অনেকের প্রশ্ন, ইমরান কি তেহরিক-ই-তালেবানসহ এ ধরনের হঠকারী দলগুলোকে সমর্থন দিচ্ছেন? ইমরানের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে আমিও হাজির ছিলাম। সেখানে তিনি বলেছিলেন, তালেবান বা তেহরিক-ই-তালেবানের সমর্থক তিনি মোটেই নন। তাঁর মনে হয়েছে, আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসন এবং পাকিস্তানে ড্রোন হামলার কারণে তালেবানরা জনপ্রিয় হচ্ছে। এবং তিনি চান, এই আগ্রাসন ও হামলার অবসান হোক। বলতেই হবে, ইমরান খান মুক্তমনা মুসলমান এবং আজ মিসর ও তিউনিসিয়ায় যাঁরা ক্ষমতায় রয়েছেন, তাঁদের থেকে তিনি অনেক গুণ বেশি উদারচেতা মানুষ।

পাঞ্জাবি প্রাধান্য
পাকিস্তানি রাজনীতিতে পাঞ্জাবি প্রাধান্য আরেকটা সমস্যা। এটাই পাকিস্তানের ফেডারেল রাষ্ট্র হওয়ার স্বপ্নকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে বলা হয়। তবে ফেডারেল পাকিস্তানের স্বপ্নটা ধূলিসাৎ হয় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর। সেটাই ছিল ফেডারেল পাকিস্তানের স্বপ্নের অন্তিম মুহূর্ত। বাংলাদেশের আলাদা হয়ে যাওয়ার পর যা থাকল, তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পাঞ্জাবিরাই সবকিছুর ওপর জেঁকে বসল। এটাই এখন এখানকার বাস্তবতা। এটা নিয়ে আমাদের বিশেষ কিছুই করার নেই। পাকিস্তান এখন খুবই মিশ্র জনসংখ্যার দেশ। করাচি এখন পাঞ্জাবি, সিন্ধি, পশতুন এবং ভারত থেকে আসা শরণার্থীদের শহর। বড় বড় নগরের সামাজিক জনবিন্যাসও বদলে যাচ্ছে। একই বাস্তবতা দেখা যাবে সিন্ধু ও বেলুচিস্তানেও। মূল বৈশিষ্ট্যটা এই: যেকোনো এলাকায় সেখানকার জাতিগতভাবে আদিবাসিন্দা নন এমন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। গোটা দুনিয়াতেও এমনটাই ঘটছে। কোনো কোনো জাতীয়তাবাদী যে রকম জাতিগত শুদ্ধতা দাবি করেন, সেটা বজায় রাখা এখন কঠিন।

সেনাবাহিনীর দাপট
এ বিষয়ে তিলমাত্র সন্দেহ নেই, পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষ আর সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করতে দিতে চায় না। এ ব্যাপারে তারা সম্পূর্ণ নিরাশ। সেনাবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বের দুর্নীতির কথা তারা ভালো করেই জানে। কয়েক দশক আগে এই দুর্নীতি প্রথমে শুরু হয়েছিল সেনাবাহিনীর একদম ওপরের স্তরে। তার পর থেকে এটা চলতেই আছে। ক্ষমতায় এলে তাদের এই দুর্নীতি আরও বাড়ে। অস্ত্র কেনার নামে দুর্নীতি হয়, এমনকি আইনের নামেও সরকারিভাবে তারা বিরাট পরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকে। তারা এখন দেশের অভিজাত বৃত্তের অংশ। কিন্তু মানুষ তাদের মোটেই ক্ষমতায় দেখতে চায় না। আমার ধারণা, বেশির ভাগ মানুষ নির্বাচিত সরকারেরই পক্ষে। তাহলেও এমন সময় আসে—এখন যেমন এসেছে—যখন একদল মানুষ বলা শুরু করে, সম্ভবত সেনাবাহিনীই ভালো ছিল। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নির্বাচিত সরকার চায়।
মানুষ সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে দেখতে না চাইলেও সেনাবাহিনী কিন্তু রাজনীতিবিমুখ নয়। ‘তুরস্কের সেনাবাহিনীর মতো করে তারা রাষ্ট্রের শীর্ষেবিশেষ একটা অবস্থানের নিশ্চয়তা চায়। বহুদিন ধরে তারা এ রকম ক্ষমতার চর্চাই করে এসেছে। তারা কেবল নিজেদের যুদ্ধের মুখে দেশ রক্ষাকারী হিসেবেই ভাবে না; তারা মনে করে দেশে একমাত্র তারাই সবচেয়ে সংগঠিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। অতএব, দেশ চালানোয় তারাই সবচেয়ে যোগ্য। শীর্ষ জেনারেলদের অনেকেরই ভাবনাটা এমন এবং তাঁরা দেশ চালিয়েছেনও। কিন্তু যতবারই তাঁরা শাসনে এসেছেন, ততবারই বিপর্যয় সৃষ্টি করেছেন। আইয়ুবের স্বৈরতন্ত্র পাকিস্তান ভাঙার জন্য দায়ী। জেনারেল জিয়ার স্বৈরতন্ত্রে দেশে ইসলামি চরমপন্থা জোরদার হয়। আমরা দেখতে পাই, সেনাবাহিনীর শীর্ষপর্যায় থেকে জিহাদিদের তহবিল জোগানো হচ্ছে, মদদ দেওয়া হচ্ছে। এখনো আমরা তাদের তৈরি বিপর্যয় থেকে বাঁচার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এরপর আমরা পেলাম জেনারেল মোশাররফকে। তিনিও এসেছিলেন একঝাঁক প্রতিশ্রুতি নিয়ে, কিন্তু শেষ হলেন গিয়ে বিচার বিভাগের সঙ্গে তুমুল ঝগড়াঝাঁটি করে। পরিণতিতে তাঁকে অসম্মানজনকভাবে বিদায় নিতে হলো।
পাকিস্তানের জন্য সেনাবাহিনী কখনোই মঙ্গল আনেনি, ভবিষ্যতেও আনবে না।

ভারতের দি আউটলুক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ, অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ
তারিক আলী: পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবী ও লেখক।

No comments

Powered by Blogger.