বাঘা তেঁতুল-নরমূত্র by সৈয়দ আবুল মকসুদ
ভারতের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই তাঁর মূত্র সেবনের কথা প্রকাশ করে দিয়ে বিশ্বব্যাপী হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। মূত্রথেরাপি নাকি সর্বরোগহর। দীর্ঘায়ু হতে সাংঘাতিক সহায়ক। তবে পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই মরতে চাইবে, তবু মূত্র পান করে আরও কয়েক দিন বেশি বাঁচার চেষ্টা করবে না।
কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, নরমূত্র শুধু মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী নয়, উদ্ভিদের পুষ্টি জোগানোর ক্ষমতা তার চমৎকার।
জৈব সার প্রস্তুত করতে মূত্রকে কাঁচামাল হিসেবে খুঁজে পেয়েছেন ব্রিটেনের ক্যামব্রিজশায়ারের মালীরা। তবে সব মানুষের মূত্র হলে হবে না, প্রয়োজন পুরুষের মূত্র। পুরুষতান্ত্রিক পৃথিবীতে বিধাতা আবারও পুরুষের প্রাধান্য প্রমাণ করে দিলেন। এখন নারীনেত্রীরা প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে রাস্তায় নামার একটি ইস্যু পেয়ে গেলেন।
ক্যামব্রিজশায়ারের জাতীয় ট্রাস্টের ৪০০ একর বাগান এলাকায় একটি মিলনায়তনে প্রস্রাবের জন্য তৈরি করা হয়েছে তিন মিটার দীর্ঘ একটি স্থান। সেখান থেকে নলের মাধ্যমে মূত্র চলে যাবে বাগানের সার প্রস্তুত করার জন্য স্তূপ করে রাখা বিভিন্ন জৈব পদার্থে। জৈব সার প্রস্তুত হবে ওই মূত্র মিশিয়ে।
বাগানের প্রধান মালী তাঁর পুরুষ সহকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, বেগ পাওয়া মাত্র তাঁরা যেন ওই নির্দিষ্ট প্রস্রাবখানায় যান। তাঁরা হিসাব কষে দেখেছেন, একজন পুরুষ বছরে অন্তত এক হাজারবার সেখানে প্রস্রাব করবেন। প্রধান মালী বিবিসিকে জানিয়েছেন, মহিলাদের চেয়ে পুরুষদের প্রস্রাবে এসিডের মাত্রা কম। সে জন্য পুরুষ সহকর্মীদের প্রতিই তাঁর এই আহ্বান।
বর্তমান সংকটময় পৃথিবীতে পুরুষের প্রস্রাব এক নতুন দিনবদলের সূচনা করল। সার-সংকট আমাদেরও আছে। জৈব সারের অভাব আরও বেশি। মতিয়া আপা কৃষকদের কোনো রকমে শান্ত রেখেছেন। পাওয়ার পাম্প চালানোর জন্য বিদ্যুৎ ঠিকমতো পাওয়া না গেলেও কৃষক মোটামুটি সার পাচ্ছেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য ক্যামব্রিজশায়ার থেকে পাওয়া এটি সুখবরই বটে।
তবে পৃথিবীর যেকোনো দেশে নরমূত্রের অভাবে জৈব সার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলেও বাংলাদেশে কোনো সমস্যা হবে না, তা আমি হলফ করে বলতে পারি। প্রতিদিন ঢাকার রাস্তায় অমূল্য নরমূত্রের যে অপচয় হয়, তা দেখলে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, আমেরিকার মানুষের চোখে পানি আসবে। শুধু একুশের বইমেলার সময় চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত পুব পাশের ফুটপাতে জৈব সার প্রস্তুতের যে পরিমাণ কাঁচামাল নষ্ট হচ্ছে, তা লন্ডন-নিউইয়র্কের মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না।
প্রচুর পানি ও শীতল পানীয় শুধু বাংলাদেশের পুরুষেরাই খায়। তাই রাস্তায় বের হওয়া মাত্র তাদের বেগ হয়। বাংলা একাডেমীর চত্বরে পর্যাপ্ত পানির অভাবে ধুলা ওড়ে, কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউর ফুটপাত সয়লাব। ফুটপাতের কাঁচামাল এসে পড়ছে রাস্তায়। কার সাধ্যি ওই ফুটপাতে হাঁটে। বইমেলায় আসা মহিলারা হাঁটু পর্যন্ত শাড়ি উঁচিয়ে কোনো রকমে চলতে পারলেও, তাঁদের ছোট ছেলেমেয়েদের উপায় কী? তারা তাদের জুতা-মোজা ও কাপড়চোপড় নষ্ট করে ঘরে ফিরে যাচ্ছে।
মূত্রত্যাগের মতো ব্যক্তিগত শারীরিক ব্যাপার যে একটু আড়াল-আবডাল বা গোপনীয়তা দাবি করে, তা বাংলার পুরুষ মানতে রাজি নয়। একটু হেঁটে ঝোপঝাড়ের আড়ালে গিয়েও কাজটি করা যায়। কিন্তু কেন যাবে? কার পরোয়া? ফুটপাত সরকারি জায়গা। প্রত্যেক নাগরিকের তাতে সমান অধিকার। যেখানে গিয়ে প্রকৃতির ডাক আসে, সেখানেই সটান দাঁড়িয়ে যায়। একা নয়, সারি সারি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।
আধুনিক শিল্পকলা ও সাহিত্যে যেমন অশ্লীলতা বলে কিছু নেই, জীবনেই বা তা থাকবে কেন? জলভার মুক্তির মুহূর্তে বাংলার পুরুষ তাঁর শরীরটিকে নানা ভঙ্গিতে বা অঙ্গবিন্যাসে স্থাপন করে। নিজের কাপড় নষ্ট হবে, মূত্রের ছিটা লাগবে বলে দুই পা ফাঁক করে দাঁড়ায়। একটু বেশি শরমিন্দা যারা, তারা বসে করে। কেউ বা বসাও না, দাঁড়ানোও না—এর মাঝামাঝি একটা ভঙ্গি। হয়তো ওই সময়ই মোবাইল ফোন আসে। কথা বলাও জরুরি। দুটো কাজই একসঙ্গে চলে। ওপার থেকে জানতে চায়, ফোনওয়ালা কী করছে। প্রস্রাবকারী বলে, ‘আমি অহন মতিঝিলে বাসে।’
পিঠের কাছ দিয়ে সালোয়ার কিছুটা উঁচিয়ে নাকে রুমাল চেপে দুটি মেয়ে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে তাদেরও একটু দ্যাখে কেউ কেউ। অথবা ফোনেই চিৎকার করে এমন যৌনতামিশ্রিত অশ্লীল বাক্য বলে, যা শুনে মেয়ে দুটির বমি আসে।
মানববন্ধন ও আমরণ অনশন জীবনে কম করিনি। ইচ্ছে হচ্ছে, কয়েকজনকে নিয়ে শাহবাগে দাঁড়াই অথবা মাটিতে বসে সত্যাগ্রহ করি। ব্যানারে লেখা থাকবে: ‘২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নজরুল এভিনিউর ফুটপাত মূত্রমুক্ত চাই’। তবে পুলিশি অ্যাকশন ছাড়া বাংলার মাটি মূত্রমুক্ত হবে না।
অজানা বীরত্বের দাবি করে চাকরি-বাকরিতে শুধু নিজের নয়, নাতি-নাতনি ও চৌদ্দ পুরুষের কোটা বাগিয়ে নিলেই বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি এক তিল এগোবে না। নিত্যদিনের আচরণে প্রমাণ করতে হবে, বাংলার মানুষ সভ্য না অসভ্য।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
জৈব সার প্রস্তুত করতে মূত্রকে কাঁচামাল হিসেবে খুঁজে পেয়েছেন ব্রিটেনের ক্যামব্রিজশায়ারের মালীরা। তবে সব মানুষের মূত্র হলে হবে না, প্রয়োজন পুরুষের মূত্র। পুরুষতান্ত্রিক পৃথিবীতে বিধাতা আবারও পুরুষের প্রাধান্য প্রমাণ করে দিলেন। এখন নারীনেত্রীরা প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে রাস্তায় নামার একটি ইস্যু পেয়ে গেলেন।
ক্যামব্রিজশায়ারের জাতীয় ট্রাস্টের ৪০০ একর বাগান এলাকায় একটি মিলনায়তনে প্রস্রাবের জন্য তৈরি করা হয়েছে তিন মিটার দীর্ঘ একটি স্থান। সেখান থেকে নলের মাধ্যমে মূত্র চলে যাবে বাগানের সার প্রস্তুত করার জন্য স্তূপ করে রাখা বিভিন্ন জৈব পদার্থে। জৈব সার প্রস্তুত হবে ওই মূত্র মিশিয়ে।
বাগানের প্রধান মালী তাঁর পুরুষ সহকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, বেগ পাওয়া মাত্র তাঁরা যেন ওই নির্দিষ্ট প্রস্রাবখানায় যান। তাঁরা হিসাব কষে দেখেছেন, একজন পুরুষ বছরে অন্তত এক হাজারবার সেখানে প্রস্রাব করবেন। প্রধান মালী বিবিসিকে জানিয়েছেন, মহিলাদের চেয়ে পুরুষদের প্রস্রাবে এসিডের মাত্রা কম। সে জন্য পুরুষ সহকর্মীদের প্রতিই তাঁর এই আহ্বান।
বর্তমান সংকটময় পৃথিবীতে পুরুষের প্রস্রাব এক নতুন দিনবদলের সূচনা করল। সার-সংকট আমাদেরও আছে। জৈব সারের অভাব আরও বেশি। মতিয়া আপা কৃষকদের কোনো রকমে শান্ত রেখেছেন। পাওয়ার পাম্প চালানোর জন্য বিদ্যুৎ ঠিকমতো পাওয়া না গেলেও কৃষক মোটামুটি সার পাচ্ছেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য ক্যামব্রিজশায়ার থেকে পাওয়া এটি সুখবরই বটে।
তবে পৃথিবীর যেকোনো দেশে নরমূত্রের অভাবে জৈব সার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলেও বাংলাদেশে কোনো সমস্যা হবে না, তা আমি হলফ করে বলতে পারি। প্রতিদিন ঢাকার রাস্তায় অমূল্য নরমূত্রের যে অপচয় হয়, তা দেখলে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, আমেরিকার মানুষের চোখে পানি আসবে। শুধু একুশের বইমেলার সময় চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত পুব পাশের ফুটপাতে জৈব সার প্রস্তুতের যে পরিমাণ কাঁচামাল নষ্ট হচ্ছে, তা লন্ডন-নিউইয়র্কের মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না।
প্রচুর পানি ও শীতল পানীয় শুধু বাংলাদেশের পুরুষেরাই খায়। তাই রাস্তায় বের হওয়া মাত্র তাদের বেগ হয়। বাংলা একাডেমীর চত্বরে পর্যাপ্ত পানির অভাবে ধুলা ওড়ে, কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউর ফুটপাত সয়লাব। ফুটপাতের কাঁচামাল এসে পড়ছে রাস্তায়। কার সাধ্যি ওই ফুটপাতে হাঁটে। বইমেলায় আসা মহিলারা হাঁটু পর্যন্ত শাড়ি উঁচিয়ে কোনো রকমে চলতে পারলেও, তাঁদের ছোট ছেলেমেয়েদের উপায় কী? তারা তাদের জুতা-মোজা ও কাপড়চোপড় নষ্ট করে ঘরে ফিরে যাচ্ছে।
মূত্রত্যাগের মতো ব্যক্তিগত শারীরিক ব্যাপার যে একটু আড়াল-আবডাল বা গোপনীয়তা দাবি করে, তা বাংলার পুরুষ মানতে রাজি নয়। একটু হেঁটে ঝোপঝাড়ের আড়ালে গিয়েও কাজটি করা যায়। কিন্তু কেন যাবে? কার পরোয়া? ফুটপাত সরকারি জায়গা। প্রত্যেক নাগরিকের তাতে সমান অধিকার। যেখানে গিয়ে প্রকৃতির ডাক আসে, সেখানেই সটান দাঁড়িয়ে যায়। একা নয়, সারি সারি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।
আধুনিক শিল্পকলা ও সাহিত্যে যেমন অশ্লীলতা বলে কিছু নেই, জীবনেই বা তা থাকবে কেন? জলভার মুক্তির মুহূর্তে বাংলার পুরুষ তাঁর শরীরটিকে নানা ভঙ্গিতে বা অঙ্গবিন্যাসে স্থাপন করে। নিজের কাপড় নষ্ট হবে, মূত্রের ছিটা লাগবে বলে দুই পা ফাঁক করে দাঁড়ায়। একটু বেশি শরমিন্দা যারা, তারা বসে করে। কেউ বা বসাও না, দাঁড়ানোও না—এর মাঝামাঝি একটা ভঙ্গি। হয়তো ওই সময়ই মোবাইল ফোন আসে। কথা বলাও জরুরি। দুটো কাজই একসঙ্গে চলে। ওপার থেকে জানতে চায়, ফোনওয়ালা কী করছে। প্রস্রাবকারী বলে, ‘আমি অহন মতিঝিলে বাসে।’
পিঠের কাছ দিয়ে সালোয়ার কিছুটা উঁচিয়ে নাকে রুমাল চেপে দুটি মেয়ে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে তাদেরও একটু দ্যাখে কেউ কেউ। অথবা ফোনেই চিৎকার করে এমন যৌনতামিশ্রিত অশ্লীল বাক্য বলে, যা শুনে মেয়ে দুটির বমি আসে।
মানববন্ধন ও আমরণ অনশন জীবনে কম করিনি। ইচ্ছে হচ্ছে, কয়েকজনকে নিয়ে শাহবাগে দাঁড়াই অথবা মাটিতে বসে সত্যাগ্রহ করি। ব্যানারে লেখা থাকবে: ‘২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নজরুল এভিনিউর ফুটপাত মূত্রমুক্ত চাই’। তবে পুলিশি অ্যাকশন ছাড়া বাংলার মাটি মূত্রমুক্ত হবে না।
অজানা বীরত্বের দাবি করে চাকরি-বাকরিতে শুধু নিজের নয়, নাতি-নাতনি ও চৌদ্দ পুরুষের কোটা বাগিয়ে নিলেই বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি এক তিল এগোবে না। নিত্যদিনের আচরণে প্রমাণ করতে হবে, বাংলার মানুষ সভ্য না অসভ্য।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments