বিবর্ণ সমাজচিত্রের নানা দিক by নিয়াজ আহম্মেদ

সমাজে দরিদ্র, অসহায় মানুষের দুঃখকষ্টের শেষ নেই। জীবনের প্রতি পদক্ষেপে তাদের প্রচণ্ড সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়। কখনো কখনো বেঁচে থাকার নূ্যনতম অবলম্বনের জন্য মৃত্যুবরণও করতে হয়। প্রথমে তাদের অন্নের সন্ধানে বের হতে হয়। দুমুঠো ভাতের সন্ধান করতে তাদের কত কিছুই না করতে হয়।


এর পর আশ্রয় নিতে হয় ফুটপাত কিংবা কোনো বস্তিতে। কেউ কেউ এর চেয়ে একটু ভালো জায়গায় থাকতে পারে, কিন্তু সে জন্য কষ্টও কম করতে হয় না। শিক্ষার কথা বাদই দিলাম, নূ্যনতম স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত তারা। বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়ার চিন্তাও করতে পারে না। সরকারি যে সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, সেখানেও মেলে না স্বাস্থ্যসেবা। যদিও-বা মেলে তাও হাসপাতালের করিডর ছাড়া অন্য কোথাও নয়। ডাক্তার হয়তো মাঝেমধ্যে আসেন, কিন্তু নার্সের দেখা পাওয়া দুষ্কর। আর ওষুধের বেশির ভাগই বাইরে থেকে কিনতে হয়। অথচ সরকারি বরাদ্দ একেবার কম নয়। কোথায় যায় সে ওষুধ? কেউ খোঁজখবর রাখেন না।
এ তো গেল বেঁচে থাকার নূ্যনতম চাহিদার কথা। মানুষ বাঁচে সমাজে, সমাজের মধ্যে, সমাজের মানুষের মধ্যকার আন্তক্রিয়ার মাধ্যমে। একটি সমাজে একা বসবাস করা, আর মৃত্যুবরণ করা প্রায় সমান। সমাজে অনেক সময় গরিবের মৃত্যুর কারণ জানা কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। এখানে হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বেশি মাত্রায় লক্ষ করা যায়। প্রথমে বিশ্লেষণে আসি সমাজে একা বসবাস করার প্রসঙ্গে। কেউই একাকী বসবাস করতে চায় না। কেনইবা চাইবে, মানুষ একা থাকতে পারে কি? কিন্তু কখনো কখনো সমাজপতিরা তাদের একা থাকতে বাধ্য করে। সমাজ যেন তাদের কেনা জায়গা, যেখানে তারা তাদের মতো করে এটিকে লালন-পালন করবে। বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি পরিবারকে একঘরে করে রাখা হয়। একটি মেয়ের সঙ্গে এক ছেলের অবৈধ সম্পর্কের অপরাধকে কেন্দ্র করে পরিবারটিকে একঘরে করে রাখা হয়। সমাজপতিরা খুব যে প্রভাবশালী, তা কিন্তু নয়। কিন্তু তারা সালিসের মাধ্যমে রায় দিয়ে চলেছে। গ্রামবাসী মেনেও নিচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো সাহস কারো মধ্যে লক্ষ করা যায় না। স্থানীয় প্রতিনিধি, পুলিশ প্রশাসনের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। মাত্র কয়েক দিন আগে একই রকম ঘটনা ঘটে রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলায়, সেখানে বাউলদের তওবা পড়ানো হয় এবং দাড়ি-গোঁফ কেটে দেওয়া হয়। ধর্র্মের দোহাই দিয়ে তথাকথিত সমাজপতিদের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের অবসানের কোনো পথ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও সমাজপতিদের এ রকম দৌরাত্ম্য আমাদের হতাশ করে। আমরা কি পারি না এদের ঠেকাতে? আমরা যাতে অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ে তুলতে না পারি, সে জন্য বাউলদের ওপর আক্রমণ করা হয়।
হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতা আমরা কমবেশি লক্ষ করি। সত্য উদ্ঘাটন করা খুব কঠিন, আর গরিবদের বেলায় এটি আরো কঠিন। গরিবদের জীবনের মূল্য খুবই কম। তারা পায় না ন্যায়বিচার, এমনকি মৃত্যুর রহস্যও জানতে পারে না। শুধু ভাত-কাপড়ের জন্য গরিব ঘরের মেয়েরা ধনীদের বাসায় কাজ করে। কী তাদের ভবিষ্যৎ? পান থেকে চুন খসলে তাদের ওপর চলে নির্যাতন। কখনো কখনো নির্যাতনের মাত্রা সহ্য করতে না পেরে কেউ কেউ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। কিন্তু সংখ্যায় তারা খুবই কম। তাদের মেরে এমন নাটক করা হয়, যেন তারা আত্মহত্যা করেছে। সমাজের বিত্তশালী এ লোকগুলোর কাছে গরিব-অসহায় মানুষের কোনো মূল্যই নেই। এদের মধ্যে রয়েছে, সরকারের বড় বড় কর্মকর্তা কিংবা সমাজের অর্থবিত্তের মালিক ব্যক্তিরা। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার সাহস পর্যন্ত পান না দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। তাদের ক্ষমতা এতই বেশি যে তারা হুমকির মাধ্যমে গরিবদের মুখ বন্ধ করে দেয়। ক্ষমতার দাপট এত বেশি যে সংবাদপত্রের পাতায় আমাদের সাংবাদিক বন্ধুরা সুন্দরভাবে ঘটনাকে তুলে ধরেন, যেখানে বিভিন্ন ব্যক্তির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থাকে।
একটি সমাজে যখন আইনের শাসন পূর্ণভাবে থাকে না, তখন সমাজে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যায়। একজন গরিব যখন পেটের দায়ে চুরি করে, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের তৎপর হতে দেখা যায়, এমনকি অপরাধ না করলেও তৎপর হতে দেখা হয়। তাই তো দেখি আসামি ধরতে গিয়ে নিরীহ এক পরীক্ষার্থীকে পায়ে গুলি করায় তাকে পা হারাতে হয়েছে। আর যখন সমাজপতিরা ফতোয়া দিয়ে একঘরে করে রাখে কিংবা হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়, তখন আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে তৎপর হতে দেখা যায় না। হয়তো তাদের সামর্থ্য নেই কিংবা তারাও নিজেদের বিত্তশালীদের কাতারে চিন্তা করে। কোনটি ঠিক? প্রথমটি, নাকি দ্বিতীয়টি? কে গরিবদের পক্ষে দাঁড়াবে?

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
neayahmed_2002@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.