অরণ্যে রোদন-ভাবিয়া করিও কাজ... by আনিসুল হক
প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ। এই ধন্যবাদটি তাঁর প্রাপ্য। তিনি একধরনের সাহসিকতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর হবে না, এটা নিজে সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা করেছেন।
আমাদের দেশে সাধারণ নিয়ম হলো, নিজের ভুল কেউ নিজে বুঝতে পারে না, সমালোচনার মুখেও ভুলটাকে ঠিক বলে আঁকড়ে ধরে থাকা হয় এবং যার ফলে একটার পর একটা ভুল ঘটে যেতেই থাকে। জনগণের ক্ষোভকে বিরোধী দল বা ষড়যন্ত্রকারীদের চক্রান্ত বলে ক্ষমতাবানদের একটা ধারণা দেওয়া হয় এবং সেই ভুল বুঝটাকেই ধারণ করে থেকে তাঁরা বিপদ বাড়াতে থাকেন। অধিকতর বিপদ ঘটে যাওয়ার আগেই এলাকার জনগণ যা চায় না, তা তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার মতো আত্মঘাতী ঘটনা থেকে শেখ হাসিনা যে সরে আসতে পেরেছেন, এ জন্য তিনি ধন্যবাদ পাবেন।
নিজের আমলনামা মূল্যায়ন করুন
শেখ হাসিনার সরকার একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপি এতটা ভালো করবে, হয়তো তা খোদ বিএনপি-নেতাদেরও অকল্পনীয় ছিল। দলের সাংগঠনিক অবস্থা ভালো নয়। চার বছর আগে যখন তারা ক্ষমতায় ছিল, তখন তারা এত বেশি রকমের বাড়াবাড়ি ও অন্যায় করেছে, দেশের মানুষের পক্ষে সেসব ভুলে যাওয়া কঠিন। তাদের গুরুত্বপূর্ণ নেতা/মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে জঙ্গি লালনের, এমনকি শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলার পেছনেও বিএনপির বা তখনকার সরকারের উচ্চপর্যায়ের লোকজন জড়িত বলে খবর বের হচ্ছে। তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানের নানা কীর্তিকলাপের স্মৃতি মানুষের মন থেকে সহজে মুছে যাওয়ার নয়। এই সেদিনই খবর বেরোল, আরাফাত রহমানের পাচার করা টাকা রাখার জন্য সিঙ্গাপুরে একজনের শাস্তি হয়েছে। অর্থাৎ গত সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের হাতে কলঙ্কের এত দুর্গন্ধ যে, আরব দেশের সব সুগন্ধিও তা আড়াল করতে পারবে না। তা সত্ত্বেও সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাসের এবং বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির যে লক্ষণ পৌর নির্বাচনের ফলে বেরিয়ে এল, তা সরকারের ও সরকারি দলের নীতিনির্ধারকদের গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার। বিএনপির ডাকা গতকালের হরতালটি সম্পূর্ণ অকারণ ও অগ্রহণযোগ্য, সেটা সহজবোধ্য। কিন্তু সরকারি নীতিনির্ধারকদের লক্ষ করা উচিত, বিএনপির মিছিল ও সভায় লোকসমাগম বৃদ্ধি পাচ্ছে কেন?
বাংলাদেশের একটা সাধারণ নিয়ম হলো, সরকার খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা হারায়। কিন্তু ২০০১-০৬ মেয়াদে বিএনপিওয়ালারা যে ভয়াবহ পর্যায়ের অপকর্ম করে রেখেছেন, তার পরেও তাঁদের দ্রুত গ্রহণযোগ্যতা লাভের একটাই মানে, দেশের মানুষ সরকারের ও সরকারি দলের পারফরম্যান্সে খুশি নয়।
সরকারের কতগুলো ব্যর্থতা তো খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে। জিনিসপাতির দাম খুব বেড়ে গেছে। শেয়ার মার্কেটের সঙ্গে নাকি ৩০ লাখ লোক জড়িত, তার মানে ৩০ লাখ পরিবার এই মার্কেটের পতনের ফলে সরকারের ওপরে অখুশি হতে বাধ্য। এই ৩০ লাখ পরিবার গ্রামগঞ্জে থাকে না, তারা পৌর এলাকাতেই থাকে, তাদের হতাশার প্রতিফলন ভোটের বাক্সে পড়তে বাধ্য। শীতকালে বিদ্যুতের সমস্যা হয়তো কম, কিন্তু সামনের গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ-সংকট যদি কমানো না যায়, তাহলে তা বড় একটা ধাক্কা হয়ে আসবে। বিদ্যুতের সঙ্গে আসবে পানির সমস্যা, আর আছে প্রকট গ্যাস-সমস্যা। যানজট তো লেগেই আছে। কিন্তু এসবের চেয়েও মানুষের মনে সৃষ্ট হতাশার বড় কারণ দলীয় নেতা-কর্মীদের বাড়াবাড়ি। ছাত্রলীগসহ নানা সরকারি সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, টেন্ডারবাজি, ভর্তি ও নিয়োগ-বাণিজ্য, দলীয়করণ এবং সন্ত্রাস। স্থানে স্থানে গডফাদারও তৈরি হচ্ছে বলে খবর আসছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো নয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে সরকারের জনপ্রিয়তা আরও কমে যাবে। পাঁচ বছর শেষে নির্বাচনের ফল কী হবে, সেটা আগামী তিন বছরে সরকারের পারফরম্যান্সের ওপর নির্ভর করছে। একটা কথা তো সহজবোধ্য, এখন সরকার যেভাবে দেশ চালাচ্ছে, সেভাবে চললে সরকারের জনপ্রিয়তা আরও কমে যাবে এবং অনন্যোপায় ভোটাররা শেষতক বিএনপিকেই বেছে নিতে বাধ্য হবে। এ অবস্থায় সরকারের নিজেদের আমলনামা একবার পুনর্বিচার করে দেখা উচিত। এখনো সময় আছে। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার-এ প্রকাশিত দুটি জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, সরকারের জনপ্রিয়তা গত বছরের তুলনায় কমলেও এখনো তা বিএনপির চেয়ে বেশি।
সরকারকে যে তার আচার-আচরণ পাল্টাতে হবে, শুধু কথা নয়, কাজের মাধ্যমে মানুষের চিত্ত জয় করতে হবে, সরকার কি আদৌ বুঝতে পারছে?
অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের সাফল্য বেশ প্রশংসনীয়। যেমন, কৃষি ও শিক্ষাক্ষেত্রে। কিন্তু অর্থনীতি ও বাণিজ্য খাত ঠিকভাবে চলছে কি? কিন্তু তারও চেয়ে বড় কথা, আওয়ামী লীগ আসলে সরকার খুব খারাপ চালায় না, তার প্রধান সমস্যা তার খাসলতে, তার আচার-আচরণ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে। একটা ছোট কিন্তু লাগসই উদাহরণ হাতের কাছেই আছে। আড়িয়ল বিলের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের কৃতিত্ব সরকার কেন খালেদা জিয়াকে দিতে গেল। বিএনপির মিছিলে লোক বাড়ছে বটে, কিন্তু আড়িয়ল বিল এলাকার মানুষ নিজেদের ভিটেমাটি-জমিজিরেত রক্ষার জন্য যে মরণপণ লড়াইয়ে নেমেছিল, যে তীব্রতা ও বিস্তার ছিল সেসব মিছিল-সমাবেশে, তার নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা, অবস্থান, ত্যাগ-স্বীকারব্রত বিএনপির নেতৃত্বের পক্ষে অর্জন করা অসম্ভব। আর হাজার হাজার অজ্ঞাতনামা মানুষের সঙ্গে এক নম্বর আসামির নাম হিসেবে খালেদা জিয়ার নামটা দিতে গেলেন যে পিপি, যিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি, তিনি যে বিএনপির হাতে একটা অপ্রয়োজনীয় ইস্যু তুলে দিলেন, সেটা কি সরকার বুঝতে পেরেছে? (তা সত্ত্বেও আমরা বলব, বিএনপি হরতাল ডেকে অত্যন্ত অন্যায় করেছে। আর বিএনপি কেবল খালেদা জিয়ার বাড়ি আর মামলা নিয়ে হরতাল ডাকে কেন? জনগণ কেবল সরকারের পারফরম্যান্স খেয়াল করে না, বিরোধীদের প্রতিও লক্ষ রাখে)।
বড় বিমানবন্দরের আইডিয়াটা কিন্তু ড. ইউনূসের
এবার আসি আমাদের দেশে যেকোনো প্রকল্প গ্রহণ ও তার স্থান নির্বাচনের পদ্ধতি প্রসঙ্গে। এ দেশে প্রথমে রাজনৈতিকভাবে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে একটা প্রকল্প ঘোষণা করা হয়, তারপর ওই বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের নামানো হয় সেই প্রকল্পের যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের নাটক করতে। কিন্তু নিয়মটা হওয়া উচিত উল্টো। প্রথমে, জনগণের চাওয়া বা দেশের প্রয়োজন বা ভবিষ্যতে দরকারে লাগবে, এই বিবেচনাবোধটাকে আমলে নিতে হবে। তারপর এ ব্যাপারে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা মাঠে ও টেবিলে সব ধরনের কোণ থেকে চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখবেন, এই প্রকল্পটা নেওয়া হলে লাভ কত হবে, ক্ষতি কত হবে। এর প্রভাবটা কত বিচিত্র আর কত গভীর হবে। পরিবেশের ওপরে তার অভিঘাতটা কী পড়বে। কত গাছ কাটা পড়বে, কত জলাভূমি ভরাট করা হবে, কত লোক বাস্তুচ্যুত হবে, কতটা আবাদি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর প্রতিটির জন্যই দেশকে, দেশের মানুষকে মূল্য দিতে হয়। সারা পৃথিবীতেই আজ এসব স্পর্শকাতর বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হয়েছে। একজন মানুষও যদি ভিটেছাড়া হয়, তার অবস্থা হয় শেকড় উপড়ানো গাছের মতো। পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই তাই বাঁধ নির্মাণ করে জলাধার নির্মাণের মতো প্রকল্পগুলো মানুষের প্রতিরোধের মুখে পড়ছে। আবাদি জমির ব্যাপারে কৃষকেরা কী রকম স্পর্শকাতর আর তা রক্ষার জন্য কী রকম মরিয়া, তার প্রমাণ তো আমাদের পাশের দেশের নিকটতম রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেই আমরা দেখেছি। অমন যে প্রতাপশালী বামফ্রন্ট সরকার, সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রামে শিল্প-কারখানার জন্য কৃষিজমি দখল করতে গিয়ে তারা প্রলয়ের মুখে পড়েছে, আজ তাদের এত দিনকার শাসনকালের অবসান আসন্ন বলে মনে হচ্ছে। কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই সিপিএম-শিবিরের বিপক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছেন, তাঁরা গান বাঁধছেন, কবিতা পড়ছেন কৃষিজমি দখলের চক্রান্তের বিরুদ্ধে। কাজেই মানুষের জমিজিরেত দখল করতে হয়, জলাধার ভরাট করতে হয়, গাছ কাটতে হয়, এমন প্রকল্প গ্রহণের আগে এক শ বার ভাবনা-চিন্তা করা উচিত।
তাই বলে কি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেমে থাকবে।
আমরা যদি আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়াতে চাই, দারিদ্র্য কমাতে চাই, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হতে চাই, তাহলে অবশ্যই আমাদের কেবল কৃষির ওপরে নির্ভরশীল থাকলে চলবে না। আমাদের শিল্পায়ন করতে হবে, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে। ব্যবসা করার জন্য নতুন নতুন বুদ্ধিও বের করতে হবে। একটা বড় সমুদ্রবন্দর আর একটা বিশাল বিমানবন্দর নির্মাণ করে আশপাশের কানাগলির দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করাটা আমাদের জন্য আয়ের একটা বড় উৎস হতে পারে, এটা কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ডেইলি স্টার-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এক বক্তৃতায় ন্যাম সম্মেলন কেন্দ্রে তিনি কয়েক বছর আগেই এ প্রস্তাব রেখেছিলেন। ২০০৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি নোবেলজয়ী অধ্যাপক ইউনূস চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে তাঁকে দেওয়া সংবর্ধনার জবাবে যা বলেছিলেন, ডেইলি স্টার-এ সে খবরের প্রথম লাইনগুলো ছিল: Nobel Lauৎeate Dৎ. Muhammad Yunus yesteৎday stৎessed the need foৎ setting up a mega seapoৎt, a mega aiৎpoৎt and a tৎansnational highway to speed up the wheel of economy and to mateৎialise ‘the dৎeam of the people’.
কাজেই আমাদের বড় বিমানবন্দর দরকার নেই, এটা আমি বলছি না। বিমানবন্দর করা হলে সেটা লাভজনক হবে কি না, সেটা নির্মাণের ফলে যে মানবিক, পরিবেশগত, অর্থনৈতিক মূল্য দিতে হবে, তার তুলনায় লাভটা কত বেশি, চুলচেরা বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের স্টাডির পরেই সেটা বলা সম্ভব। আর সেই তথ্যগুলো জনগণের সামনে প্রকাশ করতে হবে। জনমত গঠন করতে হবে। বিমানবন্দরটা কোন জায়গায় নির্মাণ করলে বাংলাদেশের লাভ সবচেয়ে বেশি হবে, সেটাও গবেষণার মাধ্যমে প্রস্তাব করবেন বিশেষজ্ঞরা। তারপর সেটা জনমত যাচাইয়ের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। বিমানমন্ত্রী জি এম কাদের যখন টেলিভিশনে আড়িয়ল বিলের মানচিত্র দেখিয়ে বলছিলেন, এটা তো বিল, এখানে তো কোনো মানুষ নেই, তা দেখে আমার হূৎপিণ্ড ঠান্ডা হয়ে গিয়ে গিয়েছিল, মানচিত্রে বিলটা একেবারেই নীল রঙের, তার মানে এটা জলাধার, জলাধার ভরাট করা তো সরকারি আইনেই মানা, আর প্রতিক্রিয়া তো ভয়াবহ হতে বাধ্য। এবার বলা হচ্ছে, পদ্মার ওপারে বিমানবন্দর করা হবে। সেটাই সবচেয়ে ভালো জায়গা কি না, এটা কি বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে যাচাইয়ের জন্য ছেড়ে দেওয়া যায় না? বাংলাদেশে আইন আছে, সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া কোনো প্রকল্প চালু করা যাবে না। আর বিমানবন্দর বানাতে তো এত জমি দরকার হয় না, উপশহর বানানোর চিন্তা মাথায় না আনা হলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা অনেক কমে যাবে।
আবার উন্নয়নের ধারণাও কিন্তু পৃথিবীতে বদলাচ্ছে। ভুটান যেমন বিশ্বব্যাংকের উন্নয়ন সূচককে মানে না, তারা প্রণয়ন করেছে হ্যাপিনেস ইনডেক্স, তারা বলে, আমাদের সবার কাজ আছে, মাথার ওপরে ছাদ আছে, আমরা রোজ সুখে নিদ্রা যাই, আমাদের তো পরিবেশ বিপর্যয়কারী শিল্পায়ন দরকার নেই।
আমাদের জমি অল্প। শুধু কৃষি-নির্ভরতা দিয়ে আমরা এগোতে পারব না। আমাদের দূরদর্শী পরিকল্পনা নিয়েই এগোতে হবে। সেসবের মধ্যে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনাও থাকবে। মেগা বিমানবন্দরও নির্মাণ করতে আমরা নিশ্চয়ই পারি। কিন্তু সিদ্ধান্তগুলো যেন বিশেষজ্ঞপর্যায়ের সম্ভাব্যতা যাচাই দ্বারা পরীক্ষিত ও সমর্থিত হয়। সেই যে একটা কৌতুক আছে: নেতা বলছেন, আপনাদের গ্রামে আমি একটা ব্রিজ বানাব, জনতা বলছে, আমাদের তো নদী নেই, ব্রিজ দেবেন কোথায়, তখন তিনি বলছেন, আচ্ছা, ব্রিজ দেওয়ার জন্য আগে আমরা একটা নদী বানাব, তারপর আপনারা ব্রিজ পাবেন, আমি যখন কথা দিয়েছি, কথা রাখবই—তা যেন না হয়।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
নিজের আমলনামা মূল্যায়ন করুন
শেখ হাসিনার সরকার একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপি এতটা ভালো করবে, হয়তো তা খোদ বিএনপি-নেতাদেরও অকল্পনীয় ছিল। দলের সাংগঠনিক অবস্থা ভালো নয়। চার বছর আগে যখন তারা ক্ষমতায় ছিল, তখন তারা এত বেশি রকমের বাড়াবাড়ি ও অন্যায় করেছে, দেশের মানুষের পক্ষে সেসব ভুলে যাওয়া কঠিন। তাদের গুরুত্বপূর্ণ নেতা/মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে জঙ্গি লালনের, এমনকি শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলার পেছনেও বিএনপির বা তখনকার সরকারের উচ্চপর্যায়ের লোকজন জড়িত বলে খবর বের হচ্ছে। তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানের নানা কীর্তিকলাপের স্মৃতি মানুষের মন থেকে সহজে মুছে যাওয়ার নয়। এই সেদিনই খবর বেরোল, আরাফাত রহমানের পাচার করা টাকা রাখার জন্য সিঙ্গাপুরে একজনের শাস্তি হয়েছে। অর্থাৎ গত সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের হাতে কলঙ্কের এত দুর্গন্ধ যে, আরব দেশের সব সুগন্ধিও তা আড়াল করতে পারবে না। তা সত্ত্বেও সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাসের এবং বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির যে লক্ষণ পৌর নির্বাচনের ফলে বেরিয়ে এল, তা সরকারের ও সরকারি দলের নীতিনির্ধারকদের গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার। বিএনপির ডাকা গতকালের হরতালটি সম্পূর্ণ অকারণ ও অগ্রহণযোগ্য, সেটা সহজবোধ্য। কিন্তু সরকারি নীতিনির্ধারকদের লক্ষ করা উচিত, বিএনপির মিছিল ও সভায় লোকসমাগম বৃদ্ধি পাচ্ছে কেন?
বাংলাদেশের একটা সাধারণ নিয়ম হলো, সরকার খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা হারায়। কিন্তু ২০০১-০৬ মেয়াদে বিএনপিওয়ালারা যে ভয়াবহ পর্যায়ের অপকর্ম করে রেখেছেন, তার পরেও তাঁদের দ্রুত গ্রহণযোগ্যতা লাভের একটাই মানে, দেশের মানুষ সরকারের ও সরকারি দলের পারফরম্যান্সে খুশি নয়।
সরকারের কতগুলো ব্যর্থতা তো খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে। জিনিসপাতির দাম খুব বেড়ে গেছে। শেয়ার মার্কেটের সঙ্গে নাকি ৩০ লাখ লোক জড়িত, তার মানে ৩০ লাখ পরিবার এই মার্কেটের পতনের ফলে সরকারের ওপরে অখুশি হতে বাধ্য। এই ৩০ লাখ পরিবার গ্রামগঞ্জে থাকে না, তারা পৌর এলাকাতেই থাকে, তাদের হতাশার প্রতিফলন ভোটের বাক্সে পড়তে বাধ্য। শীতকালে বিদ্যুতের সমস্যা হয়তো কম, কিন্তু সামনের গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ-সংকট যদি কমানো না যায়, তাহলে তা বড় একটা ধাক্কা হয়ে আসবে। বিদ্যুতের সঙ্গে আসবে পানির সমস্যা, আর আছে প্রকট গ্যাস-সমস্যা। যানজট তো লেগেই আছে। কিন্তু এসবের চেয়েও মানুষের মনে সৃষ্ট হতাশার বড় কারণ দলীয় নেতা-কর্মীদের বাড়াবাড়ি। ছাত্রলীগসহ নানা সরকারি সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, টেন্ডারবাজি, ভর্তি ও নিয়োগ-বাণিজ্য, দলীয়করণ এবং সন্ত্রাস। স্থানে স্থানে গডফাদারও তৈরি হচ্ছে বলে খবর আসছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো নয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে সরকারের জনপ্রিয়তা আরও কমে যাবে। পাঁচ বছর শেষে নির্বাচনের ফল কী হবে, সেটা আগামী তিন বছরে সরকারের পারফরম্যান্সের ওপর নির্ভর করছে। একটা কথা তো সহজবোধ্য, এখন সরকার যেভাবে দেশ চালাচ্ছে, সেভাবে চললে সরকারের জনপ্রিয়তা আরও কমে যাবে এবং অনন্যোপায় ভোটাররা শেষতক বিএনপিকেই বেছে নিতে বাধ্য হবে। এ অবস্থায় সরকারের নিজেদের আমলনামা একবার পুনর্বিচার করে দেখা উচিত। এখনো সময় আছে। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার-এ প্রকাশিত দুটি জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, সরকারের জনপ্রিয়তা গত বছরের তুলনায় কমলেও এখনো তা বিএনপির চেয়ে বেশি।
সরকারকে যে তার আচার-আচরণ পাল্টাতে হবে, শুধু কথা নয়, কাজের মাধ্যমে মানুষের চিত্ত জয় করতে হবে, সরকার কি আদৌ বুঝতে পারছে?
অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের সাফল্য বেশ প্রশংসনীয়। যেমন, কৃষি ও শিক্ষাক্ষেত্রে। কিন্তু অর্থনীতি ও বাণিজ্য খাত ঠিকভাবে চলছে কি? কিন্তু তারও চেয়ে বড় কথা, আওয়ামী লীগ আসলে সরকার খুব খারাপ চালায় না, তার প্রধান সমস্যা তার খাসলতে, তার আচার-আচরণ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে। একটা ছোট কিন্তু লাগসই উদাহরণ হাতের কাছেই আছে। আড়িয়ল বিলের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের কৃতিত্ব সরকার কেন খালেদা জিয়াকে দিতে গেল। বিএনপির মিছিলে লোক বাড়ছে বটে, কিন্তু আড়িয়ল বিল এলাকার মানুষ নিজেদের ভিটেমাটি-জমিজিরেত রক্ষার জন্য যে মরণপণ লড়াইয়ে নেমেছিল, যে তীব্রতা ও বিস্তার ছিল সেসব মিছিল-সমাবেশে, তার নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা, অবস্থান, ত্যাগ-স্বীকারব্রত বিএনপির নেতৃত্বের পক্ষে অর্জন করা অসম্ভব। আর হাজার হাজার অজ্ঞাতনামা মানুষের সঙ্গে এক নম্বর আসামির নাম হিসেবে খালেদা জিয়ার নামটা দিতে গেলেন যে পিপি, যিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি, তিনি যে বিএনপির হাতে একটা অপ্রয়োজনীয় ইস্যু তুলে দিলেন, সেটা কি সরকার বুঝতে পেরেছে? (তা সত্ত্বেও আমরা বলব, বিএনপি হরতাল ডেকে অত্যন্ত অন্যায় করেছে। আর বিএনপি কেবল খালেদা জিয়ার বাড়ি আর মামলা নিয়ে হরতাল ডাকে কেন? জনগণ কেবল সরকারের পারফরম্যান্স খেয়াল করে না, বিরোধীদের প্রতিও লক্ষ রাখে)।
বড় বিমানবন্দরের আইডিয়াটা কিন্তু ড. ইউনূসের
এবার আসি আমাদের দেশে যেকোনো প্রকল্প গ্রহণ ও তার স্থান নির্বাচনের পদ্ধতি প্রসঙ্গে। এ দেশে প্রথমে রাজনৈতিকভাবে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে একটা প্রকল্প ঘোষণা করা হয়, তারপর ওই বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের নামানো হয় সেই প্রকল্পের যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের নাটক করতে। কিন্তু নিয়মটা হওয়া উচিত উল্টো। প্রথমে, জনগণের চাওয়া বা দেশের প্রয়োজন বা ভবিষ্যতে দরকারে লাগবে, এই বিবেচনাবোধটাকে আমলে নিতে হবে। তারপর এ ব্যাপারে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা মাঠে ও টেবিলে সব ধরনের কোণ থেকে চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখবেন, এই প্রকল্পটা নেওয়া হলে লাভ কত হবে, ক্ষতি কত হবে। এর প্রভাবটা কত বিচিত্র আর কত গভীর হবে। পরিবেশের ওপরে তার অভিঘাতটা কী পড়বে। কত গাছ কাটা পড়বে, কত জলাভূমি ভরাট করা হবে, কত লোক বাস্তুচ্যুত হবে, কতটা আবাদি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর প্রতিটির জন্যই দেশকে, দেশের মানুষকে মূল্য দিতে হয়। সারা পৃথিবীতেই আজ এসব স্পর্শকাতর বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হয়েছে। একজন মানুষও যদি ভিটেছাড়া হয়, তার অবস্থা হয় শেকড় উপড়ানো গাছের মতো। পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই তাই বাঁধ নির্মাণ করে জলাধার নির্মাণের মতো প্রকল্পগুলো মানুষের প্রতিরোধের মুখে পড়ছে। আবাদি জমির ব্যাপারে কৃষকেরা কী রকম স্পর্শকাতর আর তা রক্ষার জন্য কী রকম মরিয়া, তার প্রমাণ তো আমাদের পাশের দেশের নিকটতম রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেই আমরা দেখেছি। অমন যে প্রতাপশালী বামফ্রন্ট সরকার, সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রামে শিল্প-কারখানার জন্য কৃষিজমি দখল করতে গিয়ে তারা প্রলয়ের মুখে পড়েছে, আজ তাদের এত দিনকার শাসনকালের অবসান আসন্ন বলে মনে হচ্ছে। কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই সিপিএম-শিবিরের বিপক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছেন, তাঁরা গান বাঁধছেন, কবিতা পড়ছেন কৃষিজমি দখলের চক্রান্তের বিরুদ্ধে। কাজেই মানুষের জমিজিরেত দখল করতে হয়, জলাধার ভরাট করতে হয়, গাছ কাটতে হয়, এমন প্রকল্প গ্রহণের আগে এক শ বার ভাবনা-চিন্তা করা উচিত।
তাই বলে কি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেমে থাকবে।
আমরা যদি আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়াতে চাই, দারিদ্র্য কমাতে চাই, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হতে চাই, তাহলে অবশ্যই আমাদের কেবল কৃষির ওপরে নির্ভরশীল থাকলে চলবে না। আমাদের শিল্পায়ন করতে হবে, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে। ব্যবসা করার জন্য নতুন নতুন বুদ্ধিও বের করতে হবে। একটা বড় সমুদ্রবন্দর আর একটা বিশাল বিমানবন্দর নির্মাণ করে আশপাশের কানাগলির দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করাটা আমাদের জন্য আয়ের একটা বড় উৎস হতে পারে, এটা কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ডেইলি স্টার-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এক বক্তৃতায় ন্যাম সম্মেলন কেন্দ্রে তিনি কয়েক বছর আগেই এ প্রস্তাব রেখেছিলেন। ২০০৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি নোবেলজয়ী অধ্যাপক ইউনূস চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে তাঁকে দেওয়া সংবর্ধনার জবাবে যা বলেছিলেন, ডেইলি স্টার-এ সে খবরের প্রথম লাইনগুলো ছিল: Nobel Lauৎeate Dৎ. Muhammad Yunus yesteৎday stৎessed the need foৎ setting up a mega seapoৎt, a mega aiৎpoৎt and a tৎansnational highway to speed up the wheel of economy and to mateৎialise ‘the dৎeam of the people’.
কাজেই আমাদের বড় বিমানবন্দর দরকার নেই, এটা আমি বলছি না। বিমানবন্দর করা হলে সেটা লাভজনক হবে কি না, সেটা নির্মাণের ফলে যে মানবিক, পরিবেশগত, অর্থনৈতিক মূল্য দিতে হবে, তার তুলনায় লাভটা কত বেশি, চুলচেরা বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের স্টাডির পরেই সেটা বলা সম্ভব। আর সেই তথ্যগুলো জনগণের সামনে প্রকাশ করতে হবে। জনমত গঠন করতে হবে। বিমানবন্দরটা কোন জায়গায় নির্মাণ করলে বাংলাদেশের লাভ সবচেয়ে বেশি হবে, সেটাও গবেষণার মাধ্যমে প্রস্তাব করবেন বিশেষজ্ঞরা। তারপর সেটা জনমত যাচাইয়ের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। বিমানমন্ত্রী জি এম কাদের যখন টেলিভিশনে আড়িয়ল বিলের মানচিত্র দেখিয়ে বলছিলেন, এটা তো বিল, এখানে তো কোনো মানুষ নেই, তা দেখে আমার হূৎপিণ্ড ঠান্ডা হয়ে গিয়ে গিয়েছিল, মানচিত্রে বিলটা একেবারেই নীল রঙের, তার মানে এটা জলাধার, জলাধার ভরাট করা তো সরকারি আইনেই মানা, আর প্রতিক্রিয়া তো ভয়াবহ হতে বাধ্য। এবার বলা হচ্ছে, পদ্মার ওপারে বিমানবন্দর করা হবে। সেটাই সবচেয়ে ভালো জায়গা কি না, এটা কি বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে যাচাইয়ের জন্য ছেড়ে দেওয়া যায় না? বাংলাদেশে আইন আছে, সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া কোনো প্রকল্প চালু করা যাবে না। আর বিমানবন্দর বানাতে তো এত জমি দরকার হয় না, উপশহর বানানোর চিন্তা মাথায় না আনা হলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা অনেক কমে যাবে।
আবার উন্নয়নের ধারণাও কিন্তু পৃথিবীতে বদলাচ্ছে। ভুটান যেমন বিশ্বব্যাংকের উন্নয়ন সূচককে মানে না, তারা প্রণয়ন করেছে হ্যাপিনেস ইনডেক্স, তারা বলে, আমাদের সবার কাজ আছে, মাথার ওপরে ছাদ আছে, আমরা রোজ সুখে নিদ্রা যাই, আমাদের তো পরিবেশ বিপর্যয়কারী শিল্পায়ন দরকার নেই।
আমাদের জমি অল্প। শুধু কৃষি-নির্ভরতা দিয়ে আমরা এগোতে পারব না। আমাদের দূরদর্শী পরিকল্পনা নিয়েই এগোতে হবে। সেসবের মধ্যে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনাও থাকবে। মেগা বিমানবন্দরও নির্মাণ করতে আমরা নিশ্চয়ই পারি। কিন্তু সিদ্ধান্তগুলো যেন বিশেষজ্ঞপর্যায়ের সম্ভাব্যতা যাচাই দ্বারা পরীক্ষিত ও সমর্থিত হয়। সেই যে একটা কৌতুক আছে: নেতা বলছেন, আপনাদের গ্রামে আমি একটা ব্রিজ বানাব, জনতা বলছে, আমাদের তো নদী নেই, ব্রিজ দেবেন কোথায়, তখন তিনি বলছেন, আচ্ছা, ব্রিজ দেওয়ার জন্য আগে আমরা একটা নদী বানাব, তারপর আপনারা ব্রিজ পাবেন, আমি যখন কথা দিয়েছি, কথা রাখবই—তা যেন না হয়।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments