লাল-সবুজের পাশে-গ্রামের নাম রূপসী বাংলা by আনিসুল হক

এখানে নাকি একটা গ্রাম আছে, নাম রূপসী বাংলা? চলুন না, যাওয়া যাক। আইভরি কোস্টের এই এলাকাটার নাম মান। বিভাগীয় শহর। এই শহরের দোকানপাট আমাদের ছোট্ট একটা গঞ্জের মতো। মান শহরের কাছে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী বাহিনীর ক্যাম্প। এটাকে বলা হয় ব্যানব্যাট ৩। মানে হলো, বাংলাদেশি ব্যাটালিয়ন ৩।


এর কমান্ডার কর্নেল আলমাস রাইসুল গনি। ৪৫০ জনের মতো শান্তিরক্ষী থাকেন এখানে। এখন চলছে বদলির সময়। একদল বাংলাদেশি দেশে ফিরছেন, আরেক দল স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন।
এই ব্যাটালিয়নের আর্টিলারি রেজিমেন্ট গত এক বছরে যেসব অভিযান পরিচালনা করেছে, ২৮ জানুয়ারি সকালে তার বিবরণ জানা গেল।
আইভরি কোস্টে বহু বছর পরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় ২০১০ সালে। নির্বাচনে প্রাথমিকভাবে ওয়াতারা জয়লাভ করেন। কিন্তু তখন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট লরেন্ট বাগবো সেই ফল মেনে নিতে অস্বীকার করেন এবং তাঁর সমর্থক সাংবিধানিক কাউন্সিল বাগবোকেই নির্বাচিত ঘোষণা করে। তখন বিজয়ী প্রার্থী আলাসান ওয়াতারা আর ক্ষমতাসীন বাগবো—দুজনই প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। এক দেশ, দুই প্রেসিডেন্ট। সেনাবাহিনীও দুটো। তার ওপর বাগবোর আছে ইয়াং প্যাট্রিয়টস। দেশের উত্তরাঞ্চল ওয়াতারার দখলে, দক্ষিণাঞ্চল বাগবোর। চলতে থাকল গৃহযুদ্ধ।
হত্যা, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন-নিপীড়ন তখন রাস্তায় রাস্তায়। গ্রামে গ্রামে চলছে আক্রমণ। অবস্থা হয়ে পড়ে বিভীষিকাময়।
২ মার্চ ২০১১। বাংলাদেশের এই ব্যাটালিয়নের একটি দলকে নির্দেশ দেওয়া হয়, ইউক্রেনের কিছু পাইলটকে উদ্ধার করতে হবে। তাঁদের পোর্ট বুয়ে থেকে পারগোলা হোটেল পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। ক্যাপ্টেন আখতার উস সামাদ রাফি (ইস্ট বেঙ্গল) ও ক্যাপ্টেন আসিফ আরেফিনের (আর্টিলারি) নেতৃত্বে ৩০ জনের দল চলল তিনটা এপিসি (আর্মার্ড পারসোনেল ক্যারিয়ার) ও দুটো গাড়ি নিয়ে। তখন রাস্তায় রাস্তায় বাগবো-সমর্থকদের ভিড়। সেটা এড়াতে দলটি রওনা দিল ভোর চারটায়। পোর্ট বুয়ে এলাকায় পৌঁছানোর পর দেখা গেল সেখানে অনেক চেকপোস্ট। জায়গাটা আসলে ইয়াং প্যাট্রিয়টদের শক্ত ঘাঁটি। রাস্তায় কাঠের গুঁড়ি, পাথরখণ্ড ইত্যাদি দিয়ে ব্যারিকেড বসানো। ব্যারিকেড সরানোর অনুরোধে কাজ না হলে মিলিটারি কায়দায় আদেশ দেওয়া হয় ব্যারিকেড সরানোর। এভাবে প্রায় ১৫-১৬টি ব্যারিকেড পার হয়ে পোর্ট বুয়ের হোটেলে পৌঁছায় দলটি। নয়জন পাইলট-ক্রুর দলটিকে এপিসিতে তুলে নিয়ে তাঁরা যখন ফিরছেন, ততক্ষণে পৌনে পাঁচটা বেজে গেছে। ফেরার পথে প্রথম ব্যারিকেডে দেখা গেল হাজার দেড়েক মানুষ, তাদের অনেকের হাতে অস্ত্র, মুখে মুখোশ। প্রথমে অনুনয়-বিনয়, তারপর কড়া গলায় হুকুম। তাতেও কাজ না হওয়ায় ব্যারিকেড ভেঙে সামনে এগোনোর নির্দেশ দিলেন কমান্ডার রাফি। এপিসি ব্যারিকেড ভেঙে চলতে শুরু করল। দুই পাশ থেকে বর্ষিত হতে লাগল বাগবো বাহিনীর গুলি। তখন শান্তিরক্ষীরাও পাল্টা গুলিবর্ষণ করেন।
এভাবে দুই কিলোমিটার পথ তিনটা এপিসি, তার আড়াল ধরে দুটো গাড়ি গুলিবৃষ্টির মধ্য দিয়ে ফিরে আসতে সমর্থ হয়। ইউক্রেনীয়দের হোটেল পারগোলায় পৌঁছে দিয়ে নিজের ক্যাম্পে ফিরে যায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা। তখন পাঁচটা ৪৫। বাংলাদেশিদের পক্ষে ইন্টারপ্রেটার রুহুল আমিন ও ল্যান্স করপোরাল আবদুল হাকিম আঙুলে গুলির সামান্য আঘাত পান।
এ ধরনের অনেক সফল অভিযান পরিচালনা করেছে এই ব্যাটালিয়ন। এ জন্য তারা জাতিসংঘের বাহিনীপ্রধানের কাছ থেকে পাঁচটি প্রশংসাপত্র লাভ করেছে।
সেসব যুদ্ধের কথা, গোলাগুলির রোমহর্ষক বিবরণ শোনার পর আমরা চললাম পাশের একটা গ্রামে। যার নাম ‘রূপসী বাংলা’।
গ্রামে গিয়ে নামতেই ঢোলকের বাজনা, আর রঙিন কাপড় পরা নারীদের নৃত্যগীতের শব্দে এক অপূর্ব অভ্যর্থনা যেন লাভ করলাম। গ্রামটায় মোট ১৬০টি পরিবার আছে। মাটির তৈরি ঘর। কোনোটার ওপরে ঢেউটিন, কোনোটার ওপরে শন। এই এলাকাটা মুসলিমপ্রধান। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা এখানে একটি মসজিদ বানিয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া তাদের খোঁজখবর রাখেন নিয়মিত। বিপদে-আপদে তারা সাহায্য পায় বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের কাছ থেকে। তাই তারা তাদের গ্রামটির নাম রেখেছে রূপসী বাংলা।
রূপসী বাংলা গ্রামটা দেখতে বাংলাদেশের মতোই। আমগাছে মুকুল ধরে আছে। কুয়া থেকে পানি তুলছে গ্রামের নারী।
যদিও গ্রামের নারী-পুরুষ-শিশু বেশির ভাগই ভিড় করেছে একটা খোলা চত্বরে, তাদের গ্রামপ্রধান বারান্দায় বসেছেন। সেখানেই একটু মঞ্চে বসার ভঙ্গিতে বসলেন আমাদের প্রতিনিধিদলের প্রধান ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ সেলিম ও স্থানীয় কমান্ডার কর্নেল গনি। প্রথমে নৃত্যগীত পরিবেশন করলেন অপেক্ষাকৃত বয়স্ক নারীরা। তারপর আরেকটু কম বয়সী নারীরা আরেক ধরনের পোশাক পরে নাচলেন, গাইলেন। শেষে কিশোরীরা তাদের নাচ-গান করল, যদিও তাদের অনেকের পিঠেই বাচ্চা বাঁধা।
গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে গ্রামপ্রধান বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীকে ধন্যবাদ দিলেন। তারপর আফ্রিকার ঐতিহ্যবাহী আলখাল্লা পরিয়ে দিলেন ব্রিগেডিয়ার সেলিমকে; তাঁকে বলা হলো, রূপসী বাংলা গ্রামের রক্ষক। কর্নেল গনিকে খেতাব দেওয়া হলো মসজিদের প্রধানের; তাঁকেও পরানো হলো ওই ঐতিহ্যবাহী পোশাক। খানিক পরে আমাকেও পরিয়ে দেওয়া হলো ওই আফ্রিকীয় পোশাক। আমার খেতাব হলো গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষের। ঘোষক সেটা পরিষ্কার করে দিল, আমি হলাম গিয়ে রূপসী বাংলা গ্রামের মুরব্বি। আমার অকালপক্ব চুল আমাকে কী সব সম্মানই না দিচ্ছে!
এর মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মাহবুবুল ইসলাম একটা কাজ সেরেছেন। তিনি মান এলাকার পল্লি উন্নয়ন এজেন্সির প্রধান নিয়ামিন সেলেসটিনের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। আইভরি কোস্টে কৃষিকাজে বাংলাদেশ কীভাবে সাহায্য করতে পারে, এই হলো আলোচনার বিষয়। ওরা আগ্রহ দেখালেন। তবে বললেন, যোগাযোগটা আসলে হতে হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে।
রূপসী বাংলা গ্রাম থেকে বিদায় নিয়ে আমরা চললাম এগিয়ে। আমাদের গাড়িবহরের এর পরের গন্তব্য দানানে। ওখানেও আছে বাংলাদেশিদের একটা শিবির, যে শিবিরের কাছে আছে সোনার খনি। কিন্তু সোনার খনির মালিকানা এই দেশের নয়। সোনার প্রায় পুরোটাই চলে যায় বিদেশে। গরিবের ঘরে সম্পদ থাকতে নেই। ‘আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী’, হরিণের মাংসই হলো হরিণের প্রধান শত্রু। আমাদের চর্যাপদের কবিরা যে ঠিক কথা বলেছেন, আইভরি কোস্টের সম্পদের প্রাচুর্য আর দারিদ্র্যের করুণ ছবি দেখলে বারবার সে কথাই মনে হবে।

No comments

Powered by Blogger.