১২- রিমান্ডে নির্যাতন বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা দেশকে ’৭০-এর আর্জেন্টিনা-চিলিতে পরিণত করেছে
রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভয়াবহতা
রিমান্ডের অভিজ্ঞতা বর্ণনা সমাপ্ত করেছি। এবার জেল জীবনের কাহিনী বলার পালা। তবে তার আগে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভয়াবহতা নিয়ে দুই-একটি কথা বলা আবশ্যক। রিমান্ডের তিক্ত স্বাদ গ্রহণ করে জেলখানার তুলনামূলক নিরাপদ জীবনে ফেরার দিন কয়েকের মধ্যে লোকমুখে শুনলাম, কমিশনার চৌধুরী আলমকে সাদা পোশাকের পুলিশ উঠিয়ে নিয়ে গেছে। অদ্যাবধি তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না.....
রিমান্ডের অভিজ্ঞতা বর্ণনা সমাপ্ত করেছি। এবার জেল জীবনের কাহিনী বলার পালা। তবে তার আগে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভয়াবহতা নিয়ে দুই-একটি কথা বলা আবশ্যক। রিমান্ডের তিক্ত স্বাদ গ্রহণ করে জেলখানার তুলনামূলক নিরাপদ জীবনে ফেরার দিন কয়েকের মধ্যে লোকমুখে শুনলাম, কমিশনার চৌধুরী আলমকে সাদা পোশাকের পুলিশ উঠিয়ে নিয়ে গেছে। অদ্যাবধি তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না.....
রিমান্ডের অভিজ্ঞতা বর্ণনা সমাপ্ত করেছি। এবার জেল জীবনের গল্প বলার পালা। তবে তার আগে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভয়াবহতা নিয়ে দুই-একটি কথা বলা আবশ্যক। রিমান্ডের তিক্ত স্বাদ গ্রহণ করে জেলখানার তুলনামূলক নিরাপদ জীবনে ফেরার দিন কয়েকের মধ্যে লোকমুখে শুনলাম, চৌধুরী আলম নামে বিএনপিপন্থী ঢাকার এক জনপ্রিয় কমিশনারকে সাদা পোশাকের পুলিশ উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩২(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘গ্রেফতারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে গ্রেফতারের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে হাজির করা হইবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাহাকে তদতিরিক্তকাল আটক রাখা যাইবে না।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের সমর্থনপুষ্ট মহাজোট সরকার সংবিধানের যে কোনো রকম তোয়াক্কা করে না, সেটা সরকারের দেড় বছরের কাজ-কারবার দেখার পরও এদেশের জনগণ যদি বুঝতে না পেরে থাকেন, তবে সেটা তাদেরই অপরাধ।
বিদেশি প্রভুদের নির্দেশমতো আমাদের সংবিধানের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, মনগড়া ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য তথাকথিত সংবিধান বিশেষজ্ঞরা যে একপায়ে খাড়া থাকেন, তার প্রমাণ এক-এগারোর সময়ই আমরা হাতেনাতে পেয়েছি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তিন মাসের মেয়াদকে কী চমত্কারভাবেই না ইলাস্টিকের মতো টেনে দুই বছর করা হলো। সেই সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো সাংবিধানিক ক্ষমতা না থাকলেও সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এবং রাষ্ট্রের স্বার্থ প্রতিবেশী পরাশক্তির পায়ে বিকিয়ে তারা দেদার এ জাতীয় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অগ্রজপ্রতিম বন্ধু ফরহাদ মজহার প্রায়ই বলে থাকেন, বাংলাদেশের সংবিধান কয়েকজন উকিলের কাট অ্যান্ড পেস্ট (ঈঁঃ ্ চধংঃব) অপারেশনের ফসল, এই দলিল প্রণয়নে জনগণের কোনো ভূমিকা ছিল না। সংবিধান রচয়িতার দাবিদার সেই উকিলরাই তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের নির্দেশে এক-এগারোকে জায়েজ করার জন্য সংবিধানের বিচিত্র সব ব্যাখ্যা দিয়ে সেই সময় জনগণকে বিভ্রান্ত করেছেন। সময়-সুযোগ বুঝে মুখে মানবাধিকারের ফুলঝুরি ছোটালেও জরুরি সরকারের ভয়াবহ সব মানবাধিকার লঙ্ঘনকে মেনে নিয়ে দেশে-বিদেশে তাদের পক্ষে ওকালতি করতে সুশীল (?) সমাজের চাঁইদের বাধেনি। অসংখ্য ব্যক্তির কাছ থেকে অভিযোগ শুনেছি, সেই সময় সংবিধানের ৩৩ ধারাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তাদের নাকি মাসাধিককাল নির্জন স্থানে আটকে রেখে বর্বর নির্যাতন করা হয়েছে। কেউ কেউ চিরদিনের মতোই নিখোঁজ হয়ে গেছেন। আজ নির্বাচিত সরকারের আমলে নিখোঁজ চৌধুরী আলমের এমন পরিণতি কল্পনায় আনাটাকেও আমি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের ভীরুতা ও রাজনৈতিক ব্যর্থতা বলেই মনে করি। বাস্তবতা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ চরিত্রগতভাবে ফ্যাসিবাদী হওয়ায় দলটির নেতাকর্মীরা মানবাধিকারে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করে না। তদুপরি বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মানবাধিকার প্রশ্নে দুর্ভাগ্যজনক নির্লিপ্ততা বাংলাদেশকে ক্রমেই একটি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করছে।
রাষ্ট্র পরিচালনায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়ঙ্কর এবং চরম নিন্দনীয় সংস্কৃতি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মরহুম পিতা স্বাধীনতা-উত্তরকাল থেকেই আরম্ভ করেছিলেন। সেই সময় সিরাজ সিকদারের মতো বামপন্থী-বিপ্লবী নেতাকে পুলিশ হেফাজতে কেবল ঠাণ্ডামাথায় খুন করাই হয়নি, তত্কালীন সংসদে এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড নিয়ে উল্লাস এবং দম্ভ প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই ফ্যাসিবাদী অপশাসনের সাড়ে তিন বছরে তিরিশ হাজার ভিন্ন মতাবলম্বী মুক্তিযোদ্ধাকে রক্ষীবাহিনী এবং পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ হত্যা করেছে। পরবর্তীতে ২০০২ সালে চারদলীয় জোট সরকার আইনশৃঙ্খলা উন্নয়ন কৌশলের নামে উদ্ভট, অমানবিক এবং চরম নির্যাতনমূলক ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ পরিচালনা করে। একই সরকারের সময় এলিট পুলিশ বাহিনী গঠনের নামে র্যাবের আবির্ভাব চিরস্থায়ীভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুযোগ করে দিয়েছে। সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে যতদূর শুনেছি, ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ পরিচালনা এবং র্যাব গঠনে মানবাধিকারের ধ্বজাধারী পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের মৌন সম্মতি ছিল। অবশ্য যতদূর স্মরণে পড়ছে, অপারেশন ক্লিনহার্ট চলাকালীন সেনা হেফাজতে মৃত্যু নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকরা অন্তত প্রকাশ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু এক এগারো এদেশে মানবাধিকারের সংজ্ঞাকেই পাল্টে দিয়েছে। সেই সময় থেকে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনকে উপেক্ষা করার যে নীতি উক্ত কূটনীতিকরা অনুসরণ করে চলেছেন, তা বর্তমানেও অব্যাহত রয়েছে। ক্রসফায়ারের পর গুম-খুনের নতুন পদ্ধতি এদেশে চালু হওয়ার পরও মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট নির্দ্বিধায় বাংলাদেশ সঠিক পথেই এগুচ্ছে বলে সার্টিফিকেটও দিয়েছে। আমার গ্রেফতারের কিছুদিন আগে বিচারবহির্ভূত হত্যা সম্পর্কিত এক ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করেছিলাম। সেখানে ইইউ রাষ্ট্রদূত স্টিফেন ফ্রয়েনকে নির্দ্বিধায় বলতে শুনেছিলাম, বর্তমান সরকারের আমলে ক্রসফায়ারের সংখ্যা কমাতেই তিনি বেজায় সন্তুষ্ট। কিন্তু, আমরা সংবাদ মাধ্যমে যারা কাজ করছি, তারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের উল্টো চিত্রই দেখতে পাচ্ছি।
শেখ হাসিনার দ্বিতীয় দফার প্রধানমন্ত্রিত্বের সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে তিনি একাধারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ভারতের বিশ্বস্ত মিত্রে পরিণত হতে পেরেছেন। বিদেশে এমন বন্ধুভাগ্য থাকলে বাংলাদেশের জনগণকে গরু-ছাগল গণ্য করে নির্বিচারে নির্যাতন বা হত্যা করার অধিকার অনেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই লাভ করা যায়। স্যামুয়েল হান্টিংটনের সভ্যতার সংঘাত তত্ত্ব মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলোতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের জন্য এক ‘সুবর্ণ’ সুযোগ এনে দিয়েছে। আর বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার আবরণে যে রাজনীতি চর্চা হচ্ছে, তাকে সরাসরি ইসলাম-বিদ্বেষ ছাড়া অন্য কিছু বলার সুযোগ নেই। ইসলাম ফোবিয়ায় আক্রান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা ইউরোপের অব্যাহত সমর্থন লাভের অব্যর্থ কৌশল হিসেবে ডিজিটাল সরকার দেশে নিত্য-নতুন কথিত ইসলামী জঙ্গি আবিষ্কার করে চলেছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সন্ত্রাসের সংজ্ঞা বিস্তৃত এবং ধোঁয়াশাচ্ছান্ন করে এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে, যার ফলে কোনো গৃহে ইসলাম ধর্মবিষয়ক বই-পত্র পাওয়া গেলেই তাকে জেহাদি প্রকাশনা নাম দিয়ে নির্বিচারে গ্রেফতার করা যায় এবং জনগণের সকল মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করা হলেও সমালোচনার তেমন কোনো আশঙ্কা থাকে না। একটি কুমিরের ছানা বার বার দেখানোর গল্পের মতো করে ইসলামী জঙ্গি ইস্যুকে এই সরকার সাফল্যজনকভাবে ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশে ইসলামী দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী, হিযবুত তাহরীর, জেএমবি এবং হরকাতুল জেহাদ (হুজি)—এই চারটি সংগঠন নিয়েই এখন সংবাদ মাধ্যমে সর্বাধিক চর্চা হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ছাড়া বাকি তিনটি সংগঠনই সন্ত্রাসের অভিযোগে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী এখন পর্যন্ত আইনত একটি বৈধ রাজনৈতিক দল হলেও এবং সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকা সত্ত্বেও বাস্তবতা হলো, সরকার দলটিকে তাদের সংবিধান প্রদত্ত কোনোরকম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে দিচ্ছে না। দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের সঙ্গে এখন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার প্রচারণাও ক্রমেই বেগবান হচ্ছে। সরকারের মন্ত্রীরা রাখ-ঢাক না করেই দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছেন। জামায়াতে ইসলামী এবং হিযবুত তাহরীরের নেতাদেরকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়ার পর গোয়েন্দা কর্মকর্তারা যেসব সত্য-মিথ্যা তথ্য সংবাদ মাধ্যমে ফাঁস করছেন, সেখান থেকে ধারণা করে নেয়া সহজ যে উভয় দলকেই সরকার সন্ত্রাসের দায়ে অভিযুক্ত করে মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ রূপে দেশের জনগণ ও আন্তর্জাতিক মুরব্বিদের কাছে উপস্থাপন করার কৌশল নিয়েছে। অথচ এই দুটো দল কোনোদিন বন্ধুভাবাপন্ন ছিল এমন প্রমাণ খুঁজে পাওয়া কঠিন। হিযবুত তাহরীর আদর্শগতভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হওয়ার কারণে তারা জামায়াতে ইসলামীকে সর্বদা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের প্রতি দুর্বল একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিবেচনা করেছে। তদুপরি ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে দলটির বিতর্কিত ভূমিকার জন্য হিযবুত তাহরীর তাদের সঙ্গে একটা দূরত্বও বজায় রেখেছে।
অপরদিকে জামায়াতে ইসলামী নেতারা হিযবুত তাহরীরের কর্মকাণ্ডকে হঠকারী বিবেচনা করার পাশাপাশি তাদেরকে ইসলামী আন্দোলনে বাধা হিসেবেও মনে করে। এই প্রসঙ্গে ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা চলাকালীন একটি ঘটনার উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করছি। আমি তখনও আমার দেশ পত্রিকার দায়িত্ব গ্রহণ করিনি বিধায় আমার লেখালেখির একমাত্র জায়গা ‘নয়া দিগন্ত’ পত্রিকা। প্রতি বুধবার সেখানে কলাম লিখতাম। সেই সময় প্রথম আলোর ফান ম্যাগাজিনে আমাদের মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর প্রিয় সাহাবি হজরত আবু হুরায়রাকে (রা.) ব্যঙ্গ করে ছড়াসহ একটি কার্টুন ছাপা হয়। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এ নিয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে জরুরি অবস্থার মধ্যেই বিভিন্ন মসজিদ থেকে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের হতে থাকে। এসব বিক্ষোভ মিছিল আয়োজনে হিযবুত তাহরীর সেই সময় জামায়াতে ইসলামীর তুলনায় অধিকতর সাহসী ভূমিকা পালন করে। অবস্থা সঙ্গিন দেখে শেষ পর্যন্ত প্রথম আলো পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমান বায়তুল মোকাররম মসজিদের তত্কালীন খতিব মরহুম উবায়দুল হকের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন এবং ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করে মুসলমানদের মনে আঘাত দেয়ার জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে বিতর্কটির অবসান ঘটান। ক্ষমাপ্রার্থনা অনুষ্ঠান আয়োজনে তত্কালীন তথ্য উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
সেই সময় ক্ষমতাসীন সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের দালাল গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত বিপদ উপেক্ষা করে আমার লেখালেখির কারণে একটি ক্ষুদ্র ভক্ত পাঠকগোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। জামায়াতে ইসলামী দলে যথেষ্ট প্রভাব রাখেন, এমন একজন ব্যক্তি টেলিফোন করে প্রথম আলো’র বিতর্কিত কার্টুন নিয়ে আমার কলামে কিছু না লিখতে অনুরোধ করেন। অতি সজ্জন প্রকৃতির সেই ভদ্রলোককে ব্যক্তিগত সততার জন্য আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখলেও তার অনুরোধ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। প্রথম আলোর ইসলাম বিরোধিতার সম্পাদকীয় নীতির কঠোর সমালোচনা করেই আমার সাপ্তাহিক কলামটি যথারীতি লিখেছিলাম। ‘নয়া দিগন্ত’ কর্তৃপক্ষ অবশ্য কোনো কাট-ছাঁট না করেই লেখাটি ছাপিয়েছিলেন। প্রথম আলোর বিষয়ে উল্লিখিত ভদ্রলোকের নমনীয় অবস্থানের পেছনে যুক্তি খোঁজার চেষ্টা করে পরবর্তী সময়ে দু’টি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম। একেবারে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পেরেছি এমন দাবি করব না। তবে আমার ধারণা, দু’টি কারণে তিনি প্রথম আলোর বিষয়ে নমনীয় অবস্থান নেয়ার জন্য ওকালতি করেছিলেন। প্রথমত, হিযবুত তাহরীর যেহেতু ওই আন্দোলনটিতে অন্তত জামায়াতে ইসলামীকে প্রতিযোগিতায় পরাজিত করে ইসলামী মূল্যবোধের পক্ষে লড়াইয়ে প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল, কাজেই তাদের আর অগ্রসর হতে দেয়া দলটি নিজ স্বার্থে বিপজ্জনক মনে করেছিল। আর দ্বিতীয়ত, তখন পর্যন্ত সম্ভবত জামায়াতে ইসলামী নীতিগতভাবে জরুরি সরকারকে কোনো বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে অনাগ্রহী ছিল। জামায়াতে ইসলামী এবং হিযবুত তাহরীরকে সহযোগী দল হিসেবে দেখানোর যে প্রচেষ্টা বর্তমান মহাজোট সরকার গ্রহণ করেছে, দল দু’টির আদর্শগত বিরোধ বিবেচনায় নিলে সরকারের এই প্রচারণা যে বিশ্বাসযোগ্য নয়, সেটি আশা করি বুদ্ধিমান পাঠকমাত্রই বুঝবেন।
পশ্চিমা বিশ্বে শেখ হাসিনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমর্থক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর ইসলামী জঙ্গিত্ব নিয়ে এই অতি সরলীকরণকে শেষ পর্যন্ত কোন দৃষ্টিতে দেখবে, সেটাও ভাববার বিষয়। গত বছর ৬ জানুয়ারি এদেশে সেক্যুলার মোর্চা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের ন্যূনতম মৌলিক অধিকারকেও আর স্বীকার করা হচ্ছে না। বিদেশ যেতে বিমানবন্দরে আইনবহির্ভূতভাবে বাধা প্রদান, গ্রেফতার, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং সর্বশেষ গুম-খুন গণতন্ত্রের লেবাসে এই দেশটিকে গত শতাব্দীর সত্তর দশকের আর্জেন্টিনা অথবা চিলিতে পরিণত করেছে। সেই সময় কমিউনিস্টদের শায়েস্তা করার মহত্ উদ্দেশ্য সাধনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন যেমন দক্ষিণ আমেরিকাতে তাবত্ কিসিমের মানবাধিকার লঙ্ঘনকে চোখ বুজে সমর্থন দিয়েছিল, বাংলাদেশেও আজ তারা একই নীতি অবলম্ব্বন করছে। পার্থক্য কেবল কমিউনিস্ট বিরোধিতার নীতির জায়গায় এখানে ইসলাম বিরোধিতা চলছে। গত দেড় বছরে মাত্র একটিবারই আমরা বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টিকে প্রকাশ্য বিবৃতি প্রদানের মাধ্যমে সরকারের স্বৈরাচারী আচরণের সমালোচনা করতে দেখেছি। সেটি ঘটেছিল যখন জামায়াতে ইসলামী দলের সহকারী মহাসচিব প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাককে (তিনি আমারও আইনজীবী) তার স্ত্রীসহ বিমানবন্দরে শুধু হেনস্তাই করা হয়নি, উল্টো তাদের বিরুদ্ধে সরকার বানোয়াট মামলাও দায়ের করেছিল। জামায়াতে ইসলামী দলের মধ্যম সারির একজন নেতার মৌলিক অধিকার রক্ষার পক্ষে অবস্থান নিয়ে মরিয়ার্টি সাহেব কী সঙ্কেত প্রদান করতে চেয়েছিলেন, তা তিনিই ভালো জানেন। তবে পরবর্তীতে সরকার যখন চূড়ান্ত ফ্যাসিবাদী কায়দায় দলটিকে মিছিল, সভা ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালন করতে বাধা দিয়েছে অথবা দলটির শীর্ষ নেতাদেরকে তুচ্ছ মামলায় গ্রেফতার করেছে; সেই সময় মার্কিন দূতাবাসের নীরবতা বাংলাদেশ সরকারকে মানবাধিকারের অধিকতর লঙ্ঘনে উত্সাহিত করেছে। অপরদিকে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মানববন্ধনের মতো নিরামিষ কর্মসূচি পালনের দুর্বল উদ্যোগকেও দেখা যাচ্ছে মারমুখী পুলিশ এখন পিটিয়ে ভণ্ডুল করে দিচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ‘মুজিববাদে’ বিশ্বাসী ক্ষমতাসীনরা ব্যতীত দেশের অন্য কোনো নাগরিককে কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর অধিকার দেয়া হবে না। এসব নিন্দনীয় আচরণেও ‘গণতন্ত্রের পূজারী’ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী নিদেনপক্ষে উদ্বেগ জানানোরও আর প্রয়োজন বোধ করছে না। সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্ট এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন আসকারা পেয়ে কতটা দুর্বিনীত হয়ে ওঠে, সেটা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে।
বিদেশি প্রভুদের নির্দেশমতো আমাদের সংবিধানের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, মনগড়া ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য তথাকথিত সংবিধান বিশেষজ্ঞরা যে একপায়ে খাড়া থাকেন, তার প্রমাণ এক-এগারোর সময়ই আমরা হাতেনাতে পেয়েছি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তিন মাসের মেয়াদকে কী চমত্কারভাবেই না ইলাস্টিকের মতো টেনে দুই বছর করা হলো। সেই সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো সাংবিধানিক ক্ষমতা না থাকলেও সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এবং রাষ্ট্রের স্বার্থ প্রতিবেশী পরাশক্তির পায়ে বিকিয়ে তারা দেদার এ জাতীয় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অগ্রজপ্রতিম বন্ধু ফরহাদ মজহার প্রায়ই বলে থাকেন, বাংলাদেশের সংবিধান কয়েকজন উকিলের কাট অ্যান্ড পেস্ট (ঈঁঃ ্ চধংঃব) অপারেশনের ফসল, এই দলিল প্রণয়নে জনগণের কোনো ভূমিকা ছিল না। সংবিধান রচয়িতার দাবিদার সেই উকিলরাই তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের নির্দেশে এক-এগারোকে জায়েজ করার জন্য সংবিধানের বিচিত্র সব ব্যাখ্যা দিয়ে সেই সময় জনগণকে বিভ্রান্ত করেছেন। সময়-সুযোগ বুঝে মুখে মানবাধিকারের ফুলঝুরি ছোটালেও জরুরি সরকারের ভয়াবহ সব মানবাধিকার লঙ্ঘনকে মেনে নিয়ে দেশে-বিদেশে তাদের পক্ষে ওকালতি করতে সুশীল (?) সমাজের চাঁইদের বাধেনি। অসংখ্য ব্যক্তির কাছ থেকে অভিযোগ শুনেছি, সেই সময় সংবিধানের ৩৩ ধারাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তাদের নাকি মাসাধিককাল নির্জন স্থানে আটকে রেখে বর্বর নির্যাতন করা হয়েছে। কেউ কেউ চিরদিনের মতোই নিখোঁজ হয়ে গেছেন। আজ নির্বাচিত সরকারের আমলে নিখোঁজ চৌধুরী আলমের এমন পরিণতি কল্পনায় আনাটাকেও আমি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের ভীরুতা ও রাজনৈতিক ব্যর্থতা বলেই মনে করি। বাস্তবতা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ চরিত্রগতভাবে ফ্যাসিবাদী হওয়ায় দলটির নেতাকর্মীরা মানবাধিকারে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করে না। তদুপরি বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মানবাধিকার প্রশ্নে দুর্ভাগ্যজনক নির্লিপ্ততা বাংলাদেশকে ক্রমেই একটি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করছে।
রাষ্ট্র পরিচালনায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়ঙ্কর এবং চরম নিন্দনীয় সংস্কৃতি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মরহুম পিতা স্বাধীনতা-উত্তরকাল থেকেই আরম্ভ করেছিলেন। সেই সময় সিরাজ সিকদারের মতো বামপন্থী-বিপ্লবী নেতাকে পুলিশ হেফাজতে কেবল ঠাণ্ডামাথায় খুন করাই হয়নি, তত্কালীন সংসদে এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড নিয়ে উল্লাস এবং দম্ভ প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই ফ্যাসিবাদী অপশাসনের সাড়ে তিন বছরে তিরিশ হাজার ভিন্ন মতাবলম্বী মুক্তিযোদ্ধাকে রক্ষীবাহিনী এবং পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ হত্যা করেছে। পরবর্তীতে ২০০২ সালে চারদলীয় জোট সরকার আইনশৃঙ্খলা উন্নয়ন কৌশলের নামে উদ্ভট, অমানবিক এবং চরম নির্যাতনমূলক ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ পরিচালনা করে। একই সরকারের সময় এলিট পুলিশ বাহিনী গঠনের নামে র্যাবের আবির্ভাব চিরস্থায়ীভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুযোগ করে দিয়েছে। সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে যতদূর শুনেছি, ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ পরিচালনা এবং র্যাব গঠনে মানবাধিকারের ধ্বজাধারী পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের মৌন সম্মতি ছিল। অবশ্য যতদূর স্মরণে পড়ছে, অপারেশন ক্লিনহার্ট চলাকালীন সেনা হেফাজতে মৃত্যু নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকরা অন্তত প্রকাশ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু এক এগারো এদেশে মানবাধিকারের সংজ্ঞাকেই পাল্টে দিয়েছে। সেই সময় থেকে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনকে উপেক্ষা করার যে নীতি উক্ত কূটনীতিকরা অনুসরণ করে চলেছেন, তা বর্তমানেও অব্যাহত রয়েছে। ক্রসফায়ারের পর গুম-খুনের নতুন পদ্ধতি এদেশে চালু হওয়ার পরও মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট নির্দ্বিধায় বাংলাদেশ সঠিক পথেই এগুচ্ছে বলে সার্টিফিকেটও দিয়েছে। আমার গ্রেফতারের কিছুদিন আগে বিচারবহির্ভূত হত্যা সম্পর্কিত এক ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করেছিলাম। সেখানে ইইউ রাষ্ট্রদূত স্টিফেন ফ্রয়েনকে নির্দ্বিধায় বলতে শুনেছিলাম, বর্তমান সরকারের আমলে ক্রসফায়ারের সংখ্যা কমাতেই তিনি বেজায় সন্তুষ্ট। কিন্তু, আমরা সংবাদ মাধ্যমে যারা কাজ করছি, তারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের উল্টো চিত্রই দেখতে পাচ্ছি।
শেখ হাসিনার দ্বিতীয় দফার প্রধানমন্ত্রিত্বের সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে তিনি একাধারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ভারতের বিশ্বস্ত মিত্রে পরিণত হতে পেরেছেন। বিদেশে এমন বন্ধুভাগ্য থাকলে বাংলাদেশের জনগণকে গরু-ছাগল গণ্য করে নির্বিচারে নির্যাতন বা হত্যা করার অধিকার অনেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই লাভ করা যায়। স্যামুয়েল হান্টিংটনের সভ্যতার সংঘাত তত্ত্ব মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলোতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের জন্য এক ‘সুবর্ণ’ সুযোগ এনে দিয়েছে। আর বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার আবরণে যে রাজনীতি চর্চা হচ্ছে, তাকে সরাসরি ইসলাম-বিদ্বেষ ছাড়া অন্য কিছু বলার সুযোগ নেই। ইসলাম ফোবিয়ায় আক্রান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা ইউরোপের অব্যাহত সমর্থন লাভের অব্যর্থ কৌশল হিসেবে ডিজিটাল সরকার দেশে নিত্য-নতুন কথিত ইসলামী জঙ্গি আবিষ্কার করে চলেছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সন্ত্রাসের সংজ্ঞা বিস্তৃত এবং ধোঁয়াশাচ্ছান্ন করে এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে, যার ফলে কোনো গৃহে ইসলাম ধর্মবিষয়ক বই-পত্র পাওয়া গেলেই তাকে জেহাদি প্রকাশনা নাম দিয়ে নির্বিচারে গ্রেফতার করা যায় এবং জনগণের সকল মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করা হলেও সমালোচনার তেমন কোনো আশঙ্কা থাকে না। একটি কুমিরের ছানা বার বার দেখানোর গল্পের মতো করে ইসলামী জঙ্গি ইস্যুকে এই সরকার সাফল্যজনকভাবে ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশে ইসলামী দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী, হিযবুত তাহরীর, জেএমবি এবং হরকাতুল জেহাদ (হুজি)—এই চারটি সংগঠন নিয়েই এখন সংবাদ মাধ্যমে সর্বাধিক চর্চা হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ছাড়া বাকি তিনটি সংগঠনই সন্ত্রাসের অভিযোগে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী এখন পর্যন্ত আইনত একটি বৈধ রাজনৈতিক দল হলেও এবং সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকা সত্ত্বেও বাস্তবতা হলো, সরকার দলটিকে তাদের সংবিধান প্রদত্ত কোনোরকম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে দিচ্ছে না। দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের সঙ্গে এখন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার প্রচারণাও ক্রমেই বেগবান হচ্ছে। সরকারের মন্ত্রীরা রাখ-ঢাক না করেই দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছেন। জামায়াতে ইসলামী এবং হিযবুত তাহরীরের নেতাদেরকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়ার পর গোয়েন্দা কর্মকর্তারা যেসব সত্য-মিথ্যা তথ্য সংবাদ মাধ্যমে ফাঁস করছেন, সেখান থেকে ধারণা করে নেয়া সহজ যে উভয় দলকেই সরকার সন্ত্রাসের দায়ে অভিযুক্ত করে মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ রূপে দেশের জনগণ ও আন্তর্জাতিক মুরব্বিদের কাছে উপস্থাপন করার কৌশল নিয়েছে। অথচ এই দুটো দল কোনোদিন বন্ধুভাবাপন্ন ছিল এমন প্রমাণ খুঁজে পাওয়া কঠিন। হিযবুত তাহরীর আদর্শগতভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হওয়ার কারণে তারা জামায়াতে ইসলামীকে সর্বদা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের প্রতি দুর্বল একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিবেচনা করেছে। তদুপরি ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে দলটির বিতর্কিত ভূমিকার জন্য হিযবুত তাহরীর তাদের সঙ্গে একটা দূরত্বও বজায় রেখেছে।
অপরদিকে জামায়াতে ইসলামী নেতারা হিযবুত তাহরীরের কর্মকাণ্ডকে হঠকারী বিবেচনা করার পাশাপাশি তাদেরকে ইসলামী আন্দোলনে বাধা হিসেবেও মনে করে। এই প্রসঙ্গে ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা চলাকালীন একটি ঘটনার উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করছি। আমি তখনও আমার দেশ পত্রিকার দায়িত্ব গ্রহণ করিনি বিধায় আমার লেখালেখির একমাত্র জায়গা ‘নয়া দিগন্ত’ পত্রিকা। প্রতি বুধবার সেখানে কলাম লিখতাম। সেই সময় প্রথম আলোর ফান ম্যাগাজিনে আমাদের মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর প্রিয় সাহাবি হজরত আবু হুরায়রাকে (রা.) ব্যঙ্গ করে ছড়াসহ একটি কার্টুন ছাপা হয়। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এ নিয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে জরুরি অবস্থার মধ্যেই বিভিন্ন মসজিদ থেকে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের হতে থাকে। এসব বিক্ষোভ মিছিল আয়োজনে হিযবুত তাহরীর সেই সময় জামায়াতে ইসলামীর তুলনায় অধিকতর সাহসী ভূমিকা পালন করে। অবস্থা সঙ্গিন দেখে শেষ পর্যন্ত প্রথম আলো পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমান বায়তুল মোকাররম মসজিদের তত্কালীন খতিব মরহুম উবায়দুল হকের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন এবং ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করে মুসলমানদের মনে আঘাত দেয়ার জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে বিতর্কটির অবসান ঘটান। ক্ষমাপ্রার্থনা অনুষ্ঠান আয়োজনে তত্কালীন তথ্য উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
সেই সময় ক্ষমতাসীন সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের দালাল গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত বিপদ উপেক্ষা করে আমার লেখালেখির কারণে একটি ক্ষুদ্র ভক্ত পাঠকগোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। জামায়াতে ইসলামী দলে যথেষ্ট প্রভাব রাখেন, এমন একজন ব্যক্তি টেলিফোন করে প্রথম আলো’র বিতর্কিত কার্টুন নিয়ে আমার কলামে কিছু না লিখতে অনুরোধ করেন। অতি সজ্জন প্রকৃতির সেই ভদ্রলোককে ব্যক্তিগত সততার জন্য আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখলেও তার অনুরোধ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। প্রথম আলোর ইসলাম বিরোধিতার সম্পাদকীয় নীতির কঠোর সমালোচনা করেই আমার সাপ্তাহিক কলামটি যথারীতি লিখেছিলাম। ‘নয়া দিগন্ত’ কর্তৃপক্ষ অবশ্য কোনো কাট-ছাঁট না করেই লেখাটি ছাপিয়েছিলেন। প্রথম আলোর বিষয়ে উল্লিখিত ভদ্রলোকের নমনীয় অবস্থানের পেছনে যুক্তি খোঁজার চেষ্টা করে পরবর্তী সময়ে দু’টি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম। একেবারে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পেরেছি এমন দাবি করব না। তবে আমার ধারণা, দু’টি কারণে তিনি প্রথম আলোর বিষয়ে নমনীয় অবস্থান নেয়ার জন্য ওকালতি করেছিলেন। প্রথমত, হিযবুত তাহরীর যেহেতু ওই আন্দোলনটিতে অন্তত জামায়াতে ইসলামীকে প্রতিযোগিতায় পরাজিত করে ইসলামী মূল্যবোধের পক্ষে লড়াইয়ে প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল, কাজেই তাদের আর অগ্রসর হতে দেয়া দলটি নিজ স্বার্থে বিপজ্জনক মনে করেছিল। আর দ্বিতীয়ত, তখন পর্যন্ত সম্ভবত জামায়াতে ইসলামী নীতিগতভাবে জরুরি সরকারকে কোনো বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে অনাগ্রহী ছিল। জামায়াতে ইসলামী এবং হিযবুত তাহরীরকে সহযোগী দল হিসেবে দেখানোর যে প্রচেষ্টা বর্তমান মহাজোট সরকার গ্রহণ করেছে, দল দু’টির আদর্শগত বিরোধ বিবেচনায় নিলে সরকারের এই প্রচারণা যে বিশ্বাসযোগ্য নয়, সেটি আশা করি বুদ্ধিমান পাঠকমাত্রই বুঝবেন।
পশ্চিমা বিশ্বে শেখ হাসিনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমর্থক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর ইসলামী জঙ্গিত্ব নিয়ে এই অতি সরলীকরণকে শেষ পর্যন্ত কোন দৃষ্টিতে দেখবে, সেটাও ভাববার বিষয়। গত বছর ৬ জানুয়ারি এদেশে সেক্যুলার মোর্চা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের ন্যূনতম মৌলিক অধিকারকেও আর স্বীকার করা হচ্ছে না। বিদেশ যেতে বিমানবন্দরে আইনবহির্ভূতভাবে বাধা প্রদান, গ্রেফতার, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং সর্বশেষ গুম-খুন গণতন্ত্রের লেবাসে এই দেশটিকে গত শতাব্দীর সত্তর দশকের আর্জেন্টিনা অথবা চিলিতে পরিণত করেছে। সেই সময় কমিউনিস্টদের শায়েস্তা করার মহত্ উদ্দেশ্য সাধনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন যেমন দক্ষিণ আমেরিকাতে তাবত্ কিসিমের মানবাধিকার লঙ্ঘনকে চোখ বুজে সমর্থন দিয়েছিল, বাংলাদেশেও আজ তারা একই নীতি অবলম্ব্বন করছে। পার্থক্য কেবল কমিউনিস্ট বিরোধিতার নীতির জায়গায় এখানে ইসলাম বিরোধিতা চলছে। গত দেড় বছরে মাত্র একটিবারই আমরা বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টিকে প্রকাশ্য বিবৃতি প্রদানের মাধ্যমে সরকারের স্বৈরাচারী আচরণের সমালোচনা করতে দেখেছি। সেটি ঘটেছিল যখন জামায়াতে ইসলামী দলের সহকারী মহাসচিব প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাককে (তিনি আমারও আইনজীবী) তার স্ত্রীসহ বিমানবন্দরে শুধু হেনস্তাই করা হয়নি, উল্টো তাদের বিরুদ্ধে সরকার বানোয়াট মামলাও দায়ের করেছিল। জামায়াতে ইসলামী দলের মধ্যম সারির একজন নেতার মৌলিক অধিকার রক্ষার পক্ষে অবস্থান নিয়ে মরিয়ার্টি সাহেব কী সঙ্কেত প্রদান করতে চেয়েছিলেন, তা তিনিই ভালো জানেন। তবে পরবর্তীতে সরকার যখন চূড়ান্ত ফ্যাসিবাদী কায়দায় দলটিকে মিছিল, সভা ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালন করতে বাধা দিয়েছে অথবা দলটির শীর্ষ নেতাদেরকে তুচ্ছ মামলায় গ্রেফতার করেছে; সেই সময় মার্কিন দূতাবাসের নীরবতা বাংলাদেশ সরকারকে মানবাধিকারের অধিকতর লঙ্ঘনে উত্সাহিত করেছে। অপরদিকে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মানববন্ধনের মতো নিরামিষ কর্মসূচি পালনের দুর্বল উদ্যোগকেও দেখা যাচ্ছে মারমুখী পুলিশ এখন পিটিয়ে ভণ্ডুল করে দিচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ‘মুজিববাদে’ বিশ্বাসী ক্ষমতাসীনরা ব্যতীত দেশের অন্য কোনো নাগরিককে কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর অধিকার দেয়া হবে না। এসব নিন্দনীয় আচরণেও ‘গণতন্ত্রের পূজারী’ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী নিদেনপক্ষে উদ্বেগ জানানোরও আর প্রয়োজন বোধ করছে না। সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্ট এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন আসকারা পেয়ে কতটা দুর্বিনীত হয়ে ওঠে, সেটা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে।
No comments