৮- মরতেই যদি হয়, তাহলে অন্তত আততায়ীর চেহারা দেখে চিরতরে চোখ বন্ধ করতে চাই
গন্তব্য মিন্টো রোডের ডিবি অফিস
ক্যান্টনমেন্ট থানার বিশেষ রাতের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার পর থেকে রাতে ঘুমানো ছেড়ে দিয়েছি। এদের হাতে মরতেই যদি হয়, তাহলে অন্তত আততায়ীর চেহারা দেখে চিরতরে চোখ বন্ধ করতে চাই। নয় দিনের রিমান্ডে সাত কেজি ওজন কমে গেছে। দুই হাতের চামড়া টানলেই সাপের খোলস ছাড়ানোর মতো করে উঠে যাচ্ছে। তবু জেলে এসে রিমান্ডের ডাকের অপেক্ষা করতে লাগলাম ...
ক্যান্টনমেন্ট থানার বিশেষ রাতের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার পর থেকে রাতে ঘুমানো ছেড়ে দিয়েছি। এদের হাতে মরতেই যদি হয়, তাহলে অন্তত আততায়ীর চেহারা দেখে চিরতরে চোখ বন্ধ করতে চাই। নয় দিনের রিমান্ডে সাত কেজি ওজন কমে গেছে। দুই হাতের চামড়া টানলেই সাপের খোলস ছাড়ানোর মতো করে উঠে যাচ্ছে। তবু জেলে এসে রিমান্ডের ডাকের অপেক্ষা করতে লাগলাম ...
প্রিজন ভ্যানে ওঠার সময় জানলাম, আমরা ক্যান্টনমেন্ট থানায় যাচ্ছি না। এবারের গন্তব্য মিন্টো রোডের ডিবি অফিস। শেখ হাসিনার আগের পাঁচ বছরের শাসনকালে সেখানেই রুবেল নামে সিদ্ধেশ্বরী এলাকার এক নিরপরাধ কলেজছাত্রকে স্থানীয় মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রীর মিথ্যা অভিযোগের প্রেক্ষিতে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। পুলিশেরই সোর্স জালালকে খুন করে তার মৃতদেহ ডিবি অফিসের ছাদের পানির ট্যাংকের মধ্যে ফেলে রাখা হয়েছিল। জালাল হত্যার বিচার নিয়ে উদ্দেশ্যমূলক টালবাহানা করার অভিযোগে তত্কালীন পিপি অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল হাইকোর্ট। প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের প্রেক্ষিতে বিচারপতি এস কে সিনহা এক সুয়ো মোটো (ঝঁড় সড়ঃড়) রায়ে এই অব্যাহতি প্রদান করেছিলেন। কর্তব্যকাজে গাফিলতির জন্যে অব্যাহতিপ্রাপ্ত সেই পিপি অবশ্য ভাগ্যগুণে আজ বাংলাদেশের আইন প্রতিমন্ত্রী। ক্যান্টনমেন্ট থানায় আমার ওপর যে হত্যা প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল, তারই হয়তো চূড়ান্ত রূপ দেয়া হবে ডিবি’র চারদিনের রিমান্ডে। সিএমএম আদালত থেকে মিন্টো রোডের দূরত্ব বেশি নয়। সাত-পাঁচ ভাবনার মাঝখানেই প্রিজন ভ্যান ডিবি অফিসের গেট দিয়ে প্রবেশ করল। কবজি উল্টে দেখি সন্ধ্যা ছ’টা পার হয়েছে।
জীবনে প্রথমবারের মতো ডিবি অফিসে এসে দেখলাম, যথেষ্ট পুরনো এক দ্বিতল ভবন। আমাকে নিচতলার এক হাজতে নিয়ে যাওয়া হলো। হাজতের সামনেটা অফিস। তিন-চারটে চেয়ার-টেবিল পাতা রয়েছে। সেখানে সবাই কাজ করছেন। পাশে একটা লম্বা বেঞ্চও রয়েছে। সম্ভবত আসামিদের খোঁজে আগত আত্মীয়-স্বজনরা সেখান বসে অপেক্ষা করেন। আমার সঙ্গে কাঁধে ঝোলানো যায় এমন একটা ছোট সাদা ব্যাগ। ব্যাগটি ডিউটি অফিসার গ্রহণ করলেন। স্যান্ডেল খুলে খালি পায়ে আমাকে হাজতে প্রবেশ করতে হলো। এর উদ্দেশ্য হাজতের মেঝে অপরিষ্কার হওয়া থেকে রক্ষা করা হতে পারে। তবে আমার কাছে মনে হলো, ব্যাপারটি প্রচ্ছন্ন অপমানের মাধ্যমে মানসিকভাবে দুর্বল করার কৌশল। এখানে সৌভাগ্যবশত আমাকে অন্তত টুথ ব্রাশ, পেস্ট এবং সাবান সঙ্গে রাখার অনুমতি দেয়া হলো। হাজতটি আকারে ছোট হলেও একজন আসামির জন্যে যথেষ্ট। ক্যান্টনমেন্ট থানা হাজতের মতোই সেলের এক কোণে ধূলি ধূসরিত কম্বলের স্তূপ পড়ে আছে। আমি মাটিতে বসে পড়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে তীব্র সোঁদা গন্ধযুক্ত দুটো অতিরিক্ত কম্বল আমাকে দিয়ে বলা হলো, একটি বিছানা এবং অপরটি বালিশরূপে ব্যবহার করতে হবে। নির্দেশমত মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে তার ওপর বসলাম। ঘরের কোণের ময়লা কম্বলের স্তূপ যথাস্থানে অব্যবহৃত পড়ে রইলো। টয়লেটে যাওয়ার জন্যে উঠলাম। সেলের লাগোয়া টয়লেট। আব্রু রক্ষার ব্যবস্থা ক্যান্টনমেন্ট থানার তুলনায় কিছুটা উন্নত হলেও টয়লেটের ভেতরের অবস্থা ভয়াবহ। মেঝে এবং প্যান সম্ভবত নির্মাণের পর থেকে কোনোদিন পরিষ্কার করা হয়নি। ময়লা জমে জমে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গণ-টয়লেটের মতোই প্যানের ওপর ময়লা ভাসছে। টয়লেটের ভেতরে কোনো আলোর ব্যবস্থা না থাকায় এবং মেঝে ভয়াবহ রকম পিচ্ছিল হওয়ায় যে কোনো সময় পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙার আশঙ্কা প্রবল। এক কোণে পানির কল এবং টয়লেটের তাবত্ কর্ম সম্পাদনের জন্যে একটিমাত্র বদনা। কলে পানি আছে দেখে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। যে কাজে ঢুকেছিলাম, সেটি সম্পন্ন না করেই বার হয়ে এসে ডিউটি অফিসারকে প্যানের ময়লা যাতে পানি ঢাললে যায় অন্তত সেই ব্যবস্থাটুকু করবার অনুরোধ করলাম। জবাব পেলাম, পরেরদিন ঝাড়ুদার না আসা পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে না। একটি রাত ওই পরিবেশেই আমাকে মানিয়ে নিতে হবে। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই বিবেচনা করে সোঁদা কম্বলের আশ্রয়ে ফিরে গেলাম। জুনের প্রচণ্ড গরমে দরদর করে ঘামছি। খানিক বাদে আমার সেলের বাইরে মিউজিয়ামে যাওয়ার উপযুক্ত একটা পেডেস্টাল ফ্যান কোথা থেকে আনা হলো। অনেক কসরত্ করে সেটা আমার দিকে তাক করে চালিয়ে দেয়া হলে গারদের ফাঁক দিয়ে কিছুটা বাতাস সেলের ভেতরে প্রবাহিত হলে কৃতজ্ঞবোধ করলাম। ক্যান্টনমেন্ট থানায় তিনদিনে আমার শরীর থেকে যে পরিমাণ ঘাম ঝরেছে, তাতে কিডনির বারোটা বেজে যাওয়ার কথা। মশাও মনে হলো ক্যান্টনমেন্টের তুলনায় অনেক কম। ওখানে তিনদিনের অবস্থানে মশার কামড় এবং ঘামাচিতে আমার সর্বাঙ্গ ছেয়ে গেছে।
ঘণ্টাদুয়েক পর ডিবি’র কয়েকজন কর্মকর্তা এসে জানালেন, ওই রাতে আমার কোনো জিজ্ঞাসাবাদ হবে না। আমি বিশ্রাম নিতে পারি। কর্মকর্তাদের মধ্যে একজনকে চিনতে পারলাম। গ্রেফতারের রাতে শত শত পুলিশের মধ্যে তিনিও ছিলেন। তাকে বিশেষভাবে মনে রাখার কারণটি হলো, গ্রেফতারের মুহূর্তে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, আমার হাত ধরেন স্যার, আপনার নিরাপত্তা আমি দেব। আমি জবাব দিয়েছিলাম, আপনি মনুষ্যমাত্র, আমি নিরাপত্তার জন্যে আল্লাহ ছাড়া আর কারও ওপর নির্ভর করি না। যাই হোক, তরুণটির নাম জানলাম। তিনি এডিসি নজরুল। রাতের আহারের প্রসঙ্গ উঠলে এক কাপ চা খেতে চাইলাম। বাসা থেকে পাঠানো ঝোলা ব্যাগের ভেতর থেকে এক প্যাকেট বিস্কুট বার করলাম। সেই বিস্কুটের প্যাকেটটি সঙ্গে রাখার অনুমতি চাইলে আবেদন মঞ্জুর হলো। ক্যান্টনমেন্ট থানায় বিশেষ রাতের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার পর থেকে রাতে ঘুমানো ছেড়ে দিয়েছি। এদের হাতে মরতেই যদি হয়, তাহলে অন্তত আততায়ীর চেহারা দেখে তারপর চিরতরে চোখ বন্ধ করতে চাই। ডিবি’র সেলের চতুর্দিকে নানান কিসিমের ক্যামেরা লাগানো রয়েছে। ডিউটি অফিসারদের সঙ্গে বাক্যালাপ বিপজ্জনক। বিপদটা আসামির নয়, সেটি পুলিশ কর্মকর্তার। ওপরআলাদের কোনো রকম সন্দেহ হলেই নিদেনপক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামে বদলি। গুরুতর কিছু ঘটলে চাকরিটাও যাবে। নিম্নস্তরের পুলিশ কর্মকর্তারা আমাদের সিস্টেমে সবচেয়ে অসহায় শ্রেণী। দ্বিতীয় কম্বলটা ভাঁজ করে মাথার নিচে দিয়ে ফজরের প্রতীক্ষা করতে লাগলাম। ঘুম তাড়ানোর জন্যে কম্বলের গন্ধই যথেষ্ট। রাত তিনটায় কম্বলশয্যা ত্যাগ করলাম।
সেলের বাইরে রাতের প্রহরীরা সবাই ঘুমাচ্ছে। কেউ চেয়ারে বসে, আর অন্যরা বেঞ্চে শুয়ে। নোংরা টয়লেটের অন্ধকারে অনেকক্ষণ ধরে গোসল করলাম। গুলশানে বাস করেও সেখানকার এলিট শ্রেণীর বিলাসিতায় অভ্যস্ত না হওয়ার সুফল পাচ্ছি গ্রেফতারের রাত থেকেই। জীবনের প্রায় শেষপ্রান্তে উপনীত হলেও গেণ্ডারিয়ার মধ্যবিত্ত পরিবারের কিশোর আমাকে কখনও ত্যাগ করে যায়নি। গোসল সেরে বেরিয়ে গারদের বাইরের সেই ফ্যানের সামনে জোড়াসনে বসলাম। মাথায় চুল কম থাকাও যে সুবিধাজনক, সেটা প্রমাণ হলো স্বল্প সময়ের মধ্যে চুল শুকিয়ে যাওয়ায়। সঙ্গে গামছা বা তোয়ালে নেই তাই শরীর মোছাও সম্ভব হয়নি। গায়ের পানি গায়েই শুকালো। বাড়ির কথা ভাবছিলাম। আগের দিনেই জেনেছি, মা এখন পর্যন্ত শক্ত থাকতে পারলেও পারভীন অসুস্থ হয়ে পড়েছে। রিমান্ডে আমার জীবন ধারণের অবস্থাটা জানলে দু’জনই অসুস্থ হবেন। চৈত্র মাসের কাঠফাটা গরমেও ঈষত্ গরম পানিতে গোসল করা আমার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। ঠাণ্ডা পানিতে সাইনাসের প্রকোপ বেড়ে যায়। ডিবি অফিসে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করতে তো হচ্ছেই, ভেজা শরীর শুকাচ্ছি ফ্যানের বাতাসে। ফজরের আজান এবং আমার সেলের পাশের বিশাল কড়ই গাছে আশ্রয় নেয়া অসংখ্য পাখির কিচিরমিচির সুবেহ্ সাদেকের আগমনী জানান দিল। নামাজে আল্লাহর কাছে ভিক্ষা জানালাম, আমার বন্দি জীবনে এক মুহূর্তের জন্যেও যেন জালিম সরকারের মুখাপেক্ষী হতে না হয়। জালিমের করুণা প্রত্যাশী হওয়ার পরিবর্তে আমার সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রত্যাবর্তন সর্বসময় আকাঙ্ক্ষিত। ফজরের নামাজ অন্তে এক ঘণ্টা বোধহয় ঘুমাতে পেরেছিলাম। এর মধ্যেই নতুন শিফটের লোকজন এসে তাদের দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছে। চেয়ার টানার শব্দ, তাদের কথোপকথন ঘুম ভাঙিয়ে দিল। রুটি, ডিমভাজি এবং রঙ চা’র বরাদ্দ দিয়ে নাস্তাপর্ব শেষ করে অন্তহীন অপেক্ষা শুরু হলো। দুপুরে কম্বলের ওপর বসে আছি। হঠাত্ দেখলাম সামনের করিডোর দিয়ে ফকরুল আলম কাঞ্চন দ্রুত হেঁটে গেল। যাওয়ার সময় মনে হলো, যেন সে আমাকে লক্ষ্য করেছে। কাঞ্চন আমাদের সংবাদপত্রের ক্রাইম বিভাগের প্রধান। মনের ভার এক নিমেষে হালকা হয়ে গেল। বাইরের পৃথিবী আমার অবস্থানটা এবার জানবে।
রাত এগারোটায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে আইও নুরুল আমিন নিতে এলেন। তার সঙ্গে দোতলায় ডিসি ডিবি (উত্তর) মাহবুবুর রহমানের কক্ষে গেলাম। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন এডিসি নজরুল। প্রাথমিক সৌজন্য প্রদর্শন শেষ হলে জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব শুরু হলো। আমি অভিযোগ জানতে চাইলাম। হিযবুত তাহরিরকে জড়িয়ে আমার বিরুদ্ধে ইসলামী জঙ্গিত্বের হাস্যকর অভিযোগ উত্থাপন করলেন ডিবি’র ইন্সপেক্টর নুরুল আমিন। আমার অপরাধ তিনটি। প্রথমত. হিযবুত তাহরিরের কোনো এক লিফলেটের ভাষার সঙ্গে আমার দেশ-এ প্রকাশিত সংবাদের মিল রয়েছে। দ্বিতীয়ত. আমার দেশ কার্যালয় বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল সংস্থার যে বাণিজ্যিক ভবনের ১১ তলায় অবস্থিত, সেই ভবনেরই কোনো এক তলায় হিযবুত তাহরিরের এক কথিত নেতার অফিস রয়েছে। সেই নেতা নাকি আমার সঙ্গে তাদের সংগঠনের প্রচারের উদ্দেশ্যে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। এবং তৃতীয়ত, আমার দেশ প্রেসে হিযবুত তাহরিরের লিফলেট ছাপা হওয়ার সন্দেহ করছে পুলিশ। জবাবে আমি বললাম, আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অথবা আমার কোনো লেখা নিয়ে হিযবুত তাহরির লিফলেট তৈরি করেছে এমন কোনো সংবাদ আমার জানা নেই। আর যদি আমাদের অজ্ঞাতসারে তেমন কিছু করেও থাকে, তাহলে সেক্ষেত্রে আমার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ উত্থাপনের কোনো সুযোগই নেই। আমার লেখা উদ্ধৃত করে ইচ্ছে করলে সরকারও লিফলেট ছাপাতে পারে। দ্বিতীয়ত, সরকারি ভবনে হিযবুত তাহরিরের লোকজন অফিস খুললে তার দায়িত্ব ভবন মালিকের, আমার নয়। তাছাড়া যে ব্যক্তির কথা বলা হচ্ছে, তেমন কোনো ব্যক্তির সঙ্গে কস্মিনকালেও আমার কোনোরকম যোগাযোগ হয়নি। এমন কোনো ব্যক্তিকে আমি চিনি না। আর সর্বশেষ, সংবাদপত্রের প্রেসের যন্ত্রপাতি দিয়ে লিফলেট ছাপানো যায় না। তার জন্য ভিন্ন প্রেস লাগে। আমি এটাও বললাম, আমার বিরুদ্ধে ইসলামী সন্ত্রাসের মামলা দিয়ে আপনারা সন্ত্রাসের মতো গুরুতর ও রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক বিষয়কে খেলো করে ফেলছেন। দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে এই খেলা থেকে তাদের নিবৃত্ত হতেও পরামর্শ দিলাম। হিযবুত তাহরির নিয়ে আলোচনা এখানেই সমাপ্ত হলো।
এরপর এলো আসল প্রসঙ্গ। এডিসি নজরুল জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কেন আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিবাদী বলি এবং আমার দেশ সরকারের এত তীব্র সমালোচনা কেন করে? এই প্রশ্নের সঙ্গেই আমার গ্রেফতারের প্রকৃত কারণ প্রকাশ হয়ে গেল। আরও ঘণ্টাখানেক এই বিষয় নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা শেষে ডিসি মাহবুবুর রহমান উঠে দাঁড়িয়ে জানান দিলেন, আজ রাতের মতো জিজ্ঞাসাবাদের পালা শেষ। সেলে যখন ফিরলাম, দেখলাম একটা বেজে গেছে। পূর্বরাতের মতোই শেষ রাতে গোসল, নামাজ শেষে ঘুমিয়ে পড়লাম। সারাদিন একইভাবে কেটে গেল। সকালের নাস্তাটা কোনোক্রমে গলাধঃকরণ করলেও, ওরকম পরিবেশে ভাত খাওয়ার রুচি হয় না। অতএব খাদ্য বলতে খানিক পরপর চা এবং একটা করে বিস্কুট। রাত এগারোটায় পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে নুরুল আমিন আবারও সেল থেকে নিয়ে গেলেন। আজ অতিরিক্ত কয়েকটি কথা বললাম।
আমি সংবাদপত্রে লেখালেখি করি কেবল এই কারণেই আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদী দলে পরিণত হয়ে যাচ্ছে না। জনমত এত সহজে প্রভাবিত হয় না। তাছাড়া আমি এমন কিছু শক্তিশালী লেখকও নই। বাস্তবতা হলো, দলটির শীর্ষ পর্যায় থেকে সাধারণ কর্মী পর্যন্ত প্রতিটি ব্যক্তির অসহিষ্ণু এবং চরম অগণতান্ত্রিক আচরণই জনগণকে বাধ্য করছে তাদেরকে এই বিশেষণে অভিহিত করতে। ১৯৭৫ সালে চারটি ছাড়া দেশের সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া, শত শত পুলিশ পাঠিয়ে আমার দেশ বেআইনিভাবে বন্ধ ঘোষণা করে তালা ঝুলিয়ে দেয়া, আমাকে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নির্যাতন, হত্যা প্রচেষ্টা—এসবই ফ্যাসিবাদী আচরণের মধ্যে পড়ে। ক্যান্টনমেন্ট থানার ঘটনার কথা শুনে উপস্থিত তিন ডিবি কর্মকর্তাই নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ আমি একাই কথা বলে গেলাম। এটাও বললাম, আমার দেশকে কেন্দ্র করে সরকারের ন্যক্কারজনক আচরণ তাদের কপালে যে কলঙ্ক তিলক এঁকে দিয়েছে, সেটি আর মোছা যাবে না। দীর্ঘ তিন যুগ পর আজও যেমন করে আমরা ১৯৭৫ সালের ১৫ জুনকে সংবাদপত্রের কালো দিবস হিসেবে ঘৃণা সহকারে পালন করে থাকি, একইভাবে ভবিষ্যত্ প্রজন্ম আমার দেশ বন্ধ করার অপচেষ্টার জন্যে আওয়ামী লীগকে ধিক্কার দিয়ে যাবে। আমি দৃঢ়তার সঙ্গে এটাও বললাম, আমাকে হয়তো দীর্ঘদিন বন্দি করে রাখা যাবে; কিন্তু আমার দেশ বন্ধ করে রাখা সাম্রাজ্যবাদীদের সমর্থনধন্য প্রবল প্রতাপশালী প্রধানমন্ত্রীর পক্ষেও সম্ভব হবে না। আমার বক্তব্যের ওপর কোনো মন্তব্য না করে ডিসি মাহবুবুর রহমান বারবার বলার চেষ্টা করছিলেন, তারেক জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগকে জনমন থেকে ভুলিয়ে দিতেই আমার দেশ পত্রিকা সজীব ওয়াজেদ জয় সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি ছাপিয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনের পক্ষে সব কাগজপত্র আমাদের সাংবাদিকের কাছে রয়েছে এবং সুস্থ সাংবাদিকতার সব নীতিমালা মেনেই যে সংবাদটি ছাপানো হয়েছে, এ বিষয়টি জোরের সঙ্গে উল্লেখ করলাম। তাকে জানালাম, তারেক জিয়ার দুর্নীতির অভিযোগের সঙ্গে ওই সংবাদ প্রকাশের বিষয়টি কোনোক্রমেই সম্পর্কিত নয়। এ রাতেও প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হতে দেড়টা বেজে গেল। ছাড়া পেয়ে সেলে এসে সটান শুয়ে পড়লাম। পরের রাতে জিজ্ঞাসাবাদ আরও সংক্ষিপ্ত হলো। আমার বিরুদ্ধে সরকারের নতুন মামলা দায়েরের খবর পেলাম। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশের প্রেক্ষিতে দুদক মামলা করেছে। এই আইনবহির্ভূত কাজের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি প্রমাণ করলো তারা স্বাধীন তো নয়ই; বরং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক্সটেনশন মাত্র। এই প্রত্যাশিত মামলা দায়েরে কোনোরকম উদ্বেগ বোধ না করে সংবাদটি জানানোর জন্য মাহবুবুর রহমানকে ধন্যবাদ জানিয়ে মধ্যরাতে সেলে ফিরলাম।
১৬ জুন, দুপুর একটা। সেলে চুপচাপ বসে আছি। আইও হন্তদন্ত হয়ে এসে তৈরি হতে বললেন। তখনই আদালতে যেতে হবে। ইসলামী জঙ্গিত্বের মামলার রিমান্ড শেষ হয়েছে। আদালতে উপস্থিত হতেই আইনজীবী, সাংবাদিক আমাকে দেখে আঁেক উঠলেন। সমস্বরে বলে উঠলেন, মাহমুদ ভাই এ কী চেহারা হয়েছে আপনার! রিমান্ডের নয়দিনে আয়না দেখার সুযোগ হয়নি, তাই শুভানুধ্যায়ীদের এতখানি উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠার হেতু ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ভাবলাম, নয়দিনের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হয়তো আমাকে ভয়ঙ্কর লাগছে। গাত্রবর্ণ ঘোর কৃষ্ণবর্ণ হওয়ায় সুদর্শন হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। রিমান্ডের ধাক্কায় আজ চেহারার দিকে সম্ভবত তাকানোই যাচ্ছে না। হাসিমুখেই বললাম, আয়না তো দেখিনি, কেমন করে বলবো কী চেহারা হয়েছে। যে তরুণ ম্যাজিস্ট্রেটটি আমাকে একটানা আটদিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছিলেন, তারই এজলাসে আমাকে তোলা হলো। ম্যাজিস্ট্রেটের দিকে একবারের জন্যেও তাকাতে আমার ইচ্ছে হলো না। সরকার এবং আসামিপক্ষের আইনজীবীদের বিতর্কের পুরোটা সময় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে দরজা দিয়ে সোজা বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। রিমান্ডের যে চারদিন তখনও বাকি রয়েছে, সেটি পুরো করতে পরবর্তী অজানা গন্তব্যে যাওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। ম্যাজিস্ট্রেটের দিকে আমি দৃষ্টিপাত না করলেও তিনি সম্ভবত মাত্র ক’দিনে আমার শারীরিক অবস্থার আশঙ্কাজনক পরিবর্তন লক্ষ্য করে থাকবেন। মামলার সব পক্ষকে অবাক করে আমাকে রিমান্ডে প্রেরণের পরিবর্তে জেলহাজতে পাঠিয়ে যথাযথ চিকিত্সার নির্দেশ দিয়ে বসলেন তরুণ সেই ম্যাজিস্ট্রেট। ভাবলাম সুপ্ত বিবেক হয়তো জেগে উঠেছে। আমার পক্ষের সবাই বেজায় খুশি। আমি কিন্তু কোনো আনন্দ অনুভব করছিলাম না। নয়দিনের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় আমি শারীরিক ও মানসিক উভয় যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করতে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমার কাছে রিমান্ড সমাপ্ত না করে জেলহাজতে ফিরে যাওয়াটা উটকো ঝামেলার মতো বোধ হলো। ভাবছিলাম, সবটা একবারে সাঙ্গ করে জেলে ফিরলেই তো ভালো ছিল।
সন্ধ্যা পার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সাত নম্বর সেলে ফেরার আগেই লক-আপ হয়ে গেছে। আমার প্রতিবেশীরা যার যার সেলে বন্দি। জেলে আসার প্রথম রাতের মতো ড্রামের তোলা পানিতে গোসল করে আমিও ভেতরে ঢুকে গেলাম। ডিভিশন সেল থেকে পাঠানো খাবার দিয়ে রাতের আহার শেষ করেই ঘুমিয়ে পড়লাম। দীর্ঘ নয় রাত পর এই ঘুম। নির্যাতন কিংবা হত্যার আশঙ্কা নেই এমন পরিবেশে ফিরে আসতে পেরে ঘুমটা লম্বাই হলো। সকালে উঠে নাস্তার পাট শেষ না হতেই জেল হাসপাতালের ডাক্তার এসে হাজির। আমার দিকে একনজর তাকিয়েই হাসপাতালে গিয়ে অন্তত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করাতে অনুরোধ করলেন। কথা না বাড়িয়ে ডাক্তারের সঙ্গে গেলাম। প্রথমেই ওজন পরীক্ষা। নয় দিনের রিমান্ডে ওজনের দশ শতাংশ অর্থাত্ সাত কেজি কমে গেছে। অথচ ডায়াবেটিস পাওয়া গেল না। তবে দুই হাতের চামড়া টানলেই সাপের খোলস ছাড়ানোর মতো করে উঠে যাচ্ছে। অবাক কাণ্ড, আমি একটুও দুর্বল বোধ করছি না। সমস্যার মধ্যে কোমরে এবং ঘাড়ে স্পনিডলাইটিসের পুরনো ব্যথাটা বেশ বেড়েছে। তারপরও আমি রিমান্ডে যাওয়ার জন্যে উদগ্রীব। জালিমকে মোকাবিলা করার মানসিক শক্তি আমার শারীরিক অক্ষমতাকে অতিক্রম করে গেছে। ডাক্তারদের বললাম, সুপারের মাধ্যমে ডিবি অফিসে আমার সুস্থতার সংবাদ জানিয়ে দিতে। তারা কিছুতেই সম্মত না হয়ে পিজি থেকে ডাক্তার ডাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। একদিন পর পিজির ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে বেশকিছু বেদনানাশক এবং বলবর্ধক ওষুধ পাঠালে আমি সেগুলো ছেঁড়া কাগজের ঝুড়িতে নিক্ষেপ করলাম। নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো জেলে বসে রিমান্ডের ডাকের অপেক্ষা করতে লাগলাম।
জীবনে প্রথমবারের মতো ডিবি অফিসে এসে দেখলাম, যথেষ্ট পুরনো এক দ্বিতল ভবন। আমাকে নিচতলার এক হাজতে নিয়ে যাওয়া হলো। হাজতের সামনেটা অফিস। তিন-চারটে চেয়ার-টেবিল পাতা রয়েছে। সেখানে সবাই কাজ করছেন। পাশে একটা লম্বা বেঞ্চও রয়েছে। সম্ভবত আসামিদের খোঁজে আগত আত্মীয়-স্বজনরা সেখান বসে অপেক্ষা করেন। আমার সঙ্গে কাঁধে ঝোলানো যায় এমন একটা ছোট সাদা ব্যাগ। ব্যাগটি ডিউটি অফিসার গ্রহণ করলেন। স্যান্ডেল খুলে খালি পায়ে আমাকে হাজতে প্রবেশ করতে হলো। এর উদ্দেশ্য হাজতের মেঝে অপরিষ্কার হওয়া থেকে রক্ষা করা হতে পারে। তবে আমার কাছে মনে হলো, ব্যাপারটি প্রচ্ছন্ন অপমানের মাধ্যমে মানসিকভাবে দুর্বল করার কৌশল। এখানে সৌভাগ্যবশত আমাকে অন্তত টুথ ব্রাশ, পেস্ট এবং সাবান সঙ্গে রাখার অনুমতি দেয়া হলো। হাজতটি আকারে ছোট হলেও একজন আসামির জন্যে যথেষ্ট। ক্যান্টনমেন্ট থানা হাজতের মতোই সেলের এক কোণে ধূলি ধূসরিত কম্বলের স্তূপ পড়ে আছে। আমি মাটিতে বসে পড়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে তীব্র সোঁদা গন্ধযুক্ত দুটো অতিরিক্ত কম্বল আমাকে দিয়ে বলা হলো, একটি বিছানা এবং অপরটি বালিশরূপে ব্যবহার করতে হবে। নির্দেশমত মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে তার ওপর বসলাম। ঘরের কোণের ময়লা কম্বলের স্তূপ যথাস্থানে অব্যবহৃত পড়ে রইলো। টয়লেটে যাওয়ার জন্যে উঠলাম। সেলের লাগোয়া টয়লেট। আব্রু রক্ষার ব্যবস্থা ক্যান্টনমেন্ট থানার তুলনায় কিছুটা উন্নত হলেও টয়লেটের ভেতরের অবস্থা ভয়াবহ। মেঝে এবং প্যান সম্ভবত নির্মাণের পর থেকে কোনোদিন পরিষ্কার করা হয়নি। ময়লা জমে জমে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গণ-টয়লেটের মতোই প্যানের ওপর ময়লা ভাসছে। টয়লেটের ভেতরে কোনো আলোর ব্যবস্থা না থাকায় এবং মেঝে ভয়াবহ রকম পিচ্ছিল হওয়ায় যে কোনো সময় পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙার আশঙ্কা প্রবল। এক কোণে পানির কল এবং টয়লেটের তাবত্ কর্ম সম্পাদনের জন্যে একটিমাত্র বদনা। কলে পানি আছে দেখে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। যে কাজে ঢুকেছিলাম, সেটি সম্পন্ন না করেই বার হয়ে এসে ডিউটি অফিসারকে প্যানের ময়লা যাতে পানি ঢাললে যায় অন্তত সেই ব্যবস্থাটুকু করবার অনুরোধ করলাম। জবাব পেলাম, পরেরদিন ঝাড়ুদার না আসা পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে না। একটি রাত ওই পরিবেশেই আমাকে মানিয়ে নিতে হবে। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই বিবেচনা করে সোঁদা কম্বলের আশ্রয়ে ফিরে গেলাম। জুনের প্রচণ্ড গরমে দরদর করে ঘামছি। খানিক বাদে আমার সেলের বাইরে মিউজিয়ামে যাওয়ার উপযুক্ত একটা পেডেস্টাল ফ্যান কোথা থেকে আনা হলো। অনেক কসরত্ করে সেটা আমার দিকে তাক করে চালিয়ে দেয়া হলে গারদের ফাঁক দিয়ে কিছুটা বাতাস সেলের ভেতরে প্রবাহিত হলে কৃতজ্ঞবোধ করলাম। ক্যান্টনমেন্ট থানায় তিনদিনে আমার শরীর থেকে যে পরিমাণ ঘাম ঝরেছে, তাতে কিডনির বারোটা বেজে যাওয়ার কথা। মশাও মনে হলো ক্যান্টনমেন্টের তুলনায় অনেক কম। ওখানে তিনদিনের অবস্থানে মশার কামড় এবং ঘামাচিতে আমার সর্বাঙ্গ ছেয়ে গেছে।
ঘণ্টাদুয়েক পর ডিবি’র কয়েকজন কর্মকর্তা এসে জানালেন, ওই রাতে আমার কোনো জিজ্ঞাসাবাদ হবে না। আমি বিশ্রাম নিতে পারি। কর্মকর্তাদের মধ্যে একজনকে চিনতে পারলাম। গ্রেফতারের রাতে শত শত পুলিশের মধ্যে তিনিও ছিলেন। তাকে বিশেষভাবে মনে রাখার কারণটি হলো, গ্রেফতারের মুহূর্তে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, আমার হাত ধরেন স্যার, আপনার নিরাপত্তা আমি দেব। আমি জবাব দিয়েছিলাম, আপনি মনুষ্যমাত্র, আমি নিরাপত্তার জন্যে আল্লাহ ছাড়া আর কারও ওপর নির্ভর করি না। যাই হোক, তরুণটির নাম জানলাম। তিনি এডিসি নজরুল। রাতের আহারের প্রসঙ্গ উঠলে এক কাপ চা খেতে চাইলাম। বাসা থেকে পাঠানো ঝোলা ব্যাগের ভেতর থেকে এক প্যাকেট বিস্কুট বার করলাম। সেই বিস্কুটের প্যাকেটটি সঙ্গে রাখার অনুমতি চাইলে আবেদন মঞ্জুর হলো। ক্যান্টনমেন্ট থানায় বিশেষ রাতের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার পর থেকে রাতে ঘুমানো ছেড়ে দিয়েছি। এদের হাতে মরতেই যদি হয়, তাহলে অন্তত আততায়ীর চেহারা দেখে তারপর চিরতরে চোখ বন্ধ করতে চাই। ডিবি’র সেলের চতুর্দিকে নানান কিসিমের ক্যামেরা লাগানো রয়েছে। ডিউটি অফিসারদের সঙ্গে বাক্যালাপ বিপজ্জনক। বিপদটা আসামির নয়, সেটি পুলিশ কর্মকর্তার। ওপরআলাদের কোনো রকম সন্দেহ হলেই নিদেনপক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামে বদলি। গুরুতর কিছু ঘটলে চাকরিটাও যাবে। নিম্নস্তরের পুলিশ কর্মকর্তারা আমাদের সিস্টেমে সবচেয়ে অসহায় শ্রেণী। দ্বিতীয় কম্বলটা ভাঁজ করে মাথার নিচে দিয়ে ফজরের প্রতীক্ষা করতে লাগলাম। ঘুম তাড়ানোর জন্যে কম্বলের গন্ধই যথেষ্ট। রাত তিনটায় কম্বলশয্যা ত্যাগ করলাম।
সেলের বাইরে রাতের প্রহরীরা সবাই ঘুমাচ্ছে। কেউ চেয়ারে বসে, আর অন্যরা বেঞ্চে শুয়ে। নোংরা টয়লেটের অন্ধকারে অনেকক্ষণ ধরে গোসল করলাম। গুলশানে বাস করেও সেখানকার এলিট শ্রেণীর বিলাসিতায় অভ্যস্ত না হওয়ার সুফল পাচ্ছি গ্রেফতারের রাত থেকেই। জীবনের প্রায় শেষপ্রান্তে উপনীত হলেও গেণ্ডারিয়ার মধ্যবিত্ত পরিবারের কিশোর আমাকে কখনও ত্যাগ করে যায়নি। গোসল সেরে বেরিয়ে গারদের বাইরের সেই ফ্যানের সামনে জোড়াসনে বসলাম। মাথায় চুল কম থাকাও যে সুবিধাজনক, সেটা প্রমাণ হলো স্বল্প সময়ের মধ্যে চুল শুকিয়ে যাওয়ায়। সঙ্গে গামছা বা তোয়ালে নেই তাই শরীর মোছাও সম্ভব হয়নি। গায়ের পানি গায়েই শুকালো। বাড়ির কথা ভাবছিলাম। আগের দিনেই জেনেছি, মা এখন পর্যন্ত শক্ত থাকতে পারলেও পারভীন অসুস্থ হয়ে পড়েছে। রিমান্ডে আমার জীবন ধারণের অবস্থাটা জানলে দু’জনই অসুস্থ হবেন। চৈত্র মাসের কাঠফাটা গরমেও ঈষত্ গরম পানিতে গোসল করা আমার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। ঠাণ্ডা পানিতে সাইনাসের প্রকোপ বেড়ে যায়। ডিবি অফিসে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করতে তো হচ্ছেই, ভেজা শরীর শুকাচ্ছি ফ্যানের বাতাসে। ফজরের আজান এবং আমার সেলের পাশের বিশাল কড়ই গাছে আশ্রয় নেয়া অসংখ্য পাখির কিচিরমিচির সুবেহ্ সাদেকের আগমনী জানান দিল। নামাজে আল্লাহর কাছে ভিক্ষা জানালাম, আমার বন্দি জীবনে এক মুহূর্তের জন্যেও যেন জালিম সরকারের মুখাপেক্ষী হতে না হয়। জালিমের করুণা প্রত্যাশী হওয়ার পরিবর্তে আমার সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রত্যাবর্তন সর্বসময় আকাঙ্ক্ষিত। ফজরের নামাজ অন্তে এক ঘণ্টা বোধহয় ঘুমাতে পেরেছিলাম। এর মধ্যেই নতুন শিফটের লোকজন এসে তাদের দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছে। চেয়ার টানার শব্দ, তাদের কথোপকথন ঘুম ভাঙিয়ে দিল। রুটি, ডিমভাজি এবং রঙ চা’র বরাদ্দ দিয়ে নাস্তাপর্ব শেষ করে অন্তহীন অপেক্ষা শুরু হলো। দুপুরে কম্বলের ওপর বসে আছি। হঠাত্ দেখলাম সামনের করিডোর দিয়ে ফকরুল আলম কাঞ্চন দ্রুত হেঁটে গেল। যাওয়ার সময় মনে হলো, যেন সে আমাকে লক্ষ্য করেছে। কাঞ্চন আমাদের সংবাদপত্রের ক্রাইম বিভাগের প্রধান। মনের ভার এক নিমেষে হালকা হয়ে গেল। বাইরের পৃথিবী আমার অবস্থানটা এবার জানবে।
রাত এগারোটায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে আইও নুরুল আমিন নিতে এলেন। তার সঙ্গে দোতলায় ডিসি ডিবি (উত্তর) মাহবুবুর রহমানের কক্ষে গেলাম। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন এডিসি নজরুল। প্রাথমিক সৌজন্য প্রদর্শন শেষ হলে জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব শুরু হলো। আমি অভিযোগ জানতে চাইলাম। হিযবুত তাহরিরকে জড়িয়ে আমার বিরুদ্ধে ইসলামী জঙ্গিত্বের হাস্যকর অভিযোগ উত্থাপন করলেন ডিবি’র ইন্সপেক্টর নুরুল আমিন। আমার অপরাধ তিনটি। প্রথমত. হিযবুত তাহরিরের কোনো এক লিফলেটের ভাষার সঙ্গে আমার দেশ-এ প্রকাশিত সংবাদের মিল রয়েছে। দ্বিতীয়ত. আমার দেশ কার্যালয় বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল সংস্থার যে বাণিজ্যিক ভবনের ১১ তলায় অবস্থিত, সেই ভবনেরই কোনো এক তলায় হিযবুত তাহরিরের এক কথিত নেতার অফিস রয়েছে। সেই নেতা নাকি আমার সঙ্গে তাদের সংগঠনের প্রচারের উদ্দেশ্যে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। এবং তৃতীয়ত, আমার দেশ প্রেসে হিযবুত তাহরিরের লিফলেট ছাপা হওয়ার সন্দেহ করছে পুলিশ। জবাবে আমি বললাম, আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অথবা আমার কোনো লেখা নিয়ে হিযবুত তাহরির লিফলেট তৈরি করেছে এমন কোনো সংবাদ আমার জানা নেই। আর যদি আমাদের অজ্ঞাতসারে তেমন কিছু করেও থাকে, তাহলে সেক্ষেত্রে আমার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ উত্থাপনের কোনো সুযোগই নেই। আমার লেখা উদ্ধৃত করে ইচ্ছে করলে সরকারও লিফলেট ছাপাতে পারে। দ্বিতীয়ত, সরকারি ভবনে হিযবুত তাহরিরের লোকজন অফিস খুললে তার দায়িত্ব ভবন মালিকের, আমার নয়। তাছাড়া যে ব্যক্তির কথা বলা হচ্ছে, তেমন কোনো ব্যক্তির সঙ্গে কস্মিনকালেও আমার কোনোরকম যোগাযোগ হয়নি। এমন কোনো ব্যক্তিকে আমি চিনি না। আর সর্বশেষ, সংবাদপত্রের প্রেসের যন্ত্রপাতি দিয়ে লিফলেট ছাপানো যায় না। তার জন্য ভিন্ন প্রেস লাগে। আমি এটাও বললাম, আমার বিরুদ্ধে ইসলামী সন্ত্রাসের মামলা দিয়ে আপনারা সন্ত্রাসের মতো গুরুতর ও রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক বিষয়কে খেলো করে ফেলছেন। দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে এই খেলা থেকে তাদের নিবৃত্ত হতেও পরামর্শ দিলাম। হিযবুত তাহরির নিয়ে আলোচনা এখানেই সমাপ্ত হলো।
এরপর এলো আসল প্রসঙ্গ। এডিসি নজরুল জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কেন আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিবাদী বলি এবং আমার দেশ সরকারের এত তীব্র সমালোচনা কেন করে? এই প্রশ্নের সঙ্গেই আমার গ্রেফতারের প্রকৃত কারণ প্রকাশ হয়ে গেল। আরও ঘণ্টাখানেক এই বিষয় নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা শেষে ডিসি মাহবুবুর রহমান উঠে দাঁড়িয়ে জানান দিলেন, আজ রাতের মতো জিজ্ঞাসাবাদের পালা শেষ। সেলে যখন ফিরলাম, দেখলাম একটা বেজে গেছে। পূর্বরাতের মতোই শেষ রাতে গোসল, নামাজ শেষে ঘুমিয়ে পড়লাম। সারাদিন একইভাবে কেটে গেল। সকালের নাস্তাটা কোনোক্রমে গলাধঃকরণ করলেও, ওরকম পরিবেশে ভাত খাওয়ার রুচি হয় না। অতএব খাদ্য বলতে খানিক পরপর চা এবং একটা করে বিস্কুট। রাত এগারোটায় পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে নুরুল আমিন আবারও সেল থেকে নিয়ে গেলেন। আজ অতিরিক্ত কয়েকটি কথা বললাম।
আমি সংবাদপত্রে লেখালেখি করি কেবল এই কারণেই আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদী দলে পরিণত হয়ে যাচ্ছে না। জনমত এত সহজে প্রভাবিত হয় না। তাছাড়া আমি এমন কিছু শক্তিশালী লেখকও নই। বাস্তবতা হলো, দলটির শীর্ষ পর্যায় থেকে সাধারণ কর্মী পর্যন্ত প্রতিটি ব্যক্তির অসহিষ্ণু এবং চরম অগণতান্ত্রিক আচরণই জনগণকে বাধ্য করছে তাদেরকে এই বিশেষণে অভিহিত করতে। ১৯৭৫ সালে চারটি ছাড়া দেশের সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া, শত শত পুলিশ পাঠিয়ে আমার দেশ বেআইনিভাবে বন্ধ ঘোষণা করে তালা ঝুলিয়ে দেয়া, আমাকে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নির্যাতন, হত্যা প্রচেষ্টা—এসবই ফ্যাসিবাদী আচরণের মধ্যে পড়ে। ক্যান্টনমেন্ট থানার ঘটনার কথা শুনে উপস্থিত তিন ডিবি কর্মকর্তাই নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ আমি একাই কথা বলে গেলাম। এটাও বললাম, আমার দেশকে কেন্দ্র করে সরকারের ন্যক্কারজনক আচরণ তাদের কপালে যে কলঙ্ক তিলক এঁকে দিয়েছে, সেটি আর মোছা যাবে না। দীর্ঘ তিন যুগ পর আজও যেমন করে আমরা ১৯৭৫ সালের ১৫ জুনকে সংবাদপত্রের কালো দিবস হিসেবে ঘৃণা সহকারে পালন করে থাকি, একইভাবে ভবিষ্যত্ প্রজন্ম আমার দেশ বন্ধ করার অপচেষ্টার জন্যে আওয়ামী লীগকে ধিক্কার দিয়ে যাবে। আমি দৃঢ়তার সঙ্গে এটাও বললাম, আমাকে হয়তো দীর্ঘদিন বন্দি করে রাখা যাবে; কিন্তু আমার দেশ বন্ধ করে রাখা সাম্রাজ্যবাদীদের সমর্থনধন্য প্রবল প্রতাপশালী প্রধানমন্ত্রীর পক্ষেও সম্ভব হবে না। আমার বক্তব্যের ওপর কোনো মন্তব্য না করে ডিসি মাহবুবুর রহমান বারবার বলার চেষ্টা করছিলেন, তারেক জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগকে জনমন থেকে ভুলিয়ে দিতেই আমার দেশ পত্রিকা সজীব ওয়াজেদ জয় সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি ছাপিয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনের পক্ষে সব কাগজপত্র আমাদের সাংবাদিকের কাছে রয়েছে এবং সুস্থ সাংবাদিকতার সব নীতিমালা মেনেই যে সংবাদটি ছাপানো হয়েছে, এ বিষয়টি জোরের সঙ্গে উল্লেখ করলাম। তাকে জানালাম, তারেক জিয়ার দুর্নীতির অভিযোগের সঙ্গে ওই সংবাদ প্রকাশের বিষয়টি কোনোক্রমেই সম্পর্কিত নয়। এ রাতেও প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হতে দেড়টা বেজে গেল। ছাড়া পেয়ে সেলে এসে সটান শুয়ে পড়লাম। পরের রাতে জিজ্ঞাসাবাদ আরও সংক্ষিপ্ত হলো। আমার বিরুদ্ধে সরকারের নতুন মামলা দায়েরের খবর পেলাম। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশের প্রেক্ষিতে দুদক মামলা করেছে। এই আইনবহির্ভূত কাজের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি প্রমাণ করলো তারা স্বাধীন তো নয়ই; বরং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক্সটেনশন মাত্র। এই প্রত্যাশিত মামলা দায়েরে কোনোরকম উদ্বেগ বোধ না করে সংবাদটি জানানোর জন্য মাহবুবুর রহমানকে ধন্যবাদ জানিয়ে মধ্যরাতে সেলে ফিরলাম।
১৬ জুন, দুপুর একটা। সেলে চুপচাপ বসে আছি। আইও হন্তদন্ত হয়ে এসে তৈরি হতে বললেন। তখনই আদালতে যেতে হবে। ইসলামী জঙ্গিত্বের মামলার রিমান্ড শেষ হয়েছে। আদালতে উপস্থিত হতেই আইনজীবী, সাংবাদিক আমাকে দেখে আঁেক উঠলেন। সমস্বরে বলে উঠলেন, মাহমুদ ভাই এ কী চেহারা হয়েছে আপনার! রিমান্ডের নয়দিনে আয়না দেখার সুযোগ হয়নি, তাই শুভানুধ্যায়ীদের এতখানি উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠার হেতু ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ভাবলাম, নয়দিনের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হয়তো আমাকে ভয়ঙ্কর লাগছে। গাত্রবর্ণ ঘোর কৃষ্ণবর্ণ হওয়ায় সুদর্শন হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। রিমান্ডের ধাক্কায় আজ চেহারার দিকে সম্ভবত তাকানোই যাচ্ছে না। হাসিমুখেই বললাম, আয়না তো দেখিনি, কেমন করে বলবো কী চেহারা হয়েছে। যে তরুণ ম্যাজিস্ট্রেটটি আমাকে একটানা আটদিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছিলেন, তারই এজলাসে আমাকে তোলা হলো। ম্যাজিস্ট্রেটের দিকে একবারের জন্যেও তাকাতে আমার ইচ্ছে হলো না। সরকার এবং আসামিপক্ষের আইনজীবীদের বিতর্কের পুরোটা সময় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে দরজা দিয়ে সোজা বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। রিমান্ডের যে চারদিন তখনও বাকি রয়েছে, সেটি পুরো করতে পরবর্তী অজানা গন্তব্যে যাওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। ম্যাজিস্ট্রেটের দিকে আমি দৃষ্টিপাত না করলেও তিনি সম্ভবত মাত্র ক’দিনে আমার শারীরিক অবস্থার আশঙ্কাজনক পরিবর্তন লক্ষ্য করে থাকবেন। মামলার সব পক্ষকে অবাক করে আমাকে রিমান্ডে প্রেরণের পরিবর্তে জেলহাজতে পাঠিয়ে যথাযথ চিকিত্সার নির্দেশ দিয়ে বসলেন তরুণ সেই ম্যাজিস্ট্রেট। ভাবলাম সুপ্ত বিবেক হয়তো জেগে উঠেছে। আমার পক্ষের সবাই বেজায় খুশি। আমি কিন্তু কোনো আনন্দ অনুভব করছিলাম না। নয়দিনের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় আমি শারীরিক ও মানসিক উভয় যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করতে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমার কাছে রিমান্ড সমাপ্ত না করে জেলহাজতে ফিরে যাওয়াটা উটকো ঝামেলার মতো বোধ হলো। ভাবছিলাম, সবটা একবারে সাঙ্গ করে জেলে ফিরলেই তো ভালো ছিল।
সন্ধ্যা পার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সাত নম্বর সেলে ফেরার আগেই লক-আপ হয়ে গেছে। আমার প্রতিবেশীরা যার যার সেলে বন্দি। জেলে আসার প্রথম রাতের মতো ড্রামের তোলা পানিতে গোসল করে আমিও ভেতরে ঢুকে গেলাম। ডিভিশন সেল থেকে পাঠানো খাবার দিয়ে রাতের আহার শেষ করেই ঘুমিয়ে পড়লাম। দীর্ঘ নয় রাত পর এই ঘুম। নির্যাতন কিংবা হত্যার আশঙ্কা নেই এমন পরিবেশে ফিরে আসতে পেরে ঘুমটা লম্বাই হলো। সকালে উঠে নাস্তার পাট শেষ না হতেই জেল হাসপাতালের ডাক্তার এসে হাজির। আমার দিকে একনজর তাকিয়েই হাসপাতালে গিয়ে অন্তত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করাতে অনুরোধ করলেন। কথা না বাড়িয়ে ডাক্তারের সঙ্গে গেলাম। প্রথমেই ওজন পরীক্ষা। নয় দিনের রিমান্ডে ওজনের দশ শতাংশ অর্থাত্ সাত কেজি কমে গেছে। অথচ ডায়াবেটিস পাওয়া গেল না। তবে দুই হাতের চামড়া টানলেই সাপের খোলস ছাড়ানোর মতো করে উঠে যাচ্ছে। অবাক কাণ্ড, আমি একটুও দুর্বল বোধ করছি না। সমস্যার মধ্যে কোমরে এবং ঘাড়ে স্পনিডলাইটিসের পুরনো ব্যথাটা বেশ বেড়েছে। তারপরও আমি রিমান্ডে যাওয়ার জন্যে উদগ্রীব। জালিমকে মোকাবিলা করার মানসিক শক্তি আমার শারীরিক অক্ষমতাকে অতিক্রম করে গেছে। ডাক্তারদের বললাম, সুপারের মাধ্যমে ডিবি অফিসে আমার সুস্থতার সংবাদ জানিয়ে দিতে। তারা কিছুতেই সম্মত না হয়ে পিজি থেকে ডাক্তার ডাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। একদিন পর পিজির ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে বেশকিছু বেদনানাশক এবং বলবর্ধক ওষুধ পাঠালে আমি সেগুলো ছেঁড়া কাগজের ঝুড়িতে নিক্ষেপ করলাম। নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো জেলে বসে রিমান্ডের ডাকের অপেক্ষা করতে লাগলাম।
No comments