৩২- বিশেষ উদ্দেশ্যে বর্তমান সরকারের আমলে সব নিরাপত্তা বাহিনীর মনোবল ভেঙে দেয়ার আয়োজন সম্পন্ন
কোটি টাকা জরিমানা অনাদায়ে যাবজ্জীবন
ছয় মাস কারাবাস, কোটি টাকা জরিমানা অনাদায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, এমন রায় হলেই তো সরকারপ্রধানের সন্তোষের মাত্রা বাড়ত। যে দেশে বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচির প্রবাদ রয়েছে, সেই দেশে ভবিষ্যতে এ ধরনের রায় হলেই বরং মানানসই হবে। ...
ছয় মাস কারাবাস, কোটি টাকা জরিমানা অনাদায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, এমন রায় হলেই তো সরকারপ্রধানের সন্তোষের মাত্রা বাড়ত। যে দেশে বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচির প্রবাদ রয়েছে, সেই দেশে ভবিষ্যতে এ ধরনের রায় হলেই বরং মানানসই হবে। ...
এবার তদন্তের আদেশদানের বিষয়টির দিকে দৃষ্টিপাত করি। সংবিধান অনুযায়ী আদালত ইচ্ছে করলে অবমাননার অভিযোগ তদন্তের আদেশদান করতে পারেন। আমার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল ইস্যু হয়েছিল অন্য একটি বানোয়াট জামিনযোগ্য মামলায়, আমার গ্রেফতারের বারো ঘণ্টার মধ্যে। জেলে বন্দি অবস্থায় এবং প্রশাসনের নির্যাতনের শিকার একজন নাগরিককে জেল থেকে টেনে এনে আদালত অবমাননা মামলায় নজিরবিহীন দণ্ড দিয়ে সুপ্রিমকোর্ট নিজে মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি ভয়াবহ নজির স্থাপন করেছেন। আমাকে সাজা দেয়ার ক্ষেত্রে আদালতের ব্যগ্রতাও ছিল লক্ষণীয়। জুনের ২ তারিখে রুল ইস্যু করে আগস্টের উনিশ তারিখে আমাকে সাজা প্রদান করা হয়েছে। যতদূর জানি, হাইকোর্ট এবং সুপ্রিমকোর্টে আদালত অবমাননার অসংখ্য মামলা শুনানির অপেক্ষায় পড়ে আছে। সেসব মামলা নিয়ে উচ্চ আদালতের কোনো মাথাব্যথা না থাকলেও আমার মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির পেছনের উদ্দেশ্য বোঝা কঠিন নয়।
আমার দেশ পত্রিকায় যে সংবাদ প্রকাশ নিয়ে মামলা হয়েছে, আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় সেই সংবাদে বর্ণিত তথ্যের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ছাড়া দণ্ডাদেশ দান বিস্ময়কর। সেই সংবাদে প্রতিবেদক কোনো মন্তব্য না করে কেবল আদালতের কয়েকটি রায় তথ্য-প্রমাণসহ তুলে ধরেছিলেন। সংবাদে শিরোনাম অথবা মন্তব্য হিসেবে যা ছাপা হয়েছে, সেটিও বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট ও প্রবীণ আইনজীবী এবং সাবেক বিচারপতির বক্তব্য। অনুচ্ছেদ ১০৮ অনুযায়ী সুপ্রিমকোর্টের হাতে তদন্তের ক্ষমতা অর্পণ করা সত্ত্বেও কেন মাননীয় বিচারকগণ সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করেননি, সেটি আমার জানার কোনো সুযোগ নেই। আমি কেবল বলতে পারি, তদন্তের নির্দেশ দেয়া হলে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের বহু অনিয়মের ঘটনা উদঘাটিত হতো। এমনকি মিথ্যা তথ্য দিয়ে আদালতকে বিভ্রান্ত করার অভিযোগে স্বয়ং অ্যাটর্নি জেনারেলের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা রুজু হওয়াও অসম্ভব ছিল না। দুর্ভাগ্যবশত মাননীয় বিচারপতিগণ ‘truth is no defence’ তত্ত্বের ভিত্তিতে সত্য উদঘাটনের পরিবর্তে আমাকে দণ্ড দিয়ে উদাহরণ তৈরি করতেই অধিকতর উত্সাহী ছিলেন।
‘দণ্ডাদেশের ক্ষমতা’ এবং ‘আইন সাপেক্ষে’ বিষয় দু’টি একসঙ্গে আলোচনা করাটাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। সুপ্রিমকোর্টের হাতে দণ্ডাদেশের ক্ষমতা থাকাটাই স্বাভাবিক এবং এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির কোনো সুযোগ নেই। সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদে সুপ্রিমকোর্টের সেই ক্ষমতাকে ‘আইন সাপেক্ষে’ বলার মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণেরই একটা চেষ্টা করা হয়েছে বলে আমার মতো আইন না জানা একজন নাগরিকের অভিমত। আইন বিশেষজ্ঞরা আমার ব্যাখ্যার সঙ্গে অবশ্যই দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। আমি যতদূর জানি, বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে আদালত অবমাননার সর্বোচ্চ সাজা ছয় মাস কারাদণ্ড অথবা দুই হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড। আমার এবং নোমানের ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট জরিমানা দুই হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে যথাক্রমে এক লাখ টাকা এবং দশ হাজার টাকা করেছেন। সেই টাকা অনাদায়ে আবার অতিরিক্ত জেলদণ্ডও দেয়া হয়েছে। এই রায়ের মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টের দণ্ডাদেশের ক্ষমতা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হলেও, ‘আইন সাপেক্ষে’র বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে। এখন যদি দাবি করা হয়, সুপ্রিমকোর্ট যা বলবে সেটাই দেশের আইন এবং দেশের সর্বোচ্চ আদালত সংসদকে উপেক্ষা করে আইন প্রণয়ন এবং সংবিধান সংশোধনের যথেচ্ছ ক্ষমতা সংরক্ষণ করেন, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা। এ প্রসঙ্গে আমার সর্বশেষ আলোচনা ‘সকল ক্ষমতা’ নিয়ে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকের জান-মালসহ মৌলিক অধিকার রক্ষায় সুপ্রিমকোর্ট সংবিধান প্রদত্ত তার ‘সকল ক্ষমতা’ প্রয়োগ করলে সেটা দেশে প্রকৃত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় অবশ্যই সহায়ক হবে। কিন্তু আমাকে আদালত অবমাননার পথিকৃত্ (Path finder) আখ্যা দিয়ে কেবল সাজার নজির সৃষ্টি করার জন্য সব ক্ষমতার এই প্রয়োগ নিশ্চিতভাবেই বাক, চিন্তা, বিবেক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পরিপন্থী।
মধ্যযুগের ইউরোপে অসহায় মহিলাদের আগুনে পুড়িয়ে মারা জায়েজ করার জন্য খ্রিস্টান পাদ্রীরা এভাবেই তাদের ডাইনি (witch) আখ্যা দিতেন। আমার পাঠকের উল্লেখযোগ্য অংশই জোয়ান অব আর্কের কাহিনী জানেন বলে ধারণা করছি। ব্রিটিশ দখলদার বাহিনী চার্চের সঙ্গে যোগসাজশে জোয়ান নামের ফ্রান্সের এক বীর, কৃষক-কন্যাকে ডাইনি আখ্যা দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছিল। জোয়ানের অপরাধ ছিল, সে যুদ্ধক্ষেত্রে অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করে ব্রিটিশ বাহিনীকে পরাজিত করেছিল। সকল ক্ষমতার প্রয়োগ প্রসঙ্গে আরও একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। দুই হাজার টাকা জরিমানার স্থলে এক লাখ টাকা করার যুক্তিটা কী? জরিমানার অঙ্ক দশ লাখ কিংবা কোটি টাকা হতে বাধা কোথায় ছিল? অনাদায়ে মাত্র এক মাসের জেলই-বা কেন? এটি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলো না কেন? ছয় মাস কারাবাস, কোটি টাকা জরিমানা অনাদায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, এমন রায় হলেই তো সরকারপ্রধানের সন্তোষের মাত্রা বাড়ত। যে দেশে বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচির প্রবাদ রয়েছে, সেই দেশে ভবিষ্যতে এ ধরনের রায় হলেই বরং মানানসই হবে।
ইংরেজিতে একটা বহুল প্রচলিত কথা রয়েছে ‘Power corrupts, absolute power corrupts absolutely.’ (ক্ষমতা দুর্নীতি সৃষ্টি করে, অসীম ক্ষমতা চরম দুর্নীতির জন্ম দেয়।) সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদের ‘সকল ক্ষমতা’র বিধান সুপ্রিমকোর্টে এক প্রকার স্বৈরাচারী মানসিকতার জন্ম দিচ্ছে কি-না, এমন সংশয় মন থেকে দূর করতে পারছি না। পঞ্চম এবং সপ্তম সংশোধনী সংক্রান্ত রায়ের আলোকে দেশে এখন সংবিধান সংশোধনের মরসুম চলছে। এমতাবস্থায় অনুচ্ছেদ ১০৮ নিয়েও আইন বিশেষজ্ঞদের বোধহয় চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন। ১০৪ নম্বর অনুচ্ছেদের উল্লেখ ছাড়া জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষায় সুপ্রিমকোর্টের দায়িত্ব সম্পর্কে আলোচনা পূর্ণাঙ্গ হবে না। সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের (complete justice) তাগিদ দিয়ে সেই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তির হাজিরা কিংবা কোন দলিলপত্র উদ্ঘাটন বা দাখিল করিবার আদেশসহ আপীল বিভাগের নিকট বিচারাধীন যে কোন মামলা বা বিষয়ে সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের জন্য যেরূপ প্রয়োজনীয় হইতে পারে, উক্ত বিভাগ সেই রূপ নির্দেশ, আদেশ, ডিক্রী বা রীট জারি করিতে পারিবেন।’ সংবিধানের ১০৮ এবং ১০৪ অনুচ্ছেদ একসঙ্গে বিবেচনা করলে এই ধারণা পোষণ করা অমূলক হবে না যে, সংবিধান প্রণেতাগণ ‘ন্যায়বিচার’ নিশ্চিত করার মহান লক্ষ্যেই সুপ্রিমকোর্টকে ‘সকল ক্ষমতা’ প্রদান করেছিলেন। সংবিধান প্রণয়নের চার দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পর ন্যায়বিচার বাদ দিয়ে মাননীয় বিচারপতিদের মধ্যে শুধু ‘সকল ক্ষমতা’ প্রয়োগ করার দুর্ভাগ্যজনক মানসিকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে দেশের সর্বোচ্চ আদালতও স্বৈরাচার ও প্রতিহিংসাপরায়ণতার অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারেন। কোনো দেশপ্রেমিক, গণতন্ত্রমনস্ক নাগরিক রাষ্ট্রের এমন অধঃপতন কামনা করতে পারেন না।
আজ খবর পেলাম বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার ভাগ্নে ডিউক গত রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এসেছে। সাইফুল ইসলাম ডিউক কেবল বুয়েট থেকে পাস করা একজন প্রকৌশলীই নন, তিনি চারদলীয় জোট সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর দুই নম্বর ব্যক্তিগত সচিবও (পিএস-২) ছিলেন। তাকে কাল সারারাত আমদানিতে নির্ঘুম রাত্রিযাপনে বাধ্য করে আজ সকালে দশ নম্বর সেলে পাঠানো হয়েছে। সাইফুল ইসলামের আরও একটি পরিচয় রয়েছে। তিনি বাংলাদেশ নৌবাহিনীরও একজন সাবেক কর্মকর্তা। বর্তমান সরকার যে কোনোরকম নিয়ম-নীতি অথবা সৌজন্যের ধার ধারে না, সেটি ডিউককে এক রাত আমদানিতে রাখার মধ্য দিয়ে আবার প্রমাণিত হলো। আমদানি ওয়ার্ড এক ভয়াবহ স্থান। সেখানে রাতে শোয়া তো দূরের কথা, দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়াই কঠিন। প্রতি রাতে দুই-তিনশ’ নতুন সাধারণ বন্দিকে গাদাগাদি করে আমদানিতে রেখে পরবর্তী দিনে বিভিন্ন ওয়ার্ড কিংবা সেলে পাঠানো হয়।
এই বন্দি পাঠানো নিয়েও জেল প্রশাসনে বাণিজ্য ভালোই হয়। জেল কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করলে আমদানিতে না রেখে ডিউকের সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করে রাতেই ১০ নম্বর সেলে পাঠাতে পারত। হয়রানি এবং অবমাননা করার হীন উদ্দেশ্যেই নৌবাহিনীর সাবেক এই কর্মকর্তার সঙ্গে অভব্য আচরণ করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে সাবেক সামরিক অফিসারদের যে হেনস্তা করা হচ্ছে, তা এক কথায় নজিরবিহীন। জনশ্রুতি রয়েছে, ২০০৮-এর নির্বাচনে বর্তমান মহাজোট সরকারকে ক্ষমতায় আনার জন্য সেনাবাহিনী যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। পরিণাম হয়েছে বিডিআর বর্বর হত্যাকাণ্ডে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তার করুণ মৃত্যু, তাদের পরিবারের লাঞ্ছনা, জেনারেলসহ কমিশন্ড অফিসারদের ধরে ধরে জেলে ঢুকিয়ে অবমাননাকর অবস্থায় আটক রাখা, তাদের রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন, প্রায় শ’খানেক বিডিআর জওয়ানকে নির্যাতন করে হত্যা এবং বিডিআরের পোশাক ও নাম পরিবর্তন। এক কথায় বর্তমান সরকারের প্রায় দুই বছরের মধ্যেই বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে এদেশের সব ধরনের নিরাপত্তা বাহিনীর মনোবল ভেঙে দেয়ার আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে।
যাই হোক, ডিউককে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় সহায়তাদানের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমার ধারণা, এই গ্রেফতারের পেছনে সরকারের উচ্চ মহলের ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। ওই মামলায় কোনোক্রমে বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানকে জড়ানোর পদক্ষেপ হিসেবেই ডিউককে প্রথমে জিজ্ঞাসাবাদ, তারপর রিমান্ড এবং সর্বশেষে জেলে ঢোকানো হলো। সাত নম্বর সেলে বসেই বন্দিদের কাছ থেকে শুনলাম, ডিউককে এমন প্রস্তাবও নাকি দেয়া হয়েছে, বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে রাজি হলেই তাকে সব অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে। প্রশাসনের লোকজন মিডিয়ায় এর মধ্যেই জোরেশোরে প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে, সাইফুল ইসলাম নাকি ঘটনার সঙ্গে তার ও হাওয়া ভবনের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছে। তবে এই দাবিকে সর্বৈব মিথ্যা বলে নাকচ করেছেন ডিউকের আইনজীবীরা। প্রশাসনের লোকজন যে ক্রমেই সরকারদলীয় কর্মীদের মতো আচরণ করছে, তার প্রমাণ প্রতিদিনই পাওয়া যাচ্ছে। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। এবারের মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে যে কোনো ভিন্নমত অবশিষ্ট রাখতে চান না, সেটাও এরই মধ্যে পরিষ্কার হয়েছে। তার প্রতিহিংসার আগুনে প্রয়োজনমাফিক বাতাস দিয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা আমাদের দেশটিকে ক্রমেই পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করছে।
বেগম খালেদা জিয়ার পিএস-২ সাইফুল ইসলাম ডিউকের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাত্ হয়েছিল ২০০২ সালের প্রথম দিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। অবশ্য তার ছোটভাই শাহরিন ইসলাম তুহিনকে আগে থেকেই চিনতাম। তরুণটি পেশায় প্রকৌশলী এবং জাতীয়তাবাদী প্রকৌশলীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের (AEB) কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল। সেই সুবাদেই পরিচয়। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত বিএনপি যখন বিরোধী দলে, সেই সময় তুহিন আমার বেক্সিমকোর কর্মস্থলে নিয়মিত আসত। বয়সের পার্থক্য সত্ত্বেও ব্যবহারে অত্যন্ত ভদ্র তুহিনের সঙ্গে আমার ভালোই হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল। ২০০২ সালে আমি এবং তুহিন যথাক্রমে অ্যাবের সভাপতি এবং মহাসচিব নির্বাচিত হয়েছিলাম। এছাড়া তুহিন আমার এক পূর্বপরিচিত ডাক্তারের ভাগ্নীকে বিয়ে করার সূত্রে আমাকেও মামা বলে সম্বোধন করত। তুহিনের সঙ্গে সম্পর্ক খানিকটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে গেলেও ডিউকের ক্ষেত্রে সেটা কোনোদিনই সরকারি গণ্ডি পার হয়নি। চারদলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছরে পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৈনন্দিন কাজ-কর্মে ডিউককে যথেষ্ট প্রভাবশালী বিবেচনা করা হতো। বেশ কয়েকজন সিনিয়রকে ডিঙিয়ে জেনারেল মইনকে সেনাপ্রধান বানানোতে আরও অনেকের সঙ্গে ডিউকেরও ভূমিকা থাকার জনশ্রুতি রয়েছে। অবশ্য জেনারেল মইনের কোর্সমেট মেজর (অব.) সাঈদ এস্কান্দর ডিউকের আপন মামা হওয়ার কারণেও এই গুজব ডানা মেলতে পারে। এদিকে সাঈদ এস্কান্দরের আপন ভায়রা লে. জে. মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী এক-এগারোর সময় সামরিক জান্তার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেছেন। মইন-মাসুদ জুটির সরাসরি নির্দেশ ছাড়া তারেক রহমানকে সেনা হেফাজতে নির্যাতন করার বিষয়টিও মেনে নেয়া কঠিন। সেই লে. জে. মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী এখনও বহাল তবিয়তে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। এক-এগারোর প্রধান কুশীলবদের মধ্যে বিস্ময়করভাবে একমাত্র লে. জে. মাসুদই মহাজোট আমলে তার অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছেন। একদিকে আত্মীয়তার জটিলতা এবং অন্যদিকে আওয়ামী লীগকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কূটকৌশল মইন-ফখরুদ্দীন সরকারকে এমন রহস্যময়তায় আবৃত করেছে যে, সেই সময়ের প্রকৃত ঘটনা জানতে হলে উইকিলিকসের মতো কোনো নাটকীয় তথ্য ফাঁসের প্রয়োজন। সেরকম কিছু না ঘটা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া দেশবাসীর গত্যন্তর নেই।
আমার দেশ পত্রিকায় যে সংবাদ প্রকাশ নিয়ে মামলা হয়েছে, আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় সেই সংবাদে বর্ণিত তথ্যের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ছাড়া দণ্ডাদেশ দান বিস্ময়কর। সেই সংবাদে প্রতিবেদক কোনো মন্তব্য না করে কেবল আদালতের কয়েকটি রায় তথ্য-প্রমাণসহ তুলে ধরেছিলেন। সংবাদে শিরোনাম অথবা মন্তব্য হিসেবে যা ছাপা হয়েছে, সেটিও বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট ও প্রবীণ আইনজীবী এবং সাবেক বিচারপতির বক্তব্য। অনুচ্ছেদ ১০৮ অনুযায়ী সুপ্রিমকোর্টের হাতে তদন্তের ক্ষমতা অর্পণ করা সত্ত্বেও কেন মাননীয় বিচারকগণ সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করেননি, সেটি আমার জানার কোনো সুযোগ নেই। আমি কেবল বলতে পারি, তদন্তের নির্দেশ দেয়া হলে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের বহু অনিয়মের ঘটনা উদঘাটিত হতো। এমনকি মিথ্যা তথ্য দিয়ে আদালতকে বিভ্রান্ত করার অভিযোগে স্বয়ং অ্যাটর্নি জেনারেলের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা রুজু হওয়াও অসম্ভব ছিল না। দুর্ভাগ্যবশত মাননীয় বিচারপতিগণ ‘truth is no defence’ তত্ত্বের ভিত্তিতে সত্য উদঘাটনের পরিবর্তে আমাকে দণ্ড দিয়ে উদাহরণ তৈরি করতেই অধিকতর উত্সাহী ছিলেন।
‘দণ্ডাদেশের ক্ষমতা’ এবং ‘আইন সাপেক্ষে’ বিষয় দু’টি একসঙ্গে আলোচনা করাটাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। সুপ্রিমকোর্টের হাতে দণ্ডাদেশের ক্ষমতা থাকাটাই স্বাভাবিক এবং এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির কোনো সুযোগ নেই। সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদে সুপ্রিমকোর্টের সেই ক্ষমতাকে ‘আইন সাপেক্ষে’ বলার মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণেরই একটা চেষ্টা করা হয়েছে বলে আমার মতো আইন না জানা একজন নাগরিকের অভিমত। আইন বিশেষজ্ঞরা আমার ব্যাখ্যার সঙ্গে অবশ্যই দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। আমি যতদূর জানি, বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে আদালত অবমাননার সর্বোচ্চ সাজা ছয় মাস কারাদণ্ড অথবা দুই হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড। আমার এবং নোমানের ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট জরিমানা দুই হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে যথাক্রমে এক লাখ টাকা এবং দশ হাজার টাকা করেছেন। সেই টাকা অনাদায়ে আবার অতিরিক্ত জেলদণ্ডও দেয়া হয়েছে। এই রায়ের মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টের দণ্ডাদেশের ক্ষমতা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হলেও, ‘আইন সাপেক্ষে’র বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে। এখন যদি দাবি করা হয়, সুপ্রিমকোর্ট যা বলবে সেটাই দেশের আইন এবং দেশের সর্বোচ্চ আদালত সংসদকে উপেক্ষা করে আইন প্রণয়ন এবং সংবিধান সংশোধনের যথেচ্ছ ক্ষমতা সংরক্ষণ করেন, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা। এ প্রসঙ্গে আমার সর্বশেষ আলোচনা ‘সকল ক্ষমতা’ নিয়ে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকের জান-মালসহ মৌলিক অধিকার রক্ষায় সুপ্রিমকোর্ট সংবিধান প্রদত্ত তার ‘সকল ক্ষমতা’ প্রয়োগ করলে সেটা দেশে প্রকৃত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় অবশ্যই সহায়ক হবে। কিন্তু আমাকে আদালত অবমাননার পথিকৃত্ (Path finder) আখ্যা দিয়ে কেবল সাজার নজির সৃষ্টি করার জন্য সব ক্ষমতার এই প্রয়োগ নিশ্চিতভাবেই বাক, চিন্তা, বিবেক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পরিপন্থী।
মধ্যযুগের ইউরোপে অসহায় মহিলাদের আগুনে পুড়িয়ে মারা জায়েজ করার জন্য খ্রিস্টান পাদ্রীরা এভাবেই তাদের ডাইনি (witch) আখ্যা দিতেন। আমার পাঠকের উল্লেখযোগ্য অংশই জোয়ান অব আর্কের কাহিনী জানেন বলে ধারণা করছি। ব্রিটিশ দখলদার বাহিনী চার্চের সঙ্গে যোগসাজশে জোয়ান নামের ফ্রান্সের এক বীর, কৃষক-কন্যাকে ডাইনি আখ্যা দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছিল। জোয়ানের অপরাধ ছিল, সে যুদ্ধক্ষেত্রে অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করে ব্রিটিশ বাহিনীকে পরাজিত করেছিল। সকল ক্ষমতার প্রয়োগ প্রসঙ্গে আরও একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। দুই হাজার টাকা জরিমানার স্থলে এক লাখ টাকা করার যুক্তিটা কী? জরিমানার অঙ্ক দশ লাখ কিংবা কোটি টাকা হতে বাধা কোথায় ছিল? অনাদায়ে মাত্র এক মাসের জেলই-বা কেন? এটি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলো না কেন? ছয় মাস কারাবাস, কোটি টাকা জরিমানা অনাদায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, এমন রায় হলেই তো সরকারপ্রধানের সন্তোষের মাত্রা বাড়ত। যে দেশে বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচির প্রবাদ রয়েছে, সেই দেশে ভবিষ্যতে এ ধরনের রায় হলেই বরং মানানসই হবে।
ইংরেজিতে একটা বহুল প্রচলিত কথা রয়েছে ‘Power corrupts, absolute power corrupts absolutely.’ (ক্ষমতা দুর্নীতি সৃষ্টি করে, অসীম ক্ষমতা চরম দুর্নীতির জন্ম দেয়।) সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদের ‘সকল ক্ষমতা’র বিধান সুপ্রিমকোর্টে এক প্রকার স্বৈরাচারী মানসিকতার জন্ম দিচ্ছে কি-না, এমন সংশয় মন থেকে দূর করতে পারছি না। পঞ্চম এবং সপ্তম সংশোধনী সংক্রান্ত রায়ের আলোকে দেশে এখন সংবিধান সংশোধনের মরসুম চলছে। এমতাবস্থায় অনুচ্ছেদ ১০৮ নিয়েও আইন বিশেষজ্ঞদের বোধহয় চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন। ১০৪ নম্বর অনুচ্ছেদের উল্লেখ ছাড়া জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষায় সুপ্রিমকোর্টের দায়িত্ব সম্পর্কে আলোচনা পূর্ণাঙ্গ হবে না। সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের (complete justice) তাগিদ দিয়ে সেই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তির হাজিরা কিংবা কোন দলিলপত্র উদ্ঘাটন বা দাখিল করিবার আদেশসহ আপীল বিভাগের নিকট বিচারাধীন যে কোন মামলা বা বিষয়ে সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের জন্য যেরূপ প্রয়োজনীয় হইতে পারে, উক্ত বিভাগ সেই রূপ নির্দেশ, আদেশ, ডিক্রী বা রীট জারি করিতে পারিবেন।’ সংবিধানের ১০৮ এবং ১০৪ অনুচ্ছেদ একসঙ্গে বিবেচনা করলে এই ধারণা পোষণ করা অমূলক হবে না যে, সংবিধান প্রণেতাগণ ‘ন্যায়বিচার’ নিশ্চিত করার মহান লক্ষ্যেই সুপ্রিমকোর্টকে ‘সকল ক্ষমতা’ প্রদান করেছিলেন। সংবিধান প্রণয়নের চার দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পর ন্যায়বিচার বাদ দিয়ে মাননীয় বিচারপতিদের মধ্যে শুধু ‘সকল ক্ষমতা’ প্রয়োগ করার দুর্ভাগ্যজনক মানসিকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে দেশের সর্বোচ্চ আদালতও স্বৈরাচার ও প্রতিহিংসাপরায়ণতার অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারেন। কোনো দেশপ্রেমিক, গণতন্ত্রমনস্ক নাগরিক রাষ্ট্রের এমন অধঃপতন কামনা করতে পারেন না।
আজ খবর পেলাম বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার ভাগ্নে ডিউক গত রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এসেছে। সাইফুল ইসলাম ডিউক কেবল বুয়েট থেকে পাস করা একজন প্রকৌশলীই নন, তিনি চারদলীয় জোট সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর দুই নম্বর ব্যক্তিগত সচিবও (পিএস-২) ছিলেন। তাকে কাল সারারাত আমদানিতে নির্ঘুম রাত্রিযাপনে বাধ্য করে আজ সকালে দশ নম্বর সেলে পাঠানো হয়েছে। সাইফুল ইসলামের আরও একটি পরিচয় রয়েছে। তিনি বাংলাদেশ নৌবাহিনীরও একজন সাবেক কর্মকর্তা। বর্তমান সরকার যে কোনোরকম নিয়ম-নীতি অথবা সৌজন্যের ধার ধারে না, সেটি ডিউককে এক রাত আমদানিতে রাখার মধ্য দিয়ে আবার প্রমাণিত হলো। আমদানি ওয়ার্ড এক ভয়াবহ স্থান। সেখানে রাতে শোয়া তো দূরের কথা, দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়াই কঠিন। প্রতি রাতে দুই-তিনশ’ নতুন সাধারণ বন্দিকে গাদাগাদি করে আমদানিতে রেখে পরবর্তী দিনে বিভিন্ন ওয়ার্ড কিংবা সেলে পাঠানো হয়।
এই বন্দি পাঠানো নিয়েও জেল প্রশাসনে বাণিজ্য ভালোই হয়। জেল কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করলে আমদানিতে না রেখে ডিউকের সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করে রাতেই ১০ নম্বর সেলে পাঠাতে পারত। হয়রানি এবং অবমাননা করার হীন উদ্দেশ্যেই নৌবাহিনীর সাবেক এই কর্মকর্তার সঙ্গে অভব্য আচরণ করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে সাবেক সামরিক অফিসারদের যে হেনস্তা করা হচ্ছে, তা এক কথায় নজিরবিহীন। জনশ্রুতি রয়েছে, ২০০৮-এর নির্বাচনে বর্তমান মহাজোট সরকারকে ক্ষমতায় আনার জন্য সেনাবাহিনী যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। পরিণাম হয়েছে বিডিআর বর্বর হত্যাকাণ্ডে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তার করুণ মৃত্যু, তাদের পরিবারের লাঞ্ছনা, জেনারেলসহ কমিশন্ড অফিসারদের ধরে ধরে জেলে ঢুকিয়ে অবমাননাকর অবস্থায় আটক রাখা, তাদের রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন, প্রায় শ’খানেক বিডিআর জওয়ানকে নির্যাতন করে হত্যা এবং বিডিআরের পোশাক ও নাম পরিবর্তন। এক কথায় বর্তমান সরকারের প্রায় দুই বছরের মধ্যেই বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে এদেশের সব ধরনের নিরাপত্তা বাহিনীর মনোবল ভেঙে দেয়ার আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে।
যাই হোক, ডিউককে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় সহায়তাদানের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমার ধারণা, এই গ্রেফতারের পেছনে সরকারের উচ্চ মহলের ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। ওই মামলায় কোনোক্রমে বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানকে জড়ানোর পদক্ষেপ হিসেবেই ডিউককে প্রথমে জিজ্ঞাসাবাদ, তারপর রিমান্ড এবং সর্বশেষে জেলে ঢোকানো হলো। সাত নম্বর সেলে বসেই বন্দিদের কাছ থেকে শুনলাম, ডিউককে এমন প্রস্তাবও নাকি দেয়া হয়েছে, বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে রাজি হলেই তাকে সব অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে। প্রশাসনের লোকজন মিডিয়ায় এর মধ্যেই জোরেশোরে প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে, সাইফুল ইসলাম নাকি ঘটনার সঙ্গে তার ও হাওয়া ভবনের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছে। তবে এই দাবিকে সর্বৈব মিথ্যা বলে নাকচ করেছেন ডিউকের আইনজীবীরা। প্রশাসনের লোকজন যে ক্রমেই সরকারদলীয় কর্মীদের মতো আচরণ করছে, তার প্রমাণ প্রতিদিনই পাওয়া যাচ্ছে। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। এবারের মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে যে কোনো ভিন্নমত অবশিষ্ট রাখতে চান না, সেটাও এরই মধ্যে পরিষ্কার হয়েছে। তার প্রতিহিংসার আগুনে প্রয়োজনমাফিক বাতাস দিয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা আমাদের দেশটিকে ক্রমেই পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করছে।
বেগম খালেদা জিয়ার পিএস-২ সাইফুল ইসলাম ডিউকের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাত্ হয়েছিল ২০০২ সালের প্রথম দিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। অবশ্য তার ছোটভাই শাহরিন ইসলাম তুহিনকে আগে থেকেই চিনতাম। তরুণটি পেশায় প্রকৌশলী এবং জাতীয়তাবাদী প্রকৌশলীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের (AEB) কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল। সেই সুবাদেই পরিচয়। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত বিএনপি যখন বিরোধী দলে, সেই সময় তুহিন আমার বেক্সিমকোর কর্মস্থলে নিয়মিত আসত। বয়সের পার্থক্য সত্ত্বেও ব্যবহারে অত্যন্ত ভদ্র তুহিনের সঙ্গে আমার ভালোই হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল। ২০০২ সালে আমি এবং তুহিন যথাক্রমে অ্যাবের সভাপতি এবং মহাসচিব নির্বাচিত হয়েছিলাম। এছাড়া তুহিন আমার এক পূর্বপরিচিত ডাক্তারের ভাগ্নীকে বিয়ে করার সূত্রে আমাকেও মামা বলে সম্বোধন করত। তুহিনের সঙ্গে সম্পর্ক খানিকটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে গেলেও ডিউকের ক্ষেত্রে সেটা কোনোদিনই সরকারি গণ্ডি পার হয়নি। চারদলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছরে পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৈনন্দিন কাজ-কর্মে ডিউককে যথেষ্ট প্রভাবশালী বিবেচনা করা হতো। বেশ কয়েকজন সিনিয়রকে ডিঙিয়ে জেনারেল মইনকে সেনাপ্রধান বানানোতে আরও অনেকের সঙ্গে ডিউকেরও ভূমিকা থাকার জনশ্রুতি রয়েছে। অবশ্য জেনারেল মইনের কোর্সমেট মেজর (অব.) সাঈদ এস্কান্দর ডিউকের আপন মামা হওয়ার কারণেও এই গুজব ডানা মেলতে পারে। এদিকে সাঈদ এস্কান্দরের আপন ভায়রা লে. জে. মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী এক-এগারোর সময় সামরিক জান্তার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেছেন। মইন-মাসুদ জুটির সরাসরি নির্দেশ ছাড়া তারেক রহমানকে সেনা হেফাজতে নির্যাতন করার বিষয়টিও মেনে নেয়া কঠিন। সেই লে. জে. মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী এখনও বহাল তবিয়তে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। এক-এগারোর প্রধান কুশীলবদের মধ্যে বিস্ময়করভাবে একমাত্র লে. জে. মাসুদই মহাজোট আমলে তার অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছেন। একদিকে আত্মীয়তার জটিলতা এবং অন্যদিকে আওয়ামী লীগকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কূটকৌশল মইন-ফখরুদ্দীন সরকারকে এমন রহস্যময়তায় আবৃত করেছে যে, সেই সময়ের প্রকৃত ঘটনা জানতে হলে উইকিলিকসের মতো কোনো নাটকীয় তথ্য ফাঁসের প্রয়োজন। সেরকম কিছু না ঘটা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া দেশবাসীর গত্যন্তর নেই।
No comments