১১- টিএফআই সেলে নেয়ার বৈধতার প্রশ্ন কোর্টে তুললে সরকারপক্ষ বলে আমাকে নাকি সেখানে নেয়াই হয়নি
সাত নম্বর সেলের আপন কুঠুরিতে
ডিবির গাড়ি থেকে নামিয়ে আবারও টিএফআই সেলে নিয়ে আমাকে চোখ বাঁধা হলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেন্ট্রি বা কর্মকর্তা কেউ এলেন। আঙুলের ছাপ না দিলে এবং কয়েকটি কাগজে সই না করলে আমাকে ছাড়া হবে না। চোখ বাঁধা, তাই কাগজ সাদা নাকি তাতে কিছু লেখা রয়েছে জানি না। বিনা বাক্যব্যয়ে দশ আঙুলের ছাপ দিলাম। রিমান্ড শেষে কোর্টে তোলা হলে টিএফআই সেলে নেয়ার আইনগত বৈধতার প্রশ্ন তুললাম। সরকার পক্ষের জবাব শুনে বিস্ময়ে হতবাক। আমাকে নাকি টিএফআইতে নেয়াই হয়নি...
ডিবির গাড়ি থেকে নামিয়ে আবারও টিএফআই সেলে নিয়ে আমাকে চোখ বাঁধা হলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেন্ট্রি বা কর্মকর্তা কেউ এলেন। আঙুলের ছাপ না দিলে এবং কয়েকটি কাগজে সই না করলে আমাকে ছাড়া হবে না। চোখ বাঁধা, তাই কাগজ সাদা নাকি তাতে কিছু লেখা রয়েছে জানি না। বিনা বাক্যব্যয়ে দশ আঙুলের ছাপ দিলাম। রিমান্ড শেষে কোর্টে তোলা হলে টিএফআই সেলে নেয়ার আইনগত বৈধতার প্রশ্ন তুললাম। সরকার পক্ষের জবাব শুনে বিস্ময়ে হতবাক। আমাকে নাকি টিএফআইতে নেয়াই হয়নি...
মোরশেদুল ইসলাম জানালেন, নির্দেশ এসেছে, টিএফআই সেলে ফিরতে হবে। পানির বোতলটা মুখ থেকে সরিয়ে ডিবির গাড়ি থেকে নামলাম। টিএফআই কম্পাউন্ডে ঢুকতেই আবার চোখ বাঁধা হলো। তবে কী কারণে জানি না, হাত দুটো মুক্তই রইল। ধরে নিয়ে যাওয়া হলো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সেই জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেন্ট্রি বা কর্মকর্তা কেউ এলেন। আঙুলের ছাপ না দিলে এবং কয়েকটি কাগজে সই না করলে আমাকে ছাড়া হবে না। একটু হেসেই বললাম, আপনাদের এসব কাগজের তো আইনত কোনো মূল্য নেই। অপরপক্ষ নিরুত্তর। বুঝলাম কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। কাগজপত্র আনা হলো। চোখ বাঁধা, তাই কাগজ কি সাদা না তাতে কিছু লেখা রয়েছে, সেটা বলতে পারব না। বিনা বাক্যব্যয়ে দশ আঙুলের ছাপ দিলাম, সম্ভবত কাগজের পাশের দিকে সংক্ষেপে নামের আদ্যাক্ষর লিখেও দিলাম। আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতে সর্বোচ্চ দশ মিনিট লাগল। একজন র্যাব সৈনিক এবং আইও চোখ বাঁধা অবস্থাতেই আমার দু’ হাত ধরে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে এলেন। আসার সময় মন্তব্য করলাম, খানিক আগে তো চোখ খোলা অবস্থাতেই গাড়িতে উঠেছিলাম। এখন চোখ বেঁধে কী লাভ? টিএফআই সেলের যা দেখার, তা তো দেখেই ফেলেছি। বলা বাহুল্য, কেউ কোনো উত্তর দিলেন না।
এবার বিনা বাধায় র্যাব-১ এর সদর দফতর পার হতে পারলাম। গাড়ি এয়ারপোর্ট রোডে পৌঁছানোর পর মোরশেদ দুঃখ প্রকাশ করে জানালেন, টিএফআইতে বিলম্বের কারণে আজ আর সিএমএম আদালতে যাওয়া যাচ্ছে না। আরও একটি রাত আমাকে ডিবিতে রাত্রিযাপন করতে হবে। মিন্টো রোডে পৌঁছাতে ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। পথিমধ্যে ডিবির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হলো, আমি সুস্থ শরীরে ছাড়া পেয়েছি। টিএফআই থেকে মুক্তি পেয়ে স্বস্তি বোধ করলেও এখানে এনে অপমান করার কষ্ট মন থেকে দূর করতে পারছিলাম না। ওই স্থানে লোমহর্ষক নির্যাতনের যে সব কাহিনী শুনেছি, সৌভাগ্যবশত আমার ক্ষেত্রে চোখ বেঁধে রাখা এবং হাতকড়া পরিয়ে শিকের সঙ্গে আটকে রাখা ছাড়া আর কিছু না ঘটলেও ভেবে পাচ্ছিলাম না কোন অপরাধে আমাকে টাস্কফোর্স ইন্টেরোগেশনের মুখোমুখি করা হলো। আমি চোর-ডাকাত নই, সন্ত্রাসী নই, কোনোদিন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না, সব সময় জাতির স্বার্থে কাজ করেছি। কেবল সরকারের রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডের সমালোচনামূলক লেখালেখির জন্যই কি আজ টিএফআই সেল দর্শন? আওয়ামী সমর্থক কলামিস্ট, বুদ্ধিজীবীরাই তো বাংলাদেশের প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া দীর্ঘদিন ধরে দখল করে আছেন। কলমের জবাব তারা তো কলম দিয়েই দিতে পারতেন। বন্দুক দেখানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমরা গুটিকয়েক ব্যক্তি মাত্র এতদিন মহাজোট সরকারকে ফ্যাসিস্ট নামে সম্বোধন করে এসেছি। এখন সারা বিশ্ব তাদের ওই নামে অভিহিত করবে। প্রধানমন্ত্রী আমাকে নির্যাতন করেছেন, আমার পরিবারকে হয়রানি করছেন। সে ক্ষমতা তার রয়েছে। এই নির্যাতনের মাধ্যমে প্রতিহিংসা পূরণ করে তিনি এক প্রকার মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে পারেন। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে তিনি লাভবান হয়েছেন কি? যে বিশেষ সংস্থাগুলো আমার গ্রেফতার ও নির্যাতন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, তাদের ক্রেডিবিলিটি এই ন্যক্কারজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে বাড়ল না কমল!
ডিবি অফিসে যখন ফিরলাম, ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বলতে গেলে আটচল্লিশ ঘণ্টায় কয়েক কাপ চা এবং বিস্কুট ছাড়া আর কিছু পেটে পড়েনি। ডিবির কর্মকর্তারা কিছু খেতে অনুরোধ করলেও আমার তখন প্রয়োজন গোসল করে টিএফআই সেলের ক্লেদ যথাসম্ভব ধুয়ে ফেলা। অনেকক্ষণ ধরে গোসল করে পূর্ববত্ খালি গায়ে ফ্যানের বাতাসে গায়ের পানি শুকালাম। সেই রাতে ভাত খেলাম। মেলামাইনের রংচটা প্লেটে ভাত এবং ডিমভাজি আর বাটিতে ডাল এলো। মাটিতে কাগজ বিছিয়ে রাতের আহারপর্ব শেষ করলাম। ডিউটি অফিসার দেখলাম উসখুস করছেন। জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকাতেই জানতে চাইলেন, আমি সুস্থ আছি কিনা। প্রশ্নের নিগূঢ় অর্থ হচ্ছে টিএফআই সেলে নিয়ে আমাকে পেটানো হয়েছে কিনা। তাকে ভরসা দিয়ে বললাম, তেমন কিছু ঘটেনি, আমি ভালোই আছি। রাতে ডিসি-ডিবির কক্ষে ডাক পড়ল। জিজ্ঞাসাবাদ আর হলো না। আমাকে শুধু জানানো হলো, পরদিন আমার রিমান্ড শেষ হচ্ছে এবং দুই দফায় ১৪ দিনের রিমান্ড শেষে আমি কাল সিএমএম আদালত থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফিরে যাচ্ছি। ডিসিকে ধন্যবাদ জানিয়ে নিজ সেলে ফিরে এলাম। সে রাতেও রুটিনের কোনো পরিবর্তন হলো না। ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
২৪ জুন দুপুর একটায় আমাকে ডিবির গাড়িতে তোলা হলো। আদালতে আজ আর প্রিজন ভ্যানে যাচ্ছি না। বিদায়ের সময় এসিসট্যান্ট কমিশনার জানতে চাইলেন, মুক্ত জীবনেও আমি এমনই স্বল্পাহারী কিনা। তিনি আমাকে আটদিন এখানে প্রধানত চা এবং বিস্কুটের উপরেই কাটাতে দেখেছেন। চলে যাওয়ার দিনে তার বিস্ময় আমার কাছে প্রকাশ করলেন। কোর্ট গারদ হয়ে আদালতে যখন তোলা হলো, তখন প্রায় তিনটা বাজে। কাঠগড়ার দিকে এগিয়েই থমকে গেলাম। এমপি শাম্মীর পাশে আমার বেবী খালা দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি আমার মায়ের একমাত্র সহোদর বোন। আমার একমাত্র মামা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এবং এনবিআর-এর সদস্য এম আই খান ২০০৬-এ ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেছেন। খালাকে দেখে প্রচণ্ড রেগে গেলাম। আদালতের ও রকম পরিবেশে আমার পরিবার থেকে কোনো মহিলা যাতে না আসেন, পারভীনকে সেই অনুরোধ করেই গ্রেফতার হয়েছিলাম। আমার দীর্ঘদিনের রিমান্ড প্রিয়জনদের মনে কী অসহনীয় যাতনার সৃষ্টি করেছে, আমি সেটা কিছুতেই বুঝতে চাইলাম না। তাদের মধ্য থেকে অন্তত একজন স্বচক্ষে আমি জীবিত এবং সুস্থ আছি দেখার জন্যই যে পুরনো ঢাকার এই আদালত কক্ষে ছুটে এসেছেন, সেই অনুভূতি আমাকে তখন স্পর্শ না করলেও আজ লেখার সময় মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে। আমি খালাকে বললাম, তিনি ওখান থেকে না গেলে আমি কোনো অবস্থাতেই কাঠগড়ায় উঠব না। চোখ মুছতে মুছতে খালা চলে গেলেন। আপনজনের সঙ্গে আমার এই রূঢ় আচরণ যে তাদেরই সম্মান রক্ষার জন্য, সেটা তারা উপলব্ধি করবেন কিনা আমার জানা নেই।
আমার অসহায় ক্রোধের প্রকাশ দেখে শাম্মীসহ সবাই নিশ্চুপ; কাঠগড়ায় উঠে সানাউল্লাহ ভাইকে ডেকে টিএফআই সেলের অভিজ্ঞতা নিজমুখে বর্ণনা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। আমার বক্তব্য ছাড়া আজকের আদালতের কার্যক্রমে কোনো বৈচিত্র্য নেই। আগেই জেনেছি সরকারপক্ষ নতুন করে আর রিমান্ড চাইবে না। সুতরাং, এক্ষেত্রে আমার আইনজীবীদের কোনো বক্তব্য নেই। প্রথা অনুযায়ী আইনজীবীরা আমার জামিন চাইবেন এবং সরকারি পিপির তীব্র বিরোধিতার মুখে ম্যাজিস্ট্রেট জামিন নামঞ্জুর করে আমাকে জেল হাজতে প্রেরণ করবেন। বিচারের আগেই রায় মোটামুটি আমাদের জানা। ম্যাজিস্ট্রেট বক্তব্য প্রদানের সুযোগ দিলে সংক্ষেপে আমার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে আমাকে টিএফআই সেলে নেয়ার আইনগত বৈধতার প্রশ্ন উত্থাপন করলাম। সরকার পক্ষের জবাব শুনে বিস্ময়ে আমি হতবাক। তারা বলে উঠলেন, আমাকে নাকি টিএফআইতে নেয়াই হয়নি। আদালতে আমি যা কিছু বলছি, সবই নাকি আমার কল্পনাপ্রসূত। আমার কল্পনাশক্তির প্রতি সরকারের এই অপার আস্থায় বিমোহিত হলাম। সেই সঙ্গে সরকারের প্রতি এক প্রকার করুণাবোধও হলো। আমাকে আইন-বহির্ভূতভাবে টিএফআই সেলে নেয়ার পর যে জালিম সরকারকে এমন নির্জলা মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়, তার কারণ তারা নৈতিকভাবে ইতোমধ্যে পরাজিত হয়েছে। এই মহা পরাক্রমশীলদের আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার মতো মনের জোর আর অবশিষ্ট নেই। যেসব পিপি ৭ জুন আমার রিমান্ড শুনানিতে অশালীন সব অঙ্গভঙ্গি করে আমাকে গালিগালাজ করেছে, তাদেরই মুখ থেকে শুনলাম, উনি সম্মানিত ব্যক্তি, আইন মান্য করে সৌজন্যের সঙ্গে ওনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। অধিকতর বিস্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। গাত্রবর্ণে আমার চেয়েও পাকা এক পিপি অনেক ইতর বিশেষণের সঙ্গে আমাকে সেদিন টাউট বলেও সম্বোধন করেছিল। আদালতের কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর সেই একই ব্যক্তি আজ কাঠগড়ায় আমার কাছে এসে বলল, আমি আপনাকে খুব শ্রদ্ধা করি। কথাটি বলেই সে দ্রুত পায়ে আদালত থেকে বের হয়ে গেল।
জেলে যেতে হবে। আমি কাঠগড়া থেকে নেমে এলে সবাই আদালতে উকিলদের জন্য নির্ধারিত বেঞ্চে বসে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার অনুরোধ জানালেন। আদালতের অনুমতি আগেই নেয়া ছিল। বাসা থেকে খাবার এসেছে। সেগুলো না খেলে পারভীন আর মাকে সামলানো যাবে না। সাংবাদিক, প্রকৌশলী, আইনজীবী ঘর ভরে ফেলেছেন। আমার দুই হাতের অবস্থা দেখে তারা চমকে উঠলেন। সাপের খোলস ছাড়ানোর মতো তালু এবং উল্টো পিঠে চামড়া ওঠা তখনও চলছে। সহকর্মী সৈয়দ আবদাল আহমদের সঙ্গে ‘আমার দেশ’ আবার চালু করার আইনি পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করলাম। সর্বমোট আধ ঘণ্টাখানেক শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে কাটিয়ে প্রিজন ভ্যানে উঠলাম। জেল গেটে এসে সেখানে উপস্থিত সাংবাদিক কর্মীদের দিকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে ভেতরে ঢোকার সময় মনে হলো, কতদিন বাদে মুক্ত জীবনে ফিরব সেটা একেবারেই অনিশ্চিত। গ্রেফতার হওয়ার পর চব্বিশ দিন অতিবাহিত হয়েছে। এর মধ্যে আমারই নির্দেশ রক্ষা করতে গিয়ে মা এবং পারভীনের সঙ্গে দেখা হয়নি। টিএফআই সেলে নেয়ার প্রত্যুষে দূর থেকে মাকে এক নজর দেখেছিলাম ফুটপাথে বসে থাকতে। পারভীনকে দেখার সুযোগ হয়নি। ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে রিমান্ড জীবনের অপমান, নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতি স্মরণ করতে করতে সাত নম্বর সেলের দিকে দ্রুত গতিতে হেঁটে যাচ্ছিলাম। এমন সময় দূর থেকে একজনের চিত্কারে থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। দেখলাম শেষ বিকেলে দলবেঁধে গল্পরত বন্দিদের মধ্যে আমার কাছাকাছি বয়সেরই একজন দূর থেকে হাতের ইশারা করে লেখার ইঙ্গিত করছেন। আমি মুখ তুলে তাকাতেই উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলেন, স্যার কলম যেন বন্ধ না হয়। এতক্ষণের তীব্র মানসিক যন্ত্রণা আবেগে ভেসে গেল। ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে পথ চলতে শুরু করলাম। কিন্তু আগের গতি আর রইল না। ঝাপসা চোখে চশমার কাচ মুছতে মুছতে বাকি পথ অতিক্রম করে সেলে ফিরলাম। সেখানে আমার প্রতিবেশীরা অকৃত্রিম উত্কণ্ঠা নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। টিএফআই সেলে নেয়ার সংবাদ আমি আসার আগেই বিভিন্ন সূত্রে তাদের কাছে পৌঁছে গেছে। কুশলবিনিময় শেষে আপন কুঠুরিতে ঢুকলাম। শুরু হলো দীর্ঘ, অনিশ্চিত জেল জীবনে ফ্যাসিবাদের অত্যাচার, হয়রানি, অপমানকে উপেক্ষা করে বেঁচে থাকার লড়াই।
এবার বিনা বাধায় র্যাব-১ এর সদর দফতর পার হতে পারলাম। গাড়ি এয়ারপোর্ট রোডে পৌঁছানোর পর মোরশেদ দুঃখ প্রকাশ করে জানালেন, টিএফআইতে বিলম্বের কারণে আজ আর সিএমএম আদালতে যাওয়া যাচ্ছে না। আরও একটি রাত আমাকে ডিবিতে রাত্রিযাপন করতে হবে। মিন্টো রোডে পৌঁছাতে ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। পথিমধ্যে ডিবির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হলো, আমি সুস্থ শরীরে ছাড়া পেয়েছি। টিএফআই থেকে মুক্তি পেয়ে স্বস্তি বোধ করলেও এখানে এনে অপমান করার কষ্ট মন থেকে দূর করতে পারছিলাম না। ওই স্থানে লোমহর্ষক নির্যাতনের যে সব কাহিনী শুনেছি, সৌভাগ্যবশত আমার ক্ষেত্রে চোখ বেঁধে রাখা এবং হাতকড়া পরিয়ে শিকের সঙ্গে আটকে রাখা ছাড়া আর কিছু না ঘটলেও ভেবে পাচ্ছিলাম না কোন অপরাধে আমাকে টাস্কফোর্স ইন্টেরোগেশনের মুখোমুখি করা হলো। আমি চোর-ডাকাত নই, সন্ত্রাসী নই, কোনোদিন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না, সব সময় জাতির স্বার্থে কাজ করেছি। কেবল সরকারের রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডের সমালোচনামূলক লেখালেখির জন্যই কি আজ টিএফআই সেল দর্শন? আওয়ামী সমর্থক কলামিস্ট, বুদ্ধিজীবীরাই তো বাংলাদেশের প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া দীর্ঘদিন ধরে দখল করে আছেন। কলমের জবাব তারা তো কলম দিয়েই দিতে পারতেন। বন্দুক দেখানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমরা গুটিকয়েক ব্যক্তি মাত্র এতদিন মহাজোট সরকারকে ফ্যাসিস্ট নামে সম্বোধন করে এসেছি। এখন সারা বিশ্ব তাদের ওই নামে অভিহিত করবে। প্রধানমন্ত্রী আমাকে নির্যাতন করেছেন, আমার পরিবারকে হয়রানি করছেন। সে ক্ষমতা তার রয়েছে। এই নির্যাতনের মাধ্যমে প্রতিহিংসা পূরণ করে তিনি এক প্রকার মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে পারেন। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে তিনি লাভবান হয়েছেন কি? যে বিশেষ সংস্থাগুলো আমার গ্রেফতার ও নির্যাতন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, তাদের ক্রেডিবিলিটি এই ন্যক্কারজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে বাড়ল না কমল!
ডিবি অফিসে যখন ফিরলাম, ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বলতে গেলে আটচল্লিশ ঘণ্টায় কয়েক কাপ চা এবং বিস্কুট ছাড়া আর কিছু পেটে পড়েনি। ডিবির কর্মকর্তারা কিছু খেতে অনুরোধ করলেও আমার তখন প্রয়োজন গোসল করে টিএফআই সেলের ক্লেদ যথাসম্ভব ধুয়ে ফেলা। অনেকক্ষণ ধরে গোসল করে পূর্ববত্ খালি গায়ে ফ্যানের বাতাসে গায়ের পানি শুকালাম। সেই রাতে ভাত খেলাম। মেলামাইনের রংচটা প্লেটে ভাত এবং ডিমভাজি আর বাটিতে ডাল এলো। মাটিতে কাগজ বিছিয়ে রাতের আহারপর্ব শেষ করলাম। ডিউটি অফিসার দেখলাম উসখুস করছেন। জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকাতেই জানতে চাইলেন, আমি সুস্থ আছি কিনা। প্রশ্নের নিগূঢ় অর্থ হচ্ছে টিএফআই সেলে নিয়ে আমাকে পেটানো হয়েছে কিনা। তাকে ভরসা দিয়ে বললাম, তেমন কিছু ঘটেনি, আমি ভালোই আছি। রাতে ডিসি-ডিবির কক্ষে ডাক পড়ল। জিজ্ঞাসাবাদ আর হলো না। আমাকে শুধু জানানো হলো, পরদিন আমার রিমান্ড শেষ হচ্ছে এবং দুই দফায় ১৪ দিনের রিমান্ড শেষে আমি কাল সিএমএম আদালত থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফিরে যাচ্ছি। ডিসিকে ধন্যবাদ জানিয়ে নিজ সেলে ফিরে এলাম। সে রাতেও রুটিনের কোনো পরিবর্তন হলো না। ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
২৪ জুন দুপুর একটায় আমাকে ডিবির গাড়িতে তোলা হলো। আদালতে আজ আর প্রিজন ভ্যানে যাচ্ছি না। বিদায়ের সময় এসিসট্যান্ট কমিশনার জানতে চাইলেন, মুক্ত জীবনেও আমি এমনই স্বল্পাহারী কিনা। তিনি আমাকে আটদিন এখানে প্রধানত চা এবং বিস্কুটের উপরেই কাটাতে দেখেছেন। চলে যাওয়ার দিনে তার বিস্ময় আমার কাছে প্রকাশ করলেন। কোর্ট গারদ হয়ে আদালতে যখন তোলা হলো, তখন প্রায় তিনটা বাজে। কাঠগড়ার দিকে এগিয়েই থমকে গেলাম। এমপি শাম্মীর পাশে আমার বেবী খালা দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি আমার মায়ের একমাত্র সহোদর বোন। আমার একমাত্র মামা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এবং এনবিআর-এর সদস্য এম আই খান ২০০৬-এ ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেছেন। খালাকে দেখে প্রচণ্ড রেগে গেলাম। আদালতের ও রকম পরিবেশে আমার পরিবার থেকে কোনো মহিলা যাতে না আসেন, পারভীনকে সেই অনুরোধ করেই গ্রেফতার হয়েছিলাম। আমার দীর্ঘদিনের রিমান্ড প্রিয়জনদের মনে কী অসহনীয় যাতনার সৃষ্টি করেছে, আমি সেটা কিছুতেই বুঝতে চাইলাম না। তাদের মধ্য থেকে অন্তত একজন স্বচক্ষে আমি জীবিত এবং সুস্থ আছি দেখার জন্যই যে পুরনো ঢাকার এই আদালত কক্ষে ছুটে এসেছেন, সেই অনুভূতি আমাকে তখন স্পর্শ না করলেও আজ লেখার সময় মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে। আমি খালাকে বললাম, তিনি ওখান থেকে না গেলে আমি কোনো অবস্থাতেই কাঠগড়ায় উঠব না। চোখ মুছতে মুছতে খালা চলে গেলেন। আপনজনের সঙ্গে আমার এই রূঢ় আচরণ যে তাদেরই সম্মান রক্ষার জন্য, সেটা তারা উপলব্ধি করবেন কিনা আমার জানা নেই।
আমার অসহায় ক্রোধের প্রকাশ দেখে শাম্মীসহ সবাই নিশ্চুপ; কাঠগড়ায় উঠে সানাউল্লাহ ভাইকে ডেকে টিএফআই সেলের অভিজ্ঞতা নিজমুখে বর্ণনা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। আমার বক্তব্য ছাড়া আজকের আদালতের কার্যক্রমে কোনো বৈচিত্র্য নেই। আগেই জেনেছি সরকারপক্ষ নতুন করে আর রিমান্ড চাইবে না। সুতরাং, এক্ষেত্রে আমার আইনজীবীদের কোনো বক্তব্য নেই। প্রথা অনুযায়ী আইনজীবীরা আমার জামিন চাইবেন এবং সরকারি পিপির তীব্র বিরোধিতার মুখে ম্যাজিস্ট্রেট জামিন নামঞ্জুর করে আমাকে জেল হাজতে প্রেরণ করবেন। বিচারের আগেই রায় মোটামুটি আমাদের জানা। ম্যাজিস্ট্রেট বক্তব্য প্রদানের সুযোগ দিলে সংক্ষেপে আমার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে আমাকে টিএফআই সেলে নেয়ার আইনগত বৈধতার প্রশ্ন উত্থাপন করলাম। সরকার পক্ষের জবাব শুনে বিস্ময়ে আমি হতবাক। তারা বলে উঠলেন, আমাকে নাকি টিএফআইতে নেয়াই হয়নি। আদালতে আমি যা কিছু বলছি, সবই নাকি আমার কল্পনাপ্রসূত। আমার কল্পনাশক্তির প্রতি সরকারের এই অপার আস্থায় বিমোহিত হলাম। সেই সঙ্গে সরকারের প্রতি এক প্রকার করুণাবোধও হলো। আমাকে আইন-বহির্ভূতভাবে টিএফআই সেলে নেয়ার পর যে জালিম সরকারকে এমন নির্জলা মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়, তার কারণ তারা নৈতিকভাবে ইতোমধ্যে পরাজিত হয়েছে। এই মহা পরাক্রমশীলদের আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার মতো মনের জোর আর অবশিষ্ট নেই। যেসব পিপি ৭ জুন আমার রিমান্ড শুনানিতে অশালীন সব অঙ্গভঙ্গি করে আমাকে গালিগালাজ করেছে, তাদেরই মুখ থেকে শুনলাম, উনি সম্মানিত ব্যক্তি, আইন মান্য করে সৌজন্যের সঙ্গে ওনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। অধিকতর বিস্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। গাত্রবর্ণে আমার চেয়েও পাকা এক পিপি অনেক ইতর বিশেষণের সঙ্গে আমাকে সেদিন টাউট বলেও সম্বোধন করেছিল। আদালতের কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর সেই একই ব্যক্তি আজ কাঠগড়ায় আমার কাছে এসে বলল, আমি আপনাকে খুব শ্রদ্ধা করি। কথাটি বলেই সে দ্রুত পায়ে আদালত থেকে বের হয়ে গেল।
জেলে যেতে হবে। আমি কাঠগড়া থেকে নেমে এলে সবাই আদালতে উকিলদের জন্য নির্ধারিত বেঞ্চে বসে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার অনুরোধ জানালেন। আদালতের অনুমতি আগেই নেয়া ছিল। বাসা থেকে খাবার এসেছে। সেগুলো না খেলে পারভীন আর মাকে সামলানো যাবে না। সাংবাদিক, প্রকৌশলী, আইনজীবী ঘর ভরে ফেলেছেন। আমার দুই হাতের অবস্থা দেখে তারা চমকে উঠলেন। সাপের খোলস ছাড়ানোর মতো তালু এবং উল্টো পিঠে চামড়া ওঠা তখনও চলছে। সহকর্মী সৈয়দ আবদাল আহমদের সঙ্গে ‘আমার দেশ’ আবার চালু করার আইনি পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করলাম। সর্বমোট আধ ঘণ্টাখানেক শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে কাটিয়ে প্রিজন ভ্যানে উঠলাম। জেল গেটে এসে সেখানে উপস্থিত সাংবাদিক কর্মীদের দিকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে ভেতরে ঢোকার সময় মনে হলো, কতদিন বাদে মুক্ত জীবনে ফিরব সেটা একেবারেই অনিশ্চিত। গ্রেফতার হওয়ার পর চব্বিশ দিন অতিবাহিত হয়েছে। এর মধ্যে আমারই নির্দেশ রক্ষা করতে গিয়ে মা এবং পারভীনের সঙ্গে দেখা হয়নি। টিএফআই সেলে নেয়ার প্রত্যুষে দূর থেকে মাকে এক নজর দেখেছিলাম ফুটপাথে বসে থাকতে। পারভীনকে দেখার সুযোগ হয়নি। ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে রিমান্ড জীবনের অপমান, নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতি স্মরণ করতে করতে সাত নম্বর সেলের দিকে দ্রুত গতিতে হেঁটে যাচ্ছিলাম। এমন সময় দূর থেকে একজনের চিত্কারে থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। দেখলাম শেষ বিকেলে দলবেঁধে গল্পরত বন্দিদের মধ্যে আমার কাছাকাছি বয়সেরই একজন দূর থেকে হাতের ইশারা করে লেখার ইঙ্গিত করছেন। আমি মুখ তুলে তাকাতেই উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলেন, স্যার কলম যেন বন্ধ না হয়। এতক্ষণের তীব্র মানসিক যন্ত্রণা আবেগে ভেসে গেল। ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে পথ চলতে শুরু করলাম। কিন্তু আগের গতি আর রইল না। ঝাপসা চোখে চশমার কাচ মুছতে মুছতে বাকি পথ অতিক্রম করে সেলে ফিরলাম। সেখানে আমার প্রতিবেশীরা অকৃত্রিম উত্কণ্ঠা নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। টিএফআই সেলে নেয়ার সংবাদ আমি আসার আগেই বিভিন্ন সূত্রে তাদের কাছে পৌঁছে গেছে। কুশলবিনিময় শেষে আপন কুঠুরিতে ঢুকলাম। শুরু হলো দীর্ঘ, অনিশ্চিত জেল জীবনে ফ্যাসিবাদের অত্যাচার, হয়রানি, অপমানকে উপেক্ষা করে বেঁচে থাকার লড়াই।
No comments