৪- বাংলাদেশ সম্পর্কে সাম্রাজ্যবাদীদের নীতি সম্পূর্ণ ভারতীয় স্বার্থনির্ভর বলেই আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব হুমকিতে
নতুন মামলায় রিমান্ডে নাকি?
...ফজলুর কথাবার্তায় টিএফআই সেলে যাওয়ার স্মৃতি মনে পড়ে গেল। কিন্তু আমার রিমান্ড পর্ব শেষ হয়ে এখন তো কয়েদি পর্ব চলছে। সরকার আমার অগোচরে নতুন কোনো মামলা দিয়ে রিমান্ডের ব্যবস্থা পুনরায় করে ফেলেছে নাকি?...
...ফজলুর কথাবার্তায় টিএফআই সেলে যাওয়ার স্মৃতি মনে পড়ে গেল। কিন্তু আমার রিমান্ড পর্ব শেষ হয়ে এখন তো কয়েদি পর্ব চলছে। সরকার আমার অগোচরে নতুন কোনো মামলা দিয়ে রিমান্ডের ব্যবস্থা পুনরায় করে ফেলেছে নাকি?...
তিনদিন কাটল নিছক আড্ডা মেরে। এই সাড়ে চার মাসে ঢাকা জেলের লোকজন আমাকে ভালোমতই চিনে গেছে। দ্বিতীয় মামলার রায় সম্পর্কে মুখ খোলার আগেই আসামি, কারারক্ষী, জেল কর্মকর্তাদের মুখে মুখে রটে গেছে একশ’ টাকা জরিমানাও আমি দিচ্ছি না। ফয়সাল সেই একশ’ টাকা দিয়ে পিসি থেকে সাত নম্বর সেলের সবাইকে সিঙ্গাড়া খাওয়ানোর প্রস্তাব দেয়ামাত্র কবুল করলাম।
আমাদের এই ক’দিনের আড্ডার বিষয়বস্তু ছিল সরকারের সর্ববিষয়ে নির্জলা মিথ্যাচার এবং বিরোধী দলের আন্দোলন আন্দোলন খেলা। বেগম খালেদা জিয়ার সিরাজগঞ্জ সফরকে কেন্দ্র করে ট্রেনে কাটা পড়ে এতগুলো কর্মী-সমর্থক মারা গেল, ট্রেনে আগুন দেয়া হলো, বিএনপি’র হাজার হাজার কর্মীর নামে উল্টো বানোয়াট মামলা হলো; কিন্তু আন্দোলন যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই। সিরাজগঞ্জের ডামাডোলে মাঝখান থেকে পুলিশের চোখের সামনে দিনে-দুপুরে ২০০৬ সালের লগি-বৈঠা হত্যাকা ের অনুরূপ মডেলে নাটোরে একজন নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানকে বর্বরের মতো খুন করার ঘটনা চাপা পড়ে গেল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার সোনার ছেলেদের সন্ত্রাসের মধ্যেও এখন ‘ডালমে কুছ কালা’ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তিন দশকের পোড় খাওয়া শিক্ষিত প্রধানমন্ত্রীর মুখের ভাষা শুনলে লজ্জা পেতে হয়। একই প্রধানমন্ত্রী মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা আগে একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির খুনের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তার এই প্রতিশ্রুতির পরিণতিও দশ টাকা কেজি দরে চালের মতো হতে চলেছে। অন্যদিকে বিরোধীদলীয় নেত্রী সিরাজগঞ্জের জনসভা থেকে শোক জ্ঞাপন নয়, প্রতিরোধ ও প্রতিশোধের হুঙ্কার দেয়ার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তার দল বিএনপি দেশব্যাপী কালো ব্যাজ ধারণের মতো ‘ভয়ানক’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এমন ‘কঠোর’ কর্মসূচির সামনে মহাজোট সরকার এখন টিকলে হয়! এরশাদবিরোধী আন্দোলনের আপসহীন নেত্রীর কেন এই দুর্ভাগ্যজনক পশ্চাত্পসরণ? এই প্রশ্নের উত্তরে আমার নিজস্ব ব্যাখ্যা রয়েছে, মানা-না মানা আপনাদের ব্যাপার।
বাস্তবতা হলো, বিএনপির নীতিনির্ধারক এবং বিরোধীদলীয় নেত্রীর উপদেষ্টারা এত আগে আন্দোলনে নামতে মোটেও আগ্রহী নন। তারা মরুভূমির ঝড়ে পতিত উটের মতো বালিতে মুখ গুঁজে চারটি বছর কোনোক্রমে পার করে দিতে চান। মেয়াদের শেষ বছর জনসমর্থন হারিয়ে সরকার দুর্বল হয়ে পড়লে মামলা-মোকদ্দমা, জেলখাটা, রিমান্ড, লগি-বৈঠার বাড়ি খাওয়া, ইত্যাকার বিপদের আশঙ্কা অনেকটাই কমে যাবে। জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের বিবেচনায় তখনই রাজপথের লড়াকু সৈনিকদের মাঠে নামার উপযুক্ত সময়। সেই পর্যন্ত বিনা আয়াশে প্রাপ্ত অঢেল সম্পদ ও পিঠ বাঁচানোই হলো মহাজনী পন্থা। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ‘ধারক-বাহক’রা আমার ‘হঠকারী’ কার্যকলাপে তাই ক্রমেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছেন।
এ প্রসঙ্গে ফয়সাল একটা মজার গল্প শোনালো। প্রধানমন্ত্রীপুত্র জয় এবং জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সংক্রান্ত সংবাদ গত বছর ডিসেম্বরে আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে দেশব্যাপী হৈচৈ পড়ে যায়। দুই সপ্তাহের মধ্যে আমি ও সিনিয়র রিপোর্টার আবদুল্লাহ আওয়ামী পেটোয়া বাহিনীর হাতে আক্রান্ত হই। জেলায় জেলায় আমার দেশ পত্রিকার কপিতে আগুন জ্বালানো চলতে থাকে এবং আমার ও আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ায় মাত্র পঁচিশটি মামলা দায়ের করা হয়। আমার দেশ-এর খবরে অনুপ্রাণিত হয়ে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক সংসদে জয়ের বিরুদ্ধে ভিওআইপি’র অবৈধ ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ তুললে বারুদে আগুন লাগে। ফারুকের বিরুদ্ধেও আমার মতো জেলায় জেলায় মামলা দায়েরের সিলসিলা শুরু হয়ে যায়। এদিকে সরকারের আক্রোশ গিয়ে পড়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন ল্যান্ডফোন কোম্পানিগুলোর ওপর। শুরু হয় সেসব জায়গায় র্যাব-পুলিশের অভিযান, গ্রেফতার, সিলগালা ইত্যাদি। আমার ছেলের নামে কুত্সা, দেখি ব্যাটারা তোরা ভিওআইপি ব্যবসা করিস কী করে? ব্যাপারটা অনেকটা এইরকম আর কি!
বিটিআরসি’র পুলিশি অভিযানে যেসব কোম্পানিতে তালা পড়ে, তার মধ্যে বিএনপির প্রভাবশালী নেতা মির্জা আব্বাসের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ঢাকা ফোন একটি। কোম্পানির হোমরা-চোমরাদের গ্রেফতার করা হলে ঢাকা জেলে তাদের স্থান হয় আমার বর্তমান আস্তানা, সাত নম্বর সেলেই। আমি এখানে এসে সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিলেও বোতলজাত পানি পানের বিলাসিতাটা স্বাস্থ্যগত কারণে এখনও ছাড়তে পারিনি। ঢাকা ফোনের পরিচালক অথবা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নাকি দন্ত মার্জনা, হাত-মুখ প্রক্ষালন, অজু ইত্যাদি কাজেও পিসি থেকে কেনা বোতলের পানি লাগত। ঢাকা ফোনের একজন জুনিয়র সহকর্মী জেলখানায় বিগ বসের সহগামী হয়েছিলেন। সেই ব্যক্তির কাজ ছিল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গৃহকর্মীর মতো বসের ফাই-ফরমাশ খাটা। যাক, গল্প সেটা নয়। সঠিক স্থানে রাজনৈতিক সংযোগের গুণে অতীব ধনবান লোকটিকে কয়েকটি দিন মাত্র নাজিমউদ্দিন রোডের জেলখানায় থাকতে হয়েছিল। যথাস্থানে বিপুল অর্থ প্রদানের মাধ্যমে অসুস্থ না হয়েও তিনি বাইরের হাসপাতালে গমন করেন এবং স্বাধীন বিচারব্যবস্থার কল্যাণে দ্রুত জামিন পেতেও কোনো সমস্যা হয়নি। যে ক’দিন ঢাকা ফোনের সেই বড় সাহেব জেলে ছিলেন, আমাকে ও জয়নুল আবদিন ফারুককে গালমন্দ না করে জল স্পর্শ করতেন না। আমার লেখালেখি নিয়েও নাকি তার বেজায় রাগ ছিল। তার কথা হলো, প্রধানমন্ত্রীপুত্রের টু-পাইস কামানোর সংবাদ না ছাপালেই তো তাদের টু-পাইস কামানোতে এই আচমকা বিঘ্ন সৃষ্টি হতো না। সুতরাং, যত নষ্টের গোড়া মাহমুদুর রহমান ও তার সম্পাদিত আমার দেশ পত্রিকা। মাতব্বর টাইপের লোকটা তলে তলে বিএনপির মহাশত্রু, আমাদের ভালো দেখতে পারে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। ফয়সালের বর্ণনা সত্যি কি-না এবং সত্য হলে মির্জা আব্বাস তার ব্যবসায়িক অংশীদারের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন কি-না, আমার জানা নেই। তবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নীতিনির্ধারকদের মধ্যকার বিত্তবান অংশ বর্তমান পরিস্থিতিতে কঠোর আন্দোলনের পরিবর্তে নিজেদের অর্থ-সম্পদ রক্ষাতেই যে অধিকতর আগ্রহী হবেন, এ নিয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই।
আন্দোলনের ব্যাপারে বেগম খালেদা জিয়াকে নিরুত্সাহিত করার পেছনে তার দলের সুবিধাবাদী অংশের পাশাপাশি প্রভাবশালী পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর স্থানীয় দূতাবাসের ভূমিকা থাকাও বিচিত্র নয়। নানান কিসিমের দেশি-বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহারসহ বিশেষ উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উপায়ে এরা বিভ্রান্তি ছড়াতে সিদ্ধহস্ত। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী পরাশক্তির কৌশলগত ঐক্যের অন্যতম শর্তই হচ্ছে বাংলাদেশে সেক্যুলারদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করা। এদেশের ইসলামী চিন্তা-চেতনাসমৃদ্ধ জাতীয়তাবাদী শক্তিকে কেবল হীনবল নয়, সম্ভব হলে নিশ্চিহ্ন করতে তারা বদ্ধপরিকর। মাইনাস টু-এর আড়ালে সেই লক্ষ্য পূরণেই এখানে এক-এগারো ঘটানো হয়েছিল। সে সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং তার কিছু সাঙ্গপাঙ্গের ওপর যে খানিকটা বিপদ গেছে, তা শুধু জাতীয়তাবাদী শক্তির ধ্বংসসাধন প্রক্রিয়া হালাল করার কৌশল ছিল। বাংলাদেশ সম্পর্কে সাম্রাজ্যবাদীদের নীতি আজ সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় স্বার্থনির্ভর হয়ে পড়ার ফলে আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ভয়ঙ্কর হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। অথচ এই সেদিনও আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব হত্যাকা ের জন্য সিআইএ’কে দায়ী করে বিষোদ্গার করতেন। চিলির বামপন্থী নেতা সালভাদর আলেন্দে’র সঙ্গে শেখ মুজিবকে তুলনা করে দেয়া জ্বালাময়ী বক্তৃতা আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের কণ্ঠে দেশবাসী একসময় হরহামেশা শুনেছে। এগুলো অবশ্য সবই অতীতের কথা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার মার্কিন বন্ধুরা নিশ্চয়ই অতীত খুঁড়ে আর বেদনা জাগাতে চান না। আমার এ-জাতীয় চিন্তা ও বিশ্লেষণ বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে আমাকে যে আরও অজনপ্রিয় করে তুলবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে সত্য কথা বলার নীতি এবং জনপ্রিয়তা পরস্পরবিরোধী। তবে কোনোরকম রাজনৈতিক অথবা অর্থনৈতিক উচ্চাভিলাষ না থাকার কারণে জনপ্রিয়তা আমার কাছে একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ নয়।
গতকাল উচ্চ আদালতে দু’টি মামলার রায় বেগম খালেদা জিয়ার বিপক্ষে গেছে। কোকোর প্যারোল বাতিলের প্রশাসনিক আদেশ বহাল রেখেছেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। একইদিনে বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ক্যান্টনমেন্টের প্রায় চার দশকের আনন্দ-বেদনার স্মৃতিবিজড়িত গৃহ থেকে উচ্ছেদের সরকারি অমানবিক প্রচেষ্টার গায়ে বৈধতার মোহর লাগিয়েছেন। সেই থেকে মনটা বড় খারাপ হয়ে আছে। বিচারব্যবস্থার বিদ্যমান অবস্থা বোঝার পরও বাড়ি ছাড়ার সরকারি নোটিশের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়াটা কতটা বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে, সেটা বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীরাই ভালো জানেন। শিক্ষিত লোকজন জেলে থাকলে পরিস্থিতির চাপেই আইন খানিকটা বুঝে ফেলে। সেরকমই একজন আমার কাছে জানতে চাইল জমি-জিরাতের বিষয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রী হাইকোর্টে রিটের পরিবর্তে নিম্ন আদালতের দেওয়ানি অংশে গেলেন না কেন? তাহলে তো মামলাটার নিষ্পত্তি হতে দীর্ঘদিন লাগত। ততদিনে হয়তো আদালত তাদের হৃত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে সক্ষম হতো এবং খালেদা জিয়াও ন্যায়বিচার পেতেন। বলাই বাহুল্য, এ প্রশ্নের জবাবও আমার জ্ঞানের বাইরে। এসব নিয়েই শুক্রবার সকালে ফয়সাল আর মুকুলের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করছিলাম। এমন সময় সুবেদার ফজলুল হক নামক ভগ্নদূতের আগমন সংবাদ দিয়েই জেলজীবনের কথকতার দ্বিতীয় পর্ব লেখা শুরু করেছি।
ফজলুল হক কোনো ভনিতা না করেই সরাসরি বললো, স্যার আপনাকে এখন যেতে হবে, আমরা নিতে এসেছি। সাধারণত রিমান্ডে নেয়ার সময় এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করা হয়। ফজলুর কথাবার্তায় টিএফআই সেলে যাওয়ার স্মৃতি মনে পড়ে গেল। কিন্তু আমার রিমান্ড পর্ব শেষ হয়ে এখন তো কয়েদি পর্ব চলছে। সরকার আমার অগোচরে নতুন কোনো মামলা দিয়ে রিমান্ডের ব্যবস্থা পুনরায় করে ফেলেছে নাকি? কোথায় যেতে হবে প্রশ্ন করলে ছোট সুবেদার হেঁয়ালি করে বললো, এই কাছে-ধারেই, জেলগেটে গেলে পুরোটা জানতে পারবেন। জিজ্ঞাসা করলাম, ক’দিনের কাপড় নিতে হবে? ত্বরিত ও হ্রস্ব জবাব এলো, সবকিছু। এতক্ষণে বুঝলাম রিমান্ডে নয়, চালানে যাচ্ছি। সেলের প্রতিবেশীরা হতভম্ব, নির্বাক। এবার বিপদে পড়লাম। সাড়ে চার মাসের সংসার, একটু একটু করে লটবহর তো একেবারে কম জমেনি। ফজলুর কাছে-ধারে থেকে আন্দাজ করছি আপাতত গন্তব্য কাশিমপুর জেল। ঈদুল ফিতরের দিন আইজি’র সঙ্গে বাদানুবাদের শোধ বেশ তাড়াতাড়ি এসে গেল। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। একজন আইজি আমার মতো কয়েদিকে হয়রানি করার জন্যে জেলে জেলে ঘোরানোর ক্ষমতা রাখেন। সেই ক্ষমতাই দেখাচ্ছেন আর্মি মেডিকেল কোরের অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার আশরাফুল ইসলাম খান। আমাকে ঢাকা জেল থেকে সরানোর একটা দ্বিতীয় কারণও অবশ্য থাকতে পারে। এতদিন এক জেলে থাকার ফলে কারারক্ষী, কর্মকর্তা, বন্দি নির্বিশেষে প্রায় সবার সঙ্গেই হৃদ্যতামূলক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। রূপসা, খাতা, দালান ইত্যাদি বন্দিশালা নামক গোয়াল থেকে আসামিরা তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে প্রতিদিনই হাজির হয়। আমি নিজেই বন্দি, তাই কারও তেমন উপকারের ক্ষমতা রাখি না। আমার কাছে তাদের দুঃখ-বেদনার কাহিনী বলেই শান্তি পায় এই অসহায়, দরিদ্র মানুষগুলো। সেদিন একজন বৃদ্ধ এসে হাজির। সত্তরোর্ধ্ব লোকটি মুদি দোকান চালিয়ে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করত। এক রাতে গ্রেফতারের কোটা পূরণ করার জন্য এলাকার পুলিশ একটা মদের বোতল হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাকে জেলে নিয়ে এসেছে। লোকটি কাঁদতে কাঁদতে বললো, জীবনে সিগারেট পর্যন্ত খাইনি, এই বুড়ো বয়সে আমার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ! কার কাছে বিচার চাইব? প্রশাসন হয়তো চায় না রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে এই অত্যাচারিতরা আমার সংস্পর্শে এসে তাদের মনের ভার কিঞ্চিত্ লাঘব করুক।
আমাদের এই ক’দিনের আড্ডার বিষয়বস্তু ছিল সরকারের সর্ববিষয়ে নির্জলা মিথ্যাচার এবং বিরোধী দলের আন্দোলন আন্দোলন খেলা। বেগম খালেদা জিয়ার সিরাজগঞ্জ সফরকে কেন্দ্র করে ট্রেনে কাটা পড়ে এতগুলো কর্মী-সমর্থক মারা গেল, ট্রেনে আগুন দেয়া হলো, বিএনপি’র হাজার হাজার কর্মীর নামে উল্টো বানোয়াট মামলা হলো; কিন্তু আন্দোলন যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই। সিরাজগঞ্জের ডামাডোলে মাঝখান থেকে পুলিশের চোখের সামনে দিনে-দুপুরে ২০০৬ সালের লগি-বৈঠা হত্যাকা ের অনুরূপ মডেলে নাটোরে একজন নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানকে বর্বরের মতো খুন করার ঘটনা চাপা পড়ে গেল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার সোনার ছেলেদের সন্ত্রাসের মধ্যেও এখন ‘ডালমে কুছ কালা’ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তিন দশকের পোড় খাওয়া শিক্ষিত প্রধানমন্ত্রীর মুখের ভাষা শুনলে লজ্জা পেতে হয়। একই প্রধানমন্ত্রী মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা আগে একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির খুনের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তার এই প্রতিশ্রুতির পরিণতিও দশ টাকা কেজি দরে চালের মতো হতে চলেছে। অন্যদিকে বিরোধীদলীয় নেত্রী সিরাজগঞ্জের জনসভা থেকে শোক জ্ঞাপন নয়, প্রতিরোধ ও প্রতিশোধের হুঙ্কার দেয়ার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তার দল বিএনপি দেশব্যাপী কালো ব্যাজ ধারণের মতো ‘ভয়ানক’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এমন ‘কঠোর’ কর্মসূচির সামনে মহাজোট সরকার এখন টিকলে হয়! এরশাদবিরোধী আন্দোলনের আপসহীন নেত্রীর কেন এই দুর্ভাগ্যজনক পশ্চাত্পসরণ? এই প্রশ্নের উত্তরে আমার নিজস্ব ব্যাখ্যা রয়েছে, মানা-না মানা আপনাদের ব্যাপার।
বাস্তবতা হলো, বিএনপির নীতিনির্ধারক এবং বিরোধীদলীয় নেত্রীর উপদেষ্টারা এত আগে আন্দোলনে নামতে মোটেও আগ্রহী নন। তারা মরুভূমির ঝড়ে পতিত উটের মতো বালিতে মুখ গুঁজে চারটি বছর কোনোক্রমে পার করে দিতে চান। মেয়াদের শেষ বছর জনসমর্থন হারিয়ে সরকার দুর্বল হয়ে পড়লে মামলা-মোকদ্দমা, জেলখাটা, রিমান্ড, লগি-বৈঠার বাড়ি খাওয়া, ইত্যাকার বিপদের আশঙ্কা অনেকটাই কমে যাবে। জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের বিবেচনায় তখনই রাজপথের লড়াকু সৈনিকদের মাঠে নামার উপযুক্ত সময়। সেই পর্যন্ত বিনা আয়াশে প্রাপ্ত অঢেল সম্পদ ও পিঠ বাঁচানোই হলো মহাজনী পন্থা। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ‘ধারক-বাহক’রা আমার ‘হঠকারী’ কার্যকলাপে তাই ক্রমেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছেন।
এ প্রসঙ্গে ফয়সাল একটা মজার গল্প শোনালো। প্রধানমন্ত্রীপুত্র জয় এবং জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সংক্রান্ত সংবাদ গত বছর ডিসেম্বরে আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে দেশব্যাপী হৈচৈ পড়ে যায়। দুই সপ্তাহের মধ্যে আমি ও সিনিয়র রিপোর্টার আবদুল্লাহ আওয়ামী পেটোয়া বাহিনীর হাতে আক্রান্ত হই। জেলায় জেলায় আমার দেশ পত্রিকার কপিতে আগুন জ্বালানো চলতে থাকে এবং আমার ও আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ায় মাত্র পঁচিশটি মামলা দায়ের করা হয়। আমার দেশ-এর খবরে অনুপ্রাণিত হয়ে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক সংসদে জয়ের বিরুদ্ধে ভিওআইপি’র অবৈধ ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ তুললে বারুদে আগুন লাগে। ফারুকের বিরুদ্ধেও আমার মতো জেলায় জেলায় মামলা দায়েরের সিলসিলা শুরু হয়ে যায়। এদিকে সরকারের আক্রোশ গিয়ে পড়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন ল্যান্ডফোন কোম্পানিগুলোর ওপর। শুরু হয় সেসব জায়গায় র্যাব-পুলিশের অভিযান, গ্রেফতার, সিলগালা ইত্যাদি। আমার ছেলের নামে কুত্সা, দেখি ব্যাটারা তোরা ভিওআইপি ব্যবসা করিস কী করে? ব্যাপারটা অনেকটা এইরকম আর কি!
বিটিআরসি’র পুলিশি অভিযানে যেসব কোম্পানিতে তালা পড়ে, তার মধ্যে বিএনপির প্রভাবশালী নেতা মির্জা আব্বাসের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ঢাকা ফোন একটি। কোম্পানির হোমরা-চোমরাদের গ্রেফতার করা হলে ঢাকা জেলে তাদের স্থান হয় আমার বর্তমান আস্তানা, সাত নম্বর সেলেই। আমি এখানে এসে সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিলেও বোতলজাত পানি পানের বিলাসিতাটা স্বাস্থ্যগত কারণে এখনও ছাড়তে পারিনি। ঢাকা ফোনের পরিচালক অথবা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নাকি দন্ত মার্জনা, হাত-মুখ প্রক্ষালন, অজু ইত্যাদি কাজেও পিসি থেকে কেনা বোতলের পানি লাগত। ঢাকা ফোনের একজন জুনিয়র সহকর্মী জেলখানায় বিগ বসের সহগামী হয়েছিলেন। সেই ব্যক্তির কাজ ছিল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গৃহকর্মীর মতো বসের ফাই-ফরমাশ খাটা। যাক, গল্প সেটা নয়। সঠিক স্থানে রাজনৈতিক সংযোগের গুণে অতীব ধনবান লোকটিকে কয়েকটি দিন মাত্র নাজিমউদ্দিন রোডের জেলখানায় থাকতে হয়েছিল। যথাস্থানে বিপুল অর্থ প্রদানের মাধ্যমে অসুস্থ না হয়েও তিনি বাইরের হাসপাতালে গমন করেন এবং স্বাধীন বিচারব্যবস্থার কল্যাণে দ্রুত জামিন পেতেও কোনো সমস্যা হয়নি। যে ক’দিন ঢাকা ফোনের সেই বড় সাহেব জেলে ছিলেন, আমাকে ও জয়নুল আবদিন ফারুককে গালমন্দ না করে জল স্পর্শ করতেন না। আমার লেখালেখি নিয়েও নাকি তার বেজায় রাগ ছিল। তার কথা হলো, প্রধানমন্ত্রীপুত্রের টু-পাইস কামানোর সংবাদ না ছাপালেই তো তাদের টু-পাইস কামানোতে এই আচমকা বিঘ্ন সৃষ্টি হতো না। সুতরাং, যত নষ্টের গোড়া মাহমুদুর রহমান ও তার সম্পাদিত আমার দেশ পত্রিকা। মাতব্বর টাইপের লোকটা তলে তলে বিএনপির মহাশত্রু, আমাদের ভালো দেখতে পারে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। ফয়সালের বর্ণনা সত্যি কি-না এবং সত্য হলে মির্জা আব্বাস তার ব্যবসায়িক অংশীদারের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন কি-না, আমার জানা নেই। তবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নীতিনির্ধারকদের মধ্যকার বিত্তবান অংশ বর্তমান পরিস্থিতিতে কঠোর আন্দোলনের পরিবর্তে নিজেদের অর্থ-সম্পদ রক্ষাতেই যে অধিকতর আগ্রহী হবেন, এ নিয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই।
আন্দোলনের ব্যাপারে বেগম খালেদা জিয়াকে নিরুত্সাহিত করার পেছনে তার দলের সুবিধাবাদী অংশের পাশাপাশি প্রভাবশালী পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর স্থানীয় দূতাবাসের ভূমিকা থাকাও বিচিত্র নয়। নানান কিসিমের দেশি-বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহারসহ বিশেষ উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উপায়ে এরা বিভ্রান্তি ছড়াতে সিদ্ধহস্ত। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী পরাশক্তির কৌশলগত ঐক্যের অন্যতম শর্তই হচ্ছে বাংলাদেশে সেক্যুলারদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করা। এদেশের ইসলামী চিন্তা-চেতনাসমৃদ্ধ জাতীয়তাবাদী শক্তিকে কেবল হীনবল নয়, সম্ভব হলে নিশ্চিহ্ন করতে তারা বদ্ধপরিকর। মাইনাস টু-এর আড়ালে সেই লক্ষ্য পূরণেই এখানে এক-এগারো ঘটানো হয়েছিল। সে সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং তার কিছু সাঙ্গপাঙ্গের ওপর যে খানিকটা বিপদ গেছে, তা শুধু জাতীয়তাবাদী শক্তির ধ্বংসসাধন প্রক্রিয়া হালাল করার কৌশল ছিল। বাংলাদেশ সম্পর্কে সাম্রাজ্যবাদীদের নীতি আজ সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় স্বার্থনির্ভর হয়ে পড়ার ফলে আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ভয়ঙ্কর হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। অথচ এই সেদিনও আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব হত্যাকা ের জন্য সিআইএ’কে দায়ী করে বিষোদ্গার করতেন। চিলির বামপন্থী নেতা সালভাদর আলেন্দে’র সঙ্গে শেখ মুজিবকে তুলনা করে দেয়া জ্বালাময়ী বক্তৃতা আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের কণ্ঠে দেশবাসী একসময় হরহামেশা শুনেছে। এগুলো অবশ্য সবই অতীতের কথা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার মার্কিন বন্ধুরা নিশ্চয়ই অতীত খুঁড়ে আর বেদনা জাগাতে চান না। আমার এ-জাতীয় চিন্তা ও বিশ্লেষণ বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে আমাকে যে আরও অজনপ্রিয় করে তুলবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে সত্য কথা বলার নীতি এবং জনপ্রিয়তা পরস্পরবিরোধী। তবে কোনোরকম রাজনৈতিক অথবা অর্থনৈতিক উচ্চাভিলাষ না থাকার কারণে জনপ্রিয়তা আমার কাছে একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ নয়।
গতকাল উচ্চ আদালতে দু’টি মামলার রায় বেগম খালেদা জিয়ার বিপক্ষে গেছে। কোকোর প্যারোল বাতিলের প্রশাসনিক আদেশ বহাল রেখেছেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। একইদিনে বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ক্যান্টনমেন্টের প্রায় চার দশকের আনন্দ-বেদনার স্মৃতিবিজড়িত গৃহ থেকে উচ্ছেদের সরকারি অমানবিক প্রচেষ্টার গায়ে বৈধতার মোহর লাগিয়েছেন। সেই থেকে মনটা বড় খারাপ হয়ে আছে। বিচারব্যবস্থার বিদ্যমান অবস্থা বোঝার পরও বাড়ি ছাড়ার সরকারি নোটিশের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়াটা কতটা বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে, সেটা বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীরাই ভালো জানেন। শিক্ষিত লোকজন জেলে থাকলে পরিস্থিতির চাপেই আইন খানিকটা বুঝে ফেলে। সেরকমই একজন আমার কাছে জানতে চাইল জমি-জিরাতের বিষয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রী হাইকোর্টে রিটের পরিবর্তে নিম্ন আদালতের দেওয়ানি অংশে গেলেন না কেন? তাহলে তো মামলাটার নিষ্পত্তি হতে দীর্ঘদিন লাগত। ততদিনে হয়তো আদালত তাদের হৃত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে সক্ষম হতো এবং খালেদা জিয়াও ন্যায়বিচার পেতেন। বলাই বাহুল্য, এ প্রশ্নের জবাবও আমার জ্ঞানের বাইরে। এসব নিয়েই শুক্রবার সকালে ফয়সাল আর মুকুলের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করছিলাম। এমন সময় সুবেদার ফজলুল হক নামক ভগ্নদূতের আগমন সংবাদ দিয়েই জেলজীবনের কথকতার দ্বিতীয় পর্ব লেখা শুরু করেছি।
ফজলুল হক কোনো ভনিতা না করেই সরাসরি বললো, স্যার আপনাকে এখন যেতে হবে, আমরা নিতে এসেছি। সাধারণত রিমান্ডে নেয়ার সময় এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করা হয়। ফজলুর কথাবার্তায় টিএফআই সেলে যাওয়ার স্মৃতি মনে পড়ে গেল। কিন্তু আমার রিমান্ড পর্ব শেষ হয়ে এখন তো কয়েদি পর্ব চলছে। সরকার আমার অগোচরে নতুন কোনো মামলা দিয়ে রিমান্ডের ব্যবস্থা পুনরায় করে ফেলেছে নাকি? কোথায় যেতে হবে প্রশ্ন করলে ছোট সুবেদার হেঁয়ালি করে বললো, এই কাছে-ধারেই, জেলগেটে গেলে পুরোটা জানতে পারবেন। জিজ্ঞাসা করলাম, ক’দিনের কাপড় নিতে হবে? ত্বরিত ও হ্রস্ব জবাব এলো, সবকিছু। এতক্ষণে বুঝলাম রিমান্ডে নয়, চালানে যাচ্ছি। সেলের প্রতিবেশীরা হতভম্ব, নির্বাক। এবার বিপদে পড়লাম। সাড়ে চার মাসের সংসার, একটু একটু করে লটবহর তো একেবারে কম জমেনি। ফজলুর কাছে-ধারে থেকে আন্দাজ করছি আপাতত গন্তব্য কাশিমপুর জেল। ঈদুল ফিতরের দিন আইজি’র সঙ্গে বাদানুবাদের শোধ বেশ তাড়াতাড়ি এসে গেল। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। একজন আইজি আমার মতো কয়েদিকে হয়রানি করার জন্যে জেলে জেলে ঘোরানোর ক্ষমতা রাখেন। সেই ক্ষমতাই দেখাচ্ছেন আর্মি মেডিকেল কোরের অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার আশরাফুল ইসলাম খান। আমাকে ঢাকা জেল থেকে সরানোর একটা দ্বিতীয় কারণও অবশ্য থাকতে পারে। এতদিন এক জেলে থাকার ফলে কারারক্ষী, কর্মকর্তা, বন্দি নির্বিশেষে প্রায় সবার সঙ্গেই হৃদ্যতামূলক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। রূপসা, খাতা, দালান ইত্যাদি বন্দিশালা নামক গোয়াল থেকে আসামিরা তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে প্রতিদিনই হাজির হয়। আমি নিজেই বন্দি, তাই কারও তেমন উপকারের ক্ষমতা রাখি না। আমার কাছে তাদের দুঃখ-বেদনার কাহিনী বলেই শান্তি পায় এই অসহায়, দরিদ্র মানুষগুলো। সেদিন একজন বৃদ্ধ এসে হাজির। সত্তরোর্ধ্ব লোকটি মুদি দোকান চালিয়ে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করত। এক রাতে গ্রেফতারের কোটা পূরণ করার জন্য এলাকার পুলিশ একটা মদের বোতল হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাকে জেলে নিয়ে এসেছে। লোকটি কাঁদতে কাঁদতে বললো, জীবনে সিগারেট পর্যন্ত খাইনি, এই বুড়ো বয়সে আমার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ! কার কাছে বিচার চাইব? প্রশাসন হয়তো চায় না রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে এই অত্যাচারিতরা আমার সংস্পর্শে এসে তাদের মনের ভার কিঞ্চিত্ লাঘব করুক।
No comments