২২- হঠাৎই জেল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিল, জামায়াত নেতা ও ডিভিশনের বন্দিরা ভালো খাবার কিনতে পারবেন না
জেলখানায় রোজার প্রথম রাত...
জেলখানার দক্ষিণের মসজিদ থেকে পবিত্র রমজান মাস শুরুর ঘোষণা এলো। শেষরাতে সময়মত ঘুম ভাঙবে কি-না সংশয় ছিল। কিন্তু রোজার প্রথম রাতেই বুঝলাম এই দুশ্চিন্তা অর্থহীন। রাত একটায় সাত নম্বর সেলে সেহরি আসা শুরু হলো। খাবার সরবরাহকারীদের উচ্চকণ্ঠ চিত্কারে ঘুমায় সাধ্য কার! বন্দিরা গারদের ফাঁক গলিয়ে প্লাস্টিকের বাক্স পাঠাচ্ছে আর সরবরাহকারীরা বাক্সগুলো ভরে দিচ্ছে। সাধারণ কয়েদিদের বেলায় সেহরি নেয়ার জন্য সেলের দরজা খোলার বিধান না থাকলেও আমার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ তার ব্যতিক্রম করলো...
জেলখানার দক্ষিণের মসজিদ থেকে পবিত্র রমজান মাস শুরুর ঘোষণা এলো। শেষরাতে সময়মত ঘুম ভাঙবে কি-না সংশয় ছিল। কিন্তু রোজার প্রথম রাতেই বুঝলাম এই দুশ্চিন্তা অর্থহীন। রাত একটায় সাত নম্বর সেলে সেহরি আসা শুরু হলো। খাবার সরবরাহকারীদের উচ্চকণ্ঠ চিত্কারে ঘুমায় সাধ্য কার! বন্দিরা গারদের ফাঁক গলিয়ে প্লাস্টিকের বাক্স পাঠাচ্ছে আর সরবরাহকারীরা বাক্সগুলো ভরে দিচ্ছে। সাধারণ কয়েদিদের বেলায় সেহরি নেয়ার জন্য সেলের দরজা খোলার বিধান না থাকলেও আমার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ তার ব্যতিক্রম করলো...
সন্ধ্যায় রেডিওতে প্রচারিত সংবাদে জানলাম, আমার আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হয়েছে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে প্রধানমন্ত্রী গোপালগঞ্জ যেতে পারেননি। এছাড়া আরও একটি দুঃসংবাদ শুনলাম। প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্যে সড়কপথে গোপালগঞ্জে যাওয়ার সময় এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় একজন সচিব ও তার সহযাত্রী বিসিক চেয়ারম্যান নিহত হয়েছেন। মাত্র দু’দিন আগে সরকার আমাকে গোপালগঞ্জ ঘুরিয়ে আনলেও এত ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রীকে প্রকৃতির কাছে পরাজিত হয়ে তার সফর বাতিল করতে হলো। আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আমরা নিতান্তই অসহায়—এই শাশ্বত সত্যটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা যে মানতে চান না, এটা তাদেরই দুর্ভাগ্য। আজ গোপালগঞ্জে প্রধানমন্ত্রীর নির্ধারিত একাধিক অনুষ্ঠানের মধ্যে তার মরহুম পিতার নামে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির একটি প্রকল্প উদ্বোধনেরও কথা ছিল। এই প্রকল্পটির উদ্যোক্তা তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পোশাক ব্যবসায়ীরা এই প্রকল্পের জন্য গোপালগঞ্জকে কেন বেছে নিয়েছেন, সেটা বোঝা কঠিন নয়। বর্তমানে বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে এই প্রকল্পের স্থান গোপালগঞ্জের পরিবর্তে বগুড়া কিংবা ফেনী হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক ছিল। আমাদের ব্যবসায়িক সংগঠনগুলো ক্রমেই রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। গোপালগঞ্জে তৈল প্রদান প্রকল্প নিয়ে পোশাক ব্যবসায়ীরা যখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন, ঠিক সেই সময়ে তাদেরই শিল্পে কর্মরত বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জে অধিক মজুরির দাবিতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে রত। দিনব্যাপী সংঘর্ষে পুলিশ এবং শ্রমিক মিলে একদিনে আড়াইশ’জন আহত হয়েছে। আহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। সংঘর্ষ তীব্র ও ব্যাপক হওয়ায় সাভার, আশুলিয়া শিল্প এলাকার প্রায় দেড়শ’ পোশাক কারখানা সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করতে হয়েছে।
আমার কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় শিল্প শ্রমিকদের সঙ্গে বিভিন্ন কারখানায় কেটেছে। এদেশের শ্রমিকদের আমি সবসময় পরিশ্রমী, সুশৃঙ্খল এবং অনুগতই দেখতে পেয়েছি। পোশাকশিল্প শ্রমিকদের যে কোনো আন্দোলনে সহিংসতার এই তীব্রতা আমাকে প্রচণ্ড বিস্মিত করে। আমার তিন দশকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সঙ্গে বিশেষ খাতের শ্রমিক শ্রেণীর এই ক্রোধকে মেলাতে পারি না। শ্রমজীবী মানুষের অসন্তোষকে উস্কে নিয়ন্ত্রণহীন করার পেছনে কোনো বিদেশি সংস্রব আছে কি-না, সেই রহস্য উদঘাটনের দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার। তবে এই বিশেষ শিল্প খাতটির মালিকদের বিষয়ে আমার কিছু বক্তব্য রয়েছে। বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশের পোশাকশিল্প মালিকরা তাদের পণ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেছেন। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় যে দশ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে, তার পেছনেও এদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু এদের সম্পর্কে আমার কিছু অভিযোগও আছে। আমার ধারণা, বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পোশাক মালিক গোষ্ঠীর একটি অংশ অতিমাত্রায় বিলাসবহুল জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তারা কথিত অভিজাত এলাকার প্রাসাদোপম অট্টালিকায় বসবাস করেন, যেসব যানবাহনে চড়েন, তার কোনোটিরই মূল্য কোটি টাকার নিচে নয়। শুনতে পাই, বিদেশের বড় বড় শহরে তাদের একাধিক বাড়িঘর রয়েছে এবং বিদেশি ব্যাংকে তাদের সঞ্চিত অর্থের পরিমাণ শুনলে আমাদের মাথা ঘুরে যাবে। মালিকদের এই আয়েশি জীবনধারা সম্পর্কে পোশাকশিল্প শ্রমিকরাও মোটামুটি অবহিত। এ অবস্থায় শ্রমিকদের মনে এক ধরনের বঞ্চনাজনিত ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হওয়াই স্বাভাবিক। সম্ভবত সেই ক্ষোভকেই স্বার্থান্বেষী মহল মুন্সিয়ানার সঙ্গে ব্যবহার করে আমাদের অর্থনীতির জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প খাতকে অস্থিতিশীল করে তুলছে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষের অভদ্র আচরণ ক্রমেই সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। আগেই উল্লেখ করেছি, সাধারণ এবং ডিভিশনপ্রাপ্ত আসামিদের দৈনিক খোরাকি যথাক্রমে ৪০ এবং ৮৬ টাকা। বড় কর্তাদের পকেটে খোরাকির একটি অংশ যাওয়ার পর অবশিষ্ট টাকায় সাধারণ কয়েদিদের জীবনধারণ কষ্টকর। তুলনামূলকভাবে সচ্ছল সাধারণ বন্দিরা পিসি থেকে খানিকটা উন্নত মানের খাদ্যদ্রব্য কেনাকাটা করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। পিসি থেকে প্রতিদিন মাছ অথবা মাংস ছাড়াও সপ্তাহে একদিন তেহারি সরবরাহ করা হয়। এক পিস মাছ ৬০ টাকা এবং মাংস ৭০ টাকা করে বিক্রি হয়। তেহারি এ পর্যন্ত না খাওয়ায় দাম জানা নেই। যা-ই হোক, টাকা দিলে যে কোনো বন্দি এগুলো কিনতে পারে। জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং আবদুল কাদের মোল্লাকে কর্তৃপক্ষ ডিভিশন না দেয়ায় দু’জনকেই সঙ্গত কারণে পিসি থেকে আমাদের তুলনায় বেশি পরিমাণে জিনিসপত্র কিনতে হয়। হঠাত্ একদিন শুনলাম, পিসি থেকে তাদের মাছ-মাংস কেনা প্রসঙ্গে সরকারপন্থী একটি পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, জেলবন্দি জামায়াত-বিএনপি নেতাদের নাকি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজার হালে রাখা হয়েছে। যারা এই আজগুবি খবর ছাপিয়েছেন, তাদের ক’টা দিন আমাদের মতো রাজার হালে রাখতে পারলে মন্দ হতো না!
বাস্তবতা যা-ই হোক, জেলের ভেতর সংবাদের প্রতিক্রিয়া হলো গুরুতর। কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিল, জামায়াত নেতারা এবং ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিরা পিসি থেকে ভালো খাবার-দাবার আর কিনতে পারবেন না। কর্তৃপক্ষের এই নতুন সিদ্ধান্তের কথা আমার জানা ছিল না। সাত নম্বর সেলের সব সেবক মিলে আমার কাছে শুক্রবার তেহারি খাওয়ার আবদার ধরলে সেবক সালাহউদ্দিনকে পিসিতে তেহারি আনতে পাঠালাম। সালাহউদ্দিন খালি হাতে ফিরে এসে জানালো, নতুন নিয়ম অনুযায়ী আমার কাছে তেহারি বিক্রি করা নিষিদ্ধ। অতিকষ্টে এই অপমান সহ্য করলাম। একদিন পর আরেক নাটক। প্রতিদিন দুপুরে আমার জন্য ডিভিশন চৌকা (রান্নাঘর) থেকে একটা অতিরিক্ত ডিমভাজি পাঠানো হয়। এই ডিমভাজির আবার একটা পূর্ব-ইতিহাস রয়েছে। জেলখানার রান্না মাছে অধিকাংশ দিনেই আঁশটে গন্ধ থাকায় আমি খেতে পারি না। মেনুতে মাছ থাকলেই শুধু ডাল এবং সবজি দিয়ে ভাত খেতে দেখে ফয়সালই প্রথম আমাকে ডিভিশন চৌকা (রান্নাঘর) থেকে ডিম ভাজি করে আনার পরামর্শ দেয়। আমিও ভাবলাম উত্তম পরামর্শ, শরীরে প্রোটিনের অভাব খানিকটা পূরণ হবে। সেই থেকে দুপুরের বরাদ্দ মাছ সেবককে দিয়ে আমি ডাল, সবজি আর ডিমভাজি দিয়েই খাওয়া সারি। প্রতি সপ্তাহের বরাদ্দ হিসেবে সাতটি অতিরিক্ত ডিম সপ্তাহের শুরুতে পিসি থেকে কিনে ডিভিশনের মেটের কাছে পাঠিয়ে দিই। আজও যথারীতি ডিম কেনার জন্য সালাহউদ্দিনকে পাঠিয়েছি। সে শুকনো মুখে ফিরে এসে জানালো, আমার কাছে এখন থেকে জেল কর্তৃপক্ষ আর কাঁচা ডিম বিক্রি করবে না। আমি ইচ্ছে করলে প্রতিদিন একটা করে সিদ্ধ ডিম কিনতে পারি। সমস্যা হলো, সিদ্ধ ডিম তো আর ভাজি করা যায় না। ডিমভাজি না খেলে আমার যে একেবারেই চলবে না, তা নয়। কিন্তু উপর্যুপরি দ্বিতীয় দিনের অপমান আর সহ্য হলো না। জেল সুবেদার রুস্তমকে ডেকে পাঠিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, জেলকোডের কোন আইন বলে পিসি থেকে কেবল আমাদের পাঁচ-ছয়জন বন্দির ক্ষেত্রে পছন্দসই জিনিসপত্র কেনার সুযোগ রহিত করা হয়েছে? সব বন্দির জন্য এক আইন চলবে আর আমাদের জন্য ভিন্ন আইন সরকারের কোন নথিপত্রে লেখা আছে? সুবেদার বিব্রত হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি তাকে জেলারকে ডেকে আনতে বললাম এবং সঙ্গে করে পিসির নতুন নিয়মের বিষয়ে ওপরের লিখিত নির্দেশনামাও নিয়ে আসতে বললাম। ঘণ্টাখানেক পর রুস্তম ফিরে এসে জানালো, ভুল বোঝাবুঝির কারণেই ডিম নিয়ে এ সমস্যা বেধেছে। আমার ক্ষেত্রে অন্তত কোনো বাধানিষেধ নেই। বুঝলাম, অদৃশ্য ওপরআলা এই মুহূর্তে সামান্য ডিম নিয়ে সরাসরি বিবাদে জড়াতে চাচ্ছে না। তবে এই যুদ্ধবিরতি যে নিতান্তই সাময়িক, তাও বুঝলাম। আর এক সপ্তাহের মধ্যে সুপ্রিমকোর্টে আদালত অবমাননা মামলার বিচার শুরু হচ্ছে। কৌশলগত কারণে সেখানেই সরকার এখন বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। সেই মামলার নিষ্পত্তির ওপরই আমার বিষয়ে সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ভর করছে।
আগস্টের ৭ তারিখ প্রাতে সূর্য ওঠা বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনগণের জন্যে না হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্যে অত্যন্ত সফল প্রমাণিত হলো। ওইদিন ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি পাঁচ ঘণ্টার এক ঝটিকা সফরে ঢাকা বেড়িয়ে গেলেন। তিনি ঢাকা এসেছিলেন দৃশ্যত বাংলাদেশ এবং ভারতের এক্সিম ব্যাংকের মধ্যে ১ বিলিয়ন ডলার ঋণচুক্তি সম্পাদন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে সেই অনুষ্ঠানের শোভা বাড়াতে। এছাড়া অন্তরালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কোনো আলাপ-আলোচনা হয়ে থাকলে তার হদিস সাধারণ জনগণের পাওয়ার উপায় নেই। বাংলাদেশ এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে ট্রানজিটের নামে ভারতের করিডোরের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের ব্যয়ভার মেটাতে। ঋণের টাকা সুদসহ বাংলাদেশের জনগণকেই পরিশোধ করতে হবে। বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের অর্থনৈতিক ও সামরিক স্বার্থ সংরক্ষণের মহত্ উদ্দেশ্যে এদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাঁধে অতিরিক্ত ১ বিলিয়ন ডলার ঋণের বোঝা চাপালেন আমাদের দিনবদলের প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশকে আরও কঠিনভাবে ভারতের নিগড়ে আটকানোর কাজটি সফলভাবে সম্পন্ন করে সেদেশের অর্থমন্ত্রী বীরবেশে নিজদেশে ফিরে গেছেন। জেলে বসে ধারণা করছি, বিনিময়ে আওয়ামী লীগেরও ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী (পড়ুন ২০২১ পর্যন্ত) হওয়ার আশ্বাস মিলেছে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্নকারী এই ডিলের মাধ্যমে ভারত রাষ্ট্রীয়ভাবে লাভবান হয়েছে এবং দলগতভাবে আওয়ামী লীগ ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে দলটির ব্যবসায়ীগোষ্ঠী লাভের কড়ি গুনবেন। লোকসান যা কিছু হবে, সেটি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির এবং সেই রাষ্ট্রের ১৬ কোটি নির্বিকার জনগোষ্ঠীর। দুর্ভাগ্যের কথা হলো, মার্কিন ও ভারতপন্থী মিডিয়া এবং সুশীল(?)রা মিলিতভাবে আমাদের এমনই মগজ ধোলাই করেছে যে, দেশের এত বড় ক্ষতি সত্ত্বেও কোথাও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ভারতের করিডোরকে জায়েজ করার জন্যে কী চমত্কারভাবেই না ক্ষমতাসীন মহল থেকে ভুটান এবং নেপালের সঙ্গে বাণিজ্যের স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে। আওয়ামী এবং সুশীল (?) বুদ্ধিজীবীরা এদেশের জনগণকে মূর্খ ভাবতে খুব পছন্দ করেন। নইলে এমনভাবে ভুটান, নেপালের ধাপ্পা তাদের দিতে পারতেন না। আমাদের এই দুই প্রতিবেশীর মোট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিমাণ যথাক্রমে ১.০ এবং ৬.০ বিলিয়ন ডলার। এই বাণিজ্যের শতকরা সত্তর ভাগের ওপর আবার ভারতের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, যেটা স্থলবন্দরের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে। ভুটান এবং নেপাল যদি তাদের অবশিষ্ট ৩০ ভাগ পণ্যের পুরোটাই বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে আমদানি-রফতানি করে, তাহলে তার পরিমাণ দাঁড়াবে মাত্র ২.০ বিলিয়ন ডলার। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মোট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। সুতরাং বাস্তবতা হলো, ভুটান এবং নেপাল তাদের ২ বিলিয়ন ডলার পণ্য পরিবহনের জন্য চট্টগ্রাম অথবা চালনা বন্দর ব্যবহার করলে আমরা যে সামান্য ফি আয় করবো, তা দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তেমন কোনো লাভক্ষতি হবে না। মূলত ভারতকে করিডোর দেয়ার বিষয়টি হালাল করার জন্যেই নেপাল, ভুটানের মুলা বাংলাদেশের জনগণের নাকের সামনে ঝোলানো হয়েছে।
কাকতালীয়ভাবে প্রণব মুখার্জির বাংলাদেশ সফরের দিনেই মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট তাদের এক বার্ষিক প্রতিবেদনে মহাজোট সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেছে। প্রশংসার বিষয়বস্তু অবশ্য সেই অতিপরিচিত ইসলামী জঙ্গি ইস্যু। মার্কিনিরা বলছে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ইসলামী জঙ্গি এবং ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কঠোরহস্তে দমন করে প্রশংসনীয় কাজ করেছে এবং এ কারণে মার্কিন সমর্থন অব্যাহত থাকবে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের বাংলাদেশ সম্পর্কিত প্রতিবেদনে ভারতের আসাম রাজ্যের বিদ্রোহী গোষ্ঠী উলফার উল্লেখ সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের কৌশলগত মৈত্রীর বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছে। এদিকে বর্তমান সরকারের আমলে নিয়মিত বিরতিতে র্যাব ও পুলিশ তথাকথিত ইসলামী সন্ত্রাসীদের বায়বীয় সব নাশকতার পরিকল্পনা ফাঁসের যে ঢাকঢোল পেটানো নাটক মঞ্চায়ন করে চলেছে, তার সুফল পাচ্ছে মহাজোট সরকার। এসব আষাঢ়ে গল্প ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারণে যে বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখছে, তার প্রমাণ স্টেট ডিপার্টমেন্টের সর্বশেষ প্রতিবেদন। বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস সম্প্রতি যে দু-একটি মন্তব্য করছিল, তার গুরুত্বও স্টেট ডিপার্টমেন্টের এই প্রতিবেদনের ফলে যথেষ্ট হ্রাস পাবে বলেই আমার ধারণা। কয়েক মাস আগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত তার এক বক্তৃতায় উল্লেখ করেছিলেন, এখন থেকে গণতন্ত্র এবং সন্ত্রাস দমনই হবে মার্কিন-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মূল ভিত্তি। আমি অন্তত অবাক হবো না, যদি অদূর ভবিষ্যতে গণতন্ত্র পরিত্যক্ত হয়ে একমাত্র ইসলামী সন্ত্রাস দমনই মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কিত নীতিনির্ধারণে একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করতে হলে স্বাধীনতার চেতনায় অনুপ্রাণিত জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো বিকল্প খোলা থাকছে না।
মাগরিবের নামাজ শেষ হতেই জেলখানার দক্ষিণের একেবারে লাগোয়া মসজিদ থেকে পবিত্র রমজান মাস শুরুর ঘোষণা এলো। জীবনের পড়ন্ত বেলায় গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে ফ্যাসিবাদী সরকারের সব নির্যাতন, অসম্মান কেবল নৈতিক শক্তি দিয়ে মোকাবিলার চেষ্টা করেছি। আশা করছি, আল্লাহর রহমতে কারাগারের বৈরী পরিবেশে রোজা রাখাটাও ধাতে সয়ে যাবে। আজ সন্ধ্যায় বাড়ির জন্যে আবার মনটা খারাপ লাগছে। এই দীর্ঘ জীবনে পরিবারের আপনজনদের সময় দিইনি বললেই চলে। সকাল আটটার মধ্যে কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশে ঘর ছেড়ে ফিরে এসেছি রাত দশটা পার করে। শুক্রবারেও নিয়মিত অফিসে গেছি। একমাত্র প্রতি রমজানে মা এবং স্ত্রীর সঙ্গে নিয়মিত ইফতার করার চেষ্টা করেছি। সরকারি দায়িত্ব পালনের পাঁচ বছর এদেশের ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রায় প্রতিদিন ইফতারের দাওয়াত পেলেও সচরাচর সেসব দাওয়াত এড়িয়ে চলেছি। নিজগৃহে আপনজনদের নিয়ে ইফতার টেবিলে আজানের জন্যে অপেক্ষা আমার কাছে পরম তৃপ্তির একটা ব্যাপার ছিল। বাজার করার অভ্যাস কোনোকালেই ছিল না। বিয়ের আগে মা এবং পরে স্ত্রী বিনা প্রতিবাদে এই দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। অথচ রোজার মাসে প্রতি সন্ধ্যায় ইফতার কিনতে বড় ভালো লাগত। জীবনের ওই সোনালি মুহূর্তগুলোর স্মৃতি আজকের চাঁদরাতে অসহনীয় বোধ হচ্ছে। ফেলে আসা জীবনের সুঃখ-দুঃখের স্মৃতি মানুষকে সমভাবে কাঁদায়। এত বছর রোজা রেখেছি সেহরিতে তেমন কিছু না খেয়েই। জেলে আর সেই সাহস করলাম না। এমনিতেই শরীরের ওজন বেশ দ্রুতগতিতে কমছে। সেহরিবিহীন রোজার পরিণতিতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে সরকারের শীর্ষ মহলের আনন্দ আর বৃদ্ধি করতে চাচ্ছি না। শেষরাতে সময়মত ঘুম ভাঙবে কি-না সে নিয়ে একটা সংশয় ছিল। কিন্তু রোজার প্রথম রাতেই বুঝলাম এই দুশ্চিন্তা অর্থহীন। রাত একটায় সাত নম্বর সেলে সেহরি আসা শুরু হলো। খাবার সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত কয়েদিদের উচ্চকণ্ঠে ভাত ভাত চিত্কারে ঘুমায় সাধ্য কার! তারপর একে একে ডাল ও সবজির হাঁকও শুনলাম। বন্দিরা গারদের দুই শিকের ফাঁক গলিয়ে প্লাস্টিকের বাক্স পাঠাচ্ছে আর খাদ্য সরবরাহকারীরা বাক্সগুলো ভরে একই পথে সেলের ভেতরে চালান করে দিচ্ছে। সাধারণ কয়েদিদের বেলায় সেহরি নেয়ার জন্য সেলের দরজা খোলার বিধান না থাকলেও আমার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ তার ব্যতিক্রম করলো। রাত দুটোয় জমাদার, কারারক্ষী এবং মেট আলমগীর ডিভিশন চৌকা থেকে হটপটে আমার সেহরি নিয়ে এলে সেলের দরজা খুলেই সেই টিফিন ক্যারিয়ার ঢোকানো হলো। আজকের মেনু ভাত, ডাল, সবজি এবং মাছ ভাজা। প্রথম সেহরিতে খাওয়ার জন্যে রাতের মেনু থেকে গরুর গোশত বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। সাত নম্বর সেলের বিবেচনায় রীতিমত রাজসিক সেহরি শেষ করে একবারে ফজরের নামাজ পড়লাম। জেলজীবনের প্রথম রোজা শুরু হলো।
আমার কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় শিল্প শ্রমিকদের সঙ্গে বিভিন্ন কারখানায় কেটেছে। এদেশের শ্রমিকদের আমি সবসময় পরিশ্রমী, সুশৃঙ্খল এবং অনুগতই দেখতে পেয়েছি। পোশাকশিল্প শ্রমিকদের যে কোনো আন্দোলনে সহিংসতার এই তীব্রতা আমাকে প্রচণ্ড বিস্মিত করে। আমার তিন দশকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সঙ্গে বিশেষ খাতের শ্রমিক শ্রেণীর এই ক্রোধকে মেলাতে পারি না। শ্রমজীবী মানুষের অসন্তোষকে উস্কে নিয়ন্ত্রণহীন করার পেছনে কোনো বিদেশি সংস্রব আছে কি-না, সেই রহস্য উদঘাটনের দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার। তবে এই বিশেষ শিল্প খাতটির মালিকদের বিষয়ে আমার কিছু বক্তব্য রয়েছে। বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশের পোশাকশিল্প মালিকরা তাদের পণ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেছেন। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় যে দশ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে, তার পেছনেও এদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু এদের সম্পর্কে আমার কিছু অভিযোগও আছে। আমার ধারণা, বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পোশাক মালিক গোষ্ঠীর একটি অংশ অতিমাত্রায় বিলাসবহুল জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তারা কথিত অভিজাত এলাকার প্রাসাদোপম অট্টালিকায় বসবাস করেন, যেসব যানবাহনে চড়েন, তার কোনোটিরই মূল্য কোটি টাকার নিচে নয়। শুনতে পাই, বিদেশের বড় বড় শহরে তাদের একাধিক বাড়িঘর রয়েছে এবং বিদেশি ব্যাংকে তাদের সঞ্চিত অর্থের পরিমাণ শুনলে আমাদের মাথা ঘুরে যাবে। মালিকদের এই আয়েশি জীবনধারা সম্পর্কে পোশাকশিল্প শ্রমিকরাও মোটামুটি অবহিত। এ অবস্থায় শ্রমিকদের মনে এক ধরনের বঞ্চনাজনিত ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হওয়াই স্বাভাবিক। সম্ভবত সেই ক্ষোভকেই স্বার্থান্বেষী মহল মুন্সিয়ানার সঙ্গে ব্যবহার করে আমাদের অর্থনীতির জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প খাতকে অস্থিতিশীল করে তুলছে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষের অভদ্র আচরণ ক্রমেই সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। আগেই উল্লেখ করেছি, সাধারণ এবং ডিভিশনপ্রাপ্ত আসামিদের দৈনিক খোরাকি যথাক্রমে ৪০ এবং ৮৬ টাকা। বড় কর্তাদের পকেটে খোরাকির একটি অংশ যাওয়ার পর অবশিষ্ট টাকায় সাধারণ কয়েদিদের জীবনধারণ কষ্টকর। তুলনামূলকভাবে সচ্ছল সাধারণ বন্দিরা পিসি থেকে খানিকটা উন্নত মানের খাদ্যদ্রব্য কেনাকাটা করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। পিসি থেকে প্রতিদিন মাছ অথবা মাংস ছাড়াও সপ্তাহে একদিন তেহারি সরবরাহ করা হয়। এক পিস মাছ ৬০ টাকা এবং মাংস ৭০ টাকা করে বিক্রি হয়। তেহারি এ পর্যন্ত না খাওয়ায় দাম জানা নেই। যা-ই হোক, টাকা দিলে যে কোনো বন্দি এগুলো কিনতে পারে। জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং আবদুল কাদের মোল্লাকে কর্তৃপক্ষ ডিভিশন না দেয়ায় দু’জনকেই সঙ্গত কারণে পিসি থেকে আমাদের তুলনায় বেশি পরিমাণে জিনিসপত্র কিনতে হয়। হঠাত্ একদিন শুনলাম, পিসি থেকে তাদের মাছ-মাংস কেনা প্রসঙ্গে সরকারপন্থী একটি পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, জেলবন্দি জামায়াত-বিএনপি নেতাদের নাকি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজার হালে রাখা হয়েছে। যারা এই আজগুবি খবর ছাপিয়েছেন, তাদের ক’টা দিন আমাদের মতো রাজার হালে রাখতে পারলে মন্দ হতো না!
বাস্তবতা যা-ই হোক, জেলের ভেতর সংবাদের প্রতিক্রিয়া হলো গুরুতর। কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিল, জামায়াত নেতারা এবং ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিরা পিসি থেকে ভালো খাবার-দাবার আর কিনতে পারবেন না। কর্তৃপক্ষের এই নতুন সিদ্ধান্তের কথা আমার জানা ছিল না। সাত নম্বর সেলের সব সেবক মিলে আমার কাছে শুক্রবার তেহারি খাওয়ার আবদার ধরলে সেবক সালাহউদ্দিনকে পিসিতে তেহারি আনতে পাঠালাম। সালাহউদ্দিন খালি হাতে ফিরে এসে জানালো, নতুন নিয়ম অনুযায়ী আমার কাছে তেহারি বিক্রি করা নিষিদ্ধ। অতিকষ্টে এই অপমান সহ্য করলাম। একদিন পর আরেক নাটক। প্রতিদিন দুপুরে আমার জন্য ডিভিশন চৌকা (রান্নাঘর) থেকে একটা অতিরিক্ত ডিমভাজি পাঠানো হয়। এই ডিমভাজির আবার একটা পূর্ব-ইতিহাস রয়েছে। জেলখানার রান্না মাছে অধিকাংশ দিনেই আঁশটে গন্ধ থাকায় আমি খেতে পারি না। মেনুতে মাছ থাকলেই শুধু ডাল এবং সবজি দিয়ে ভাত খেতে দেখে ফয়সালই প্রথম আমাকে ডিভিশন চৌকা (রান্নাঘর) থেকে ডিম ভাজি করে আনার পরামর্শ দেয়। আমিও ভাবলাম উত্তম পরামর্শ, শরীরে প্রোটিনের অভাব খানিকটা পূরণ হবে। সেই থেকে দুপুরের বরাদ্দ মাছ সেবককে দিয়ে আমি ডাল, সবজি আর ডিমভাজি দিয়েই খাওয়া সারি। প্রতি সপ্তাহের বরাদ্দ হিসেবে সাতটি অতিরিক্ত ডিম সপ্তাহের শুরুতে পিসি থেকে কিনে ডিভিশনের মেটের কাছে পাঠিয়ে দিই। আজও যথারীতি ডিম কেনার জন্য সালাহউদ্দিনকে পাঠিয়েছি। সে শুকনো মুখে ফিরে এসে জানালো, আমার কাছে এখন থেকে জেল কর্তৃপক্ষ আর কাঁচা ডিম বিক্রি করবে না। আমি ইচ্ছে করলে প্রতিদিন একটা করে সিদ্ধ ডিম কিনতে পারি। সমস্যা হলো, সিদ্ধ ডিম তো আর ভাজি করা যায় না। ডিমভাজি না খেলে আমার যে একেবারেই চলবে না, তা নয়। কিন্তু উপর্যুপরি দ্বিতীয় দিনের অপমান আর সহ্য হলো না। জেল সুবেদার রুস্তমকে ডেকে পাঠিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, জেলকোডের কোন আইন বলে পিসি থেকে কেবল আমাদের পাঁচ-ছয়জন বন্দির ক্ষেত্রে পছন্দসই জিনিসপত্র কেনার সুযোগ রহিত করা হয়েছে? সব বন্দির জন্য এক আইন চলবে আর আমাদের জন্য ভিন্ন আইন সরকারের কোন নথিপত্রে লেখা আছে? সুবেদার বিব্রত হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি তাকে জেলারকে ডেকে আনতে বললাম এবং সঙ্গে করে পিসির নতুন নিয়মের বিষয়ে ওপরের লিখিত নির্দেশনামাও নিয়ে আসতে বললাম। ঘণ্টাখানেক পর রুস্তম ফিরে এসে জানালো, ভুল বোঝাবুঝির কারণেই ডিম নিয়ে এ সমস্যা বেধেছে। আমার ক্ষেত্রে অন্তত কোনো বাধানিষেধ নেই। বুঝলাম, অদৃশ্য ওপরআলা এই মুহূর্তে সামান্য ডিম নিয়ে সরাসরি বিবাদে জড়াতে চাচ্ছে না। তবে এই যুদ্ধবিরতি যে নিতান্তই সাময়িক, তাও বুঝলাম। আর এক সপ্তাহের মধ্যে সুপ্রিমকোর্টে আদালত অবমাননা মামলার বিচার শুরু হচ্ছে। কৌশলগত কারণে সেখানেই সরকার এখন বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। সেই মামলার নিষ্পত্তির ওপরই আমার বিষয়ে সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ভর করছে।
আগস্টের ৭ তারিখ প্রাতে সূর্য ওঠা বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনগণের জন্যে না হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্যে অত্যন্ত সফল প্রমাণিত হলো। ওইদিন ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি পাঁচ ঘণ্টার এক ঝটিকা সফরে ঢাকা বেড়িয়ে গেলেন। তিনি ঢাকা এসেছিলেন দৃশ্যত বাংলাদেশ এবং ভারতের এক্সিম ব্যাংকের মধ্যে ১ বিলিয়ন ডলার ঋণচুক্তি সম্পাদন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে সেই অনুষ্ঠানের শোভা বাড়াতে। এছাড়া অন্তরালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কোনো আলাপ-আলোচনা হয়ে থাকলে তার হদিস সাধারণ জনগণের পাওয়ার উপায় নেই। বাংলাদেশ এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে ট্রানজিটের নামে ভারতের করিডোরের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের ব্যয়ভার মেটাতে। ঋণের টাকা সুদসহ বাংলাদেশের জনগণকেই পরিশোধ করতে হবে। বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের অর্থনৈতিক ও সামরিক স্বার্থ সংরক্ষণের মহত্ উদ্দেশ্যে এদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাঁধে অতিরিক্ত ১ বিলিয়ন ডলার ঋণের বোঝা চাপালেন আমাদের দিনবদলের প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশকে আরও কঠিনভাবে ভারতের নিগড়ে আটকানোর কাজটি সফলভাবে সম্পন্ন করে সেদেশের অর্থমন্ত্রী বীরবেশে নিজদেশে ফিরে গেছেন। জেলে বসে ধারণা করছি, বিনিময়ে আওয়ামী লীগেরও ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী (পড়ুন ২০২১ পর্যন্ত) হওয়ার আশ্বাস মিলেছে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্নকারী এই ডিলের মাধ্যমে ভারত রাষ্ট্রীয়ভাবে লাভবান হয়েছে এবং দলগতভাবে আওয়ামী লীগ ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে দলটির ব্যবসায়ীগোষ্ঠী লাভের কড়ি গুনবেন। লোকসান যা কিছু হবে, সেটি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির এবং সেই রাষ্ট্রের ১৬ কোটি নির্বিকার জনগোষ্ঠীর। দুর্ভাগ্যের কথা হলো, মার্কিন ও ভারতপন্থী মিডিয়া এবং সুশীল(?)রা মিলিতভাবে আমাদের এমনই মগজ ধোলাই করেছে যে, দেশের এত বড় ক্ষতি সত্ত্বেও কোথাও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ভারতের করিডোরকে জায়েজ করার জন্যে কী চমত্কারভাবেই না ক্ষমতাসীন মহল থেকে ভুটান এবং নেপালের সঙ্গে বাণিজ্যের স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে। আওয়ামী এবং সুশীল (?) বুদ্ধিজীবীরা এদেশের জনগণকে মূর্খ ভাবতে খুব পছন্দ করেন। নইলে এমনভাবে ভুটান, নেপালের ধাপ্পা তাদের দিতে পারতেন না। আমাদের এই দুই প্রতিবেশীর মোট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিমাণ যথাক্রমে ১.০ এবং ৬.০ বিলিয়ন ডলার। এই বাণিজ্যের শতকরা সত্তর ভাগের ওপর আবার ভারতের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, যেটা স্থলবন্দরের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে। ভুটান এবং নেপাল যদি তাদের অবশিষ্ট ৩০ ভাগ পণ্যের পুরোটাই বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে আমদানি-রফতানি করে, তাহলে তার পরিমাণ দাঁড়াবে মাত্র ২.০ বিলিয়ন ডলার। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মোট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। সুতরাং বাস্তবতা হলো, ভুটান এবং নেপাল তাদের ২ বিলিয়ন ডলার পণ্য পরিবহনের জন্য চট্টগ্রাম অথবা চালনা বন্দর ব্যবহার করলে আমরা যে সামান্য ফি আয় করবো, তা দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তেমন কোনো লাভক্ষতি হবে না। মূলত ভারতকে করিডোর দেয়ার বিষয়টি হালাল করার জন্যেই নেপাল, ভুটানের মুলা বাংলাদেশের জনগণের নাকের সামনে ঝোলানো হয়েছে।
কাকতালীয়ভাবে প্রণব মুখার্জির বাংলাদেশ সফরের দিনেই মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট তাদের এক বার্ষিক প্রতিবেদনে মহাজোট সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেছে। প্রশংসার বিষয়বস্তু অবশ্য সেই অতিপরিচিত ইসলামী জঙ্গি ইস্যু। মার্কিনিরা বলছে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ইসলামী জঙ্গি এবং ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কঠোরহস্তে দমন করে প্রশংসনীয় কাজ করেছে এবং এ কারণে মার্কিন সমর্থন অব্যাহত থাকবে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের বাংলাদেশ সম্পর্কিত প্রতিবেদনে ভারতের আসাম রাজ্যের বিদ্রোহী গোষ্ঠী উলফার উল্লেখ সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের কৌশলগত মৈত্রীর বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছে। এদিকে বর্তমান সরকারের আমলে নিয়মিত বিরতিতে র্যাব ও পুলিশ তথাকথিত ইসলামী সন্ত্রাসীদের বায়বীয় সব নাশকতার পরিকল্পনা ফাঁসের যে ঢাকঢোল পেটানো নাটক মঞ্চায়ন করে চলেছে, তার সুফল পাচ্ছে মহাজোট সরকার। এসব আষাঢ়ে গল্প ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারণে যে বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখছে, তার প্রমাণ স্টেট ডিপার্টমেন্টের সর্বশেষ প্রতিবেদন। বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস সম্প্রতি যে দু-একটি মন্তব্য করছিল, তার গুরুত্বও স্টেট ডিপার্টমেন্টের এই প্রতিবেদনের ফলে যথেষ্ট হ্রাস পাবে বলেই আমার ধারণা। কয়েক মাস আগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত তার এক বক্তৃতায় উল্লেখ করেছিলেন, এখন থেকে গণতন্ত্র এবং সন্ত্রাস দমনই হবে মার্কিন-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মূল ভিত্তি। আমি অন্তত অবাক হবো না, যদি অদূর ভবিষ্যতে গণতন্ত্র পরিত্যক্ত হয়ে একমাত্র ইসলামী সন্ত্রাস দমনই মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কিত নীতিনির্ধারণে একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করতে হলে স্বাধীনতার চেতনায় অনুপ্রাণিত জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো বিকল্প খোলা থাকছে না।
মাগরিবের নামাজ শেষ হতেই জেলখানার দক্ষিণের একেবারে লাগোয়া মসজিদ থেকে পবিত্র রমজান মাস শুরুর ঘোষণা এলো। জীবনের পড়ন্ত বেলায় গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে ফ্যাসিবাদী সরকারের সব নির্যাতন, অসম্মান কেবল নৈতিক শক্তি দিয়ে মোকাবিলার চেষ্টা করেছি। আশা করছি, আল্লাহর রহমতে কারাগারের বৈরী পরিবেশে রোজা রাখাটাও ধাতে সয়ে যাবে। আজ সন্ধ্যায় বাড়ির জন্যে আবার মনটা খারাপ লাগছে। এই দীর্ঘ জীবনে পরিবারের আপনজনদের সময় দিইনি বললেই চলে। সকাল আটটার মধ্যে কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশে ঘর ছেড়ে ফিরে এসেছি রাত দশটা পার করে। শুক্রবারেও নিয়মিত অফিসে গেছি। একমাত্র প্রতি রমজানে মা এবং স্ত্রীর সঙ্গে নিয়মিত ইফতার করার চেষ্টা করেছি। সরকারি দায়িত্ব পালনের পাঁচ বছর এদেশের ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রায় প্রতিদিন ইফতারের দাওয়াত পেলেও সচরাচর সেসব দাওয়াত এড়িয়ে চলেছি। নিজগৃহে আপনজনদের নিয়ে ইফতার টেবিলে আজানের জন্যে অপেক্ষা আমার কাছে পরম তৃপ্তির একটা ব্যাপার ছিল। বাজার করার অভ্যাস কোনোকালেই ছিল না। বিয়ের আগে মা এবং পরে স্ত্রী বিনা প্রতিবাদে এই দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। অথচ রোজার মাসে প্রতি সন্ধ্যায় ইফতার কিনতে বড় ভালো লাগত। জীবনের ওই সোনালি মুহূর্তগুলোর স্মৃতি আজকের চাঁদরাতে অসহনীয় বোধ হচ্ছে। ফেলে আসা জীবনের সুঃখ-দুঃখের স্মৃতি মানুষকে সমভাবে কাঁদায়। এত বছর রোজা রেখেছি সেহরিতে তেমন কিছু না খেয়েই। জেলে আর সেই সাহস করলাম না। এমনিতেই শরীরের ওজন বেশ দ্রুতগতিতে কমছে। সেহরিবিহীন রোজার পরিণতিতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে সরকারের শীর্ষ মহলের আনন্দ আর বৃদ্ধি করতে চাচ্ছি না। শেষরাতে সময়মত ঘুম ভাঙবে কি-না সে নিয়ে একটা সংশয় ছিল। কিন্তু রোজার প্রথম রাতেই বুঝলাম এই দুশ্চিন্তা অর্থহীন। রাত একটায় সাত নম্বর সেলে সেহরি আসা শুরু হলো। খাবার সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত কয়েদিদের উচ্চকণ্ঠে ভাত ভাত চিত্কারে ঘুমায় সাধ্য কার! তারপর একে একে ডাল ও সবজির হাঁকও শুনলাম। বন্দিরা গারদের দুই শিকের ফাঁক গলিয়ে প্লাস্টিকের বাক্স পাঠাচ্ছে আর খাদ্য সরবরাহকারীরা বাক্সগুলো ভরে একই পথে সেলের ভেতরে চালান করে দিচ্ছে। সাধারণ কয়েদিদের বেলায় সেহরি নেয়ার জন্য সেলের দরজা খোলার বিধান না থাকলেও আমার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ তার ব্যতিক্রম করলো। রাত দুটোয় জমাদার, কারারক্ষী এবং মেট আলমগীর ডিভিশন চৌকা থেকে হটপটে আমার সেহরি নিয়ে এলে সেলের দরজা খুলেই সেই টিফিন ক্যারিয়ার ঢোকানো হলো। আজকের মেনু ভাত, ডাল, সবজি এবং মাছ ভাজা। প্রথম সেহরিতে খাওয়ার জন্যে রাতের মেনু থেকে গরুর গোশত বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। সাত নম্বর সেলের বিবেচনায় রীতিমত রাজসিক সেহরি শেষ করে একবারে ফজরের নামাজ পড়লাম। জেলজীবনের প্রথম রোজা শুরু হলো।
No comments