১৫- পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘জিরো টলারেন্স’ এখন তামাশা : সার্বভৌমত্ব আগেই গেছে, ভৌগোলিক স্বাধীনতাও যায়যায়
রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সর্বগ্রাসী রূপ
এই আমলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস যে সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে সেটা নিয়েই আমার যত দুর্ভাবনা। সরকারের শর্টকাট পদ্ধতি হচ্ছে ক্রসফায়ারে পরপারে পাঠিয়ে দেয়া। অন্যান্য অপরাধ তো বটেই লোমহর্ষক খুনের ঘটনাও আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘জিরো টলারেন্স’ এখন তামাশা। জেলে বন্দি অবস্থায় ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত পরাজয়ের স্বপ্ন দেখে দিন কাটাই...
এই আমলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস যে সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে সেটা নিয়েই আমার যত দুর্ভাবনা। সরকারের শর্টকাট পদ্ধতি হচ্ছে ক্রসফায়ারে পরপারে পাঠিয়ে দেয়া। অন্যান্য অপরাধ তো বটেই লোমহর্ষক খুনের ঘটনাও আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘জিরো টলারেন্স’ এখন তামাশা। জেলে বন্দি অবস্থায় ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত পরাজয়ের স্বপ্ন দেখে দিন কাটাই...
রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস প্রসঙ্গে শেষ আলোচনা বাংলাদেশে বিচার বিভাগ এবং আইনের শাসনের বর্তমান অবস্থা নিয়ে। দলীয়করণের মাধ্যমে বিচার বিভাগকে কুক্ষিগত করার দুর্ভাগ্যজনক প্রক্রিয়া শেখ হাসিনা শুরু করেছিলেন প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ে। প্রতিক্রিয়া হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার পরবর্তী সরকারও হাইকোর্টের বিচারপতি নির্বাচনে পুরোপুরি নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়নি। অথচ এই বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সরকার পরিচালনাকালে বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে কতখানি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, তার প্রমাণ ব্যারিস্টার আমিনুল হককে সে সময় অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগ প্রদান। সার্জেন্ট জহুরুল হকের ছোট ভাই ব্যারিস্টার আমিনুল হক যে আওয়ামী লীগের রাজনীতির প্রতি দুর্বল ছিলেন, এটি সর্বজনবিদিত।
চারদলীয় জোট সরকার সর্বাপেক্ষা বিতর্কিত হয়েছিল উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়সসীমা দুই বছর বৃদ্ধি করে। সে সময় সংবাদপত্র সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত, স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ লাভ করার কারণে সরকারের এই বয়সবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সংবাদমাধ্যমে তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছিল। বহুল আলোচিত মাজদার হোসেন মামলার রায় বাস্তবায়নের দাবিও একই সময় জোরালো হয়ে ওঠে। চারদলীয় জোট সরকারের বিদায়ের পর জরুরি আইনের সাংবিধানিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ আধা-সামরিক সরকার অবশেষে কাগজে-কলমে মাজদার হোসেন মামলার রায় বাস্তবায়ন করে। বিচার বিভাগের তথাকথিত স্বাধীনতা লাভে জেনারেল মইন এবং ড. ফখরুদ্দীনকে সমর্থনকারী বাংলাদেশের সুশীল (?) সমাজ আহ্লাদে আটখানা হয়ে পড়ে। তাদের মুখপত্রগুলোতে প্রশংসার বানডাকা সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, কলাম লেখার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। বিদেশি শক্তির ইশারা-ইঙ্গিতে পরিচালিত সেই সরকারের বিচার বিভাগকে কথিত স্বাধীনতা প্রদানের পুরো বিষয়টি যে একটি বিশাল ধাপ্পা ছাড়া অন্য কিছু ছিল না, তা কালক্রমে প্রমাণিত হয়েছে। দেশবাসীর স্মরণে থাকার কথা, সেই সময় একদিকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ডঙ্কা পেটানো হচ্ছিল, আবার অন্যদিকে সংসদ ভবনে ক্যাঙ্গারু আদালত বসিয়ে আজকের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রীসহ অন্যান্য রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীদের বিচারের নামে প্রহসন চলছিল। বিশেষ সংস্থার ব্যক্তিরা আদালতে বসে প্রকাশ্যে ক্যাঙ্গারু কোর্টের বিচারকদের কেবল নিয়ন্ত্রণই করত না, বৈরী সাক্ষীদের সংসদ ভবনের গোপন কক্ষে ধরে নিয়ে নির্যাতন করারও ব্যবস্থা ছিল। সন্ধ্যাবেলায় থানায় মামলা দায়ের করে রাত পোহানোর আগেই গ্রেফতার করার প্রক্রিয়াও বর্তমান সরকারকে শিখিয়ে গেছে মহাজোটের আন্দোলনের ফসল এক-এগারো সরকার। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াও একই প্রক্রিয়ায় গ্রেফতার হয়েছিলেন। রিমান্ডে থাকা অবস্থায় পুলিশ সদস্যদের কাছ থেকে তাদের গ্রেফতার সম্পর্কে অনেক ঘটনাই শুনেছি। হাইকোর্ট প্রদত্ত জামিনের রায় চেম্বার জজ আদালতে গণহারে স্টে করার পদ্ধতিও ব্যবহৃত হতে শুরু করে তখন থেকেই।
বর্তমান সরকার ক্যাঙ্গারু কোর্ট না বসালেও জেনারেল মইনের বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করার কৌশলগুলোকে আরও পরিশীলিত করে প্রয়োগ করছে। উচ্চ আদালতে বিগত দেড় বছরে যে ডজন তিনেক বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তাদের অতীত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও দলীয় পরিচয় নিয়ে খানিকটা ঘাঁটাঘাঁটি করলেই প্রমাণ হয়ে যাবে আদালত নিয়ে খেলায় আওয়ামী লীগের কাছে বিএনপি দুগ্ধপোষ্য শিশুমাত্র। চেম্বার জজ আদালতে বেশুমার স্টে নিয়ে আমার দেশ পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় আমার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের হয়েছে। সেই মামলার শুনানি রয়েছে আগস্ট মাসে। কাজেই আজ আর বিচারাধীন বিষয় নিয়ে কিছু লিখতে চাচ্ছি না। নিম্ন আদালতের কাজ-কারবার নিয়েও কোনো মন্তব্য করার পরিবর্তে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করছি মাত্র। আশা করি, বুদ্ধিমান পাঠক যার যার মতো করে অবস্থার ভয়াবহতা বুঝে নিতে পারবেন।
১. প্রধানমন্ত্রীপুত্র এবং জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সংবলিত একটি সংবাদ আমার দেশ পত্রিকায় ছাপা হয় ২০০৯ সালের ডিসেম্বরের ১৭ তারিখে। সেদিন থেকে আমার গ্রেফতার পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ মাসে আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন জেলায় ২৬টি মানহানি মামলা দায়ের হয়েছে। সর্বশেষ মামলাটি করেছেন জ্বালানি উপদেষ্টা নিজে। বাকি পঁচিশটি মামলার বাদী আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। এই পঁচিশটি মামলার মধ্যে একমাত্র কক্সবাজার জেলার একজন অসীম সাহসী ম্যাজিস্ট্রেট দায়েরকৃত মামলাটি খারিজ করেন এই যুক্তিতে যে, মামলার বাদী কোনোভাবেই সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি নন। মানহানি মামলায় কেবল সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি মামলা দায়ের করতে পারেন। অন্য কারও পক্ষে মানহানি মামলা দায়েরের সুযোগ নেই। বাকি পঁচিশটি মামলা কিন্তু অন্যান্য জেলার ম্যাজিস্ট্রেটরা আমলে নিয়েছেন। মাগুরার ম্যাজিস্ট্রেট তো আমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা পর্যন্ত জারি করেছিলেন। আমার বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দায়ের এবং আমলে নেয়াকালীন বিচারব্যবস্থার ঠিক উল্টো চিত্র পরিলক্ষিত হয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র তারেক রহমানের ক্ষেত্রে। আওয়ামী লীগের নেতারা বিরোধী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে কটূক্তি করতে সিদ্ধহস্ত। দেশের বিবেকবান নাগরিক মাত্রই স্বীকার করবেন যে, সেই কটূক্তি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শালীনতার সীমা অতিক্রম করে যায়। তারেক রহমান সম্পর্কে এ ধরনের কটূক্তির প্রতিবাদে বিএনপি’র জেলা পর্যায়ের নেতাদের দায়ের করা প্রতিটি মানহানি মামলা সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে খারিজ করা হয়েছে। আদালতের যুক্তি হচ্ছে, বাদীরা কেউ সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি নন। সুতরাং, মামলা আমলে নেয়ার ক্ষেত্রে বাদীর রাজনৈতিক পরিচয় বর্তমান সরকারের আমলে আদালতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
২. আমি গ্রেফতার হওয়ার মাসখানেক পর জামায়াতে ইসলামী দলের আমির মতিউর রহমান নিজামী এবং মহাসচিব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ বাংলাদেশের ইসলাম ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। তাদের দলীয় সভায় এক নেতার প্রদত্ত বক্তব্যকে কেন্দ্র করে মামলাটির উত্পত্তি হয়েছে। ওই সভায় একজন বক্তা (সম্ভবত ঢাকা মহানগরী আমির রফিকুল ইসলাম খান) মতিউর রহমান নিজামীর ওপর সরকারি হয়রানির বর্ণনাকালে ইসলাম প্রচারের সময় আমাদের মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা. আ.) যে অত্যাচার সহ্য করেছিলেন, সেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন। আর যায় কোথায়? তত্ক্ষণাত্ আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগে গেল। জেলায় জেলায় মামলা দায়ের এবং রাতারাতি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারিতে কোনো সমস্যাই হলো না। উল্লেখ্য, যে সভা নিয়ে মামলার সূত্রপাত সেখানে মতিউর রহমান নিজামী নিজে উপস্থিত ছিলেন না।
এবার উল্টোচিত্র দেখা যাক। ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশে যতগুলো সংসদ নির্বাচন হয়েছে, তার প্রতিটিতেই পরাজিত দল কারচুপির অভিযোগ তুলেছে। এ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনাকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন, এদেশে স্বয়ং আল্লাহ নেমে এলেও অভিযোগমুক্ত নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবেন না। তার এই দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্যের প্রতিবাদে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অপরাধে একাধিক মামলা দায়ের হলে একটিকেও আমলে নেয়া হয়নি। ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয় এক্ষেত্রে ধর্মীয় আঘাতের নাকি কোনো উপাদান খুঁজে পাননি। উপাদান নেই, তাই সঙ্গত কারণেই মামলা খারিজ হয়ে গেছে। হজরত মোহাম্মদ (সা. আ.)-এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলে সর্বশক্তিমান আল্লাহ কোনো কিছু করতে পারবেন না—এমন মূর্খের মতো মন্তব্যে কেন সেই আঘাত আরও বেশি করে লাগবে না, এর উত্তর আমার জানা নেই। পাঠক ভেবে দেখতে পারেন।
৩. আমার বিরুদ্ধে ৪৯টি মামলার মধ্যে দু’টি দায়ের করা হয়েছে পুলিশের কর্তব্যকাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে। তার মধ্যে কোতোয়ালি থানার দায়েরকৃত মামলার ঘটনার সময় আমি পুলিশ হেফাজতে বন্দি অবস্থায় শত শত পুলিশ দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলাম। সেই মামলা আমলে নিয়ে গ্রেফতার দেখিয়ে আমাকে রিমান্ডেও পাঠিয়েছিলেন বিজ্ঞ ও স্বাধীন ম্যাজিস্ট্রেট।
৪. আমাকে সরকার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের যে সাত নম্বর সেলে রেখেছে, সেখানে সন্ত্রাসের দায়ে অভিযুক্ত অন্তত ডজনখানেক সাধারণ আসামিও আটক রয়েছে। এদের মধ্যে বিভিন্ন অভিযোগে একাধিকবার জেলে এসেছে, এমন বন্দিও আছে। সময় পেলেই তাদের বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প শুনি। ওদের কাছ থেকেই জানলাম, বাংলাদেশে চুক্তিভিত্তিতে জামিনের ব্যবস্থা এখন কেবল নিম্ন আদালতেই হচ্ছে না, উচ্চ আদালতেও নাকি একই সিস্টেম সংক্রমিত হয়েছে। ব্যক্তি ও আদালত ভেদে চুক্তির অঙ্ক এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে ওঠানামা করে। সেই টাকা কাদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়, সে সম্পর্কে মুখ খোলা বিপজ্জনক। এমনিতেই এক আদালত অবমাননা মামলা নিয়ে সাংঘাতিক পেরেশানিতে আছি।
বাংলাদেশের বিদ্যমান বিচারব্যবস্থা নিয়ে লেখার সময় সংবিধানের ১০৯ নম্বর ধারার কথা মনে পড়ে গেল। সেখানে বলা হয়েছে, ‘হাইকোর্ট বিভাগের অধস্তন সকল (আদালত ও ট্রাইব্যুনালের) উপরি উক্ত বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা থাকিবে।’ এই ধারার অর্থ সাদামাটাভাবে যা বুঝি, তা হলো নিম্ন আদালতের কর্মকাণ্ডের ওপর উচ্চ আদালতের তীক্ষষ্ট দৃষ্টি থাকবে যাতে প্রশাসন বিচার বিভাগকে কোনোভাবে প্রভাবিত করতে না পারে এবং বিচার প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির বিস্তার না ঘটে। সমস্যা হলো সরষে তো ভূত তাড়াবে, কিন্তু সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে তাকে তাড়াবে কে? ক্রসফায়ারের পক্ষে প্রশাসনের একটা যুক্তি সরকারে থাকতেও শুনেছি, এখনও শুনছি। পুলিশের কর্মকর্তারা অভিযোগ করে থাকেন যে, তারা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সন্ত্রাসীদের আটক করলেও তাদের সাজাবিধান করা সম্ভব হয় না। তিন কারণে সচরাচর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সন্ত্রাস দমনের সত্ প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। প্রথমটির কথা অর্থাত্ চুক্তির বিনিময়ে জামিনের বিষয়টি আগেই উল্লেখ করেছি। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সমস্যা যথাক্রমে রাজনৈতিক প্রভাব এবং সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে সাধারণ নাগরিকের ভীতি। সুতরাং, শর্টকাট পদ্ধতি হচ্ছে ক্রসফায়ারে পরপারে পাঠিয়ে দেয়া। কিন্তু আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যে সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা গ্রহণের পরিবর্তে ক্রসফায়ার সংস্কৃতি যে সমস্যার সমাধান নয়, তার সর্বোত্কৃষ্ট প্রমাণ হচ্ছে এত হত্যাকাণ্ডের পরও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি কোনোক্রমেই ঠেকানো যাচ্ছে না। বর্তমান সরকারের আমলে অন্যান্য অপরাধ তো বটেই, এমনকি লোমহর্ষক খুনের সংখ্যাও আগের সব রেকর্ডকে অনায়াসে অতিক্রম করেছে।রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর কাছে ভয়াবহ আতঙ্করূপে আবির্ভূত হয়েছে। আইনের শাসনের ধারাবাহিক অবক্ষয়ের যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আমাদের স্বাধীনতার পর থেকেই হতে হচ্ছিল, সেটি আরও হতাশাব্যঞ্জক রূপ নিয়েছে এক-এগারোর জরুরি শাসনকাল থেকে। এর আগপর্যন্ত সব সরকারকেই আন্তর্জাতিক মহলের কাছে এক ধরনের জবাবদিহির বিষয়টি স্মরণে রাখতে হয়েছে। উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ডলার-পাউন্ড ঋণ নেয়ার সময় এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে যে কী ধরনের বিব্রত হতে হয়, তার অভিজ্ঞতা আমার নিজেরই রয়েছে। কিন্তু ২০০৭-এর ছদ্মবেশে সামরিক অভ্যুত্থান সেই পরিস্থিতি অনেকখানি পাল্টে দিয়েছে। জাতিসংঘের বাংলাদেশ অফিস ইউএনডিপিসহ প্রায় সব পশ্চিমা দূতাবাস সেই অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার ফায়দা নিয়ে মইন-ফখরুদ্দীন জুটি তাদের শাসনামলে তাবত্ মানবাধিকারকে উপেক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীদের ধরে অজ্ঞাতবাসে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করার পদ্ধতি তারাই চালু করেছিল। একই সঙ্গে ক্রসফায়ার চলেছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। পরিবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে তাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য এদেশের জাতীয়তাবাদী শক্তি হলেও লোকদেখানো নিরপেক্ষতা প্রমাণের তাগিদে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও দলটির সমর্থক ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকেও কয়েকজন সেই সময় শাসক জান্তার হাতে অত্যাচারিত হয়েছিলেন। অনেকটা সে কারণেই এদেশের গণমানুষ এবার আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট চরিত্রের অন্তত কিছু পরিবর্তন প্রত্যাশা করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে আমি যদিও এমন কোনো ভ্রান্তিবিলাসে পতিত হইনি। নির্বাচনের আগেই সম্ভবত ২০০৮-এর নভেম্বরে আমার দেশ-এ মন্তব্য প্রতিবেদন লিখে শিরোনাম দিয়েছিলাম, ‘নবরূপে বাকশাল’। মহাজোট গঠন প্রক্রিয়া দেখে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম পার্শ্ববর্তী পরাশক্তির মদতে এদেশে আবার একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা হতে চলেছে। আমার ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণিত হলে আমি সত্যিই আনন্দিত হতাম। কিন্তু গত দেড় বছরের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে, কন্যা অত্যাচার-নির্যাতনে তার পিতাকেও ছাড়িয়ে গেছেন। আমি নির্যাতিত হয়েছি, আমার পরিবার অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে, আমার ভবিষ্যত্ অনিশ্চিত, ১৬ কোটি মানুষের ঘরবসতির রাষ্ট্রের নিরিখে সেটা এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কিন্তু এই সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস যে সর্বগ্রাসী রূপ পরিগ্রহণ করছে, সেটা নিয়েই আমার যত দুর্ভাবনা। মার্কিন-ভারত কৌশলগত মৈত্রী যদি অটুট থাকে এবং সেই মৈত্রীর মূল্য স্বরূপ বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ভূখণ্ডটিকে যদি ভারতের হাঁড়িকাঠে বলি চড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে, তাহলে সে অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? বিএনপি তার সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে সমর্থ হয়নি। ডান-বামের অন্যান্য রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনও অপ্রাসঙ্গিক বললে আশা করি, তারা রাগ করবেন না। ফ্যাসিবাদসৃষ্ট রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সফল গণআন্দোলনে নানান সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নেতৃত্ব দিতে পারেন একমাত্র বেগম খালেদা জিয়া। তবে সেই আন্দোলনের ডাক দেয়ার আগে তাকে অবশ্যই জনগণকে ভরসা দিতে হবে মানবাধিকারের প্রশ্নে তিনি আগের তুলনায় অনেক গণমুখী চিন্তা-চেতনাকে এখন ধারণ করছেন। মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ফানুস উড়িয়ে ক্ষমতায় বসে শেখ হাসিনা দেশের অধিকাংশ নাগরিককে হতাশ এবং ক্রুদ্ধ করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির ‘জিরো টলারেন্স’-এর গল্প এখন তামাশামাত্র। দেশের সার্বভৌমত্ব আগেই গেছে, ভৌগোলিক স্বাধীনতাও যায়যায় অবস্থা। সুশাসনের অভাবে মানবাধিকারের ইস্যুতে বাংলাদেশ বিশ্বে নিন্দিত হোক, এটা এদেশের নাগরিক হিসেবে চাইতে পারি না। জেলে বন্দি অবস্থাতেই দেশপ্রেমিক মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের সামনে ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত পরাজয়ের স্বপ্ন দেখে দিন কাটাই। বন্দিত্বের কারণে সেই গণজোয়ারে আমার কোনো অংশগ্রহণ সম্ভব না হলেও দুঃখ নেই। তবু সেই পরম আকাঙ্ক্ষিত জোয়ার এসে রাষ্ট্র কাঠামোতে এতদিনের পুঞ্জীভূত ক্লেদ ধুয়ে-মুছে যাক, এটুকুই প্রত্যাশা।
চারদলীয় জোট সরকার সর্বাপেক্ষা বিতর্কিত হয়েছিল উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়সসীমা দুই বছর বৃদ্ধি করে। সে সময় সংবাদপত্র সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত, স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ লাভ করার কারণে সরকারের এই বয়সবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সংবাদমাধ্যমে তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছিল। বহুল আলোচিত মাজদার হোসেন মামলার রায় বাস্তবায়নের দাবিও একই সময় জোরালো হয়ে ওঠে। চারদলীয় জোট সরকারের বিদায়ের পর জরুরি আইনের সাংবিধানিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ আধা-সামরিক সরকার অবশেষে কাগজে-কলমে মাজদার হোসেন মামলার রায় বাস্তবায়ন করে। বিচার বিভাগের তথাকথিত স্বাধীনতা লাভে জেনারেল মইন এবং ড. ফখরুদ্দীনকে সমর্থনকারী বাংলাদেশের সুশীল (?) সমাজ আহ্লাদে আটখানা হয়ে পড়ে। তাদের মুখপত্রগুলোতে প্রশংসার বানডাকা সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, কলাম লেখার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। বিদেশি শক্তির ইশারা-ইঙ্গিতে পরিচালিত সেই সরকারের বিচার বিভাগকে কথিত স্বাধীনতা প্রদানের পুরো বিষয়টি যে একটি বিশাল ধাপ্পা ছাড়া অন্য কিছু ছিল না, তা কালক্রমে প্রমাণিত হয়েছে। দেশবাসীর স্মরণে থাকার কথা, সেই সময় একদিকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ডঙ্কা পেটানো হচ্ছিল, আবার অন্যদিকে সংসদ ভবনে ক্যাঙ্গারু আদালত বসিয়ে আজকের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রীসহ অন্যান্য রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীদের বিচারের নামে প্রহসন চলছিল। বিশেষ সংস্থার ব্যক্তিরা আদালতে বসে প্রকাশ্যে ক্যাঙ্গারু কোর্টের বিচারকদের কেবল নিয়ন্ত্রণই করত না, বৈরী সাক্ষীদের সংসদ ভবনের গোপন কক্ষে ধরে নিয়ে নির্যাতন করারও ব্যবস্থা ছিল। সন্ধ্যাবেলায় থানায় মামলা দায়ের করে রাত পোহানোর আগেই গ্রেফতার করার প্রক্রিয়াও বর্তমান সরকারকে শিখিয়ে গেছে মহাজোটের আন্দোলনের ফসল এক-এগারো সরকার। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াও একই প্রক্রিয়ায় গ্রেফতার হয়েছিলেন। রিমান্ডে থাকা অবস্থায় পুলিশ সদস্যদের কাছ থেকে তাদের গ্রেফতার সম্পর্কে অনেক ঘটনাই শুনেছি। হাইকোর্ট প্রদত্ত জামিনের রায় চেম্বার জজ আদালতে গণহারে স্টে করার পদ্ধতিও ব্যবহৃত হতে শুরু করে তখন থেকেই।
বর্তমান সরকার ক্যাঙ্গারু কোর্ট না বসালেও জেনারেল মইনের বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করার কৌশলগুলোকে আরও পরিশীলিত করে প্রয়োগ করছে। উচ্চ আদালতে বিগত দেড় বছরে যে ডজন তিনেক বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তাদের অতীত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও দলীয় পরিচয় নিয়ে খানিকটা ঘাঁটাঘাঁটি করলেই প্রমাণ হয়ে যাবে আদালত নিয়ে খেলায় আওয়ামী লীগের কাছে বিএনপি দুগ্ধপোষ্য শিশুমাত্র। চেম্বার জজ আদালতে বেশুমার স্টে নিয়ে আমার দেশ পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় আমার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের হয়েছে। সেই মামলার শুনানি রয়েছে আগস্ট মাসে। কাজেই আজ আর বিচারাধীন বিষয় নিয়ে কিছু লিখতে চাচ্ছি না। নিম্ন আদালতের কাজ-কারবার নিয়েও কোনো মন্তব্য করার পরিবর্তে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করছি মাত্র। আশা করি, বুদ্ধিমান পাঠক যার যার মতো করে অবস্থার ভয়াবহতা বুঝে নিতে পারবেন।
১. প্রধানমন্ত্রীপুত্র এবং জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সংবলিত একটি সংবাদ আমার দেশ পত্রিকায় ছাপা হয় ২০০৯ সালের ডিসেম্বরের ১৭ তারিখে। সেদিন থেকে আমার গ্রেফতার পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ মাসে আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন জেলায় ২৬টি মানহানি মামলা দায়ের হয়েছে। সর্বশেষ মামলাটি করেছেন জ্বালানি উপদেষ্টা নিজে। বাকি পঁচিশটি মামলার বাদী আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। এই পঁচিশটি মামলার মধ্যে একমাত্র কক্সবাজার জেলার একজন অসীম সাহসী ম্যাজিস্ট্রেট দায়েরকৃত মামলাটি খারিজ করেন এই যুক্তিতে যে, মামলার বাদী কোনোভাবেই সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি নন। মানহানি মামলায় কেবল সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি মামলা দায়ের করতে পারেন। অন্য কারও পক্ষে মানহানি মামলা দায়েরের সুযোগ নেই। বাকি পঁচিশটি মামলা কিন্তু অন্যান্য জেলার ম্যাজিস্ট্রেটরা আমলে নিয়েছেন। মাগুরার ম্যাজিস্ট্রেট তো আমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা পর্যন্ত জারি করেছিলেন। আমার বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দায়ের এবং আমলে নেয়াকালীন বিচারব্যবস্থার ঠিক উল্টো চিত্র পরিলক্ষিত হয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র তারেক রহমানের ক্ষেত্রে। আওয়ামী লীগের নেতারা বিরোধী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে কটূক্তি করতে সিদ্ধহস্ত। দেশের বিবেকবান নাগরিক মাত্রই স্বীকার করবেন যে, সেই কটূক্তি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শালীনতার সীমা অতিক্রম করে যায়। তারেক রহমান সম্পর্কে এ ধরনের কটূক্তির প্রতিবাদে বিএনপি’র জেলা পর্যায়ের নেতাদের দায়ের করা প্রতিটি মানহানি মামলা সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে খারিজ করা হয়েছে। আদালতের যুক্তি হচ্ছে, বাদীরা কেউ সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি নন। সুতরাং, মামলা আমলে নেয়ার ক্ষেত্রে বাদীর রাজনৈতিক পরিচয় বর্তমান সরকারের আমলে আদালতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
২. আমি গ্রেফতার হওয়ার মাসখানেক পর জামায়াতে ইসলামী দলের আমির মতিউর রহমান নিজামী এবং মহাসচিব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ বাংলাদেশের ইসলাম ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। তাদের দলীয় সভায় এক নেতার প্রদত্ত বক্তব্যকে কেন্দ্র করে মামলাটির উত্পত্তি হয়েছে। ওই সভায় একজন বক্তা (সম্ভবত ঢাকা মহানগরী আমির রফিকুল ইসলাম খান) মতিউর রহমান নিজামীর ওপর সরকারি হয়রানির বর্ণনাকালে ইসলাম প্রচারের সময় আমাদের মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা. আ.) যে অত্যাচার সহ্য করেছিলেন, সেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন। আর যায় কোথায়? তত্ক্ষণাত্ আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগে গেল। জেলায় জেলায় মামলা দায়ের এবং রাতারাতি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারিতে কোনো সমস্যাই হলো না। উল্লেখ্য, যে সভা নিয়ে মামলার সূত্রপাত সেখানে মতিউর রহমান নিজামী নিজে উপস্থিত ছিলেন না।
এবার উল্টোচিত্র দেখা যাক। ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশে যতগুলো সংসদ নির্বাচন হয়েছে, তার প্রতিটিতেই পরাজিত দল কারচুপির অভিযোগ তুলেছে। এ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনাকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন, এদেশে স্বয়ং আল্লাহ নেমে এলেও অভিযোগমুক্ত নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবেন না। তার এই দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্যের প্রতিবাদে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অপরাধে একাধিক মামলা দায়ের হলে একটিকেও আমলে নেয়া হয়নি। ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয় এক্ষেত্রে ধর্মীয় আঘাতের নাকি কোনো উপাদান খুঁজে পাননি। উপাদান নেই, তাই সঙ্গত কারণেই মামলা খারিজ হয়ে গেছে। হজরত মোহাম্মদ (সা. আ.)-এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলে সর্বশক্তিমান আল্লাহ কোনো কিছু করতে পারবেন না—এমন মূর্খের মতো মন্তব্যে কেন সেই আঘাত আরও বেশি করে লাগবে না, এর উত্তর আমার জানা নেই। পাঠক ভেবে দেখতে পারেন।
৩. আমার বিরুদ্ধে ৪৯টি মামলার মধ্যে দু’টি দায়ের করা হয়েছে পুলিশের কর্তব্যকাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে। তার মধ্যে কোতোয়ালি থানার দায়েরকৃত মামলার ঘটনার সময় আমি পুলিশ হেফাজতে বন্দি অবস্থায় শত শত পুলিশ দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলাম। সেই মামলা আমলে নিয়ে গ্রেফতার দেখিয়ে আমাকে রিমান্ডেও পাঠিয়েছিলেন বিজ্ঞ ও স্বাধীন ম্যাজিস্ট্রেট।
৪. আমাকে সরকার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের যে সাত নম্বর সেলে রেখেছে, সেখানে সন্ত্রাসের দায়ে অভিযুক্ত অন্তত ডজনখানেক সাধারণ আসামিও আটক রয়েছে। এদের মধ্যে বিভিন্ন অভিযোগে একাধিকবার জেলে এসেছে, এমন বন্দিও আছে। সময় পেলেই তাদের বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প শুনি। ওদের কাছ থেকেই জানলাম, বাংলাদেশে চুক্তিভিত্তিতে জামিনের ব্যবস্থা এখন কেবল নিম্ন আদালতেই হচ্ছে না, উচ্চ আদালতেও নাকি একই সিস্টেম সংক্রমিত হয়েছে। ব্যক্তি ও আদালত ভেদে চুক্তির অঙ্ক এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে ওঠানামা করে। সেই টাকা কাদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়, সে সম্পর্কে মুখ খোলা বিপজ্জনক। এমনিতেই এক আদালত অবমাননা মামলা নিয়ে সাংঘাতিক পেরেশানিতে আছি।
বাংলাদেশের বিদ্যমান বিচারব্যবস্থা নিয়ে লেখার সময় সংবিধানের ১০৯ নম্বর ধারার কথা মনে পড়ে গেল। সেখানে বলা হয়েছে, ‘হাইকোর্ট বিভাগের অধস্তন সকল (আদালত ও ট্রাইব্যুনালের) উপরি উক্ত বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা থাকিবে।’ এই ধারার অর্থ সাদামাটাভাবে যা বুঝি, তা হলো নিম্ন আদালতের কর্মকাণ্ডের ওপর উচ্চ আদালতের তীক্ষষ্ট দৃষ্টি থাকবে যাতে প্রশাসন বিচার বিভাগকে কোনোভাবে প্রভাবিত করতে না পারে এবং বিচার প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির বিস্তার না ঘটে। সমস্যা হলো সরষে তো ভূত তাড়াবে, কিন্তু সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে তাকে তাড়াবে কে? ক্রসফায়ারের পক্ষে প্রশাসনের একটা যুক্তি সরকারে থাকতেও শুনেছি, এখনও শুনছি। পুলিশের কর্মকর্তারা অভিযোগ করে থাকেন যে, তারা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সন্ত্রাসীদের আটক করলেও তাদের সাজাবিধান করা সম্ভব হয় না। তিন কারণে সচরাচর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সন্ত্রাস দমনের সত্ প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। প্রথমটির কথা অর্থাত্ চুক্তির বিনিময়ে জামিনের বিষয়টি আগেই উল্লেখ করেছি। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সমস্যা যথাক্রমে রাজনৈতিক প্রভাব এবং সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে সাধারণ নাগরিকের ভীতি। সুতরাং, শর্টকাট পদ্ধতি হচ্ছে ক্রসফায়ারে পরপারে পাঠিয়ে দেয়া। কিন্তু আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যে সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা গ্রহণের পরিবর্তে ক্রসফায়ার সংস্কৃতি যে সমস্যার সমাধান নয়, তার সর্বোত্কৃষ্ট প্রমাণ হচ্ছে এত হত্যাকাণ্ডের পরও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি কোনোক্রমেই ঠেকানো যাচ্ছে না। বর্তমান সরকারের আমলে অন্যান্য অপরাধ তো বটেই, এমনকি লোমহর্ষক খুনের সংখ্যাও আগের সব রেকর্ডকে অনায়াসে অতিক্রম করেছে।রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর কাছে ভয়াবহ আতঙ্করূপে আবির্ভূত হয়েছে। আইনের শাসনের ধারাবাহিক অবক্ষয়ের যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আমাদের স্বাধীনতার পর থেকেই হতে হচ্ছিল, সেটি আরও হতাশাব্যঞ্জক রূপ নিয়েছে এক-এগারোর জরুরি শাসনকাল থেকে। এর আগপর্যন্ত সব সরকারকেই আন্তর্জাতিক মহলের কাছে এক ধরনের জবাবদিহির বিষয়টি স্মরণে রাখতে হয়েছে। উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ডলার-পাউন্ড ঋণ নেয়ার সময় এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে যে কী ধরনের বিব্রত হতে হয়, তার অভিজ্ঞতা আমার নিজেরই রয়েছে। কিন্তু ২০০৭-এর ছদ্মবেশে সামরিক অভ্যুত্থান সেই পরিস্থিতি অনেকখানি পাল্টে দিয়েছে। জাতিসংঘের বাংলাদেশ অফিস ইউএনডিপিসহ প্রায় সব পশ্চিমা দূতাবাস সেই অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার ফায়দা নিয়ে মইন-ফখরুদ্দীন জুটি তাদের শাসনামলে তাবত্ মানবাধিকারকে উপেক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীদের ধরে অজ্ঞাতবাসে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করার পদ্ধতি তারাই চালু করেছিল। একই সঙ্গে ক্রসফায়ার চলেছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। পরিবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে তাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য এদেশের জাতীয়তাবাদী শক্তি হলেও লোকদেখানো নিরপেক্ষতা প্রমাণের তাগিদে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও দলটির সমর্থক ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকেও কয়েকজন সেই সময় শাসক জান্তার হাতে অত্যাচারিত হয়েছিলেন। অনেকটা সে কারণেই এদেশের গণমানুষ এবার আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট চরিত্রের অন্তত কিছু পরিবর্তন প্রত্যাশা করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে আমি যদিও এমন কোনো ভ্রান্তিবিলাসে পতিত হইনি। নির্বাচনের আগেই সম্ভবত ২০০৮-এর নভেম্বরে আমার দেশ-এ মন্তব্য প্রতিবেদন লিখে শিরোনাম দিয়েছিলাম, ‘নবরূপে বাকশাল’। মহাজোট গঠন প্রক্রিয়া দেখে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম পার্শ্ববর্তী পরাশক্তির মদতে এদেশে আবার একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা হতে চলেছে। আমার ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণিত হলে আমি সত্যিই আনন্দিত হতাম। কিন্তু গত দেড় বছরের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে, কন্যা অত্যাচার-নির্যাতনে তার পিতাকেও ছাড়িয়ে গেছেন। আমি নির্যাতিত হয়েছি, আমার পরিবার অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে, আমার ভবিষ্যত্ অনিশ্চিত, ১৬ কোটি মানুষের ঘরবসতির রাষ্ট্রের নিরিখে সেটা এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কিন্তু এই সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস যে সর্বগ্রাসী রূপ পরিগ্রহণ করছে, সেটা নিয়েই আমার যত দুর্ভাবনা। মার্কিন-ভারত কৌশলগত মৈত্রী যদি অটুট থাকে এবং সেই মৈত্রীর মূল্য স্বরূপ বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ভূখণ্ডটিকে যদি ভারতের হাঁড়িকাঠে বলি চড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে, তাহলে সে অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? বিএনপি তার সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে সমর্থ হয়নি। ডান-বামের অন্যান্য রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনও অপ্রাসঙ্গিক বললে আশা করি, তারা রাগ করবেন না। ফ্যাসিবাদসৃষ্ট রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সফল গণআন্দোলনে নানান সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নেতৃত্ব দিতে পারেন একমাত্র বেগম খালেদা জিয়া। তবে সেই আন্দোলনের ডাক দেয়ার আগে তাকে অবশ্যই জনগণকে ভরসা দিতে হবে মানবাধিকারের প্রশ্নে তিনি আগের তুলনায় অনেক গণমুখী চিন্তা-চেতনাকে এখন ধারণ করছেন। মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ফানুস উড়িয়ে ক্ষমতায় বসে শেখ হাসিনা দেশের অধিকাংশ নাগরিককে হতাশ এবং ক্রুদ্ধ করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির ‘জিরো টলারেন্স’-এর গল্প এখন তামাশামাত্র। দেশের সার্বভৌমত্ব আগেই গেছে, ভৌগোলিক স্বাধীনতাও যায়যায় অবস্থা। সুশাসনের অভাবে মানবাধিকারের ইস্যুতে বাংলাদেশ বিশ্বে নিন্দিত হোক, এটা এদেশের নাগরিক হিসেবে চাইতে পারি না। জেলে বন্দি অবস্থাতেই দেশপ্রেমিক মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের সামনে ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত পরাজয়ের স্বপ্ন দেখে দিন কাটাই। বন্দিত্বের কারণে সেই গণজোয়ারে আমার কোনো অংশগ্রহণ সম্ভব না হলেও দুঃখ নেই। তবু সেই পরম আকাঙ্ক্ষিত জোয়ার এসে রাষ্ট্র কাঠামোতে এতদিনের পুঞ্জীভূত ক্লেদ ধুয়ে-মুছে যাক, এটুকুই প্রত্যাশা।
No comments