২৩- সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে এত নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বোধহয় লাদেনের জন্যও করা হতো না
আদালত অবমাননা মামলার শুনানি
আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে আমার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা মামলার শুনানি হবে সকাল ন’টায়। প্রিজন ভ্যান জেলগেট থেকে রাস্তায় পড়তেই দেখলাম, অন্তত গোটাচারেক পুলিশভর্তি গাড়ি অপেক্ষা করছে আমাকে আদালত পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার জন্য। সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে প্রবেশ করে দেখি, সেখানে জবরদস্ত বন্দোবস্ত। আদালতের মূল দরজা থেকে বিচারপতিদের প্রবেশের নির্দিষ্ট দরজা পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে দশ হাত পর পর পুলিশ অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এত নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বোধহয় ওসামা বিন লাদেনের জন্যও করা হতো না...
আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে আমার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা মামলার শুনানি হবে সকাল ন’টায়। প্রিজন ভ্যান জেলগেট থেকে রাস্তায় পড়তেই দেখলাম, অন্তত গোটাচারেক পুলিশভর্তি গাড়ি অপেক্ষা করছে আমাকে আদালত পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার জন্য। সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে প্রবেশ করে দেখি, সেখানে জবরদস্ত বন্দোবস্ত। আদালতের মূল দরজা থেকে বিচারপতিদের প্রবেশের নির্দিষ্ট দরজা পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে দশ হাত পর পর পুলিশ অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এত নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বোধহয় ওসামা বিন লাদেনের জন্যও করা হতো না...
জেলজীবনে দাড়ি কামাতে আমার বড় আলস্য বোধ হচ্ছে। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে গালে চুলকানি শুরু না হওয়া পর্যন্ত দাড়ি কাটার ঝামেলায় যেতে চাই না। অপ্রশস্ত সেলে দাড়ি কামানোটাও এক ঝকমারি। বিছানার এক কোণে আয়না দাঁড় করিয়ে রেখে মাটিতে বসে রেজর চালাতে হয়। আজ ফজরের নামাজ পড়েই অপছন্দের কাজটিতে লাগতে হলো। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে আমার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা মামলার শুনানি হবে সকাল ন’টায়। প্রধান বিচারপতির এজলাসে মামলা, একটু সেজেগুজে তো যেতেই হয়! ক্ষৌরকর্ম শেষ করে বালতি হাতে চৌবাচ্চার ধারে যখন গেছি, তখন ভোরের আলো কেবল ফুটতে শুরু করেছে। সাত নম্বর সেলে সবাই ঘুমে অচেতন, আর আমি প্রস্তুতি নিচ্ছি অন্যরকম সংগ্রামের। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার হাল নিয়ে এই লড়াইকে আমি মোটেও ব্যক্তিগত বিবেচনা করছি না। বর্তমান সরকার আদালতকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে মজলুমদের প্রতি যে অত্যাচার চালাচ্ছে, আমি তারই প্রতিবাদ করেছি। ফ্যাসিবাদের জোয়াল ১৬ কোটি জনগণের কাঁধে ক্রমেই শক্ত হয়ে চেপে বসছে, কারণ কোথাও শক্ত প্রতিবাদ নেই।
আমাদের সংবিধানে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসঙ্গতি থাকলেও সেখানে বার বার ব্যক্তিস্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার এবং মানবসত্তার মর্যাদার কথা বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার সংবিধানের সেই মহান আদর্শকে ভূলুণ্ঠিত করে একটি নির্যাতনকারী পুলিশি রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করেছে। সুশীল (?) সমাজের চেনা মুখগুলো সম্ভবত তাদের মার্কিন ও ভারতীয় নিয়োগকর্তাদের নির্দেশক্রমে রাষ্ট্রের এসব অসঙ্গতি দেখেও দেখছে না। তারা মূক ও বধিরের ভূমিকা পালন করছে। অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম সরকার তোষণের সম্পাদকীয় নীতি গ্রহণ করে নগদ লাভের হিসাব কষতে ব্যস্ত। সরকারের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান ‘স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী’ প্রবণতাকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রতিরোধ করার জন্য প্রকৃত দলনিরপেক্ষ, স্বাধীন ও পক্ষপাতশূন্য বিচার বিভাগের প্রয়োজন ছিল। দুর্ভাগ্যবশত সেখানকার অবস্থায় আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না। ইনসাফ প্রাপ্তির সব ক’টা দরজা বন্ধ হয়ে গেলে দেশ শেষ পর্যন্ত নৈরাজ্যের দিকে ধাবিত হয় কি-না, সেটি জানার জন্য আরও কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে।
বাঙালি মনস্কতার পরাকাষ্ঠার কারণে সরকারের শীর্ষ ব্যক্তি যে তাবত্ ব্যাপারে নাটকীয়তা পছন্দ করেন, সেই তথ্য আমাদের জানা। তার সেই নাটকপ্রীতি বর্তমানে প্রশাসনেও সংক্রমিত হয়েছে। সুপ্রিমকোর্টে আমাকে শুনানির জন্য হাজির করা নিয়েও জেল প্রশাসন নাটক কম করলো না। শুনেছিলাম, প্রধান বিচারপতি এজলাসে ওঠেন সকাল ন’টায়। তার আগেই বিচারপ্রার্থী, আমার মতো আসামি এবং আইনজীবীদের তার এজলাসে উপস্থিত হওয়াই রীতি। নাজিমউদ্দীন রোড থেকে সুপ্রিমকোর্ট পৌঁছাতে মিনিট পনেরো লাগে। সেল থেকে জেলগেটে যাওয়া, অতঃপর ডেপুটি জেলারের সামনে বসে প্রিজন ভ্যানে ওঠার জন্যে ডাকের অপেক্ষা ইত্যাদি প্রক্রিয়া সমাপ্ত করার প্রয়োজনীয় সময় বিবেচনা করে সকাল আটটা থেকে তৈরি হয়ে বসে থাকলাম সাড়ে ন’টা পর্যন্ত। কারা প্রশাসনের কোনো পাত্তা নেই। ভাবলাম, যে কোনো কারণেই হোক আজ আর আমাকে আদালতে নেয়া হচ্ছে না। পয়লা রোজার দিন বলে সকালে চা-নাস্তার পাট ছিল না। রাত তিনটায় শয্যাত্যাগ করার পর আর ঘুমানো হয়নি। নিদ্রার জন্য প্যান্ট-শার্ট বদলে সবে চৌকিতে গা এলিয়ে দিয়েছি, আর ডেপুটি জেলার হন্ত-দন্ত এসে হাজির। তার সঙ্গে তত্ক্ষণাত্ যেতে হবে। বিরক্ত হয়ে বিলম্বের কারণ জানতে চাইলে জবাবে আমতা আমতা করে যা বললো, তার অর্থ সে-ই ভালো জানে। জেলগেটে আরেক নতুন অভিজ্ঞতা হলো। প্রিজন ভ্যান অনেক কসরত করে প্রধান ফটকের ভেতরে ঢোকানো হয়েছে। অর্থাত্ জেলের বাইরে অপেক্ষমাণ দর্শনার্থীরা কোনোক্রমে আমাকে একনজর দেখে ফেলুক, সেটাও প্রশাসন চাচ্ছে না। এতদিন জেলগেটের প্রধান ফটক পার হয়ে বাইরে দাঁড় করানো প্রিজন ভ্যানে হেঁটে উঠতাম। পরে জেনেছি, একমাত্র শেখ মুজিব হত্যা মামলার আসামি এবং জেএমবির মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিদের এই বিশেষ তরিকায় আদালতে আনা-নেয়া করা হতো। দেয়ালের পাশ ঘেঁষে অতিকষ্টে বিশাল ভ্যানে উঠলাম। আমাকে নিয়ে প্রশাসন যে কতখানি আতঙ্কগ্রস্ত, সেটা পুরোপুরি টের পাওয়া তখনও বাকি ছিল।
প্রিজন ভ্যান জেলগেটে থেকে রাস্তায় পড়তেই দেখলাম অন্তত গোটা চারেক পুলিশভর্তি গাড়ি অপেক্ষা করছে আমাকে বহনকারী প্রিজন ভ্যান অ্যাসকর্ট করে আদালত পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার জন্যে। বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়। সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে প্রবেশ করে দেখি, সেখানে জবরদস্ত বন্দোবস্ত। আদালতের মূল দরজা থেকে বিচারপতিদের প্রবেশের নির্দিষ্ট দরজা পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে দশ হাত পর পর পুলিশ অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওসামা বিন লাদেনকে সুপ্রিমকোর্টে নেয়া হলেও বোধহয় এমন নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হতো না। দুই স্তর পুলিশ পাহারার মধ্যে প্রিজন ভ্যান থেকে নামলাম। মিডিয়াকে ফাঁকি দেয়ার জন্য সংবাদকর্মীদের সুপ্রিমকোর্ট ভবনের মূল প্রবেশপথের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে আমাকে পেছনের দরজা দিয়ে ঢোকানো হলো। আয়োজনের এই আতিশয্যে কৌতুক বোধ করে সঙ্গের পুলিশ কর্মকর্তাকে আমাকে এতটা ভয় পাওয়ার হেতু জিজ্ঞাসা করে কোনো জবাব পেলাম না। সামনে-পেছনে বিস্তৃত পুলিশ কর্ডনের মধ্য দিয়ে দোতলায় প্রধান বিচারপতির এজলাসে পৌঁছালাম। যা ভেবেছিলাম তা-ই, বিচার কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। তবে আমার মামলার নম্বর তেরো হওয়ায় উপস্থিত বন্ধু, শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে নিচু স্বরে গল্পগুজব করার কিছুটা সময় পাওয়া গেল। বাল্যবন্ধু ড. সালাহউদ্দিন (বাবলু) আদালতের মাঝখানের বিরতিতে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমার জন্মদিনে জেলে ওর কাছ থেকে কার্ড পেলেও গ্রেফতারের পর ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর সঙ্গে এই প্রথম সাক্ষাত্। পারভীনের কাছ থেকে আগেই শুনেছি, ডিবিতে রিমান্ডের ক’দিন আমার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বাবলু আর ওর বউ বেলী মিন্টো রোডের ফুটপাতে বসে রাত কাটিয়েছে। রাতের পর রাত পাহারায় ওদের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী দলের বেশ ক’জন সংসদ সদস্য এবং সাংবাদিক, পেশাজীবীরাও বিপুল সংখ্যায় অংশ নিয়েছিলেন। বাবলু আর বেলীর একমাত্র কন্যা সারাহ্ স্কুলে পড়ে। আমার কন্যাসম বালিকাটি রেস্টুরেন্টে খেতে খুব পছন্দ করে। মুক্তজীবনে আমি, পারভীন, বাবলু, বেলী এবং সারাহ্ মাসে অন্তত একবার বাইরে খেতে যেতাম। বাবলুর কাছ থেকে শুনলাম, সারাহ্ বলেছে আমি মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত ও আর কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে যাবে না। আদালতের গুরুগম্ভীর পরিবেশের মধ্যেও চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। এমন ভালোবাসার শক্তিতেই তো মাথা উঁচু করে ফ্যাসিবাদী সরকারের সঙ্গে লড়াই অব্যাহত রাখতে পারছি।
শুনানির প্রথম দিনে বাবলু ছাড়াও প্রচুর বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, আপনজনেরা আদালত কক্ষে ভিড় জমিয়েছেন। সাংবাদিক নেতারা এবং সংবাদকর্মীরা তো আছেনই। শেষপর্যন্ত দুপুর একটায় আমার মামলার শুনানি শুরু হলো। ততক্ষণে আপিল বিভাগের দিনের নির্ধারিত সময় প্রায় শেষ। ‘চেম্বার মানেই সরকার পক্ষে স্টে’ শিরোনামে যে সংবাদ প্রকাশের অভিযোগে মামলা দায়ের হয়েছে, সেটি আদালত কক্ষে পড়ে শোনাতেই বাকি সময় সমাপ্ত হলো। প্রধান বিচারপতি শুনানির পরবর্তী তারিখ আগস্টের ১৬ তারিখে নির্ধারণ করলেন। একই রকম কড়া পাহারার মধ্য দিয়ে ফিরতি পথের উদ্দেশে প্রিজন ভ্যানে উঠলাম। তবে এবার সংবাদকর্মীদের ফাঁকি দেয়া সম্ভব হয়নি। আমি দোতলা থেকে নামার আগেই নিচতলায় পেছনের ছোট প্রবেশদ্বারের বাইরে ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ার বিপুলসংখ্যক ফটোসাংবাদিক গাদাগাদি করে প্রস্তুত। প্রিজন ভ্যানে ওঠার সময় হাসিমুখে, হাত নেড়ে সবাইকে শুভেচ্ছা জানালাম।
শুনানির দ্বিতীয় দিন সরকারপক্ষ সম্পূরক এফিডেভিট দিয়ে আমার লেখা মন্তব্য প্রতিবেদন আদালতে পেশ করলো, যার শিরোনাম ‘স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা’। ওই লেখাটি শেষ করেছিলাম ছোট একটি পুনশ্চ দিয়ে। যেখানে অনেকটা দৈববাণীর মতো করে লিখেছিলাম, ‘লেখার শুরুতেই বলেছিলাম আমার বিরুদ্ধে এরই মধ্যে আদালত অবমাননার একটি মামলা দায়ের হয়েছে। আজই সম্ভবত আপিল বিভাগে সেই মামলার প্রথম শুনানি। পাঠক যখন আমার এই লেখা পড়ছেন, তখন হয়তো আপিল বিভাগে আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার শুনানি চলছে। আজকের মন্তব্য-প্রতিবেদন লেখার অপরাধে আদালত অবমাননার দ্বিতীয় মামলা মোকাবিলারও আগাম মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখলাম। মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের সুপথে পরিচালিত করুন।’ একই লেখার অপর একটি অংশে বলেছিলাম, ‘শুধু এটুকু আগাম বলে রাখছি, সত্য কথা প্রকাশের অপরাধে কারাগারে যেতে আমি বরং গৌরবই বোধ করব। কারাগার থেকে জীবিত ফিরে আসতে পারলে আবার সত্য কথা বলব এবং লিখব, প্রয়োজনে পুনর্বার কারাগারে যাব।’ মন্তব্য প্রতিবেদনটি ছাপা হয়েছিল মে মাসের ১০ তারিখে এবং আমি গ্রেফতার হয়েছিলাম জুনের ১ তারিখে। আদালতে সম্পূরক এফিডেভিট উপস্থাপনের রীতি অনুযায়ী পুরো লেখাটি ভরা মজলিসে পড়ে শোনানো হলো। বাদীপক্ষের মূল আইনজীবী, অ্যাডিশনাল অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান লেখাটি থেমে থেমে পড়ছেন আর আপিল বিভাগের বিচারপতিদের মুখের রঙ পাল্টাচ্ছে। তারা বিস্মিত থেকে ক্রমেই ক্রুদ্ধ হচ্ছেন।
আমি বিচারপতিদের প্রতিক্রিয়ায় খানিকটা হতাশ হয়েই ভাবছিলাম, লেখাটি কি তাহলে এর আগে মাননীয় বিচারপতিদের নজরে পড়েনি? তাদের উদ্দেশেই তো আমার এই লেখা। জেনারেল মইন এবং শেখ হাসিনা আমাদের বিচারাঙ্গনের স্বাধীন সত্তার যে ভয়াবহ ক্ষতিসাধন করেছেন, মন্তব্যসহ তারই উল্লেখ রয়েছে লেখাটিতে। হয়তো সুশীল (?) কলামিস্ট ছাড়া অন্য কারও লেখা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিগণ পাঠের উপযুক্ত বিবেচনা করেন না। যা-ই হোক, সম্পূরক এফিডেভিট উপস্থাপন শেষ হলে আদালত এফিডেভিট গ্রহণ করার পরিবর্তে আমার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় আদালত অবমাননা মামলা দায়েরের নির্দেশ দিলেন। আমার গ্রেফতারপূর্ব ভবিষ্যদ্বাণী শতভাগ ফলে গেল দেখে লেখক হিসেবে সন্তোষবোধ করলেও কয়েদ খাটার মেয়াদও যে বাড়তে পারে, তাও অনুধাবন করলাম। মন্তব্য-প্রতিবেদন পাঠ শেষে আবার শুরু হলো মূল মামলা প্রসঙ্গে অ্যাডিশনাল অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তৃতা। যথারীতি ১টায় সেদিনের কার্যক্রম সমাপ্ত হলো। প্রধান বিচারপতি সরকারপক্ষকে পরবর্তী কার্যদিবসের মধ্যে তাদের শুনানি শেষ করার নির্দেশ দিয়ে সদলবলে উঠে দাঁড়ালেন। আমিও প্রিজন ভ্যানের দিকে হাঁটা দিলাম। ১৭ তারিখে এজলাসে পৌঁছে দেখি, উপস্থিত আইনজীবীদের হাতে হাতে আমার মন্তব্য-প্রতিবেদনের ফটোকপি। অধিকাংশ আইনজীবীই গভীর মনোযোগ দিয়ে আমার লেখা পড়ছেন। এই দৃশ্য অবলোকনে লেখক হিসেবে আনন্দিত বোধ করলেও আমার প্রতিপক্ষের ক্রোধের আগুনে যে ঘৃতাহুতি পড়ছে, সেটাও বুঝতে পারছি। এদিনও সরকারপক্ষ অবিরাম বলে চললো। অ্যাডিশনাল অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের মাঝখানে কোনো কোনো বিচারপতি নানা রকম মন্তব্য করে চলেছেন। অধিকাংশ মন্তব্যের মধ্যেই আমার প্রতি অপরিসীম বিতৃষ্ণা ও ক্রোধ প্রকাশ পাচ্ছে। বিচারপতি এস কে সিনহা একাধিকবার সংবিধানের ১০৮ ধারা উল্লেখ করে সরকারপক্ষের মতামত চাইলেন যে, আপিল বিভাগ আদালত অবমাননাকারীকে যথেচ্ছা সাজা দিতে পারেন কি-না। সরকারপক্ষ অতিশয় আনন্দিত চিত্তে মাননীয় বিচারপতির সঙ্গে সবিনয়ে সহমত পোষণ করলো। মঙ্গলবার সমস্ত দিন একটানা বলেও সরকারপক্ষের শুনানি শেষ হলো না। আপিল বিভাগের অন্য সব মামলার কার্যক্রম তিনদিন ধরে থেমে আছে আমার এক মামলার দাপটে। বিষয়টি আমি বেশ উপভোগ করছি দেখে ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কিছুটা বিরক্তি সহকারে মন্তব্য করলেন, আমাদের সব মামলা তিনদিন ধরে আটকে আছে আর আপনি মজা পাচ্ছেন। ব্যারিস্টার হোসেন মইনের জামানায় আমার আইনজীবী ছিলেন। দেশের এই বিশিষ্ট আইনজীবী বাল্যকালে আমার মতোই পুরনো ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় কাটিয়েছেন। জরুরি অবস্থার সময় সন্ধ্যেবেলা তার চেম্বারে বসে চা খেতে খেতে একাধিকবার আমরা সেই পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করেছি। আমি হেসেই তাকে জবাব দিলাম, আপনাদের এই বিরক্তি আমার খুশির মাত্রা আরও বাড়াতে সাহায্য করছে।
শুনানির প্রথম দিন থেকেই বিচারপতি এমএ মতিন, বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক এবং বিচারপতি এস কে সিনহার আক্রমণাত্মক ভূমিকা লক্ষণীয় ছিল। প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম মাঝে-মধ্যে মন্তব্য করছিলেন। বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান গম্ভীরমুখে কেবল শুনেই গেছেন। চেম্বার জজের ভূমিকা পালনকারী বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন প্রদত্ত রায় সংক্রান্ত সংবাদ নিয়েই যেহেতু মামলার সূত্রপাত, কাজেই তার বিরক্ত চেহারা নিয়ে মামলার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ এবং শ্রবণ ছাড়া গত্যন্তর নেই। আদালতের রীতি-নীতি যতটুকু জানি, সেই ভিত্তিতে এই মামলায় বেঞ্চে তার উপস্থিতি আমি প্রত্যাশা করিনি। আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তিনদিনের শুনানির ধারা থেকে আমি ইতোমধ্যেই নিশ্চিত হয়ে গেছি যে সাজা হচ্ছেই। বিচারপতি এমএ মতিন গত তিনদিনে অন্তত বারছয়েক বলেছেন, সংবাদ সত্য না মিথ্যা এটা বিচার্য বিষয় নয়, সংবাদ প্রকাশ করায় আদালতের কোনো অসম্মান হয়েছে কি-না, সেটাই মূল প্রশ্ন। তিনদিন ধরে শুনানি চলছে অথচ আদালতে বসার জায়গা তো দূরের কথা, দাঁড়ানোর জায়গা মেলাই মুশকিল। চাঞ্চল্যকর মামলার শুনানি শুনতে সুপ্রিমকোর্টের অধিকাংশ আইনজীবী ছাড়াও অন্য পেশার নাগরিকরা দল বেঁধে এসেছেন। সাংবাদিকদের উপস্থিতিও বোধগম্য কারণেই লক্ষণীয়। এরা সবাই যে আমার প্রতি সহমর্মিতাবশত এসেছেন, তা নয়। বাংলাদেশের মতো বিভক্ত সমাজে সাংবাদিকদের মধ্যকার একটি বড় অংশ যে আমার সাজাপ্রাপ্তিতে আনন্দিত হবেন, এটা সবারই জানা। যদিও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা এই মামলার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দুর্ভাগ্যবশত রাজনৈতিক বিভেদের কারণে এ ধরনের সুস্থ চিন্তা আমরা বহু আগেই পরিত্যাগ করে বসে আছি। পেশাগত স্বার্থ ক্ষুণ্ন করেও শত্রুর ক্ষতি এবং হয়রানি দেখার মতো সুখ বাঙালি মুসলমানের অন্য কিছুতে নেই। বুধবার সকাল পর্যন্ত অ্যাটর্নি জেনারেল, অ্যাডিশনাল অ্যাটর্নি জেনারেল নিরবচ্ছিন্নভাবে শুনানি করে গেলেন। আপিল বিভাগের মাননীয় বিচারপতিগণ কেবল যে নিবিষ্ট মনে সরকারপক্ষের সব যুক্তিতর্ক শুনে গেলেন তা-ই নয়, প্রয়োজনমত আইনের বিভিন্ন সূত্র ধরিয়ে দিয়ে তাদের সাধ্যমত সহযোগিতাও করলেন। সকাল দশটার পর অবশেষে আমার আত্মপক্ষ সমর্থনের পালা এলো।
আমাদের সংবিধানে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসঙ্গতি থাকলেও সেখানে বার বার ব্যক্তিস্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার এবং মানবসত্তার মর্যাদার কথা বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার সংবিধানের সেই মহান আদর্শকে ভূলুণ্ঠিত করে একটি নির্যাতনকারী পুলিশি রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করেছে। সুশীল (?) সমাজের চেনা মুখগুলো সম্ভবত তাদের মার্কিন ও ভারতীয় নিয়োগকর্তাদের নির্দেশক্রমে রাষ্ট্রের এসব অসঙ্গতি দেখেও দেখছে না। তারা মূক ও বধিরের ভূমিকা পালন করছে। অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম সরকার তোষণের সম্পাদকীয় নীতি গ্রহণ করে নগদ লাভের হিসাব কষতে ব্যস্ত। সরকারের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান ‘স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী’ প্রবণতাকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রতিরোধ করার জন্য প্রকৃত দলনিরপেক্ষ, স্বাধীন ও পক্ষপাতশূন্য বিচার বিভাগের প্রয়োজন ছিল। দুর্ভাগ্যবশত সেখানকার অবস্থায় আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না। ইনসাফ প্রাপ্তির সব ক’টা দরজা বন্ধ হয়ে গেলে দেশ শেষ পর্যন্ত নৈরাজ্যের দিকে ধাবিত হয় কি-না, সেটি জানার জন্য আরও কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে।
বাঙালি মনস্কতার পরাকাষ্ঠার কারণে সরকারের শীর্ষ ব্যক্তি যে তাবত্ ব্যাপারে নাটকীয়তা পছন্দ করেন, সেই তথ্য আমাদের জানা। তার সেই নাটকপ্রীতি বর্তমানে প্রশাসনেও সংক্রমিত হয়েছে। সুপ্রিমকোর্টে আমাকে শুনানির জন্য হাজির করা নিয়েও জেল প্রশাসন নাটক কম করলো না। শুনেছিলাম, প্রধান বিচারপতি এজলাসে ওঠেন সকাল ন’টায়। তার আগেই বিচারপ্রার্থী, আমার মতো আসামি এবং আইনজীবীদের তার এজলাসে উপস্থিত হওয়াই রীতি। নাজিমউদ্দীন রোড থেকে সুপ্রিমকোর্ট পৌঁছাতে মিনিট পনেরো লাগে। সেল থেকে জেলগেটে যাওয়া, অতঃপর ডেপুটি জেলারের সামনে বসে প্রিজন ভ্যানে ওঠার জন্যে ডাকের অপেক্ষা ইত্যাদি প্রক্রিয়া সমাপ্ত করার প্রয়োজনীয় সময় বিবেচনা করে সকাল আটটা থেকে তৈরি হয়ে বসে থাকলাম সাড়ে ন’টা পর্যন্ত। কারা প্রশাসনের কোনো পাত্তা নেই। ভাবলাম, যে কোনো কারণেই হোক আজ আর আমাকে আদালতে নেয়া হচ্ছে না। পয়লা রোজার দিন বলে সকালে চা-নাস্তার পাট ছিল না। রাত তিনটায় শয্যাত্যাগ করার পর আর ঘুমানো হয়নি। নিদ্রার জন্য প্যান্ট-শার্ট বদলে সবে চৌকিতে গা এলিয়ে দিয়েছি, আর ডেপুটি জেলার হন্ত-দন্ত এসে হাজির। তার সঙ্গে তত্ক্ষণাত্ যেতে হবে। বিরক্ত হয়ে বিলম্বের কারণ জানতে চাইলে জবাবে আমতা আমতা করে যা বললো, তার অর্থ সে-ই ভালো জানে। জেলগেটে আরেক নতুন অভিজ্ঞতা হলো। প্রিজন ভ্যান অনেক কসরত করে প্রধান ফটকের ভেতরে ঢোকানো হয়েছে। অর্থাত্ জেলের বাইরে অপেক্ষমাণ দর্শনার্থীরা কোনোক্রমে আমাকে একনজর দেখে ফেলুক, সেটাও প্রশাসন চাচ্ছে না। এতদিন জেলগেটের প্রধান ফটক পার হয়ে বাইরে দাঁড় করানো প্রিজন ভ্যানে হেঁটে উঠতাম। পরে জেনেছি, একমাত্র শেখ মুজিব হত্যা মামলার আসামি এবং জেএমবির মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিদের এই বিশেষ তরিকায় আদালতে আনা-নেয়া করা হতো। দেয়ালের পাশ ঘেঁষে অতিকষ্টে বিশাল ভ্যানে উঠলাম। আমাকে নিয়ে প্রশাসন যে কতখানি আতঙ্কগ্রস্ত, সেটা পুরোপুরি টের পাওয়া তখনও বাকি ছিল।
প্রিজন ভ্যান জেলগেটে থেকে রাস্তায় পড়তেই দেখলাম অন্তত গোটা চারেক পুলিশভর্তি গাড়ি অপেক্ষা করছে আমাকে বহনকারী প্রিজন ভ্যান অ্যাসকর্ট করে আদালত পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার জন্যে। বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়। সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে প্রবেশ করে দেখি, সেখানে জবরদস্ত বন্দোবস্ত। আদালতের মূল দরজা থেকে বিচারপতিদের প্রবেশের নির্দিষ্ট দরজা পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে দশ হাত পর পর পুলিশ অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওসামা বিন লাদেনকে সুপ্রিমকোর্টে নেয়া হলেও বোধহয় এমন নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হতো না। দুই স্তর পুলিশ পাহারার মধ্যে প্রিজন ভ্যান থেকে নামলাম। মিডিয়াকে ফাঁকি দেয়ার জন্য সংবাদকর্মীদের সুপ্রিমকোর্ট ভবনের মূল প্রবেশপথের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে আমাকে পেছনের দরজা দিয়ে ঢোকানো হলো। আয়োজনের এই আতিশয্যে কৌতুক বোধ করে সঙ্গের পুলিশ কর্মকর্তাকে আমাকে এতটা ভয় পাওয়ার হেতু জিজ্ঞাসা করে কোনো জবাব পেলাম না। সামনে-পেছনে বিস্তৃত পুলিশ কর্ডনের মধ্য দিয়ে দোতলায় প্রধান বিচারপতির এজলাসে পৌঁছালাম। যা ভেবেছিলাম তা-ই, বিচার কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। তবে আমার মামলার নম্বর তেরো হওয়ায় উপস্থিত বন্ধু, শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে নিচু স্বরে গল্পগুজব করার কিছুটা সময় পাওয়া গেল। বাল্যবন্ধু ড. সালাহউদ্দিন (বাবলু) আদালতের মাঝখানের বিরতিতে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমার জন্মদিনে জেলে ওর কাছ থেকে কার্ড পেলেও গ্রেফতারের পর ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর সঙ্গে এই প্রথম সাক্ষাত্। পারভীনের কাছ থেকে আগেই শুনেছি, ডিবিতে রিমান্ডের ক’দিন আমার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বাবলু আর ওর বউ বেলী মিন্টো রোডের ফুটপাতে বসে রাত কাটিয়েছে। রাতের পর রাত পাহারায় ওদের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী দলের বেশ ক’জন সংসদ সদস্য এবং সাংবাদিক, পেশাজীবীরাও বিপুল সংখ্যায় অংশ নিয়েছিলেন। বাবলু আর বেলীর একমাত্র কন্যা সারাহ্ স্কুলে পড়ে। আমার কন্যাসম বালিকাটি রেস্টুরেন্টে খেতে খুব পছন্দ করে। মুক্তজীবনে আমি, পারভীন, বাবলু, বেলী এবং সারাহ্ মাসে অন্তত একবার বাইরে খেতে যেতাম। বাবলুর কাছ থেকে শুনলাম, সারাহ্ বলেছে আমি মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত ও আর কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে যাবে না। আদালতের গুরুগম্ভীর পরিবেশের মধ্যেও চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। এমন ভালোবাসার শক্তিতেই তো মাথা উঁচু করে ফ্যাসিবাদী সরকারের সঙ্গে লড়াই অব্যাহত রাখতে পারছি।
শুনানির প্রথম দিনে বাবলু ছাড়াও প্রচুর বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, আপনজনেরা আদালত কক্ষে ভিড় জমিয়েছেন। সাংবাদিক নেতারা এবং সংবাদকর্মীরা তো আছেনই। শেষপর্যন্ত দুপুর একটায় আমার মামলার শুনানি শুরু হলো। ততক্ষণে আপিল বিভাগের দিনের নির্ধারিত সময় প্রায় শেষ। ‘চেম্বার মানেই সরকার পক্ষে স্টে’ শিরোনামে যে সংবাদ প্রকাশের অভিযোগে মামলা দায়ের হয়েছে, সেটি আদালত কক্ষে পড়ে শোনাতেই বাকি সময় সমাপ্ত হলো। প্রধান বিচারপতি শুনানির পরবর্তী তারিখ আগস্টের ১৬ তারিখে নির্ধারণ করলেন। একই রকম কড়া পাহারার মধ্য দিয়ে ফিরতি পথের উদ্দেশে প্রিজন ভ্যানে উঠলাম। তবে এবার সংবাদকর্মীদের ফাঁকি দেয়া সম্ভব হয়নি। আমি দোতলা থেকে নামার আগেই নিচতলায় পেছনের ছোট প্রবেশদ্বারের বাইরে ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ার বিপুলসংখ্যক ফটোসাংবাদিক গাদাগাদি করে প্রস্তুত। প্রিজন ভ্যানে ওঠার সময় হাসিমুখে, হাত নেড়ে সবাইকে শুভেচ্ছা জানালাম।
শুনানির দ্বিতীয় দিন সরকারপক্ষ সম্পূরক এফিডেভিট দিয়ে আমার লেখা মন্তব্য প্রতিবেদন আদালতে পেশ করলো, যার শিরোনাম ‘স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা’। ওই লেখাটি শেষ করেছিলাম ছোট একটি পুনশ্চ দিয়ে। যেখানে অনেকটা দৈববাণীর মতো করে লিখেছিলাম, ‘লেখার শুরুতেই বলেছিলাম আমার বিরুদ্ধে এরই মধ্যে আদালত অবমাননার একটি মামলা দায়ের হয়েছে। আজই সম্ভবত আপিল বিভাগে সেই মামলার প্রথম শুনানি। পাঠক যখন আমার এই লেখা পড়ছেন, তখন হয়তো আপিল বিভাগে আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার শুনানি চলছে। আজকের মন্তব্য-প্রতিবেদন লেখার অপরাধে আদালত অবমাননার দ্বিতীয় মামলা মোকাবিলারও আগাম মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখলাম। মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের সুপথে পরিচালিত করুন।’ একই লেখার অপর একটি অংশে বলেছিলাম, ‘শুধু এটুকু আগাম বলে রাখছি, সত্য কথা প্রকাশের অপরাধে কারাগারে যেতে আমি বরং গৌরবই বোধ করব। কারাগার থেকে জীবিত ফিরে আসতে পারলে আবার সত্য কথা বলব এবং লিখব, প্রয়োজনে পুনর্বার কারাগারে যাব।’ মন্তব্য প্রতিবেদনটি ছাপা হয়েছিল মে মাসের ১০ তারিখে এবং আমি গ্রেফতার হয়েছিলাম জুনের ১ তারিখে। আদালতে সম্পূরক এফিডেভিট উপস্থাপনের রীতি অনুযায়ী পুরো লেখাটি ভরা মজলিসে পড়ে শোনানো হলো। বাদীপক্ষের মূল আইনজীবী, অ্যাডিশনাল অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান লেখাটি থেমে থেমে পড়ছেন আর আপিল বিভাগের বিচারপতিদের মুখের রঙ পাল্টাচ্ছে। তারা বিস্মিত থেকে ক্রমেই ক্রুদ্ধ হচ্ছেন।
আমি বিচারপতিদের প্রতিক্রিয়ায় খানিকটা হতাশ হয়েই ভাবছিলাম, লেখাটি কি তাহলে এর আগে মাননীয় বিচারপতিদের নজরে পড়েনি? তাদের উদ্দেশেই তো আমার এই লেখা। জেনারেল মইন এবং শেখ হাসিনা আমাদের বিচারাঙ্গনের স্বাধীন সত্তার যে ভয়াবহ ক্ষতিসাধন করেছেন, মন্তব্যসহ তারই উল্লেখ রয়েছে লেখাটিতে। হয়তো সুশীল (?) কলামিস্ট ছাড়া অন্য কারও লেখা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিগণ পাঠের উপযুক্ত বিবেচনা করেন না। যা-ই হোক, সম্পূরক এফিডেভিট উপস্থাপন শেষ হলে আদালত এফিডেভিট গ্রহণ করার পরিবর্তে আমার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় আদালত অবমাননা মামলা দায়েরের নির্দেশ দিলেন। আমার গ্রেফতারপূর্ব ভবিষ্যদ্বাণী শতভাগ ফলে গেল দেখে লেখক হিসেবে সন্তোষবোধ করলেও কয়েদ খাটার মেয়াদও যে বাড়তে পারে, তাও অনুধাবন করলাম। মন্তব্য-প্রতিবেদন পাঠ শেষে আবার শুরু হলো মূল মামলা প্রসঙ্গে অ্যাডিশনাল অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তৃতা। যথারীতি ১টায় সেদিনের কার্যক্রম সমাপ্ত হলো। প্রধান বিচারপতি সরকারপক্ষকে পরবর্তী কার্যদিবসের মধ্যে তাদের শুনানি শেষ করার নির্দেশ দিয়ে সদলবলে উঠে দাঁড়ালেন। আমিও প্রিজন ভ্যানের দিকে হাঁটা দিলাম। ১৭ তারিখে এজলাসে পৌঁছে দেখি, উপস্থিত আইনজীবীদের হাতে হাতে আমার মন্তব্য-প্রতিবেদনের ফটোকপি। অধিকাংশ আইনজীবীই গভীর মনোযোগ দিয়ে আমার লেখা পড়ছেন। এই দৃশ্য অবলোকনে লেখক হিসেবে আনন্দিত বোধ করলেও আমার প্রতিপক্ষের ক্রোধের আগুনে যে ঘৃতাহুতি পড়ছে, সেটাও বুঝতে পারছি। এদিনও সরকারপক্ষ অবিরাম বলে চললো। অ্যাডিশনাল অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের মাঝখানে কোনো কোনো বিচারপতি নানা রকম মন্তব্য করে চলেছেন। অধিকাংশ মন্তব্যের মধ্যেই আমার প্রতি অপরিসীম বিতৃষ্ণা ও ক্রোধ প্রকাশ পাচ্ছে। বিচারপতি এস কে সিনহা একাধিকবার সংবিধানের ১০৮ ধারা উল্লেখ করে সরকারপক্ষের মতামত চাইলেন যে, আপিল বিভাগ আদালত অবমাননাকারীকে যথেচ্ছা সাজা দিতে পারেন কি-না। সরকারপক্ষ অতিশয় আনন্দিত চিত্তে মাননীয় বিচারপতির সঙ্গে সবিনয়ে সহমত পোষণ করলো। মঙ্গলবার সমস্ত দিন একটানা বলেও সরকারপক্ষের শুনানি শেষ হলো না। আপিল বিভাগের অন্য সব মামলার কার্যক্রম তিনদিন ধরে থেমে আছে আমার এক মামলার দাপটে। বিষয়টি আমি বেশ উপভোগ করছি দেখে ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কিছুটা বিরক্তি সহকারে মন্তব্য করলেন, আমাদের সব মামলা তিনদিন ধরে আটকে আছে আর আপনি মজা পাচ্ছেন। ব্যারিস্টার হোসেন মইনের জামানায় আমার আইনজীবী ছিলেন। দেশের এই বিশিষ্ট আইনজীবী বাল্যকালে আমার মতোই পুরনো ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় কাটিয়েছেন। জরুরি অবস্থার সময় সন্ধ্যেবেলা তার চেম্বারে বসে চা খেতে খেতে একাধিকবার আমরা সেই পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করেছি। আমি হেসেই তাকে জবাব দিলাম, আপনাদের এই বিরক্তি আমার খুশির মাত্রা আরও বাড়াতে সাহায্য করছে।
শুনানির প্রথম দিন থেকেই বিচারপতি এমএ মতিন, বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক এবং বিচারপতি এস কে সিনহার আক্রমণাত্মক ভূমিকা লক্ষণীয় ছিল। প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম মাঝে-মধ্যে মন্তব্য করছিলেন। বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান গম্ভীরমুখে কেবল শুনেই গেছেন। চেম্বার জজের ভূমিকা পালনকারী বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন প্রদত্ত রায় সংক্রান্ত সংবাদ নিয়েই যেহেতু মামলার সূত্রপাত, কাজেই তার বিরক্ত চেহারা নিয়ে মামলার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ এবং শ্রবণ ছাড়া গত্যন্তর নেই। আদালতের রীতি-নীতি যতটুকু জানি, সেই ভিত্তিতে এই মামলায় বেঞ্চে তার উপস্থিতি আমি প্রত্যাশা করিনি। আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তিনদিনের শুনানির ধারা থেকে আমি ইতোমধ্যেই নিশ্চিত হয়ে গেছি যে সাজা হচ্ছেই। বিচারপতি এমএ মতিন গত তিনদিনে অন্তত বারছয়েক বলেছেন, সংবাদ সত্য না মিথ্যা এটা বিচার্য বিষয় নয়, সংবাদ প্রকাশ করায় আদালতের কোনো অসম্মান হয়েছে কি-না, সেটাই মূল প্রশ্ন। তিনদিন ধরে শুনানি চলছে অথচ আদালতে বসার জায়গা তো দূরের কথা, দাঁড়ানোর জায়গা মেলাই মুশকিল। চাঞ্চল্যকর মামলার শুনানি শুনতে সুপ্রিমকোর্টের অধিকাংশ আইনজীবী ছাড়াও অন্য পেশার নাগরিকরা দল বেঁধে এসেছেন। সাংবাদিকদের উপস্থিতিও বোধগম্য কারণেই লক্ষণীয়। এরা সবাই যে আমার প্রতি সহমর্মিতাবশত এসেছেন, তা নয়। বাংলাদেশের মতো বিভক্ত সমাজে সাংবাদিকদের মধ্যকার একটি বড় অংশ যে আমার সাজাপ্রাপ্তিতে আনন্দিত হবেন, এটা সবারই জানা। যদিও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা এই মামলার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দুর্ভাগ্যবশত রাজনৈতিক বিভেদের কারণে এ ধরনের সুস্থ চিন্তা আমরা বহু আগেই পরিত্যাগ করে বসে আছি। পেশাগত স্বার্থ ক্ষুণ্ন করেও শত্রুর ক্ষতি এবং হয়রানি দেখার মতো সুখ বাঙালি মুসলমানের অন্য কিছুতে নেই। বুধবার সকাল পর্যন্ত অ্যাটর্নি জেনারেল, অ্যাডিশনাল অ্যাটর্নি জেনারেল নিরবচ্ছিন্নভাবে শুনানি করে গেলেন। আপিল বিভাগের মাননীয় বিচারপতিগণ কেবল যে নিবিষ্ট মনে সরকারপক্ষের সব যুক্তিতর্ক শুনে গেলেন তা-ই নয়, প্রয়োজনমত আইনের বিভিন্ন সূত্র ধরিয়ে দিয়ে তাদের সাধ্যমত সহযোগিতাও করলেন। সকাল দশটার পর অবশেষে আমার আত্মপক্ষ সমর্থনের পালা এলো।
No comments