২৪- সরকারপক্ষ সময় পেল চারদিন : আমার বক্তব্যের জন্য বরাদ্দ সাকুল্যে ৫০ মিনিট
কোর্টে অসুস্থ হয়ে পড়া
আপিল বিভাগের এজলাস ছেড়ে প্রিজন ভ্যানের দিকে যাচ্ছি আর ভাবছি, কোর্টে আমার অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর শুনে জায়া ও জননীর হাল কী হবে। বাবলু, ফরহাদ ভাই আর শুভ্রকে আদালত থেকে সরাসরি আমার বাসায় যেতে অনুরোধ করলাম। আমি যে সামলে উঠেছি এবং বড় কোনো বিপদের ভয় নেই, সামনাসামনি এ সংবাদটি তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া খুব জরুরি। জেলে ফেরার পথে প্রাচীন রোমের কথা বার বার মনে হচ্ছিল। রোমানরা এক সময় অনাহারক্লিষ্ট বন্দিদের ক্ষুধার্ত সিংহ পালের সামনে ছেড়ে দিয়ে কলোসিয়ামে বসে মজা দেখতো। দু’হাজার বছর আগের সেই অসহায় বন্দিদের সঙ্গে নিজের বর্তমান অবস্থার কোনো পার্থক্য খুঁজে পেলাম না .....
আপিল বিভাগের এজলাস ছেড়ে প্রিজন ভ্যানের দিকে যাচ্ছি আর ভাবছি, কোর্টে আমার অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর শুনে জায়া ও জননীর হাল কী হবে। বাবলু, ফরহাদ ভাই আর শুভ্রকে আদালত থেকে সরাসরি আমার বাসায় যেতে অনুরোধ করলাম। আমি যে সামলে উঠেছি এবং বড় কোনো বিপদের ভয় নেই, সামনাসামনি এ সংবাদটি তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া খুব জরুরি। জেলে ফেরার পথে প্রাচীন রোমের কথা বার বার মনে হচ্ছিল। রোমানরা এক সময় অনাহারক্লিষ্ট বন্দিদের ক্ষুধার্ত সিংহ পালের সামনে ছেড়ে দিয়ে কলোসিয়ামে বসে মজা দেখতো। দু’হাজার বছর আগের সেই অসহায় বন্দিদের সঙ্গে নিজের বর্তমান অবস্থার কোনো পার্থক্য খুঁজে পেলাম না .....
আমার পক্ষের অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড দাঁড়িয়ে কোনো আইনজীবীর পরিবর্তে অভিযুক্ত নিজে বক্তব্য দেবেন—এই কথা বলামাত্র প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে বড়সড় ঝারি খেলেন। আদালতের রীতি অনুযায়ী আইনজীবীর পরিবর্তে অভিযুক্ত তার আত্মপক্ষ সমর্থন করলে এফিডেভিটে তারই স্বাক্ষর করতে হবে, অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড সই করলে সেটা বিধিসম্মত হবে না। আমি জেলে বন্দি, কারা প্রশাসন আইনজীবীদের সঙ্গে জেলগেটে আমাকে দেখা করতে দিতে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে চলেছে, এসব কারণে এফিডেভিটে আমার সই নেয়া হয়নি। অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড বিব্রত হয়ে আদালতের কাছে এই ব্যত্যয়ের জন্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করলে প্রধান বিচারপতি বেশ রাগতভাবেই তার আবেদন মঞ্জুর করলেন। পুরো সময়টা আমি বোকার মতো কাগজপত্র বগলে বেচারা অ্যাডভোকেট অন রেকর্ডের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। কথা বলার অনুমতি পেয়ে স্ট্যান্ডের দিকে এগোচ্ছি আর ভাবছি, সূচনাতেই আদালতের মনোভাব স্পষ্ট। মাইক স্ট্যান্ডে কাগজপত্র রাখার জায়গায় আমার দলিল-দস্তাবেজ ঠিকমত রাখতেও পারিনি, দ্বিতীয় দফার আক্রমণ এলো, এবারের লক্ষ্য আমি। বিচারপতি এমএ মতিন অনেকটা ধমকের সুরে বললেন, লিখিত এফিডেভিটের বাইরে আমি কোনো কথা বলতে পারব না। এই আঘাতের জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না। সত্যি কথা বলতে, আমার পক্ষ থেকে যে এফিডেভিট জমা দেয়া হয়েছে তার বক্তব্য আমার মনঃপূত হয়নি। আদালত অবমাননা মামলার ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা সাধারণত যে গত্বাঁধা ভাষায় জবাব দিয়ে থাকে, তার সঙ্গে আমার এফিডেভিটের বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। সংবাদ প্রকাশের পেছনে আমার কোনো মন্দ উদ্দেশ্য ছিল না, আমি বরং স্বাধীন বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় আদালতকে সাহায্য করতে চেয়েছি, এভিডেভিটে এ-জাতীয় বক্তব্যই বেশি। এ ধরনের জবাবের সমাপ্তিতে নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনাই (unconditional apology) অধিকতর মানানসই হতো। সেটা থাকলে আদালতেরও হয়তো চারদিন ধরে এত উষ্মা প্রকাশের প্রয়োজন পড়তো না। কিন্তু কোনো কোনো আইনজীবীর ভিন্ন পরামর্শ সত্ত্বেও আমার বিবেচনায় বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করে আমি যেহেতু কোনো অপরাধ করিনি, কাজেই ক্ষমাপ্রার্থনা না করে স্বেচ্ছায় অভিযোগ মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই ক’দিন সরকারপক্ষের বক্তব্য শুনে কারাগারের সেলে বসে আমি যে জবাব তৈরি করেছি, তার সঙ্গে আমার পক্ষে আদালতে জমা দেয়া এফিডেভিটের সামান্যই মিল রয়েছে। জেল কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতার কারণে শুনানি চলাকালীন জেলে আমার আইনজীবীদের সঙ্গে প্রয়োজনমত দেখা করতে না পারায় নতুন করে এফিডেভিট তৈরি করাও সম্ভব হয়নি। রাতের পর রাত জেগে অনেক কষ্টে হাতে লিখে আত্মপক্ষ সমর্থনের একটা খসড়া তৈরি করে নিয়ে এসেছিলাম। বিচারপতি এমএ মতিনের নির্দেশ আমার কাছে অনেকটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই ঠেকলো। প্রধান বিচারপতির কাছে আমার এই কথাগুলো নিবেদনের কোনো সুযোগ পেলাম না। তার আগেই হলুদ রঙের আইনের একটি চটি বই হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলা হলো ৮(১) ধারা উচ্চস্বরে পাঠ করার জন্য। স্কুলের ছাত্রের মতো বুড়ো বয়সে রিডিং পড়ার পরীক্ষা দিতে হলো। পড়ে যা বুঝলাম, তাতে মনে হলো—আত্মপক্ষ সমর্থনে অভিযুক্তের বক্তব্য দেয়ার তেমন কোনো সুযোগই রাখা হয়নি। অনেকটা হাত বেঁধে মুষ্টিযুদ্ধে নামিয়ে দেয়ার মতো। আসল কথা হলো, তুই ব্যাটা আদালত অবমাননা করেছিস, তোর আবার আত্মপক্ষ সমর্থন কী? পরবর্তী চল্লিশ মিনিট ধরে আমার বক্তব্য দেয়ার প্রাণপণ এবং ব্যর্থ চেষ্টার মধ্যে এ কথাটিই খানিকটা ভদ্রতাসহকারে এবং আইনি ভাষার মারপ্যাঁচে আমাকে শোনানো হয়েছে। একটি উদাহরণ দিলেই অবস্থাটা পাঠকের কাছে খোলাসা হবে। অনেক উপদেশ শ্রবণের মধ্যে এটাও জানলাম, আদালত অবমাননা মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তি তার বক্তব্য প্রদানের সময় ‘ডিফেন্স’ (defence) শব্দটাও উচ্চারণ করতে পারবেন না, করলেই নাকি নতুন সুয়ো-মোটো (suo-moto) মামলা দায়ের হবে। আত্মপক্ষ সমর্থনের সেই বিচিত্র অভিজ্ঞতা এবার বর্ণনা করছি।
অসুস্থ হয়ে পড়ে যাওয়ার আগে সাকুল্যে মিনিট তিরিশেক সময় পেয়েছিলাম। বৈরী পরিস্থিতিতে এক একটি বাক্য শেষ করাই ছোটখাটো পাহাড় অতিক্রমের মতো দুরূহ লাগছিল। বাক্যের মাঝখানেই অনবরত অন্তত তিনজনের কাছ থেকে কথার তীর ছুটে আসছে। একজন ক্ষত তৈরি করছেন, অপরজন সেখানে বাটা মরিচের মলম লাগিয়ে দিচ্ছেন। স্কুলজীবনে হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মহাভারতে অভিমন্যু বধের গল্প পড়েছিলাম। তৃতীয় পাণ্ডব এবং কৃষ্ণসখা অর্জুনের ছেলে অভিমন্যু কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরব সেনাপতিদের ব্যূহের মধ্যে ঢুকে পড়ে আর জীবিত বের হতে পারেনি। সে ব্যূহের ভেতরে ঢোকার কৌশল জানতো কিন্তু ব্যূহ ভেদ করে বেরিয়ে আসার পদ্ধতি জানতো না। আমার আজকের অবস্থা অভিমন্যুর চেয়েও ভয়াবহ। অনেক বাধা পেরিয়ে ড. মিজানুর রহমান এবং ড. শাহদীন মালিকের বিচার বিভাগ সম্পর্কিত সাম্প্রতিক বক্তব্য পড়ে শোনাতে পারলাম। এ বছরেরই আগস্টের ১১ তারিখে ঢাকায় এক প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তারা দু’জন এদেশে স্বাধীন বিচারের নামে সাধারণ মানুষের প্রতি অবিচারের কঠোর সমালোচনা করেছেন। বর্তমান সরকারের সময় নিয়োগপ্রাপ্ত মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান প্রধান অতিথির বক্তৃতায় সেখানে বলেছেন, ‘দেশে আইনের শাসন সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। আইনের শাসন বলে কিছু নেই। যেখানে মানুষের বিচার পাওয়ার সুযোগ নেই, সেখানে কিসের বিচার? এখানে গরিব মানুষের জন্য আইন; যারা বড় ক্ষমতাসীন তাদের জন্য আইন নয়। জেল-জুলুম সেটা গরিব মানুষের জন্য। আজ দরিদ্র মানুষের চরম অনাস্থা বিচার বিভাগের প্রতি।’ একই বক্তৃতায় উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেছেন, ‘বিচার বিভাগ স্বেচ্ছায় পরাধীনতা বেছে নিচ্ছে। কিছু কিছু বিচারক আছেন যারা বিবেককে নাড়া দেন। কিন্তু তারা ক’জন? পুরো বিচারব্যবস্থার মধ্যে কিছু বিচারকের নাম বলতে পারলে তাদের দিয়ে কি ন্যায়বিচার সম্ভব? বিচারকের মানসিকতা দরিদ্র-বান্ধব না হলে সে আইন ও বিচার দিয়ে দরিদ্র মানুষের কল্যাণ হবে না।’ সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রধান ড. শাহদীন মালিক চেম্বার জজ আদালতের সমালোচনা করে একই অনুষ্ঠানে বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতির আদালতে যেভাবে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত হচ্ছে, এভাবে স্থগিত হওয়া উচিত নয়। ২০০৩ সাল পর্যন্ত হাইকোর্টের আদেশ স্টে করার প্র্যাকটিস ছিল না। এটা এখন ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে। হাইকোর্টে একটি মামলা পাঁচ-সাতদিনেরও বেশি সময় শুনানির পর চেম্বার জজের কাছে তা কয়েক সেকেন্ডের আদেশে স্টে হবে এটা ঠিক নয়। এটা শুধরাতে হবে। বর্তমানে চেম্বার জজের স্থগিত আদেশ বেশি বেড়ে গেছে। এটা কমানো উচিত। হাইকোর্টের আদেশের ওপর আপিল হলে তা স্টে না করে নিয়মিত আপিল শুনানি হওয়া প্রয়োজন।’ আমি উল্লেখ করলাম, ড. শাহদীন মালিকের বক্তব্যের সঙ্গে আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ‘চেম্বার মানেই সরকার পক্ষে স্টে’র কোনো গুণগত পার্থক্য নেই। পার্থক্য শুধু এটুকু, ড. শাহদীন মালিক তার মতামত দিয়েছেন আর আমার দেশ কতগুলো মামলার ঘটনা তুলে ধরেছে। দুই বিশিষ্ট ব্যক্তির বক্তব্য যে পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, সেই পত্রিকার কপি আদালতে এভিডেন্স (evidence) হিসেবে জমাও দিলাম।
সাপ্লিমেন্টারি এফিডেভিট হিসেবে ড. মিজানুর রহমান এবং ড. শাহদীন মালিকের বক্তব্য আদালতে উপস্থাপন করা মাত্র আগুনে ঘৃতাহুতির মতো প্রতিক্রিয়া হলো। চরম বিরক্তিসহকারে প্রধান বিচারপতি জানতে চাইলেন, এই সাপ্লিমেন্টারি এফিডেভিটের মাধ্যমে আমি কী প্রমাণ করতে চাইছি? মামলার পরিণতি আমি তো বুঝেই গেছি। সাহস সঞ্চয় করে বললাম, বিচার বিভাগ সম্পর্কে দেশের মানুষের মূল্যায়ন বোঝানোর জন্যই আমি এই সম্পূরক এফিডেভিট দাখিল করেছি। সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরীও কিছুদিন আগে এক অনুষ্ঠানে বিচার বিভাগকে কাচের ঘরের সঙ্গে তুলনা করে বক্তব্য দিয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে কাকতালীয়ভাবে বর্তমান প্রধান বিচারপতি উপস্থিত ছিলেন। আমি বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরীর বক্তব্য উদ্ধৃত করতে চাইলে তার অনুমতি মিললো না। পরবর্তী পনেরো মিনিট বেঞ্চ থেকে অপমানের চূড়ান্ত করা হলো আমাকে। আমি নিজেকে ‘এই-সেই’ মনে করি, সম্পাদক হওয়ার কী যোগ্যতা আছে আমার, আমি অ্যাপ্রেনটিস সাংবাদিক হওয়ার জন্য কখনও পরীক্ষা দিয়েছি কি-না, আমার তুচ্ছ শিক্ষা-দীক্ষা, আমি এতই অভব্য যে বিচারপতিদের নামের আগে মাননীয় লিখতে হয় তাও জানি না, সাংবাদিকতা না জানা আমি একজন চান্স বা দৈবক্রমে সম্পাদক (chance editor), ইত্যাকার আক্রমণে ধূলিসাত্ করে দেয়া হলো আমাকে। এই ব্রাশফায়ারের মাঝখানে বলার চেষ্টা করলাম যে, আমার এফিডেভিটে নিজের সম্পর্কে ‘এই-সেই’ জাতীয় কোনো শব্দ আমি ব্যবহার করিনি এবং অচেনা শব্দটির অর্থও আমার জানা নেই। বিচারকার্য পরিচালনাকালে দেশের উচ্চতম আদালতের লর্ডশিপ বিচারপতিরা যে এতখানি ক্রোধ ও আক্রোশ প্রকাশ করে থাকেন, সেটি আমার জানা ছিল না। আমি আইনজীবী নই, হয়তো এটাই আদালতের স্বাভাবিক রূপ। অব্যাহত আক্রমণের মধ্যেই আত্মপক্ষ সমর্থন চালিয়ে যাওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম। অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের মিথ্যা তথ্য দিয়ে চেম্বার জজ আদালতে প্রভাব খাটিয়ে হাইকোর্টের দেয়া জামিন স্টে করার প্রমাণও দিলাম। আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতার প্রতিও আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার সব চেষ্টাই বিফলে গেল, মাননীয় বিচারপতিরা তাদের অবস্থানে অটল রইলেন। তাদের একই কথা। সংবাদের সত্য-মিথ্যা দেখতে তারা বসেননি। বিচারপতি এমএ মতিন রুলিং দিলেন, আদালত অবমাননা মামলায় সত্য কোনো কৈফিয়ত নয় (truth is no defence)। সংবাদ প্রকাশে আদালতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে কি-না, একমাত্র সেটাই তারা বিচার করতে বসেছেন। আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য প্রদানকালে defence শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করা যাবে না বলা হলে ক্ষীণ কণ্ঠে জানতে চেয়েছিলাম, তাহলে show cause করার আর অর্থ কী, সরকারপক্ষের একতরফা অভিযোগের ভিত্তিতেই তো রায় দেয়া সম্ভব। চার মাননীয় বিচারপতির মিলিত আক্রমণ এবং পাশ থেকে অ্যাটর্নি জেনারেলের নেতৃত্বে প্রসিকিউশন বেঞ্চের বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য ও হাসির তোড়ে আমার ক্ষীণ কণ্ঠ চাপা পড়ে গেল। চারপাশ থেকে আঘাতের পর আঘাত ঠেকানোর ব্যর্থ চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত পরাজিত হতেই হলো। চরম বৈরী পরিবেশে কেবল মনের জোরে টিকে থাকা অসম্ভব বোধ হলো। গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হলাম। দীর্ঘ পাঁচদিন রাতে না ঘুমিয়ে থাকা, রোজার উপবাসজনিত দুর্বলতা এবং মানসিক চাপে শরীর ভেঙে পড়তে চাইলো। আমি মাইক স্ট্যান্ড ধরে পতন রোধ করতে চাইলাম। ডানদিকে আমার পক্ষের আইনজীবীদের বেঞ্চের দিকে পড়ে যাওয়ার আগে অনুভব করলাম রক্তচাপ দ্রুত নেমে যাচ্ছে। বেঞ্চের ওপর পড়ে গেলে রাজ্জাক ভাই এবং মওদুদ ভাই বোধহয় আমাকে প্রথম ধরলেন। ঘামে সমস্ত শরীর ভিজে গেছে, বিচারপতিরা চেয়ার ছেড়ে উঠে এজলাস ত্যাগ করলেন। মনে হলো, অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলমের গলা শুনলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করছেন আমার ডায়াবেটিস আছে কি-না। ততক্ষণে ফরহাদ ভাই তার কাঁধের চাদর পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে এসেছেন। বন্ধু বাবলুও দৌড়ে এলো পেছন থেকে। ভিড়ের মধ্যে সাবেক উপমন্ত্রী এবং গুলশানে আমার প্রতিবেশী রুহুল কুদ্দুস দুলুকেও বোধহয় দেখতে পেলাম। ফরহাদ ভাই তার ভেজা চাদর দিয়ে মুখ, মাথা মুছে দিলে খানিকটা সুস্থবোধ করলাম। এর মধ্যে সুপ্রিমকোর্ট বারের ডাক্তার চলে এসেছেন। রক্তচাপ মাপা হলো, আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। উপরেরটা ৯০ এবং নিচেরটা ৬০। ডাক্তার বললেন, এখনই ইন্ট্রাভেনাস স্যালাইন দিতে হবে। রাজ্জাক ভাই হাদিস উল্লেখ করে রোজা ভাঙতে অনুরোধ করলেন। আমি সম্মত না হয়ে আল্লাহর রহমতের ওপর ভরসা করে রইলাম। আধঘণ্টা বিশ্রামেই শরীরে দাঁড়ানোর মতো জোর পেলাম। মওদুদ ভাই, রফিক ভাই, মোহাম্মদ আলী ভাই, আদিলুর রহমান খান শুভ্র আমার শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় পরদিন সকাল পর্যন্ত সময় প্রার্থনা করার পরামর্শ দিলেন। মওদুদ ভাই বললেন, বিচারপতিরা এজলাসে ফিরলেই তিনি দাঁড়িয়ে আমার রক্তচাপের অবস্থা বর্ণনা করবেন এবং সুপ্রিমকোর্ট ডাক্তারের সার্টিফিকেট জমা দিয়ে সময় প্রার্থনা করবেন। ডাক্তারের সার্টিফিকেট আনানোও হলো।
দুপুর বারোটার খানিক পর প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতি পুনরায় আসন গ্রহণ করলেন। ব্যারিস্টার মওদুদ উঠে আমার শারীরিক অবস্থার কথা বলতে গিয়ে বেশ রূঢ়ভাবেই বাধাপ্রাপ্ত হলেন। বেঞ্চ থেকে নির্দেশ এলো, যা কিছু কথা আমাকেই বলতে হবে। এই অমানবিকতায় বিস্মিত হলেও সোজা হয়েই দাঁড়ালাম এবং মাইক স্ট্যান্ডে মওদুদ ভাইয়ের জায়গা নিলাম। আমার শরীরের অবস্থা জানার কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে প্রধান বিচারপতি বললেন, আমার আর কোনো বক্তব্য শোনার ইচ্ছা তাদের নেই, আমার আত্মপক্ষ সমর্থন সমাপ্ত হয়েছে, পণ্ডশ্রম করে আর কোনো ফায়দা নেই। বাদীপক্ষ চারদিন ধরে বাধাহীনভাবে তাদের যত কথা বলে গেছেন, আর কারাগারে বন্দি আমি মাত্র একটি ঘণ্টাও সময় পাব না। মাথা খুব একটা কাজ করছিল না। তবু ওই অবস্থাতেই প্রতিবাদ করে বসে পড়তে অস্বীকৃতি জানালাম। বললাম, আমার বক্তব্য যেহেতু শেষ হয়নি, কাজেই আমাকে আরও সময় দিতে হবে। আমি অসুস্থ এবং রোজাদার বিবেচনায় কাল সকাল পর্যন্ত সময় প্রার্থনা করছি; অন্যথায় অসুস্থ শরীরেই বক্তব্য চালিয়ে যাব। তাতে যদি আবারও জ্ঞান হারাতে হয় কোনো সমস্যা নেই। প্রধান বিচারপতি কী মনে করে সময়ের আবেদন মঞ্জুর করলেন। পরদিন সকালে আমার জন্যে মাত্র দশ মিনিট সময় বরাদ্দ হলো। মাননীয় প্রধান বিচারপতি ঘড়ি ধরে ঠিক দশ মিনিট আমার বক্তব্য শুনবেন। এ কথাটাও একাধিকবার বলে দেয়া হলো। আমি আর পাঁচটি মিনিট অতিরিক্ত সময় চাইলে সেই আবেদন অগ্রাহ্য করা হলো। সরকারপক্ষের জন্যে চারদিন আর আমার জন্যে আজকের চল্লিশ এবং আগামীকালের দশ মিলে সাকুল্যে পঞ্চাশ মিনিট। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের আইনের আশ্রয় লাভ করা এবং আইনের দৃষ্টিতে সমতার কথা আমাদের সংবিধানে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা রয়েছে। সংবিধান প্রদত্ত সেই অধিকার প্রাপ্তির কী চমত্কার উদাহরণই না আমাকে কেন্দ্র করে এখানে সৃষ্টি হচ্ছে!
এজলাস ছেড়ে প্রিজন ভ্যানের দিকে যাচ্ছি আর ভাবছি, কোর্টে আমার অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর শুনে জায়া ও জননীর হাল কী হবে। বাবলু, ফরহাদ ভাই আর শুভ্রকে আদালত থেকে সরাসরি আমার বাসায় যেতে অনুরোধ করলাম। আমি যে সামলে উঠেছি এবং বড় কোনো বিপদের ভয় নেই, সামনাসামনি এই সংবাদটি তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া খুব জরুরি। শুভানুধ্যায়ীদের উদ্বেগের মধ্যে রেখে কারও সাহায্য ছাড়াই প্রিজন ভ্যানে উঠলাম। জেলে ফেরার পথে প্রাচীন রোমের কথা বার বার মনে হচ্ছিল। রোমানরা একসময় অনাহারক্লিষ্ট বন্দিদের ক্ষুধার্ত সিংহের পালের সামনে ছেড়ে দিয়ে কলোসিয়ামে বসে মজা দেখতো। দু’হাজার বছর আগের সেই অসহায় বন্দিদের সঙ্গে নিজের বর্তমান অবস্থার কোনো পার্থক্য খুঁজে পেলাম না।
অসুস্থ হয়ে পড়ে যাওয়ার আগে সাকুল্যে মিনিট তিরিশেক সময় পেয়েছিলাম। বৈরী পরিস্থিতিতে এক একটি বাক্য শেষ করাই ছোটখাটো পাহাড় অতিক্রমের মতো দুরূহ লাগছিল। বাক্যের মাঝখানেই অনবরত অন্তত তিনজনের কাছ থেকে কথার তীর ছুটে আসছে। একজন ক্ষত তৈরি করছেন, অপরজন সেখানে বাটা মরিচের মলম লাগিয়ে দিচ্ছেন। স্কুলজীবনে হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মহাভারতে অভিমন্যু বধের গল্প পড়েছিলাম। তৃতীয় পাণ্ডব এবং কৃষ্ণসখা অর্জুনের ছেলে অভিমন্যু কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরব সেনাপতিদের ব্যূহের মধ্যে ঢুকে পড়ে আর জীবিত বের হতে পারেনি। সে ব্যূহের ভেতরে ঢোকার কৌশল জানতো কিন্তু ব্যূহ ভেদ করে বেরিয়ে আসার পদ্ধতি জানতো না। আমার আজকের অবস্থা অভিমন্যুর চেয়েও ভয়াবহ। অনেক বাধা পেরিয়ে ড. মিজানুর রহমান এবং ড. শাহদীন মালিকের বিচার বিভাগ সম্পর্কিত সাম্প্রতিক বক্তব্য পড়ে শোনাতে পারলাম। এ বছরেরই আগস্টের ১১ তারিখে ঢাকায় এক প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তারা দু’জন এদেশে স্বাধীন বিচারের নামে সাধারণ মানুষের প্রতি অবিচারের কঠোর সমালোচনা করেছেন। বর্তমান সরকারের সময় নিয়োগপ্রাপ্ত মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান প্রধান অতিথির বক্তৃতায় সেখানে বলেছেন, ‘দেশে আইনের শাসন সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। আইনের শাসন বলে কিছু নেই। যেখানে মানুষের বিচার পাওয়ার সুযোগ নেই, সেখানে কিসের বিচার? এখানে গরিব মানুষের জন্য আইন; যারা বড় ক্ষমতাসীন তাদের জন্য আইন নয়। জেল-জুলুম সেটা গরিব মানুষের জন্য। আজ দরিদ্র মানুষের চরম অনাস্থা বিচার বিভাগের প্রতি।’ একই বক্তৃতায় উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেছেন, ‘বিচার বিভাগ স্বেচ্ছায় পরাধীনতা বেছে নিচ্ছে। কিছু কিছু বিচারক আছেন যারা বিবেককে নাড়া দেন। কিন্তু তারা ক’জন? পুরো বিচারব্যবস্থার মধ্যে কিছু বিচারকের নাম বলতে পারলে তাদের দিয়ে কি ন্যায়বিচার সম্ভব? বিচারকের মানসিকতা দরিদ্র-বান্ধব না হলে সে আইন ও বিচার দিয়ে দরিদ্র মানুষের কল্যাণ হবে না।’ সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রধান ড. শাহদীন মালিক চেম্বার জজ আদালতের সমালোচনা করে একই অনুষ্ঠানে বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতির আদালতে যেভাবে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত হচ্ছে, এভাবে স্থগিত হওয়া উচিত নয়। ২০০৩ সাল পর্যন্ত হাইকোর্টের আদেশ স্টে করার প্র্যাকটিস ছিল না। এটা এখন ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে। হাইকোর্টে একটি মামলা পাঁচ-সাতদিনেরও বেশি সময় শুনানির পর চেম্বার জজের কাছে তা কয়েক সেকেন্ডের আদেশে স্টে হবে এটা ঠিক নয়। এটা শুধরাতে হবে। বর্তমানে চেম্বার জজের স্থগিত আদেশ বেশি বেড়ে গেছে। এটা কমানো উচিত। হাইকোর্টের আদেশের ওপর আপিল হলে তা স্টে না করে নিয়মিত আপিল শুনানি হওয়া প্রয়োজন।’ আমি উল্লেখ করলাম, ড. শাহদীন মালিকের বক্তব্যের সঙ্গে আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ‘চেম্বার মানেই সরকার পক্ষে স্টে’র কোনো গুণগত পার্থক্য নেই। পার্থক্য শুধু এটুকু, ড. শাহদীন মালিক তার মতামত দিয়েছেন আর আমার দেশ কতগুলো মামলার ঘটনা তুলে ধরেছে। দুই বিশিষ্ট ব্যক্তির বক্তব্য যে পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, সেই পত্রিকার কপি আদালতে এভিডেন্স (evidence) হিসেবে জমাও দিলাম।
সাপ্লিমেন্টারি এফিডেভিট হিসেবে ড. মিজানুর রহমান এবং ড. শাহদীন মালিকের বক্তব্য আদালতে উপস্থাপন করা মাত্র আগুনে ঘৃতাহুতির মতো প্রতিক্রিয়া হলো। চরম বিরক্তিসহকারে প্রধান বিচারপতি জানতে চাইলেন, এই সাপ্লিমেন্টারি এফিডেভিটের মাধ্যমে আমি কী প্রমাণ করতে চাইছি? মামলার পরিণতি আমি তো বুঝেই গেছি। সাহস সঞ্চয় করে বললাম, বিচার বিভাগ সম্পর্কে দেশের মানুষের মূল্যায়ন বোঝানোর জন্যই আমি এই সম্পূরক এফিডেভিট দাখিল করেছি। সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরীও কিছুদিন আগে এক অনুষ্ঠানে বিচার বিভাগকে কাচের ঘরের সঙ্গে তুলনা করে বক্তব্য দিয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে কাকতালীয়ভাবে বর্তমান প্রধান বিচারপতি উপস্থিত ছিলেন। আমি বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরীর বক্তব্য উদ্ধৃত করতে চাইলে তার অনুমতি মিললো না। পরবর্তী পনেরো মিনিট বেঞ্চ থেকে অপমানের চূড়ান্ত করা হলো আমাকে। আমি নিজেকে ‘এই-সেই’ মনে করি, সম্পাদক হওয়ার কী যোগ্যতা আছে আমার, আমি অ্যাপ্রেনটিস সাংবাদিক হওয়ার জন্য কখনও পরীক্ষা দিয়েছি কি-না, আমার তুচ্ছ শিক্ষা-দীক্ষা, আমি এতই অভব্য যে বিচারপতিদের নামের আগে মাননীয় লিখতে হয় তাও জানি না, সাংবাদিকতা না জানা আমি একজন চান্স বা দৈবক্রমে সম্পাদক (chance editor), ইত্যাকার আক্রমণে ধূলিসাত্ করে দেয়া হলো আমাকে। এই ব্রাশফায়ারের মাঝখানে বলার চেষ্টা করলাম যে, আমার এফিডেভিটে নিজের সম্পর্কে ‘এই-সেই’ জাতীয় কোনো শব্দ আমি ব্যবহার করিনি এবং অচেনা শব্দটির অর্থও আমার জানা নেই। বিচারকার্য পরিচালনাকালে দেশের উচ্চতম আদালতের লর্ডশিপ বিচারপতিরা যে এতখানি ক্রোধ ও আক্রোশ প্রকাশ করে থাকেন, সেটি আমার জানা ছিল না। আমি আইনজীবী নই, হয়তো এটাই আদালতের স্বাভাবিক রূপ। অব্যাহত আক্রমণের মধ্যেই আত্মপক্ষ সমর্থন চালিয়ে যাওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম। অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের মিথ্যা তথ্য দিয়ে চেম্বার জজ আদালতে প্রভাব খাটিয়ে হাইকোর্টের দেয়া জামিন স্টে করার প্রমাণও দিলাম। আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতার প্রতিও আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার সব চেষ্টাই বিফলে গেল, মাননীয় বিচারপতিরা তাদের অবস্থানে অটল রইলেন। তাদের একই কথা। সংবাদের সত্য-মিথ্যা দেখতে তারা বসেননি। বিচারপতি এমএ মতিন রুলিং দিলেন, আদালত অবমাননা মামলায় সত্য কোনো কৈফিয়ত নয় (truth is no defence)। সংবাদ প্রকাশে আদালতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে কি-না, একমাত্র সেটাই তারা বিচার করতে বসেছেন। আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য প্রদানকালে defence শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করা যাবে না বলা হলে ক্ষীণ কণ্ঠে জানতে চেয়েছিলাম, তাহলে show cause করার আর অর্থ কী, সরকারপক্ষের একতরফা অভিযোগের ভিত্তিতেই তো রায় দেয়া সম্ভব। চার মাননীয় বিচারপতির মিলিত আক্রমণ এবং পাশ থেকে অ্যাটর্নি জেনারেলের নেতৃত্বে প্রসিকিউশন বেঞ্চের বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য ও হাসির তোড়ে আমার ক্ষীণ কণ্ঠ চাপা পড়ে গেল। চারপাশ থেকে আঘাতের পর আঘাত ঠেকানোর ব্যর্থ চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত পরাজিত হতেই হলো। চরম বৈরী পরিবেশে কেবল মনের জোরে টিকে থাকা অসম্ভব বোধ হলো। গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হলাম। দীর্ঘ পাঁচদিন রাতে না ঘুমিয়ে থাকা, রোজার উপবাসজনিত দুর্বলতা এবং মানসিক চাপে শরীর ভেঙে পড়তে চাইলো। আমি মাইক স্ট্যান্ড ধরে পতন রোধ করতে চাইলাম। ডানদিকে আমার পক্ষের আইনজীবীদের বেঞ্চের দিকে পড়ে যাওয়ার আগে অনুভব করলাম রক্তচাপ দ্রুত নেমে যাচ্ছে। বেঞ্চের ওপর পড়ে গেলে রাজ্জাক ভাই এবং মওদুদ ভাই বোধহয় আমাকে প্রথম ধরলেন। ঘামে সমস্ত শরীর ভিজে গেছে, বিচারপতিরা চেয়ার ছেড়ে উঠে এজলাস ত্যাগ করলেন। মনে হলো, অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলমের গলা শুনলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করছেন আমার ডায়াবেটিস আছে কি-না। ততক্ষণে ফরহাদ ভাই তার কাঁধের চাদর পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে এসেছেন। বন্ধু বাবলুও দৌড়ে এলো পেছন থেকে। ভিড়ের মধ্যে সাবেক উপমন্ত্রী এবং গুলশানে আমার প্রতিবেশী রুহুল কুদ্দুস দুলুকেও বোধহয় দেখতে পেলাম। ফরহাদ ভাই তার ভেজা চাদর দিয়ে মুখ, মাথা মুছে দিলে খানিকটা সুস্থবোধ করলাম। এর মধ্যে সুপ্রিমকোর্ট বারের ডাক্তার চলে এসেছেন। রক্তচাপ মাপা হলো, আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। উপরেরটা ৯০ এবং নিচেরটা ৬০। ডাক্তার বললেন, এখনই ইন্ট্রাভেনাস স্যালাইন দিতে হবে। রাজ্জাক ভাই হাদিস উল্লেখ করে রোজা ভাঙতে অনুরোধ করলেন। আমি সম্মত না হয়ে আল্লাহর রহমতের ওপর ভরসা করে রইলাম। আধঘণ্টা বিশ্রামেই শরীরে দাঁড়ানোর মতো জোর পেলাম। মওদুদ ভাই, রফিক ভাই, মোহাম্মদ আলী ভাই, আদিলুর রহমান খান শুভ্র আমার শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় পরদিন সকাল পর্যন্ত সময় প্রার্থনা করার পরামর্শ দিলেন। মওদুদ ভাই বললেন, বিচারপতিরা এজলাসে ফিরলেই তিনি দাঁড়িয়ে আমার রক্তচাপের অবস্থা বর্ণনা করবেন এবং সুপ্রিমকোর্ট ডাক্তারের সার্টিফিকেট জমা দিয়ে সময় প্রার্থনা করবেন। ডাক্তারের সার্টিফিকেট আনানোও হলো।
দুপুর বারোটার খানিক পর প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতি পুনরায় আসন গ্রহণ করলেন। ব্যারিস্টার মওদুদ উঠে আমার শারীরিক অবস্থার কথা বলতে গিয়ে বেশ রূঢ়ভাবেই বাধাপ্রাপ্ত হলেন। বেঞ্চ থেকে নির্দেশ এলো, যা কিছু কথা আমাকেই বলতে হবে। এই অমানবিকতায় বিস্মিত হলেও সোজা হয়েই দাঁড়ালাম এবং মাইক স্ট্যান্ডে মওদুদ ভাইয়ের জায়গা নিলাম। আমার শরীরের অবস্থা জানার কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে প্রধান বিচারপতি বললেন, আমার আর কোনো বক্তব্য শোনার ইচ্ছা তাদের নেই, আমার আত্মপক্ষ সমর্থন সমাপ্ত হয়েছে, পণ্ডশ্রম করে আর কোনো ফায়দা নেই। বাদীপক্ষ চারদিন ধরে বাধাহীনভাবে তাদের যত কথা বলে গেছেন, আর কারাগারে বন্দি আমি মাত্র একটি ঘণ্টাও সময় পাব না। মাথা খুব একটা কাজ করছিল না। তবু ওই অবস্থাতেই প্রতিবাদ করে বসে পড়তে অস্বীকৃতি জানালাম। বললাম, আমার বক্তব্য যেহেতু শেষ হয়নি, কাজেই আমাকে আরও সময় দিতে হবে। আমি অসুস্থ এবং রোজাদার বিবেচনায় কাল সকাল পর্যন্ত সময় প্রার্থনা করছি; অন্যথায় অসুস্থ শরীরেই বক্তব্য চালিয়ে যাব। তাতে যদি আবারও জ্ঞান হারাতে হয় কোনো সমস্যা নেই। প্রধান বিচারপতি কী মনে করে সময়ের আবেদন মঞ্জুর করলেন। পরদিন সকালে আমার জন্যে মাত্র দশ মিনিট সময় বরাদ্দ হলো। মাননীয় প্রধান বিচারপতি ঘড়ি ধরে ঠিক দশ মিনিট আমার বক্তব্য শুনবেন। এ কথাটাও একাধিকবার বলে দেয়া হলো। আমি আর পাঁচটি মিনিট অতিরিক্ত সময় চাইলে সেই আবেদন অগ্রাহ্য করা হলো। সরকারপক্ষের জন্যে চারদিন আর আমার জন্যে আজকের চল্লিশ এবং আগামীকালের দশ মিলে সাকুল্যে পঞ্চাশ মিনিট। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের আইনের আশ্রয় লাভ করা এবং আইনের দৃষ্টিতে সমতার কথা আমাদের সংবিধানে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা রয়েছে। সংবিধান প্রদত্ত সেই অধিকার প্রাপ্তির কী চমত্কার উদাহরণই না আমাকে কেন্দ্র করে এখানে সৃষ্টি হচ্ছে!
এজলাস ছেড়ে প্রিজন ভ্যানের দিকে যাচ্ছি আর ভাবছি, কোর্টে আমার অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর শুনে জায়া ও জননীর হাল কী হবে। বাবলু, ফরহাদ ভাই আর শুভ্রকে আদালত থেকে সরাসরি আমার বাসায় যেতে অনুরোধ করলাম। আমি যে সামলে উঠেছি এবং বড় কোনো বিপদের ভয় নেই, সামনাসামনি এই সংবাদটি তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া খুব জরুরি। শুভানুধ্যায়ীদের উদ্বেগের মধ্যে রেখে কারও সাহায্য ছাড়াই প্রিজন ভ্যানে উঠলাম। জেলে ফেরার পথে প্রাচীন রোমের কথা বার বার মনে হচ্ছিল। রোমানরা একসময় অনাহারক্লিষ্ট বন্দিদের ক্ষুধার্ত সিংহের পালের সামনে ছেড়ে দিয়ে কলোসিয়ামে বসে মজা দেখতো। দু’হাজার বছর আগের সেই অসহায় বন্দিদের সঙ্গে নিজের বর্তমান অবস্থার কোনো পার্থক্য খুঁজে পেলাম না।
No comments