৩২- প্রধানমন্ত্রীসহ চারজন মন্ত্রী নারী হলেও নারীর সম্ভ্রমের মর্যাদার প্রমাণ দেশবাসী পায়নি
পারভীনকে নিবৃত্ত করলাম
চ্যাম্পিয়ন দলবাজ প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ক’দিন আগে জাঁক করে বলেছেন, উচ্চ আদালতের বিচারপতিরা নাকি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। সেই দায়বদ্ধতা কী প্রকারে প্রমাণিত হবে, সেটা অবশ্য তিনি খোলাসা করে বলেননি। পারভীন তাকে পত্র দিয়ে সেই দায়বদ্ধতার প্রমাণ নেয়ার প্রস্তাব করলে অনেক ভেবেচিন্তে তাকে নিবৃত্ত করলাম। এই সরকারে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নারী হলেও নারীর সম্ভ্রমের কোনো রকম মর্যাদা যে তাদের কাছে আছে, গত দুই বছরে দেশবাসী তার কোনো প্রমাণ পায়নি।
চ্যাম্পিয়ন দলবাজ প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ক’দিন আগে জাঁক করে বলেছেন, উচ্চ আদালতের বিচারপতিরা নাকি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। সেই দায়বদ্ধতা কী প্রকারে প্রমাণিত হবে, সেটা অবশ্য তিনি খোলাসা করে বলেননি। পারভীন তাকে পত্র দিয়ে সেই দায়বদ্ধতার প্রমাণ নেয়ার প্রস্তাব করলে অনেক ভেবেচিন্তে তাকে নিবৃত্ত করলাম। এই সরকারে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নারী হলেও নারীর সম্ভ্রমের কোনো রকম মর্যাদা যে তাদের কাছে আছে, গত দুই বছরে দেশবাসী তার কোনো প্রমাণ পায়নি।
ঢাকা থেকে কাশিমপুর জেলে চালানের গল্প দিয়ে আমার জেল জীবনের দ্বিতীয় পর্ব আরম্ভ করেছিলাম। ভাবতে পারিনি মাত্র তিন মাস পাঁচদিনের মাথায় দ্বিতীয় চালানের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করব। জানুয়ারির ২০ তারিখ, সকাল দশটার খানিক পর ডেপুটি জেলার নূর মোহাম্মদ, বড় সুবেদার মোসলেম বিষণ্ন চেহারা নিয়ে এসে আমাকে গাজীপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলে পাঠিয়ে দেয়ার খবর দিল। প্রায় আট মাসের বন্দি জীবনে সবকিছু কেমন যেন গা সওয়া হয়ে গেছে। প্রথম চালানের খবরে ঢাকায় যেমন চমকে উঠেছিলাম, আজ তার কিছুই হলো না। এই ক’দিনের দুনিয়ায় সব আবাসস্থলই একেকটি মুসাফিরখানা।
কালবিলম্ব না করে কালাম আর হাতেমকে নিয়ে গোছগাছে লেগে গেলাম। দেয়ালঘেরা কারাগারে খবর রটতে সময় লাগে না। প্রতি বিকেলের চা পর্বের সঙ্গী মানিক খবর পেয়ে কাঁদো কাঁদো মুখে এসে হাজির হলো। সম্পত্তির মধ্যে বইয়ের সংখ্যাই বেশি। ওগুলো ব্যাগে ভর্তি করার আগেই সুপার টিপু সুলতান বিদায়ী সাক্ষাতে এসে জানাল, আমার এই সেলে বিএনপি’র স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী আসছেন। তিনি চট্টগ্রাম জেল থেকে সকালে রওয়ানা হয়েও গেছেন। অতএব, ওপরের নির্দেশে আমাকে আর কাশিমপুর জেলে রাখা চলবে না।
এক এগারোর সময় এই ডিভিশন ওয়ার্ডেই বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের ডজনেরও অধিক ভিআইপি নেতা একসঙ্গে মিলেমিশেই ছিলেন। এখন কেন মাত্র দু’জনকেও একত্রে রাখা যাবে না, তার জবাব সাহারা খাতুনই ভালো জানেন। আওয়ামী লীগের জাত সমস্যা হলো একবার রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে পেলে তারা দেশটিকে পৈতৃক সম্পত্তি বিবেচনা করতে আরম্ভ করেন। মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার এমনতর চিন্তার তবু একটা যুক্তি থাকতে পারে। তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা কেন একই মানসিক রোগে আক্রান্ত হন, তার জবাব খুঁজতে হলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। হয়তো দিনরাত জাতির পিতা নাম জপতে জপতে জন্মদাতা পিতাকে বিস্মৃত হয়ে তারাও মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানকেই নিজের পিতা ভাবতে শুরু করেন। সেই সম্পর্কের জোরে আওয়ামী লীগার মাত্রই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির মালিক বনে যান।
এক ঘণ্টার মধ্যেই মুসাফিরের গাঁটরি বাঁধা শেষ। মধ্যাহ্নের আহারও চলে এলো নির্ধারিত সময়ের অনেক আগে। খেতে ইচ্ছে না করলেও এতগুলো সহৃদয় মানুষের ব্যাকুল অনুরোধ উপেক্ষা করা গেল না। দুপুর দুটোয় এসকর্টসহ যান প্রস্তুত হলো। বিদায়ের সময় মানিক, কালাম তো কাঁদলই, জেল কর্মকর্তাদের চোখেও মনে হলো অশ্রুর আভাস। মাত্র তিন মাসের মধ্যে কত অচেনা মানুষ কতই না আপন হয়ে গেছে। ডেপুটি জেলর মুশফিক, ছোট সুবেদার সাত্তার জেলগেটের বাইরে অপেক্ষমাণ মাইক্রোবাসে তুলে দিল। এই জেলে আমাকে প্রথম দিন গ্রহণ করা তখন বড় সুবেদারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাত্তারের খুব শখ ছিল আমার মুক্তির দিনে বিদায় জানানোর। আজ বিদায় অবশ্য জানাল কিন্তু এই বিদায়ের রূপ আলাদা। সেই কারণে সুবেদার সাত্তারের চোখে-মুখে আনন্দের পরিবর্তে বিষাদের ছায়া।
প্রিজনভ্যানের পরিবর্তে আজ এক জেল থেকে অন্য জেলে মাইক্রোবাসে নেয়া হচ্ছে দেখে অবাক হলাম। হয়তো কাশিমপুর জেল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে আমার জন্য এটা এক ধরনের বিদায় উপহার। মনে মনে এখনকার সবাইকে ধন্যবাদ জানালাম। কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে গাজীপুর ডিস্ট্রিক্ট জেল গাড়িতে মাত্র পনেরো মিনিটের রাস্তা। হাবিলদারসহ তিন পুলিশ এসকর্টের সঙ্গে কুশল বিনিময় পর্ব শেষ না হতেই পথ ফুরিয়ে গেল। এলাম নতুন আবাসে। জেলর সিরাজুল ইসলাম, ডেপুটি জেলর শিরিন, ডেপুটি জেলর সেলিম এবং সুবেদার কুদ্দুসের সঙ্গে কারা অফিসে পরিচয় শেষে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো ডিভিশন সেলে। অবিকল কক্সবাজার কারাগারের মতোই ব্যবস্থা। দুই মুখোমুখি সেল নিয়ে একতলা ডিভিশন ওয়ার্ড। আমার ঠাঁই হলো পশ্চিমদিকের সেলে। অন্য সেলটি দেখলাম সুবেদারের বিশ্রাম কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাছাড়া, জেলের যাবতীয় ডাণ্ডাবেড়ি এবং আরও কিছু যন্ত্রপাতি রাখার স্টোর রুমও সেটি।
আমার সেলে যথারীতি উঁচু-নিচু তোষকসহ একটা চৌকি এবং টেবিল-চেয়ার, বড় বড় জানালায় পাতলা মার্কিন কাপড়ের পর্দা ঝুলিয়ে কিছুটা আব্রু রক্ষার ব্যবস্থা। সার্বিক অবস্থা কাশিমপুরের তুলনায় বেশ অসুবিধাজনক, তবে ঢাকার সাত নম্বর সেলের তুলনায় অবশ্যই উত্তম। নানান জেলে প্রায় আট মাস কাটানোর পর নতুন জেলে চালানে এসে কোনো রকম সমস্যা বোধ না করলেও বাড়ির কথা ভেবে খানিকটা উদ্বিগ্ন লাগছিল। আজ বৃহস্পতিবার, সাপ্তাহিক দেখার দু’দিন এখনও বাকি রয়েছে। এর মধ্যে পারভীন চালানের খবর পাবে কিনা, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। অবশ্য কাশিমপুর জেল প্রশাসনের জনে জনে খবরটা পৌঁছানোর অনুরোধ করে এসেছি। ওদের মধ্য থেকে কোনো সহৃদয় কর্মকর্তা যদি অনুরোধটা রক্ষা করে, তাহলেই বাঁচোয়া।
সন্ধ্যার লক-আপ পর্যন্ত জেলের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজনের আনাগোনা চলল। ডেপুটি জেলর জিজ্ঞাসা করে গেল আমার কিংবা মুখোমুখি সেলে কোনো কয়েদিকে রাতে ফাই-ফরমাশ খাটার জন্য রাখতে হবে কিনা। জবাবে একা থাকতে পারার অভ্যাসের কথা জানালাম। ঠিক ছ’টায় তালা লাগিয়ে সুবেদার বিদায় নিল। ডিভিশন সেলে রইলাম আমি এবং দেয়ালের চারপাশ দিয়ে হেঁটে চলা রাতের প্রহরী। নতুন জায়গায় প্রথম রাতে ঘুমের স্বাভাবিক সমস্যার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেলাম না। বাড়ির লোকজনকে নিয়েই, বেশি চিন্তা হচ্ছিল। আমি যে জেলে প্রকৃতই ভালোভাবে মানিয়ে নিয়েছি এটা মা কিংবা বৌ কাউকেই বিশ্বাস করাতে পারি না। নতুন কোনো জেলে গেলেই অজানা আশঙ্কায় তাদের আহার-নিদ্রা বন্ধ হয়ে যায়। আসলে শেখ হাসিনা আমার প্রতি যত না জুলুম করছেন, তার শতগুণ করছেন আমার পরিবারের সদস্যদের ওপর।
গাজীপুর জেলের দ্বিতীয় দিনেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আমার চালানের খবর পেয়ে পারভীন আজ দেখা করতে চেয়েছিল। কিন্তু, কর্তৃপক্ষের অনুমতি মেলেনি। দেখা করতে না দেয়ার কারণটিও চমত্কৃত হওয়ার মতো। কাশিমপুর জেলে আমার সাপ্তাহিক দেখার দিন নির্ধারিত ছিল শনিবার। সেখানকার তিন মাস জেলজীবনে কোনো সপ্তাহেই যে তার ব্যত্যয় হয়নি, বিষয়টি সে রকম নয়। যে সপ্তাহে শনিবারের পরিবর্তে শুক্রবার পারভীন আসত, সেই সপ্তাহে কারাবিধি অনুযায়ী শনিবার আর দেখা হতো না। মোদ্দা কথা হলো, একজন ডিভিশন কয়েদি সপ্তাহে একবারই মাত্র আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পায়। এখানকার কর্তারা কাশিমপুর থেকে খবর নিয়ে যেই জেনেছে ওখানে সাধারণত শনিবার দেখার ব্যবস্থা ছিল, অমনি পারভীনের অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়ে তাকে আগামীকাল আসতে বলেছে। নতুন জেলে আমার হাল-অবস্থা জানার জন্য জননী এবং জায়া অস্থির হয়ে থাকলেও প্রশাসনের লোকজনের তাতে কোনো মাথা-ব্যথা নেই। এদের ভাবখানা দেখে মনে হলো, এই সপ্তাহে শনিবারের পরিবর্তে একদিন আগে শুক্রবারে দেখা করতে দিলে হয়তো তারা ভেবেছে গাজীপুর জেলের মাথার ওপর আস্ত আকাশখানা ভেঙে পড়ত। এদের বোঝানোর সাধ্য আমার নেই। এসব কর্মকর্তা মাছি মারা কেরানিরও অধম। এটুকুও তাদের মাথায় ঢুকল না, এ সপ্তাহে শুক্রবারে দেখা করতে দিলেও আগামী সপ্তাহে আবার সেটি শনিবারেই ঘটছে। অর্থাত্ সপ্তাহে একবার দেখা করার যে বিধি, সেটি কোনোক্রমেই লঙ্ঘিত হচ্ছে না। অসহায় আসামির অক্ষম ক্রোধ হজম করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। তিনজন মানুষের যার যার উদ্বেগ বুকের মধ্যে চেপে রেখে আরও চব্বিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে।
শনিবারে মা আর পারভীনের সঙ্গে দেখা হলো। দুই অসহায় নারীকে আমার জন্য জেল থেকে জেলে ছুটে বেড়াতে হচ্ছে। পারভীনের কাছ থেকে শুনলাম, বাংলাদেশ ব্যাংক নাকি ঢাকা, গাজীপুর, নরসিংদী, রাজশাহী এবং মানিকগঞ্জে ওর আর আমার কোনো লুকানো ব্যাংক একাউন্ট আছে কিনা সেটি খুঁজে বের করার জন্য চিরুণি অভিযান চালাচ্ছে। ঢাকায় সারাজীবন কাটিয়েছি, আর মানিকগঞ্জ পারভীনের পিতার এলাকা। এই দুই জায়গায় ব্যাংক একাউন্ট খোঁজার তবু একটা কারণ খুঁজে পেলাম। কিন্তু গাজীপুর, নরসিংদী এবং রাজশাহীর মাজেজা বুঝলাম না। দেশের বাকি জেলাগুলোই বা দোষ করল কী, তাও বুদ্ধির অগম্য। অন্তত আমার পিতা ও মাতার জেলা যথাক্রমে কুমিল্লা এবং রাজবাড়ী বাদ যাওয়ার জন্য তো স্বয়ং গভর্নরের চাকরি যাওয়া উচিত। পারভীনকে বললাম, ড. আতিউরকে জেলা দুটির নাম পাঠিয়ে দিতে। এ দেশে ক্ষমতা হাতে পেয়েও কোনো ব্যক্তি যে সত্ জীবনযাপন করতে পারে, এটা বোধহয় বর্তমান নীতিনির্ধারকদের চিন্তার বাইরে। ব্যাপারটা অনেকটা অতি প্রত্যুষে নদীতে গোসল করতে যাওয়া সেই পুরনো চোর আর সাধুর দেখা হয়ে যাওয়ার গল্পের মতো। এত সকালে একে অপরকে দেখে চোর ভাবে সাধু চোর, আর সাধু ভাবে চোরও সাধু।
এদিকে প্রশাসনের লোকজনদের মধ্যেও আর যাই হোক শক্ত মেরুদণ্ডের কোনো অস্তিত্ব নেই। তারা যে সাহস করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়রানির বিরুদ্ধে একটা নৈতিক অবস্থান নেবে, সেই শক্তি কবেই হারিয়ে বসে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন! তিনি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তার ব্যক্তিগত ঘানিতে প্রস্তুত বিশেষ প্রকৃতির তৈল প্রদান করে যে লেখাটি পত্রিকাতে ছাপিয়েছেন, তার শিরোনাম পড়লেই আমাদের শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চরম নৈতিক অবক্ষয় ও নির্লজ্জ সুবিধাবাদী চরিত্রের দুর্ভাগ্যজনক চিত্র পরিষ্কার হয়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষক, বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের তোষামোদি লেখার শিরোনাম, ‘জন্মদিনের শুভেচ্ছা, নন্দিত সাহসী জনহিতৈষী শেখ হাসিনা।’ কি চমত্কার শিরোনাম, তাই না? কোথায় যেন পড়েছিলাম ড. আতিউর নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে জীবনের অনেক চড়াই-উত্রাই পার হয়ে তবেই এই পর্যায়ে পৌঁছেছেন। আমি নিজেও মধ্যবিত্ত, শিক্ষক পরিবার থেকে এসেছি। আপন অভিজ্ঞতায় দেখেছি যারা কষ্ট করে জীবনে দাঁড়ায়, সচরাচর তাদের আত্মসম্মানজ্ঞান তীব্র হয়ে থাকে। ড. আতিউরের কাণ্ডকীর্তি দেখে তাকে এ ব্যাপারে ব্যতিক্রমই বলতে হচ্ছে। অবশ্য আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এক বিশেষ প্রজাতি। আমাদের মতো আমজনতার নিয়ম তাদের ক্ষেত্রে খাটে না। এই সরকারকে বহুবার বলেছি আমার সাকুল্যে একটাই ব্যাংক একাউন্ট। তারপরও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কেন যে এই পণ্ডশ্রম করছেন, বুঝতে পারি না।
এদিকে চ্যাম্পিয়ন দলবাজ প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ক’দিন আগে জাঁক করে বলেছেন, উচ্চ আদালতের বিচারপতিরা নাকি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। সেই দায়বদ্ধতা কী প্রকারে প্রমাণিত হবে, সেটা অবশ্য তিনি খোলাসা করে বলেননি। পারভীন তাকে পত্র দিয়ে সেই দায়বদ্ধতার প্রমাণ নেয়ার প্রস্তাব করলে অনেক ভেবেচিন্তে তাকে নিবৃত্ত করলাম। এই সরকারে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নারী হলেও নারীর সম্ভ্রমের কোনো রকম মর্যাদা যে তাদের কাছে আছে, গত দুই বছরে দেশবাসী তার কোনো প্রমাণ পায়নি। সুতরাং, আমাদের দুই নারী এবং একজন পুরুষের ছোট সংসারে আপাতত লড়াইটা একমাত্র পুরুষই চালিয়ে যাক। ভবিষ্যতে তেমন পরিস্থিতির উদয় হলে নারীরা তো রইলেনই। প্রধান বিচারপতির যাবতীয় পরীক্ষাটাও তখনই নেয়া যাবে। সাক্ষাতের সময় শেষ হলে মা আর পারভীনকে বিদায় জানালাম।
তাদের বিদায়ের সময় জেলর সাহেব আমার পিঠে হাত রেখে এক প্রকার সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলেন। আচরণটি আমার মনঃপূত না হলেও ভদ্রলোককে তার অবস্থানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে মনে কষ্ট দিতে চাইলাম না। মুখে কৃত্রিম হাসি অনেক কষ্টে ধরে রাখলাম। এই জেলে আগমনের দিনেই তিনি যে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, এই তথ্যটি সহকর্মীদের জানাতে ভোলেননি। আমার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেও তিনি মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনিয়েছেন। কাজেই ভদ্রলোক আমার বয়োজ্যেষ্ঠ না হলেও অন্তত সমবয়সী হবেন। তার বন্ধুত্বের এই প্রকাশকে বয়সের মাপকাঠিতে বিবেচনা করে মেনেই নিলাম।
কালবিলম্ব না করে কালাম আর হাতেমকে নিয়ে গোছগাছে লেগে গেলাম। দেয়ালঘেরা কারাগারে খবর রটতে সময় লাগে না। প্রতি বিকেলের চা পর্বের সঙ্গী মানিক খবর পেয়ে কাঁদো কাঁদো মুখে এসে হাজির হলো। সম্পত্তির মধ্যে বইয়ের সংখ্যাই বেশি। ওগুলো ব্যাগে ভর্তি করার আগেই সুপার টিপু সুলতান বিদায়ী সাক্ষাতে এসে জানাল, আমার এই সেলে বিএনপি’র স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী আসছেন। তিনি চট্টগ্রাম জেল থেকে সকালে রওয়ানা হয়েও গেছেন। অতএব, ওপরের নির্দেশে আমাকে আর কাশিমপুর জেলে রাখা চলবে না।
এক এগারোর সময় এই ডিভিশন ওয়ার্ডেই বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের ডজনেরও অধিক ভিআইপি নেতা একসঙ্গে মিলেমিশেই ছিলেন। এখন কেন মাত্র দু’জনকেও একত্রে রাখা যাবে না, তার জবাব সাহারা খাতুনই ভালো জানেন। আওয়ামী লীগের জাত সমস্যা হলো একবার রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে পেলে তারা দেশটিকে পৈতৃক সম্পত্তি বিবেচনা করতে আরম্ভ করেন। মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার এমনতর চিন্তার তবু একটা যুক্তি থাকতে পারে। তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা কেন একই মানসিক রোগে আক্রান্ত হন, তার জবাব খুঁজতে হলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। হয়তো দিনরাত জাতির পিতা নাম জপতে জপতে জন্মদাতা পিতাকে বিস্মৃত হয়ে তারাও মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানকেই নিজের পিতা ভাবতে শুরু করেন। সেই সম্পর্কের জোরে আওয়ামী লীগার মাত্রই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির মালিক বনে যান।
এক ঘণ্টার মধ্যেই মুসাফিরের গাঁটরি বাঁধা শেষ। মধ্যাহ্নের আহারও চলে এলো নির্ধারিত সময়ের অনেক আগে। খেতে ইচ্ছে না করলেও এতগুলো সহৃদয় মানুষের ব্যাকুল অনুরোধ উপেক্ষা করা গেল না। দুপুর দুটোয় এসকর্টসহ যান প্রস্তুত হলো। বিদায়ের সময় মানিক, কালাম তো কাঁদলই, জেল কর্মকর্তাদের চোখেও মনে হলো অশ্রুর আভাস। মাত্র তিন মাসের মধ্যে কত অচেনা মানুষ কতই না আপন হয়ে গেছে। ডেপুটি জেলর মুশফিক, ছোট সুবেদার সাত্তার জেলগেটের বাইরে অপেক্ষমাণ মাইক্রোবাসে তুলে দিল। এই জেলে আমাকে প্রথম দিন গ্রহণ করা তখন বড় সুবেদারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাত্তারের খুব শখ ছিল আমার মুক্তির দিনে বিদায় জানানোর। আজ বিদায় অবশ্য জানাল কিন্তু এই বিদায়ের রূপ আলাদা। সেই কারণে সুবেদার সাত্তারের চোখে-মুখে আনন্দের পরিবর্তে বিষাদের ছায়া।
প্রিজনভ্যানের পরিবর্তে আজ এক জেল থেকে অন্য জেলে মাইক্রোবাসে নেয়া হচ্ছে দেখে অবাক হলাম। হয়তো কাশিমপুর জেল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে আমার জন্য এটা এক ধরনের বিদায় উপহার। মনে মনে এখনকার সবাইকে ধন্যবাদ জানালাম। কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে গাজীপুর ডিস্ট্রিক্ট জেল গাড়িতে মাত্র পনেরো মিনিটের রাস্তা। হাবিলদারসহ তিন পুলিশ এসকর্টের সঙ্গে কুশল বিনিময় পর্ব শেষ না হতেই পথ ফুরিয়ে গেল। এলাম নতুন আবাসে। জেলর সিরাজুল ইসলাম, ডেপুটি জেলর শিরিন, ডেপুটি জেলর সেলিম এবং সুবেদার কুদ্দুসের সঙ্গে কারা অফিসে পরিচয় শেষে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো ডিভিশন সেলে। অবিকল কক্সবাজার কারাগারের মতোই ব্যবস্থা। দুই মুখোমুখি সেল নিয়ে একতলা ডিভিশন ওয়ার্ড। আমার ঠাঁই হলো পশ্চিমদিকের সেলে। অন্য সেলটি দেখলাম সুবেদারের বিশ্রাম কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাছাড়া, জেলের যাবতীয় ডাণ্ডাবেড়ি এবং আরও কিছু যন্ত্রপাতি রাখার স্টোর রুমও সেটি।
আমার সেলে যথারীতি উঁচু-নিচু তোষকসহ একটা চৌকি এবং টেবিল-চেয়ার, বড় বড় জানালায় পাতলা মার্কিন কাপড়ের পর্দা ঝুলিয়ে কিছুটা আব্রু রক্ষার ব্যবস্থা। সার্বিক অবস্থা কাশিমপুরের তুলনায় বেশ অসুবিধাজনক, তবে ঢাকার সাত নম্বর সেলের তুলনায় অবশ্যই উত্তম। নানান জেলে প্রায় আট মাস কাটানোর পর নতুন জেলে চালানে এসে কোনো রকম সমস্যা বোধ না করলেও বাড়ির কথা ভেবে খানিকটা উদ্বিগ্ন লাগছিল। আজ বৃহস্পতিবার, সাপ্তাহিক দেখার দু’দিন এখনও বাকি রয়েছে। এর মধ্যে পারভীন চালানের খবর পাবে কিনা, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। অবশ্য কাশিমপুর জেল প্রশাসনের জনে জনে খবরটা পৌঁছানোর অনুরোধ করে এসেছি। ওদের মধ্য থেকে কোনো সহৃদয় কর্মকর্তা যদি অনুরোধটা রক্ষা করে, তাহলেই বাঁচোয়া।
সন্ধ্যার লক-আপ পর্যন্ত জেলের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজনের আনাগোনা চলল। ডেপুটি জেলর জিজ্ঞাসা করে গেল আমার কিংবা মুখোমুখি সেলে কোনো কয়েদিকে রাতে ফাই-ফরমাশ খাটার জন্য রাখতে হবে কিনা। জবাবে একা থাকতে পারার অভ্যাসের কথা জানালাম। ঠিক ছ’টায় তালা লাগিয়ে সুবেদার বিদায় নিল। ডিভিশন সেলে রইলাম আমি এবং দেয়ালের চারপাশ দিয়ে হেঁটে চলা রাতের প্রহরী। নতুন জায়গায় প্রথম রাতে ঘুমের স্বাভাবিক সমস্যার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেলাম না। বাড়ির লোকজনকে নিয়েই, বেশি চিন্তা হচ্ছিল। আমি যে জেলে প্রকৃতই ভালোভাবে মানিয়ে নিয়েছি এটা মা কিংবা বৌ কাউকেই বিশ্বাস করাতে পারি না। নতুন কোনো জেলে গেলেই অজানা আশঙ্কায় তাদের আহার-নিদ্রা বন্ধ হয়ে যায়। আসলে শেখ হাসিনা আমার প্রতি যত না জুলুম করছেন, তার শতগুণ করছেন আমার পরিবারের সদস্যদের ওপর।
গাজীপুর জেলের দ্বিতীয় দিনেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আমার চালানের খবর পেয়ে পারভীন আজ দেখা করতে চেয়েছিল। কিন্তু, কর্তৃপক্ষের অনুমতি মেলেনি। দেখা করতে না দেয়ার কারণটিও চমত্কৃত হওয়ার মতো। কাশিমপুর জেলে আমার সাপ্তাহিক দেখার দিন নির্ধারিত ছিল শনিবার। সেখানকার তিন মাস জেলজীবনে কোনো সপ্তাহেই যে তার ব্যত্যয় হয়নি, বিষয়টি সে রকম নয়। যে সপ্তাহে শনিবারের পরিবর্তে শুক্রবার পারভীন আসত, সেই সপ্তাহে কারাবিধি অনুযায়ী শনিবার আর দেখা হতো না। মোদ্দা কথা হলো, একজন ডিভিশন কয়েদি সপ্তাহে একবারই মাত্র আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পায়। এখানকার কর্তারা কাশিমপুর থেকে খবর নিয়ে যেই জেনেছে ওখানে সাধারণত শনিবার দেখার ব্যবস্থা ছিল, অমনি পারভীনের অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়ে তাকে আগামীকাল আসতে বলেছে। নতুন জেলে আমার হাল-অবস্থা জানার জন্য জননী এবং জায়া অস্থির হয়ে থাকলেও প্রশাসনের লোকজনের তাতে কোনো মাথা-ব্যথা নেই। এদের ভাবখানা দেখে মনে হলো, এই সপ্তাহে শনিবারের পরিবর্তে একদিন আগে শুক্রবারে দেখা করতে দিলে হয়তো তারা ভেবেছে গাজীপুর জেলের মাথার ওপর আস্ত আকাশখানা ভেঙে পড়ত। এদের বোঝানোর সাধ্য আমার নেই। এসব কর্মকর্তা মাছি মারা কেরানিরও অধম। এটুকুও তাদের মাথায় ঢুকল না, এ সপ্তাহে শুক্রবারে দেখা করতে দিলেও আগামী সপ্তাহে আবার সেটি শনিবারেই ঘটছে। অর্থাত্ সপ্তাহে একবার দেখা করার যে বিধি, সেটি কোনোক্রমেই লঙ্ঘিত হচ্ছে না। অসহায় আসামির অক্ষম ক্রোধ হজম করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। তিনজন মানুষের যার যার উদ্বেগ বুকের মধ্যে চেপে রেখে আরও চব্বিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে।
শনিবারে মা আর পারভীনের সঙ্গে দেখা হলো। দুই অসহায় নারীকে আমার জন্য জেল থেকে জেলে ছুটে বেড়াতে হচ্ছে। পারভীনের কাছ থেকে শুনলাম, বাংলাদেশ ব্যাংক নাকি ঢাকা, গাজীপুর, নরসিংদী, রাজশাহী এবং মানিকগঞ্জে ওর আর আমার কোনো লুকানো ব্যাংক একাউন্ট আছে কিনা সেটি খুঁজে বের করার জন্য চিরুণি অভিযান চালাচ্ছে। ঢাকায় সারাজীবন কাটিয়েছি, আর মানিকগঞ্জ পারভীনের পিতার এলাকা। এই দুই জায়গায় ব্যাংক একাউন্ট খোঁজার তবু একটা কারণ খুঁজে পেলাম। কিন্তু গাজীপুর, নরসিংদী এবং রাজশাহীর মাজেজা বুঝলাম না। দেশের বাকি জেলাগুলোই বা দোষ করল কী, তাও বুদ্ধির অগম্য। অন্তত আমার পিতা ও মাতার জেলা যথাক্রমে কুমিল্লা এবং রাজবাড়ী বাদ যাওয়ার জন্য তো স্বয়ং গভর্নরের চাকরি যাওয়া উচিত। পারভীনকে বললাম, ড. আতিউরকে জেলা দুটির নাম পাঠিয়ে দিতে। এ দেশে ক্ষমতা হাতে পেয়েও কোনো ব্যক্তি যে সত্ জীবনযাপন করতে পারে, এটা বোধহয় বর্তমান নীতিনির্ধারকদের চিন্তার বাইরে। ব্যাপারটা অনেকটা অতি প্রত্যুষে নদীতে গোসল করতে যাওয়া সেই পুরনো চোর আর সাধুর দেখা হয়ে যাওয়ার গল্পের মতো। এত সকালে একে অপরকে দেখে চোর ভাবে সাধু চোর, আর সাধু ভাবে চোরও সাধু।
এদিকে প্রশাসনের লোকজনদের মধ্যেও আর যাই হোক শক্ত মেরুদণ্ডের কোনো অস্তিত্ব নেই। তারা যে সাহস করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়রানির বিরুদ্ধে একটা নৈতিক অবস্থান নেবে, সেই শক্তি কবেই হারিয়ে বসে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন! তিনি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তার ব্যক্তিগত ঘানিতে প্রস্তুত বিশেষ প্রকৃতির তৈল প্রদান করে যে লেখাটি পত্রিকাতে ছাপিয়েছেন, তার শিরোনাম পড়লেই আমাদের শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চরম নৈতিক অবক্ষয় ও নির্লজ্জ সুবিধাবাদী চরিত্রের দুর্ভাগ্যজনক চিত্র পরিষ্কার হয়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষক, বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের তোষামোদি লেখার শিরোনাম, ‘জন্মদিনের শুভেচ্ছা, নন্দিত সাহসী জনহিতৈষী শেখ হাসিনা।’ কি চমত্কার শিরোনাম, তাই না? কোথায় যেন পড়েছিলাম ড. আতিউর নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে জীবনের অনেক চড়াই-উত্রাই পার হয়ে তবেই এই পর্যায়ে পৌঁছেছেন। আমি নিজেও মধ্যবিত্ত, শিক্ষক পরিবার থেকে এসেছি। আপন অভিজ্ঞতায় দেখেছি যারা কষ্ট করে জীবনে দাঁড়ায়, সচরাচর তাদের আত্মসম্মানজ্ঞান তীব্র হয়ে থাকে। ড. আতিউরের কাণ্ডকীর্তি দেখে তাকে এ ব্যাপারে ব্যতিক্রমই বলতে হচ্ছে। অবশ্য আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এক বিশেষ প্রজাতি। আমাদের মতো আমজনতার নিয়ম তাদের ক্ষেত্রে খাটে না। এই সরকারকে বহুবার বলেছি আমার সাকুল্যে একটাই ব্যাংক একাউন্ট। তারপরও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কেন যে এই পণ্ডশ্রম করছেন, বুঝতে পারি না।
এদিকে চ্যাম্পিয়ন দলবাজ প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ক’দিন আগে জাঁক করে বলেছেন, উচ্চ আদালতের বিচারপতিরা নাকি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। সেই দায়বদ্ধতা কী প্রকারে প্রমাণিত হবে, সেটা অবশ্য তিনি খোলাসা করে বলেননি। পারভীন তাকে পত্র দিয়ে সেই দায়বদ্ধতার প্রমাণ নেয়ার প্রস্তাব করলে অনেক ভেবেচিন্তে তাকে নিবৃত্ত করলাম। এই সরকারে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নারী হলেও নারীর সম্ভ্রমের কোনো রকম মর্যাদা যে তাদের কাছে আছে, গত দুই বছরে দেশবাসী তার কোনো প্রমাণ পায়নি। সুতরাং, আমাদের দুই নারী এবং একজন পুরুষের ছোট সংসারে আপাতত লড়াইটা একমাত্র পুরুষই চালিয়ে যাক। ভবিষ্যতে তেমন পরিস্থিতির উদয় হলে নারীরা তো রইলেনই। প্রধান বিচারপতির যাবতীয় পরীক্ষাটাও তখনই নেয়া যাবে। সাক্ষাতের সময় শেষ হলে মা আর পারভীনকে বিদায় জানালাম।
তাদের বিদায়ের সময় জেলর সাহেব আমার পিঠে হাত রেখে এক প্রকার সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলেন। আচরণটি আমার মনঃপূত না হলেও ভদ্রলোককে তার অবস্থানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে মনে কষ্ট দিতে চাইলাম না। মুখে কৃত্রিম হাসি অনেক কষ্টে ধরে রাখলাম। এই জেলে আগমনের দিনেই তিনি যে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, এই তথ্যটি সহকর্মীদের জানাতে ভোলেননি। আমার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেও তিনি মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনিয়েছেন। কাজেই ভদ্রলোক আমার বয়োজ্যেষ্ঠ না হলেও অন্তত সমবয়সী হবেন। তার বন্ধুত্বের এই প্রকাশকে বয়সের মাপকাঠিতে বিবেচনা করে মেনেই নিলাম।
No comments