৪২- ফ্যাসিবাদী সরকার যত গণবিচ্ছিন্ন হয় তাদের মধ্যে হিংস্রতা ততই বাড়তে থাকে
সুশাসন শব্দটি উচ্চারণ করাও নিরর্থক
....আবার অবৈধ অস্ত্র দিয়ে হত্যা করেও জায়গামত টাকা-পয়সা খরচ করলে কয়েক মাসের মধ্যেই জামিন পাওয়া কোনো সমস্যাই নয়। এমন বিচার বিভাগ যে দেশে থাকে এবং এই অবস্থাতেও সর্বোচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতিরা কোনোরকম লজ্জাবোধ না করে উল্টো পর্বতসমান অহমিকা প্রদর্শন করেন, সে দেশে ‘সুশাসন’ শব্দটি উচ্চারণ করাও নিরর্থক...
....আবার অবৈধ অস্ত্র দিয়ে হত্যা করেও জায়গামত টাকা-পয়সা খরচ করলে কয়েক মাসের মধ্যেই জামিন পাওয়া কোনো সমস্যাই নয়। এমন বিচার বিভাগ যে দেশে থাকে এবং এই অবস্থাতেও সর্বোচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতিরা কোনোরকম লজ্জাবোধ না করে উল্টো পর্বতসমান অহমিকা প্রদর্শন করেন, সে দেশে ‘সুশাসন’ শব্দটি উচ্চারণ করাও নিরর্থক...
রংপুরের করিমউদ্দিন ভরসার পুত্র কবির ভরসা আজ জামিনে মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। তার বিরুদ্ধে দু’টি মামলা ছিল। একটি আপন সহোদরকে গুলি করে হত্যা এবং দ্বিতীয়টি অবৈধ অস্ত্র রাখা। সাত নম্বর সেলের অন্যদের কাছ থেকে শুনেছি, ওই অবৈধ পিস্তলটি দিয়েই নাকি মাদকাসক্ত কবির ভরসা তার ছোট ভাইকে খুন করেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার ‘ইনসাফের’ বিশ্বে কোনো তুলনা নেই। এ দেশে এহসানুল হক মিলনের মতো সাবেক প্রতিমন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যকে মোবাইল চুরি, সোনার হার ছিনতাই, মূর্তি ভাংচুরের কথিত নির্দেশ প্রদানের অভিযোগ, ইত্যাকার আজগুবি মামলায় জামিন না দিয়ে মাসের পর মাস আটকে রাখা যায়। আবার অবৈধ অস্ত্র দিয়ে হত্যা করেও জায়গামত টাকা-পয়সা খরচ করলে কয়েক মাসের মধ্যেই জামিন পাওয়া কোনো সমস্যাই নয়। এমন বিচার বিভাগ যে দেশে থাকে এবং এই অবস্থাতেও সর্বোচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতিরা কোনোরকম লজ্জাবোধ না করে উল্টো পর্বতসমান অহমিকা প্রদর্শন করেন, সে দেশে ‘সুশাসন’ শব্দটি উচ্চারণ করাও নিরর্থক।
যাই হোক, আল্লাহর কাছে দোয়া করি জীবনে এত বড় বিপর্যয়ের পর অন্তত কবির ভরসা সুস্থ জীবনে ফিরে যাক। সম্পদশালী পরিবারের বখে যাওয়া সন্তান তার পুরনো পাপ সংসর্গ থেকে দূরে থাকতে পারলে তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা স্বস্তি পাবে, সুখে থাকবে। এই সেলে আমরা আর ছয়জন থাকলাম, চার কয়েদি এবং দুই হাজতি। আন্দাজ করছি, দুই-চারদিনের মধ্যেই আবার ভিড় বাড়তে আরম্ভ করবে। গতকাল নতুন জেলার মাহাবুবুর রহমানকে অনুরোধ করেছি, কোনো সন্ত্রাসীকে যেন আর এখানে না পাঠায়। সেই অনুরোধে কাজ কতটা হবে অবশ্য বলতে পারব না। ঢাকা জেলে কোথায়, কোন বন্দি থাকবে, সেটাও নির্ধারিত হয় প্রধানত লেনদেনের মাধ্যমেই।
আজকাল রেডিও শোনা ছেড়ে দিয়েছি। আমার সেলে নিকনের যে টেলিভিশন সেটটি ছিল সেটিও বিটিভি’র অত্যাচারে বিদায় করেছি। জেলখানায় যে গোটাচারেক সরকার সমর্থক পত্রিকা পাওয়া যায়, গুরুত্বপূর্ণ কোনো সংবাদ না থাকলে সেগুলো পড়তেও তেমন একটা উত্সাহ বোধ করি না। দুপুরে মিনিট দশেকের জন্য বিনে পয়সায় প্রাপ্ত সুশীল (?) ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে চোখ বুলিয়েই বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে প্রাত্যহিক যোগাযোগ সাঙ্গ করি। প্রতি সকালে চা সহকারে আড্ডার সময় ফয়সালই প্রধানত দেশি-বিদেশি রেডিও থেকে প্রাপ্ত খবরাখবর সরবরাহ করে। খাদ্যমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক চাল-আটার মূল্য বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে যে বলেছেন, আগামী এক মাস খাদ্য ঘাটতির কারণে দেশে সঙ্কট বিরাজ করবে, সেই সংবাদও আজ সকালে যথারীতি ফয়সালের কাছ থেকেই জানলাম। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ক’দিন আগেই বোরোর বাম্পার ফলনের গল্প শোনালেন। গত বছর আমনের সময়ও সরকারের একই দাবি শুনেছি। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভও ১১ বিলিয়ন ডলার। সুতরাং বিদেশ থেকে চাল আমদানি করতে কোনো অর্থ সঙ্কটও নেই। তাহলে দেশে খাদ্য সঙ্কটের প্রশ্ন উঠবে কেন?
আজ অক্টোবরের চার তারিখ। আগামী দু’মাসের আগে কৃষকের গোলায় আমন ধান ওঠার সম্ভাবনা নেই। অবস্থা যে কতটা সঙ্গিন, তার প্রমাণ কিছুক্ষণের মধ্যেই হাতেনাতে পেলাম। সেবক সালাহ্উদ্দিন ২৬ সেল থেকে ঘুরে এসে জানাল, আজ থেকে চিকন চালের ভাত আর পাওয়া যাবে না। জেল কোড অনুযায়ী ডিভিশন বন্দিরা চিকন চালের ভাত পেয়ে থাকেন। সম্প্রতি সেই চালের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে জেলের বাজেটে নাকি টান পড়েছে, কাজেই অন্য সব বন্দির মতো আজ থেকে ডিভিশনেও মোটা চাল সরবরাহ করা হবে। হঠাত্ ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষকালীন অবস্থার কথা মনে পড়ে গেল। তখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরে বাংলা হলে থাকতাম। চালের দাম হু হু করে বাড়ছিল, মাত্র দিন কয়েকের মধ্যেই মোটা চালের দাম মণপ্রতি ১০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকায় উঠে গিয়েছিল। অনেক বাজারে টাকা দিয়েও চাল পাওয়া যাচ্ছিল না। সেই সময় সরকারি প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তারা মাসে বেতনই পেতেন সাকুল্যে সাত-আটশ’ টাকা। যাই হোক, হোস্টেলে আমাদের ভাত বন্ধ করে ইয়া মোটা রুটি দেয়া হতো। সেই ডাল-রুটি খেয়েই তখন জীবন ধারণ করেছি। সেসব দিনের কথা স্মরণ করে সালাহ্উদ্দিনকেও জানিয়ে দিলাম, তথাস্তু। মোটা চালই সই। জেলের দশ হাজার বন্দি ওই ভাত খেতে পারলে আমিই বা পারব না কেন?
সাতদিন পেরিয়ে গেছে, এর মধ্যে বাড়ি-ঘরের আর কোনো খোঁজ-খবর পাইনি। গত সপ্তাহে পারভীনের কাছ থেকে শোনা প্রজাতন্ত্রের দলবাজ কর্মকর্তাদের দম্ভোক্তির কথা মনে হলে মা আর পারভীনের জন্য বড় দুশ্চিন্তা হয়। ফ্যাসিবাদী সরকার যতই গণবিচ্ছিন্ন হয়, ততই তাদের মধ্যে হিংস্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। জেলে বন্দি থাকার ফলে আমি সংসারের বাকি দু’জনের তুলনায় অধিক নিরাপদে আছি। রিমান্ডে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, কোর্টে আসা-যাওয়ার পথে এখনও হামলা চালানো সম্ভব। ঝুঁকি অবশ্যই আছে, তবে বাস্তবতা হলো আমি এখনও সুস্থ অবস্থায় বেঁচে আছি। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে আমার জননী এবং জায়ার কোনো নিরাপত্তা নেই। বিশেষত, পারভীনকে অফিসেও যেতে হয়, বাজার করতে হয়, আমার অর্ধশত মামলার তদবিরে আইনজীবীদের দোরে দোরে দৌড়াতে হয়। চরম প্রতিহিংসাপরায়ণ সরকারের রুদ্ররোষের শিকার হওয়ার সর্বপ্রকার ঝুঁকি মাথায় নিয়েও কবি ফরহাদ মজহার, নারীনেত্রী ফরিদা আক্তার, মানবাধিকার কর্মী আদিলুর রহমান খান শুভ্র, আমার বাল্য বন্ধু ড. সালাহউদ্দিন এবং ওর স্ত্রী বেলী আমার পরিবারকে যে সহযোগিতা, সাহস দিয়ে চলেছেন তা অতুলনীয়। সেই কৃতজ্ঞতার ঋণ শোধ করি এমন সাধ্য নেই আমার। আল্লাহর রহমত এবং এই ক’জন পরমাত্মীয়র চেয়েও আপনজনদের ওপর ভরসা করেই আমার নিঃসঙ্গ কারাজীবন কাটছে। আমার শুভানুধ্যায়ীরা দেখা করতে এলেও মন্দ খবরগুলো সচরাচর দিতে চায় না। রোজার মধ্যে পারভীন যে ডেঙ্গুতে ভুগেছে, সেই খবর জেনেছি মাত্র ক’দিন আগে। মারও বয়স হয়েছে, রক্তচাপের সমস্যা ও ডায়াবেটিস দুটোই আছে। সারাজীবন সংগ্রাম করে এই জীবনসায়াহ্নে একটু সুখে থাকবেন, সেই কপালও করে আসেননি। প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে আপন দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্য সবার কাছে ক্ষমা চাই।
জেল খাটতে খাটতে বেশ কৃপণ হয়ে গেছি। প্রথম দু’মাস পিসি থেকে যথেষ্ট কেনাকাটা করেছি। তবে সেই কেনাকাটারও উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত ঋণশোধ। আমার জেলে আসার পর দুই বাবুর প্রাথমিক সহায়তার ঋণ শোধের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় পিসি থেকে তখন নিয়মিত মাছ, গোস্ত ইত্যাদি কিনেছি। দু’জনই জামিন পেয়ে চলে যাওয়ায় এখন এসব কেনার উত্সাহ চলে গেছে। পারভীন আগের মতোই পনেরো দিন পরপর পিসিতে অনেক টাকা পাঠায়। টাকাগুলো ওখানেই জমছে। টাকা পাঠাতে নিষেধ করি না, কারণ তাহলেই আমার খাওয়া-দাওয়া নিয়ে বাড়িতে উদ্বেগ বাড়বে। রোজকার ডায়রি লেখার মাঝখানে সালাহ্উদ্দিন এসে হাজির। আজ পিসির মেন্যুতে মুরগি রয়েছে। জানতে চাইল, আমি কিনব কিনা। নেতিবাচক জবাব শুনে খানিকটা হতাশ, খানিকটা অবাক হয়ে চলে গেল। বোধ হয় ভাবল, আমার বাড়ি থেকে টাকা আসায় টান ধরেছে। আমি ভাবছি কিছুদিন কৃচ্ছ্রতাসাধন করেই দেখি না মানুষ কতখানি বাহুল্য বর্জন করতে পারে। দুপুর দেড়টা বেজে গেলেও এখনও ছাব্বিশ নম্বর সেল থেকে মধ্যাহ্নের আহার আসেনি। আজ থেকে মোটা চালের ভাত আরম্ভ হওয়ার কথা। কি রয়েছে আজ মেন্যুতে? কাঁচকি, চাপিলা নাকি সরপুঁটি?
ভাতের থালায় সবে হাত দিয়েছি, এমন সময় জেলগেট থেকে দেখার স্লিপ হাতে কারারক্ষী এসে হাজির। অপ্রত্যাশিতভাবে মা এবং পারভীন দেখা করতে এসেছে। টেলিপ্যাথি তাহলে শুধুই গল্প নয়। মধ্যাহ্নের আহার পড়ে রইল। পাঞ্জাবি তো গায়েই ছিল। লুঙ্গি পাল্টে পায়জামা পরতে যে কয়েক মুহূর্ত লাগে। এক ছুটে দেখার জায়গায় পৌঁছে গেলাম। পারভীন বলল, জেল থেকে মুক্তি পেয়ে আমার কারাজীবনের ওপর অলিউল্লাহ্ নোমান একটা প্রতিবেদন লিখেছে। সেটা আজই ছাপা হয়েছে। কী লিখেছে জানি না। সকালে ওটা পড়েই আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য মা অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। পারভীন বেচারা আর কি করে। বাধ্য হয়েই শাশুড়িকে নিয়ে জেলগেটে এসেছে। এতদিন ধরে এই দু’জন মানুষকে এখানে আসতে বারণ করেছি। আজ ওদের দেখে যে কি আনন্দ হলো, সেটা প্রকাশের সাধ্য আমার নেই। মার সেই অতি পুরাতন কথা, তুই রোগা হয়ে গেছিস। আর পারভীন জানতে চাইল প্রয়োজনমাফিক মাছ-মাংস পাচ্ছি কিনা। নিঃশব্দে হাসা ছাড়া এই প্রশ্ন এবং অনুযোগের আর কি জবাব দেব? বলতে তো পারছি না চাপিলা মাছ ছেড়ে এই মাত্র উঠে এসেছি। হাসতে হাসতেই বললাম, জেলজীবনের ওপর বই লিখছি, একদিন সব জানতে পারবে।
একজন কারারক্ষী পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের কথোপকথন শুনছিল। সে হঠাত্ আমাদের কথার মাঝখানে বলে উঠল, স্যার, আজকে আমার দেশ-এ আপনার ছবি দেখেছি, ঠিক গায়ের পাঞ্জাবিটাই পরা। ছেলেটির সাহস দেখে অবাকই হলাম। আশপাশে এতগুলো গোয়েন্দা উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও একজন কারারক্ষীর প্রকাশ্যে এই সমবেদনা ভরা কথা জেলগেটে পরিবারের সঙ্গে দেখা করার সব অসম্মানকে ভুলিয়ে দিল। আজ পারভীনকেও অনেক শক্ত মনে হলো। গতকালই সে মোহাম্মদ আলী ভাইকে জানিয়ে এসেছে, আদালত অবমাননার দ্বিতীয় মামলায় আরও সাত মাস কারাদণ্ডের রায় শোনার জন্য আমরা প্রত্যেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুত। আর্টিজান সিরামিকে নতুন রফতানি অর্ডার পাওয়া গেছে। এদিকে আতাউস সামাদ ভাই আমার অবর্তমানে পত্রিকা অফিসে আবার বসছেন। গত চার মাসের সব মন্দ খবরের মধ্যে আজ ভাগ্য একটু প্রসন্ন বোধ হলো। কি মনে করে জেল প্রশাসন দেখার সময়ও দশ মিনিট বাড়িয়ে তিরিশ মিনিট করল। আধ ঘণ্টা চমত্কার সময় কাটিয়ে সোফা ছেড়ে তিনজন উঠে দাঁড়ালাম। এবার বিদায়ের পালা। মা যতটা উদ্বেগ নিয়ে ছুটে এসেছিলেন, যাওয়ার সময় সেই তুলনায় অনেকটা স্বস্তি নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। যাওয়ার সময় অবশ্য বেশি করে খাওয়ার জন্য তাগাদার পর তাগাদা দিতে ভুললেন না। পারভীনও বিদায় মুহূর্তে মুখের হাসি ধরে রাখতে পারল। সেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, আগামী সপ্তাহে ঠিক এই দিনেই আমার মামলা উঠবে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে। এদেশে একটা প্রাচীন প্রবাদ আছে, ভাগ্যবানের বোঝা ভগবান বয়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী অতিশয় ভাগ্যবান। তার যাবতীয় বোঝা বহন করার মহান দায়িত্ব তার ভগবানকেও নিতে হয়নি, সেটি গ্রহণ করেছে আমাদের ‘স্বাধীন’ আদালত। জয়তু বাংলাদেশের স্বাধীন বিচার বিভাগ।
যাই হোক, আল্লাহর কাছে দোয়া করি জীবনে এত বড় বিপর্যয়ের পর অন্তত কবির ভরসা সুস্থ জীবনে ফিরে যাক। সম্পদশালী পরিবারের বখে যাওয়া সন্তান তার পুরনো পাপ সংসর্গ থেকে দূরে থাকতে পারলে তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা স্বস্তি পাবে, সুখে থাকবে। এই সেলে আমরা আর ছয়জন থাকলাম, চার কয়েদি এবং দুই হাজতি। আন্দাজ করছি, দুই-চারদিনের মধ্যেই আবার ভিড় বাড়তে আরম্ভ করবে। গতকাল নতুন জেলার মাহাবুবুর রহমানকে অনুরোধ করেছি, কোনো সন্ত্রাসীকে যেন আর এখানে না পাঠায়। সেই অনুরোধে কাজ কতটা হবে অবশ্য বলতে পারব না। ঢাকা জেলে কোথায়, কোন বন্দি থাকবে, সেটাও নির্ধারিত হয় প্রধানত লেনদেনের মাধ্যমেই।
আজকাল রেডিও শোনা ছেড়ে দিয়েছি। আমার সেলে নিকনের যে টেলিভিশন সেটটি ছিল সেটিও বিটিভি’র অত্যাচারে বিদায় করেছি। জেলখানায় যে গোটাচারেক সরকার সমর্থক পত্রিকা পাওয়া যায়, গুরুত্বপূর্ণ কোনো সংবাদ না থাকলে সেগুলো পড়তেও তেমন একটা উত্সাহ বোধ করি না। দুপুরে মিনিট দশেকের জন্য বিনে পয়সায় প্রাপ্ত সুশীল (?) ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে চোখ বুলিয়েই বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে প্রাত্যহিক যোগাযোগ সাঙ্গ করি। প্রতি সকালে চা সহকারে আড্ডার সময় ফয়সালই প্রধানত দেশি-বিদেশি রেডিও থেকে প্রাপ্ত খবরাখবর সরবরাহ করে। খাদ্যমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক চাল-আটার মূল্য বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে যে বলেছেন, আগামী এক মাস খাদ্য ঘাটতির কারণে দেশে সঙ্কট বিরাজ করবে, সেই সংবাদও আজ সকালে যথারীতি ফয়সালের কাছ থেকেই জানলাম। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ক’দিন আগেই বোরোর বাম্পার ফলনের গল্প শোনালেন। গত বছর আমনের সময়ও সরকারের একই দাবি শুনেছি। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভও ১১ বিলিয়ন ডলার। সুতরাং বিদেশ থেকে চাল আমদানি করতে কোনো অর্থ সঙ্কটও নেই। তাহলে দেশে খাদ্য সঙ্কটের প্রশ্ন উঠবে কেন?
আজ অক্টোবরের চার তারিখ। আগামী দু’মাসের আগে কৃষকের গোলায় আমন ধান ওঠার সম্ভাবনা নেই। অবস্থা যে কতটা সঙ্গিন, তার প্রমাণ কিছুক্ষণের মধ্যেই হাতেনাতে পেলাম। সেবক সালাহ্উদ্দিন ২৬ সেল থেকে ঘুরে এসে জানাল, আজ থেকে চিকন চালের ভাত আর পাওয়া যাবে না। জেল কোড অনুযায়ী ডিভিশন বন্দিরা চিকন চালের ভাত পেয়ে থাকেন। সম্প্রতি সেই চালের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে জেলের বাজেটে নাকি টান পড়েছে, কাজেই অন্য সব বন্দির মতো আজ থেকে ডিভিশনেও মোটা চাল সরবরাহ করা হবে। হঠাত্ ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষকালীন অবস্থার কথা মনে পড়ে গেল। তখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরে বাংলা হলে থাকতাম। চালের দাম হু হু করে বাড়ছিল, মাত্র দিন কয়েকের মধ্যেই মোটা চালের দাম মণপ্রতি ১০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকায় উঠে গিয়েছিল। অনেক বাজারে টাকা দিয়েও চাল পাওয়া যাচ্ছিল না। সেই সময় সরকারি প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তারা মাসে বেতনই পেতেন সাকুল্যে সাত-আটশ’ টাকা। যাই হোক, হোস্টেলে আমাদের ভাত বন্ধ করে ইয়া মোটা রুটি দেয়া হতো। সেই ডাল-রুটি খেয়েই তখন জীবন ধারণ করেছি। সেসব দিনের কথা স্মরণ করে সালাহ্উদ্দিনকেও জানিয়ে দিলাম, তথাস্তু। মোটা চালই সই। জেলের দশ হাজার বন্দি ওই ভাত খেতে পারলে আমিই বা পারব না কেন?
সাতদিন পেরিয়ে গেছে, এর মধ্যে বাড়ি-ঘরের আর কোনো খোঁজ-খবর পাইনি। গত সপ্তাহে পারভীনের কাছ থেকে শোনা প্রজাতন্ত্রের দলবাজ কর্মকর্তাদের দম্ভোক্তির কথা মনে হলে মা আর পারভীনের জন্য বড় দুশ্চিন্তা হয়। ফ্যাসিবাদী সরকার যতই গণবিচ্ছিন্ন হয়, ততই তাদের মধ্যে হিংস্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। জেলে বন্দি থাকার ফলে আমি সংসারের বাকি দু’জনের তুলনায় অধিক নিরাপদে আছি। রিমান্ডে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, কোর্টে আসা-যাওয়ার পথে এখনও হামলা চালানো সম্ভব। ঝুঁকি অবশ্যই আছে, তবে বাস্তবতা হলো আমি এখনও সুস্থ অবস্থায় বেঁচে আছি। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে আমার জননী এবং জায়ার কোনো নিরাপত্তা নেই। বিশেষত, পারভীনকে অফিসেও যেতে হয়, বাজার করতে হয়, আমার অর্ধশত মামলার তদবিরে আইনজীবীদের দোরে দোরে দৌড়াতে হয়। চরম প্রতিহিংসাপরায়ণ সরকারের রুদ্ররোষের শিকার হওয়ার সর্বপ্রকার ঝুঁকি মাথায় নিয়েও কবি ফরহাদ মজহার, নারীনেত্রী ফরিদা আক্তার, মানবাধিকার কর্মী আদিলুর রহমান খান শুভ্র, আমার বাল্য বন্ধু ড. সালাহউদ্দিন এবং ওর স্ত্রী বেলী আমার পরিবারকে যে সহযোগিতা, সাহস দিয়ে চলেছেন তা অতুলনীয়। সেই কৃতজ্ঞতার ঋণ শোধ করি এমন সাধ্য নেই আমার। আল্লাহর রহমত এবং এই ক’জন পরমাত্মীয়র চেয়েও আপনজনদের ওপর ভরসা করেই আমার নিঃসঙ্গ কারাজীবন কাটছে। আমার শুভানুধ্যায়ীরা দেখা করতে এলেও মন্দ খবরগুলো সচরাচর দিতে চায় না। রোজার মধ্যে পারভীন যে ডেঙ্গুতে ভুগেছে, সেই খবর জেনেছি মাত্র ক’দিন আগে। মারও বয়স হয়েছে, রক্তচাপের সমস্যা ও ডায়াবেটিস দুটোই আছে। সারাজীবন সংগ্রাম করে এই জীবনসায়াহ্নে একটু সুখে থাকবেন, সেই কপালও করে আসেননি। প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে আপন দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্য সবার কাছে ক্ষমা চাই।
জেল খাটতে খাটতে বেশ কৃপণ হয়ে গেছি। প্রথম দু’মাস পিসি থেকে যথেষ্ট কেনাকাটা করেছি। তবে সেই কেনাকাটারও উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত ঋণশোধ। আমার জেলে আসার পর দুই বাবুর প্রাথমিক সহায়তার ঋণ শোধের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় পিসি থেকে তখন নিয়মিত মাছ, গোস্ত ইত্যাদি কিনেছি। দু’জনই জামিন পেয়ে চলে যাওয়ায় এখন এসব কেনার উত্সাহ চলে গেছে। পারভীন আগের মতোই পনেরো দিন পরপর পিসিতে অনেক টাকা পাঠায়। টাকাগুলো ওখানেই জমছে। টাকা পাঠাতে নিষেধ করি না, কারণ তাহলেই আমার খাওয়া-দাওয়া নিয়ে বাড়িতে উদ্বেগ বাড়বে। রোজকার ডায়রি লেখার মাঝখানে সালাহ্উদ্দিন এসে হাজির। আজ পিসির মেন্যুতে মুরগি রয়েছে। জানতে চাইল, আমি কিনব কিনা। নেতিবাচক জবাব শুনে খানিকটা হতাশ, খানিকটা অবাক হয়ে চলে গেল। বোধ হয় ভাবল, আমার বাড়ি থেকে টাকা আসায় টান ধরেছে। আমি ভাবছি কিছুদিন কৃচ্ছ্রতাসাধন করেই দেখি না মানুষ কতখানি বাহুল্য বর্জন করতে পারে। দুপুর দেড়টা বেজে গেলেও এখনও ছাব্বিশ নম্বর সেল থেকে মধ্যাহ্নের আহার আসেনি। আজ থেকে মোটা চালের ভাত আরম্ভ হওয়ার কথা। কি রয়েছে আজ মেন্যুতে? কাঁচকি, চাপিলা নাকি সরপুঁটি?
ভাতের থালায় সবে হাত দিয়েছি, এমন সময় জেলগেট থেকে দেখার স্লিপ হাতে কারারক্ষী এসে হাজির। অপ্রত্যাশিতভাবে মা এবং পারভীন দেখা করতে এসেছে। টেলিপ্যাথি তাহলে শুধুই গল্প নয়। মধ্যাহ্নের আহার পড়ে রইল। পাঞ্জাবি তো গায়েই ছিল। লুঙ্গি পাল্টে পায়জামা পরতে যে কয়েক মুহূর্ত লাগে। এক ছুটে দেখার জায়গায় পৌঁছে গেলাম। পারভীন বলল, জেল থেকে মুক্তি পেয়ে আমার কারাজীবনের ওপর অলিউল্লাহ্ নোমান একটা প্রতিবেদন লিখেছে। সেটা আজই ছাপা হয়েছে। কী লিখেছে জানি না। সকালে ওটা পড়েই আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য মা অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। পারভীন বেচারা আর কি করে। বাধ্য হয়েই শাশুড়িকে নিয়ে জেলগেটে এসেছে। এতদিন ধরে এই দু’জন মানুষকে এখানে আসতে বারণ করেছি। আজ ওদের দেখে যে কি আনন্দ হলো, সেটা প্রকাশের সাধ্য আমার নেই। মার সেই অতি পুরাতন কথা, তুই রোগা হয়ে গেছিস। আর পারভীন জানতে চাইল প্রয়োজনমাফিক মাছ-মাংস পাচ্ছি কিনা। নিঃশব্দে হাসা ছাড়া এই প্রশ্ন এবং অনুযোগের আর কি জবাব দেব? বলতে তো পারছি না চাপিলা মাছ ছেড়ে এই মাত্র উঠে এসেছি। হাসতে হাসতেই বললাম, জেলজীবনের ওপর বই লিখছি, একদিন সব জানতে পারবে।
একজন কারারক্ষী পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের কথোপকথন শুনছিল। সে হঠাত্ আমাদের কথার মাঝখানে বলে উঠল, স্যার, আজকে আমার দেশ-এ আপনার ছবি দেখেছি, ঠিক গায়ের পাঞ্জাবিটাই পরা। ছেলেটির সাহস দেখে অবাকই হলাম। আশপাশে এতগুলো গোয়েন্দা উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও একজন কারারক্ষীর প্রকাশ্যে এই সমবেদনা ভরা কথা জেলগেটে পরিবারের সঙ্গে দেখা করার সব অসম্মানকে ভুলিয়ে দিল। আজ পারভীনকেও অনেক শক্ত মনে হলো। গতকালই সে মোহাম্মদ আলী ভাইকে জানিয়ে এসেছে, আদালত অবমাননার দ্বিতীয় মামলায় আরও সাত মাস কারাদণ্ডের রায় শোনার জন্য আমরা প্রত্যেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুত। আর্টিজান সিরামিকে নতুন রফতানি অর্ডার পাওয়া গেছে। এদিকে আতাউস সামাদ ভাই আমার অবর্তমানে পত্রিকা অফিসে আবার বসছেন। গত চার মাসের সব মন্দ খবরের মধ্যে আজ ভাগ্য একটু প্রসন্ন বোধ হলো। কি মনে করে জেল প্রশাসন দেখার সময়ও দশ মিনিট বাড়িয়ে তিরিশ মিনিট করল। আধ ঘণ্টা চমত্কার সময় কাটিয়ে সোফা ছেড়ে তিনজন উঠে দাঁড়ালাম। এবার বিদায়ের পালা। মা যতটা উদ্বেগ নিয়ে ছুটে এসেছিলেন, যাওয়ার সময় সেই তুলনায় অনেকটা স্বস্তি নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। যাওয়ার সময় অবশ্য বেশি করে খাওয়ার জন্য তাগাদার পর তাগাদা দিতে ভুললেন না। পারভীনও বিদায় মুহূর্তে মুখের হাসি ধরে রাখতে পারল। সেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, আগামী সপ্তাহে ঠিক এই দিনেই আমার মামলা উঠবে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে। এদেশে একটা প্রাচীন প্রবাদ আছে, ভাগ্যবানের বোঝা ভগবান বয়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী অতিশয় ভাগ্যবান। তার যাবতীয় বোঝা বহন করার মহান দায়িত্ব তার ভগবানকেও নিতে হয়নি, সেটি গ্রহণ করেছে আমাদের ‘স্বাধীন’ আদালত। জয়তু বাংলাদেশের স্বাধীন বিচার বিভাগ।
No comments