৩০- শুধু ভারতের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলেই হবে না অব্যাহত মার্কিন সমর্থনও জরুরি
দুই বছরে একই ভোটাররা যথেষ্ট সাবালক
...উত্তরবঙ্গের পৌরসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোটের এক কথায় ভরাডুবি ঘটেছে। গত দুই বছরে ভোটাররা যথেষ্ট সাবালক হয়ে উঠেছে।...
...উত্তরবঙ্গের পৌরসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোটের এক কথায় ভরাডুবি ঘটেছে। গত দুই বছরে ভোটাররা যথেষ্ট সাবালক হয়ে উঠেছে।...
বেশ কয়েক বছর বিরতির পর কাশিমপুর জেল কর্তৃপক্ষের কল্যাণে বাংলাদেশে গত দশ বছরের অন্যতম বিতর্কিত চরিত্র গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের সঙ্গে অকস্মাত্ সাক্ষাত্ ঘটল। তারেক রহমানের বন্ধু হিসেবে সমাজে পরিচিত এই ব্যবসায়ীর সঙ্গে সরকারে থাকা অবস্থায় দুই-তিনবারের বেশি দেখা হয়নি। সর্বশেষ কোথায় কবে দেখা হয়েছিল, মনে না পড়লেও সর্বপ্রথম কোথায় দেখা হয়েছিল সেটা পরিষ্কার মনে আছে। ২০০২ সালে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে চীন সফরের সময় সেখানেই গিয়াসউদ্দিন মামুনকে সর্বপ্রথম দেখি।
যতদূর মনে পড়ছে, বেইজিংয়ের রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর এসাইনমেন্ট অফিসার ডা. ফিরোজ মাহমুদ ইকবাল। দেশে মামুন তখনই এক বহুল আলোচিত, বিতর্কিত নাম। আমার একগুঁয়ে চরিত্র অনুযায়ী মামুনের সঙ্গে সেদিনের আলাপে আমি কোনো রকম উত্সাহ বোধ করিনি। সরকারের পরবর্তী সাড়ে তিন বছরে গিয়াসউদ্দিন আল মামুনও আমার সঙ্গে সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রেখেই চলেছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে তার প্রভাব সম্পর্কে নানা কথা চালু থাকলেও বিনিয়োগ বোর্ড কিংবা জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালনের সময় কোনো বিষয়েই মামুন আমার অফিসে কোনো অনুরোধ নিয়ে আসেনি। এক এগারোর সামরিক অভ্যুত্থানের কয়েক দিনের মধ্যেই গিয়াসউদ্দিন মামুন গ্রেফতার হয়ে গেলে আমার সঙ্গে সহজে দেখা হওয়ার সম্ভাবনাও তিরোহিত হয়।
আজ সকাল থেকেই ঘন কুয়াশায় পুরো জেলটাই প্রায় ঢেকে দিল। সাড়ে সাতটায় জেলগেটে ডেপুটি জেলারদের অফিসে পৌঁছে দেখি সেখানে বিদ্যুত্ নেই। ডেপুটি জেলার মুশফিক চার্জার বাতি জ্বালিয়ে ওর টেবিলে কাজ করছে, সামনে দু-তিনজন লোক বসা। আমি যাওয়া মাত্র একজন চেয়ার ছেড়ে আমাকে বসতে দিল।
মুশফিকের সঙ্গে কুশল বিনিময় শেষ না হতেই পাশের চেয়ার থেকে এক ব্যক্তি হাত বাড়িয়ে বললেন, মাহমুদ ভাই কেমন আছেন? কয়েক সেকেন্ড লোকটিকে ঠিক চিনে উঠতে পারিনি। আসলে ওখানে ওই আলো-আঁধারিতে তাকে একেবারেই প্রত্যাশা করিনি। সপ্তাহ দুয়েক আগে অবশ্য কালামের মুখে শুনেছিলাম, গাজীপুর জেল থেকে গিয়াসউদ্দিন মামুন এই জেলে চালানে এসে ফাঁসির সেলে আছে।
ডেপুটি জেলার যখন বলল, মামুন আমার সঙ্গে একই প্রিজন ভ্যানে সিএমএম কোর্টে হাজিরা দিতে যাবে, আমার বিস্ময় এবং বিরক্তি দুটোই বাড়ল।
যতদূর জানি, ডিভিশনপ্রাপ্ত কয়েদির সঙ্গে সাধারণ কয়েদির একই গাড়িতে চলাচল জেলকোডের লঙ্ঘন। তাছাড়া তারেক রহমানের বন্ধু হিসেবে বিশেষ পরিচিত মামুনকে প্রায় ছয়-সাত ঘণ্টা আমার সঙ্গে একান্ত ভ্রমণ করানোর কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত সন্দেহজনক মনে হলো। মুশফিক অবশ্য এই নজিরবিহীন কাণ্ডের একটা যুক্তি খাড়া করল। আজ বিডিআর বিদ্রোহের মামলা থাকায় প্রায় ছয়-সাতশ’ বিডিআর সৈনিককে ঢাকায় নিতে হচ্ছে, এদিকে প্রিজন ভ্যানের সংখ্যা অপ্রতুল। বাধ্য হয়েই নাকি কারা প্রশাসন আমাকে ও মামুনকে একসঙ্গে প্রিজন ভ্যানে পাঠানোর এই বিধিবহির্ভূত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
আমার বিরক্তির আরও একটা কারণ ছিল। এ ধরনের বিধিবহির্ভূত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে আমার মতামত নেয়াটা স্বাভাবিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়া উচিত ছিল। জেল প্রশাসন সেটারও কোনো প্রয়োজন অনুভব করেনি। আমার কেবলই মনে হতে লাগল, এর মধ্যেও সরকারের কোনো দুরভিসন্ধি রয়েছে। অপ্রসন্ন মনেই গাড়িতে উঠলাম। পথের তিন ঘণ্টায় কুশল বিনিময়ের বাইরে তেমন কোনো কথাবার্তা হলো না। আমি এবং তারেক রহমানের এই ‘বিখ্যাত’ বন্ধু পরস্পরের প্রায় অপরিচিত। আমাদের মধ্যে আলাপের মতো বিশেষ কোনো বিষয়ও খুঁজে পেলাম না। দু’জনই দীর্ঘদিন ধরে জেলে বন্দি, কাজেই বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে কেউই অবহিত নই। তাছাড়া প্রচণ্ড ঠাণ্ডা সামলাতেই প্রাণ ওষ্ঠাগত। মামুনকে ঢাকা জজকোর্টে নামিয়ে আমাকে কোর্ট গারদে নিতে প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে গেল।
গারদে সূর্যের আলো সরাসরি ঢোকে না, ভেতরে পা দিয়েই মনে হলো একেবারে জমে যাচ্ছি। সঙ্গে নেয়া খবরের কাগজ অন্যদিনের মতো মাটিতে বিছিয়ে বসার চেষ্টা করলাম। বসামাত্র লাফিয়ে উঠলাম। মেঝে থেকে উঠে আসা স্যাঁতস্যাঁতে ঠাণ্ডা সামাল দেয়া ওই এক পাতা নিউজপ্রিন্টের কম্ম নয়। বারোটার দিকে গারদের এক নিম্নস্তরের পুলিশ কর্মকর্তা এসে জানাল, আমার মামলার কাজ আজকের মতো শেষ হয়েছে। পরবর্তী তারিখ পড়েছে ফেব্রুয়ারির সতেরোতে। অন্যদিনের মতো আদালতে একা এলে এখনই ফিরতে পারতাম। কিন্তু, জেল কর্তৃপক্ষ আমার সঙ্গে মামুনকে ভিড়িয়ে দেয়ার কারণে তার কাজ শেষ না হওয়া অবধি এই হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা গারদে বসে অপেক্ষা করতে হবে।
সময় কাটানোর জন্য মোস্তফা মীরের অনুবাদকৃত কাহলিল জিবরানের রচনা সমগ্র এনেছিলাম। সেই বই পড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। একে এতো শীতে বই হাতে ধরে রাখা মুশকিল, তার ওপর কাহলিল জিবরানের দার্শনিক লেখা পড়তে হলে মনের যে একাগ্রতা দরকার, সেটা দেয়া সম্ভব হলো না। দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে এক সময় বরফ ঠাণ্ডা মেঝেতেই গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়লাম। থেকে থেকে শরীরে প্রচণ্ড কাঁপুনি দিচ্ছে। মনে হচ্ছিল এই ঠাণ্ডা সহ্য করতে না পেরে বোধহয় অজ্ঞান হয়ে যাব। একবার ভাবলাম, কোর্ট গারদের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে ডেকে সেলের বাইরে রোদে বসতে দেয়ার অনুরোধ করি। পরক্ষণেই মনে হলো, যেচে অনুরোধ প্রত্যাখ্যানের অপমান সহ্য করি কেন, তার চেয়ে যতক্ষণ পারা যায় দাঁতে দাঁত চেপে থাকি।
ঠিক পৌনে দুটোয় পুলিশ গারদের তালা খুলে সংবাদ দিল মামুনের কাজ শেষ হয়েছে। কোর্ট গারদ থেকে জজকোর্টে গিয়ে মামুনকে প্রিজন ভ্যানে তুলতে হলো। ভ্যানের ভাঙা বেঞ্চে বসেই উত্ফুল্ল মামুন জানাল, আজকের মামলায় সে খালাস পেয়েছে। এতক্ষণ মেজাজ তিরিক্ষে হয়ে ছিল, এই সংবাদে বিস্ময়ের ঠেলায় রাগের পারদ মুহূর্তে নেমে এলো। তারেক রহমানের বিশেষ বন্ধু এবং কেস পার্টনারের কোনো মামলা শেখ হাসিনার সরকারের আমলে খারিজ হয়েছে এমন চাঞ্চল্যকর খবর তো আক্কেল গুড়ুম হওয়ার মতো! সচরাচর নিজ থেকে অন্যের খবর জানায় আমার কোনো আগ্রহ না থাকলেও আজ আর নির্বিকার থাকতে পারলাম না। মামলার বিবরণী শোনার পর বিস্ময় কেটে গিয়ে এদেশের বিচার বিভাগের প্রতি করুণা বোধ করতে লাগলাম।
মামুন নিজগুণে মামলায় খালাস পায়নি, সেটা সম্ভব হয়েছে একই মামলায় অন্য এক প্রভাবশালী অভিযুক্তের কল্যাণে। এই ব্যক্তি বাংলাদেশের সেসব ব্যবসায়ীর মধ্যে একজন, যে জানে কি করে দেশের দুই প্রধানদলকে খুশি রাখতে হয়। যে দেবতা যে নৈবেদ্যে সন্তুষ্ট, তাকে সেই নৈবেদ্য অকাতরে দেয়ায় ভদ্রলোকের জুড়ি নেই। দুষ্ট লোকে বলে এক এগারোর পর মইনের খাস লোকজন বিমানবন্দরে সশরীরে উপস্থিত থেকে সপরিবারে তাকে বিদেশ যেতে সহায়তা করেছিল। এই সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর মণিকাঞ্চনের জোরে দেশে-বিদেশের হাইকমাণ্ডকে বাগে আনতে তার কোনো সমস্যাই হয়নি।
সসম্মানে দেশে ফিরে তিনি ব্যবসার হাল ধরেছেন এবং চুটিয়ে সরকারের সঙ্গে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করে যাচ্ছেন। এ ধরনের প্রভাবশালী ব্যক্তি যে মামলায় অভিযুক্ত, সেই মামলা খারিজের আদেশ দেবে না, এমন জজ বাংলাদেশে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। আজ যে মামলা ছিল, সেটি বানোয়াটও যে হতে পারে, সে সম্পর্কে আমি কোনো সন্দেহ ব্যক্ত করতে চাচ্ছি না। তবে, ‘স্বাধীন’ বিচার বিভাগের জামানায় মামলা আসল না নকল, এ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে মামলার বাদী এবং বিবাদী কোন পক্ষের, সেদিকে দৃষ্টি দেয়াই বুদ্ধিমানের লক্ষণ। আর একটি তথ্য পাঠকদের না জানালে আপন বিবেকের কাছে অপরাধী থেকে যাব। বিএনপির অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দের মধ্যেও কিন্তু এই ব্যবসায়ীর গুণগ্রাহীর সংখ্যা একেবারে কম নয়।
মামুন দেখলাম মধ্যাহ্নভোজের জন্য বার্গার, কেক ইত্যাদিসহ নানারকম খাদ্যসামগ্রী নিয়েই প্রিজন ভ্যানে উঠেছে। আমাকে অনেকবার সেখান থেকে খাদ্য গ্রহণের সনির্বন্ধ অনুরোধ জানানো সত্ত্বেও আমি কিছুতেই রাজি হলাম না। অনেক কষ্টে মামুনকে বোঝাতে পারলাম, আমার এই না খাওয়ার হেতু কোনো ব্যক্তিগত বিরাগ নয়, আমি আসলেই প্রিজন ভ্যানের ভেতরে কোনো খাদ্য গ্রহণ করি না। মামুনের সঙ্গে ছয়-সাত ঘণ্টা কাটিয়ে একটা বিষয়ে খুব আশ্চর্য বোধ হতে লাগল। প্রায় চার বছর কারাগারে কাটানোর পরও বাহ্যত তাকে কোনোরকম উদ্বিগ্ন হতে দেখলাম না। কারাগারে ফেরার আগেই লক-আপের সময় হয়ে গেল।
ফিরে দেখি জমাদার, সুবেদারের গালাগাল সহ্য করেও যার যার সেলে না ফিরে মানিক এবং হীরা আমার অপেক্ষায় উদ্বিগ্ন মুখে ডিভিশন ওয়ার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই ছেলে দুটো অজানা কারণে আমাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধাভক্তি করে। এই শীতে আমার গায়ে গরম কাপড়ের স্বল্পতা দেখে দু’জনই অনুযোগ করল। হীরা তো সাহস করে বলেই ফেলল, স্যার এরকম করলে শুধু মনের জোরে শরীর সুস্থ রাখা যাবে না। আমি হেসে জবাব দিলাম, মনের জোর নয়, আল্লাহ্ চাইলে শরীর সুস্থই থাকবে। শীতের প্রচণ্ডতায় ততক্ষণে আমার কিন্তু কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে। কালাম ছুটে এসে একটা পশমী চাদর গায়ে জড়িয়ে দিল। হাতেম নিয়ে এলো গরম চা ভর্তি মেলামাইনের মগ। শেষ হলো কোর্টে হাজিরার নামে আরও একটি দিনের নির্যাতন।
মাননীয় অর্থমন্ত্রী হয় বাংলাদেশের জনগণকে গণ্ডমূর্খ বিবেচনা করেন, অথবা তিনি জনমতের কোনো ধার ধারেন না। নইলে শেয়ারবাজারে একদিনে ১৫ শতাংশ দর বৃদ্ধির তেলেসমাতি দেখানোর আগে এর পরিণতি নিয়ে হাজারবার চিন্তা করতেন। মানছি, এ দেশের শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর অধিকাংশই বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সৈনিক। এটাও সত্যি যে, এদের মাধ্যমে নানা কৌশলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মাথায় কাঁঠাল ভাঙতে আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকরা বিশেষ পারদর্শী। কিন্তু, ২০১১ সালের এক এগারোতে (আজ ১/১১/১১) ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে যে কারসাজি ঘটানো হলো, তাকে এক কথায় ন্যক্কারজনক বললেও কম বলা হয়। অন্য কোনো দেশ হলে কারসাজির হোতাদের এতক্ষণে কোমরে দড়ি পড়ত। কিন্তু, মহাজোটের বাংলাদেশে বিচার, আইন এগুলো সব মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভ্যানিটি ব্যাগে বন্দি।
ভাবা যায়, একদিনে মূল্যসূচক বেড়েছে ১০১২ পয়েন্ট! পুঁজিবাজারের কোম্পানিগুলোকে আল্লাহ কি এমন ছাপ্পর ফুড়ে রাতারাতি কোটি কোটি টাকার লাভ দিলেন যে, লোকে জ্ঞানশূন্য হয়ে সেসব কোম্পানির শেয়ার কেনার জন্য মতিঝিল এলাকায় দলবেঁধে এমনভাবেই ঝাঁপিয়ে পড়ল যাতে এক লাফে শেয়ারের দাম গড়ে ১৫ ভাগ বেড়ে গেল। এই তেলেসমাতি দেখিয়ে কিছুদিন জনগণকে বোকা বানানো গেলেও মনে হয় না ক্ষমতাসীনদের শেষ রক্ষা হবে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যে ক্রমেই সরকারের প্রবঞ্চনা ধরে ফেলছে, তার প্রমাণ পাওয়ার জন্য ২৪ ঘণ্টার বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি।
উত্তরবঙ্গের পৌরসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোটের এক কথায় ভরাডুবি ঘটেছে। মহাজোটের স্বৈরাচারী সাথী এরশাদের ঘাঁটি রংপুরেও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের অবিশ্বাস্য বিজয়েও যদি এদের সংবিত্ না ফেরে, তাহলে কপালে অনেক দুঃখ আছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় সাধারণ ভোটারদের রূপকথার রোমাঞ্চকর গল্প শুনিয়ে মোহিত করা গেলেও গত দুই বছরে একই ভোটাররা যথেষ্ট সাবালক হয়ে উঠেছে। অবশ্য এক উত্তরবঙ্গ দিয়েই সারাদেশের জনমতের ব্যাপারটা বোঝা যাবে না। তবে অতীতের নির্বাচনসমূহে দেখা গেছে, ভোটারদের একটা ঝোঁক শুরু হলে সেটা সচরাচর সেই নির্বাচনে আর বদলায় না।
তবে উত্তরবঙ্গের অপ্রত্যাশিত বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে অন্য বিভাগগুলোতে সরকার যদি প্রশাসনকে অধিক মাত্রায় ব্যবহার করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেয় তাহলে অবাক হওয়া উচিত হবে না। একদিনে সকল বিভাগে নির্বাচন হলে জনরায়ের চিত্রটা স্বচ্ছতার সঙ্গে বোঝা যেত। কিন্তু এটা তো আর হচ্ছে না। যাই হোক, ২০১১ সাল যে শেখ হাসিনার জন্য সুসময় নিয়ে আসেনি, এটা পরিষ্কার। দেশের জনগণ মুখ ফিরিয়ে নেয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতকে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরা ছাড়া সেক্যুলার সরকারের আর কোনো উপায় নেই। তবে শুধু কথায় তো আর চিড়ে ভিজবে না। শাইলকের জাতভাইদের চাহিদাও মেটাতে হবে। পাশের বাড়ির সাম্রাজ্যবাদকে এরই মধ্যে করিডোর, বন্দর, সবই দেয়া হয়ে গেছে। এরও অতিরিক্ত কিছু থাকলে তারও তালিকা মনমোহন সিংয়ের সফরের আগেই তৈরি হয়ে যাবে। ওদিকে আটলান্টিক পাড়ের প্রভুকে তুষ্ট রাখতে হলে সমুদ্রবক্ষে গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে বেশিদিন তালবাহানা করা যাবে না। একই কুমিরছানা বার বার দেখানোর মতো করে ক’দিন পর পর ইসলামী জঙ্গির গল্প ফেঁদে সন্তুষ্ট রাখার দিন দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। কেবল ভারতের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে সম্ভবত শেষরক্ষা হবে না। বৈরী জনমতকে উপেক্ষা করে মসনদে টিকে থাকতে হলে অব্যাহত মার্কিন সমর্থন অপরিহার্য। ১৯৭৫ সালের ভুলের পুনরাবৃত্তি ক্ষমতাসীনরা করবেন না বলেই আমার ধারণা। তবে, ষোল কোটি মানুষ কতদিন তাদের মাতৃভূমি নিয়ে বানরের এই পিঠাভাগ নির্বিকারভাবে দেখে যাবে, সেটাই প্রশ্ন।
যতদূর মনে পড়ছে, বেইজিংয়ের রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর এসাইনমেন্ট অফিসার ডা. ফিরোজ মাহমুদ ইকবাল। দেশে মামুন তখনই এক বহুল আলোচিত, বিতর্কিত নাম। আমার একগুঁয়ে চরিত্র অনুযায়ী মামুনের সঙ্গে সেদিনের আলাপে আমি কোনো রকম উত্সাহ বোধ করিনি। সরকারের পরবর্তী সাড়ে তিন বছরে গিয়াসউদ্দিন আল মামুনও আমার সঙ্গে সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রেখেই চলেছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে তার প্রভাব সম্পর্কে নানা কথা চালু থাকলেও বিনিয়োগ বোর্ড কিংবা জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালনের সময় কোনো বিষয়েই মামুন আমার অফিসে কোনো অনুরোধ নিয়ে আসেনি। এক এগারোর সামরিক অভ্যুত্থানের কয়েক দিনের মধ্যেই গিয়াসউদ্দিন মামুন গ্রেফতার হয়ে গেলে আমার সঙ্গে সহজে দেখা হওয়ার সম্ভাবনাও তিরোহিত হয়।
আজ সকাল থেকেই ঘন কুয়াশায় পুরো জেলটাই প্রায় ঢেকে দিল। সাড়ে সাতটায় জেলগেটে ডেপুটি জেলারদের অফিসে পৌঁছে দেখি সেখানে বিদ্যুত্ নেই। ডেপুটি জেলার মুশফিক চার্জার বাতি জ্বালিয়ে ওর টেবিলে কাজ করছে, সামনে দু-তিনজন লোক বসা। আমি যাওয়া মাত্র একজন চেয়ার ছেড়ে আমাকে বসতে দিল।
মুশফিকের সঙ্গে কুশল বিনিময় শেষ না হতেই পাশের চেয়ার থেকে এক ব্যক্তি হাত বাড়িয়ে বললেন, মাহমুদ ভাই কেমন আছেন? কয়েক সেকেন্ড লোকটিকে ঠিক চিনে উঠতে পারিনি। আসলে ওখানে ওই আলো-আঁধারিতে তাকে একেবারেই প্রত্যাশা করিনি। সপ্তাহ দুয়েক আগে অবশ্য কালামের মুখে শুনেছিলাম, গাজীপুর জেল থেকে গিয়াসউদ্দিন মামুন এই জেলে চালানে এসে ফাঁসির সেলে আছে।
ডেপুটি জেলার যখন বলল, মামুন আমার সঙ্গে একই প্রিজন ভ্যানে সিএমএম কোর্টে হাজিরা দিতে যাবে, আমার বিস্ময় এবং বিরক্তি দুটোই বাড়ল।
যতদূর জানি, ডিভিশনপ্রাপ্ত কয়েদির সঙ্গে সাধারণ কয়েদির একই গাড়িতে চলাচল জেলকোডের লঙ্ঘন। তাছাড়া তারেক রহমানের বন্ধু হিসেবে বিশেষ পরিচিত মামুনকে প্রায় ছয়-সাত ঘণ্টা আমার সঙ্গে একান্ত ভ্রমণ করানোর কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত সন্দেহজনক মনে হলো। মুশফিক অবশ্য এই নজিরবিহীন কাণ্ডের একটা যুক্তি খাড়া করল। আজ বিডিআর বিদ্রোহের মামলা থাকায় প্রায় ছয়-সাতশ’ বিডিআর সৈনিককে ঢাকায় নিতে হচ্ছে, এদিকে প্রিজন ভ্যানের সংখ্যা অপ্রতুল। বাধ্য হয়েই নাকি কারা প্রশাসন আমাকে ও মামুনকে একসঙ্গে প্রিজন ভ্যানে পাঠানোর এই বিধিবহির্ভূত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
আমার বিরক্তির আরও একটা কারণ ছিল। এ ধরনের বিধিবহির্ভূত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে আমার মতামত নেয়াটা স্বাভাবিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়া উচিত ছিল। জেল প্রশাসন সেটারও কোনো প্রয়োজন অনুভব করেনি। আমার কেবলই মনে হতে লাগল, এর মধ্যেও সরকারের কোনো দুরভিসন্ধি রয়েছে। অপ্রসন্ন মনেই গাড়িতে উঠলাম। পথের তিন ঘণ্টায় কুশল বিনিময়ের বাইরে তেমন কোনো কথাবার্তা হলো না। আমি এবং তারেক রহমানের এই ‘বিখ্যাত’ বন্ধু পরস্পরের প্রায় অপরিচিত। আমাদের মধ্যে আলাপের মতো বিশেষ কোনো বিষয়ও খুঁজে পেলাম না। দু’জনই দীর্ঘদিন ধরে জেলে বন্দি, কাজেই বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে কেউই অবহিত নই। তাছাড়া প্রচণ্ড ঠাণ্ডা সামলাতেই প্রাণ ওষ্ঠাগত। মামুনকে ঢাকা জজকোর্টে নামিয়ে আমাকে কোর্ট গারদে নিতে প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে গেল।
গারদে সূর্যের আলো সরাসরি ঢোকে না, ভেতরে পা দিয়েই মনে হলো একেবারে জমে যাচ্ছি। সঙ্গে নেয়া খবরের কাগজ অন্যদিনের মতো মাটিতে বিছিয়ে বসার চেষ্টা করলাম। বসামাত্র লাফিয়ে উঠলাম। মেঝে থেকে উঠে আসা স্যাঁতস্যাঁতে ঠাণ্ডা সামাল দেয়া ওই এক পাতা নিউজপ্রিন্টের কম্ম নয়। বারোটার দিকে গারদের এক নিম্নস্তরের পুলিশ কর্মকর্তা এসে জানাল, আমার মামলার কাজ আজকের মতো শেষ হয়েছে। পরবর্তী তারিখ পড়েছে ফেব্রুয়ারির সতেরোতে। অন্যদিনের মতো আদালতে একা এলে এখনই ফিরতে পারতাম। কিন্তু, জেল কর্তৃপক্ষ আমার সঙ্গে মামুনকে ভিড়িয়ে দেয়ার কারণে তার কাজ শেষ না হওয়া অবধি এই হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা গারদে বসে অপেক্ষা করতে হবে।
সময় কাটানোর জন্য মোস্তফা মীরের অনুবাদকৃত কাহলিল জিবরানের রচনা সমগ্র এনেছিলাম। সেই বই পড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। একে এতো শীতে বই হাতে ধরে রাখা মুশকিল, তার ওপর কাহলিল জিবরানের দার্শনিক লেখা পড়তে হলে মনের যে একাগ্রতা দরকার, সেটা দেয়া সম্ভব হলো না। দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে এক সময় বরফ ঠাণ্ডা মেঝেতেই গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়লাম। থেকে থেকে শরীরে প্রচণ্ড কাঁপুনি দিচ্ছে। মনে হচ্ছিল এই ঠাণ্ডা সহ্য করতে না পেরে বোধহয় অজ্ঞান হয়ে যাব। একবার ভাবলাম, কোর্ট গারদের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে ডেকে সেলের বাইরে রোদে বসতে দেয়ার অনুরোধ করি। পরক্ষণেই মনে হলো, যেচে অনুরোধ প্রত্যাখ্যানের অপমান সহ্য করি কেন, তার চেয়ে যতক্ষণ পারা যায় দাঁতে দাঁত চেপে থাকি।
ঠিক পৌনে দুটোয় পুলিশ গারদের তালা খুলে সংবাদ দিল মামুনের কাজ শেষ হয়েছে। কোর্ট গারদ থেকে জজকোর্টে গিয়ে মামুনকে প্রিজন ভ্যানে তুলতে হলো। ভ্যানের ভাঙা বেঞ্চে বসেই উত্ফুল্ল মামুন জানাল, আজকের মামলায় সে খালাস পেয়েছে। এতক্ষণ মেজাজ তিরিক্ষে হয়ে ছিল, এই সংবাদে বিস্ময়ের ঠেলায় রাগের পারদ মুহূর্তে নেমে এলো। তারেক রহমানের বিশেষ বন্ধু এবং কেস পার্টনারের কোনো মামলা শেখ হাসিনার সরকারের আমলে খারিজ হয়েছে এমন চাঞ্চল্যকর খবর তো আক্কেল গুড়ুম হওয়ার মতো! সচরাচর নিজ থেকে অন্যের খবর জানায় আমার কোনো আগ্রহ না থাকলেও আজ আর নির্বিকার থাকতে পারলাম না। মামলার বিবরণী শোনার পর বিস্ময় কেটে গিয়ে এদেশের বিচার বিভাগের প্রতি করুণা বোধ করতে লাগলাম।
মামুন নিজগুণে মামলায় খালাস পায়নি, সেটা সম্ভব হয়েছে একই মামলায় অন্য এক প্রভাবশালী অভিযুক্তের কল্যাণে। এই ব্যক্তি বাংলাদেশের সেসব ব্যবসায়ীর মধ্যে একজন, যে জানে কি করে দেশের দুই প্রধানদলকে খুশি রাখতে হয়। যে দেবতা যে নৈবেদ্যে সন্তুষ্ট, তাকে সেই নৈবেদ্য অকাতরে দেয়ায় ভদ্রলোকের জুড়ি নেই। দুষ্ট লোকে বলে এক এগারোর পর মইনের খাস লোকজন বিমানবন্দরে সশরীরে উপস্থিত থেকে সপরিবারে তাকে বিদেশ যেতে সহায়তা করেছিল। এই সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর মণিকাঞ্চনের জোরে দেশে-বিদেশের হাইকমাণ্ডকে বাগে আনতে তার কোনো সমস্যাই হয়নি।
সসম্মানে দেশে ফিরে তিনি ব্যবসার হাল ধরেছেন এবং চুটিয়ে সরকারের সঙ্গে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করে যাচ্ছেন। এ ধরনের প্রভাবশালী ব্যক্তি যে মামলায় অভিযুক্ত, সেই মামলা খারিজের আদেশ দেবে না, এমন জজ বাংলাদেশে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। আজ যে মামলা ছিল, সেটি বানোয়াটও যে হতে পারে, সে সম্পর্কে আমি কোনো সন্দেহ ব্যক্ত করতে চাচ্ছি না। তবে, ‘স্বাধীন’ বিচার বিভাগের জামানায় মামলা আসল না নকল, এ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে মামলার বাদী এবং বিবাদী কোন পক্ষের, সেদিকে দৃষ্টি দেয়াই বুদ্ধিমানের লক্ষণ। আর একটি তথ্য পাঠকদের না জানালে আপন বিবেকের কাছে অপরাধী থেকে যাব। বিএনপির অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দের মধ্যেও কিন্তু এই ব্যবসায়ীর গুণগ্রাহীর সংখ্যা একেবারে কম নয়।
মামুন দেখলাম মধ্যাহ্নভোজের জন্য বার্গার, কেক ইত্যাদিসহ নানারকম খাদ্যসামগ্রী নিয়েই প্রিজন ভ্যানে উঠেছে। আমাকে অনেকবার সেখান থেকে খাদ্য গ্রহণের সনির্বন্ধ অনুরোধ জানানো সত্ত্বেও আমি কিছুতেই রাজি হলাম না। অনেক কষ্টে মামুনকে বোঝাতে পারলাম, আমার এই না খাওয়ার হেতু কোনো ব্যক্তিগত বিরাগ নয়, আমি আসলেই প্রিজন ভ্যানের ভেতরে কোনো খাদ্য গ্রহণ করি না। মামুনের সঙ্গে ছয়-সাত ঘণ্টা কাটিয়ে একটা বিষয়ে খুব আশ্চর্য বোধ হতে লাগল। প্রায় চার বছর কারাগারে কাটানোর পরও বাহ্যত তাকে কোনোরকম উদ্বিগ্ন হতে দেখলাম না। কারাগারে ফেরার আগেই লক-আপের সময় হয়ে গেল।
ফিরে দেখি জমাদার, সুবেদারের গালাগাল সহ্য করেও যার যার সেলে না ফিরে মানিক এবং হীরা আমার অপেক্ষায় উদ্বিগ্ন মুখে ডিভিশন ওয়ার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই ছেলে দুটো অজানা কারণে আমাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধাভক্তি করে। এই শীতে আমার গায়ে গরম কাপড়ের স্বল্পতা দেখে দু’জনই অনুযোগ করল। হীরা তো সাহস করে বলেই ফেলল, স্যার এরকম করলে শুধু মনের জোরে শরীর সুস্থ রাখা যাবে না। আমি হেসে জবাব দিলাম, মনের জোর নয়, আল্লাহ্ চাইলে শরীর সুস্থই থাকবে। শীতের প্রচণ্ডতায় ততক্ষণে আমার কিন্তু কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে। কালাম ছুটে এসে একটা পশমী চাদর গায়ে জড়িয়ে দিল। হাতেম নিয়ে এলো গরম চা ভর্তি মেলামাইনের মগ। শেষ হলো কোর্টে হাজিরার নামে আরও একটি দিনের নির্যাতন।
মাননীয় অর্থমন্ত্রী হয় বাংলাদেশের জনগণকে গণ্ডমূর্খ বিবেচনা করেন, অথবা তিনি জনমতের কোনো ধার ধারেন না। নইলে শেয়ারবাজারে একদিনে ১৫ শতাংশ দর বৃদ্ধির তেলেসমাতি দেখানোর আগে এর পরিণতি নিয়ে হাজারবার চিন্তা করতেন। মানছি, এ দেশের শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর অধিকাংশই বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সৈনিক। এটাও সত্যি যে, এদের মাধ্যমে নানা কৌশলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মাথায় কাঁঠাল ভাঙতে আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকরা বিশেষ পারদর্শী। কিন্তু, ২০১১ সালের এক এগারোতে (আজ ১/১১/১১) ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে যে কারসাজি ঘটানো হলো, তাকে এক কথায় ন্যক্কারজনক বললেও কম বলা হয়। অন্য কোনো দেশ হলে কারসাজির হোতাদের এতক্ষণে কোমরে দড়ি পড়ত। কিন্তু, মহাজোটের বাংলাদেশে বিচার, আইন এগুলো সব মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভ্যানিটি ব্যাগে বন্দি।
ভাবা যায়, একদিনে মূল্যসূচক বেড়েছে ১০১২ পয়েন্ট! পুঁজিবাজারের কোম্পানিগুলোকে আল্লাহ কি এমন ছাপ্পর ফুড়ে রাতারাতি কোটি কোটি টাকার লাভ দিলেন যে, লোকে জ্ঞানশূন্য হয়ে সেসব কোম্পানির শেয়ার কেনার জন্য মতিঝিল এলাকায় দলবেঁধে এমনভাবেই ঝাঁপিয়ে পড়ল যাতে এক লাফে শেয়ারের দাম গড়ে ১৫ ভাগ বেড়ে গেল। এই তেলেসমাতি দেখিয়ে কিছুদিন জনগণকে বোকা বানানো গেলেও মনে হয় না ক্ষমতাসীনদের শেষ রক্ষা হবে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যে ক্রমেই সরকারের প্রবঞ্চনা ধরে ফেলছে, তার প্রমাণ পাওয়ার জন্য ২৪ ঘণ্টার বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি।
উত্তরবঙ্গের পৌরসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোটের এক কথায় ভরাডুবি ঘটেছে। মহাজোটের স্বৈরাচারী সাথী এরশাদের ঘাঁটি রংপুরেও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের অবিশ্বাস্য বিজয়েও যদি এদের সংবিত্ না ফেরে, তাহলে কপালে অনেক দুঃখ আছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় সাধারণ ভোটারদের রূপকথার রোমাঞ্চকর গল্প শুনিয়ে মোহিত করা গেলেও গত দুই বছরে একই ভোটাররা যথেষ্ট সাবালক হয়ে উঠেছে। অবশ্য এক উত্তরবঙ্গ দিয়েই সারাদেশের জনমতের ব্যাপারটা বোঝা যাবে না। তবে অতীতের নির্বাচনসমূহে দেখা গেছে, ভোটারদের একটা ঝোঁক শুরু হলে সেটা সচরাচর সেই নির্বাচনে আর বদলায় না।
তবে উত্তরবঙ্গের অপ্রত্যাশিত বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে অন্য বিভাগগুলোতে সরকার যদি প্রশাসনকে অধিক মাত্রায় ব্যবহার করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেয় তাহলে অবাক হওয়া উচিত হবে না। একদিনে সকল বিভাগে নির্বাচন হলে জনরায়ের চিত্রটা স্বচ্ছতার সঙ্গে বোঝা যেত। কিন্তু এটা তো আর হচ্ছে না। যাই হোক, ২০১১ সাল যে শেখ হাসিনার জন্য সুসময় নিয়ে আসেনি, এটা পরিষ্কার। দেশের জনগণ মুখ ফিরিয়ে নেয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতকে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরা ছাড়া সেক্যুলার সরকারের আর কোনো উপায় নেই। তবে শুধু কথায় তো আর চিড়ে ভিজবে না। শাইলকের জাতভাইদের চাহিদাও মেটাতে হবে। পাশের বাড়ির সাম্রাজ্যবাদকে এরই মধ্যে করিডোর, বন্দর, সবই দেয়া হয়ে গেছে। এরও অতিরিক্ত কিছু থাকলে তারও তালিকা মনমোহন সিংয়ের সফরের আগেই তৈরি হয়ে যাবে। ওদিকে আটলান্টিক পাড়ের প্রভুকে তুষ্ট রাখতে হলে সমুদ্রবক্ষে গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে বেশিদিন তালবাহানা করা যাবে না। একই কুমিরছানা বার বার দেখানোর মতো করে ক’দিন পর পর ইসলামী জঙ্গির গল্প ফেঁদে সন্তুষ্ট রাখার দিন দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। কেবল ভারতের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে সম্ভবত শেষরক্ষা হবে না। বৈরী জনমতকে উপেক্ষা করে মসনদে টিকে থাকতে হলে অব্যাহত মার্কিন সমর্থন অপরিহার্য। ১৯৭৫ সালের ভুলের পুনরাবৃত্তি ক্ষমতাসীনরা করবেন না বলেই আমার ধারণা। তবে, ষোল কোটি মানুষ কতদিন তাদের মাতৃভূমি নিয়ে বানরের এই পিঠাভাগ নির্বিকারভাবে দেখে যাবে, সেটাই প্রশ্ন।
No comments