৩৩- কারারক্ষী অম্লান বদনে বললো, হালকা-পাতলা মাইর না দিলে স্যার শয়তান শায়েস্তা হয় না
পক্ষপাতদুষ্ট সম্পাদকীয় নীতি ও প্রতারণা
...রিপোর্টটি সরকারের পক্ষে গেলে একই পত্রিকায় প্রথম পাতায় ভাঁজের উপরে তিন কলামে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। অথবা এই নেতিবাচক রিপোর্ট বিএনপি সরকারের আমলে প্রকাশ পেলে হয়তো হেড লাইনই হয়ে যেত। একটি পত্রিকার এ ধরনের সম্পাদকীয় নীতি হতেই পারে। তবে পরিষ্কার পক্ষপাতদুষ্ট সম্পাদকীয় নীতি অনুসরণ করে কেউ যখন নিরপেক্ষতার দাবি করেন, তখন সেটিকে পাঠকের সঙ্গে প্রবঞ্চনা ছাড়া আর কোনো নামে বর্ণনা করার উপায় থাকে না।...
...রিপোর্টটি সরকারের পক্ষে গেলে একই পত্রিকায় প্রথম পাতায় ভাঁজের উপরে তিন কলামে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। অথবা এই নেতিবাচক রিপোর্ট বিএনপি সরকারের আমলে প্রকাশ পেলে হয়তো হেড লাইনই হয়ে যেত। একটি পত্রিকার এ ধরনের সম্পাদকীয় নীতি হতেই পারে। তবে পরিষ্কার পক্ষপাতদুষ্ট সম্পাদকীয় নীতি অনুসরণ করে কেউ যখন নিরপেক্ষতার দাবি করেন, তখন সেটিকে পাঠকের সঙ্গে প্রবঞ্চনা ছাড়া আর কোনো নামে বর্ণনা করার উপায় থাকে না।...
ঢাকা এবং কাশিমপুরের তুলনায় গাজীপুর অনেক ছোট আকারের কারাগার। খাতা-কলমে এই জেলা কারাগারটির বন্দি ধারণক্ষমতা তিনশ’ হলেও কোনোদিনই সেই সংখ্যা হাজারের নিচে নামে না। জেলের ভেতরে ঢুকলে বাম দিকেই আমার ডিভিশন সেল। আজ পাঁচদিন এখানে যে জীবন কাটাচ্ছি, তাকে প্রকৃত অর্থেই নির্জন কারাবাস বলা চলে। ঢাকায় সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে সাড়ে চার মাস কাটিয়েছি। তারপর কাশিমপুরে তিন মাস ডিভিশনে থাকলেও প্রথম দু’সপ্তাহের পর থেকেই বিকেলের চায়ের আসরে অন্তত মানিক, হীরা, আমিন, পাপ্পু ঘণ্টাখানেক গল্প করে যেত। এখানে সাধারণ কয়েদিদের আসার ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা। মাঝে মধ্যে দুই-একজন দেয়ালের বাইরে থেকে কপালে হাত ঠেকিয়ে সালাম জানায়, আমিও মৃদু হেসে সালামের জবাব দিই। পারস্পরিক সালাম বিনিময়ের দৃশ্য দৈবাত্ জমাদার, সুবেদারের নজরে পড়ে গেলে তারা সেই আসামির উদ্দেশে ধমকে ওঠে, ওরা সভয়ে সরে যায়।
কাশিমপুরে রাতের খাওয়া সাঙ্গ না হওয়া পর্যন্ত কালাম বসে বসে গল্প করত। খাওয়া শেষ হলে সবকিছু গুছিয়ে রেখে মশারি টাঙিয়ে দিয়ে দুই সেবক চলে যাওয়ার পর কারারক্ষী রাত ন’টার দিকে সেলে তালা লাগাতে আসতো। গাজীপুর জেলে ছ’টার মধ্যেই সেই তালা পড়ে যায়। রাতে এশার নামাজ অন্তে টিফিন বাটি থেকে আমাকেই খাবার বার করে নিতে হয়। খাওয়া শেষ হলে নিজেকেই আবার সবকিছু গুছিয়ে রাখতে হয়। জেল কর্তৃপক্ষের প্রস্তাব অনুযায়ী একজন সেবককে আমার সেলে থাকতে দিলে এই ঝামেলাগুলো পোহাতে হতো না। কিন্তু একা থাকার প্রাইভেসি বিসর্জন দেয়া সম্ভব নয়। বাধ্য হয়েই বাসন-কোসন গোছানো, সকালে চা-কফি বানানো, গোসলের পানি গরম করা ইত্যাদি কাজ রপ্ত করে নিতে হয়েছে।
অবশ্য দুই ডেপুটি জেলর এবং সুবেদার দিনে অন্তত একবার করে খোঁজখবর নিয়ে যায়। গতকাল জেলসুপারও দেখা করে গেছেন। ভদ্রলোকের আবার দু’টি দায়িত্ব, গাজীপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলের সুপার এবং জেল সিকিউরিটি বিভাগের প্রধান। দ্বিতীয় দায়িত্ব পালনের জন্য তাকে সপ্তাহের অর্ধেক সময় ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে কাটাতে হয়। জেলসুপারকে দেখে মনে হলো বয়স হয়েছে, অবসর গ্রহণের আর বোধহয় বেশিদিন বাকি নেই। আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে আমি শুধু সম্ভব হলে টয়লেটে কমোড লাগানোর কথা বলতেই তিনি তত্ক্ষণাত্ সম্মতি দিলেন। আমার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার আগে সুপার সেলে টেলিভিশন দেয়ার প্রস্তাব করতে আঁতকে উঠে বললাম, বিটিভি দেখার জুলুম সহ্য হবে না। আমার রসিকতায় জেলসুপার মৃদু হেসে বিদায় নিলেন।
মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ায় শিশুকাল থেকেই আমার একা থাকার অভ্যেস গড়ে উঠেছে। গাজীপুরের সলিটারি কনফাইনমেন্ট তাই তেমন একটা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারেনি। সারাদিন পড়া এবং লেখার মধ্য দিয়ে দিন কেটে যায়। তবে ছোট সংসারের দুই নারী ব্যাকুল হয়ে আমার ফেরার প্রতীক্ষায় দিন গুনছে মনে হলে খানিকক্ষণ বিষণ্নতাবোধে আক্রান্ত হই। হাতের কলম নামিয়ে তখন এক চিলতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। কাশিমপুরের অবারিত প্রকৃতি এখানে নেই; জানালার শিকের ফাঁক দিয়ে বিশাল আকাশের সামান্য একটুখানি অংশমাত্র দেখা যায়। ভোর আর সন্ধ্যা এই দু’টি সময়েই বড় একা লাগে। আজও ফজরের নামাজ শেষ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভোরের আলোর প্রতীক্ষা করছিলাম। হঠাত্ বাবা গো, মা গো আর্তচিত্কার আর লাঠি দিয়ে নির্দয়ভাবে পেটানোর শব্দে চমকে উঠলাম। এই জেলে ডিভিশন সেলের একেবারে গা ঘেঁষে সাধারণ বন্দিদের দেখা-সাক্ষাতের কক্ষ। ওদিক থেকেই চিত্কার ভেসে আসছিল। প্রায় আধঘণ্টা ধরে পেটানো এবং আর্তচিত্কার সমান তালে চলল। তারপর পেটানো বন্ধ হলো, তবে গোঙানি এবং অস্ফুট কান্নার শব্দ চলতেই থাকল।
আটটার দিকে সেবক আলমগীর নাস্তা নিয়ে আসার পর সেই প্রচণ্ড মারের হেতু জানলাম। এক আসামিকে লুকিয়ে গঞ্জিকা সেবনরত অবস্থায় দেখতে পেয়ে অন্য এক সিআইডি আসামি কর্তৃপক্ষকে জানায়। জেল কর্তৃপক্ষ বন্দিদের ওপর নজরদারির জন্য কারারক্ষীদের অতিরিক্ত কয়েকজন আসামিকেও গোয়েন্দার দায়িত্বে রেখে দেয়। এদেরকেই সিআইডি আসামি বলা হয়। আমার সেবক আলমগীরও একজন সিআইডি আসামি। প্রতিদানে এরা হয়তো সাজা রেমিশনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। যা-ই হোক, গঞ্জিকা সেবনে আসক্ত বন্দি সাজা ভোগের পর থেকেই প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তক্কে তক্কে ছিল। কাল রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে প্লাস্টিকের দাড়ি কামানোর ডিসপোজেবল রেজর নিয়ে সেই আসামি সিআইডি’র ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার সারা মুখ ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। সিআইডি’র আর্তচিত্কারে সেলের অন্য আসামিরা ঘুম থেকে জেগে আক্রমণকারীকে হাতে-নাতে ধরে ফেলেছে।
সিআইডি গেছে জেল হাসপাতালে আর গঞ্জিকাসেবীকে সকাল থেকে মেরামত করা চলছে। অপরাধ নিঃসন্দেহে গুরুতর। আলমগীরের কাছ থেকে শুনলাম, চূড়ান্ত বিচার নাকি দুপুরে জেলর এলে হবে। মধ্যাহ্নের আহারের পর শুরু হলো সেই বিচার। সকালের মতোই লাঠির বাড়ি এবং বাবা গো, মা গোর মিলিত আওয়াজ মিনিট পনেরো চলল। তারপর সব চুপচাপ। বিকেলে সেই লাঠিয়াল কারারক্ষীর কাছ থেকেই শাস্তির পুরো বিবরণ শুনলাম। কাউকে পেটাতে হলে সাধারণত গাট্টা-গোট্টা এই বিশেষ কারারক্ষীকেই ডেকে আনা হয়। দুই দফায় ঘণ্টাখানেক পেটানোর পর কুড়ি দিনের ডাণ্ডাবেড়ির সাজা হয়েছে। ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে দশ দিন নির্জন সেলে রাখার পর দুই দিন বিরতি দিয়ে আবার দশ দিনের ডাণ্ডাবেড়ি ট্রিটমেন্ট। ডাণ্ডাবেড়ি সাজা দেয়া হলে আবার লাঠির বাড়ি কেন, প্রশ্ন করায় কারারক্ষী অম্লান বদনে বললো, হালকা-পাতলা মাইর না দিলে শয়তান শায়েস্তা হয় না, স্যার। ঢাকা জেলে থাকতে ক’দিন জেল কোডের পাতা উল্টেছিলাম। সেখানে লাঠিপেটা নামক কোনো সাজা না থাকলেও সম্ভবত বেত্রাঘাত দেখেছি।
গঞ্জিকায় আসক্ত আসামি অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ করা সত্ত্বেও এই বেধড়ক লাঠিপেটার ব্যাপারটি কেন যেন মেনে নিতে পারলাম না। এ ধরনের লাঠিপেটার গল্প অবশ্য ঢাকা এবং কাশিমপুর দুই জেলেই শুনেছি। পেটানোর আবার নানারকম প্রক্রিয়া রয়েছে। পিঠ, নিতম্ব, হাত, পায়ের পাতা কোনোটাই বাদ যায় না। এতদিনের শোনা গল্প গাজীপুরে এসে চোখে দেখার অভিজ্ঞতা হলো। শব্দচয়নে বোধহয় ভুল করলাম। চোখে এখনও দেখিনি, আজ কেবল শব্দ শুনেছি। ডাণ্ডাবেড়ির সাজা প্রসঙ্গে অপর এক আশঙ্কায় শিহরিত হলাম। এদেশে রাজনৈতিক সরকারের আমলে বিরোধী দলের নেতাদের রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের রেওয়াজ এতদিন ছিল না। শেখ হাসিনার দিনবদলের সরকার জেনারেল মইনের কাছ থেকে ট্রেনিং নিয়ে এবার সম্মানিত ব্যক্তিদের নানা প্রক্রিয়ায় অপমান করার পাশাপাশি রিমান্ডে নিয়ে ভয়াবহ নির্যাতনের কলঙ্কজনক ইতিহাস সৃষ্টি করল। ভবিষ্যতে দিনবদলে অধিকতর উত্সাহী কেউ ক্ষমতা দখল করার পর সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে জেলে আটকে রাখার নজির তৈরি করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) বিশ্ব মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১০ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশে মানবাধিকারের ভয়াবহ পরিস্থিতির কথাও বিশদভাবে উল্লেখ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। জেলে থেকে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পড়ার সুযোগ নেই। তবে সরকারপন্থী ডেইলি স্টারে যতটুকু ছাপানো হয়েছে, তাতে মনে হলো ক্রসফায়ার, রিমান্ডে নির্যাতন, সংবাদপত্রের ওপর আক্রমণ, ভিন্নমতাবলম্বীদের নিগ্রহ, সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক নির্বিচারে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা ইত্যাদি বিষয় প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আমার দেশ প্রসঙ্গ রিপোর্টে এসেছে কিনা, সেটি ডেইলি স্টার পড়ে বোঝার উপায় নেই। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের মানবাধিকারের অবস্থা সরেজমিনে দেখতে এসে আমার দেশ প্রসঙ্গ নিয়ে পারভীনের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ শেষে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে গেছে, এ খবর আমি আগেই পেয়েছিলাম। হয়তো প্রতিবেদনে আমার প্রসঙ্গ থাকলেও ডেইলি স্টার সেটি ছাপার যোগ্য বিবেচনা করেনি।
মানবাধিকার সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ সংবাদটি যথাসম্ভব গুরুত্বহীনভাবে ছাপিয়েছে প্রগতিশীলতা এবং কখনও কখনও মানবাধিকারের ধ্বজাধারী ইংরেজি পত্রিকাটি। এই খবরটির জন্য সম্পাদক মহোদয় শেষের পাতায় একটিমাত্র কলাম বরাদ্দ করেছেন। সংবাদের বাকি অংশ জাম্পে ভেতরের পাতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রিপোর্টটি সরকারের পক্ষে গেলে একই পত্রিকায় প্রথম পাতায় ভাঁজের উপরে তিন কলামে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। অথবা এই নেতিবাচক রিপোর্ট বিএনপি সরকারের আমলে প্রকাশ পেলে হয়তো হেড লাইনই হয়ে যেত। একটি পত্রিকার এ ধরনের সম্পাদকীয় নীতি হতেই পারে। তবে পরিষ্কার পক্ষপাতদুষ্ট সম্পাদকীয় নীতি অনুসরণ করে কেউ যখন নিরপেক্ষতার দাবি করেন, তখন সেটিকে পাঠকের সঙ্গে প্রবঞ্চনা ছাড়া আর কোনো নামে বর্ণনা করার উপায় থাকে না। মাত্র ক’দিন আগে লন্ডনের ইকোনমিস্ট পত্রিকা ২০০৯ সালে বাংলাদেশে ‘গণতন্ত্রের অগ্রগতি’ আবিষ্কার করে প্রতিবেদন ছাপালে একই ডেইলি স্টারে সেই সংবাদ প্রথম পাতায় জায়গা পেয়েছিল। অবশ্য এটাও হতে পারে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তুলনায় ইকোনমিস্টকে বাংলাদেশের চিহ্নিত সুশীল (?) পত্রিকাটি অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে থাকে। এই সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার অবশ্যই সম্পাদকের আছে।
দুনিয়ার সর্বত্র রাজনীতিকদের মিথ্যা বচনের বিশেষ ‘সুনাম’ রয়েছে। ইরাক যুদ্ধের সময় পশ্চিমা শাসকদের গণবিধ্বংসী অস্ত্র নিয়ে মিথ্যাচার সম্ভবত নাজি জার্মানির গোয়েবলসেকও হার মানিয়েছিল। যুক্তরাজ্যের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের মিথ্যার ফুলঝুরি এখনও সমান তালেই চলছে। তবে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন মনে হচ্ছে সবাইকে টেক্কা দিয়ে ফেলবেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনের ওপর মন্তব্যকালে তিনি মিডিয়াকে জোর গলায় বলেছেন, তাদের দুই বছরের শাসনকালে বাংলাদেশে একটিও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেনি! স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই দাবির পর আর কী বলা যেতে পারে! গতকালই লন্ডনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর একটা সেমিনার হয়েছে। জেলখানায় সরবরাহ করা সরকার সমর্থক সংবাদপত্রের ট্রিটমেন্ট দেখে ধারণা করছি, বর্তমান প্রশাসন সম্পর্কে কোনো প্রশংসাসূচক বাক্য সেই সেমিনারে উচ্চারিত হয়নি। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী শেখ হাসিনা সরকার নিয়ে ক্রমেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের প্রতিবেদনে মানবাধিকার প্রশ্নে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সুবিধাবাদী নীতিরও তীব্র সমালোচনা করেছে। আন্তর্জাতিক বৈরী পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইসলামী জঙ্গি দমনে তার অপরিহার্যতা পশ্চিমের রাজধানীগুলোকে বোঝানোর জন্য অনেকটা বিনা দাওয়াতেই লটবহর নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
দেশের জনগণ স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় বিগড়ে গিয়ে আগামী নির্বাচনে নৌকা মার্কায় ভোট না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে ক্ষমতাসীনদের কিচ্ছু এসে যায় না। আসল কথা হলো ওবামা, ক্যামেরন, মনমোহনকে তুষ্ট রাখা। সেই লক্ষ্যেই ২৭ জানুয়ারি শেখ হাসিনা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সেমিনারে নিজে ইসলাম ধর্মাবলম্বী হয়েও কথিত ইসলামী জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ক্রুসেডের ঘোষণা দিয়েছেন। কবুল করে নিচ্ছি যে, ইসলামী শরিয়াহ্ সম্পর্কে আমার কোনো জ্ঞান নেই। তবে সুযোগ পেলেই ইসলামের ইতিহাস পড়ার চেষ্টা করি। কোনো মুসলমান কোনোদিন অপর মুসলমানের বিরুদ্ধে ক্রুসেডের ডাক দিয়েছেন—এমন নজির ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাইনি। হতে পারে মৌলবাদী, কট্টরপন্থীদের সম্পর্কে ইসলামের ব্যাখ্যায় ভুল আছে। তারা যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে চলেছে, তার বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক সরকারের বলপ্রয়োগও আবশ্যক। কিন্তু পশ্চিমা কট্টরপন্থী, চরম সাম্প্রদায়িক খ্রিস্টান ধর্মযাজক ও অত্যাচারী শাসকদের শতাব্দীর পর শতাব্দী পরিচালিত ইসলামবিরোধী ক্রুসেডের মর্মান্তিক ইতিহাস জানা থাকলে কোনো মুসলমান ওই শব্দ উচ্চারণ করতে পারে না। প্রথম ক্রুসেডে জেরুজালেমের পতন ঘটলে প্রায় এক লাখ নারী, শিশু, বৃদ্ধ মুসলমানকে খ্রিস্টান হানাদার বাহিনী নির্বিচারে হত্যা করেছিল। জেরুজালেম শহরে মুসলমানদের রক্তের হোলি খেলা হয়েছিল। অথচ সুলতান সালাহ্উদ্দিন আইয়ুবী তৃতীয় ক্রুসেডে জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করলে কোনো খ্রিস্টান বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করা হয়নি। মুসলমানের বিরুদ্ধে ক্রুসেড চালানোর হুমকি দেয়ার আগে মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনার এই রক্তরঞ্জিত ইতিহাস জেনে নেয়া উচিত ছিল।
ক্রুসেড প্রসঙ্গে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের (জুনিয়র) সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের (war against terror) কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ২০০২ সালে আফগানিস্তান আক্রমণের প্রাক্কালে তিনিও একবারের জন্য ‘ক্রুসেড’ শব্দটি ব্যবহার করে যথেষ্ট বিব্রত হয়েছিলেন। উপদেষ্টাদের পরামর্শক্রমে তিনি দ্বিতীয়বার আর এই শব্দ উচ্চারণ করেননি। সেই থেকে শেখ হাসিনা ছাড়া আর কেউ কথিত ইসলামী জঙ্গি প্রসঙ্গে ক্রুসেডকে টেনে আনেননি। বিগত দুই বছরে বর্তমান সরকার ভারতের পদতলে বাংলাদেশের সব স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়েছে। বাংলাদেশের আজব জনগণ নির্বিকারভাবে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেয়া দেখে গেছে। বাংলাদেশে নানা ধরনের রক্ষা সমিতি থাকলেও ভারতের ব্যাপারে তারা টুঁ শব্দটিও করেনি। এবার যুক্তরাজ্য সফরে গিয়ে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ক্রুসেডের ঘোষণা দিয়ে শেখ হাসিনা তার সর্বশেষ ট্রাম্প কার্ডটি ব্যবহার করলেন। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে এত বড় ঝুঁকি নেয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ভারতের সহায়তায় তিনি ২০২১ পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার স্বপ্ন দেখতেই পারেন।
কাশিমপুরে রাতের খাওয়া সাঙ্গ না হওয়া পর্যন্ত কালাম বসে বসে গল্প করত। খাওয়া শেষ হলে সবকিছু গুছিয়ে রেখে মশারি টাঙিয়ে দিয়ে দুই সেবক চলে যাওয়ার পর কারারক্ষী রাত ন’টার দিকে সেলে তালা লাগাতে আসতো। গাজীপুর জেলে ছ’টার মধ্যেই সেই তালা পড়ে যায়। রাতে এশার নামাজ অন্তে টিফিন বাটি থেকে আমাকেই খাবার বার করে নিতে হয়। খাওয়া শেষ হলে নিজেকেই আবার সবকিছু গুছিয়ে রাখতে হয়। জেল কর্তৃপক্ষের প্রস্তাব অনুযায়ী একজন সেবককে আমার সেলে থাকতে দিলে এই ঝামেলাগুলো পোহাতে হতো না। কিন্তু একা থাকার প্রাইভেসি বিসর্জন দেয়া সম্ভব নয়। বাধ্য হয়েই বাসন-কোসন গোছানো, সকালে চা-কফি বানানো, গোসলের পানি গরম করা ইত্যাদি কাজ রপ্ত করে নিতে হয়েছে।
অবশ্য দুই ডেপুটি জেলর এবং সুবেদার দিনে অন্তত একবার করে খোঁজখবর নিয়ে যায়। গতকাল জেলসুপারও দেখা করে গেছেন। ভদ্রলোকের আবার দু’টি দায়িত্ব, গাজীপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলের সুপার এবং জেল সিকিউরিটি বিভাগের প্রধান। দ্বিতীয় দায়িত্ব পালনের জন্য তাকে সপ্তাহের অর্ধেক সময় ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে কাটাতে হয়। জেলসুপারকে দেখে মনে হলো বয়স হয়েছে, অবসর গ্রহণের আর বোধহয় বেশিদিন বাকি নেই। আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে আমি শুধু সম্ভব হলে টয়লেটে কমোড লাগানোর কথা বলতেই তিনি তত্ক্ষণাত্ সম্মতি দিলেন। আমার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার আগে সুপার সেলে টেলিভিশন দেয়ার প্রস্তাব করতে আঁতকে উঠে বললাম, বিটিভি দেখার জুলুম সহ্য হবে না। আমার রসিকতায় জেলসুপার মৃদু হেসে বিদায় নিলেন।
মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ায় শিশুকাল থেকেই আমার একা থাকার অভ্যেস গড়ে উঠেছে। গাজীপুরের সলিটারি কনফাইনমেন্ট তাই তেমন একটা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারেনি। সারাদিন পড়া এবং লেখার মধ্য দিয়ে দিন কেটে যায়। তবে ছোট সংসারের দুই নারী ব্যাকুল হয়ে আমার ফেরার প্রতীক্ষায় দিন গুনছে মনে হলে খানিকক্ষণ বিষণ্নতাবোধে আক্রান্ত হই। হাতের কলম নামিয়ে তখন এক চিলতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। কাশিমপুরের অবারিত প্রকৃতি এখানে নেই; জানালার শিকের ফাঁক দিয়ে বিশাল আকাশের সামান্য একটুখানি অংশমাত্র দেখা যায়। ভোর আর সন্ধ্যা এই দু’টি সময়েই বড় একা লাগে। আজও ফজরের নামাজ শেষ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভোরের আলোর প্রতীক্ষা করছিলাম। হঠাত্ বাবা গো, মা গো আর্তচিত্কার আর লাঠি দিয়ে নির্দয়ভাবে পেটানোর শব্দে চমকে উঠলাম। এই জেলে ডিভিশন সেলের একেবারে গা ঘেঁষে সাধারণ বন্দিদের দেখা-সাক্ষাতের কক্ষ। ওদিক থেকেই চিত্কার ভেসে আসছিল। প্রায় আধঘণ্টা ধরে পেটানো এবং আর্তচিত্কার সমান তালে চলল। তারপর পেটানো বন্ধ হলো, তবে গোঙানি এবং অস্ফুট কান্নার শব্দ চলতেই থাকল।
আটটার দিকে সেবক আলমগীর নাস্তা নিয়ে আসার পর সেই প্রচণ্ড মারের হেতু জানলাম। এক আসামিকে লুকিয়ে গঞ্জিকা সেবনরত অবস্থায় দেখতে পেয়ে অন্য এক সিআইডি আসামি কর্তৃপক্ষকে জানায়। জেল কর্তৃপক্ষ বন্দিদের ওপর নজরদারির জন্য কারারক্ষীদের অতিরিক্ত কয়েকজন আসামিকেও গোয়েন্দার দায়িত্বে রেখে দেয়। এদেরকেই সিআইডি আসামি বলা হয়। আমার সেবক আলমগীরও একজন সিআইডি আসামি। প্রতিদানে এরা হয়তো সাজা রেমিশনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। যা-ই হোক, গঞ্জিকা সেবনে আসক্ত বন্দি সাজা ভোগের পর থেকেই প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তক্কে তক্কে ছিল। কাল রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে প্লাস্টিকের দাড়ি কামানোর ডিসপোজেবল রেজর নিয়ে সেই আসামি সিআইডি’র ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার সারা মুখ ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। সিআইডি’র আর্তচিত্কারে সেলের অন্য আসামিরা ঘুম থেকে জেগে আক্রমণকারীকে হাতে-নাতে ধরে ফেলেছে।
সিআইডি গেছে জেল হাসপাতালে আর গঞ্জিকাসেবীকে সকাল থেকে মেরামত করা চলছে। অপরাধ নিঃসন্দেহে গুরুতর। আলমগীরের কাছ থেকে শুনলাম, চূড়ান্ত বিচার নাকি দুপুরে জেলর এলে হবে। মধ্যাহ্নের আহারের পর শুরু হলো সেই বিচার। সকালের মতোই লাঠির বাড়ি এবং বাবা গো, মা গোর মিলিত আওয়াজ মিনিট পনেরো চলল। তারপর সব চুপচাপ। বিকেলে সেই লাঠিয়াল কারারক্ষীর কাছ থেকেই শাস্তির পুরো বিবরণ শুনলাম। কাউকে পেটাতে হলে সাধারণত গাট্টা-গোট্টা এই বিশেষ কারারক্ষীকেই ডেকে আনা হয়। দুই দফায় ঘণ্টাখানেক পেটানোর পর কুড়ি দিনের ডাণ্ডাবেড়ির সাজা হয়েছে। ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে দশ দিন নির্জন সেলে রাখার পর দুই দিন বিরতি দিয়ে আবার দশ দিনের ডাণ্ডাবেড়ি ট্রিটমেন্ট। ডাণ্ডাবেড়ি সাজা দেয়া হলে আবার লাঠির বাড়ি কেন, প্রশ্ন করায় কারারক্ষী অম্লান বদনে বললো, হালকা-পাতলা মাইর না দিলে শয়তান শায়েস্তা হয় না, স্যার। ঢাকা জেলে থাকতে ক’দিন জেল কোডের পাতা উল্টেছিলাম। সেখানে লাঠিপেটা নামক কোনো সাজা না থাকলেও সম্ভবত বেত্রাঘাত দেখেছি।
গঞ্জিকায় আসক্ত আসামি অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ করা সত্ত্বেও এই বেধড়ক লাঠিপেটার ব্যাপারটি কেন যেন মেনে নিতে পারলাম না। এ ধরনের লাঠিপেটার গল্প অবশ্য ঢাকা এবং কাশিমপুর দুই জেলেই শুনেছি। পেটানোর আবার নানারকম প্রক্রিয়া রয়েছে। পিঠ, নিতম্ব, হাত, পায়ের পাতা কোনোটাই বাদ যায় না। এতদিনের শোনা গল্প গাজীপুরে এসে চোখে দেখার অভিজ্ঞতা হলো। শব্দচয়নে বোধহয় ভুল করলাম। চোখে এখনও দেখিনি, আজ কেবল শব্দ শুনেছি। ডাণ্ডাবেড়ির সাজা প্রসঙ্গে অপর এক আশঙ্কায় শিহরিত হলাম। এদেশে রাজনৈতিক সরকারের আমলে বিরোধী দলের নেতাদের রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের রেওয়াজ এতদিন ছিল না। শেখ হাসিনার দিনবদলের সরকার জেনারেল মইনের কাছ থেকে ট্রেনিং নিয়ে এবার সম্মানিত ব্যক্তিদের নানা প্রক্রিয়ায় অপমান করার পাশাপাশি রিমান্ডে নিয়ে ভয়াবহ নির্যাতনের কলঙ্কজনক ইতিহাস সৃষ্টি করল। ভবিষ্যতে দিনবদলে অধিকতর উত্সাহী কেউ ক্ষমতা দখল করার পর সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে জেলে আটকে রাখার নজির তৈরি করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) বিশ্ব মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১০ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশে মানবাধিকারের ভয়াবহ পরিস্থিতির কথাও বিশদভাবে উল্লেখ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। জেলে থেকে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পড়ার সুযোগ নেই। তবে সরকারপন্থী ডেইলি স্টারে যতটুকু ছাপানো হয়েছে, তাতে মনে হলো ক্রসফায়ার, রিমান্ডে নির্যাতন, সংবাদপত্রের ওপর আক্রমণ, ভিন্নমতাবলম্বীদের নিগ্রহ, সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক নির্বিচারে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা ইত্যাদি বিষয় প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আমার দেশ প্রসঙ্গ রিপোর্টে এসেছে কিনা, সেটি ডেইলি স্টার পড়ে বোঝার উপায় নেই। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের মানবাধিকারের অবস্থা সরেজমিনে দেখতে এসে আমার দেশ প্রসঙ্গ নিয়ে পারভীনের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ শেষে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে গেছে, এ খবর আমি আগেই পেয়েছিলাম। হয়তো প্রতিবেদনে আমার প্রসঙ্গ থাকলেও ডেইলি স্টার সেটি ছাপার যোগ্য বিবেচনা করেনি।
মানবাধিকার সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ সংবাদটি যথাসম্ভব গুরুত্বহীনভাবে ছাপিয়েছে প্রগতিশীলতা এবং কখনও কখনও মানবাধিকারের ধ্বজাধারী ইংরেজি পত্রিকাটি। এই খবরটির জন্য সম্পাদক মহোদয় শেষের পাতায় একটিমাত্র কলাম বরাদ্দ করেছেন। সংবাদের বাকি অংশ জাম্পে ভেতরের পাতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রিপোর্টটি সরকারের পক্ষে গেলে একই পত্রিকায় প্রথম পাতায় ভাঁজের উপরে তিন কলামে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। অথবা এই নেতিবাচক রিপোর্ট বিএনপি সরকারের আমলে প্রকাশ পেলে হয়তো হেড লাইনই হয়ে যেত। একটি পত্রিকার এ ধরনের সম্পাদকীয় নীতি হতেই পারে। তবে পরিষ্কার পক্ষপাতদুষ্ট সম্পাদকীয় নীতি অনুসরণ করে কেউ যখন নিরপেক্ষতার দাবি করেন, তখন সেটিকে পাঠকের সঙ্গে প্রবঞ্চনা ছাড়া আর কোনো নামে বর্ণনা করার উপায় থাকে না। মাত্র ক’দিন আগে লন্ডনের ইকোনমিস্ট পত্রিকা ২০০৯ সালে বাংলাদেশে ‘গণতন্ত্রের অগ্রগতি’ আবিষ্কার করে প্রতিবেদন ছাপালে একই ডেইলি স্টারে সেই সংবাদ প্রথম পাতায় জায়গা পেয়েছিল। অবশ্য এটাও হতে পারে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তুলনায় ইকোনমিস্টকে বাংলাদেশের চিহ্নিত সুশীল (?) পত্রিকাটি অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে থাকে। এই সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার অবশ্যই সম্পাদকের আছে।
দুনিয়ার সর্বত্র রাজনীতিকদের মিথ্যা বচনের বিশেষ ‘সুনাম’ রয়েছে। ইরাক যুদ্ধের সময় পশ্চিমা শাসকদের গণবিধ্বংসী অস্ত্র নিয়ে মিথ্যাচার সম্ভবত নাজি জার্মানির গোয়েবলসেকও হার মানিয়েছিল। যুক্তরাজ্যের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের মিথ্যার ফুলঝুরি এখনও সমান তালেই চলছে। তবে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন মনে হচ্ছে সবাইকে টেক্কা দিয়ে ফেলবেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনের ওপর মন্তব্যকালে তিনি মিডিয়াকে জোর গলায় বলেছেন, তাদের দুই বছরের শাসনকালে বাংলাদেশে একটিও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেনি! স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই দাবির পর আর কী বলা যেতে পারে! গতকালই লন্ডনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর একটা সেমিনার হয়েছে। জেলখানায় সরবরাহ করা সরকার সমর্থক সংবাদপত্রের ট্রিটমেন্ট দেখে ধারণা করছি, বর্তমান প্রশাসন সম্পর্কে কোনো প্রশংসাসূচক বাক্য সেই সেমিনারে উচ্চারিত হয়নি। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী শেখ হাসিনা সরকার নিয়ে ক্রমেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের প্রতিবেদনে মানবাধিকার প্রশ্নে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সুবিধাবাদী নীতিরও তীব্র সমালোচনা করেছে। আন্তর্জাতিক বৈরী পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইসলামী জঙ্গি দমনে তার অপরিহার্যতা পশ্চিমের রাজধানীগুলোকে বোঝানোর জন্য অনেকটা বিনা দাওয়াতেই লটবহর নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
দেশের জনগণ স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় বিগড়ে গিয়ে আগামী নির্বাচনে নৌকা মার্কায় ভোট না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে ক্ষমতাসীনদের কিচ্ছু এসে যায় না। আসল কথা হলো ওবামা, ক্যামেরন, মনমোহনকে তুষ্ট রাখা। সেই লক্ষ্যেই ২৭ জানুয়ারি শেখ হাসিনা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সেমিনারে নিজে ইসলাম ধর্মাবলম্বী হয়েও কথিত ইসলামী জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ক্রুসেডের ঘোষণা দিয়েছেন। কবুল করে নিচ্ছি যে, ইসলামী শরিয়াহ্ সম্পর্কে আমার কোনো জ্ঞান নেই। তবে সুযোগ পেলেই ইসলামের ইতিহাস পড়ার চেষ্টা করি। কোনো মুসলমান কোনোদিন অপর মুসলমানের বিরুদ্ধে ক্রুসেডের ডাক দিয়েছেন—এমন নজির ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাইনি। হতে পারে মৌলবাদী, কট্টরপন্থীদের সম্পর্কে ইসলামের ব্যাখ্যায় ভুল আছে। তারা যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে চলেছে, তার বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক সরকারের বলপ্রয়োগও আবশ্যক। কিন্তু পশ্চিমা কট্টরপন্থী, চরম সাম্প্রদায়িক খ্রিস্টান ধর্মযাজক ও অত্যাচারী শাসকদের শতাব্দীর পর শতাব্দী পরিচালিত ইসলামবিরোধী ক্রুসেডের মর্মান্তিক ইতিহাস জানা থাকলে কোনো মুসলমান ওই শব্দ উচ্চারণ করতে পারে না। প্রথম ক্রুসেডে জেরুজালেমের পতন ঘটলে প্রায় এক লাখ নারী, শিশু, বৃদ্ধ মুসলমানকে খ্রিস্টান হানাদার বাহিনী নির্বিচারে হত্যা করেছিল। জেরুজালেম শহরে মুসলমানদের রক্তের হোলি খেলা হয়েছিল। অথচ সুলতান সালাহ্উদ্দিন আইয়ুবী তৃতীয় ক্রুসেডে জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করলে কোনো খ্রিস্টান বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করা হয়নি। মুসলমানের বিরুদ্ধে ক্রুসেড চালানোর হুমকি দেয়ার আগে মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনার এই রক্তরঞ্জিত ইতিহাস জেনে নেয়া উচিত ছিল।
ক্রুসেড প্রসঙ্গে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের (জুনিয়র) সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের (war against terror) কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ২০০২ সালে আফগানিস্তান আক্রমণের প্রাক্কালে তিনিও একবারের জন্য ‘ক্রুসেড’ শব্দটি ব্যবহার করে যথেষ্ট বিব্রত হয়েছিলেন। উপদেষ্টাদের পরামর্শক্রমে তিনি দ্বিতীয়বার আর এই শব্দ উচ্চারণ করেননি। সেই থেকে শেখ হাসিনা ছাড়া আর কেউ কথিত ইসলামী জঙ্গি প্রসঙ্গে ক্রুসেডকে টেনে আনেননি। বিগত দুই বছরে বর্তমান সরকার ভারতের পদতলে বাংলাদেশের সব স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়েছে। বাংলাদেশের আজব জনগণ নির্বিকারভাবে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেয়া দেখে গেছে। বাংলাদেশে নানা ধরনের রক্ষা সমিতি থাকলেও ভারতের ব্যাপারে তারা টুঁ শব্দটিও করেনি। এবার যুক্তরাজ্য সফরে গিয়ে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ক্রুসেডের ঘোষণা দিয়ে শেখ হাসিনা তার সর্বশেষ ট্রাম্প কার্ডটি ব্যবহার করলেন। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে এত বড় ঝুঁকি নেয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ভারতের সহায়তায় তিনি ২০২১ পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার স্বপ্ন দেখতেই পারেন।
No comments