২৭- পশ্চিমা সরকারগুলো বাংলাদেশে মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতার দুরবস্থায় ক্রমেই বিরক্ত, উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে
কারাগারে এলো নোমান
জানতে পারিনি, জেলের প্রথম রাত নোমানের কেমন কেটেছে। তবে বন্দিশালার মোটা মোটা শিকের মধ্য দিয়ে একচিলতে আকাশের দিকে তাকিয়ে জুলুমের বিরুদ্ধে এ দেশের গণমানুষের আগামী দিনের জাগরণের চিত্র দেখতে পাই। গতকাল জেলগেট পর্যন্ত নোমানকে সঙ্গ দিয়ে আতাউস সামাদ, ফরহাদ মজহার এবং রুহুল আমিন গাজী আমার স্বপ্নে দেখা সেই বিপ্লবের প্রত্যাশা উজ্জ্বলতর করেছেন।
জানতে পারিনি, জেলের প্রথম রাত নোমানের কেমন কেটেছে। তবে বন্দিশালার মোটা মোটা শিকের মধ্য দিয়ে একচিলতে আকাশের দিকে তাকিয়ে জুলুমের বিরুদ্ধে এ দেশের গণমানুষের আগামী দিনের জাগরণের চিত্র দেখতে পাই। গতকাল জেলগেট পর্যন্ত নোমানকে সঙ্গ দিয়ে আতাউস সামাদ, ফরহাদ মজহার এবং রুহুল আমিন গাজী আমার স্বপ্নে দেখা সেই বিপ্লবের প্রত্যাশা উজ্জ্বলতর করেছেন।
অলিউল্লাহ নোমানকে আজও আদালতে উপস্থিত দেখে বিস্মিত হলাম। ভয় পাচ্ছিলাম ওকে না আবার সুপ্রিমকোর্ট চত্বর থেকেই পুলিশ গ্রেফতার করে। আবদালসহ অন্য সাংবাদিকরা জানাল তেমন কোনো আশঙ্কা নেই। আমার দেশ পত্রিকার সব সাংবাদিক এবং তাদের শুভানুধ্যায়ীরা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নোমান আগামীকাল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আত্মসমর্পণ করবে। আমাদের মামলার রায় নিয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিক্রিয়া সংবলিত সংবাদের কাটিংসমৃদ্ধ একটি ফাইল নোমানই আমার দিকে এগিয়ে দিল। সেখানে দেখলাম ফরাসি দেশের সাংবাদিক সংগঠন রিপোর্টার্স স্যানস ফ্রন্টিয়াসর্্ (Reporters Sans Frontiers) আমার এবং নোমানের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের কঠোর সমালোচনা করেছে। তারা বলেছে, "The authorities are trying to relieve prison overcrowding by freeing lots of detainees, yet the Supreme Court has passed jail terms on these two journalists. This is absurd. The government and the courts are making a mistake by targeting the opposition media. They are not the enemy."
(প্রশাসন যে সময় বিপুলসংখ্যক বন্দিকে মুক্তি দিয়ে কারাগারের জনাধিক্য সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করছে, সেই সময় সুপ্রিমকোর্ট দু’জন সাংবাদিককে জেলের দণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠাচ্ছে। সরকার এবং আদালত বিরুদ্ধ মতকে নিশানা বানিয়ে ভুল করছে। তারা শত্রু নয়।) আমাকে যে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন করা হয়েছে, বিবৃতিতে তারও উল্লেখ রয়েছে। বন্দিত্বের কারণে আমি পত্রিকা চালাতে পারছি না, এ বিষয়টি উল্লেখ করে বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকদের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত ফ্রান্সের এই সাংবাদিক সংগঠনটি রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপেরও আহ্বান জানিয়েছে।
পশ্চিমা বিশ্বের সরকারগুলো তাদের স্বার্থে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’ সরকারের যতই প্রশংসা করুক না কেন তাদের দেশের বিবেকসম্পন্ন জনগণ বাংলাদেশের মানবাধিকার ও বাক্ স্বাধীনতার দুরবস্থার কথা জানতে পেরে ক্রমেই বিরক্ত ও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছেন। তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্বকে এতই কাছাকাছি নিয়ে এসেছে যে, একবিংশ শতাব্দীতে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই দীর্ঘদিন ধরে অপকর্ম ঢেকে রাখা সম্ভব নয়। ডিজিটালের ডঙ্কা পেটানো চরম নিবর্তনমূলক ফ্যাসিবাদি সরকারের মূল সমস্যা এখানেই। দেশে দেশে লবিস্ট নিয়োগ করে সরকারকে খানিকটা প্রভাবিত করা গেলেও প্রকৃত অবস্থা জেনে সেসব দেশের জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে সেসব সরকারকেও এক সময় জনমতের কাছে নতি স্বীকার করতে হবে। আমার দেশ-এর উপর রাষ্ট্রযন্ত্র লেলিয়ে দিয়ে মহাজোট সরকার তাদের চরম অগণতান্ত্রিক চেহারাকেই আন্তর্জাতিক মহলে উন্মোচিত করেছে। বিলম্বে হলেও এর প্রতিফল তাদের ভোগ করতে হবে।
সকাল ন’টা বেজে ঠিক কুড়ি মিনিটে আমার পূর্বপরিচিত ছয় লর্ডশিপ তাদের উচ্চ আসন গ্রহণ করলেন। দিনের কার্য তালিকায় আমার মামলার নম্বর তিন। মিনিট দশেকের মধ্যেই ডাক পড়ল। সেই পরিচিত মাইক স্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, দ্বিতীয় মামলার কনটেম্পট্ পিটিশন এখনও চোখেই দেখিনি এবং আগস্টের উনিশের পর থেকে গত পাঁচদিনে কোনো আইনজীবীকে আমার সঙ্গে দেখাও করতে দেয়া হয়নি। সঙ্গত কারণেই জবাবের প্রস্তুতির জন্য যুক্তিসঙ্গত সময় দরকার। বিচারপতিরা অ্যাটর্নি জেনারেলের দিকে জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকালেন। সেখান থেকে ‘চমত্কার’ জবাব এলো। সরকার পক্ষের যুক্তি হলো, যেহেতু প্রথম মামলার শুনানি চলাকালীন আদালত রুল ইস্যু করেছে সে কারণে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস আসামির কাছে কাগজপত্র পাঠানোর কোনো প্রয়োজন বোধ করেনি। দশ বছর আগের বিচার বিভাগ হলে সরকারি উকিলকে এই অজ্ঞতাপ্রসূত, তাচ্ছিল্যপূর্ণ জবাবের জন্য আদালতের কঠোর ভর্ত্সনা শুনতে হতো। কিন্তু, দিন বদলের সরকারের আমলে আদালতের পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। দৃশ্যত: বিব্রত প্রধান বিচারপতি মো. ফজলুল করিম বেঞ্চের নিচে বসে থাকা সুপ্রিমকোর্টের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আমার বক্তব্যের সত্যতা জানতে চাইলেন। সেখানকার নথিতে প্রমাণ মিলল, আমি সত্য কথাই বলেছি। কারাগারে আমার কাছে সমন কিংবা পিটিশন কোনোটাই পৌঁছানো হয়নি। সিস্টেম আমাকে নিয়ে কতটা বিপদগ্রস্ত সেটা বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের মন্তব্যে প্রমাণিত হলো। তিনি বার দুয়েক জানতে চাইলেন, সমনই যদি আমার কাছে পৌঁছানো না হয়ে থাকে তাহলে কোন্ আইন বলে রাষ্ট্রপক্ষ আমাকে আজ আদালতে হাজির করেছে। বলাই বাহুল্য অ্যাটর্নি জেনারেল এই প্রশ্নের জবাব দেয়ার কোনো প্রয়োজনই বোধ করলেন না। সরকার পক্ষের আইনজীবীদের দ্বিতীয় সারিতে উপবিষ্ট অ্যাডভোকেট আনিসুল হক আইন অনুযায়ী আমার সময়ের দাবি যথার্থ মন্তব্য করলে অ্যাটর্নি জেনারেল আমাকে ২৪ ঘণ্টার সময় দেয়ার প্রস্তাব করলেন।
এই তামাশায় মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখা আর সম্ভব হলো না। বেশ উচ্চকণ্ঠেই বলে উঠলাম, বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল সম্ভবত ভুলে গেছেন আমি কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক একজন বন্দি। তার মতো মুক্ত মানুষ নই। একদিনের মধ্যে জবাব তৈরি করার প্রস্তাব অবাস্তব। যে আদালত এতক্ষণ ধরে সরকার পক্ষের আইনজীবীদের যাবতীয় বালখিল্যতা অম্লান বদনে সহ্য করছিলেন, তারাই আমার একটি মাত্র মন্তব্যে ভয়ানক রাগান্বিত হয়ে উঠলেন। উষ্মাসহকারে আমাকে থামতে বলে প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করলেন, এসব বিষয় দেখার জন্য তারাই রয়েছেন, আমার কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই। আমিও ভাবলাম, তাই তো, মাত্র পাঁচদিন আগে এই আদালতেই ন্যায়পরায়ণতার অনন্য উদাহরণ দেখার পর আমার মনে ইনসাফ প্রাপ্তি নিয়ে কোনো রকম সংশয় পোষণ করাটাই চরম বেয়াদবি! সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদে বর্ণিত সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার করার মহান দায়িত্ব লর্ডশিপদের ওপর অর্পণ করে আমি নীরব রইলাম। শেষ পর্যন্ত অক্টোবরের ১১ তারিখে পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য হলো। এছাড়া অবশ্য আদালতের কোনো গত্যন্তর ছিল না। আজ ২৪ তারিখ, পরশু থেকে উচ্চ আদালত এক মাসের শরত্কালীন ছুটিতে যাচ্ছে। তারপর বর্তমান প্রধান বিচারপতি অবসরে যাবেন। আমার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত এই মামলার বিচারকার্য সমাধা করতে তার যথেষ্ট উত্সাহ উপস্থিত সবার কাছে দৃশ্যমান হলেও তার সময় শেষ হয়েছে। তিনি দ্বিতীয়বার আমার সাজা শোনানোর সুযোগ পাচ্ছেন না। দু’রাত খেটেখুটে জবাবের একটা খসড়া তৈরি করেছিলাম। সেই খসড়াটি ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের হাতে দিয়ে এজলাস ত্যাগ করলাম।
গতকাল সুপ্রিমকোর্ট থেকে ফিরে ভেবেছিলাম, সেপ্টেম্বর ৬ এর আগে আদালতে আর কোনো হাজিরা নেই। সকাল ন’টায় হাজিরার স্লিপ নিয়ে এক কারারক্ষী এসে হাজির। আজই নাকি সিএমএম আদালতে কোনো এক অজানা মামলার শুনানি রয়েছে। সংবাদ বাহক মামলা সম্পর্কে একেবারেই অন্ধকারে। মামলার সংখ্যাও এখন অর্ধশত হতে একটা মাত্র বাকি। এই বয়সে আমার পক্ষেও এত মামলার হিসাব রাখা সম্ভব নয়। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তৈরি হয়ে কারারক্ষীর সঙ্গে রওয়ানা দিলাম। পৌনে দশটার মধ্যে আমাকে কোর্ট গারদে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। হঠাত্ করে আদালতে আসায় আজ আর সঙ্গে করে বই এবং মেঝেতে বিছানোর জন্য পুরনো খবরের কাগজ আনা হয়নি। এদিকে শরীর বাহ্যত সুস্থ থাকলেও রমজানের অর্ধেক পার হওয়াতে ক্রমেই ক্লান্তি ভর করছে। গারদের ওই নোংরা মেঝেতেই এক সময় সটান শুয়ে পড়লাম। ক্লান্তিতে চোখও লেগে এসেছিল। সশব্দে গারদের দরজা খোলার আওয়াজে চোখ খুলতেই একজন পুলিশ কর্মকর্তা আদালতে ডাক পড়ার খবর দিল। তখনও জানি না, কোন মামলার হাজিরাতে যাচ্ছি। আজ আমার পক্ষের কোনো আইনজীবী গারদে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেননি। আমার অসংখ্য মামলার দায়িত্ব নিয়ে তাদের মধ্যেও সম্ভবত: ক্লান্তি এসেছে। গারদ থেকে ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাস পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার পথে কোর্ট গারদের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক অশিষ্ট, অতি উত্সাহী পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাদানুবাদে লিপ্ত হতে হলো। কর্মকর্তাটির নাম মুরাদ। পুলিশ বেষ্টনীর মধ্যে হাঁট ার সময় তরুণ অফিসারটি বার বার আমার কবজি ধরে চলার চেষ্টা করায় আমি যারপরনাই বিরক্ত হয়ে প্রতিবার হাত ছাড়িয়ে নিচ্ছিলাম। উদ্ধত প্রকৃতির পুলিশ কর্মকর্তাটি জানাল, আমি যাতে অপেক্ষমাণ সাংবাদিক, জনতার উদ্দেশে হাত নাড়তে না পারি, সে কারণেই উপর থেকে নাকি তাকে এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বলাই বাহুল্য চোর, ডাকাতের মতো আমার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে পুলিশটির আদালত পর্যন্ত ধরে নিয়ে যাওয়ার খায়েশ পূর্ণ হতে দেইনি। আমাকে নিয়ে সরকারের ভয় এবং আমার প্রতি তাদের আক্রোশ কতটা নগ্নভাবে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে দেখে দেশের ভবিষ্যত্ নিয়ে শঙ্কাবোধ করলাম। এই সরকার রাষ্ট্রের তাবত্ অংশকে চরমভাবে দলীয়করণই কেবল করেনি, এই অতীব গর্হিত কাজ করা নিয়ে কারও মধ্যে কোনো রকম লজ্জাবোধও আর অবশিষ্ট নেই। চলার পথে দু’পাশ থেকে আদালত চত্বরে উপস্থিত জনগণ সালাম জানাচ্ছিলেন। সেই সালামের জবাব দেয়ার উপর কোনো বাধা-নিষেধ আছে কিনা, জিজ্ঞাসা করলে পুলিশ কর্মকর্তাটি নিরুত্তরই রইল।
আদালতের কাঠগড়ায় ওঠার পর জানতে পারলাম, আইন প্রতিমন্ত্রীর পরিবারের রাজাকারি অতীত নিয়ে সংবাদ প্রকাশের অপরাধে যে মানহানি মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল, আজ তারই চার্জ গঠন শুনানি। অন্যান্য দিনের মতো আমার মামলায় ঢাকা বারের জাতীয়তাবাদী আইনজীবীদের ভিড় লক্ষ্য করলাম না। পরে অবশ্য জেনেছিলাম, একই দিনে বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের একটি মামলা থাকায় সঙ্গত কারণেই আমার পক্ষে আইনজীবী পাওয়া যাচ্ছিল না। ম্যাজিস্ট্রেটকে দেখে পরিচিত মনে হলো। এই ভদ্রলোকই সম্ভবত তেজগাঁও থানার দায়েরকৃত পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা দেয়ার বানোয়াট মামলায় সরকার পক্ষের এক তরফা শুনানি করে আমাকে তিন দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছিলেন। সেই রিমান্ডেই ক্যান্টনমেন্ট থানায় নিয়ে আমাকে নির্যাতনের কাহিনী আগেই বর্ণনা করেছি। রিমান্ডের রায় ঘোষণার সময় ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয়ের চোখে-মুখে যে অপার সন্তোষ লক্ষ্য করেছিলাম, তা আজ পর্যন্ত ভোলা সম্ভব হয়নি। যাই হোক, আজকের মামলা শুনানির ঠিক পূর্ব মুহূর্তে ঢাকা বার সভাপতি অ্যাডভোকেট সানাউল্লা মিঞার জুনিয়র অ্যাডভোকেট মেসবাহউদ্দিন, ঢাকার নিম্নআদালতে আমার দেশ পত্রিকার প্রতিনিধি অ্যাডভোকেট বেলাল হোসেন এবং অ্যাডভোকেট সুলতান মাহমুদকে দেখে খানিকটা ভরসা পেলাম। তারা চার্জ গঠন আবেদনের বিরোধিতা করার জন্য সময় প্রার্থনা করলে আমাকে বেশ অবাক করেই ম্যাজিস্ট্রেট সেপ্টেম্বরের ঊনত্রিশ তারিখ মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করলেন। গারদে ফিরে প্রিজন ভ্যানে উঠতে যাব, এমন সময় অ্যাডভোকেট মাসুদ তালুকদার এসে উপস্থিত হলেন। আজকের মামলার খবর মাসুদ ভাইয়ের জানা না থাকায় তিনি সময়মত আদালতে হাজির না থাকার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। আমিও খুশি মনেই জেলে ফিরলাম। ডজন ডজন মামলা এখন আর আমাকে উদ্বিগ্ন করে না। বরং ‘সাগরে পেতেছি শয্যা শিশিরে কি ভয়’ বহুল পরিচিত এই পঙিক্তটি স্মরণ করে এক প্রকার আত্মপ্রসাদ অনুভব করি।
কাল বিকালে আদালত থেকে জেলে ফেরার পর থেকেই অলিউল্লাহ নোমানের জন্য দুশ্চিন্তায় ছিলাম। ২৪ তারিখে সুপ্রিমকোর্টে জেনে এসেছিলাম নোমান ২৫ তারিখে জেলগেটে আত্মসমর্পণ করবে। প্রায় তিন মাসের জেলজীবনে এখানে অনেক শিষ্য জুটে গেছে। বেলা এগারোটার দিকে তাদেরই একজনকে আমার তরুণ, বিপ্লবী সহকর্মী ও কেস পার্টনারের খোঁজ-খবরের জন্য জেলগেটে পাঠালাম। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরে এসে জানাল, গতকাল বিকেলে পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেলে আসার পর ১০ নম্বর সেলের ১ নম্বর কক্ষে নোমানের ঠাঁই মিলেছে। সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করার বিনিময়ে এই জেলদণ্ড নোমানকে দেশ-বিদেশের সাংবাদিকতা জগতে অধিকতর মর্যাদা দান করবে, এটাই প্রত্যাশা করি। নোমান জরিমানা দেয়ার পরিবর্তে এক সপ্তাহ অতিরিক্ত সাজা খাটার সিদ্ধান্ত নিয়ে আপসকামিতার এই বাংলাদেশে এক নতুন নজির সৃষ্টি করেছে। এখন থেকে আদালত অবমাননার অন্যায় মামলায় দেশের সব নাগরিক অনুপ্রাণিত হয়ে ক্ষমা না চাইবার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে, এমন আকাশ-কুসুম প্রত্যাশা আমার নেই। তবে আমার এবং নোমানের সাজার প্রতিক্রিয়ায় ১৯২৬ সালের ঔপনিবেশিক আমলের আদালত অবমাননা আইন নিয়ে সমাজের সর্বস্তরে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তার মূল্য মোটেও সামান্য নয়। বিনা প্রতিবাদে সব অবিচার মেনে নেয়ার ফলেই বর্তমান সরকার আদালতকে এতখানি নগ্নভাবে দলীয়করণ করতে সক্ষম হয়েছে। ইনসাফের জন্য কেবল আল্লাহ্র কাছে কান্নাকাটি করে কোনো লাভ নেই। ইনসাফ এবং হক আদায় করার লক্ষ্যে লড়াই করাও জরুরি। আমার দুই জেল-শিষ্যের কাছ থেকে শুনলাম, জেলগেটে নোমানের আত্মসমর্পণের সময় সহমর্মিতা জানাতে তার সঙ্গে কাল এসেছিলেন প্রবীণ সাংবাদিক আতাউস সামাদ, প্রথাবিরোধী বুদ্ধিজীবী ও কবি ফরহাদ মজহার, সাংবাদিক নেতা রুহুল আমিন গাজীসহ তিন শতাধিক সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীর এক বিরাট দল। আমি এখনও জানতে পারিনি, জেলের প্রথম রাত নোমানের কেমন কেটেছে। তবে বন্দিশালার মোটা মোটা শিকের মধ্য দিয়ে এক চিলতে আকাশের দিকে তাকিয়ে জুলুমের বিরুদ্ধে এ দেশের গণমানুষের আগামী দিনের জাগরণের চিত্র দেখতে পাই। গতকাল জেলগেট পর্যন্ত নোমানকে সঙ্গ দিয়ে আতাউস সামাদ, ফরহাদ মজহার এবং রুহুল আমিন গাজী আমার স্বপ্নে দেখা সেই বিপ্লবের প্রত্যাশা উজ্জ্বলতর করেছেন। মহান আল্লাহ্তায়ালা তাদের মঙ্গল করুন।
(প্রশাসন যে সময় বিপুলসংখ্যক বন্দিকে মুক্তি দিয়ে কারাগারের জনাধিক্য সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করছে, সেই সময় সুপ্রিমকোর্ট দু’জন সাংবাদিককে জেলের দণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠাচ্ছে। সরকার এবং আদালত বিরুদ্ধ মতকে নিশানা বানিয়ে ভুল করছে। তারা শত্রু নয়।) আমাকে যে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন করা হয়েছে, বিবৃতিতে তারও উল্লেখ রয়েছে। বন্দিত্বের কারণে আমি পত্রিকা চালাতে পারছি না, এ বিষয়টি উল্লেখ করে বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকদের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত ফ্রান্সের এই সাংবাদিক সংগঠনটি রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপেরও আহ্বান জানিয়েছে।
পশ্চিমা বিশ্বের সরকারগুলো তাদের স্বার্থে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’ সরকারের যতই প্রশংসা করুক না কেন তাদের দেশের বিবেকসম্পন্ন জনগণ বাংলাদেশের মানবাধিকার ও বাক্ স্বাধীনতার দুরবস্থার কথা জানতে পেরে ক্রমেই বিরক্ত ও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছেন। তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্বকে এতই কাছাকাছি নিয়ে এসেছে যে, একবিংশ শতাব্দীতে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই দীর্ঘদিন ধরে অপকর্ম ঢেকে রাখা সম্ভব নয়। ডিজিটালের ডঙ্কা পেটানো চরম নিবর্তনমূলক ফ্যাসিবাদি সরকারের মূল সমস্যা এখানেই। দেশে দেশে লবিস্ট নিয়োগ করে সরকারকে খানিকটা প্রভাবিত করা গেলেও প্রকৃত অবস্থা জেনে সেসব দেশের জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে সেসব সরকারকেও এক সময় জনমতের কাছে নতি স্বীকার করতে হবে। আমার দেশ-এর উপর রাষ্ট্রযন্ত্র লেলিয়ে দিয়ে মহাজোট সরকার তাদের চরম অগণতান্ত্রিক চেহারাকেই আন্তর্জাতিক মহলে উন্মোচিত করেছে। বিলম্বে হলেও এর প্রতিফল তাদের ভোগ করতে হবে।
সকাল ন’টা বেজে ঠিক কুড়ি মিনিটে আমার পূর্বপরিচিত ছয় লর্ডশিপ তাদের উচ্চ আসন গ্রহণ করলেন। দিনের কার্য তালিকায় আমার মামলার নম্বর তিন। মিনিট দশেকের মধ্যেই ডাক পড়ল। সেই পরিচিত মাইক স্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, দ্বিতীয় মামলার কনটেম্পট্ পিটিশন এখনও চোখেই দেখিনি এবং আগস্টের উনিশের পর থেকে গত পাঁচদিনে কোনো আইনজীবীকে আমার সঙ্গে দেখাও করতে দেয়া হয়নি। সঙ্গত কারণেই জবাবের প্রস্তুতির জন্য যুক্তিসঙ্গত সময় দরকার। বিচারপতিরা অ্যাটর্নি জেনারেলের দিকে জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকালেন। সেখান থেকে ‘চমত্কার’ জবাব এলো। সরকার পক্ষের যুক্তি হলো, যেহেতু প্রথম মামলার শুনানি চলাকালীন আদালত রুল ইস্যু করেছে সে কারণে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস আসামির কাছে কাগজপত্র পাঠানোর কোনো প্রয়োজন বোধ করেনি। দশ বছর আগের বিচার বিভাগ হলে সরকারি উকিলকে এই অজ্ঞতাপ্রসূত, তাচ্ছিল্যপূর্ণ জবাবের জন্য আদালতের কঠোর ভর্ত্সনা শুনতে হতো। কিন্তু, দিন বদলের সরকারের আমলে আদালতের পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। দৃশ্যত: বিব্রত প্রধান বিচারপতি মো. ফজলুল করিম বেঞ্চের নিচে বসে থাকা সুপ্রিমকোর্টের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আমার বক্তব্যের সত্যতা জানতে চাইলেন। সেখানকার নথিতে প্রমাণ মিলল, আমি সত্য কথাই বলেছি। কারাগারে আমার কাছে সমন কিংবা পিটিশন কোনোটাই পৌঁছানো হয়নি। সিস্টেম আমাকে নিয়ে কতটা বিপদগ্রস্ত সেটা বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের মন্তব্যে প্রমাণিত হলো। তিনি বার দুয়েক জানতে চাইলেন, সমনই যদি আমার কাছে পৌঁছানো না হয়ে থাকে তাহলে কোন্ আইন বলে রাষ্ট্রপক্ষ আমাকে আজ আদালতে হাজির করেছে। বলাই বাহুল্য অ্যাটর্নি জেনারেল এই প্রশ্নের জবাব দেয়ার কোনো প্রয়োজনই বোধ করলেন না। সরকার পক্ষের আইনজীবীদের দ্বিতীয় সারিতে উপবিষ্ট অ্যাডভোকেট আনিসুল হক আইন অনুযায়ী আমার সময়ের দাবি যথার্থ মন্তব্য করলে অ্যাটর্নি জেনারেল আমাকে ২৪ ঘণ্টার সময় দেয়ার প্রস্তাব করলেন।
এই তামাশায় মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখা আর সম্ভব হলো না। বেশ উচ্চকণ্ঠেই বলে উঠলাম, বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল সম্ভবত ভুলে গেছেন আমি কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক একজন বন্দি। তার মতো মুক্ত মানুষ নই। একদিনের মধ্যে জবাব তৈরি করার প্রস্তাব অবাস্তব। যে আদালত এতক্ষণ ধরে সরকার পক্ষের আইনজীবীদের যাবতীয় বালখিল্যতা অম্লান বদনে সহ্য করছিলেন, তারাই আমার একটি মাত্র মন্তব্যে ভয়ানক রাগান্বিত হয়ে উঠলেন। উষ্মাসহকারে আমাকে থামতে বলে প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করলেন, এসব বিষয় দেখার জন্য তারাই রয়েছেন, আমার কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই। আমিও ভাবলাম, তাই তো, মাত্র পাঁচদিন আগে এই আদালতেই ন্যায়পরায়ণতার অনন্য উদাহরণ দেখার পর আমার মনে ইনসাফ প্রাপ্তি নিয়ে কোনো রকম সংশয় পোষণ করাটাই চরম বেয়াদবি! সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদে বর্ণিত সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার করার মহান দায়িত্ব লর্ডশিপদের ওপর অর্পণ করে আমি নীরব রইলাম। শেষ পর্যন্ত অক্টোবরের ১১ তারিখে পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য হলো। এছাড়া অবশ্য আদালতের কোনো গত্যন্তর ছিল না। আজ ২৪ তারিখ, পরশু থেকে উচ্চ আদালত এক মাসের শরত্কালীন ছুটিতে যাচ্ছে। তারপর বর্তমান প্রধান বিচারপতি অবসরে যাবেন। আমার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত এই মামলার বিচারকার্য সমাধা করতে তার যথেষ্ট উত্সাহ উপস্থিত সবার কাছে দৃশ্যমান হলেও তার সময় শেষ হয়েছে। তিনি দ্বিতীয়বার আমার সাজা শোনানোর সুযোগ পাচ্ছেন না। দু’রাত খেটেখুটে জবাবের একটা খসড়া তৈরি করেছিলাম। সেই খসড়াটি ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের হাতে দিয়ে এজলাস ত্যাগ করলাম।
গতকাল সুপ্রিমকোর্ট থেকে ফিরে ভেবেছিলাম, সেপ্টেম্বর ৬ এর আগে আদালতে আর কোনো হাজিরা নেই। সকাল ন’টায় হাজিরার স্লিপ নিয়ে এক কারারক্ষী এসে হাজির। আজই নাকি সিএমএম আদালতে কোনো এক অজানা মামলার শুনানি রয়েছে। সংবাদ বাহক মামলা সম্পর্কে একেবারেই অন্ধকারে। মামলার সংখ্যাও এখন অর্ধশত হতে একটা মাত্র বাকি। এই বয়সে আমার পক্ষেও এত মামলার হিসাব রাখা সম্ভব নয়। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তৈরি হয়ে কারারক্ষীর সঙ্গে রওয়ানা দিলাম। পৌনে দশটার মধ্যে আমাকে কোর্ট গারদে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। হঠাত্ করে আদালতে আসায় আজ আর সঙ্গে করে বই এবং মেঝেতে বিছানোর জন্য পুরনো খবরের কাগজ আনা হয়নি। এদিকে শরীর বাহ্যত সুস্থ থাকলেও রমজানের অর্ধেক পার হওয়াতে ক্রমেই ক্লান্তি ভর করছে। গারদের ওই নোংরা মেঝেতেই এক সময় সটান শুয়ে পড়লাম। ক্লান্তিতে চোখও লেগে এসেছিল। সশব্দে গারদের দরজা খোলার আওয়াজে চোখ খুলতেই একজন পুলিশ কর্মকর্তা আদালতে ডাক পড়ার খবর দিল। তখনও জানি না, কোন মামলার হাজিরাতে যাচ্ছি। আজ আমার পক্ষের কোনো আইনজীবী গারদে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেননি। আমার অসংখ্য মামলার দায়িত্ব নিয়ে তাদের মধ্যেও সম্ভবত: ক্লান্তি এসেছে। গারদ থেকে ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাস পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার পথে কোর্ট গারদের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক অশিষ্ট, অতি উত্সাহী পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাদানুবাদে লিপ্ত হতে হলো। কর্মকর্তাটির নাম মুরাদ। পুলিশ বেষ্টনীর মধ্যে হাঁট ার সময় তরুণ অফিসারটি বার বার আমার কবজি ধরে চলার চেষ্টা করায় আমি যারপরনাই বিরক্ত হয়ে প্রতিবার হাত ছাড়িয়ে নিচ্ছিলাম। উদ্ধত প্রকৃতির পুলিশ কর্মকর্তাটি জানাল, আমি যাতে অপেক্ষমাণ সাংবাদিক, জনতার উদ্দেশে হাত নাড়তে না পারি, সে কারণেই উপর থেকে নাকি তাকে এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বলাই বাহুল্য চোর, ডাকাতের মতো আমার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে পুলিশটির আদালত পর্যন্ত ধরে নিয়ে যাওয়ার খায়েশ পূর্ণ হতে দেইনি। আমাকে নিয়ে সরকারের ভয় এবং আমার প্রতি তাদের আক্রোশ কতটা নগ্নভাবে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে দেখে দেশের ভবিষ্যত্ নিয়ে শঙ্কাবোধ করলাম। এই সরকার রাষ্ট্রের তাবত্ অংশকে চরমভাবে দলীয়করণই কেবল করেনি, এই অতীব গর্হিত কাজ করা নিয়ে কারও মধ্যে কোনো রকম লজ্জাবোধও আর অবশিষ্ট নেই। চলার পথে দু’পাশ থেকে আদালত চত্বরে উপস্থিত জনগণ সালাম জানাচ্ছিলেন। সেই সালামের জবাব দেয়ার উপর কোনো বাধা-নিষেধ আছে কিনা, জিজ্ঞাসা করলে পুলিশ কর্মকর্তাটি নিরুত্তরই রইল।
আদালতের কাঠগড়ায় ওঠার পর জানতে পারলাম, আইন প্রতিমন্ত্রীর পরিবারের রাজাকারি অতীত নিয়ে সংবাদ প্রকাশের অপরাধে যে মানহানি মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল, আজ তারই চার্জ গঠন শুনানি। অন্যান্য দিনের মতো আমার মামলায় ঢাকা বারের জাতীয়তাবাদী আইনজীবীদের ভিড় লক্ষ্য করলাম না। পরে অবশ্য জেনেছিলাম, একই দিনে বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের একটি মামলা থাকায় সঙ্গত কারণেই আমার পক্ষে আইনজীবী পাওয়া যাচ্ছিল না। ম্যাজিস্ট্রেটকে দেখে পরিচিত মনে হলো। এই ভদ্রলোকই সম্ভবত তেজগাঁও থানার দায়েরকৃত পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা দেয়ার বানোয়াট মামলায় সরকার পক্ষের এক তরফা শুনানি করে আমাকে তিন দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছিলেন। সেই রিমান্ডেই ক্যান্টনমেন্ট থানায় নিয়ে আমাকে নির্যাতনের কাহিনী আগেই বর্ণনা করেছি। রিমান্ডের রায় ঘোষণার সময় ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয়ের চোখে-মুখে যে অপার সন্তোষ লক্ষ্য করেছিলাম, তা আজ পর্যন্ত ভোলা সম্ভব হয়নি। যাই হোক, আজকের মামলা শুনানির ঠিক পূর্ব মুহূর্তে ঢাকা বার সভাপতি অ্যাডভোকেট সানাউল্লা মিঞার জুনিয়র অ্যাডভোকেট মেসবাহউদ্দিন, ঢাকার নিম্নআদালতে আমার দেশ পত্রিকার প্রতিনিধি অ্যাডভোকেট বেলাল হোসেন এবং অ্যাডভোকেট সুলতান মাহমুদকে দেখে খানিকটা ভরসা পেলাম। তারা চার্জ গঠন আবেদনের বিরোধিতা করার জন্য সময় প্রার্থনা করলে আমাকে বেশ অবাক করেই ম্যাজিস্ট্রেট সেপ্টেম্বরের ঊনত্রিশ তারিখ মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করলেন। গারদে ফিরে প্রিজন ভ্যানে উঠতে যাব, এমন সময় অ্যাডভোকেট মাসুদ তালুকদার এসে উপস্থিত হলেন। আজকের মামলার খবর মাসুদ ভাইয়ের জানা না থাকায় তিনি সময়মত আদালতে হাজির না থাকার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। আমিও খুশি মনেই জেলে ফিরলাম। ডজন ডজন মামলা এখন আর আমাকে উদ্বিগ্ন করে না। বরং ‘সাগরে পেতেছি শয্যা শিশিরে কি ভয়’ বহুল পরিচিত এই পঙিক্তটি স্মরণ করে এক প্রকার আত্মপ্রসাদ অনুভব করি।
কাল বিকালে আদালত থেকে জেলে ফেরার পর থেকেই অলিউল্লাহ নোমানের জন্য দুশ্চিন্তায় ছিলাম। ২৪ তারিখে সুপ্রিমকোর্টে জেনে এসেছিলাম নোমান ২৫ তারিখে জেলগেটে আত্মসমর্পণ করবে। প্রায় তিন মাসের জেলজীবনে এখানে অনেক শিষ্য জুটে গেছে। বেলা এগারোটার দিকে তাদেরই একজনকে আমার তরুণ, বিপ্লবী সহকর্মী ও কেস পার্টনারের খোঁজ-খবরের জন্য জেলগেটে পাঠালাম। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরে এসে জানাল, গতকাল বিকেলে পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেলে আসার পর ১০ নম্বর সেলের ১ নম্বর কক্ষে নোমানের ঠাঁই মিলেছে। সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করার বিনিময়ে এই জেলদণ্ড নোমানকে দেশ-বিদেশের সাংবাদিকতা জগতে অধিকতর মর্যাদা দান করবে, এটাই প্রত্যাশা করি। নোমান জরিমানা দেয়ার পরিবর্তে এক সপ্তাহ অতিরিক্ত সাজা খাটার সিদ্ধান্ত নিয়ে আপসকামিতার এই বাংলাদেশে এক নতুন নজির সৃষ্টি করেছে। এখন থেকে আদালত অবমাননার অন্যায় মামলায় দেশের সব নাগরিক অনুপ্রাণিত হয়ে ক্ষমা না চাইবার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে, এমন আকাশ-কুসুম প্রত্যাশা আমার নেই। তবে আমার এবং নোমানের সাজার প্রতিক্রিয়ায় ১৯২৬ সালের ঔপনিবেশিক আমলের আদালত অবমাননা আইন নিয়ে সমাজের সর্বস্তরে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তার মূল্য মোটেও সামান্য নয়। বিনা প্রতিবাদে সব অবিচার মেনে নেয়ার ফলেই বর্তমান সরকার আদালতকে এতখানি নগ্নভাবে দলীয়করণ করতে সক্ষম হয়েছে। ইনসাফের জন্য কেবল আল্লাহ্র কাছে কান্নাকাটি করে কোনো লাভ নেই। ইনসাফ এবং হক আদায় করার লক্ষ্যে লড়াই করাও জরুরি। আমার দুই জেল-শিষ্যের কাছ থেকে শুনলাম, জেলগেটে নোমানের আত্মসমর্পণের সময় সহমর্মিতা জানাতে তার সঙ্গে কাল এসেছিলেন প্রবীণ সাংবাদিক আতাউস সামাদ, প্রথাবিরোধী বুদ্ধিজীবী ও কবি ফরহাদ মজহার, সাংবাদিক নেতা রুহুল আমিন গাজীসহ তিন শতাধিক সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীর এক বিরাট দল। আমি এখনও জানতে পারিনি, জেলের প্রথম রাত নোমানের কেমন কেটেছে। তবে বন্দিশালার মোটা মোটা শিকের মধ্য দিয়ে এক চিলতে আকাশের দিকে তাকিয়ে জুলুমের বিরুদ্ধে এ দেশের গণমানুষের আগামী দিনের জাগরণের চিত্র দেখতে পাই। গতকাল জেলগেট পর্যন্ত নোমানকে সঙ্গ দিয়ে আতাউস সামাদ, ফরহাদ মজহার এবং রুহুল আমিন গাজী আমার স্বপ্নে দেখা সেই বিপ্লবের প্রত্যাশা উজ্জ্বলতর করেছেন। মহান আল্লাহ্তায়ালা তাদের মঙ্গল করুন।
No comments