৯- যে সরকার নাগরিককে ক্রসফায়ারে পাঠায় তারাই ভয়াবহ সন্ত্রাসীদের মুক্তি দেয়
সুশীল (?) বিবেকে কোনো নাড়া পড়েনি
...লগি-বৈঠা দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছে, অথচ আমরা অপরাধীদের শাস্তি বিধানের পরিবর্তে নিহতের রাজনৈতিক পরিচয় খুঁজে বেড়িয়েছি। তথাকথিত সুশীল (?) বিবেকে কোনো নাড়া পড়েনি। বছরের পর বছর রিমান্ডে নির্যাতন, পুলিশ হেফাজতে হত্যা এবং ক্রসফায়ার চলেছে অপ্রতিরোধ্যভাবে। আমরা চুপচাপ মেনে নিয়েছি।...
...লগি-বৈঠা দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছে, অথচ আমরা অপরাধীদের শাস্তি বিধানের পরিবর্তে নিহতের রাজনৈতিক পরিচয় খুঁজে বেড়িয়েছি। তথাকথিত সুশীল (?) বিবেকে কোনো নাড়া পড়েনি। বছরের পর বছর রিমান্ডে নির্যাতন, পুলিশ হেফাজতে হত্যা এবং ক্রসফায়ার চলেছে অপ্রতিরোধ্যভাবে। আমরা চুপচাপ মেনে নিয়েছি।...
আদর্শহীন তরুণের নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্র হৃদয়ে তীব্র বেদনার জন্ম দেয়। ইভটিজিং নামে সমাজের এক সাম্প্রতিক ক্ষত এখন গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ছে। ক’দিন আগে ফরিদপুরের এক পল্লীতে কয়েকজন বখাটে তরুণ এক মধ্যবয়সিনী মহিলাকে মোটরসাইকেল চাপা দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। মহিলাটির অপরাধ, তিনি চারজন তরুণী ও কিশোরীর জননী। বখে যাওয়া প্রতিবেশী তরুণদের লালসা থেকে সেই মা তার আত্মজাদের রক্ষা করবার প্রচেষ্টায় প্রাণ দিয়েছেন। এই দুঃখজনক ঘটনার মাত্র ক’দিন আগে সম্ভবত মানিকগঞ্জে একজন শিক্ষককে একই কারণে হত্যা করেছে দুর্বিনীত তরুণের দল। সেই শিক্ষক তার ছাত্রীদের ইভটিজারদের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টায় সাহস করে প্রতিবাদ করেছিলেন।
এ কোন বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন তরুণ প্রজন্ম এ দেশে বিকশিত হচ্ছে? এরাই কি বাংলাদেশের ভবিষ্যত্? অসুস্থ সমাজের অবধারিত প্রতিক্রিয়া হিসেবেই এই বর্বর শ্রেণী আবির্ভূত হয়েছে। লগি-বৈঠা দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছে, অথচ আমরা অপরাধীদের শাস্তি বিধানের পরিবর্তে নিহতের রাজনৈতিক পরিচয় খুঁজে বেড়িয়েছি। তথাকথিত সুশীল (?) বিবেকে কোনো নাড়া পড়েনি। বছরের পর বছর রিমান্ডে নির্যাতন, পুলিশ হেফাজতে হত্যা এবং ক্রসফায়ার চলেছে অপ্রতিরোধ্যভাবে। আমরা চুপচাপ মেনে নিয়েছি। রাজনৈতিক বিরোধীপক্ষের নেতাকর্মীদের গুম খুন করা হচ্ছে, নদী-নালায় কারও লাশ পাওয়া যাচ্ছে, আবার কারও ঠাঁই হচ্ছে চিরস্থায়ীভাবে নিখোঁজের তালিকায়। তাদের আপনজন বাকি জীবন অন্তহীন প্রতীক্ষার দুঃসহ বেদনায় কাটিয়ে দিচ্ছে। এত অন্যায়, অথচ কোথাও কোনো প্রতিবাদ নেই।
দিনবদলের সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে পাতিনেতা পর্যন্ত সমাজের সর্বত্র হিংসা ও বিদ্বেষের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিতে ব্যস্ত। তরুণী কন্যার আব্রু রক্ষা করতে পারছি না। অথচ বোরখা ও হেজাবের ওপর সরকারদলীয় নেতাকর্মী এবং ঠ্যাঙাড়ে পুলিশ বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ভাবা যায়, যে রাষ্ট্রের নব্বই শতাংশ নাগরিক ইসলাম ধর্মাবলম্বী, সেই রাষ্ট্রে কেবল বোরখা পরার ‘অপরাধে’ সম্ভ্রান্ত পরিবারের তরুণীকে জেলে এবং রিমান্ডে পাঠানো হচ্ছে। আমার মা সারাজীবন অধ্যাপনা করেছেন, বোরখা পরেননি। আমার স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছে, কখনও বোরখা পরেনি। কিন্তু, তাই বলে অন্য পরিবারে বোরখার প্রচলনকে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করার কোনো অধিকার আমার নেই।
এই সরকারের কর্তাব্যক্তিদের সেই অধিকার কে দিল? নির্বাচনের আগে এক বিদেশিকে সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীপুত্র ইংরেজিতে একটি আর্টিকেল লিখেছিলেন। সেই লেখায় বোরখা এবং বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীতে মাদ্রাসায় শিক্ষিত সৈনিকদের উপস্থিতি নিয়ে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য ছিল। এবারের মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণ করেই বর্তমান সরকার মাদ্রাসা ও বোরখার ওপর খড়গহস্ত হওয়ার যে নীতি গ্রহণ করেছে, সেটি প্রণয়নে সজীব ওয়াজেদ জয় কী ভূমিকা রেখেছেন, তা আমার জানা নেই। তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে যে এ ধরনের নীতি গ্রহণ করা হবে, তার একটা আগাম ইঙ্গিত ছিল তার লেখায়। ইসলামবিদ্বেষী সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদকে সন্তুষ্ট করে ক্ষমতালাভ এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার অপকৌশল বাংলাদেশকে ক্রমেই আইনের শাসনবিহীন একটি বর্বর, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করছে। জেল থেকেই খবর পাচ্ছি, দলীয় বিবেচনায় একের পর এক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতায় মুক্তি দেয়া হচ্ছে। যে সরকার শত শত নাগরিককে সন্ত্রাসের অভিযোগে ক্রসফায়ারে পরপারে পাঠায়, তারাই আবার আদালতকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রশাসনিক আদেশে ভয়াবহ সব সন্ত্রাসীকে মুক্তি দিচ্ছে। এই বৈপরীত্য মেনে নেয়া যায় না। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসব সংবাদ বন্দিজীবনের হতাশাকে কেবল বাড়িয়েই দিচ্ছে। জীবনের বাকি যে ক’টা দিন আল্লাহ নির্দিষ্ট করে রেখেছেন, তার মধ্যে পচে যাওয়া সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লব দেখে যাওয়ার বড় সাধ জাগে।
নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও জেল প্রশাসনে আজ ছোটখাটো একটা ঝড় তুলতে হলো। ইচ্ছা ছিল না, কারণ ঢাকা জেল প্রশাসনের তুলনায় এখানকার লোকজন অধিকতর মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন। কিন্তু পরিস্থিতি বাধ্য করলো। আমার বাবুর্চি দু’দিন ধরে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে শয্যাশায়ী। কালাম একে-ওকে ধরে কোনোমতে তিনজনের রান্নার কাজ চালিয়ে নিচ্ছিল। আজ ন’টা বেজে যায়, নাস্তার খবর নেই। বাংলাদেশের কথিত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের একটা বড় অংশ কাশিমপুর জেলে বন্দি। অর্থ ও শক্তির দাপটে কয়েদিদের মধ্যে এদের বিরাট প্রভাব-প্রতিপত্তি। বিশেষ ব্যবস্থায় তাদের রান্নার আয়োজন ও মেন্যু দেখলে যে কোনো মধ্যবিত্তের মাথা ঘুরে যাবে। বাবুর্চির কামপাশধারী জেলের অধিকাংশ আসামি এই টপটেররদের রান্না-বান্নাতেই বেশি উত্সাহী। গত দু’দিনে সেসব বাবুর্চির কেউ কেউ আমার জন্যে রাঁধতে এসে যত্সামান্য আয়োজন দেখে নাক সিঁটকে চলে গেছে। কর্তৃপক্ষ তাদের নানাবিধ দুর্বলতার কারণে কিছু বলতেও পারছিল না। আজ নাস্তা একেবারে আসছেই না দেখে কালামের কাছে হেতু জিজ্ঞাসা করে যে জবাব পেলাম, তাতে মেজাজ আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলাম না। কালাম জানালো, আজ নতুন এক সমস্যা জুটেছে। এতদিন বাবুর্চি পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক অনুরোধ, উপরোধের পর আজ সকালে বাবুর্চি একজন এসেছে; কিন্তু চুলা খালি পাওয়া যাচ্ছে না। সবগুলোতেই নাকি ভাইদের নাস্তা তৈরি হচ্ছে। ডজন ডজন পরোটা, ডিমের ওমলেট, হালুয়া, মুরগির কারি ইত্যাদি রান্না শেষ হলে তবেই আমি নাস্তা পাব।
জেলবাস যথাসম্ভব মানিয়ে চলার চেষ্টা করছি। তাই বলে এতটা সহ্য করা কঠিন। কালাম বললো, আমার জায়গায় লুত্ফুজ্জামান বাবর হলে এতক্ষণে তুলকালাম বেধে যেত। আমি কলমপেষা মানুষ, চিত্কার, চেঁচামেচি ঠিক ধাতে সয় না। অতএব, যা পারি সেটাই করলাম। জেল কোড অনুযায়ী আমার অধিকারের বিষয়টি উদ্ধৃত করে জেলসুপারকে পত্র লিখে কালামকে দিয়ে জেলগেটে পাঠিয়ে দিলাম। এরপর অবশ্য আধঘণ্টার বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। নাস্তা তো এলোই, তার সঙ্গে বড় সাহেবরাও দল বেঁধে এলেন। আমি শান্তভাবে বললাম, তিন বেলা অতি সাধারণ খাওয়া ছাড়া আমার আর তো কোনো চাহিদা নেই। ওটুকুর ব্যবস্থাও যদি করা সম্ভব না হয়, তাহলে আমাকে জানালে বাইরে থেকে না হয় আনানোর ব্যবস্থা করব। সুপার, জেলার যথেষ্ট দুঃখ প্রকাশ করে এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর ঘটবে না প্রতিশ্রুুতি দিয়ে সদলবলে বিদায় নিলেন। বেচারা বড় সুবেদার কিছু গালমন্দ হজম করলো। তখন আবার আমারই খারাপ লাগতে লাগল। ছেলেগুলো ভালোই। সামান্য নাস্তার জন্যে এত হুলস্থূল না করলেই পারতাম।
আজ পত্রিকায় লুত্ফুজ্জামান বাবরের ছবি দেখে মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। তাকে রিমান্ড শুনানির জন্যে গতকাল চট্টগ্রামে নেয়া হয়েছে। ছবিতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সাবেক এই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর নাক দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত চুইয়ে পড়ছে। গুরুতর অসুস্থ এই লোকটিকে হাসপাতালে নেয়ার পরিবর্তে টানা-হ্যাঁচড়া করে চট্টগ্রাম নিয়ে কাঠগড়ায় তুলতে কথিত গণতান্ত্রিক সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মনুষ্যত্বে বিন্দুমাত্র আঘাত লাগেনি। অবশ্য লাগবেই বা কী করে? এদেরই অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালতে উঁচু গলায় বলেছিলেন, বাবর আগে মারা যাক, তারপর মামলা করতে আইসেন। এমন দুর্বিনীত উচ্চারণ সত্ত্বেও উচ্চ আদালত তাকে ভর্ত্সনা না করে বরং তারই আবেদনক্রমে বাবরের হাইকোর্ট থেকে প্রাপ্ত জামিন স্থগিত করেছিল। ‘চেম্বার মানেই সরকারপক্ষে স্টে’ শিরোনামে আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে সেই ঘটনার উল্লেখ ছিল। উচ্চ আদালতসংশ্লিষ্ট বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের অপরাধেই অলিউল্লাহ নোমান এক মাস সাত দিন জেল খেটে গেছে এবং আমি এখনও সাজা ভোগ করছি। এরপর কার এত সাহস যে বলে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা স্বাধীন হয়নি? সেই স্বাধীনতার নমুনা কাল বাবরের রিমান্ড শুনানিতে পুনর্বার দেখা গেল। রক্তাক্ত, অসুস্থ আসামি চোখের সামনে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে, আর ‘ন্যায়বিচার ও বিবেকের’ পরাকাষ্ঠা মাননীয় ম্যাজিস্ট্রেট পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদেশ দিলেন। পত্রিকার সংবাদ অনুযায়ী আসামিপক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য সমাপ্ত করারও সুযোগ না দিয়ে দশ মিনিটের মধ্যেই ম্যাজিস্ট্রেট এজলাস থেকে নেমে গেছেন। আজ যে ক’জন কারারক্ষী ও বন্দির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে, তারা প্রত্যেকেই এক বাক্যে আমাকে বলেছে, আদালতের এই আদেশ অন্যায় এবং চরম অমানবিক।
বাবরের বিরুদ্ধে আমারও অনেক নালিশ রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তার মন্ত্রিত্বের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অহরহ ঘটেছে এবং আজকের বিতর্কিত র্যাব তারই সৃষ্টি। সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ এবং এক-এগারোর সময় তার ভূমিকা নিয়েও সমাজে অনেক সমালোচনা রয়েছে। কিন্তু তাই বলে আইনের শাসনে প্রকৃতই বিশ্বাস করলে তার ওপর রিমান্ডে নির্যাতনও আমরা মানতে পারি না। অথচ বাবরের একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, গুলশান-বারিধারার দূতাবাস পাড়ার পশ্চিমা কূটনীতিকরা সম্পূর্ণ নীরব। জনশ্রুতি রয়েছে, এদেরই পরামর্শক্রমে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন লুত্ফুজ্জামান বাবর নির্যাতন করার সব আধুনিক যন্ত্রপাতি আমদানি করেছিলেন। জরুরি সরকারের সময় বাবর গ্রেফতার হলে গুজব শুনেছিলাম সেসব যন্ত্রপাতির কয়েকটির ব্যবহার নাকি তাকে দিয়েই শুরু করা হয়েছিল। বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিজ প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস তার দায়িত্ব পালন শেষে এ দেশ থেকে চলে যাওয়ার সময় লুত্ফুজ্জামান বাবর গুলশানের এক হোটেলে তার বিদায় উপলক্ষে এক বিশাল বিদায়ী ভোজসভার আয়োজন করেছিলেন। সেই ভোজসভায় যাওয়ার জন্য আমাকে তিনি একাধিকবার সনির্বন্ধ আমন্ত্রণ জানালেও নৈতিক কারণে আমি সম্মত হইনি। বিউটেনিস চলে যাওয়ার দিনকয়েক পরেই বাবর গ্রেফতার হন। আজ তার বিদেশি বন্ধুরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আমরা সেসময় নীতিগতভাবে বিরোধী ক্যাম্পের হলেও মানবাধিকারের প্রশ্নে আজ বাবরের পক্ষে কলম ধরেছি। জেলে এসেও বাবরের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ ঘটেনি। আশা করি, লুত্ফুজ্জামান বাবর তার ভুল বুঝতে পেরেছেন। ভিয়েতনামের নগো দিন দিয়েম, পানামার নরিয়েগা, ইরানের শাহ্, ইরাকের সাদ্দাম—এদের সবাইকে আত্মা বিক্রি করার মূল্য একসময় চুকাতে হয়েছে। বাংলাদেশেও যারা আত্মা বিক্রি করে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে আজ অসহায় জনগণের ওপর নির্মম নির্যাতন-নিপীড়ন চালাচ্ছেন, মহাকাল তাদেরও পরিণতি দেখার অপেক্ষায় রয়েছে। ইতিহাসে ধিকৃতদের পাশে তাদেরও নাম প্রোথিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী।
এ কোন বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন তরুণ প্রজন্ম এ দেশে বিকশিত হচ্ছে? এরাই কি বাংলাদেশের ভবিষ্যত্? অসুস্থ সমাজের অবধারিত প্রতিক্রিয়া হিসেবেই এই বর্বর শ্রেণী আবির্ভূত হয়েছে। লগি-বৈঠা দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছে, অথচ আমরা অপরাধীদের শাস্তি বিধানের পরিবর্তে নিহতের রাজনৈতিক পরিচয় খুঁজে বেড়িয়েছি। তথাকথিত সুশীল (?) বিবেকে কোনো নাড়া পড়েনি। বছরের পর বছর রিমান্ডে নির্যাতন, পুলিশ হেফাজতে হত্যা এবং ক্রসফায়ার চলেছে অপ্রতিরোধ্যভাবে। আমরা চুপচাপ মেনে নিয়েছি। রাজনৈতিক বিরোধীপক্ষের নেতাকর্মীদের গুম খুন করা হচ্ছে, নদী-নালায় কারও লাশ পাওয়া যাচ্ছে, আবার কারও ঠাঁই হচ্ছে চিরস্থায়ীভাবে নিখোঁজের তালিকায়। তাদের আপনজন বাকি জীবন অন্তহীন প্রতীক্ষার দুঃসহ বেদনায় কাটিয়ে দিচ্ছে। এত অন্যায়, অথচ কোথাও কোনো প্রতিবাদ নেই।
দিনবদলের সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে পাতিনেতা পর্যন্ত সমাজের সর্বত্র হিংসা ও বিদ্বেষের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিতে ব্যস্ত। তরুণী কন্যার আব্রু রক্ষা করতে পারছি না। অথচ বোরখা ও হেজাবের ওপর সরকারদলীয় নেতাকর্মী এবং ঠ্যাঙাড়ে পুলিশ বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ভাবা যায়, যে রাষ্ট্রের নব্বই শতাংশ নাগরিক ইসলাম ধর্মাবলম্বী, সেই রাষ্ট্রে কেবল বোরখা পরার ‘অপরাধে’ সম্ভ্রান্ত পরিবারের তরুণীকে জেলে এবং রিমান্ডে পাঠানো হচ্ছে। আমার মা সারাজীবন অধ্যাপনা করেছেন, বোরখা পরেননি। আমার স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছে, কখনও বোরখা পরেনি। কিন্তু, তাই বলে অন্য পরিবারে বোরখার প্রচলনকে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করার কোনো অধিকার আমার নেই।
এই সরকারের কর্তাব্যক্তিদের সেই অধিকার কে দিল? নির্বাচনের আগে এক বিদেশিকে সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীপুত্র ইংরেজিতে একটি আর্টিকেল লিখেছিলেন। সেই লেখায় বোরখা এবং বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীতে মাদ্রাসায় শিক্ষিত সৈনিকদের উপস্থিতি নিয়ে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য ছিল। এবারের মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণ করেই বর্তমান সরকার মাদ্রাসা ও বোরখার ওপর খড়গহস্ত হওয়ার যে নীতি গ্রহণ করেছে, সেটি প্রণয়নে সজীব ওয়াজেদ জয় কী ভূমিকা রেখেছেন, তা আমার জানা নেই। তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে যে এ ধরনের নীতি গ্রহণ করা হবে, তার একটা আগাম ইঙ্গিত ছিল তার লেখায়। ইসলামবিদ্বেষী সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদকে সন্তুষ্ট করে ক্ষমতালাভ এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার অপকৌশল বাংলাদেশকে ক্রমেই আইনের শাসনবিহীন একটি বর্বর, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করছে। জেল থেকেই খবর পাচ্ছি, দলীয় বিবেচনায় একের পর এক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতায় মুক্তি দেয়া হচ্ছে। যে সরকার শত শত নাগরিককে সন্ত্রাসের অভিযোগে ক্রসফায়ারে পরপারে পাঠায়, তারাই আবার আদালতকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রশাসনিক আদেশে ভয়াবহ সব সন্ত্রাসীকে মুক্তি দিচ্ছে। এই বৈপরীত্য মেনে নেয়া যায় না। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসব সংবাদ বন্দিজীবনের হতাশাকে কেবল বাড়িয়েই দিচ্ছে। জীবনের বাকি যে ক’টা দিন আল্লাহ নির্দিষ্ট করে রেখেছেন, তার মধ্যে পচে যাওয়া সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লব দেখে যাওয়ার বড় সাধ জাগে।
নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও জেল প্রশাসনে আজ ছোটখাটো একটা ঝড় তুলতে হলো। ইচ্ছা ছিল না, কারণ ঢাকা জেল প্রশাসনের তুলনায় এখানকার লোকজন অধিকতর মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন। কিন্তু পরিস্থিতি বাধ্য করলো। আমার বাবুর্চি দু’দিন ধরে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে শয্যাশায়ী। কালাম একে-ওকে ধরে কোনোমতে তিনজনের রান্নার কাজ চালিয়ে নিচ্ছিল। আজ ন’টা বেজে যায়, নাস্তার খবর নেই। বাংলাদেশের কথিত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের একটা বড় অংশ কাশিমপুর জেলে বন্দি। অর্থ ও শক্তির দাপটে কয়েদিদের মধ্যে এদের বিরাট প্রভাব-প্রতিপত্তি। বিশেষ ব্যবস্থায় তাদের রান্নার আয়োজন ও মেন্যু দেখলে যে কোনো মধ্যবিত্তের মাথা ঘুরে যাবে। বাবুর্চির কামপাশধারী জেলের অধিকাংশ আসামি এই টপটেররদের রান্না-বান্নাতেই বেশি উত্সাহী। গত দু’দিনে সেসব বাবুর্চির কেউ কেউ আমার জন্যে রাঁধতে এসে যত্সামান্য আয়োজন দেখে নাক সিঁটকে চলে গেছে। কর্তৃপক্ষ তাদের নানাবিধ দুর্বলতার কারণে কিছু বলতেও পারছিল না। আজ নাস্তা একেবারে আসছেই না দেখে কালামের কাছে হেতু জিজ্ঞাসা করে যে জবাব পেলাম, তাতে মেজাজ আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলাম না। কালাম জানালো, আজ নতুন এক সমস্যা জুটেছে। এতদিন বাবুর্চি পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক অনুরোধ, উপরোধের পর আজ সকালে বাবুর্চি একজন এসেছে; কিন্তু চুলা খালি পাওয়া যাচ্ছে না। সবগুলোতেই নাকি ভাইদের নাস্তা তৈরি হচ্ছে। ডজন ডজন পরোটা, ডিমের ওমলেট, হালুয়া, মুরগির কারি ইত্যাদি রান্না শেষ হলে তবেই আমি নাস্তা পাব।
জেলবাস যথাসম্ভব মানিয়ে চলার চেষ্টা করছি। তাই বলে এতটা সহ্য করা কঠিন। কালাম বললো, আমার জায়গায় লুত্ফুজ্জামান বাবর হলে এতক্ষণে তুলকালাম বেধে যেত। আমি কলমপেষা মানুষ, চিত্কার, চেঁচামেচি ঠিক ধাতে সয় না। অতএব, যা পারি সেটাই করলাম। জেল কোড অনুযায়ী আমার অধিকারের বিষয়টি উদ্ধৃত করে জেলসুপারকে পত্র লিখে কালামকে দিয়ে জেলগেটে পাঠিয়ে দিলাম। এরপর অবশ্য আধঘণ্টার বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। নাস্তা তো এলোই, তার সঙ্গে বড় সাহেবরাও দল বেঁধে এলেন। আমি শান্তভাবে বললাম, তিন বেলা অতি সাধারণ খাওয়া ছাড়া আমার আর তো কোনো চাহিদা নেই। ওটুকুর ব্যবস্থাও যদি করা সম্ভব না হয়, তাহলে আমাকে জানালে বাইরে থেকে না হয় আনানোর ব্যবস্থা করব। সুপার, জেলার যথেষ্ট দুঃখ প্রকাশ করে এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর ঘটবে না প্রতিশ্রুুতি দিয়ে সদলবলে বিদায় নিলেন। বেচারা বড় সুবেদার কিছু গালমন্দ হজম করলো। তখন আবার আমারই খারাপ লাগতে লাগল। ছেলেগুলো ভালোই। সামান্য নাস্তার জন্যে এত হুলস্থূল না করলেই পারতাম।
আজ পত্রিকায় লুত্ফুজ্জামান বাবরের ছবি দেখে মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। তাকে রিমান্ড শুনানির জন্যে গতকাল চট্টগ্রামে নেয়া হয়েছে। ছবিতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সাবেক এই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর নাক দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত চুইয়ে পড়ছে। গুরুতর অসুস্থ এই লোকটিকে হাসপাতালে নেয়ার পরিবর্তে টানা-হ্যাঁচড়া করে চট্টগ্রাম নিয়ে কাঠগড়ায় তুলতে কথিত গণতান্ত্রিক সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মনুষ্যত্বে বিন্দুমাত্র আঘাত লাগেনি। অবশ্য লাগবেই বা কী করে? এদেরই অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালতে উঁচু গলায় বলেছিলেন, বাবর আগে মারা যাক, তারপর মামলা করতে আইসেন। এমন দুর্বিনীত উচ্চারণ সত্ত্বেও উচ্চ আদালত তাকে ভর্ত্সনা না করে বরং তারই আবেদনক্রমে বাবরের হাইকোর্ট থেকে প্রাপ্ত জামিন স্থগিত করেছিল। ‘চেম্বার মানেই সরকারপক্ষে স্টে’ শিরোনামে আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে সেই ঘটনার উল্লেখ ছিল। উচ্চ আদালতসংশ্লিষ্ট বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের অপরাধেই অলিউল্লাহ নোমান এক মাস সাত দিন জেল খেটে গেছে এবং আমি এখনও সাজা ভোগ করছি। এরপর কার এত সাহস যে বলে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা স্বাধীন হয়নি? সেই স্বাধীনতার নমুনা কাল বাবরের রিমান্ড শুনানিতে পুনর্বার দেখা গেল। রক্তাক্ত, অসুস্থ আসামি চোখের সামনে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে, আর ‘ন্যায়বিচার ও বিবেকের’ পরাকাষ্ঠা মাননীয় ম্যাজিস্ট্রেট পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদেশ দিলেন। পত্রিকার সংবাদ অনুযায়ী আসামিপক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য সমাপ্ত করারও সুযোগ না দিয়ে দশ মিনিটের মধ্যেই ম্যাজিস্ট্রেট এজলাস থেকে নেমে গেছেন। আজ যে ক’জন কারারক্ষী ও বন্দির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে, তারা প্রত্যেকেই এক বাক্যে আমাকে বলেছে, আদালতের এই আদেশ অন্যায় এবং চরম অমানবিক।
বাবরের বিরুদ্ধে আমারও অনেক নালিশ রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তার মন্ত্রিত্বের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অহরহ ঘটেছে এবং আজকের বিতর্কিত র্যাব তারই সৃষ্টি। সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ এবং এক-এগারোর সময় তার ভূমিকা নিয়েও সমাজে অনেক সমালোচনা রয়েছে। কিন্তু তাই বলে আইনের শাসনে প্রকৃতই বিশ্বাস করলে তার ওপর রিমান্ডে নির্যাতনও আমরা মানতে পারি না। অথচ বাবরের একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, গুলশান-বারিধারার দূতাবাস পাড়ার পশ্চিমা কূটনীতিকরা সম্পূর্ণ নীরব। জনশ্রুতি রয়েছে, এদেরই পরামর্শক্রমে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন লুত্ফুজ্জামান বাবর নির্যাতন করার সব আধুনিক যন্ত্রপাতি আমদানি করেছিলেন। জরুরি সরকারের সময় বাবর গ্রেফতার হলে গুজব শুনেছিলাম সেসব যন্ত্রপাতির কয়েকটির ব্যবহার নাকি তাকে দিয়েই শুরু করা হয়েছিল। বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিজ প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস তার দায়িত্ব পালন শেষে এ দেশ থেকে চলে যাওয়ার সময় লুত্ফুজ্জামান বাবর গুলশানের এক হোটেলে তার বিদায় উপলক্ষে এক বিশাল বিদায়ী ভোজসভার আয়োজন করেছিলেন। সেই ভোজসভায় যাওয়ার জন্য আমাকে তিনি একাধিকবার সনির্বন্ধ আমন্ত্রণ জানালেও নৈতিক কারণে আমি সম্মত হইনি। বিউটেনিস চলে যাওয়ার দিনকয়েক পরেই বাবর গ্রেফতার হন। আজ তার বিদেশি বন্ধুরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আমরা সেসময় নীতিগতভাবে বিরোধী ক্যাম্পের হলেও মানবাধিকারের প্রশ্নে আজ বাবরের পক্ষে কলম ধরেছি। জেলে এসেও বাবরের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ ঘটেনি। আশা করি, লুত্ফুজ্জামান বাবর তার ভুল বুঝতে পেরেছেন। ভিয়েতনামের নগো দিন দিয়েম, পানামার নরিয়েগা, ইরানের শাহ্, ইরাকের সাদ্দাম—এদের সবাইকে আত্মা বিক্রি করার মূল্য একসময় চুকাতে হয়েছে। বাংলাদেশেও যারা আত্মা বিক্রি করে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে আজ অসহায় জনগণের ওপর নির্মম নির্যাতন-নিপীড়ন চালাচ্ছেন, মহাকাল তাদেরও পরিণতি দেখার অপেক্ষায় রয়েছে। ইতিহাসে ধিকৃতদের পাশে তাদেরও নাম প্রোথিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী।
No comments