৩৪- পিসি বাণিজ্যে বছরে কোটি কোটি টাকার ভাগাভাগি বর্তমান আমলে জেলে দুর্নীতির সর্বগ্রাসী রূপ
দুই-তিনশ’ বন্দির জন্য টয়লেট মাত্র দুটো
এমন ওয়ার্ডও আছে যেখানে অনেক কষ্টে কাত হয়ে শুতে হয় এবং একবার গাদাগাদি করে শুলে নড়াচড়ার কোনো উপায় থাকে না। দুই-তিনশ’ বন্দির সেসব ওয়ার্ডে দুটো মাত্র টয়লেট থাকে, যার ভয়াবহ অবস্থায় বর্ণনা দেয়া আমার সাধ্যাতীত। সেসব ওয়ার্ডের সামনের আঙিনায় শত শত বন্দির মুখনিঃসৃত এত কফ-থুথু পড়ে থাকে যে, সেখানে জুতা পরে হাঁটতেও অস্বস্তি হয়।
এমন ওয়ার্ডও আছে যেখানে অনেক কষ্টে কাত হয়ে শুতে হয় এবং একবার গাদাগাদি করে শুলে নড়াচড়ার কোনো উপায় থাকে না। দুই-তিনশ’ বন্দির সেসব ওয়ার্ডে দুটো মাত্র টয়লেট থাকে, যার ভয়াবহ অবস্থায় বর্ণনা দেয়া আমার সাধ্যাতীত। সেসব ওয়ার্ডের সামনের আঙিনায় শত শত বন্দির মুখনিঃসৃত এত কফ-থুথু পড়ে থাকে যে, সেখানে জুতা পরে হাঁটতেও অস্বস্তি হয়।
সাত নম্বর সেলের তিন নম্বর ঘরের নাজিমউদ্দিন বাবু ওরফে হোন্ডা বাবু আজ সকালে জামিনে মুক্তি পেয়ে চলে গেল। গত ক’দিন ধরেই শুনছিলাম রোজার ঈদের আগেই জেল থেকে বার হওয়ার জন্যে প্রচুর টাকা-পয়সা খরচ করছিল। আদালতে বাবুর এ বাবদ চুক্তি ছিল চার লাখ টাকার। অনেক ঢাকঢোল পেটানো বাংলাদেশের স্বাধীন বিচারব্যবস্থার হালহকিকত অনুধাবনের জন্যে এই জামিন কৌশলটা জানা জরুরি। শুনেছি সন্ত্রাসীদের ‘খ্যাতি’ অনুযায়ী জামিনের চুক্তির টাকা নির্ধারণ করা হয়। যার ‘খ্যাতি’ যত বেশি, তার জামিনের মিটারও তত চড়া। চুক্তি হওয়া মাত্র ষাট থেকে সত্তর ভাগ টাকা দালালকে আগাম দিতে হয়, বাকিটা জামিনের আদেশ প্রদানের সপ্তাহখানেক আগে। এই অর্থের বণ্টননামা সম্পর্কে লিখলে আবার আদালত অবমাননা মামলা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তাই চেপে যাওয়াই উত্তম। জামিন হলেই অবশ্য মুক্তির নিশ্চয়তা নেই। জেলের দেয়াল টপকাতে আরও অন্তত দুই ধাপ পার হতে হবে। আদালত থেকে জামিন আদেশপ্রাপ্তির পর শুরু হয় জেল প্রশাসন এবং এখানে কর্মরত অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের সঙ্গে দাম-দস্তুর। হোন্ডা বাবুকে এই ধাপ পেরোনো বাবদ এক লাখ টাকা গুনতে হয়েছে। এরপর রয়েছে জেলগেটের বাইরে ক্রসফায়ার অথবা গুম-খুন ঠেকানোর মূল্য।
ধারণা করছি, সর্বশেষ ধাপেই সর্বোচ্চ লেনদেন হচ্ছে। জেলে এসেই এক ভবিষ্যত্ টপ-টেররের মুক্তির চিত্তাকর্ষক গল্প শুনেছিলাম। টপ-টেররের নাম এবং কোন আমলের গল্প, সেটা বোধগম্য কারণে উহ্য রাখলাম। খুন, অস্ত্র, মাদক এবং অপহরণের একাধিক মামলার আসামি হয়ে এরই মধ্যে বেশ নাম-ডাক করে ফেলেছে তরুণটি। রাজনৈতিক সংযোগের গুণে ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে ওঠা সন্ত্রাসীটির মুক্তির পর তাকে ক্ষমতাবান লোকজন রীতিমত ভিআইপি প্রটোকল সহকারে পাহারা দিয়ে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। এমন রাজকীয় আয়োজনের জন্যে অর্থের ব্যবস্থাও করতে হয় মানানসই। যাই হোক, সকাল বেলাতেই বাবু হাসিমুখে এসে দোয়া চাইল। গত তিন মাসে ছেলেটি আমার সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর নিয়েছে। জেলের প্রথম কয়েকদিনের বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থায় সিনিয়র এবং জুনিয়র দুই বাবুই আমার সহায় ছিল। গাঁটের পয়সা খরচ করে আমাকে খাইয়েছে, কাপড়-জামা জোর করে ধুয়ে দিয়েছে, গোসলের পানি তুলে দিয়েছে এবং জেল সম্পর্কে তাবত্ ধারণা দিয়েছে। রোজার মধ্যে প্রতি সন্ধ্যায় বাদ ইফতার ওদের সেল থেকে চা তৈরি করে কারারক্ষীর মাধ্যমে পাঠিয়েছে। সিনিয়র বাবু মাস দুয়েক আগে মুক্তি পেয়েছে। দোয়া করি পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালো থাকুক। জুনিয়র বাবু আজ মুক্তি পেল। জেল থেকে বার হওয়ার সব বন্দোবস্ত যে হয়েছে, সেটা ওর কাছ থেকেই শুনেছি। ক্রসফায়ার থেকে বাঁচবে কি-না, সে সম্পর্কে অবশ্য আগাম মন্তব্য সম্ভব নয়। তবে সন্ত্রাস ত্যাগ করে সুস্থ জীবনে ফিরতে পারলে সমাজের জন্য মঙ্গল হবে। বিদায়ের সময় সেই কথাটি একাধিকবার স্মরণ করিয়ে দিলাম।
জেলে একশ’ দিন আজ অতিক্রান্ত হলো। গতকাল আদালতে হাজিরা শেষে সেলে ফেরার সময় নতুন একটা ব্যাপার আবিষ্কার করে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়েছি। ঢাকা জেলের সেলগুলো সব আলাদা দেয়াল দিয়ে ঘেরা। দেয়ালঘেরা সেলের আঙিনায় প্রবেশ করতে হলে একটি অতিরিক্ত ফাটক পার হতে হয়। অধিকাংশ সময় ফাটকটি খোলা থাকলেও মাঝে-মধ্যে কোনো অতিউত্সাহী কারারক্ষী সেটি বন্ধ করে সামনে বসেও থাকে। অনেকটা জেলের মধ্যে জেল আর কি! কাল হঠাত্ চোখে পড়লো দেয়ালের গায়ে লেখা, বকুল। তখনই প্রথম জানলাম সাত নম্বর সেলের একটা চমত্কার পোশাকি নাম রয়েছে। বকুল আমার প্রিয় ফুলের মধ্যে একটি। এই ফুলটি কুলীন শ্রেণীভুক্ত নয় বিধায় অনেককেই অবহেলা করতে দেখেছি। বকুল ফুলের সঙ্গে আমার বাল্য ও কৈশোরের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। পাঠক আবার কোনো রোম্যানটিক গল্প শোনার আশায় নড়ে-চড়ে বসবেন না। পুরনো ঢাকার গেণ্ডারিয়া স্কুল, যেখান থেকে আমি ১৯৬৯ সালে এসএসসি পাস করেছি, সেই স্কুলে এক প্রকাণ্ড বকুল গাছ ছিল। যতদূর মনে পড়ে, সেই গাছতলায় কবর সদৃশ বাঁধানো একটা স্থাপনাও ছিল। স্কুলের ছেলেরা সচরাচর ভয়ে ওই গাছের কাছে যেতে চাইত না। আমি কিন্তু প্রায়ই গাছের নিচ থেকে ফুল কুড়িয়ে আনতাম। এতদিনে সেই গাছ নিশ্চয়ই নতুন ইমারত গড়ার প্রয়োজনে কাটা পড়েছে। বকুলের সঙ্গে নিষ্পাপ বালকের সেই যে ভালোবাসা গড়ে উঠেছিল, তার ছেদ পড়েনি কখনও।
বকুলের আরেকটা গল্প বলি। সাভারে আমার মায়ের একটা বাড়ি ছিল। পারভীন বাড়িটার নাম রেখেছিল ‘অনঘমহী’ অর্থাত্ দুঃখহীন পৃথিবী। আমার দেশ এবং আর্টিসান সিরামিকে অর্থের প্রয়োজন হওয়ায় গ্রেফতারের কিছুদিন আগে অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাড়িটা বিক্রি করতে হয়েছে। আমার এই সিদ্ধান্তে মা খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। রাগ করে সপ্তাহ দুয়েক আমার আর পারভীনের সঙ্গে কথা বলেননি। নিজের ঘরে বসে বসে কেঁদেছেন। পারভীনের কষ্টও মায়ের চেয়ে কিছু কম ছিল না। বাড়ির নামটাও যে পারভীনেরই দেয়া। জেলে এসে কখনও কখনও মনে হয় টাকার জন্যে দুঃখহীন পৃথিবী ছেড়ে দেয়াতেই বোধহয় আমাদের অতি ক্ষুদ্র এই নিজস্ব পৃথিবীতে এত দুঃখ প্রবেশ করেছে। যাই হোক, মায়ের ওই বাড়িতেও একটা বকুল গাছ লাগানো হয়েছিল। এই ক’বছরে গাছটা বেশ বড় হয়েছে, ক’দিন বাদেই বোধহয় ফুল দিত। সেই ফুল দেখা হবে না কোনোদিন। বুড়ো হচ্ছি তো! একটুতেই মন খারাপ হয়ে যায়। আমাদের বকুল সেলের আঙিনাতেও একটা বকুল গাছ লাগানো হয়েছে। বেশ ঝাঁকড়া হয়ে বাড়ছে, যদিও ফুল দিতে অন্তত আরও পাঁচ-ছয় বছর লাগবে।
অনেক নস্টালজিয়া হলো। এবার কঠিন বর্তমানে ফেরা যাক। ভাবছি, একশ’ দিনের সালতামামি কী দেব পাঠকদের। নিজের সম্পর্কে তো অনেক কথা বললাম। হয়তো খানিক অতিরিক্তই বলে ফেলেছি। এবার জেলের অন্যান্য বাসিন্দা, বিশেষ করে সাধারণ বন্দিদের জীবনধারা সম্পর্কে কিছু না লিখলে একটা অপরাধবোধ থেকে যাবে। তাদের সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে পেরেছি এমন দাবি করবো না। আমি তো সেল থেকে বার হই না বললেই চলে। তাদের সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি, সেটা এই সেলেরই অন্য বন্দিদের মারফত। সেকথা বলার আগে এখানে আমার জীবন ধারণের এ যাবত্ আঁকা ছবিতে সামান্য সংযোজন প্রয়োজন। পরিচিতজনরা তো জানেনই, আমার লেখালেখির চার বছরে পাঠকরাও জেনে গেছেন আমি নিতান্তই এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ছেলেবেলায় বাড়িতে দামি আসবাবপত্র দেখিনি। তবে যেগুলো ছিল, সেগুলোকে সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেখেছি, বিছানার কমদামি চাদরটা টানটান করে পাতা, বসার ঘরে নানার ইজিচেয়ারের চওড়া হাতলে ধুলো নেই, ঘরের পর্দায় ময়লা হাতের ছাপ নেই। নানী প্রচণ্ড পান খেতেন, অথচ বাসার কোনো জায়গা পানের পিকে রাঙানো নেই। মা এবং পারভীনের মধ্যে শুচি বাইয়ের প্রতিযোগিতা রয়েছে। কাজেই বাড়িঘর এখনও পরিষ্কার, আমার বাতিক আবার পরিষ্কার টয়লেটের। জেলজীবনে আমার প্রবল কষ্টের কারণ হয়েছে এখানকার অপরিচ্ছন্নতা। দশ বাই সাত সেলের মধ্যকার টয়লেটের কাছে দাঁড়িয়ে থালা-বাসন ধুয়ে সেই বাসনে খেতে হবে মনে করলেই খিদে চলে যায়। প্রথম দিকে কত রাত না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছি। এখন অবশ্য ক্রমেই অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ মানুষকে অনাহারে বেঁচে থাকার কোনো উপায় করে দেননি। কিছুটা পুরনো কথা আবারও বললাম কারণ অন্য বন্দিরা বলে, ঢাকা জেলে সাধারণ বন্দিদের যতগুলো সেল আছে, তার মধ্যে সাত নম্বর সেলটাই নাকি সবচাইতে ভালো। এমন ওয়ার্ডও এখানে আছে, যেখানে অনেক কষ্টে কাত হয়ে শুতে হয় এবং একবার গাদাগাদি করে শুলে নড়াচড়ার কোনো উপায় থাকে না। দুই-তিনশ’ বন্দির সেসব ওয়ার্ডে দুটো মাত্র টয়লেট থাকে, যার ভয়াবহ অবস্থার বর্ণনা দেয়া আমার সাধ্যাতীত। সেসব ওয়ার্ডের সামনের আঙিনায় শত শত বন্দির মুখনিঃসৃত এতই কফ-থুথু পড়ে থাকে যে, সেখানে জুতা পরে হাঁটতেও অস্বস্তি হয়। ‘খাতা’ নামক ওয়ার্ডের এই বন্দিরা দিনের পর দিন পানির অভাবে থাকে। একজন গোসল করলে অপরজন একেবারে তার গা ঘেঁষে দাঁড়ায় যাতে ছিটে আসা পানিটা অন্তত সে ব্যবহার করতে পারে। ফলে সাধারণ বন্দিদের মধ্যে চর্মরোগ, পেটের পীড়ায় ভুগছে না এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। জেলখানায় চিকিত্সার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। জেল ডাক্তারের কাছে যেতে হলেও ঘাটে ঘাটে কড়ি ফেলতে হবে। মৃত্যুর আগে বাইরের হাসপাতালে যাওয়ার কথা এসব অসহায় মানুষ নামের প্রাণীগুলো কল্পনাও করতে পারে না। কোনো বন্দি জেলের ভেতরেই প্রাণ ত্যাগ করলে তার নিষ্প্রাণ দেহটিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পাঠানো হয় বিনা চিকিত্সায় মারা যাওয়ার দায়-দায়িত্ব এড়ানোর জন্য। শতকরা সত্তর জন পুষ্টিহীনতার শিকার কারণ সরকারি বরাদ্দে যে আহার্য জোটে, তা দিয়ে প্রাণ ধারণ যে হয় সেটাই বিস্ময়কর। পিসি থেকে নগদ টাকার বিনিময়ে খাদ্য কেনার ব্যবস্থা আছে বটে, তবে সেখানকার দুর্নীতির গল্প বন্দিদের মুখে মুখে। সবকিছু অগ্নিমূল্য। বাজারের সঙ্গে দামের পার্থক্য ২০ থেকে ৩০ ভাগ। তার ওপর ৮০০ গ্রাম কিনে ১ কেজির দাম দিতে হয়। পিসি থেকে কিনে খেতে পারে এমন সাধারণ বন্দির সংখ্যা অবশ্য হাতে গোনা। পিসি বাণিজ্য থেকে বছরে কোটি কোটি টাকা ভাগাভাগি হচ্ছে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত। দুর্নীতির এমন মচ্ছব দেখে তাজ্জব বনে যেতে হয়। জেলখানার পুরনো বাসিন্দাদের কাছ থেকে শুনেছি, দুর্নীতি সব সরকারের আমলেই ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে সেটি সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। লোকে তামাশা করে বলে, দুই গঞ্জ মিলে নাকি জেলখানা চালাচ্ছে। গঞ্জ দুটো হলো যথাক্রমে গোপালগঞ্জ এবং কিশোরগঞ্জ। কেবল জেলই বা বলি কেন, পুরো বাংলাদেশটাই তো কিশোর এবং গোপালের হাতে।
ধারণা করছি, সর্বশেষ ধাপেই সর্বোচ্চ লেনদেন হচ্ছে। জেলে এসেই এক ভবিষ্যত্ টপ-টেররের মুক্তির চিত্তাকর্ষক গল্প শুনেছিলাম। টপ-টেররের নাম এবং কোন আমলের গল্প, সেটা বোধগম্য কারণে উহ্য রাখলাম। খুন, অস্ত্র, মাদক এবং অপহরণের একাধিক মামলার আসামি হয়ে এরই মধ্যে বেশ নাম-ডাক করে ফেলেছে তরুণটি। রাজনৈতিক সংযোগের গুণে ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে ওঠা সন্ত্রাসীটির মুক্তির পর তাকে ক্ষমতাবান লোকজন রীতিমত ভিআইপি প্রটোকল সহকারে পাহারা দিয়ে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। এমন রাজকীয় আয়োজনের জন্যে অর্থের ব্যবস্থাও করতে হয় মানানসই। যাই হোক, সকাল বেলাতেই বাবু হাসিমুখে এসে দোয়া চাইল। গত তিন মাসে ছেলেটি আমার সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর নিয়েছে। জেলের প্রথম কয়েকদিনের বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থায় সিনিয়র এবং জুনিয়র দুই বাবুই আমার সহায় ছিল। গাঁটের পয়সা খরচ করে আমাকে খাইয়েছে, কাপড়-জামা জোর করে ধুয়ে দিয়েছে, গোসলের পানি তুলে দিয়েছে এবং জেল সম্পর্কে তাবত্ ধারণা দিয়েছে। রোজার মধ্যে প্রতি সন্ধ্যায় বাদ ইফতার ওদের সেল থেকে চা তৈরি করে কারারক্ষীর মাধ্যমে পাঠিয়েছে। সিনিয়র বাবু মাস দুয়েক আগে মুক্তি পেয়েছে। দোয়া করি পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালো থাকুক। জুনিয়র বাবু আজ মুক্তি পেল। জেল থেকে বার হওয়ার সব বন্দোবস্ত যে হয়েছে, সেটা ওর কাছ থেকেই শুনেছি। ক্রসফায়ার থেকে বাঁচবে কি-না, সে সম্পর্কে অবশ্য আগাম মন্তব্য সম্ভব নয়। তবে সন্ত্রাস ত্যাগ করে সুস্থ জীবনে ফিরতে পারলে সমাজের জন্য মঙ্গল হবে। বিদায়ের সময় সেই কথাটি একাধিকবার স্মরণ করিয়ে দিলাম।
জেলে একশ’ দিন আজ অতিক্রান্ত হলো। গতকাল আদালতে হাজিরা শেষে সেলে ফেরার সময় নতুন একটা ব্যাপার আবিষ্কার করে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়েছি। ঢাকা জেলের সেলগুলো সব আলাদা দেয়াল দিয়ে ঘেরা। দেয়ালঘেরা সেলের আঙিনায় প্রবেশ করতে হলে একটি অতিরিক্ত ফাটক পার হতে হয়। অধিকাংশ সময় ফাটকটি খোলা থাকলেও মাঝে-মধ্যে কোনো অতিউত্সাহী কারারক্ষী সেটি বন্ধ করে সামনে বসেও থাকে। অনেকটা জেলের মধ্যে জেল আর কি! কাল হঠাত্ চোখে পড়লো দেয়ালের গায়ে লেখা, বকুল। তখনই প্রথম জানলাম সাত নম্বর সেলের একটা চমত্কার পোশাকি নাম রয়েছে। বকুল আমার প্রিয় ফুলের মধ্যে একটি। এই ফুলটি কুলীন শ্রেণীভুক্ত নয় বিধায় অনেককেই অবহেলা করতে দেখেছি। বকুল ফুলের সঙ্গে আমার বাল্য ও কৈশোরের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। পাঠক আবার কোনো রোম্যানটিক গল্প শোনার আশায় নড়ে-চড়ে বসবেন না। পুরনো ঢাকার গেণ্ডারিয়া স্কুল, যেখান থেকে আমি ১৯৬৯ সালে এসএসসি পাস করেছি, সেই স্কুলে এক প্রকাণ্ড বকুল গাছ ছিল। যতদূর মনে পড়ে, সেই গাছতলায় কবর সদৃশ বাঁধানো একটা স্থাপনাও ছিল। স্কুলের ছেলেরা সচরাচর ভয়ে ওই গাছের কাছে যেতে চাইত না। আমি কিন্তু প্রায়ই গাছের নিচ থেকে ফুল কুড়িয়ে আনতাম। এতদিনে সেই গাছ নিশ্চয়ই নতুন ইমারত গড়ার প্রয়োজনে কাটা পড়েছে। বকুলের সঙ্গে নিষ্পাপ বালকের সেই যে ভালোবাসা গড়ে উঠেছিল, তার ছেদ পড়েনি কখনও।
বকুলের আরেকটা গল্প বলি। সাভারে আমার মায়ের একটা বাড়ি ছিল। পারভীন বাড়িটার নাম রেখেছিল ‘অনঘমহী’ অর্থাত্ দুঃখহীন পৃথিবী। আমার দেশ এবং আর্টিসান সিরামিকে অর্থের প্রয়োজন হওয়ায় গ্রেফতারের কিছুদিন আগে অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাড়িটা বিক্রি করতে হয়েছে। আমার এই সিদ্ধান্তে মা খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। রাগ করে সপ্তাহ দুয়েক আমার আর পারভীনের সঙ্গে কথা বলেননি। নিজের ঘরে বসে বসে কেঁদেছেন। পারভীনের কষ্টও মায়ের চেয়ে কিছু কম ছিল না। বাড়ির নামটাও যে পারভীনেরই দেয়া। জেলে এসে কখনও কখনও মনে হয় টাকার জন্যে দুঃখহীন পৃথিবী ছেড়ে দেয়াতেই বোধহয় আমাদের অতি ক্ষুদ্র এই নিজস্ব পৃথিবীতে এত দুঃখ প্রবেশ করেছে। যাই হোক, মায়ের ওই বাড়িতেও একটা বকুল গাছ লাগানো হয়েছিল। এই ক’বছরে গাছটা বেশ বড় হয়েছে, ক’দিন বাদেই বোধহয় ফুল দিত। সেই ফুল দেখা হবে না কোনোদিন। বুড়ো হচ্ছি তো! একটুতেই মন খারাপ হয়ে যায়। আমাদের বকুল সেলের আঙিনাতেও একটা বকুল গাছ লাগানো হয়েছে। বেশ ঝাঁকড়া হয়ে বাড়ছে, যদিও ফুল দিতে অন্তত আরও পাঁচ-ছয় বছর লাগবে।
অনেক নস্টালজিয়া হলো। এবার কঠিন বর্তমানে ফেরা যাক। ভাবছি, একশ’ দিনের সালতামামি কী দেব পাঠকদের। নিজের সম্পর্কে তো অনেক কথা বললাম। হয়তো খানিক অতিরিক্তই বলে ফেলেছি। এবার জেলের অন্যান্য বাসিন্দা, বিশেষ করে সাধারণ বন্দিদের জীবনধারা সম্পর্কে কিছু না লিখলে একটা অপরাধবোধ থেকে যাবে। তাদের সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে পেরেছি এমন দাবি করবো না। আমি তো সেল থেকে বার হই না বললেই চলে। তাদের সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি, সেটা এই সেলেরই অন্য বন্দিদের মারফত। সেকথা বলার আগে এখানে আমার জীবন ধারণের এ যাবত্ আঁকা ছবিতে সামান্য সংযোজন প্রয়োজন। পরিচিতজনরা তো জানেনই, আমার লেখালেখির চার বছরে পাঠকরাও জেনে গেছেন আমি নিতান্তই এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ছেলেবেলায় বাড়িতে দামি আসবাবপত্র দেখিনি। তবে যেগুলো ছিল, সেগুলোকে সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেখেছি, বিছানার কমদামি চাদরটা টানটান করে পাতা, বসার ঘরে নানার ইজিচেয়ারের চওড়া হাতলে ধুলো নেই, ঘরের পর্দায় ময়লা হাতের ছাপ নেই। নানী প্রচণ্ড পান খেতেন, অথচ বাসার কোনো জায়গা পানের পিকে রাঙানো নেই। মা এবং পারভীনের মধ্যে শুচি বাইয়ের প্রতিযোগিতা রয়েছে। কাজেই বাড়িঘর এখনও পরিষ্কার, আমার বাতিক আবার পরিষ্কার টয়লেটের। জেলজীবনে আমার প্রবল কষ্টের কারণ হয়েছে এখানকার অপরিচ্ছন্নতা। দশ বাই সাত সেলের মধ্যকার টয়লেটের কাছে দাঁড়িয়ে থালা-বাসন ধুয়ে সেই বাসনে খেতে হবে মনে করলেই খিদে চলে যায়। প্রথম দিকে কত রাত না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছি। এখন অবশ্য ক্রমেই অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ মানুষকে অনাহারে বেঁচে থাকার কোনো উপায় করে দেননি। কিছুটা পুরনো কথা আবারও বললাম কারণ অন্য বন্দিরা বলে, ঢাকা জেলে সাধারণ বন্দিদের যতগুলো সেল আছে, তার মধ্যে সাত নম্বর সেলটাই নাকি সবচাইতে ভালো। এমন ওয়ার্ডও এখানে আছে, যেখানে অনেক কষ্টে কাত হয়ে শুতে হয় এবং একবার গাদাগাদি করে শুলে নড়াচড়ার কোনো উপায় থাকে না। দুই-তিনশ’ বন্দির সেসব ওয়ার্ডে দুটো মাত্র টয়লেট থাকে, যার ভয়াবহ অবস্থার বর্ণনা দেয়া আমার সাধ্যাতীত। সেসব ওয়ার্ডের সামনের আঙিনায় শত শত বন্দির মুখনিঃসৃত এতই কফ-থুথু পড়ে থাকে যে, সেখানে জুতা পরে হাঁটতেও অস্বস্তি হয়। ‘খাতা’ নামক ওয়ার্ডের এই বন্দিরা দিনের পর দিন পানির অভাবে থাকে। একজন গোসল করলে অপরজন একেবারে তার গা ঘেঁষে দাঁড়ায় যাতে ছিটে আসা পানিটা অন্তত সে ব্যবহার করতে পারে। ফলে সাধারণ বন্দিদের মধ্যে চর্মরোগ, পেটের পীড়ায় ভুগছে না এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। জেলখানায় চিকিত্সার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। জেল ডাক্তারের কাছে যেতে হলেও ঘাটে ঘাটে কড়ি ফেলতে হবে। মৃত্যুর আগে বাইরের হাসপাতালে যাওয়ার কথা এসব অসহায় মানুষ নামের প্রাণীগুলো কল্পনাও করতে পারে না। কোনো বন্দি জেলের ভেতরেই প্রাণ ত্যাগ করলে তার নিষ্প্রাণ দেহটিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পাঠানো হয় বিনা চিকিত্সায় মারা যাওয়ার দায়-দায়িত্ব এড়ানোর জন্য। শতকরা সত্তর জন পুষ্টিহীনতার শিকার কারণ সরকারি বরাদ্দে যে আহার্য জোটে, তা দিয়ে প্রাণ ধারণ যে হয় সেটাই বিস্ময়কর। পিসি থেকে নগদ টাকার বিনিময়ে খাদ্য কেনার ব্যবস্থা আছে বটে, তবে সেখানকার দুর্নীতির গল্প বন্দিদের মুখে মুখে। সবকিছু অগ্নিমূল্য। বাজারের সঙ্গে দামের পার্থক্য ২০ থেকে ৩০ ভাগ। তার ওপর ৮০০ গ্রাম কিনে ১ কেজির দাম দিতে হয়। পিসি থেকে কিনে খেতে পারে এমন সাধারণ বন্দির সংখ্যা অবশ্য হাতে গোনা। পিসি বাণিজ্য থেকে বছরে কোটি কোটি টাকা ভাগাভাগি হচ্ছে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত। দুর্নীতির এমন মচ্ছব দেখে তাজ্জব বনে যেতে হয়। জেলখানার পুরনো বাসিন্দাদের কাছ থেকে শুনেছি, দুর্নীতি সব সরকারের আমলেই ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে সেটি সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। লোকে তামাশা করে বলে, দুই গঞ্জ মিলে নাকি জেলখানা চালাচ্ছে। গঞ্জ দুটো হলো যথাক্রমে গোপালগঞ্জ এবং কিশোরগঞ্জ। কেবল জেলই বা বলি কেন, পুরো বাংলাদেশটাই তো কিশোর এবং গোপালের হাতে।
No comments