৪০- ভারতকে ট্রানজিট দেয়া রাষ্ট্রীয় আত্মহত্যারই নামান্তর

বাংলাদেশই আজ একটি বৃহত্ কারাগার
... শোষণের একটি পর্যায়ে অবশ্যই আধিপত্যবাদী শক্তি ও তাদের এদেশীয় দালালদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ আরম্ভ হবে। সেই চূড়ান্ত লড়াইয়ের পরিণতি আমার জানা নেই। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় আমার কাছে তাই বাংলাদেশকেও আজ একটি বৃহত্ কারাগার বলেই মনে হয়। ...
আজ ১২ মার্চ, শনিবার। সকালে বাবলুকে সঙ্গে নিয়ে পারভীন এসেছিল। আমার সাজার মেয়াদ সম্পন্ন হওয়ার আগে অদ্যই শেষ শনিবার। বাবলুর পরিচিতজনেরা সবাই আমার মুক্তি নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন। সবার একই উত্কণ্ঠা, এই সরকার আমাকে মুক্তি দেবে তো? আইনের বর্তমান ধারা অনুযায়ী আগামী চার দিনের মধ্যে পঞ্চাশতম মামলা দায়ের করে ‘শ্যেন অ্যারেস্ট’ না হলে আমাকে আর আটকে রাখা যাবে না। অবশ্য জেলগেট থেকে আবার গ্রেফতার করে ৫৪ ধারায় আটক দেখানো সম্ভব।
গত দু’বছরে আইনকে নিয়ে এ জাতীয় তামাশা প্রশাসন অনেক বিরোধী রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রেই করেছে। তবে প্রফেসর ইউনূস কেলেঙ্কারি নিয়ে দেশে-বিদেশে সরকারের তীব্র সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমার বেলায় সেটি বোধহয় তাদের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে। পারভীনকে শুধু বললাম, এই জেলে সম্ভবত আজই তার শেষ আসা। বৃহস্পতিবারে মুক্তি না পেলেও আমাকে যে আর গাজীপুর জেলে রাখা হচ্ছে না, সে বিষয়ে আমি মোটামুটি নিশ্চিত। এক প্রকার অনিশ্চয়তার উদ্বেগের ভারে আজ নীরবতার মধ্যেই দেখার সময় পার হলো। পারভীনের কাছ থেকে দুটো খবর পেলাম। নিউইয়র্কভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একটি প্রতিনিধিদল বৃহস্পতিবার পারভীনের সঙ্গে দেখা করে আমার সাজার মেয়াদ এবং মুক্তির সম্ভাবনা প্রসঙ্গে কথা বলে গেছে। এদিকে অলিউল্লাহ নোমান বিশেষ সংস্থার কাছ থেকে রহস্যজনক ফোন পেয়েছে। নম্বরবিহীন টেলিফোনের ওপার থেকে নাম-পরিচয় দিতে অনিচ্ছুক একজন জানতে চেয়েছেন, আমার দেশ পত্রিকার সহকর্মীরা ১৭ মার্চ আমার মুক্তির ব্যাপারে কতখানি আশাবাদী। এসব প্রশ্নকে কী বলা যেতে পারে? সম্ভবত তামাশা কিংবা মানসিক যন্ত্রণা দেয়ার সর্বশেষ চেষ্টা। দেখার সময় শেষ হলে তিনজন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের বন্ধুত্বের মর্ম হয়তো আজকের তরুণরা বুঝবে না। বাবলুকে জড়িয়ে ধরলাম সেই বাল্যকালের মতো। আমাকে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কাঁদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় অধ্যাপক ড. সালাহউদ্দিন মো. আমিনুজ্জামান।
ওর ছাত্রছাত্রীরা কি তাদের শিক্ষকের শিশুর মতো এই মনটাকে জানার সুযোগ পেয়েছে? পারভীন দু’চোখ ভরা পানি নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে প্রাণপণ চেষ্টায় কান্নার শব্দ আটকাচ্ছে। চিরকালের পাষাণ হৃদয় আমি, পাষাণের মতোই দাঁড়িয়ে রইলাম। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি কি তখনও ধরে রাখতে পেরেছিলাম? কারা কর্মকর্তারাও সবাই বিষণ্ন, কেউ কোনো কথা বলছে না। বার বার পেছন ফিরে চাইতে চাইতে বাবলু ও পারভীন এক সময় জেলগেট পেরিয়ে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল। আমি ফিরলাম আপন সেলে।
১৬ তারিখও সমস্ত দিন পার হয়ে সন্ধ্যা এলো। জেল কর্তৃপক্ষ আমার মুক্তির ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত কিছুই জানায়নি। যেন আমার সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার ব্যাপারটা প্রশাসন একেবারে ভুলে বসে আছে। মাগরিবের খানিক আগে আমি আর সাঈদী ভাই আজানের অপেক্ষা করছি, হঠাত্ ফার্মাসিস্ট শাহিনকে সঙ্গে নিয়ে সুবেদার কুদ্দুসের আগমন। এদিক-ওদিক তাকিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করল, স্যার জিনিসপত্র গোছানো কি শেষ হয়েছে? আমি নির্লিপ্তভাবে জবাব দিলাম, আপনারা তো আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে মুক্তির বিষয়ে কিছু জানাননি। যতক্ষণ জেলার এবং সুপার কিছু না জানাচ্ছেন, ততক্ষণ এখান থেকে বিদায়ের কোনো রকম প্রস্তুতি গ্রহণ করছি না। এই শেষ সময়ে প্রশাসনের হাতে আর নতুন করে হেনস্থা হতে চাই না। কুদ্দুস অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেল। সে চলে গেলে শাহিন আমাকে সম্ভবত আশ্বস্ত করার জন্য যোগ করল, আপনাকে আটক রাখার সিদ্ধান্ত হলে এতক্ষণে ওপর থেকে নির্দেশ চলে আসত। যতদূর শুনেছি, সে রকম কোনো ইঙ্গিত এখনও কোনো মহল থেকেই পাওয়া যায়নি। শাহিন বিদায় নেয়ার পর সাঈদী ভাই বরাবরের মতোই জোর দিয়ে বললেন, মাহমুদ ভাই, ইন্শাআল্লাহ্ কাল আপনি মুক্তি পাচ্ছেন। গত দেড় মাস ধরে এই আলেম মানুষটি বড় ভাইয়ের মতো করে সব অবস্থায় আমাকে সাহস দিয়ে চলেছেন। আজ মাগরিবের নামাজের পর মাওলানা দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদী বিএনপির মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের বিদেহী আত্মার মাগফিরাতের জন্য বিশেষভাবে দোয়া করলেন। তিনি দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভুগে আজ দুপুরে সিঙ্গাপুরে ইন্তেকাল করেছেন। এক এগারো পরবর্তী অত্যন্ত কঠিন সময়ে বিএনপির মহাসচিব হিসেবে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকবলিত দলটিকে দৃঢ় হাতে ধরে রেখে খন্দকার দেলোয়ার এক ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি কোনোদিনই কারিশমাটিক রাজনীতিবিদ হতে পারেননি। কিন্তু জেনারেল মইনের আধা-সামরিক জামানার বৈরী সময়ে সাহস, দেশপ্রেম ও বিশ্বস্ততার পরীক্ষায় খন্দকার দেলোয়ার যেভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন, সেটি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ত্যাগী নেতা-কর্মীদের দীর্ঘদিন ধরে অনুপ্রাণিত করবে।
এ দেশের জাতীয়তাবাদী রাজনীতি হীনবল করার চতুর্মুখী ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার বিপরীতে তিনি বেগম খালেদা জিয়ার তার প্রতি অর্পিত দায়িত্ব ও আস্থার পূর্ণ সম্মান দিতে পেরেছিলেন। আমার সঙ্গে খন্দকার দেলোয়ারের কখনও তেমন পরিচয় না থাকলেও এক এগারোর বিপর্যয়ের সময় বেগম খালেদা জিয়ার সমর্থনে বিএনপির মূল ধারার সঙ্গে অন্যান্য রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির যোগাযোগ স্থাপনে একসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করতে পেরেছিলাম। কাল সকালে খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের মরদেহ বাংলাদেশে আসছে। জানি না আমার জেল থেকে মুক্তি এবং তার মরদেহের মাতৃভূমির মাটি স্পর্শ করার ঘটনা একই সময় ঘটবে কিনা।
নামাজ সমাপ্ত করে সাঈদী ভাইয়ের সেলে সান্ধ্যকালীন চায়ের আসরে যোগ দিলাম। উনি জেলে আসার পর থেকে আমরা তিনজন প্রতি সন্ধ্যায় চানাচুর, বাদাম ইত্যাদি মেশানো মুড়িসহযোগে চা পান করে থাকি। আমাদের তৃতীয় সঙ্গী সিআইডি কয়েদি কাম সেবক আলমগীর। আজ দীর্ঘ সময় সাঈদী ভাইয়ের সেলে বসে রইলাম। আজ শেষ সন্ধ্যা, তাই সবাই আমরা বিষণ্ন। সিআইডি আলমগীর কোত্থেকে খবর এনেছে, আমাকে নাকি সরকার অবশেষে ছেড়েই দিচ্ছে। আমি আশা-নিরাশার দোলাচলে। আমাকে ছেড়ে এই জেলে একা থাকতে যে প্রচণ্ডভাবে নিঃসঙ্গ বোধ করবেন, এ কথাটি সাঈদী ভাই একাধিকবার বললেন। এই দেড় মাসে আমার প্রতি তার অপার স্নেহ সর্বক্ষণ অনুভব করেছি। তিন জনার জামাতে এশার নামাজ আদায় করে নিজ সেলে ফিরলাম, কারারক্ষী এসে খাঁচা বন্ধ করে বিশাল তালা লাগাল।
সারারাত প্রায় নির্ঘুমই কাটল। মুক্তির অনিশ্চয়তার উত্কণ্ঠা তো ছিলই, তার চেয়েও বড় দুর্ভাবনা দেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ে। দিনে দিনে বর্তমান সরকার দিল্লির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন মহলে ক্রমেই এক ধরনের সিকিম সিনড্রোমের প্রাবল্য অনুভূত হচ্ছে। সিকিমের প্রায় একদলীয় নির্বাচিত সংসদেই লেন্ডুপ দোর্জির নেতৃত্বে ভারতভুক্তির প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছিল। বাংলাদেশ হয়তো সরাসরি ভারতের অংশে পরিণত হবে না, কিন্তু সে দেশের প্রতি বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পরিবারটির ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতার ঋণ শোধের ব্যগ্রতায় ভারতের স্বার্থের কাছে বাংলাদেশের স্বার্থ সর্বাংশে জলাঞ্জলি দেয়া সম্পন্ন হয়েছে। সরকারের এই নতজানু নীতির বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে যে তীব্র গণপ্রতিরোধ এতদিনে গড়ে ওঠা উচিত ছিল, দুর্ভাগ্যজনকভাবে দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অবধারিত পরিণতিতে বাংলাদেশে সেটি আজও হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আসন্ন ঢাকা সফরে সীমান্তের একাধিক পয়েন্ট দিয়ে ট্রানজিট প্রদান চুক্তি স্বাক্ষর হতে চলেছে। ট্রানজিটের নামে আঞ্চলিক সাম্রাজ্যবাদী দেশটিকে করিডোর দেয়ার বিপক্ষে আমার স্পষ্ট অবস্থান রয়েছে। জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে ট্রানজিট নিয়ে অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ করার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করেছি।
পক্ষান্তরে আমি মনে করি, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিবেচনায় বাংলাদেশের পক্ষে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার প্রস্তাবে সম্মত হওয়া আমাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে আত্মহত্যারই নামান্তর। আমাদের দেশের চারদিকে পৃথিবীর দীর্ঘতম কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করে এবং এখন আবার তার মধ্য দিয়ে বর্তমানে পণ্য ও অন্যান্য সরঞ্জাম পরিবহন এবং এক সময়ে সৈন্য চলাচলের জন্য রাস্তা বানিয়ে ভারত আমাদের দেশটিকে ক্রমেই অধিকৃত ফিলিস্তিনের মতো টুকরো টুকরো করছে। নিজভূমে পরবাসী হয়ে থাকার অপমান বাংলাদেশের জনগণ অনন্তকাল ধরে সহ্য করে যাবে এতটা হতাশাবাদী হতে এখনও মন সায় দেয় না। শোষণের একটি পর্যায়ে অবশ্যই আধিপত্যবাদী শক্তি ও তাদের এ দেশীয় দালালদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ আরম্ভ হবে। সেই চূড়ান্ত লড়াইয়ের পরিণতি আমার জানা নেই। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় আমার কাছে তাই বাংলাদেশকেও আজ একটি বৃহত্ কারাগার বলেই মনে হয়। প্রায় দশ মাস ধরে জেলের ভেতরে কংক্রিটের দেয়ালঘেরা জায়গার মধ্যে নিয়ন্ত্রিত বিচরণ করছি। যদি মুক্তি পাই তাহলে কাঁটাতারের বেড়ায় আবদ্ধ ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত প্রান্তরে হয়তো ঘুরে বেড়ানোর আপাত স্বাধীনতা মিলবে। এটুকুই যা পার্থক্য।
আজ ১৭ই মার্চ, জেলকোড অনুযায়ী বিকেলে গুনতি মেলানোর আগেই আমাকে ছেড়ে দিতে হবে। অন্যদিন ফজরের নামাজ পড়ে সাঈদী ভাই ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে নেন। আজ সকালে রুটিনের ব্যতিক্রম ঘটল। ভোরে এক প্রস্থ চা-বিস্কুট খেয়ে দু’জন মিলে খানিকক্ষণ যার যার জীবনের গল্প, দেশের গল্প করলাম। গাজীপুর জেলে আসার পর থেকে সকাল সাতটার মধ্যেই গোসলের পাট শেষ করে ফেলি। আজও সেটা সাঙ্গ করে ডিভিশন সেলের দুই আসামি শেষ বারের মতো একসঙ্গে নাস্তা খেলাম। আলমগীর গেল জেল প্রশাসনের সর্বশেষ হাবভাব বুঝতে। সকাল আটটার দিকে উত্তেজিত হয়ে ফিরে এসে বলল, গাজীপুর জেলের সামনের রাজপথ নাকি লোকে-লোকারণ্য হয়ে গেছে। ভোর হতে দূর-দূরান্ত থেকে সবাই আসছেন আমাকে মুক্ত জীবনে বরণ করে নেয়ার জন্য। বাইরে অব্যাহত মিছিল, স্লোগান চলছে। রাস্তার দুই পাশ গাড়িতে ভরে গেছে। আমি অভিভূত হলাম।
আমি নেতা নই, সুশীল (?) নই, বিত্তশালী নই, জ্ঞানী-গুণী নই। অথচ এই নগণ্য মাহমুদুর রহমানের জন্য কষ্ট করে এত সকালে এতগুলো মানুষ ছুটে এসেছেন, ভাবতেই দীর্ঘদিনের এই জেল জীবনের সব কষ্ট, অত্যাচার, নির্যাতন তুচ্ছ বোধ হলো। সকাল ন’টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও যখন কারা প্রশাসনের তরফ থেকে আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হলো না তখন ভাবলাম হয়তো নতুন কোনো ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। সাঈদী ভাই অসুস্থ মানুষ, তাকে অনেকটা জোর করেই কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে তার সেলে পাঠিয়ে আমি ডিভিশন সেলের বারান্দায় চেয়ার পেতে চূড়ান্ত খবরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
কিছুক্ষণ পর জেলের রুটিন অনুযায়ী জেলার সকালের রাউন্ডে বেরিয়ে ডিভিশন সেলকে একটু দূরত্বে রেখেই দুই ডেপুটি জেলার এবং সুবেদারকে নিয়ে চক্কর শুরু করায় আমার উদ্বেগ বাড়ল। অন্যদিন দূর থেকেই ভদ্রলোক সালামের ভঙ্গিতে কপাল পর্যন্ত হাত তোলেন। আজ ইচ্ছাকৃতভাবে এদিকে তাকালেনই না। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না যে, সরকারের ওপর মহলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও জেলার পর্যন্ত এসে পৌঁছায়নি। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বিব্রত হতে চাচ্ছেন না। সকাল দশটায় এক মুখচেনা কয়েদি বেশ চিন্তিত মুখে ডিভিশন ওয়ার্ডের পাঁচিলের বাইরে থেকে আমাকে তার কাছে যাওয়ার জন্য ইশারা করল। লোকটিকে এর আগে দু’ তিনবার জেলের মধ্যেই দেখেছি। দেখা হলেই সসম্ভ্রমে সালাম দিয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করত। কাছে যেতেই জানাল, জেলগেট থেকে শুনে এসেছে আমাকে মুক্তি দেয়া হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, কারারক্ষীরা নাকি বলেছে, জেলের বাইরে অনেক বিডিআর চলে এসেছে। আমি জেলেগেট পার হয়ে বাইরে পা দেয়া মাত্র আবার গ্রেফতার করে অজানা স্থানে নিয়ে যাওয়া হবে। সে ধরনের পরিস্থিতিতে উপস্থিত জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে তাদের সামলানোর দায়িত্ব পড়বে বিডিআরের ওপর।
এই উড়ো খবরে মনটা স্বাভাবিকভাবেই খারাপ হয়ে গেল। সাঈদী ভাইয়ের ঘুম ভাঙিয়ে দুঃসংবাদটা জানালাম। তিনি কিছুটা চিন্তিত হলেও বরাবরের মতোই দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, আপনাকে সরকারের আজ ছাড়তেই হবে। দু’জনে কথা বলছি, এমন সময় দুই ডেপুটি জেলার এসে খবর দিল, স্যার এইমাত্র সব সংস্থা থেকে ক্লিয়ারেন্স এসে গেছে, আপনি মুক্তি পাচ্ছেন। এবার সত্যিই হতভম্ব হলাম। কোন খবরটা বিশ্বাস করব? কিছুটা অসৌজন্যমূলকভাবেই ছেলে দুটিকে বললাম, তোমরা মিথ্যা কথা বলছ, আমি বাইরে গেলেই আবার গ্রেফতার হব, এজন্যই তোমরা বিডিআর ডেকে এনেছ। ওরা কিছুতেই আমাকে বোঝাতে না পেরে জেলার সিরাজুল ইসলামকে ডেকে নিয়ে এলো। তিনি এসে নিশ্চয়তা দিলেন যে, তার কাছে আইজির চূড়ান্ত নির্দেশ এসেছে আমাকে মুক্তি দেয়ার জন্য। প্রশাসনকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে না পারলেও পরনের লুঙ্গি বদলে পায়জামা-পাঞ্জাবি গায়ে চাপালাম। আমার লটবহর যত্সামান্য, গোছাতে আধ ঘণ্টার বেশি লাগল না। চোখে পানি নিয়ে সাঈদী ভাই ডিভিশন ওয়ার্ডের মূল দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে বিদায় নিলেন। মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর সঙ্গে আমার মাত্র দেড় মাসের পরিচয়। আজ একজন প্রকৃত স্বজনের সঙ্গে বিচ্ছেদের বেদনা বুকে নিয়ে কারা অফিসের দিকে এগুলাম। সুপারের অফিসকক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো, ভদ্রলোক সকাল থেকে এসে বসে আছেন। তার সামনে গাজীপুর পুলিশের অফিসাররাও অপেক্ষমাণ। আমি তখনও অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি। খানিকটা রসিকতার সুরে পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রশ্ন করলাম, আবার গ্রেফতার কি সুপারের অফিসেই করবেন নাকি জেলগেটের বাইরে? সুপার কেবল হেসে আসামির রেজিস্টারটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে সই করতে বললেন। পুলিশ অফিসারটিও যথাযথ সৌজন্য প্রদর্শন করে জানালেন, গ্রেফতারের জন্য নয়, তারা আমাকে নিরাপত্তা দিতে এসেছেন। ৪৯টি মামলায় অভিযুক্ত রাষ্ট্রদ্রোহী মাহমুদুর রহমানের নিরাপত্তার জন্য গাজীপুর প্রশাসন পুলিশ পাঠিয়েছে, শুনে খানিকটা তামাশার মতো মনে হলো। মিনিট দশেকের মধ্যে জেলমুক্তির আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে জেলগেটের বাইরে পা দেয়া মাত্র দূরে রাস্তায় অপেক্ষমাণ জনতা সমস্বরে গগনবিদারী চিত্কার করে উঠল। আমি আকাশের দিকে মুখ তুলে উচ্চারণ করলাম, শোকর আলহামদুলিল্লাহ্, আল্লাহু আকবর। গাজীপুর জেল পেছনে রেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলাম আবেগাপ্লুত হাজার হাজার লড়াকু মানুষের প্রসারিত হাত স্পর্শ করে ধন্য হওয়ার জন্য। এরাই আমাকে ফ্যাসিবাদের কারাগার থেকে মুক্ত করে এনেছেন। এখন আরও ব্যাপক ও প্রাণঘাতী লড়াই বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনগণের জন্য অপেক্ষা করে আছে। কাঁটাতারে আবদ্ধ ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ নামক কারাগারে আটক ষোল কোটি নাগরিকের মুক্তির যে লড়াই তার মূল প্রতিপক্ষ এই যোগসাজশের মহাজোট সরকারের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষমতাবান। সেই দীর্ঘ, রক্তাক্ত ও কঠিন সংগ্রামের সৈনিকতার প্রস্তুতি শুরু করব জেলমুক্ত জীবনের প্রথম দিন থেকেই।
প্রথম জেল জীবনের কথকতার এইখানেই সমাপ্তি।
শেষ

No comments

Powered by Blogger.