১৪- চোখ বাঁধা প্রবীণ রাজনীতিকের পায়ের নখ উপড়ে ফেলা ছিল ন্যূনতম নির্যাতন
এ কোন গণতন্ত্রের বড়াই করি
নিজের কথা বাদ দিয়ে অপর একজন রাজনৈতিক নেতাকে রিমান্ডে নিয়ে নিষ্ঠুর অত্যাচারের কথা বলি। জেলে এসে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তার ওপর রিমান্ডে যে লোমহর্ষক নির্যাতন হয়েছে, সেটি শোনার পর সে রাতে আর ঘুমাতে পারিনি। প্রবীণ সেই রাজনীতিককে সবচেয়ে কম যন্ত্রণাদায়ক যে নির্যাতন করা হয়েছে, তা হলো চোখ বাঁধা অবস্থায় একটি ভারী বস্তুর আঘাতে তার পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ উপড়ে ফেলা....
নিজের কথা বাদ দিয়ে অপর একজন রাজনৈতিক নেতাকে রিমান্ডে নিয়ে নিষ্ঠুর অত্যাচারের কথা বলি। জেলে এসে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তার ওপর রিমান্ডে যে লোমহর্ষক নির্যাতন হয়েছে, সেটি শোনার পর সে রাতে আর ঘুমাতে পারিনি। প্রবীণ সেই রাজনীতিককে সবচেয়ে কম যন্ত্রণাদায়ক যে নির্যাতন করা হয়েছে, তা হলো চোখ বাঁধা অবস্থায় একটি ভারী বস্তুর আঘাতে তার পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ উপড়ে ফেলা....
দ্বিতীয় গল্পের মূল চরিত্র জেলের ভাষায় একজন টিটি অর্থাত্ টপ টেরর। প্রায় আট বছর জেলে আটক থাকাকালে সহবন্দিদের কাছে অপরাধ জগত্ ছেড়ে দিয়ে বিদেশে চলে যাওয়ার স্বপ্নের কথা বলেছে বহুবার। নিজের অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে অহরহ অনুতাপ করত। পথভ্রষ্ট ছেলেকে অন্ধকার জগত্ থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় সর্বস্ব বিক্রি করে বিদেশে পাঠানোর প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন মধ্যবিত্ত পিতা। ছেলের জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার দিন উত্কণ্ঠিত পিতা অপেক্ষা করছিলেন জেল গেটের বাইরে। ছেলে জেল থেকে বেরোলেই তাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন, যেখানে প্রিয়জনরা ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে। তরুণটি জেল গেট দিয়ে বার হয়েই দেখল সাক্ষাত্ মৃত্যু ওত পেতে বসে আছে। ভয়ার্ত কণ্ঠে চিত্কার করে আবার জেল গেটের ভেতরে ফিরে আসার চেষ্টা করল। ততক্ষণে জেল গেটের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। এলিট বাহিনীর সদস্যরা অপেক্ষমাণ দামী গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে এসে শিকারের দু’হাত ধরল। পিতার চোখের সামনেই ঘটছে এই নাটকীয় দৃশ্য। ছেলেকে রক্ষা করার জন্য পিতা উদ্ভ্রান্তের মতো নিরাপত্তা রক্ষীদের কর্ডন ভেঙে ছুটে আসার চেষ্টা করলেন। এক ধাক্কায় তাকে ফেলে দেয়া হলো রাস্তায়। সদ্য কারামুক্ত টপ টেররকে ততক্ষণে টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে ওঠানো হয়েছে। অনেক কষ্টে বৃদ্ধ পিতা উঠে দাঁড়ালেন, চলন্ত গাড়ির পেছন পেছন দৌড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টাও করলেন। যন্ত্রের গতির কাছে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের গতি পরাজিত হল। পরের দিনের সংবাদপত্রে সেই অতিপরিচিত গল্প। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বন্দুকযুদ্ধের এক পর্যায়ে ক্রসফায়ারে আরও একজন টপ টেরর নিহত হয়েছে। অকুস্থল থেকে একটি আগ্নেয়াস্ত্র এবং কয়েক রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। পুত্রহারা পিতা অনেক সাহস করে সত্য ঘটনা জানানোর জন্য সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে প্রকৃত ঘটনা তুলেও ধরেছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একাকী, ক্ষমতাহীন নাগরিকের প্রতিবাদ অব্যাহত রাখা যায়নি। পরিবারের অন্যান্য সদস্যের একই পরিণতির হুমকিকে উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি। এক পুত্র গেলেও অন্য পুত্র, কন্যা, কন্যাজামাতারা তো আছে। তাদের প্রতিও তো পিতার কর্তব্য রয়েছে।
এরপর একজন ব্যর্থ প্রেমিকের হারিয়ে যাওয়ার গল্প। পাড়ার সুন্দরী মেয়েটিকে ভালোবেসে ফেলেছে এক বেকার রংবাজ যুবক। একতরফা প্রেমে মেয়েটি সাড়া দেয়নি। তারপরও মনোযোগ আকর্ষণের ব্যর্থ চেষ্টা চলছেই, যাকে হয়তো খানিকটা ইভটিজিংয়ের পর্যায়েও ফেলা যেতে পারে। মেয়েটি যে যুবককে ভালোবাসে, এলিট বাহিনীতে তার যথেষ্ট জানা-শোনা রয়েছে। নাছোড়বান্দা প্রেমিককে ঘাড় থেকে নামানোর জন্য একদিন মেয়েটি ফোন করে তাকে নির্জনে দেখা করার প্রস্তাব দিল। ওয়ার্ডরোবের সেরা পোশাক পরে নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে দেখে প্রেমের প্রভাবশালী প্রতিদ্বন্দ্বী তার ক্ষমতাধর বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে অপেক্ষমাণ। সেই শেষ। রংবাজ তরুণটি তারপর থেকে নিখোঁজদের তালিকাভুক্ত হয়ে গেছে। এই ছেলেটির মতো অসংখ্য মানুষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে নিখোঁজ হয়েছে। ক্রসফায়ারে তবু লাশটা মেলে। সেটা এক ধরনের সান্ত্বনা। আত্মীয়-স্বজনরা কিছুদিন কান্নাকাটি করার পর যার যার স্বাভাবিক, দৈনন্দিন জীবনে ফিরে যায়। কিন্তু নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবারের প্রতীক্ষার প্রহর গোনা কোনোদিন শেষ হয় না। প্রতিবার কলিংবেল বাজলে কিংবা দরজার কড়া নাড়ার আওয়াজ পেলেই মনে হয়, সে বুঝি ফিরে এসেছে। প্রিয়জনের এ এক অসহনীয় বেঁচে থাকা।
সর্বশেষ কাহিনীতে হত্যাকাণ্ড দু’টি। এক বড়সড় সন্ত্রাসী ক্রসফায়ারের হাত থেকে বাঁচার জন্য গোপন স্থানে পালিয়ে আছে। তারই পাড়ার আরেক দরিদ্র যুবককে সে ভাড়া করেছে দু’বেলা খাবার পৌঁছে দেয়ার জন্যে। যুবকটি কিছুটা টাকার লোভে আর কিছুটা সন্ত্রাসীর আতঙ্কে এই কাজে সম্মত হয়েছে। একদিন দু’জনাই ধরা পড়ে। শুরু হয় নির্যাতন। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা খাবার বহনকারী ছেলেটিকে দু-চারটি চড়-থাপ্পড় মারা ছাড়া তেমন গুরুতর কোনো নির্যাতন করেনি। ওদেরও গরিব ছেলেটির প্রতি এক ধরনের মায়া জন্মে গেছে। একদিন তাকে মুক্তির আশ্বাসও দেয়া হয়। আটকাবস্থাতেই ছেলেটি কোনোক্রমে তার মায়ের কাছে পত্র দিয়ে কিছু টাকা-পয়সা জোগাড় করতে বলে। এ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। ছেলেটি হয়তো যত্সামান্য অর্থের বিনিময়ে মুক্তিও পেয়ে যেত। সমস্যা বাধল যখন অতিরিক্ত নির্যাতনে টপ টেরর ছেলেটি পুলিশ হেফাজতেই মৃত্যুবরণ করল। লাশ ফেলে দেয়ার আয়োজন চলছে, এমন সময় খবর এলো নিহত টপ টেররের সহোদর নিজেই একটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। সঙ্গত কারণেই পুলিশ হেফাজতে সন্ত্রাসীর মৃত্যুর ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার গরজ বহুলাংশে বেড়ে গেল। সেক্ষেত্রে নির্যাতনের সঙ্গীকে তো আর জীবিত রাখা যায় না। অতএব দরিদ্র পরিবারের তরুণটিকেও মরতে হলো। কিছুদিন পর বস্তাবন্দি দুটো লাশ ভেসে উঠলো ঢাকার খুব কাছের এক নদীতে।
এটাই বাংলাদেশের আইনের শাসনের প্রকৃত চিত্র। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি জেনেভায় গিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যার প্রশ্নে তার সরকারের ‘জিরো টলারেন্সের’ কল্পকাহিনী প্রচার করে হাততালি কুড়িয়ে আনেন। আইনমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্বিকারভাবে তাদের আমলে একটিও বিচারবহির্ভূত হত্যা না হওয়ার নির্জলা মিথ্যা দাবি করেন। প্রধানমন্ত্রী এসব তুচ্ছ বিষয়কে আলোচনার উপযুক্তই বিবেচনা করেন না। ২০০৮ সালে আমার দেশ পত্রিকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই আমরা মানবাধিকারের পক্ষে সম্পাদকীয় নীতি গ্রহণ করেছি। ক্রসফায়ার, রিমান্ডে নির্যাতন, শ্যোন অ্যারেস্টের অপব্যবহার, ইত্যাদি মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে পত্রিকাটিতে দিনের পর দিন রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে, সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে। এসব বিষয়ে লেখালেখি করার সময় কখনও মনে হয়নি জীবনের পড়ন্ত বেলায় আমাকে রিমান্ডে নির্যাতনের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। আমার সেই নির্মম অভিজ্ঞতার বর্ণনা এর আগেই লিখে ফেলেছি। এখন অপেক্ষা করে আছি কবে মুক্তি পাব আর আমার সেই যাতনার কাহিনী বাংলাদেশের জনগণ জানতে পারবে। সেই অপেক্ষা দীর্ঘ হবে, সেটাও আমি জানি।
নিজের কথা বাদ দিয়ে অপর একজন রাজনৈতিক নেতাকে রিমান্ডে নিয়ে নিষ্ঠুর অত্যাচারের কথা বলি। জেলে এসে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। অতি সজ্জন ব্যক্তিটির ওপর রিমান্ডে যে লোমহর্ষক নির্যাতন হয়েছে, সেটি শোনার পর সে রাতে আর ঘুমাতে পারিনি। রাষ্ট্রযন্ত্রের এই পাশবিকতার নিন্দা জানানোর উপযুক্ত ভাষা আমার জানা নেই। প্রবীণ সেই রাজনীতিককে সবচেয়ে কম যন্ত্রণাদায়ক যে নির্যাতন করা হয়েছে, তা হলো চোখ বাঁধা অবস্থায় একটি ভারী বস্তুর আঘাতে তার পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ উপড়ে ফেলা। অনবরত নির্যাতনের মধ্যে ছিল শরীরের সর্বত্র পুনঃ পুনঃ ইলেকট্রিক শক প্রয়োগ এবং এক ধরনের বৈদ্যুতিক চেয়ারে বসিয়ে অবিশ্বাস্য গতিতে ঘোরানো। অশালীন অত্যাচারের একটি নমুনার কথাও তিনি আমাকে বলেছিলেন; বিশেষভাবে নির্মিত একটি বৈদ্যুতিক পাত্রে তাকে মূত্রত্যাগে বাধ্য করা হয়, যার প্রতিক্রিয়ায় তাত্ক্ষণিক ভয়াবহ শকের ফলে মূত্রের সঙ্গে জমাটবাঁধা রক্ত অনবরত যেতে থাকে। এই ফ্যাসিবাদী নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনার সময় তিনি বার বার কণ্ঠরুদ্ধ হয়েছেন। আমিও অশ্রু সংবরণ করতে পারিনি। তার কান্না কেবল দৈহিক যন্ত্রণার স্মৃতির কারণে ছিল না। অপমান, ক্ষোভ, অসহায়ত্ব, ক্রোধ মিলেমিশে এক প্রবীণ সম্মানিত মানুষের হৃদয়ভাঙা বেদনার বহিঃপ্রকাশ দেখেছিলাম সেদিন। সারা রাত বিনিদ্র থেকে বার বার নিজেকে প্রশ্ন করেছি, এ কোন সংবিধান এবং গণতন্ত্রের বড়াই করি আমরা? ব্রিটিশরা না হয় ঔপনিবেশিক নির্যাতনকারী শক্তি ছিল, পাকিস্তানিরা এক ধর্মের হলেও তারাও বিজাতীয় ছিল; কিন্তু বর্তমান শাসক শ্রেণীকে কোন পরিচয়ে অভিহিত করব—সেই প্রশ্নের উত্তর এই বন্দিজীবনে অহর্নিশ খুঁজে চলেছি। টিএফআই সেলে আমার জিজ্ঞাসাবাদের সময় কথা প্রসঙ্গে এক তরুণ (কণ্ঠস্বরে তা-ই মনে হয়েছিল) বেশ বড়াই করে কাচের বোতল ব্যবহারের মাধ্যমে এক বিচিত্র নির্যাতন প্রক্রিয়ার আভাস দিলে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বাইরে থেকে যেসব অত্যাচার-নির্যাতনের বিবরণ আমরা শুনতে পাই, সেগুলো তাহলে বাস্তব। উপস্থিত অপর একজন ঊর্ধ্বতন অফিসারের বাধার কারণে আলোচনা বেশি দূর এগোতে পারেনি। জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়ে গেলে টিএফআই’র অন্ধকূপসম সেলে বসে বসে তরুণ অফিসারটির অসুস্থ মানসিকতার জন্য নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছিল। আমরা যারা কোনো না কোনো পর্যায়ে রাষ্ট্রের শাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকার সুযোগ পেয়েছি, তারা ক্ষমতাসীন অবস্থায় মানবাধিকারের প্রতি যথাযথ সম্মান না দেখানোর ফলে আজ সম্পূর্ণ রাষ্ট্রব্যবস্থাই এক ভয়াবহ নির্যাতনকারী যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। একা ওই তরুণের দোষ কেথায়? আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অর্থ হচ্ছে, যাবতীয় সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সন্ত্রাসীদের আদালতে বিচারের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে শাস্তির বিধান করা। সেই শাস্তি মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। কিন্তু আজ যেভাবে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হচ্ছে, পুলিশ হেফাজতে হত্যা করা হচ্ছে এবং নির্বিচারে ক্রসফায়ারে পাঠানো হচ্ছে সেটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের লক্ষণ। বর্তমান সরকারের শাসনামলে ফ্যাসিবাদের সেই কুিসত চিহ্ন রাষ্ট্রের সর্বাঙ্গে ফুটে উঠেছে। এর বিরুদ্ধে বিবেকবান নাগরিকদের সাহস করে নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করা আবশ্যক। জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামে স্বাধীন সংবাদমাধ্যম এবং দলীয় প্রভাবমুক্ত বিচার বিভাগ সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বে উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে।
আগে সংবাদমাধ্যমের কথা বলি। এ দেশে সংবাদমাধ্যম কতভাবে নিয়ন্ত্রিত ও নির্যাতিত হচ্ছে, সেটা আমার চেয়ে বেশি আর কে জানে? জেলে বসে খবরের কাগজে পড়লাম, তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সফর করে এসেছেন। পাঠকদের জানিয়ে রাখা দরকার যে, জেলের ভেতরে গুটিকয়েক সরকারপন্থী পত্রিকা ছাড়া অন্য পত্রিকার প্রবেশাধিকার নেই। আমার দেশ-এর তো প্রশ্নই ওঠে না। প্রশাসনের বিবেচনায় জেলে ঢোকার উপযুক্ত পাঁচ সংবাদপত্র হলো জনকণ্ঠ, সংবাদ, সমকাল, যুগান্তর এবং দি ডেইলি স্টার। যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে তথ্যমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সমর্থকগোষ্ঠী আয়োজিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উচ্চকণ্ঠে বলে এসেছেন, বাংলাদেশে নাকি সংবাদমাধ্যম বর্তমানে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে। সব দেশেই বোধহয় রাজনীতিবিদদের পেশাগত বাধ্যবাধকতায় একটু-আধটু মিথ্যাচার করতে হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এই বিশেষ কর্মে প্রতিযোগিতায় দাঁড়াতে পারে, এমন রাজনীতিবিদ সারা বিশ্বে কোথাও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শত শত পুলিশের বুটের আঘাতে আমার দেশ পত্রিকা অফিস ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পরদিন তথ্যমন্ত্রী সংসদে লিখিত বিবৃতি পড়ার সময় বার বার যে আটকে যাচ্ছিলেন, সে দৃশ্য সেদিন যারা টেলিভিশন দেখেছিলেন তাদের স্মরণে থাকার কথা। তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদের পক্ষেও ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওই ধরনের মিথ্যা বিবৃতি পাঠ করা সম্ভবত অস্বস্তিকর বোধ হচ্ছিল। যতদূর অবগত আছি, বাংলাদেশের বর্তমান তথ্যমন্ত্রী পেশায় একজন সাংবাদিক ছিলেন এবং তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সম্মানিত সদস্য। এদের মতো ব্যক্তিদের নীতিহীনতার কারণেই এদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এত সহজে হরণ করা গেছে। আওয়ামী লীগ বাকস্বাধীনতায় যে বিশ্বাস করে না, সেটি তাদের ১৯৭৫, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং এবারের শাসনামলে ধারাবাহিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। অথচ দলটি ২০০৮ সালে দিনবদলের সনদ নামক নির্বাচনী ইশতেহারে গণমাধ্যমের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার গালভরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। অবশ্য এদেশে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকে অপরাধরূপে বিবেচনা করার সংস্কৃতি স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪০ বছর পরও দুর্ভাগ্যজনকভাবে গড়ে ওঠেনি। জনগণ ধরেই নেয় নির্বাচনপূর্ব প্রতিশ্রুতি ক্ষমতা লাভের পর ভাঙার জন্যই দেয়া হয়। অবশ্য অধিকার আদায় করে নেয়ার হিম্মত না থাকলে বলদর্পীদের হাতে নির্যাতিত হওয়ার জন্যে নালিশ করে কোনো ফায়দা নেই। দুর্বলের হাহুতাশই বিধিলিপি। তদুপরি বাংলাদেশের সংবাদকর্মীদের মধ্যে দলীয় বিভাজন প্রকট হওয়ায় তারা কোনো সরকারের আমলেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে সমর্থ হয় না। ফলে এদেশে ফ্যাসিবাদের উত্থান সহজতর হচ্ছে।
এরপর একজন ব্যর্থ প্রেমিকের হারিয়ে যাওয়ার গল্প। পাড়ার সুন্দরী মেয়েটিকে ভালোবেসে ফেলেছে এক বেকার রংবাজ যুবক। একতরফা প্রেমে মেয়েটি সাড়া দেয়নি। তারপরও মনোযোগ আকর্ষণের ব্যর্থ চেষ্টা চলছেই, যাকে হয়তো খানিকটা ইভটিজিংয়ের পর্যায়েও ফেলা যেতে পারে। মেয়েটি যে যুবককে ভালোবাসে, এলিট বাহিনীতে তার যথেষ্ট জানা-শোনা রয়েছে। নাছোড়বান্দা প্রেমিককে ঘাড় থেকে নামানোর জন্য একদিন মেয়েটি ফোন করে তাকে নির্জনে দেখা করার প্রস্তাব দিল। ওয়ার্ডরোবের সেরা পোশাক পরে নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে দেখে প্রেমের প্রভাবশালী প্রতিদ্বন্দ্বী তার ক্ষমতাধর বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে অপেক্ষমাণ। সেই শেষ। রংবাজ তরুণটি তারপর থেকে নিখোঁজদের তালিকাভুক্ত হয়ে গেছে। এই ছেলেটির মতো অসংখ্য মানুষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে নিখোঁজ হয়েছে। ক্রসফায়ারে তবু লাশটা মেলে। সেটা এক ধরনের সান্ত্বনা। আত্মীয়-স্বজনরা কিছুদিন কান্নাকাটি করার পর যার যার স্বাভাবিক, দৈনন্দিন জীবনে ফিরে যায়। কিন্তু নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবারের প্রতীক্ষার প্রহর গোনা কোনোদিন শেষ হয় না। প্রতিবার কলিংবেল বাজলে কিংবা দরজার কড়া নাড়ার আওয়াজ পেলেই মনে হয়, সে বুঝি ফিরে এসেছে। প্রিয়জনের এ এক অসহনীয় বেঁচে থাকা।
সর্বশেষ কাহিনীতে হত্যাকাণ্ড দু’টি। এক বড়সড় সন্ত্রাসী ক্রসফায়ারের হাত থেকে বাঁচার জন্য গোপন স্থানে পালিয়ে আছে। তারই পাড়ার আরেক দরিদ্র যুবককে সে ভাড়া করেছে দু’বেলা খাবার পৌঁছে দেয়ার জন্যে। যুবকটি কিছুটা টাকার লোভে আর কিছুটা সন্ত্রাসীর আতঙ্কে এই কাজে সম্মত হয়েছে। একদিন দু’জনাই ধরা পড়ে। শুরু হয় নির্যাতন। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা খাবার বহনকারী ছেলেটিকে দু-চারটি চড়-থাপ্পড় মারা ছাড়া তেমন গুরুতর কোনো নির্যাতন করেনি। ওদেরও গরিব ছেলেটির প্রতি এক ধরনের মায়া জন্মে গেছে। একদিন তাকে মুক্তির আশ্বাসও দেয়া হয়। আটকাবস্থাতেই ছেলেটি কোনোক্রমে তার মায়ের কাছে পত্র দিয়ে কিছু টাকা-পয়সা জোগাড় করতে বলে। এ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। ছেলেটি হয়তো যত্সামান্য অর্থের বিনিময়ে মুক্তিও পেয়ে যেত। সমস্যা বাধল যখন অতিরিক্ত নির্যাতনে টপ টেরর ছেলেটি পুলিশ হেফাজতেই মৃত্যুবরণ করল। লাশ ফেলে দেয়ার আয়োজন চলছে, এমন সময় খবর এলো নিহত টপ টেররের সহোদর নিজেই একটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। সঙ্গত কারণেই পুলিশ হেফাজতে সন্ত্রাসীর মৃত্যুর ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার গরজ বহুলাংশে বেড়ে গেল। সেক্ষেত্রে নির্যাতনের সঙ্গীকে তো আর জীবিত রাখা যায় না। অতএব দরিদ্র পরিবারের তরুণটিকেও মরতে হলো। কিছুদিন পর বস্তাবন্দি দুটো লাশ ভেসে উঠলো ঢাকার খুব কাছের এক নদীতে।
এটাই বাংলাদেশের আইনের শাসনের প্রকৃত চিত্র। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি জেনেভায় গিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যার প্রশ্নে তার সরকারের ‘জিরো টলারেন্সের’ কল্পকাহিনী প্রচার করে হাততালি কুড়িয়ে আনেন। আইনমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্বিকারভাবে তাদের আমলে একটিও বিচারবহির্ভূত হত্যা না হওয়ার নির্জলা মিথ্যা দাবি করেন। প্রধানমন্ত্রী এসব তুচ্ছ বিষয়কে আলোচনার উপযুক্তই বিবেচনা করেন না। ২০০৮ সালে আমার দেশ পত্রিকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই আমরা মানবাধিকারের পক্ষে সম্পাদকীয় নীতি গ্রহণ করেছি। ক্রসফায়ার, রিমান্ডে নির্যাতন, শ্যোন অ্যারেস্টের অপব্যবহার, ইত্যাদি মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে পত্রিকাটিতে দিনের পর দিন রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে, সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে। এসব বিষয়ে লেখালেখি করার সময় কখনও মনে হয়নি জীবনের পড়ন্ত বেলায় আমাকে রিমান্ডে নির্যাতনের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। আমার সেই নির্মম অভিজ্ঞতার বর্ণনা এর আগেই লিখে ফেলেছি। এখন অপেক্ষা করে আছি কবে মুক্তি পাব আর আমার সেই যাতনার কাহিনী বাংলাদেশের জনগণ জানতে পারবে। সেই অপেক্ষা দীর্ঘ হবে, সেটাও আমি জানি।
নিজের কথা বাদ দিয়ে অপর একজন রাজনৈতিক নেতাকে রিমান্ডে নিয়ে নিষ্ঠুর অত্যাচারের কথা বলি। জেলে এসে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। অতি সজ্জন ব্যক্তিটির ওপর রিমান্ডে যে লোমহর্ষক নির্যাতন হয়েছে, সেটি শোনার পর সে রাতে আর ঘুমাতে পারিনি। রাষ্ট্রযন্ত্রের এই পাশবিকতার নিন্দা জানানোর উপযুক্ত ভাষা আমার জানা নেই। প্রবীণ সেই রাজনীতিককে সবচেয়ে কম যন্ত্রণাদায়ক যে নির্যাতন করা হয়েছে, তা হলো চোখ বাঁধা অবস্থায় একটি ভারী বস্তুর আঘাতে তার পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ উপড়ে ফেলা। অনবরত নির্যাতনের মধ্যে ছিল শরীরের সর্বত্র পুনঃ পুনঃ ইলেকট্রিক শক প্রয়োগ এবং এক ধরনের বৈদ্যুতিক চেয়ারে বসিয়ে অবিশ্বাস্য গতিতে ঘোরানো। অশালীন অত্যাচারের একটি নমুনার কথাও তিনি আমাকে বলেছিলেন; বিশেষভাবে নির্মিত একটি বৈদ্যুতিক পাত্রে তাকে মূত্রত্যাগে বাধ্য করা হয়, যার প্রতিক্রিয়ায় তাত্ক্ষণিক ভয়াবহ শকের ফলে মূত্রের সঙ্গে জমাটবাঁধা রক্ত অনবরত যেতে থাকে। এই ফ্যাসিবাদী নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনার সময় তিনি বার বার কণ্ঠরুদ্ধ হয়েছেন। আমিও অশ্রু সংবরণ করতে পারিনি। তার কান্না কেবল দৈহিক যন্ত্রণার স্মৃতির কারণে ছিল না। অপমান, ক্ষোভ, অসহায়ত্ব, ক্রোধ মিলেমিশে এক প্রবীণ সম্মানিত মানুষের হৃদয়ভাঙা বেদনার বহিঃপ্রকাশ দেখেছিলাম সেদিন। সারা রাত বিনিদ্র থেকে বার বার নিজেকে প্রশ্ন করেছি, এ কোন সংবিধান এবং গণতন্ত্রের বড়াই করি আমরা? ব্রিটিশরা না হয় ঔপনিবেশিক নির্যাতনকারী শক্তি ছিল, পাকিস্তানিরা এক ধর্মের হলেও তারাও বিজাতীয় ছিল; কিন্তু বর্তমান শাসক শ্রেণীকে কোন পরিচয়ে অভিহিত করব—সেই প্রশ্নের উত্তর এই বন্দিজীবনে অহর্নিশ খুঁজে চলেছি। টিএফআই সেলে আমার জিজ্ঞাসাবাদের সময় কথা প্রসঙ্গে এক তরুণ (কণ্ঠস্বরে তা-ই মনে হয়েছিল) বেশ বড়াই করে কাচের বোতল ব্যবহারের মাধ্যমে এক বিচিত্র নির্যাতন প্রক্রিয়ার আভাস দিলে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বাইরে থেকে যেসব অত্যাচার-নির্যাতনের বিবরণ আমরা শুনতে পাই, সেগুলো তাহলে বাস্তব। উপস্থিত অপর একজন ঊর্ধ্বতন অফিসারের বাধার কারণে আলোচনা বেশি দূর এগোতে পারেনি। জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়ে গেলে টিএফআই’র অন্ধকূপসম সেলে বসে বসে তরুণ অফিসারটির অসুস্থ মানসিকতার জন্য নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছিল। আমরা যারা কোনো না কোনো পর্যায়ে রাষ্ট্রের শাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকার সুযোগ পেয়েছি, তারা ক্ষমতাসীন অবস্থায় মানবাধিকারের প্রতি যথাযথ সম্মান না দেখানোর ফলে আজ সম্পূর্ণ রাষ্ট্রব্যবস্থাই এক ভয়াবহ নির্যাতনকারী যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। একা ওই তরুণের দোষ কেথায়? আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অর্থ হচ্ছে, যাবতীয় সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সন্ত্রাসীদের আদালতে বিচারের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে শাস্তির বিধান করা। সেই শাস্তি মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। কিন্তু আজ যেভাবে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হচ্ছে, পুলিশ হেফাজতে হত্যা করা হচ্ছে এবং নির্বিচারে ক্রসফায়ারে পাঠানো হচ্ছে সেটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের লক্ষণ। বর্তমান সরকারের শাসনামলে ফ্যাসিবাদের সেই কুিসত চিহ্ন রাষ্ট্রের সর্বাঙ্গে ফুটে উঠেছে। এর বিরুদ্ধে বিবেকবান নাগরিকদের সাহস করে নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করা আবশ্যক। জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামে স্বাধীন সংবাদমাধ্যম এবং দলীয় প্রভাবমুক্ত বিচার বিভাগ সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বে উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে।
আগে সংবাদমাধ্যমের কথা বলি। এ দেশে সংবাদমাধ্যম কতভাবে নিয়ন্ত্রিত ও নির্যাতিত হচ্ছে, সেটা আমার চেয়ে বেশি আর কে জানে? জেলে বসে খবরের কাগজে পড়লাম, তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সফর করে এসেছেন। পাঠকদের জানিয়ে রাখা দরকার যে, জেলের ভেতরে গুটিকয়েক সরকারপন্থী পত্রিকা ছাড়া অন্য পত্রিকার প্রবেশাধিকার নেই। আমার দেশ-এর তো প্রশ্নই ওঠে না। প্রশাসনের বিবেচনায় জেলে ঢোকার উপযুক্ত পাঁচ সংবাদপত্র হলো জনকণ্ঠ, সংবাদ, সমকাল, যুগান্তর এবং দি ডেইলি স্টার। যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে তথ্যমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সমর্থকগোষ্ঠী আয়োজিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উচ্চকণ্ঠে বলে এসেছেন, বাংলাদেশে নাকি সংবাদমাধ্যম বর্তমানে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে। সব দেশেই বোধহয় রাজনীতিবিদদের পেশাগত বাধ্যবাধকতায় একটু-আধটু মিথ্যাচার করতে হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এই বিশেষ কর্মে প্রতিযোগিতায় দাঁড়াতে পারে, এমন রাজনীতিবিদ সারা বিশ্বে কোথাও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শত শত পুলিশের বুটের আঘাতে আমার দেশ পত্রিকা অফিস ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পরদিন তথ্যমন্ত্রী সংসদে লিখিত বিবৃতি পড়ার সময় বার বার যে আটকে যাচ্ছিলেন, সে দৃশ্য সেদিন যারা টেলিভিশন দেখেছিলেন তাদের স্মরণে থাকার কথা। তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদের পক্ষেও ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওই ধরনের মিথ্যা বিবৃতি পাঠ করা সম্ভবত অস্বস্তিকর বোধ হচ্ছিল। যতদূর অবগত আছি, বাংলাদেশের বর্তমান তথ্যমন্ত্রী পেশায় একজন সাংবাদিক ছিলেন এবং তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সম্মানিত সদস্য। এদের মতো ব্যক্তিদের নীতিহীনতার কারণেই এদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এত সহজে হরণ করা গেছে। আওয়ামী লীগ বাকস্বাধীনতায় যে বিশ্বাস করে না, সেটি তাদের ১৯৭৫, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং এবারের শাসনামলে ধারাবাহিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। অথচ দলটি ২০০৮ সালে দিনবদলের সনদ নামক নির্বাচনী ইশতেহারে গণমাধ্যমের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার গালভরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। অবশ্য এদেশে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকে অপরাধরূপে বিবেচনা করার সংস্কৃতি স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪০ বছর পরও দুর্ভাগ্যজনকভাবে গড়ে ওঠেনি। জনগণ ধরেই নেয় নির্বাচনপূর্ব প্রতিশ্রুতি ক্ষমতা লাভের পর ভাঙার জন্যই দেয়া হয়। অবশ্য অধিকার আদায় করে নেয়ার হিম্মত না থাকলে বলদর্পীদের হাতে নির্যাতিত হওয়ার জন্যে নালিশ করে কোনো ফায়দা নেই। দুর্বলের হাহুতাশই বিধিলিপি। তদুপরি বাংলাদেশের সংবাদকর্মীদের মধ্যে দলীয় বিভাজন প্রকট হওয়ায় তারা কোনো সরকারের আমলেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে সমর্থ হয় না। ফলে এদেশে ফ্যাসিবাদের উত্থান সহজতর হচ্ছে।
No comments