৩৬- বাস্তবতা হলো দুর্নীতি করলেই বরং ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে লেনদেনের মাধ্যমে নিরাপদে থাকা যায়
নীতির প্রশ্নে আপস করা যায় না—
...কাল থেকে এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ের এক মাস অতিরিক্ত সাজা আরম্ভ হবে। জেল সুপার আমার খোঁজখবর নিতে এসে বলেই ফেললেন, জরিমানার টাকাটা দিয়ে দিলেই তো পারতেন। জবাবে বললাম, এখানে বিষয়টা টাকার নয়, নীতির লড়াইয়ে কোনো আপস করা যায় না। গত বছর আগস্ট মাসে আমার সাজা ঘোষণার পরপরই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চাঁদা তুলে জরিমানার এক লাখ টাকা দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। অসীম কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তাদেরও তখন নিবৃত্ত করেছিলাম।...
...কাল থেকে এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ের এক মাস অতিরিক্ত সাজা আরম্ভ হবে। জেল সুপার আমার খোঁজখবর নিতে এসে বলেই ফেললেন, জরিমানার টাকাটা দিয়ে দিলেই তো পারতেন। জবাবে বললাম, এখানে বিষয়টা টাকার নয়, নীতির লড়াইয়ে কোনো আপস করা যায় না। গত বছর আগস্ট মাসে আমার সাজা ঘোষণার পরপরই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চাঁদা তুলে জরিমানার এক লাখ টাকা দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। অসীম কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তাদেরও তখন নিবৃত্ত করেছিলাম।...
আর্টিসান সিরামিকের হস্তান্তর আজ সম্পন্ন হলো। জেলে বসেই চুক্তিপত্র এবং শেয়ার হস্তান্তরের সব কাগজপত্রে সই করে দিলাম। এই সিরামিক কারখানা প্রতিষ্ঠার পর আশা ছিল, পোরসেলিন দিয়ে শুরু করলেও এরপর বোন-চায়নার উচ্চমানের তৈজসপত্রও এখানে তৈরি হবে। কারখানা প্রতিষ্ঠার প্রথম বছরেই প্রায় ২৫ কোটি টাকার পণ্য ইউরোপ, আমেরিকায় রফতানি করে যথেষ্ট উত্সাহও পেয়েছিলাম। বর্তমান সরকারের অব্যাহত চরম বৈরী আচরণে কোম্পানি ধরে রাখা আর সমীচীন বোধ করলাম না। জেল থেকে কবে মুক্তি পাব, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
পারভীনের একার পক্ষে এত বোঝা বহন করা সম্ভব নয়। প্রতিষ্ঠানটির প্রায় সাতশ’ সহকর্মীর সঙ্গে আবার কবে দেখা হবে জানি না। এই হলো তথাকথিত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে একজন নাগরিকের সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের প্রকৃত চিত্র। এই দেশে আমার মতো ভিন্ন মতাবলম্বী পেশাজীবীর ব্যবসা-বাণিজ্য করে সংসার চালানোর স্বাধীনতাও নেই। তবে কোম্পানিটা বিক্রি করে দেয়ায় আমাদের বেশকিছু নগদ অর্থের সংস্থান হয়েছে। মাথার ওপর থেকে ঋণের বোঝাও চলে গেছে। এখন আমি কারাগারে বন্দি থাকলেও মা এবং পারভীনকে অন্তত অর্থকষ্টে পড়তে হবে না। আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায়ের জন্য দুই রাকাত নফল নামাজ পড়লাম।
আমার ৩৪ বছরের দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশের সার্বিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবস্থা নিয়ে কিছু অপ্রিয় মন্তব্য করলে আশা করি, পাঠক নিজ গুণে ক্ষমা করে দেবেন। দীর্ঘদিন ধরে একটা প্রশ্নের জবাব কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না। রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে তীব্রভাবে বিভক্ত এই দেশে আমরা কি প্রকৃতই সততার কোনো মূল্যায়ন করি? নাকি বিবেচনাটা এরকম যে আমার দলের লোক চূড়ান্ত অসত্ হলেও গ্রহণযোগ্য, আর বিরোধী মতের লোক সত্ হলেও তাকে কোনো অবস্থাতেই সহ্য করা হবে না। বর্তমান সরকারের সর্বব্যাপী দলীয়করণের রাষ্ট্রবিনাশী নীতি বিচার বিভাগকে সর্বাপেক্ষা কলুষিত করেছে। প্রধান বিচারপতির এজলাস ভাংচুরের নেতৃত্বদানকারী ‘বীর পুরুষকে’ হাইকোর্টের বিচারকের আসনে বসিয়ে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। খুনের মামলার আসামিরাও আজকাল সেসব আসনে বসছেন।
উচ্চ আদালতের বিশেষ বিচারকদের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে মইন জামানায় নিম্ন আদালতে দুর্নীতির মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত সরকারি রথী-মহারথীরা একের পর এক খালাস পাচ্ছেন। মহাজোটের আন্দোলনের ফসল জরুরি সরকারের আমলে নিম্ন আদালতকে যে ‘ক্যাঙ্গারু কোর্টে’ পরিণত করা হয়েছিল, এ নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। সে সব আদালতের ফরমায়েশি রায় ছুঁড়ে ফেলা উচিত এটাও ঠিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই নীতি কেবল আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীদের বেলায় সীমাবদ্ধ রাখা হবে কেন? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে উচ্চ আদালতে প্রায় ডজনখানেক মামলায় ‘সুবিচার’ প্রাপ্ত হয়ে মামলার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন, সেই একই আদালতে বেগম খালেদা জিয়ার জন্য সুবিচারের দরজা বন্ধ থাকবে কোন যুক্তিতে? বাংলাদেশের জনগণ’ই বা আর কতদিন বিনা প্রতিবাদে এসব অবিচার সহ্য করে যাবে?
এবার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে আসি। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের পাঁচ বছরে সর্বতোভাবে রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থ রক্ষা করে গেছি। আকস্মিকভাবে প্রাপ্ত সরকারি পদকে ক্ষমতা নয়, আমানত হিসেবে বিবেচনা করেছি। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে মানুষ হিসেবে ভুল-ভ্রান্তি হতে পারে। কিন্তু, সেই ভুল হয়ে থাকলে তার পেছনে ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার কোনোরূপ ভূমিকা কখনও ছিল না, এই দাবি আরাফাতের ময়দানে দাঁড়িয়েও করবার নৈতিক বল রাখি। সরকারের পাঁচ বছরে ফল হবে না জেনে কোনো তদবিরকারক ভুলেও আমার দফতরে পা রাখেনি। তত্কালীন প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রীর মধ্যে কেউ বলতে পারবেন না কখনও কোনো ব্যক্তিগত কাজ নিয়ে তাদের কাছে গেছি। ঢাকা শহরে একটি অ্যাপার্টমেন্ট ছাড়া আমার কোথাও কোনো স্থাবর সম্পত্তি নেই। মা সারাজীবন শিক্ষকতা করে তিতুমীর সরকারি কলেজ থেকে সহযোগী অধ্যাপক হয়ে অবসর নিয়েছেন। তারও ঢাকা শহরে কখনও কোনো সম্পত্তি ছিল না।
১৯৯৭ সালে আমি যখন বেক্সিমকোতে চাকরি করি সেই সময় কেনা সাভারের জমিতে মার একটা বাড়ি ছিল যেটা অর্থের প্রয়োজনে আমার গ্রেফতারের আগেই বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলাম। বাংলাদেশের কত রথী-মহারথী, সুশীল (?), সম্পাদক, সাংবাদিক, মন্ত্রী, সরকারি কর্মকর্তা বিভিন্ন সরকারের আমলে রাজউকের প্লট, বাড়ি ইত্যাদি হাসিল করেছেন। আল্লাহ্র অসীম অনুগ্রহে এ ধরনের কোনো আকাঙ্ক্ষা মনে কখনও ঠাঁই পায়নি। তাতে আমার জেলে আসা কিন্তু আটকে থাকেনি। মহাজোট তাদের দিনবদলের সনদ নামক নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ক্ষমতা গ্রহণের আগে এবং তারপর প্রতি বছর সব মন্ত্রী, এমপি’র সম্পদের হিসাব জনগণকে জানানো হবে। সরকার তৃতীয় বছরে পদার্পণ করলেও সেই প্রতিশ্রুতি অদ্যাবধি পালিত হয়নি। অথচ ‘স্বাধীন’ দুদক আমাকে শুধু সম্পদের নোটিশই পাঠায়নি, সেই নোটিশ উচ্চ আদালতে স্থগিত এবং আমি কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থাতেও সম্পদের হিসাব না দেয়ার মামলাও দায়ের করেছে। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে দুর্নীতি করলেই বরং ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে লেনদেনের মাধ্যমে নিরাপদে থাকা যায়। এই দেশে বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সততার পুরস্কার জেল-জুলুম ছাড়া অন্যকিছু প্রত্যাশা করাটাই বোকামি।
সরকারের দ্বিমুখী আচরণ দেখার পর এবার সামাজিক প্রেক্ষাপট খানিকটা বিবেচনা করা যাক। আমার দেশ পত্রিকা এবং ব্যক্তিগতভাবে আমার ওপর সরকার যে জুলুম, নির্যাতন চালিয়েছে দেশে তার প্রতিবাদ হয়নি বললে মিথ্যাচার করা হবে। সাংবাদিক, পেশাজীবী, রাজনৈতিক কর্মী, সাধারণ জনগণ বিগত প্রায় নয় মাস ধরে আমার মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধন, গোলটেবিল করে চলেছেন। আমি বিএনপি’র নেতা বা কর্মী না হওয়া সত্ত্বেও বেগম খালেদা জিয়া তার কোনো কোনো সহকর্মীর বাধা উপেক্ষা করে পুলিশ হেফাজতে আমার নির্যাতনের প্রতিবাদে নিজে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। এই সমর্থন অমূল্য। প্রত্যেকের কাছে আমি অপরিশোধ্য ঋণে আবদ্ধ। কিন্তু তথাকথিত সুশীল (?) সমাজ, বুদ্ধিজীবী শ্রেণী, সম্পাদককমণ্ডলী কি দলীয় বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্রযন্ত্রের ফ্যাসিবাদী আচরণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ জানাতে পেরেছেন? আমি একটি জাতীয় দৈনিকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হওয়া সত্ত্বেও দেশের অধিকাংশ সম্পাদক রাজনৈতিক মতভিন্নতার কারণে শুধু চুপই থাকেননি, তাদের মধ্যে কেউ কেউ এই নির্যাতনকে প্রকাশ্যে সমর্থনও জানিয়েছেন।
এই রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতা অতিক্রম না করতে পারলে কেবল সভা, সেমিনারে সত্ নেতৃত্বের জন্য হাপিত্যেশ করলে দেশের নেতৃত্বে কোনোদিনই পরিবর্তন সাধিত হবে না। পবিত্র কোরআন শরীফের একাধিক আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা নেতৃত্বে পরিবর্তন আনয়নের জন্য বিশ্বাসীদের জন্য পথ নির্দেশ করেছেন। সেই পবিত্র গ্রন্থ থেকে পাঁচটি আয়াত উদ্ধৃত করছি;
সূরা আল বাক্কারাহ্ : (৪২) তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে দিও না এবং জানা সত্ত্বেও সত্যকে তোমরা গোপন করো না।
(৪৪) তোমরা কি মানুষকে সত্ কর্মের নির্দেশ দাও এবং নিজেরা নিজেদেরকে ভুলে যাও, অথচ তোমরা কিতাব পাঠ কর? তবুও কি তোমরা চিন্তা করো না?
সূরা আন-নিসাঃ (১৩৮) সে সব মোনাফেককে সুসংবাদ শুনিয়ে দিন যে, তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে বেদনাদায়ক আযাব।
সূরা রাদ ঃ (১১) আল্লাহ্ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।
সূরা আশ-শুরা ঃ (৪২) অভিযোগ কেবল তাদের বিরুদ্ধে, যারা মানুষের উপর অত্যাচার চালায় এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ করে বেড়ায়। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও যারা অপরিসীম ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করে আল্লাহ্র রজ্জু ধরে থেকে সততার পথে অবিচল থাকেন, তাদেরকে কোনোভাবে নিরুত্সাহিত করা আমার উদ্দেশ্য নয়। এই মহত্ ব্যক্তিদের শুদ্ধ জীবন কোনোদিনই ব্যর্থ হবে না। সৃষ্টিকর্তা সূরা আর রাহমানের ৬০ নম্বর আয়াতে এই শ্রেণীর মুমিনদের উদ্দেশ্য করেই বলেছেন, ‘সত্ কাজের প্রতিদান উত্তম পুরস্কার ব্যতীত কী হতে পারে?’ এই মানুষেরা দুনিয়াতে অবশিষ্ট আছেন বলেই সম্ভবত আল্লাহ্ এখনও জগতের ওপর তার অপার রহমত বর্ষণ করে চলেছেন। কিন্তু সত্কর্মের বিনিময়ে রাষ্ট্রযন্ত্র ও জাতির কাছ থেকে কোনো প্রতিদানের প্রত্যাশা না করাটাই উত্তম। তাতে আশা ভঙ্গের বেদনা অন্তত কম সইতে হবে।
আজ ১৮ ফেব্রুয়ারি; ছয় মাসের সাজার মেয়াদ শেষ হলো। কাল থেকে এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ের এক মাস অতিরিক্ত সাজা আরম্ভ হবে। জেল সুপার আমার খোঁজ-খবর নিতে এসে বলেই ফেললেন, জরিমানার টাকাটা দিয়ে দিলেই তো পারতেন। জবাবে বললাম, এখানে বিষয়টা টাকার নয়, নীতির লড়াইয়ে কোনো আপস করা যায় না। গত বছর আগস্ট মাসে আমার সাজা ঘোষণার পরপরই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চাঁদা তুলে জরিমানার এক লাখ টাকা দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। অসীম কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তাদেরও তখন নিবৃত্ত করেছিলাম। গাজীপুর জেলের এক মাসের কারাবাসে জেল সুপারকে দু’তিনবারের দেখাতে আমার কাছে সজ্জন ব্যক্তি বলেই মনে হয়েছে। তিনি ঘুণেধরা সিস্টেমের বিরুদ্ধে আমার এই লড়াইয়ের মর্ম বুঝলেন কিনা, জানি না। হয়তো আমাকে খানিকটা খ্যাপাটেই মনে করলেন। একবার ভাবলাম লেবাননের বিখ্যাত কবি, দার্শনিক, চিত্রশিল্পী কাহলীল জিবরান থেকে তাকে একটা উদ্ধৃতি শোনাই। কাহলীল জিবরান লিখেছেন, ‘একজন অত্যাচারী শাসক কীভাবে শাসন করতে পারে স্বাধীন ও গর্বিতদের, যদি তাদের নিজস্ব স্বাধীনতার ভেতরে নিপীড়ন এবং নিজস্ব গর্বের ভেতরে লজ্জা না থাকে।’ পণ্ডশ্রম হবে মনে করে চুপ থেকে কেবল মৃদু হাসলাম।
জেল সুপার বিদায় নেয়ার আগে আমাকে বিভিন্ন জেলার আদালত থেকে হাজিরার আদেশগুলো (চড) প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিলেন। ওগুলো প্রত্যাহার না করালে সুপ্রিমকোর্টের দণ্ড শেষ হলেও নির্ধারিত তারিখে মুক্তি মিলবে না। এই সরকারের আমলে আমার মুক্তি মিলবে, এটা কেন যেন একেবারেই বিশ্বাস হতে চায় না। অবশ্য মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী কেন জানি না আমার মুক্তির ব্যাপারে অত্যন্ত আশাবাদী। তাহাজ্জতের নামাজ পড়ার সময় সাঈদী ভাই নিয়মিত আমার মুক্তির জন্য দোয়া করে চলেছেন। আর এক কথা। আমার সাজার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের দেখা কিন্তু এখনও মেলে নি। আজ সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এই রায় পাওয়া একেবারেই অর্থহীন। মনে প্রশ্ন জাগে, লর্ডশিপরা রায় লিখলেন না কেন? যাতে আমি রিভিউ করার সুযোগ না পাই, নাকি বিবেক তাদের বাধা দিচ্ছে? প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের তত্ত্ব অনুযায়ী ... বিচারপতিদের হৃদয়ে ওই বস্তুটির অস্তিত্ব থাকলে হতভাগা জাতির এখনও তাহলে আশা আছে।
পারভীনের একার পক্ষে এত বোঝা বহন করা সম্ভব নয়। প্রতিষ্ঠানটির প্রায় সাতশ’ সহকর্মীর সঙ্গে আবার কবে দেখা হবে জানি না। এই হলো তথাকথিত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে একজন নাগরিকের সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের প্রকৃত চিত্র। এই দেশে আমার মতো ভিন্ন মতাবলম্বী পেশাজীবীর ব্যবসা-বাণিজ্য করে সংসার চালানোর স্বাধীনতাও নেই। তবে কোম্পানিটা বিক্রি করে দেয়ায় আমাদের বেশকিছু নগদ অর্থের সংস্থান হয়েছে। মাথার ওপর থেকে ঋণের বোঝাও চলে গেছে। এখন আমি কারাগারে বন্দি থাকলেও মা এবং পারভীনকে অন্তত অর্থকষ্টে পড়তে হবে না। আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায়ের জন্য দুই রাকাত নফল নামাজ পড়লাম।
আমার ৩৪ বছরের দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশের সার্বিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবস্থা নিয়ে কিছু অপ্রিয় মন্তব্য করলে আশা করি, পাঠক নিজ গুণে ক্ষমা করে দেবেন। দীর্ঘদিন ধরে একটা প্রশ্নের জবাব কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না। রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে তীব্রভাবে বিভক্ত এই দেশে আমরা কি প্রকৃতই সততার কোনো মূল্যায়ন করি? নাকি বিবেচনাটা এরকম যে আমার দলের লোক চূড়ান্ত অসত্ হলেও গ্রহণযোগ্য, আর বিরোধী মতের লোক সত্ হলেও তাকে কোনো অবস্থাতেই সহ্য করা হবে না। বর্তমান সরকারের সর্বব্যাপী দলীয়করণের রাষ্ট্রবিনাশী নীতি বিচার বিভাগকে সর্বাপেক্ষা কলুষিত করেছে। প্রধান বিচারপতির এজলাস ভাংচুরের নেতৃত্বদানকারী ‘বীর পুরুষকে’ হাইকোর্টের বিচারকের আসনে বসিয়ে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। খুনের মামলার আসামিরাও আজকাল সেসব আসনে বসছেন।
উচ্চ আদালতের বিশেষ বিচারকদের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে মইন জামানায় নিম্ন আদালতে দুর্নীতির মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত সরকারি রথী-মহারথীরা একের পর এক খালাস পাচ্ছেন। মহাজোটের আন্দোলনের ফসল জরুরি সরকারের আমলে নিম্ন আদালতকে যে ‘ক্যাঙ্গারু কোর্টে’ পরিণত করা হয়েছিল, এ নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। সে সব আদালতের ফরমায়েশি রায় ছুঁড়ে ফেলা উচিত এটাও ঠিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই নীতি কেবল আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীদের বেলায় সীমাবদ্ধ রাখা হবে কেন? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে উচ্চ আদালতে প্রায় ডজনখানেক মামলায় ‘সুবিচার’ প্রাপ্ত হয়ে মামলার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন, সেই একই আদালতে বেগম খালেদা জিয়ার জন্য সুবিচারের দরজা বন্ধ থাকবে কোন যুক্তিতে? বাংলাদেশের জনগণ’ই বা আর কতদিন বিনা প্রতিবাদে এসব অবিচার সহ্য করে যাবে?
এবার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে আসি। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের পাঁচ বছরে সর্বতোভাবে রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থ রক্ষা করে গেছি। আকস্মিকভাবে প্রাপ্ত সরকারি পদকে ক্ষমতা নয়, আমানত হিসেবে বিবেচনা করেছি। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে মানুষ হিসেবে ভুল-ভ্রান্তি হতে পারে। কিন্তু, সেই ভুল হয়ে থাকলে তার পেছনে ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার কোনোরূপ ভূমিকা কখনও ছিল না, এই দাবি আরাফাতের ময়দানে দাঁড়িয়েও করবার নৈতিক বল রাখি। সরকারের পাঁচ বছরে ফল হবে না জেনে কোনো তদবিরকারক ভুলেও আমার দফতরে পা রাখেনি। তত্কালীন প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রীর মধ্যে কেউ বলতে পারবেন না কখনও কোনো ব্যক্তিগত কাজ নিয়ে তাদের কাছে গেছি। ঢাকা শহরে একটি অ্যাপার্টমেন্ট ছাড়া আমার কোথাও কোনো স্থাবর সম্পত্তি নেই। মা সারাজীবন শিক্ষকতা করে তিতুমীর সরকারি কলেজ থেকে সহযোগী অধ্যাপক হয়ে অবসর নিয়েছেন। তারও ঢাকা শহরে কখনও কোনো সম্পত্তি ছিল না।
১৯৯৭ সালে আমি যখন বেক্সিমকোতে চাকরি করি সেই সময় কেনা সাভারের জমিতে মার একটা বাড়ি ছিল যেটা অর্থের প্রয়োজনে আমার গ্রেফতারের আগেই বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলাম। বাংলাদেশের কত রথী-মহারথী, সুশীল (?), সম্পাদক, সাংবাদিক, মন্ত্রী, সরকারি কর্মকর্তা বিভিন্ন সরকারের আমলে রাজউকের প্লট, বাড়ি ইত্যাদি হাসিল করেছেন। আল্লাহ্র অসীম অনুগ্রহে এ ধরনের কোনো আকাঙ্ক্ষা মনে কখনও ঠাঁই পায়নি। তাতে আমার জেলে আসা কিন্তু আটকে থাকেনি। মহাজোট তাদের দিনবদলের সনদ নামক নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ক্ষমতা গ্রহণের আগে এবং তারপর প্রতি বছর সব মন্ত্রী, এমপি’র সম্পদের হিসাব জনগণকে জানানো হবে। সরকার তৃতীয় বছরে পদার্পণ করলেও সেই প্রতিশ্রুতি অদ্যাবধি পালিত হয়নি। অথচ ‘স্বাধীন’ দুদক আমাকে শুধু সম্পদের নোটিশই পাঠায়নি, সেই নোটিশ উচ্চ আদালতে স্থগিত এবং আমি কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থাতেও সম্পদের হিসাব না দেয়ার মামলাও দায়ের করেছে। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে দুর্নীতি করলেই বরং ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে লেনদেনের মাধ্যমে নিরাপদে থাকা যায়। এই দেশে বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সততার পুরস্কার জেল-জুলুম ছাড়া অন্যকিছু প্রত্যাশা করাটাই বোকামি।
সরকারের দ্বিমুখী আচরণ দেখার পর এবার সামাজিক প্রেক্ষাপট খানিকটা বিবেচনা করা যাক। আমার দেশ পত্রিকা এবং ব্যক্তিগতভাবে আমার ওপর সরকার যে জুলুম, নির্যাতন চালিয়েছে দেশে তার প্রতিবাদ হয়নি বললে মিথ্যাচার করা হবে। সাংবাদিক, পেশাজীবী, রাজনৈতিক কর্মী, সাধারণ জনগণ বিগত প্রায় নয় মাস ধরে আমার মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধন, গোলটেবিল করে চলেছেন। আমি বিএনপি’র নেতা বা কর্মী না হওয়া সত্ত্বেও বেগম খালেদা জিয়া তার কোনো কোনো সহকর্মীর বাধা উপেক্ষা করে পুলিশ হেফাজতে আমার নির্যাতনের প্রতিবাদে নিজে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। এই সমর্থন অমূল্য। প্রত্যেকের কাছে আমি অপরিশোধ্য ঋণে আবদ্ধ। কিন্তু তথাকথিত সুশীল (?) সমাজ, বুদ্ধিজীবী শ্রেণী, সম্পাদককমণ্ডলী কি দলীয় বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্রযন্ত্রের ফ্যাসিবাদী আচরণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ জানাতে পেরেছেন? আমি একটি জাতীয় দৈনিকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হওয়া সত্ত্বেও দেশের অধিকাংশ সম্পাদক রাজনৈতিক মতভিন্নতার কারণে শুধু চুপই থাকেননি, তাদের মধ্যে কেউ কেউ এই নির্যাতনকে প্রকাশ্যে সমর্থনও জানিয়েছেন।
এই রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতা অতিক্রম না করতে পারলে কেবল সভা, সেমিনারে সত্ নেতৃত্বের জন্য হাপিত্যেশ করলে দেশের নেতৃত্বে কোনোদিনই পরিবর্তন সাধিত হবে না। পবিত্র কোরআন শরীফের একাধিক আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা নেতৃত্বে পরিবর্তন আনয়নের জন্য বিশ্বাসীদের জন্য পথ নির্দেশ করেছেন। সেই পবিত্র গ্রন্থ থেকে পাঁচটি আয়াত উদ্ধৃত করছি;
সূরা আল বাক্কারাহ্ : (৪২) তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে দিও না এবং জানা সত্ত্বেও সত্যকে তোমরা গোপন করো না।
(৪৪) তোমরা কি মানুষকে সত্ কর্মের নির্দেশ দাও এবং নিজেরা নিজেদেরকে ভুলে যাও, অথচ তোমরা কিতাব পাঠ কর? তবুও কি তোমরা চিন্তা করো না?
সূরা আন-নিসাঃ (১৩৮) সে সব মোনাফেককে সুসংবাদ শুনিয়ে দিন যে, তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে বেদনাদায়ক আযাব।
সূরা রাদ ঃ (১১) আল্লাহ্ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।
সূরা আশ-শুরা ঃ (৪২) অভিযোগ কেবল তাদের বিরুদ্ধে, যারা মানুষের উপর অত্যাচার চালায় এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ করে বেড়ায়। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও যারা অপরিসীম ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করে আল্লাহ্র রজ্জু ধরে থেকে সততার পথে অবিচল থাকেন, তাদেরকে কোনোভাবে নিরুত্সাহিত করা আমার উদ্দেশ্য নয়। এই মহত্ ব্যক্তিদের শুদ্ধ জীবন কোনোদিনই ব্যর্থ হবে না। সৃষ্টিকর্তা সূরা আর রাহমানের ৬০ নম্বর আয়াতে এই শ্রেণীর মুমিনদের উদ্দেশ্য করেই বলেছেন, ‘সত্ কাজের প্রতিদান উত্তম পুরস্কার ব্যতীত কী হতে পারে?’ এই মানুষেরা দুনিয়াতে অবশিষ্ট আছেন বলেই সম্ভবত আল্লাহ্ এখনও জগতের ওপর তার অপার রহমত বর্ষণ করে চলেছেন। কিন্তু সত্কর্মের বিনিময়ে রাষ্ট্রযন্ত্র ও জাতির কাছ থেকে কোনো প্রতিদানের প্রত্যাশা না করাটাই উত্তম। তাতে আশা ভঙ্গের বেদনা অন্তত কম সইতে হবে।
আজ ১৮ ফেব্রুয়ারি; ছয় মাসের সাজার মেয়াদ শেষ হলো। কাল থেকে এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ের এক মাস অতিরিক্ত সাজা আরম্ভ হবে। জেল সুপার আমার খোঁজ-খবর নিতে এসে বলেই ফেললেন, জরিমানার টাকাটা দিয়ে দিলেই তো পারতেন। জবাবে বললাম, এখানে বিষয়টা টাকার নয়, নীতির লড়াইয়ে কোনো আপস করা যায় না। গত বছর আগস্ট মাসে আমার সাজা ঘোষণার পরপরই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চাঁদা তুলে জরিমানার এক লাখ টাকা দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। অসীম কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তাদেরও তখন নিবৃত্ত করেছিলাম। গাজীপুর জেলের এক মাসের কারাবাসে জেল সুপারকে দু’তিনবারের দেখাতে আমার কাছে সজ্জন ব্যক্তি বলেই মনে হয়েছে। তিনি ঘুণেধরা সিস্টেমের বিরুদ্ধে আমার এই লড়াইয়ের মর্ম বুঝলেন কিনা, জানি না। হয়তো আমাকে খানিকটা খ্যাপাটেই মনে করলেন। একবার ভাবলাম লেবাননের বিখ্যাত কবি, দার্শনিক, চিত্রশিল্পী কাহলীল জিবরান থেকে তাকে একটা উদ্ধৃতি শোনাই। কাহলীল জিবরান লিখেছেন, ‘একজন অত্যাচারী শাসক কীভাবে শাসন করতে পারে স্বাধীন ও গর্বিতদের, যদি তাদের নিজস্ব স্বাধীনতার ভেতরে নিপীড়ন এবং নিজস্ব গর্বের ভেতরে লজ্জা না থাকে।’ পণ্ডশ্রম হবে মনে করে চুপ থেকে কেবল মৃদু হাসলাম।
জেল সুপার বিদায় নেয়ার আগে আমাকে বিভিন্ন জেলার আদালত থেকে হাজিরার আদেশগুলো (চড) প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিলেন। ওগুলো প্রত্যাহার না করালে সুপ্রিমকোর্টের দণ্ড শেষ হলেও নির্ধারিত তারিখে মুক্তি মিলবে না। এই সরকারের আমলে আমার মুক্তি মিলবে, এটা কেন যেন একেবারেই বিশ্বাস হতে চায় না। অবশ্য মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী কেন জানি না আমার মুক্তির ব্যাপারে অত্যন্ত আশাবাদী। তাহাজ্জতের নামাজ পড়ার সময় সাঈদী ভাই নিয়মিত আমার মুক্তির জন্য দোয়া করে চলেছেন। আর এক কথা। আমার সাজার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের দেখা কিন্তু এখনও মেলে নি। আজ সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এই রায় পাওয়া একেবারেই অর্থহীন। মনে প্রশ্ন জাগে, লর্ডশিপরা রায় লিখলেন না কেন? যাতে আমি রিভিউ করার সুযোগ না পাই, নাকি বিবেক তাদের বাধা দিচ্ছে? প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের তত্ত্ব অনুযায়ী ... বিচারপতিদের হৃদয়ে ওই বস্তুটির অস্তিত্ব থাকলে হতভাগা জাতির এখনও তাহলে আশা আছে।
No comments