১৯- এখন থেকে প্রতি বছর জুনে একটি নয় দু’টি করে কালো দিবস পালিত হবে

মার দেশ বন্ধ রাখতে পারবেন না
আজ ১৮ জুলাই। সকাল থেকে বড় উদ্বেগের মধ্যে আছি। সময় আর কাটতে চাচ্ছে না। জুনের পয়লা দিন সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে, ফ্যাসিবাদী কায়দায় সরকার আমার দেশ বন্ধ করার পর উচ্চ আদালতে যে আইনি লড়াই আমার সহকর্মীরা চালিয়ে যাচ্ছেন, তার একটি পর্যায়ের চূড়ান্ত পরিণতি আজ ঘটতে চলেছে। দুপুর একটায় ছয় নম্বর সেলের বন্দি সোহেল রীতিমত লাফাতে লাফাতে এসে জানালো, আমার দেশ প্রকাশে আর কোনো বাধা নেই ...

আজ ১৮ জুলাই। সকাল থেকে বড় উদ্বেগের মধ্যে আছি। সময় আর কাটতে চাচ্ছে না। জুনের পয়লা দিন সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে, ফ্যাসিবাদী কায়দায় সরকার আমার দেশ বন্ধ করার পর উচ্চ আদালতে যে আইনি লড়াই আমার সহকর্মীরা চালিয়ে যাচ্ছেন, তার একটি পর্যায়ের চূড়ান্ত পরিণতি আজ ঘটতে চলেছে। ঢাকার জেলা প্রশাসকের আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করা হলে বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার নেতৃত্বে দ্বৈত বেঞ্চ সেই আদেশকে স্থগিত ঘোষণা করে সরকারের বিরুদ্ধে রুল জারি করেন। হাইকোর্টের নির্দেশপ্রাপ্তির পর তিন-চারদিন পত্রিকা পুনঃপ্রকাশও হয়েছিল। আমি তখন রিমান্ডে নির্যাতিত হচ্ছি। সে সময় পত্রিকা পুনঃপ্রকাশের সংবাদ পেয়ে রিমান্ডের যাতনাও ভুলে গিয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত হাইকোর্টের সেই আদেশ চেম্বার জজ বিচারপতি এস কে সিনহা চার সপ্তাহের জন্যে স্থগিত করলে পত্রিকাটির প্রকাশনা আবারও বন্ধ হয়ে যায়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আওয়ামী লীগ সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। ১৯৭৫ সালে চারটি মাত্র পত্রিকা রেখে দেশের সব প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়ে হাজার হাজার সাংবাদিককে বেকারত্বের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছিল। ১৬ জুন তাই আজও এদেশে সংবাদমাধ্যমের কালো দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে কন্যাও সেই জুন মাসেরই ১ তারিখে আরেকটি কলঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টি করে ইতিহাসে নিজের নাম অক্ষয় করলেন।
এখন থেকে প্রতি বছর জুন মাসে একটি নয়, দু’টি করে কালো দিন পালিত হবে। সেই জুন মাসেই আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত সরকারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে একটি পত্রিকাকে দ্বিতীয়বার বন্ধের মাধ্যমে এদেশে বাকস্বাধীনতাকেই হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছেন। চেম্বার জজ আদালতের এই সিদ্ধান্তকেও ইতিহাস তার মতো করেই মূল্যায়ন করবে। যা-ই হোক, আজ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ কেবল আমার দেশ-এর ভাগ্যই নির্ধারণ করতে যাচ্ছেন না, তারা বাংলাদেশে মুক্ত সাংবাদিকতার ভাগ্যও নির্ধারণ করবেন। যে দেশে চিন্তা, বিবেক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকে না, সেদেশে গণতন্ত্র যে তামাশায় পরিণত হয় এই সত্যটি আশা করি, দেশের সব বিবেকবান নাগরিক স্বীকার করবেন। সেই নাগরিক আওয়ামী লীগের মতো জন্মাবধি ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দলের সমর্থক হলেও। আমাদের সংবিধানের ৩৯ নম্বর ধারায় চিন্তা, বিবেক, বাক্ ও ভাব প্রকাশ এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার যে নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে, আমার দেশ পত্রিকার ওপর সরকারের আক্রোশের আলোকে তারও কী ব্যাখ্যা দেশের সর্বোচ্চ আদালত দিতে যাচ্ছেন, সেটিও জানার জন্যে দেশবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।
দুপুর একটায় ছয় নম্বর সেলের বন্দি সোহেল রীতিমত লাফাতে লাফাতে এসে জানালো, আপিল বিভাগ চেম্বার জজ আদালতের স্থগিতাদেশ বাতিল করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখেছেন, আমার দেশ প্রকাশে আর কোনো বাধা নেই। সোহেলের সর্বাঙ্গ ভেজা, মাথায়, মুখে সাবানের ফেনা। গোসলের মাঝখান থেকে উঠে এসেছে সে। চোখে পানি নিয়ে ছেলেমানুষের মতো আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম। ওর গায়ের সাবান আমার পরনের কাপড়কে মাখামাখি করে ফেলেছে। সেদিকে আমার ভ্রূক্ষেপ নেই। মনে পড়ে গেল, রিমান্ড চলাকালীন এক বড়কর্তাকে বড় গলায় বলেছিলাম, আপনার প্রধানমন্ত্রী আমাকে নির্যাতন করতে পারেন, হয়তো হত্যাও করতে পারবেন। কিন্তু আমার দেশ আর বেশিদিন বন্ধ করে রাখতে পারবেন না। মহান আল্লাহতায়ালা আমার সেই আশাবাদকে আজ সত্যে পরিণত করেছেন। বাংলাদেশের বিচার বিভাগ নিয়ে অনেক হতাশার মধ্যেও এই রায় নিভু নিভু করে হলেও ইনসাফপ্রাপ্তির আশার প্রদীপটিকে জ্বালিয়ে রাখতে সহায়তা করবে। সন্ধ্যেবেলা রেডিওতে আমার দেশ নিয়ে ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের চমত্কার মন্তব্য শুনলাম। তিনি বললেন, এই জয় প্রতিটি সংবাদপত্রের, ব্যক্তি মাহমুদুর রহমান এখানে উপলক্ষমাত্র।
আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে আদালতপাড়া থেকে আরও একটি সুসংবাদ পেলাম। আমার বিরুদ্ধে সরকার ইসলামী জঙ্গিবাদ এবং রাষ্ট্রদ্রোহের যে দু’টি আজগুবি মামলা দায়ের করেছিল, সেই উভয় মামলাতেই গত সপ্তাহে হাইকোর্ট থেকে জামিন লাভ করেছিলাম। সরকার যথারীতি সেই আদেশ স্থগিত করার আবেদন নিয়ে চেম্বার জজ আদালতে গেলে বিচারপতি এস কে সিনহা আমার হাইকোর্টের জামিন বহাল রেখেছেন। এই রায়ের ফলে অবশ্য আমি এখনই মুক্তি পাচ্ছি না। বিচারপতি এস কে সিনহার সর্বশেষ রায় প্রদানের আগে পুলিশের কর্তব্যকাজে বাধা দেয়ার তেজগাঁও থানার মামলায় আমার হাইকোর্টের জামিন তখনকার চেম্বার জজ বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন স্থগিত করে রেখেছেন। কাজেই আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত আমার মুক্তির কোনো সুযোগ নেই। যে মামলাটির জামিন বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন স্থগিত করেছেন, সেই মামলাটি নিয়ে আমার বিশেষ তিক্ততা ও স্পর্শকাতরতা রয়েছে। তেজগাঁও থানার ওই মামলার রিমান্ডে ক্যান্টনমেন্ট থানায় নিয়েই মামলার আইও রেজাউল করিম এবং অন্যান্য অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি আমাকে নির্যাতন করে হত্যার চেষ্টা করেছিল। আল্লাহর অসীম অনুগ্রহে আততায়ী দলটি তাদের কাজ সম্পন্ন না করেই সে রাতে ফিরে গিয়েছিল। এই পুরো ঘটনাটি আমি সিএমএম আদালতে বর্ণনা করেছিলাম। অথচ এই মামলাতেই আমার হাইকোর্ট থেকে প্রাপ্ত জামিন স্থগিত করেছেন চেম্বার জজ বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন। কার্যত পুলিশ হেফাজতে নির্যাতিত হওয়ার পর আমি এদেশের বিচারব্যবস্থার নির্যাতনের শিকার হয়েছি। কেবল তা-ই নয়, আমার বিবেচনায় ওই স্থগিতাদেশের মাধ্যমে উচ্চ আদালত দুর্ভাগ্যজনকভাবে রিমান্ডে নির্যাতনকে এক ধরনের বৈধতাও দিয়েছেন। বর্ণিত মামলায় আমার জামিনের আবেদন বর্তমানে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির অপেক্ষায় আছে। জানি না কবে মাননীয় বিচারপতিদের মামলা নিষ্পত্তির সময় হবে। তাদের সেই সময় না হওয়া পর্যন্ত সরকার কোনো আইনি জটিলতা ছাড়াই আমাকে অনির্দিষ্টকাল আটকে রাখতে পারছে। এর মধ্যে আদালত অবমাননা মামলায় সাজা দেয়ার একটা বাড়তি সুযোগও সরকারের হাতে থাকছে। সব মিলিয়ে অন্তত আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত আমার নিশ্চিত জেলজীবন।
আগেই উল্লেখ করেছি, আমার পাশের ছয় নম্বর সেল সরকারের তালিকাভুক্ত টপটেররদের আবাসস্থল। কয়েকদিন হলো সেখানে মহাজোট সরকার এবং সরকার সমর্থক মিডিয়ার বিবেচনায় দুই দুর্ধর্ষ টপটেররকে (!) নিয়ে আসা হয়েছে। এরা হলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর দুই অ্যাসিসট্যান্ট জেনারেল সেক্রেটারি মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং আবদুল কাদের মোল্লা। দু’জনার সঙ্গেই আমার সর্বপ্রথম সাক্ষাত্ ঘটেছিল ২০০১ সালে সরকারি দায়িত্ব গ্রহণের পর। তারপর বিগত প্রায় দশ বছরে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। পূর্বপরিচিত দুই রাজনীতিবিদ পাশের সেলে থাকলেও আমার সঙ্গে এখন পর্যন্ত দেখা-সাক্ষাতের কোনো সুযোগ হয়নি। আদালতে হাজিরা না থাকলে অথবা জেলগেটে কেউ দেখা করতে না এলে আমি সেল থেকে একেবারেই বার হই না। আর জামায়াতে ইসলামীর দুই নেতার বন্দিজীবনের যে কাহিনী শুনছি, তাতে তাদের পক্ষে সাত নম্বর সেলে এসে আমার সঙ্গে দেখা করার প্রশ্নই ওঠে না। উভয়কেই নাকি চব্বিশ ঘণ্টা তালাবন্ধ করে রাখা হচ্ছে। প্রত্যুষে এবং অপরাহেপ্ত মাত্র এক ঘণ্টা করে সময় দেয়া হচ্ছে গোসল এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক প্রাত্যহিক কাজ-কর্ম সম্পাদনের জন্য। পুরনো বন্দিদের কাছ থেকে জেনেছি, আমার সাত নম্বর সেল পার্শ্ববর্তী ছয় নম্বর সেলের তুলনায় অনেক উচ্চমানের। এই বর্ণনা থেকেই চোখে না দেখেও ছয় নম্বর সেলের অবস্থা বুঝতে পেরেছি। দু’জন বর্ষীয়ান রাজনীতিককে ওই ধরনের অন্ধকূপে সারাদিন তালাবন্ধ করে রাখা কারা-নির্যাতনের পর্যায়েই পড়ে। জেলের আইন অনুযায়ী চব্বিশ ঘণ্টা লক-আপ এক ভয়ানক শাস্তি। জেলে এসে যারা গুরুতর শৃঙ্খলাভঙ্গের মতো অপরাধ করে থাকে, সাধারণত তাদেরই এ ধরনের শাস্তি দেয়া হয়। অবশ্য মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামিকেও চব্বিশ ঘণ্টা লক-আপে রাখা হয়। যতদূর খবর পাচ্ছি, তাতে মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং আবদুল কাদের মোল্লাকে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে রাখাটাই কেবল বাকি আছে। সরকারের শীর্ষপর্যায়ের নির্দেশেই যে দুই নেতাকে বিশেষভাবে শায়েস্তা করা হচ্ছে, সেটা বুঝতে পারছি। জামায়াতে ইসলামীর বন্দি অপর তিন নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ এবং দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী যথাক্রমে সাবেক মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্য হওয়ায় ডিভিশন ওয়ার্ডে থাকার সুযোগ পেয়েছেন। ধারণা করছি, ডিভিশন সেলে অবস্থানের কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ তাদের চব্বিশ ঘণ্টা লক-আপে রাখতে পারছে না। জেলখানায় কানাঘুষা শুনছি মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং আবদুল কাদের মোল্লার ছেলে ও জামাইকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্রলীগ নেতা নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিবিরের ওপর নির্মম চিরুনি অভিযান পরিচালনার পর সরকার এখন মূল দল জামায়াতে ইসলামীর ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। গ্রেফতার হওয়ার আগেই আমার মনে হয়েছিল, ছাত্রশিবিরকে শায়েস্তা করে সরকার জামায়াতে ইসলামীর সাংগঠনিক শক্তি ও দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মাত্রা বুঝতে চেয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্যাতনের বিরুদ্ধে শিবির কোনো কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলে এবং বিদেশ থেকেও কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া না আসার পর জামায়াতে ইসলামীর ওপর আঘাত অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। মুক্ত অবস্থায় সরকার সমর্থক পত্রিকায় এমন আগাম খবরও পড়েছি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের কোনো কোনো দেশ দলটির নেতৃত্বে নতুন মুখ দেখতে আগ্রহী। পুরনো নেতৃত্বের ওপর সাম্প্রতিক সর্বাত্মক আঘাত সেই লক্ষ্য অর্জনেই পরিচালিত হচ্ছে কি-না, এ প্রশ্নের জবাব জানতে হলে আমাদের আরও কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে।
জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে লিখতে বসে এক-এগারো পরবর্তী সময়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। জেনারেল মইন গংয়ের ক্ষমতা দখলের আগপর্যন্ত আমি দেশের রাজনীতি নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামাইনি। চারদলীয় জোট সরকারের পুরো পাঁচটা বছর রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকলেও অর্থনীতি এবং জ্বালানির বাইরে পা ফেলার প্রয়োজন ছিল না। সেই পাঁচ বছরে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে একটিবারের জন্যও দেশের রাজনীতি অথবা তার দল নিয়ে কোনোরকম আলোচনা করেছি, এমন কথা স্মরণে আসছে না। বাংলাদেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার অংশ হিসেবে এদেশের সার্বভৌমত্ব যখন বিদেশিদের পদতলে অর্পণ করা হলো এবং দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলেন, সেই দুঃসময়ে একমাত্র কলমকে সম্বল করেই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিলাম। আমার আজকের কয়েদবাস সেই সংগ্রামেরই অবধারিত পরিণতি। রাজনীতির সঙ্গে যা কিছু সরাসরি যোগাযোগ, সে সময়েই স্থাপিত হয়েছে। যা-ই হোক, বিদেশি শক্তির কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া কয়েকজন উচ্চাভিলাষী সেনাপতির শাসনকালে জামায়াতে ইসলামী অজ্ঞাত কারণে এক ধরনের অতিরিক্ত ও অবাস্তব আত্মবিশ্বাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল বলেই আমার ধারণা। বিশেষ উদ্দেশ্যে সেই সময় ভারতীয় মিডিয়া এবং বাংলাদেশের ইসলামবিদ্বেষী সেক্যুলার মিডিয়া যৌথভাবে দলটির সঙ্গে মঈন গংয়ের আঁতাতের গল্প নিয়মিতভাবে প্রচার করতো। এই প্রচারণার পালে সামরিক গোয়েন্দা শাখার যে প্রভাবশালী কর্মকর্তা তখন বাতাস জোগাতেন, তার নাম মেজর জেনারেল (অব.) আমিন। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত পত্র-পত্রিকায় এই মেজর জেনারেল (অব.) আমিনের মরহুম চাচার জামায়াত কানেকশনকে উপলক্ষ করে তাকেও জামায়াতপন্থী হিসেবে প্রচার করা হতো। মজার ব্যাপার হলো, জনশ্রুতি রয়েছে এই জেনারেল আমিনই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বিশেষ কারাগারে বন্দি অবস্থায় তার সঙ্গে বর্তমান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর সঙ্গে নিয়মিত সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতেন। ড. গওহর রিজভী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তখন উড়ে এসেছিলেন নির্বাচনপূর্ব মার্কিন-ভারত-আওয়ামী লীগ ডিল সম্পন্ন করার মহত্ উদ্দেশ্য নিয়ে। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত বর্তমান পররাষ্ট্র উপদেষ্টার প্রকৃত নাগরিকত্ব নিয়েও জনমনে সন্দেহ রয়েছে। জেনারেল আমিনকে নিয়ে আরও গল্প আছে।
২০০৮ সালে বাংলাদেশের তত্কালীন খর্বাকৃতি লৌহমানব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছিলেন। তার সফরের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী ছিল, সেটা আমার মতো আমজনতার জানার কথা নয়। তবে সে সময় প্রচার করা হয়েছিল তিনি নাকি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেয়ার আমন্ত্রণ রক্ষা করতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছিলেন। হার্ভার্ডে তার সেই জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতার শ্রোতা কারা ছিলেন, এ নিয়ে যথেষ্ট জল্পনা-কল্পনা রয়েছে। তবে শ্রোতাদের মধ্যে একজন যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ছিলেন, সেটা নিশ্চিত। মইন-জয় সাক্ষাত্পর্ব সফলভাবে সম্পন্ন করার বিশেষ মিশনে জেনারেল মইনের আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেছিলেন যে সামরিক কর্মকর্তা, তিনিও একই জেনারেল আমিন। রটনা রয়েছে জরুরি শাসনকালে আঞ্চলিক পরাশক্তির গোয়েন্দা প্রধান বাংলাদেশ সফর করে ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তার সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। সেই বৈঠকেরও নেপথ্য নায়ক ছিলেন জেনারেল আমিন। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠবে, এই চৌকস জেনারেল আসলে কাদের স্বার্থরক্ষা করেছেন। এহেন রহস্যজনক এক ব্যক্তির খপ্পরে পড়ে জামায়াতে ইসলামী দল আজ কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে, সেটা বিবেচনার দায়িত্ব দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের। তবে ২০০৮-এর নির্বাচনপূর্বকালে যে অতিমাত্রায় আস্থাশীল জামায়াতে ইসলামীকে দেখেছিলাম, তার সঙ্গে বর্তমান বিপর্যস্ত দলটিকে মেলানো কঠিন।

No comments

Powered by Blogger.