১- লড়াই বিফলে যায়নি, আমার দুর্বল কণ্ঠ : ইউরোপ-আমেরিকায় পৌঁছে গেছে
বার হব, ভরসা কই
...দিনবদলের নেত্রীর বন্দিশালা থেকে কবে মুক্তি পাব, সেটা তো আর জানা নেই। জীবিত বার হব, তারই বা ভরসা কই? পারভীন পাণ্ডুলিপিটা হাতে পেলে কোনো একদিন আমার এবং সহবন্দিদের ঢাকা জেলে দিনযাপনের বৃত্তান্ত জানতে পারবেন।...
...দিনবদলের নেত্রীর বন্দিশালা থেকে কবে মুক্তি পাব, সেটা তো আর জানা নেই। জীবিত বার হব, তারই বা ভরসা কই? পারভীন পাণ্ডুলিপিটা হাতে পেলে কোনো একদিন আমার এবং সহবন্দিদের ঢাকা জেলে দিনযাপনের বৃত্তান্ত জানতে পারবেন।...
অক্টোবরের ১৫, ২০১০, আশ্বিনের তিরিশ ১৪১৭। প্রিজন ভ্যান কাশিমপুর জেলের প্রধান ফটক অতিক্রম করতেই কব্জির দিকে তাকালাম, তখন দুপুর আড়াইটা। নাজিমউদ্দিন রোড থেকে এই পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রায় তিন ঘণ্টা লাগল। ভাঙাচোরা কাঠের বেঞ্চে অনেক কসরত করে দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে কোমর ধরে গেছে। অসহ্য ভ্যাপসা গরমে ভেতরে বাতাস চলাচলের কোনো ব্যবস্থা নেই, কেবল দাঁড়ালে ভ্যানের ছাদের কাছের ঘুলঘুলি দিয়ে কিছুটা বাতাস আসে। আসার পথে অক্সিজেনের জন্য বারকয়েক ওঠা-বসা করেছি। ঘামে ভিজে নীল পাঞ্জাবি গায়ের সঙ্গে একেবারে লেপ্টে গেছে। সকাল দশটা পর্যন্ত জানতাম না আজ আমি চালানে যাচ্ছি। নাস্তার পাট চুকিয়ে ঢাকা জেলের সাত নম্বর সেলের বারান্দায় বসে ফয়সাল আর ছয় নম্বর সেলের মুকুলের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম। বিএনপি আমলে ছাত্রদলের দুই পক্ষের গোলাগুলিতে নিহত বুয়েটের সনি হত্যাকাণ্ডের অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে যাবজ্জীবন জেল খাটছে কালো গাত্র বর্ণের, সুপুরুষ বুদ্ধিমান তরুণটি। তিন জনের হাতেই ধোঁয়া ওঠা রং চা ভর্তি মেলামাইনের মগ ধরা ছিল। এমন সময় পাঁচ-ছয়জন কারারক্ষী এবং জমাদার বাদশাকে সঙ্গে করে সুবেদার ফজলু হন্তদন্ত হয়ে এসে হাজির। সুবেদার ফজলু এক রহস্যময় চরিত্র; তার চেহারা দেখে মনের কথা আন্দাজ করা দুঃসাধ্য। যারা বলে থাকেন নারীর মন নাকি বিধাতাও বোঝেন না, তারা ফজলুকে দেখেননি। আজ তাকে স্বভাববিরুদ্ধভাবে কিছুটা যেন বিমর্ষ বোধ হলো। বলতে শুনলাম, স্যার বাঁধা-ছাঁদা করে নিন, আপনাকে যেতে হবে। কোথায় যাব জিজ্ঞাসা করতেই জবাব এলো, কাছেই, বাকি সংবাদ জেলগেটে এলে জানতে পারবেন। চালানের গল্পে এবার খানিক বিরতি দিচ্ছি। আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা দ্বিতীয় আদালত অবমাননা মামলার কাহিনী বর্ণনা এখনও বাকি রয়ে গেছে। জেল জীবনের কথকতার প্রথম পর্ব শেষ করেছিলাম শুনানির পূর্ব রাতে। এখন ফিরে যাচ্ছি ১১ অক্টোবর, সুপ্রিমকোর্ট আঙিনায়।
পত্রিকায় পড়েছিলাম, নতুন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক হাইকোর্টের মাজারসংলগ্ন রাস্তাটি আদালতের গাড়ি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। ১১ তারিখে কাঁটায় কাঁটায় সকাল ৯টায় আমাকে পেটের মধ্যে নিয়ে প্রিজন ভ্যান মাজার অতিক্রম করল। পুলিশ এসকর্ট দলটি মনে হলো সুপ্রিমকোর্টে আজই প্রথম এসেছে, রাস্তাঘাট তেমন ভালো করে চেনে না। গাড়ির চালক দুই প্রস্থ ভুল জায়গায় প্রিজন ভ্যান থামানোর পর আমিই ভেতর থেকে তারস্বরে চেঁচিয়ে দিকভ্রষ্ট চালককে সঠিক পথের নিশানা দিলাম। সাংবাদিক, পুলিশের ভিড় ঠেলে চেনাপথে এজলাসে পৌঁছে দেখলাম আদালত তখনও বসেনি। আমার দেশ পত্রিকার ডেপুটি এডিটর সৈয়দ আবদাল আহমদসহ সিনিয়র, জুনিয়র রিপোর্টারদের অনেকেই এসেছে, প্রকৌশলীদের মধ্যে রিজু, হাসিন, রিপন, কাইউম ছাড়াও আরও জনাদশেককে দেখলাম, আর্টিজান সিরামিকের সহকর্মী সাইদুর, আরিফ, জামালকে অনেকদিন পর দেখে বড় ভালো লাগল। আর যাকে বিশেষভাবে প্রত্যাশা করছিলাম সেই বাল্যবন্ধু বাবলু তো ছিলই। আগের রাতেই জেল জীবনের প্রথম খণ্ডের যবনিকা টেনেছি। পাণ্ডুলিপিটা ওর হাতে দিয়ে পারভীনকে পৌঁছে দিতে বললাম। দিন বদলের নেত্রীর বন্দিশালা থেকে কবে মুক্তি পাব, সেটা তো আর জানা নেই। জীবিত বার হব, তারই বা ভরসা কই? পারভীন পাণ্ডুলিপিটা হাতে পেলে পাঠক কোনো একদিন আমার এবং সহবন্দিদের ঢাকা জেলে দিনযাপনের বৃত্তান্ত জানতে পারবেন। বাবলুর হাতে ডায়রিটা দেয়া মাত্র মনটা এত হাল্কা হয়ে গেল যে, আদালতে উপস্থিত সবাইকেই বড় আপন মনে হচ্ছিল। অবশ্য তখন পর্যন্ত আমার প্রতিপক্ষ আইনজীবী এবং তিন লর্ডশিপ এজলাসে আসেননি; খানিক বাদেই শুভ্র এক বিদেশিনীকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকলেন। ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস্ ফেডারেশন (fidh)-এর ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল মিজ ফ্লোরেন্স বেলেভিয়ের সেই ফ্রান্স থেকে উড়ে এসেছেন আমার মামলা পর্যবেক্ষণ করতে। মনে হলো, এই জালিম শাসকের দেশে নাগরিকের ওপর রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্মম অত্যাচার এবং বিচার বিভাগ দলীয়করণের বিরুদ্ধে আমার লড়াই তাহলে একেবারে বিফলে যায়নি। নগণ্য এক মাহমুদুর রহমানের দুর্বল কণ্ঠ দেশের সীমানা পেরিয়ে ইউরোপ, আমেরিকার দেশসমূহের রাজধানীতে পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। মিজ বেলেভিয়ের আমার এবং অলিউল্লাহ্ নোমানের জন্য সমবেদনা প্রকাশ করলেন। এফআইডিএইচ কর্তৃক প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের একটি কপি আমার হাতে দিয়ে দেখালেন, সেখানে আমার প্রসঙ্গ এসেছে।
এফআইডিএইচ লিখেছে, "The case of Mr. Mahmudur Rahman, the Acting Editor of the Daily Amar Desh, unfortunately illustrates the abuse of power by the police on remand. Mr. Rahman with whom fidh mission met during its stay in Bangladesh was arrested by the police on 2nd June 2010, after the daily's publisher filed a fraud case against him allegedly at the instigation of the National Security Intelligence (NSI). When he was produced before a court at the end of his remand, Mr. Mahmudur Rahman alleged he has been tortured in detention. Subsequently, Mr. Rahman has been charged with sedition for allegedly meeting with people attempting to overthrow the government in 2006, which allows for indefinite remand. Writers and reporters, detained for sedition, report that mistreatment, malnutrition and torture are common. He has also been charged under section 6(1) of Anti Terrorism Act, 2009."
(আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মাহমুদুর রহমানের ঘটনা রিমান্ডে পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি দুর্ভাগ্যজনক উদাহরণ। জনাব রহমান, যার সঙ্গে বাংলাদেশে অবস্থানকালে এফআইডিএইচ-এর একটি প্রতিনিধিদল সাক্ষাত্ করেছিল, জুন মাসের ২ তারিখে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই)-এর প্ররোচনায় পত্রিকার প্রকাশক কর্তৃক একটি জালিয়াতি মামলায় গ্রেফতার হন। রিমান্ড শেষে তাকে আদালতে আনা হলে মাহমুদুর রহমান পুলিশের হেফাজতে তার ওপর নির্যাতনের অভিযোগ করেন। পরবর্তী সময়ে জনাব রহমানের বিরুদ্ধে ২০০৬ সালে তত্কালীন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সচেষ্ট কিছু ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করার অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করা হয়। এ ধরনের মামলায় অনির্দিষ্টকাল রিমান্ডে আটক রাখার সুযোগ রয়েছে। রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় আটককৃত লেখক, সাংবাদিকরা সর্বদাই দুর্ব্যবহার, অপুষ্টি এবং নির্যাতনের অভিযোগ করেন। তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯-এর ৬(১) ধারাতেও মামলা করা হয়েছে।)
প্রধান বিচারপতির এজলাসে বসেই ফ্লোরেন্স বেলেভিয়েরের সঙ্গে এদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচার বিভাগে অনিয়ম ও দলীয়করণ এবং আমার জেল জীবনের নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বললাম। আমার মামলা পর্যবেক্ষণ ছাড়াও এফআইডিএইচ কর্মকর্তা ল’ কমিশনের চেয়ারম্যান, প্রধান বিচারপতি, বার সভাপতি এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের আইনের শাসনের প্রকৃত অবস্থা বোঝার চেষ্টা করবেন। আমাদের কথাবার্তার ফাঁকে মিজ বেলেভিয়ের ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের সঙ্গেও পরিচিত হলেন। রফিক ভাই ভারতীয় হাইকোর্টের কয়েকটি রায় যেখানে আদালতের সমালোচনা করার অধিকারকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে, তা আমাদের পড়ে শোনালেন। বিশেষ করে তিনি ভারতের সাবেক আইনমন্ত্রী মি. শান্তিভূষণের একটি বক্তব্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। মি. শান্তিভূষণ এ বছরেরই ১৬ সেপ্টেম্বর ভারতের সুপ্রিমকোর্টে আদালত অবমাননার এক অভিযোগের জবাবে বলেছেন, "I would consider it as an honour to spend some time in jail for making an effort to get the people of India an honest and clean judiciary." (ভারতের জনগণকে একটি সত্ ও পরিচ্ছন্ন বিচার ব্যবস্থা প্রদানের লক্ষ্যে কিছু সময় জেলে কাটানোকে আমি গৌরবজনক বিবেচনা করব।)
ভারতের সাবেক আইনমন্ত্রীর বক্তব্য পড়ে উত্সাহিত বোধ করলাম। আমার বিরুদ্ধে আজকের মামলার বিষয়বস্তুর সঙ্গে মি. শান্তিভূষণের এফিডেভিটের বিস্ময়কর সাদৃশ্য রয়েছে। এ বছর মে মাসের ১০ তারিখে ‘স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা’ শিরোনামে মন্তব্য প্রতিবেদন লেখার কারণেই দ্বিতীয়বারের মতো আজ আমি সুপ্রিমকোর্টের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছি। সেই লেখাটির এক জায়গায় বলেছিলাম, ‘শুধু এটুকু আগাম বলে রাখছি, সত্য কথা প্রকাশের অপরাধে কারাগারে যেতে আমি বরং গৌরবই বোধ করব। কারাগার থেকে জীবিত ফিরে আসতে পারলে আবার সত্য কথা বলব এবং লিখব, প্রয়োজনে পুনর্বার কারাগারে যাব’। ভারতের সাবেক আইনমন্ত্রীকে জেলে যেতে না হলেও আমাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আমি দরিদ্র রাষ্ট্রের, মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের পদলেহন করে সুশীলের (?) তকমা গায়ে লাগানোর চেষ্টা করিনি কখনও। কাজেই আমার বক্তব্য আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব। চরম ইসলাম বিদ্বেষী আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় কল্কে পেতে হলে আল্লাহ্-রাসুলের বিরুদ্ধে দু-চারটে কথা বলতে হয়, যা আমার ঈমানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তবে, আনন্দের কথা হলো বিলম্বে হলেও দেশে দেশে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার আওয়াজ উঠতে শুরু করেছে। মজলুম জনতার বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস একদিন আল্লাহ্র আরশ স্পর্শ করবেই। সেই বিশ্বাস সর্বান্তকরণে আঁকড়ে ধরেই আমার পথচলা।
সাড়ে ৯টায় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে তিন সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এজলাসে উঠলেন। তার আগেই দেশের অধিকাংশ বিশিষ্ট আইনজীবী ঘর ভরিয়ে ফেলেছেন। আমার পক্ষে মামলা লড়তে এসেছেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক এবং সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ. জে. মোহাম্মদ আলী। আজ আর আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে হবে না, সে কাজটি প্রধানত করবেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক। প্রধান বিচারপতি সরকার পক্ষকে তাদের অভিযোগ উত্থাপন করতে বললেন। অ্যাডিশনাল অ্যাটর্নি জেনারেল খলিলুর রহমান দেড় ঘণ্টা একটানা বক্তৃতা দিলেন। ‘স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা’ পুরোটাই ভরা আদালতে পড়ে শোনানো হলো। দেশের এতগুলো বিজ্ঞজনের সামনে আমার মতো অভাজনের লেখা পাঠ করাতে যথেষ্ট আনন্দবোধ করছিলাম। অপরদিকে আদালতের রং ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাচ্ছিল। প্রধান বিচারপতি লেখাটি প্রকাশের তারিখ জানতে চাইলে সরকারি কৌঁসুলি গুলিয়ে ফেলে বললেন, আমি নাকি জেলে বসেই এই দুষ্কর্ম করেছি। জেলে বসে লেখালেখি করা গেলেও সেটা যে ছাপানো যায় না, এটা নিশ্চয়ই তিনি জানেন। সম্ভবত কোনো কারণে অপ্রস্তুত অথবা বিব্রতবোধ করার কারণেই তার এই বিস্ময়কর বিভ্রম। রাজ্জাক ভাই উঠে দাঁড়িয়ে ভ্রম সংশোধন করে আদালতকে আশ্বস্ত করলেন যে, লেখাটি আমার গ্রেফতারের আগেই ছাপা হয়েছিল। প্রধান বিচারপতি মাথা নেড়ে অ্যাডিশনাল অ্যাটর্নি জেনারেলকে তার বক্তব্য অব্যাহত রাখতে নির্দেশ দিলেন।
পত্রিকায় পড়েছিলাম, নতুন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক হাইকোর্টের মাজারসংলগ্ন রাস্তাটি আদালতের গাড়ি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। ১১ তারিখে কাঁটায় কাঁটায় সকাল ৯টায় আমাকে পেটের মধ্যে নিয়ে প্রিজন ভ্যান মাজার অতিক্রম করল। পুলিশ এসকর্ট দলটি মনে হলো সুপ্রিমকোর্টে আজই প্রথম এসেছে, রাস্তাঘাট তেমন ভালো করে চেনে না। গাড়ির চালক দুই প্রস্থ ভুল জায়গায় প্রিজন ভ্যান থামানোর পর আমিই ভেতর থেকে তারস্বরে চেঁচিয়ে দিকভ্রষ্ট চালককে সঠিক পথের নিশানা দিলাম। সাংবাদিক, পুলিশের ভিড় ঠেলে চেনাপথে এজলাসে পৌঁছে দেখলাম আদালত তখনও বসেনি। আমার দেশ পত্রিকার ডেপুটি এডিটর সৈয়দ আবদাল আহমদসহ সিনিয়র, জুনিয়র রিপোর্টারদের অনেকেই এসেছে, প্রকৌশলীদের মধ্যে রিজু, হাসিন, রিপন, কাইউম ছাড়াও আরও জনাদশেককে দেখলাম, আর্টিজান সিরামিকের সহকর্মী সাইদুর, আরিফ, জামালকে অনেকদিন পর দেখে বড় ভালো লাগল। আর যাকে বিশেষভাবে প্রত্যাশা করছিলাম সেই বাল্যবন্ধু বাবলু তো ছিলই। আগের রাতেই জেল জীবনের প্রথম খণ্ডের যবনিকা টেনেছি। পাণ্ডুলিপিটা ওর হাতে দিয়ে পারভীনকে পৌঁছে দিতে বললাম। দিন বদলের নেত্রীর বন্দিশালা থেকে কবে মুক্তি পাব, সেটা তো আর জানা নেই। জীবিত বার হব, তারই বা ভরসা কই? পারভীন পাণ্ডুলিপিটা হাতে পেলে পাঠক কোনো একদিন আমার এবং সহবন্দিদের ঢাকা জেলে দিনযাপনের বৃত্তান্ত জানতে পারবেন। বাবলুর হাতে ডায়রিটা দেয়া মাত্র মনটা এত হাল্কা হয়ে গেল যে, আদালতে উপস্থিত সবাইকেই বড় আপন মনে হচ্ছিল। অবশ্য তখন পর্যন্ত আমার প্রতিপক্ষ আইনজীবী এবং তিন লর্ডশিপ এজলাসে আসেননি; খানিক বাদেই শুভ্র এক বিদেশিনীকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকলেন। ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস্ ফেডারেশন (fidh)-এর ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল মিজ ফ্লোরেন্স বেলেভিয়ের সেই ফ্রান্স থেকে উড়ে এসেছেন আমার মামলা পর্যবেক্ষণ করতে। মনে হলো, এই জালিম শাসকের দেশে নাগরিকের ওপর রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্মম অত্যাচার এবং বিচার বিভাগ দলীয়করণের বিরুদ্ধে আমার লড়াই তাহলে একেবারে বিফলে যায়নি। নগণ্য এক মাহমুদুর রহমানের দুর্বল কণ্ঠ দেশের সীমানা পেরিয়ে ইউরোপ, আমেরিকার দেশসমূহের রাজধানীতে পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। মিজ বেলেভিয়ের আমার এবং অলিউল্লাহ্ নোমানের জন্য সমবেদনা প্রকাশ করলেন। এফআইডিএইচ কর্তৃক প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের একটি কপি আমার হাতে দিয়ে দেখালেন, সেখানে আমার প্রসঙ্গ এসেছে।
এফআইডিএইচ লিখেছে, "The case of Mr. Mahmudur Rahman, the Acting Editor of the Daily Amar Desh, unfortunately illustrates the abuse of power by the police on remand. Mr. Rahman with whom fidh mission met during its stay in Bangladesh was arrested by the police on 2nd June 2010, after the daily's publisher filed a fraud case against him allegedly at the instigation of the National Security Intelligence (NSI). When he was produced before a court at the end of his remand, Mr. Mahmudur Rahman alleged he has been tortured in detention. Subsequently, Mr. Rahman has been charged with sedition for allegedly meeting with people attempting to overthrow the government in 2006, which allows for indefinite remand. Writers and reporters, detained for sedition, report that mistreatment, malnutrition and torture are common. He has also been charged under section 6(1) of Anti Terrorism Act, 2009."
(আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মাহমুদুর রহমানের ঘটনা রিমান্ডে পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি দুর্ভাগ্যজনক উদাহরণ। জনাব রহমান, যার সঙ্গে বাংলাদেশে অবস্থানকালে এফআইডিএইচ-এর একটি প্রতিনিধিদল সাক্ষাত্ করেছিল, জুন মাসের ২ তারিখে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই)-এর প্ররোচনায় পত্রিকার প্রকাশক কর্তৃক একটি জালিয়াতি মামলায় গ্রেফতার হন। রিমান্ড শেষে তাকে আদালতে আনা হলে মাহমুদুর রহমান পুলিশের হেফাজতে তার ওপর নির্যাতনের অভিযোগ করেন। পরবর্তী সময়ে জনাব রহমানের বিরুদ্ধে ২০০৬ সালে তত্কালীন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সচেষ্ট কিছু ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করার অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করা হয়। এ ধরনের মামলায় অনির্দিষ্টকাল রিমান্ডে আটক রাখার সুযোগ রয়েছে। রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় আটককৃত লেখক, সাংবাদিকরা সর্বদাই দুর্ব্যবহার, অপুষ্টি এবং নির্যাতনের অভিযোগ করেন। তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯-এর ৬(১) ধারাতেও মামলা করা হয়েছে।)
প্রধান বিচারপতির এজলাসে বসেই ফ্লোরেন্স বেলেভিয়েরের সঙ্গে এদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচার বিভাগে অনিয়ম ও দলীয়করণ এবং আমার জেল জীবনের নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বললাম। আমার মামলা পর্যবেক্ষণ ছাড়াও এফআইডিএইচ কর্মকর্তা ল’ কমিশনের চেয়ারম্যান, প্রধান বিচারপতি, বার সভাপতি এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের আইনের শাসনের প্রকৃত অবস্থা বোঝার চেষ্টা করবেন। আমাদের কথাবার্তার ফাঁকে মিজ বেলেভিয়ের ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের সঙ্গেও পরিচিত হলেন। রফিক ভাই ভারতীয় হাইকোর্টের কয়েকটি রায় যেখানে আদালতের সমালোচনা করার অধিকারকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে, তা আমাদের পড়ে শোনালেন। বিশেষ করে তিনি ভারতের সাবেক আইনমন্ত্রী মি. শান্তিভূষণের একটি বক্তব্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। মি. শান্তিভূষণ এ বছরেরই ১৬ সেপ্টেম্বর ভারতের সুপ্রিমকোর্টে আদালত অবমাননার এক অভিযোগের জবাবে বলেছেন, "I would consider it as an honour to spend some time in jail for making an effort to get the people of India an honest and clean judiciary." (ভারতের জনগণকে একটি সত্ ও পরিচ্ছন্ন বিচার ব্যবস্থা প্রদানের লক্ষ্যে কিছু সময় জেলে কাটানোকে আমি গৌরবজনক বিবেচনা করব।)
ভারতের সাবেক আইনমন্ত্রীর বক্তব্য পড়ে উত্সাহিত বোধ করলাম। আমার বিরুদ্ধে আজকের মামলার বিষয়বস্তুর সঙ্গে মি. শান্তিভূষণের এফিডেভিটের বিস্ময়কর সাদৃশ্য রয়েছে। এ বছর মে মাসের ১০ তারিখে ‘স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা’ শিরোনামে মন্তব্য প্রতিবেদন লেখার কারণেই দ্বিতীয়বারের মতো আজ আমি সুপ্রিমকোর্টের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছি। সেই লেখাটির এক জায়গায় বলেছিলাম, ‘শুধু এটুকু আগাম বলে রাখছি, সত্য কথা প্রকাশের অপরাধে কারাগারে যেতে আমি বরং গৌরবই বোধ করব। কারাগার থেকে জীবিত ফিরে আসতে পারলে আবার সত্য কথা বলব এবং লিখব, প্রয়োজনে পুনর্বার কারাগারে যাব’। ভারতের সাবেক আইনমন্ত্রীকে জেলে যেতে না হলেও আমাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আমি দরিদ্র রাষ্ট্রের, মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের পদলেহন করে সুশীলের (?) তকমা গায়ে লাগানোর চেষ্টা করিনি কখনও। কাজেই আমার বক্তব্য আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব। চরম ইসলাম বিদ্বেষী আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় কল্কে পেতে হলে আল্লাহ্-রাসুলের বিরুদ্ধে দু-চারটে কথা বলতে হয়, যা আমার ঈমানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তবে, আনন্দের কথা হলো বিলম্বে হলেও দেশে দেশে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার আওয়াজ উঠতে শুরু করেছে। মজলুম জনতার বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস একদিন আল্লাহ্র আরশ স্পর্শ করবেই। সেই বিশ্বাস সর্বান্তকরণে আঁকড়ে ধরেই আমার পথচলা।
সাড়ে ৯টায় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে তিন সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এজলাসে উঠলেন। তার আগেই দেশের অধিকাংশ বিশিষ্ট আইনজীবী ঘর ভরিয়ে ফেলেছেন। আমার পক্ষে মামলা লড়তে এসেছেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক এবং সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ. জে. মোহাম্মদ আলী। আজ আর আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে হবে না, সে কাজটি প্রধানত করবেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক। প্রধান বিচারপতি সরকার পক্ষকে তাদের অভিযোগ উত্থাপন করতে বললেন। অ্যাডিশনাল অ্যাটর্নি জেনারেল খলিলুর রহমান দেড় ঘণ্টা একটানা বক্তৃতা দিলেন। ‘স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা’ পুরোটাই ভরা আদালতে পড়ে শোনানো হলো। দেশের এতগুলো বিজ্ঞজনের সামনে আমার মতো অভাজনের লেখা পাঠ করাতে যথেষ্ট আনন্দবোধ করছিলাম। অপরদিকে আদালতের রং ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাচ্ছিল। প্রধান বিচারপতি লেখাটি প্রকাশের তারিখ জানতে চাইলে সরকারি কৌঁসুলি গুলিয়ে ফেলে বললেন, আমি নাকি জেলে বসেই এই দুষ্কর্ম করেছি। জেলে বসে লেখালেখি করা গেলেও সেটা যে ছাপানো যায় না, এটা নিশ্চয়ই তিনি জানেন। সম্ভবত কোনো কারণে অপ্রস্তুত অথবা বিব্রতবোধ করার কারণেই তার এই বিস্ময়কর বিভ্রম। রাজ্জাক ভাই উঠে দাঁড়িয়ে ভ্রম সংশোধন করে আদালতকে আশ্বস্ত করলেন যে, লেখাটি আমার গ্রেফতারের আগেই ছাপা হয়েছিল। প্রধান বিচারপতি মাথা নেড়ে অ্যাডিশনাল অ্যাটর্নি জেনারেলকে তার বক্তব্য অব্যাহত রাখতে নির্দেশ দিলেন।
No comments