১৩- স্বাধীনতার পক্ষের পত্রিকা ‘আমার দেশ’-এর প্রবেশাধিকার নেই ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে
ডিসি কি সরকারের বাইরের?
... ঢাকার ডিসি সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে গভীর রাতে আমার দেশ পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করার পর তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ সংসদে বলেছিলেন —পত্রিকা বন্ধের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সরকার জড়িত নয়। সেই সময় দেশের বিবেকসম্পন্ন নাগরিকরা একবাক্যে প্রশ্ন করেছিলেন, ঢাকার ডিসি সরকারের বাইরের লোক হয় কী করে?....
... ঢাকার ডিসি সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে গভীর রাতে আমার দেশ পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করার পর তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ সংসদে বলেছিলেন —পত্রিকা বন্ধের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সরকার জড়িত নয়। সেই সময় দেশের বিবেকসম্পন্ন নাগরিকরা একবাক্যে প্রশ্ন করেছিলেন, ঢাকার ডিসি সরকারের বাইরের লোক হয় কী করে?....
বেগম খালেদা জিয়াকে তার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ-উত্তর বাহাত্তর ঘণ্টায় মহাজোট সরকার এবং আওয়ামী মিডিয়া যে প্রচারণা চালিয়েছে, তাতে এ দেশের বিবেকসম্পন্ন যে কোনো নাগরিকের লজ্জাবোধ করা উচিত। এমন একটি অভব্য, মিথ্যাচারী, কুরুচিসম্পন্ন শাসকশ্রেণী আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা—ভাবতে নিজের ওপরই ঘৃণা হচ্ছে। কার বক্তব্য ছেড়ে কারটা উল্লেখ করব ভেবে উঠতে পারছি না। মহামহিম অ্যাটর্নি জেনারেলকেই আগে স্মরণ করি। তিনি বললেন, হাইকোর্টের রায় যেহেতু চেম্বার জজ আদালত স্থগিত করেনি, তাই বেগম খালেদা জিয়ার এই উচ্ছেদ আইনসম্মত হয়েছে। অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলমের ভাষ্য অনুযায়ী জনগণের সম্পদ নাকি জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে।
অনেকদিন ধরেই সরকারি মহল থেকে প্রচার চালানো হচ্ছে, বেগম খালেদা জিয়ার কাছ থেকে বাড়িটি কেড়ে নিয়ে সেখানে বিডিআর বিদ্রোহে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের জন্য ফ্ল্যাট বানানো হবে। সেক্ষেত্রে জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার প্রশ্ন কোথা থেকে এলো, এটাই বুঝলাম না। বেগম খালেদা জিয়াও তো সেনা বিদ্রোহে নিহত একজন প্রেসিডেন্ট এবং সেনাপ্রধানের বিধবা স্ত্রী। অ্যাটর্নি জেনারেল খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের উল্টো দোষারোপ করে অভিযোগ করেছেন, তারা নাকি হাইকোর্টের রায় স্থগিতের জন্য চেম্বার জজের কাছে আবেদনই করেননি। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং প্রধান মুখপাত্র মাহবুবুল আলম হানিফ দাবি করেছেন, বিষয়টি একান্তভাবেই বিচার বিভাগ এবং সেনাবাহিনীর হওয়ায় সরকার এই উচ্ছেদের সঙ্গে কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট নয়। তিনি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার মতো করে বিরোধী দলীয় নেতাকে স্বেচ্ছায় বাড়ি ছাড়ার জন্য আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়েছেন।
চেম্বার জজ আদালতে বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা স্থগিতাদেশের আবেদন করেছেন কী করেননি এবং না করে থাকলে কেন করেননি, এসব বিষয়ে ব্যাখ্যা সেই আইনজীবীরাই দেবেন। আমার কথা হলো, এমন একটি বিষয় নিয়ে সারা দেশে যখন তোলপাড় চলছে তখন ‘ন্যায়বিচার’ এবং ঔঁফরপরধষ অপঃরারংস-এর পরাকাষ্ঠা দেখানো প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক আপিল বিভাগে শুনানি শেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত ওই বাড়িতে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে খোলাসা করে সরকারকে নির্দেশ দিলেন না কেন? একজন নাগরিককে তার ৩৮ বছরের গৃহ থেকে এমন অমানবিকভাবে উচ্ছেদের দায় নিয়ে, এই প্রধান বিচারপতিকে একদিন অবশ্যই জনগণের আদালতে জবাবদিহি করতে হবে।
মাহবুবুল আলম হানিফ দাবি করেছেন, এই উচ্ছেদের সঙ্গে সরকার জড়িত নয়। বিরোধী দলীয় নেতাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদের সময় সেখানে র্যাব, পুলিশ এবং সম্ভবত সাদা পোশাক পরিহিত সেনাবাহিনীর যেসব সদস্য উপস্থিত থেকে চরম অমার্জিত পন্থায় জোর খাটিয়েছেন, তারা তাহলে কার নির্দেশ পালন করেছেন? ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড থেকে জারিকৃত জমির বরাদ্দ বাতিলের যে নোটিশের উপর ভিত্তি করে হাইকোর্ট বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিল, সেই নোটিশটিও কি সরকারের নির্দেশ ছাড়াই জারি করা হয়েছিল? সবচেয়ে বড় কথা, সরকার মানে কী? মাহবুবুল আলম হানিফের অদ্ভুত যুক্তি শুনে আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করা নিয়ে সংসদে দেয়া তথ্যমন্ত্রীর বিবৃতির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ঢাকার ডিসি সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে গভীর রাতে আমার দেশ পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করার পর তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ সংসদে বলেছিলেন—পত্রিকা বন্ধের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সরকার জড়িত নয়। সেই সময় দেশের বিবেকসম্পন্ন নাগরিকরা একবাক্যে প্রশ্ন করেছিলেন, ঢাকার ডিসি সরকারের বাইরের লোক হয় কী করে! বেগম খালেদা জিয়ার বাড়ি এবং আমার দেশ নিয়ে সরকারের নির্লজ্জ মিথ্যাচারে মনে হচ্ছে ক্ষমতাসীনরা দেশের ১৬ কোটি নাগরিককে মূর্খই বিবেচনা করেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের মধ্যে আদালত ও সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক নোংরা খেলায় ব্যবহার করার নগ্ন প্রচেষ্টা লক্ষ্যণীয়। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু বিবিসি রেডিওতে দেয়া সাক্ষাত্কারে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ক্যান্টনমেন্টের বাড়িতে থেকে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র করার বায়বীয় অভিযোগ এনেছেন। আওয়ামী লীগের অন্য এক পাতি নেতা এমন উদ্ভট অভিযোগও আনলেন যে, রাষ্টপতি জিয়া ৬ নম্বর মইনুল রোড থেকেই নাকি মুজিব হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। সর্বশেষ গত ক’দিনে সংবাদ মাধ্যমে হঠাত্ তারকা হয়ে ওঠা আইএসপিআর’র জনৈক শাহিনুল ইসলাম, আওয়ামী প্রচারবিদের মতো করে বেগম খালেদা জিয়ার স্বেচ্ছায় বাড়ি ছাড়ার তত্ত্ব নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হয়েছেন। এই লোকটি যে উদ্ধত ভঙ্গি এবং ভাষায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে কথা বলেছেন, আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায় তার মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মর্যাদা বহুলাংশে ক্ষুণ্ন হয়েছে।
খালেদা জিয়া স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে গেছেন—এমন দাবির পেছনে শাহিনুল ইসলাম দুটো যুক্তি হাজির করেছেন। প্রথম যুক্তি, সেনাবাহিনী চাইলে ভোর হওয়ামাত্র বিরোধী দলীয় নেত্রীকে বাড়ি থেকে বার করে দিতে পারত। তিনি যে বিকাল সাড়ে তিনটায় তার ৩৮ বছরের গৃহ ত্যাগ করেছেন, এর মাধ্যমেই নাকি স্বেচ্ছায় যাওয়ার ব্যাপারটি প্রমাণিত হয়ে গেছে। এরপর এই চৌকস কর্মকর্তা অপর ‘মোক্ষম’ যুক্তি পেশ করেছেন। বেগম খালেদা জিয়া তার ব্যক্তিগত ড্রাইভার চালিত গাড়িতে চড়েই ক্যান্টনমেন্ট এলাকা ত্যাগ করেছেন। সরকার জোর করলে তো তাকে প্রিজন ভ্যানে করেই পাঠানো হতো! তিনি অবশ্য প্রিজন ভ্যান শব্দটি উচ্চারণ করেননি। তবে, বেগম খালেদা জিয়ার নিজ ড্রাইভার চালিত গাড়িতে ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ সম্পর্কিত বক্তব্যের এর চেয়ে যথার্থ অর্থ আমি অন্তত বের করতে পারিনি।
আইএসপিআর-এর পরিচালক শাহিনুল ইসলাম কেবল গণমাধ্যমে উচ্ছেদের পক্ষে ওকালতি করেই তার দায়িত্ব সমাপ্ত করেননি। বেগম খালেদা জিয়া বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার একদিন পর তিনি বিশেষভাবে বাছাই করা সাংবাদিকদের মইনুল রোডের বাড়িতে ডেকে নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর চরিত্র হননের ধৃষ্টতাও দেখিয়েছেন। কয়েকটি প্রাপ্তবয়স্কদের পাঠযোগ্য পত্রিকা এবং খালি মদের বোতল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সাজিয়ে টেলিভিশনে দেখিয়ে নীতিনির্ধারকরা তাদের পূতিগন্ধময় মানসিকতাই জাতির সামনে উন্মোচিত করেছেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিধবা স্ত্রীর বাড়ি সংক্রান্ত এই ট্রাজিক, স্পর্শকাতর বিষয়ে সেনাবাহিনীর মুখপাত্র রূপে পরিচিত আইএসপিআরকে এভাবে জড়িত করার সিদ্ধান্ত কত ওপরের ‘উর্বর’ মস্তিষ্ক থেকে এসেছে, সেই তথ্য আমার মতো অতি সাধারণ নাগরিকের জানার কোনো উপায় নেই। তবে এই অতীব গর্হিত কাজটির মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে আরও বিতর্কিত না করাটাই বোধহয় বুদ্ধিমানের কাজ হতো। এমনিতে এক এগারোর হঠকারিতা এবং বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ধাক্কা সামলাতেই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার মহান দায়িত্বে নিয়োজিত এই বাহিনীর দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। এই তিনদিনের চরম হঠকারী এবং অবিমৃষ্যকারী আচরণে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ও মর্যাদার যে ক্ষতি হয়েছে, তা ঘটা করে জাতিসংঘে সর্বাধিক সৈন্য প্রেরণের সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে কতটুকু নিরাময় করা গেছে তার নির্ণয় দুরূহ।
আমার বিশ্বাস, একটি দেশের সেনাবাহিনীর প্রধান কর্তব্য বহিশত্রুর আক্রমণ থেকে সেই দেশের নিরাপত্তা বিধান করা, বিদেশে শান্তিমিশনে সৈন্য প্রেরণ নয়। অবশ্য এই মাথা হেট করা ঘটনার মধ্য দিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার দল, বিএনপি’র একটা বড় উপকার সাধিত হয়েছে। এতদিন ধরে আওয়ামী বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়াগোষ্ঠী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে ক্যান্টনমেন্টে সৃষ্ট অভিহিত করে নানা রকম উপহাস করত। বেগম খালেদা জিয়াকে বাস্তুচ্যুত করার কার্যক্রমে সেনাবাহিনী ও আইএসপিআর-এর বিতর্কিত ভূমিকার পর বিএনপিকে অন্তত সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংযোগের দায়ে আর অভিযুক্ত করা যাবে না। দায়টা এখন থেকে আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে।
একদা চরমভাবে সেনাবিদ্বেষী ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর ইদানীংকার প্রগাঢ় বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ আমার দেশ পত্রিকার একটি অভিজ্ঞতার কথাও বর্ণনা করা যেতে পারে। আমার গ্রেফতারের মুহূর্তে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে আমার সম্পাদিত পত্রিকাটি দ্বিতীয় জনপ্রিয় ছিল এবং হার্ড কপি বিক্রিতে আমরা ছিলাম চতুর্থ স্থানে। অথচ এমন একটি জনপ্রিয় এবং স্বাধীনতার পক্ষের পত্রিকার ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় প্রবেশাধিকার নেই। সেখানকার হকারদের আমার দেশ বিক্রয়ের ওপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ক্যান্টনমেন্টের লাইব্রেরিসমূহে আমার দেশ রাখা হয় না। শুধু তাই নয়, সেনাবাহিনীর কোনো সদস্য হকারকে আমার দেশ দিতে বললে বিষয়টি সামরিক গোয়েন্দাদের জানানোর নির্দেশ আছে। এ দেশে গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের হাল-হকিকত বোঝার জন্য ক্যান্টনমেন্ট এলাকার এই একটি উদাহরণই যথেষ্ট।
দুই মাস সাত দিনের মাথায় বন্দি জীবনের দ্বিতীয় ঈদ পালন করলাম। ঈদুল ফিতরের সময় ঢাকা জেলে ছিলাম। মনে আছে, সেদিন সাত নম্বর সেলের প্রতিবেশী ফয়সালের অতিথি হয়ে তার বাসা থেকে পাঠানো পোলাও, কোর্মা পেট পুরে খেয়েছিলাম। এবার খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন নিজেই করেছি। গতকালই পিসির টাকায় কেজি দশেক বড় সাইজের রসগোল্লা আনিয়ে রেখেছিলাম। ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে বন্দি, কারারক্ষী নির্বিশেষে যেই আজ এসেছে, একটা করে মিষ্টি ধরিয়ে দিয়েছি। দুপুরে গরু এবং খাসি দুই রকম গোস্ত এবং পোলাও-এর আয়োজন ছিল। সব ব্যবস্থা কালাম একাই করেছে। বন্দিত্বের কারণে ঈদের জামাতে অংশগ্রহণ না করলেও একদিনের এই উন্নত খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন প্রধানত প্রতিবেশীদের সঙ্গে একত্রে বসে একবেলা খাওয়ার জন্যই করেছি। প্রায় পঞ্চাশজন মানুষের সঙ্গে একটা দিন গল্প-গুজব করে খেতে বড় আনন্দ লাগল।
আহারের সুযোগ-সুবিধায় কাশিমপুর জেলে যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যেই আছি। এত বড় জেলে আমি একমাত্র ডিভিশনপ্রাপ্ত কয়েদি। পিসির টাকা দিয়ে যথেচ্ছ বাজারে প্রশাসন থেকে কোনো বাধা নেই। কালাম আবার এসব বিষয়ে দারুণ চৌকস। একে মেট, তার ওপর জেল রেকর্ড ভালো থাকায় জেল প্রশাসনেও কালামের যথেষ্ট প্রভাব-প্রতিপত্তি। সুতরাং, নাজিমউদ্দিন রোডের জেল জীবনের মতো চাপিলা, কাচকি দিয়ে এখানে ভাত খেতে হচ্ছে না। পরবর্তী জেলে চালানে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছে শরীরের হারানো ওজন বেশ খানিকটা ফিরে পাওয়া যাবে। সমস্যার মধ্যে সপ্তাহে বারতিনেক প্রিজন ভ্যানে চড়ে পুরনো ঢাকার সিএমএম আদালতে যাওয়া-আসা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার বর্তমান অবস্থাটা জানতে পারলে হয়তো সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে যাবেন। মাহমুদুর রহমানকে নিয়ে কী করা? ব্যাটাকে ঢাকার সাত নম্বর সেলে রেখে খাওয়া-দাওয়ায় টাইট দেয়া, নাকি কাশিমপুর থেকে প্রিজন ভ্যানে চক্কর দেওয়ানো? আমার অবশ্য কোনোটাতেই বিশেষ কোনো অসুবিধা নেই। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র কাছে কায়মনোবাক্যে আত্মসমর্পণের সুবিধাটাই এখানে।
কাশিমপুর আসার একমাস পর মা’র সঙ্গে আজই প্রথম দেখা হলো। জুনের পয়লা তারিখ সকালে কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হওয়ার পর বিগত প্রায় ছয় মাসে এটা মায়ের সঙ্গে তৃতীয় সাক্ষাত্। দেখলাম তিনি আরও রোগা হয়েছেন। ঘণ্টা খানেকের সাক্ষাতে যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছেন। বরং পারভীনই পারেনি। বন্দিত্বের মেয়াদ যত দীর্ঘ হচ্ছে, দেখতে পাচ্ছি আমার স্ত্রী ততটাই দুর্বল হয়ে পড়ছে। ঘরে-বাইরের সব বোঝা ওর একাকী কাঁধে। আর্টিজান বিক্রির প্রক্রিয়া চলছে, কোম্পানি হস্তান্তরের যত ধকল পারভীনকেই সামলাতে হচ্ছে। এদিকে আমার দেশ’র নানাবিধ সমস্যা তো আছেই। সর্বোপরি আমার অর্ধশত মামলার দেন-দরবার। পারভীনের তুলনায় আমিই জেলে অনেক শান্তিতে আছি। নিয়মিত খাচ্ছি-দাচ্ছি, নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছি।
ঈদোত্তর দেখায় কথামত বাবলু ও বেলী এসেছিল। সুপ্রিমকোর্টে আমার মামলা চলাকালীন বাবলু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কষ্ট করে প্রতিদিন এসেছে। আমার সহোদরপ্রতিম বাল্যবন্ধুর ঋণ এই জীবনে আর শোধ করতে পারব না। আমি জেলে আসার পর থেকে বোধহয় এমন একটি দিনও যায়নি যেদিন বাবলু অথবা বেলী বাসার খোঁজখবর নেয়নি। আজ জেলগেট থেকে বিদায় নেয়ার সময় বেলীও তার অশ্রু আটকাতে পারেনি। ওদের একমাত্র কন্যা সারাহ’র কথাও বার বার মনে পড়ছিল। মুক্ত জীবনে আমরা পাঁচজন মাসে অন্তত একবার বাইরে খেতে যেতাম। বাবলুকে বললাম, জেল থেকে যদি ছাড়া না পাই তাহলে আমার সংসারের দায়িত্ব তারই। এই চরম স্বার্থপর জগতে এমন বন্ধুভাগ্য ক’জনের হয়?
অনেকদিন ধরেই সরকারি মহল থেকে প্রচার চালানো হচ্ছে, বেগম খালেদা জিয়ার কাছ থেকে বাড়িটি কেড়ে নিয়ে সেখানে বিডিআর বিদ্রোহে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের জন্য ফ্ল্যাট বানানো হবে। সেক্ষেত্রে জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার প্রশ্ন কোথা থেকে এলো, এটাই বুঝলাম না। বেগম খালেদা জিয়াও তো সেনা বিদ্রোহে নিহত একজন প্রেসিডেন্ট এবং সেনাপ্রধানের বিধবা স্ত্রী। অ্যাটর্নি জেনারেল খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের উল্টো দোষারোপ করে অভিযোগ করেছেন, তারা নাকি হাইকোর্টের রায় স্থগিতের জন্য চেম্বার জজের কাছে আবেদনই করেননি। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং প্রধান মুখপাত্র মাহবুবুল আলম হানিফ দাবি করেছেন, বিষয়টি একান্তভাবেই বিচার বিভাগ এবং সেনাবাহিনীর হওয়ায় সরকার এই উচ্ছেদের সঙ্গে কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট নয়। তিনি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার মতো করে বিরোধী দলীয় নেতাকে স্বেচ্ছায় বাড়ি ছাড়ার জন্য আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়েছেন।
চেম্বার জজ আদালতে বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা স্থগিতাদেশের আবেদন করেছেন কী করেননি এবং না করে থাকলে কেন করেননি, এসব বিষয়ে ব্যাখ্যা সেই আইনজীবীরাই দেবেন। আমার কথা হলো, এমন একটি বিষয় নিয়ে সারা দেশে যখন তোলপাড় চলছে তখন ‘ন্যায়বিচার’ এবং ঔঁফরপরধষ অপঃরারংস-এর পরাকাষ্ঠা দেখানো প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক আপিল বিভাগে শুনানি শেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত ওই বাড়িতে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে খোলাসা করে সরকারকে নির্দেশ দিলেন না কেন? একজন নাগরিককে তার ৩৮ বছরের গৃহ থেকে এমন অমানবিকভাবে উচ্ছেদের দায় নিয়ে, এই প্রধান বিচারপতিকে একদিন অবশ্যই জনগণের আদালতে জবাবদিহি করতে হবে।
মাহবুবুল আলম হানিফ দাবি করেছেন, এই উচ্ছেদের সঙ্গে সরকার জড়িত নয়। বিরোধী দলীয় নেতাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদের সময় সেখানে র্যাব, পুলিশ এবং সম্ভবত সাদা পোশাক পরিহিত সেনাবাহিনীর যেসব সদস্য উপস্থিত থেকে চরম অমার্জিত পন্থায় জোর খাটিয়েছেন, তারা তাহলে কার নির্দেশ পালন করেছেন? ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড থেকে জারিকৃত জমির বরাদ্দ বাতিলের যে নোটিশের উপর ভিত্তি করে হাইকোর্ট বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিল, সেই নোটিশটিও কি সরকারের নির্দেশ ছাড়াই জারি করা হয়েছিল? সবচেয়ে বড় কথা, সরকার মানে কী? মাহবুবুল আলম হানিফের অদ্ভুত যুক্তি শুনে আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করা নিয়ে সংসদে দেয়া তথ্যমন্ত্রীর বিবৃতির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ঢাকার ডিসি সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে গভীর রাতে আমার দেশ পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করার পর তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ সংসদে বলেছিলেন—পত্রিকা বন্ধের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সরকার জড়িত নয়। সেই সময় দেশের বিবেকসম্পন্ন নাগরিকরা একবাক্যে প্রশ্ন করেছিলেন, ঢাকার ডিসি সরকারের বাইরের লোক হয় কী করে! বেগম খালেদা জিয়ার বাড়ি এবং আমার দেশ নিয়ে সরকারের নির্লজ্জ মিথ্যাচারে মনে হচ্ছে ক্ষমতাসীনরা দেশের ১৬ কোটি নাগরিককে মূর্খই বিবেচনা করেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের মধ্যে আদালত ও সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক নোংরা খেলায় ব্যবহার করার নগ্ন প্রচেষ্টা লক্ষ্যণীয়। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু বিবিসি রেডিওতে দেয়া সাক্ষাত্কারে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ক্যান্টনমেন্টের বাড়িতে থেকে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র করার বায়বীয় অভিযোগ এনেছেন। আওয়ামী লীগের অন্য এক পাতি নেতা এমন উদ্ভট অভিযোগও আনলেন যে, রাষ্টপতি জিয়া ৬ নম্বর মইনুল রোড থেকেই নাকি মুজিব হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। সর্বশেষ গত ক’দিনে সংবাদ মাধ্যমে হঠাত্ তারকা হয়ে ওঠা আইএসপিআর’র জনৈক শাহিনুল ইসলাম, আওয়ামী প্রচারবিদের মতো করে বেগম খালেদা জিয়ার স্বেচ্ছায় বাড়ি ছাড়ার তত্ত্ব নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হয়েছেন। এই লোকটি যে উদ্ধত ভঙ্গি এবং ভাষায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে কথা বলেছেন, আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায় তার মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মর্যাদা বহুলাংশে ক্ষুণ্ন হয়েছে।
খালেদা জিয়া স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে গেছেন—এমন দাবির পেছনে শাহিনুল ইসলাম দুটো যুক্তি হাজির করেছেন। প্রথম যুক্তি, সেনাবাহিনী চাইলে ভোর হওয়ামাত্র বিরোধী দলীয় নেত্রীকে বাড়ি থেকে বার করে দিতে পারত। তিনি যে বিকাল সাড়ে তিনটায় তার ৩৮ বছরের গৃহ ত্যাগ করেছেন, এর মাধ্যমেই নাকি স্বেচ্ছায় যাওয়ার ব্যাপারটি প্রমাণিত হয়ে গেছে। এরপর এই চৌকস কর্মকর্তা অপর ‘মোক্ষম’ যুক্তি পেশ করেছেন। বেগম খালেদা জিয়া তার ব্যক্তিগত ড্রাইভার চালিত গাড়িতে চড়েই ক্যান্টনমেন্ট এলাকা ত্যাগ করেছেন। সরকার জোর করলে তো তাকে প্রিজন ভ্যানে করেই পাঠানো হতো! তিনি অবশ্য প্রিজন ভ্যান শব্দটি উচ্চারণ করেননি। তবে, বেগম খালেদা জিয়ার নিজ ড্রাইভার চালিত গাড়িতে ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ সম্পর্কিত বক্তব্যের এর চেয়ে যথার্থ অর্থ আমি অন্তত বের করতে পারিনি।
আইএসপিআর-এর পরিচালক শাহিনুল ইসলাম কেবল গণমাধ্যমে উচ্ছেদের পক্ষে ওকালতি করেই তার দায়িত্ব সমাপ্ত করেননি। বেগম খালেদা জিয়া বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার একদিন পর তিনি বিশেষভাবে বাছাই করা সাংবাদিকদের মইনুল রোডের বাড়িতে ডেকে নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর চরিত্র হননের ধৃষ্টতাও দেখিয়েছেন। কয়েকটি প্রাপ্তবয়স্কদের পাঠযোগ্য পত্রিকা এবং খালি মদের বোতল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সাজিয়ে টেলিভিশনে দেখিয়ে নীতিনির্ধারকরা তাদের পূতিগন্ধময় মানসিকতাই জাতির সামনে উন্মোচিত করেছেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিধবা স্ত্রীর বাড়ি সংক্রান্ত এই ট্রাজিক, স্পর্শকাতর বিষয়ে সেনাবাহিনীর মুখপাত্র রূপে পরিচিত আইএসপিআরকে এভাবে জড়িত করার সিদ্ধান্ত কত ওপরের ‘উর্বর’ মস্তিষ্ক থেকে এসেছে, সেই তথ্য আমার মতো অতি সাধারণ নাগরিকের জানার কোনো উপায় নেই। তবে এই অতীব গর্হিত কাজটির মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে আরও বিতর্কিত না করাটাই বোধহয় বুদ্ধিমানের কাজ হতো। এমনিতে এক এগারোর হঠকারিতা এবং বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ধাক্কা সামলাতেই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার মহান দায়িত্বে নিয়োজিত এই বাহিনীর দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। এই তিনদিনের চরম হঠকারী এবং অবিমৃষ্যকারী আচরণে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ও মর্যাদার যে ক্ষতি হয়েছে, তা ঘটা করে জাতিসংঘে সর্বাধিক সৈন্য প্রেরণের সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে কতটুকু নিরাময় করা গেছে তার নির্ণয় দুরূহ।
আমার বিশ্বাস, একটি দেশের সেনাবাহিনীর প্রধান কর্তব্য বহিশত্রুর আক্রমণ থেকে সেই দেশের নিরাপত্তা বিধান করা, বিদেশে শান্তিমিশনে সৈন্য প্রেরণ নয়। অবশ্য এই মাথা হেট করা ঘটনার মধ্য দিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার দল, বিএনপি’র একটা বড় উপকার সাধিত হয়েছে। এতদিন ধরে আওয়ামী বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়াগোষ্ঠী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে ক্যান্টনমেন্টে সৃষ্ট অভিহিত করে নানা রকম উপহাস করত। বেগম খালেদা জিয়াকে বাস্তুচ্যুত করার কার্যক্রমে সেনাবাহিনী ও আইএসপিআর-এর বিতর্কিত ভূমিকার পর বিএনপিকে অন্তত সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংযোগের দায়ে আর অভিযুক্ত করা যাবে না। দায়টা এখন থেকে আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে।
একদা চরমভাবে সেনাবিদ্বেষী ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর ইদানীংকার প্রগাঢ় বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ আমার দেশ পত্রিকার একটি অভিজ্ঞতার কথাও বর্ণনা করা যেতে পারে। আমার গ্রেফতারের মুহূর্তে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে আমার সম্পাদিত পত্রিকাটি দ্বিতীয় জনপ্রিয় ছিল এবং হার্ড কপি বিক্রিতে আমরা ছিলাম চতুর্থ স্থানে। অথচ এমন একটি জনপ্রিয় এবং স্বাধীনতার পক্ষের পত্রিকার ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় প্রবেশাধিকার নেই। সেখানকার হকারদের আমার দেশ বিক্রয়ের ওপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ক্যান্টনমেন্টের লাইব্রেরিসমূহে আমার দেশ রাখা হয় না। শুধু তাই নয়, সেনাবাহিনীর কোনো সদস্য হকারকে আমার দেশ দিতে বললে বিষয়টি সামরিক গোয়েন্দাদের জানানোর নির্দেশ আছে। এ দেশে গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের হাল-হকিকত বোঝার জন্য ক্যান্টনমেন্ট এলাকার এই একটি উদাহরণই যথেষ্ট।
দুই মাস সাত দিনের মাথায় বন্দি জীবনের দ্বিতীয় ঈদ পালন করলাম। ঈদুল ফিতরের সময় ঢাকা জেলে ছিলাম। মনে আছে, সেদিন সাত নম্বর সেলের প্রতিবেশী ফয়সালের অতিথি হয়ে তার বাসা থেকে পাঠানো পোলাও, কোর্মা পেট পুরে খেয়েছিলাম। এবার খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন নিজেই করেছি। গতকালই পিসির টাকায় কেজি দশেক বড় সাইজের রসগোল্লা আনিয়ে রেখেছিলাম। ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে বন্দি, কারারক্ষী নির্বিশেষে যেই আজ এসেছে, একটা করে মিষ্টি ধরিয়ে দিয়েছি। দুপুরে গরু এবং খাসি দুই রকম গোস্ত এবং পোলাও-এর আয়োজন ছিল। সব ব্যবস্থা কালাম একাই করেছে। বন্দিত্বের কারণে ঈদের জামাতে অংশগ্রহণ না করলেও একদিনের এই উন্নত খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন প্রধানত প্রতিবেশীদের সঙ্গে একত্রে বসে একবেলা খাওয়ার জন্যই করেছি। প্রায় পঞ্চাশজন মানুষের সঙ্গে একটা দিন গল্প-গুজব করে খেতে বড় আনন্দ লাগল।
আহারের সুযোগ-সুবিধায় কাশিমপুর জেলে যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যেই আছি। এত বড় জেলে আমি একমাত্র ডিভিশনপ্রাপ্ত কয়েদি। পিসির টাকা দিয়ে যথেচ্ছ বাজারে প্রশাসন থেকে কোনো বাধা নেই। কালাম আবার এসব বিষয়ে দারুণ চৌকস। একে মেট, তার ওপর জেল রেকর্ড ভালো থাকায় জেল প্রশাসনেও কালামের যথেষ্ট প্রভাব-প্রতিপত্তি। সুতরাং, নাজিমউদ্দিন রোডের জেল জীবনের মতো চাপিলা, কাচকি দিয়ে এখানে ভাত খেতে হচ্ছে না। পরবর্তী জেলে চালানে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছে শরীরের হারানো ওজন বেশ খানিকটা ফিরে পাওয়া যাবে। সমস্যার মধ্যে সপ্তাহে বারতিনেক প্রিজন ভ্যানে চড়ে পুরনো ঢাকার সিএমএম আদালতে যাওয়া-আসা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার বর্তমান অবস্থাটা জানতে পারলে হয়তো সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে যাবেন। মাহমুদুর রহমানকে নিয়ে কী করা? ব্যাটাকে ঢাকার সাত নম্বর সেলে রেখে খাওয়া-দাওয়ায় টাইট দেয়া, নাকি কাশিমপুর থেকে প্রিজন ভ্যানে চক্কর দেওয়ানো? আমার অবশ্য কোনোটাতেই বিশেষ কোনো অসুবিধা নেই। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র কাছে কায়মনোবাক্যে আত্মসমর্পণের সুবিধাটাই এখানে।
কাশিমপুর আসার একমাস পর মা’র সঙ্গে আজই প্রথম দেখা হলো। জুনের পয়লা তারিখ সকালে কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হওয়ার পর বিগত প্রায় ছয় মাসে এটা মায়ের সঙ্গে তৃতীয় সাক্ষাত্। দেখলাম তিনি আরও রোগা হয়েছেন। ঘণ্টা খানেকের সাক্ষাতে যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছেন। বরং পারভীনই পারেনি। বন্দিত্বের মেয়াদ যত দীর্ঘ হচ্ছে, দেখতে পাচ্ছি আমার স্ত্রী ততটাই দুর্বল হয়ে পড়ছে। ঘরে-বাইরের সব বোঝা ওর একাকী কাঁধে। আর্টিজান বিক্রির প্রক্রিয়া চলছে, কোম্পানি হস্তান্তরের যত ধকল পারভীনকেই সামলাতে হচ্ছে। এদিকে আমার দেশ’র নানাবিধ সমস্যা তো আছেই। সর্বোপরি আমার অর্ধশত মামলার দেন-দরবার। পারভীনের তুলনায় আমিই জেলে অনেক শান্তিতে আছি। নিয়মিত খাচ্ছি-দাচ্ছি, নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছি।
ঈদোত্তর দেখায় কথামত বাবলু ও বেলী এসেছিল। সুপ্রিমকোর্টে আমার মামলা চলাকালীন বাবলু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কষ্ট করে প্রতিদিন এসেছে। আমার সহোদরপ্রতিম বাল্যবন্ধুর ঋণ এই জীবনে আর শোধ করতে পারব না। আমি জেলে আসার পর থেকে বোধহয় এমন একটি দিনও যায়নি যেদিন বাবলু অথবা বেলী বাসার খোঁজখবর নেয়নি। আজ জেলগেট থেকে বিদায় নেয়ার সময় বেলীও তার অশ্রু আটকাতে পারেনি। ওদের একমাত্র কন্যা সারাহ’র কথাও বার বার মনে পড়ছিল। মুক্ত জীবনে আমরা পাঁচজন মাসে অন্তত একবার বাইরে খেতে যেতাম। বাবলুকে বললাম, জেল থেকে যদি ছাড়া না পাই তাহলে আমার সংসারের দায়িত্ব তারই। এই চরম স্বার্থপর জগতে এমন বন্ধুভাগ্য ক’জনের হয়?
No comments