১২- মুক্তি পেলেও ইসলামবিদ্বেষী এই সরকার আমাকে হজে যেতে দেবে কিনা কে জানে
বড় সাহেবের পদধূলি মানেই দুঃসংবাদ
... দুপুরে জেল ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে টিপু সুলতান এসে হাজির। জেলখানায় আসামির কাছে বড় সাহেবের পদধূলি দিতে আসা মানেই হলো কিছু একটা সংবাদ আছে। আর শতকরা নব্বইভাগ ক্ষেত্রে সেটি দুঃসংবাদই হয়ে থাকে। .....
... দুপুরে জেল ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে টিপু সুলতান এসে হাজির। জেলখানায় আসামির কাছে বড় সাহেবের পদধূলি দিতে আসা মানেই হলো কিছু একটা সংবাদ আছে। আর শতকরা নব্বইভাগ ক্ষেত্রে সেটি দুঃসংবাদই হয়ে থাকে। .....
আজ হজ। আল্লাহুমা লাব্বায়েক, হে আল্লাহ আমি হাজির। এহরাম পরনে লাখ লাখ বান্দার কণ্ঠে এই ধ্বনি শুনলে গায়ে কাঁটা দেয়। মা আর পারভীনকে সঙ্গে নিয়ে ২০০৩ সালে হজে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। তবে সেবার বড় ব্যস্ততার মধ্যে হজ সম্পন্ন করেছিলাম। এ বছর হাতে সময় নিয়ে আরও একবার আমাদের মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর স্মৃতিবিজড়িত সেই পবিত্র ভূমিতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, সরকারের রোষানলের কারণে সম্ভব হয়নি। পাশের সেলের কালামের রেডিও থেকে ভেসে আসা আল্লাহুমা লাব্বায়েক ধ্বনি শুনছি আর মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে আত্মসমর্পণের জন্যে মনটা আরাফাতের ময়দানে ছুটে যাচ্ছে। জেল থেকে মুক্তি পেলেও ইসলামবিদ্বেষী বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকা পর্যন্ত আমাকে হজ করতে যেতে দেবে কিনা, তা-ই বা কে জানে। তবে আল্লাহর কাছ থেকে ডাক এলে বাধা দেয় এমন সাধ্য কার?
দুপুরে জেল ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে টিপু সুলতান এসে হাজির। জেলখানায় আসামির কাছে বড় সাহেবের পদধূলি দিতে আসা মানেই হলো কিছু একটা সংবাদ আছে। আর শতকরা নব্বই ভাগ ক্ষেত্রে সেটি দুঃসংবাদই হয়ে থাকে। কাশিমপুর জেলের বড় সাহেব সংবাদ দিয়ে গেল কক্সবাজারের মানহানি মামলায় হাজিরা দিতে আমাকে এবার সেখানে যেতে হবে। অন্য বন্দিরা এত দূরের জেলখানায় চালানে যাওয়ার সংবাদে বিচলিত বোধ করলেও আমার শুনে ভালোই লাগল। দীর্ঘদিন সলিটারি কনফাইনমেন্টে আটক থেকে হাঁপিয়ে ওঠার পর এটাও একধরনের হাওয়া বদল। তার ওপর স্থানটি কক্সবাজার। সমুদ্র দর্শন হবে কিনা জানি না, তবে সমুদ্রের এই হাতছানিতে মনটা উদাস হয়ে গেল। মামলাজটের কারণে চালানে যাওয়া নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা এখনও অবশ্য আছে। কক্সবাজার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আমার হাজিরার তারিখ ২৫ নভেম্বর। এদিকে ২৪ নভেম্বর অন্য একটি মামলায় ঢাকায় হাজিরা। ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট কৃপা প্রদর্শন করে তাড়াতাড়ি সেখানে হাজিরার আনুষ্ঠানিকতা শেষ করলেও দুপুর বারোটার আগে বাহাদুর শাহ্ পার্ক থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করা সম্ভব হবে না। ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রাস্তাঘাটের যে অবস্থা, তাতে আমাকে মাইক্রোবাসে নিলেও ১৪-১৫ ঘণ্টার কমে পৌঁছানো যাবে না। আর প্রিজন ভ্যানে চড়ালে তো পাক্কা ২৪ ঘণ্টার ধাক্কা। গোপালগঞ্জ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে ধরে নিচ্ছি, শেষ পর্যন্ত একটা মাইক্রোবাসই হয়তো সদাশয় সরকার বরাদ্দ দেবে। অর্থাত্ কোনো অবস্থাতেই ফজরের আগে পৌঁছানো যাচ্ছে না। সুপারকে জানালাম, তাদের চালক এত দীর্ঘপথ গাড়ি চালিয়ে সুস্থ থাকলে আমার কোনো সমস্যা নেই। সেই সঙ্গে রসিকতা করে বললাম, সদাশয় সরকার একটা হেলিকপ্টার দিলে দু’দিনের মধ্যে এই ঢাকা-কক্সবাজার করাটা অনেক সহজ হতো। টিপু সুলতান যাওয়ার আগে বলে গেল, আচ্ছা আমি একটু আইজি স্যারের সঙ্গে আলাপ করে দেখি। সেই আলাপে আনুষ্ঠানিকতা রক্ষা হলেও ফায়দা যে কিছু হবে না, সেকথা বলে তরুণ কারা অফিসারটিকে আর বিব্রত করলাম না। প্রধানমন্ত্রী আমাকে যথাসাধ্য হয়রানি করার জন্যেই জেলে পুরেছেন। জেলে জেলে চালানে প্রেরণ সেই হয়রানিরই অবধারিত অংশ। সুতরাং তিনি আমাকে কক্সবাজার নিতে চাইলে আইজি’র ঘাড়ে মাথা একখানাই। তাছাড়া জেলের সবচেয়ে বড় কর্তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কও এমন কিছু মধুর নয়। সুপার সেল থেকে যাওয়ামাত্র আসন্ন সমুদ্র সৈকত ভ্রমণে দুই-একখানা কাপড়-চোপড় যা নিতে হবে, তার একটা বন্দোবস্ত করে ফেললাম। এখানে তো অখণ্ড অবসর, কাজ একটা পেলে তবু খানিকটা সময় কাটে। ব্যাগ গোছানো হয়ে গেল। এবার আগামী দেখা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকব কক্সবাজার ভ্রমণের খবরটা বাসায় পাঠানোর জন্যে। ১৮ তারিখে ঈদের দেখায় পারভীন আসবে মা, বাবলু আর ওর বউ বেলীকে নিয়ে।
আজ জেলের এক ঘটনায় মনটা বড় খারাপ হয়ে গেছে। এখানকার কয়েদিদের মধ্যে যে কয়েকজন সেন্ট্রি, জমাদারের সতর্ক চোখ এড়িয়ে আমার খোঁজখবর নেয়, তার মধ্যে এক তরুণকে আমি বেশ পছন্দ করি। ছেলেটি তার পাঁচ বছরের জেলজীবনে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করার পাশাপাশি ল’তেও গ্র্যাজুয়েশন করেছে। সাধারণ বন্দির দুঃসহ জীবনে এমন অধ্যবসায় আমি ভাবতেও পারি না। লেখাপড়ার এই মনোযোগ দেখে বয়সে তরুণ হলেও আমি ওর প্রতি খানিকটা শ্রদ্ধাও পোষণ করি। প্রথম দিনের পরিচয়ের ঘটনাটা আগে বলে নিই। আমি এখানে আসার ক’দিন পর বারান্দায় চেয়ার পেতে একাকী বসে আছি। এক অচেনা তরুণ বারান্দার মুখের লোহার দরজায় ঝোলানো পর্দাটা সরিয়ে বাইরে থেকে সালাম দিয়ে লাজুক মুখে বললো, স্যার ভেতরে আসতে পারি? আমি ততদিনে সলিটারি কনফাইনমেন্টে থেকে কারও সঙ্গে কথা বলার জন্যে কিছুটা ব্যাকুল হয়ে উঠেছি। নির্ভেজাল আনন্দ সহকারে বললাম, অবশ্যই। হালকা-পাতলা গড়নের ছেলেটি যথেষ্ট শ্রদ্ধাভক্তি নিয়ে আমার লেখালেখির বিষয়ে কথা বললো। সেই এক-এগারো থেকে আমার প্রতিটা লেখা নাকি সে পড়েছে। জেলের বাইরের এবং ভেতরের পরিস্থিতি নিয়েও খানিকটা আলাপ হলো। প্রথম দিন ওই পর্যন্তই।
এরপর থেকে সপ্তাহে বারদুয়েক আসতো। কথা প্রসঙ্গে ছেলেটির যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে শুনে দুঃখিত হলেও মামলার বিষয়ে নিজ থেকে কোনো প্রশ্ন করিনি। ছেলেটিও আর কিছু বলেনি। আজ একজন কারারক্ষী সেই মামলার কথাই বলে গেল। সেই থেকে কিছুই ভালো লাগছে না। কারারক্ষীর গল্পের সঙ্গে ছেলেটিকে একেবারেই মেলাতে পারছি না। ভদ্র, বিনয়ী, মিষ্টভাষী ছেলেটির নাকি আড়াই বছরের এক শিশুহত্যার অভিযোগে নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। একই ঘটনায় অপহরণ এবং হত্যার দু’টি পৃথক মামলা হয়েছে। অপহরণের মামলার বিচার প্রক্রিয়া নিম্ন আদালতে সমাপ্তির পর এখন হত্যা মামলা চলছে। সেই মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত হলে কী সাজা হতে পারে, সেটি আন্দাজ করা শক্ত নয়।
আমার আঘাতের তখনও শেষ হয়নি। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো যখন শুনলাম নিষ্পাপ শিশুটি ওরই আপন চাচাত ভাই। বিত্তবান চাচার নাকি ওই একটিই পুত্রসন্তান ছিল। নিতান্ত মধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবী ভাতিজাকে চাচা-চাচী দু’জনই যথেষ্ট স্নেহ করতেন। আড়াই বছরের শিশুটি প্রায়ই চাচাত ভাইয়ের সঙ্গে এখানে-সেখানে বেড়াতে যায়। হঠাত্ একদিন সেই শিশু নিখোঁজ। দু’দিন পর মুক্তিপণের জন্যে ফোন এলো, অসহায় পিতা সেটা দিতেও রাজি হলেন। কিন্তু সন্তানের আর খোঁজ মেলে না। শেষ পর্যন্ত পুলিশ শিশুটির হদিস পেলেও ততক্ষণে বড় দেরি হয়ে গেছে। মফস্বল শহরের এক বাড়ির মেঝে খুঁড়ে পাঁচদিন পর মায়ের সাজিয়ে দেয়া পোশাকেই তার নিথর দেহ উদ্ধার হলো। সেই বাড়িটি কাশিমপুর জেলে আমার সঙ্গে আলাপ হওয়া তরুণটির ঘনিষ্ঠ বন্ধুর। মামলার ছক মেলানো হলো। মোটা টাকা মুক্তিপণ আদায়ের জন্যে দুই বন্ধু যুক্তি করে শিশুটিকে অপহরণ করেছিল। মেরে ফেলার উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু অবুঝ শিশু, সারাক্ষণ মায়ের জন্যে কাঁদে। অতএব চটজলদি সমাধান, ঘুমের ওষুধ। মা-হারা ফুটফুটে শিশুটি মাত্র দু’দিন বেঁচে ছিল। অপহরণের তৃতীয় দিনেই আনাড়ি হাতে ঘুমের ওষুধের মাত্রা বেশি হয়ে গেল। বন্ধুটির ঘরেই মাটি খুঁড়ে লাশ চাপা দেয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
এদিকে অর্ধ-উন্মাদিনী ছেলেহারা জননী ছোট শহরের বাড়িতে বাড়িতে বুক চাপড়ে একমাত্র সন্তানকে খুঁজে ফিরছে। একসময় সবার সন্দেহ গিয়ে পড়ে ভাতিজার ওপর। তারপর খুনের রহস্য ভেদ করতে পুলিশের তেমন একটা সমস্যা হয়নি। মামলার প্রতি শুনানিতে শোকাতুরা মা এখনও আদালতে আসেন। তার একটাই দাবি, অপরাধীর সাজার দরকার নেই, শুধু আমার ছেলে ফিরিয়ে দাও। আদালতে যেদিন এই মামলা ওঠে, সেদিন মায়ের আহাজারি শুনে কেউই সেখানে চোখের পানি আটকে রাখতে পারে না। গল্প শেষ করে কারারক্ষী চলে যাওয়ার পর দীর্ঘক্ষণ স্থাণুর মতো চেয়ারে বসে থাকলাম। আসামি আমার কেউ না, ক’দিন আগে মাত্র পরিচয়। কিন্তু এমন হতাশা ও লজ্জাবোধ করছিলাম যে, মনে হয়েছে আমার কোনো আত্মীয় যেন এই ঘৃণ্য অপরাধ করে ফেলেছে। চোখ বুজলেই আদালতে আলুথালু বেশে, উদভ্রান্ত এক জননীকে কাঁদতে দেখছিলাম। দুপুরে খাওয়ায় রুচি হলো না। কালামকে শুধু এক কাপ চা দিতে বললে ও অবাক হয়ে আমার শরীর খারাপ কিনা জানতে চাইল। জবাবে অর্থহীন মাথা নেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। গতকালই মাত্র তরুণটি আমাকে অনুরোধ করেছিল মুক্তি পেলে আমি যেন মামলার তদবিরে ওর বাবাকে সাহায্য করি। জেলের এই বিচিত্র মানুষদেরই কাহিনী নিয়ে অসাধারণ কথাশিল্পী জরাসন্ধ তার লৌহকপাটের পাতার পর পাতা সাজিয়েছেন। আমার সেই ক্ষমতা নেই।
আধপেট খেয়ে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে কী লাভ হলো, স্যার? সংসারযুদ্ধে পরাজিত, দরিদ্র একজন কারারক্ষীর বেদনামাখা এই প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারিনি। তিরিশ বছর ধরে কারারক্ষীর সামান্য চাকরি করে দুই ছেলেমেয়েকে অনেক কষ্টে পড়াশোনা করিয়েছিল বরিশালের সাত্তার মিঞা (ছদ্মনাম)। ছেলে আর মেয়ের মধ্যে সে কোনো ফারাক করেনি। ছেলে এইচএসসি পাস করে বিডিআরে সৈনিকের চাকরি নিয়েছিল। মনে অসীম সুখ নিয়ে অবসরে যাওয়ার দিন গুনছিল নির্বিরোধী ভালো মানুষ সাত্তার। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি, এই একটিমাত্র দিনে সাত্তারের সব স্বপ্ন ধূলিসাত্ হয়ে গেল। পিলখানায় সেদিনের ঘৃণ্য ও বর্বর হত্যাকাণ্ডে সাত্তার মিঞার ছেলের কোনো সংস্রব না থাকলেও সেখানে উপস্থিত থাকার কারণে সে বন্দি হলো। সেই থেকে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে জেলে বন্দি থেকে বিচারের প্রতীক্ষা করছে। পিতা এক জেলে কারারক্ষী, আর পুত্র অন্য জেলে আসামি। ট্র্যাজিক নাটক, সিনেমাকেও হার মানায় জীবনের এই বাস্তবতা। ছেলের সঙ্গে বিচার শেষ হওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে উত্কণ্ঠিত পিতাও। কিন্তু অপেক্ষার পালা শেষ হয় কই?
এর মধ্যে মেয়েটি এমএ পাস করে একটা চাকরির জন্যে হন্যে হয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশে চাকরি কোথায়? বাধা তো একটি নয়, একাধিক। প্রথম বাধা স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের কাছ থেকে ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী হওয়ার সার্টিফিকেট লাগবে। মেয়ে যেহেতু কখনও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল না, তাই সেই প্রত্যয়নপত্র পেতে জায়গামত বিশাল অংকের খরচাপাতি প্রয়োজন। কোনোক্রমে প্রথম বাধা পার হতে পারলেও দ্বিতীয় আরও বৃহত্ বাধা পথ আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রাইমারি স্কুলের একজন শিক্ষকের চাকরির ঘুষের বাজারদর এখন কমপক্ষে তিন লাখ টাকা। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় এমন একজন কারারক্ষীর কাছে তিন লাখ টাকার অংক প্রায় রাজার ধনের সমপরিমাণ। ছেলের শোকে আর অনূঢ়া কন্যার দুশ্চিন্তায় সাত্তার মিঞার স্ত্রী অনেক আগেই বিছানা নিয়েছে। কায়ক্লেশে জীবনধারণ করে আছে সেই কঙ্কালসার জননী। বিডিআর বিদ্রোহের সঙ্গে এই পরিবারের আশার সব প্রদীপ নির্বাপিত হয়েছে। রাষ্ট্রের বঞ্চনা ও শাসকের নিপীড়নের শিকার এদেশের অজস্র নাগরিকের একজন হয়ে আমার সামনে এখন দাঁড়িয়ে কাশিমপুর জেলের কারারক্ষী সাত্তার। আমি নির্বাক বসে ভাবছি, সরকার পরিবর্তন হলেই কি সাত্তারের ভাগ্য পরিবর্তন হবে? তার চোখের ভাষা থেকে বুঝতে পারছি, সে আমার কাছ থেকে আশার বাণী শুনতে চাচ্ছে। কিন্তু তার একমাত্র ছেলের মুক্তি এবং মেয়ের চাকরির আশ্বাস দিতে পারি এমন ক্ষমতা আমার কই?
দুপুরে জেল ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে টিপু সুলতান এসে হাজির। জেলখানায় আসামির কাছে বড় সাহেবের পদধূলি দিতে আসা মানেই হলো কিছু একটা সংবাদ আছে। আর শতকরা নব্বই ভাগ ক্ষেত্রে সেটি দুঃসংবাদই হয়ে থাকে। কাশিমপুর জেলের বড় সাহেব সংবাদ দিয়ে গেল কক্সবাজারের মানহানি মামলায় হাজিরা দিতে আমাকে এবার সেখানে যেতে হবে। অন্য বন্দিরা এত দূরের জেলখানায় চালানে যাওয়ার সংবাদে বিচলিত বোধ করলেও আমার শুনে ভালোই লাগল। দীর্ঘদিন সলিটারি কনফাইনমেন্টে আটক থেকে হাঁপিয়ে ওঠার পর এটাও একধরনের হাওয়া বদল। তার ওপর স্থানটি কক্সবাজার। সমুদ্র দর্শন হবে কিনা জানি না, তবে সমুদ্রের এই হাতছানিতে মনটা উদাস হয়ে গেল। মামলাজটের কারণে চালানে যাওয়া নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা এখনও অবশ্য আছে। কক্সবাজার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আমার হাজিরার তারিখ ২৫ নভেম্বর। এদিকে ২৪ নভেম্বর অন্য একটি মামলায় ঢাকায় হাজিরা। ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট কৃপা প্রদর্শন করে তাড়াতাড়ি সেখানে হাজিরার আনুষ্ঠানিকতা শেষ করলেও দুপুর বারোটার আগে বাহাদুর শাহ্ পার্ক থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করা সম্ভব হবে না। ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রাস্তাঘাটের যে অবস্থা, তাতে আমাকে মাইক্রোবাসে নিলেও ১৪-১৫ ঘণ্টার কমে পৌঁছানো যাবে না। আর প্রিজন ভ্যানে চড়ালে তো পাক্কা ২৪ ঘণ্টার ধাক্কা। গোপালগঞ্জ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে ধরে নিচ্ছি, শেষ পর্যন্ত একটা মাইক্রোবাসই হয়তো সদাশয় সরকার বরাদ্দ দেবে। অর্থাত্ কোনো অবস্থাতেই ফজরের আগে পৌঁছানো যাচ্ছে না। সুপারকে জানালাম, তাদের চালক এত দীর্ঘপথ গাড়ি চালিয়ে সুস্থ থাকলে আমার কোনো সমস্যা নেই। সেই সঙ্গে রসিকতা করে বললাম, সদাশয় সরকার একটা হেলিকপ্টার দিলে দু’দিনের মধ্যে এই ঢাকা-কক্সবাজার করাটা অনেক সহজ হতো। টিপু সুলতান যাওয়ার আগে বলে গেল, আচ্ছা আমি একটু আইজি স্যারের সঙ্গে আলাপ করে দেখি। সেই আলাপে আনুষ্ঠানিকতা রক্ষা হলেও ফায়দা যে কিছু হবে না, সেকথা বলে তরুণ কারা অফিসারটিকে আর বিব্রত করলাম না। প্রধানমন্ত্রী আমাকে যথাসাধ্য হয়রানি করার জন্যেই জেলে পুরেছেন। জেলে জেলে চালানে প্রেরণ সেই হয়রানিরই অবধারিত অংশ। সুতরাং তিনি আমাকে কক্সবাজার নিতে চাইলে আইজি’র ঘাড়ে মাথা একখানাই। তাছাড়া জেলের সবচেয়ে বড় কর্তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কও এমন কিছু মধুর নয়। সুপার সেল থেকে যাওয়ামাত্র আসন্ন সমুদ্র সৈকত ভ্রমণে দুই-একখানা কাপড়-চোপড় যা নিতে হবে, তার একটা বন্দোবস্ত করে ফেললাম। এখানে তো অখণ্ড অবসর, কাজ একটা পেলে তবু খানিকটা সময় কাটে। ব্যাগ গোছানো হয়ে গেল। এবার আগামী দেখা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকব কক্সবাজার ভ্রমণের খবরটা বাসায় পাঠানোর জন্যে। ১৮ তারিখে ঈদের দেখায় পারভীন আসবে মা, বাবলু আর ওর বউ বেলীকে নিয়ে।
আজ জেলের এক ঘটনায় মনটা বড় খারাপ হয়ে গেছে। এখানকার কয়েদিদের মধ্যে যে কয়েকজন সেন্ট্রি, জমাদারের সতর্ক চোখ এড়িয়ে আমার খোঁজখবর নেয়, তার মধ্যে এক তরুণকে আমি বেশ পছন্দ করি। ছেলেটি তার পাঁচ বছরের জেলজীবনে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করার পাশাপাশি ল’তেও গ্র্যাজুয়েশন করেছে। সাধারণ বন্দির দুঃসহ জীবনে এমন অধ্যবসায় আমি ভাবতেও পারি না। লেখাপড়ার এই মনোযোগ দেখে বয়সে তরুণ হলেও আমি ওর প্রতি খানিকটা শ্রদ্ধাও পোষণ করি। প্রথম দিনের পরিচয়ের ঘটনাটা আগে বলে নিই। আমি এখানে আসার ক’দিন পর বারান্দায় চেয়ার পেতে একাকী বসে আছি। এক অচেনা তরুণ বারান্দার মুখের লোহার দরজায় ঝোলানো পর্দাটা সরিয়ে বাইরে থেকে সালাম দিয়ে লাজুক মুখে বললো, স্যার ভেতরে আসতে পারি? আমি ততদিনে সলিটারি কনফাইনমেন্টে থেকে কারও সঙ্গে কথা বলার জন্যে কিছুটা ব্যাকুল হয়ে উঠেছি। নির্ভেজাল আনন্দ সহকারে বললাম, অবশ্যই। হালকা-পাতলা গড়নের ছেলেটি যথেষ্ট শ্রদ্ধাভক্তি নিয়ে আমার লেখালেখির বিষয়ে কথা বললো। সেই এক-এগারো থেকে আমার প্রতিটা লেখা নাকি সে পড়েছে। জেলের বাইরের এবং ভেতরের পরিস্থিতি নিয়েও খানিকটা আলাপ হলো। প্রথম দিন ওই পর্যন্তই।
এরপর থেকে সপ্তাহে বারদুয়েক আসতো। কথা প্রসঙ্গে ছেলেটির যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে শুনে দুঃখিত হলেও মামলার বিষয়ে নিজ থেকে কোনো প্রশ্ন করিনি। ছেলেটিও আর কিছু বলেনি। আজ একজন কারারক্ষী সেই মামলার কথাই বলে গেল। সেই থেকে কিছুই ভালো লাগছে না। কারারক্ষীর গল্পের সঙ্গে ছেলেটিকে একেবারেই মেলাতে পারছি না। ভদ্র, বিনয়ী, মিষ্টভাষী ছেলেটির নাকি আড়াই বছরের এক শিশুহত্যার অভিযোগে নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। একই ঘটনায় অপহরণ এবং হত্যার দু’টি পৃথক মামলা হয়েছে। অপহরণের মামলার বিচার প্রক্রিয়া নিম্ন আদালতে সমাপ্তির পর এখন হত্যা মামলা চলছে। সেই মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত হলে কী সাজা হতে পারে, সেটি আন্দাজ করা শক্ত নয়।
আমার আঘাতের তখনও শেষ হয়নি। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো যখন শুনলাম নিষ্পাপ শিশুটি ওরই আপন চাচাত ভাই। বিত্তবান চাচার নাকি ওই একটিই পুত্রসন্তান ছিল। নিতান্ত মধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবী ভাতিজাকে চাচা-চাচী দু’জনই যথেষ্ট স্নেহ করতেন। আড়াই বছরের শিশুটি প্রায়ই চাচাত ভাইয়ের সঙ্গে এখানে-সেখানে বেড়াতে যায়। হঠাত্ একদিন সেই শিশু নিখোঁজ। দু’দিন পর মুক্তিপণের জন্যে ফোন এলো, অসহায় পিতা সেটা দিতেও রাজি হলেন। কিন্তু সন্তানের আর খোঁজ মেলে না। শেষ পর্যন্ত পুলিশ শিশুটির হদিস পেলেও ততক্ষণে বড় দেরি হয়ে গেছে। মফস্বল শহরের এক বাড়ির মেঝে খুঁড়ে পাঁচদিন পর মায়ের সাজিয়ে দেয়া পোশাকেই তার নিথর দেহ উদ্ধার হলো। সেই বাড়িটি কাশিমপুর জেলে আমার সঙ্গে আলাপ হওয়া তরুণটির ঘনিষ্ঠ বন্ধুর। মামলার ছক মেলানো হলো। মোটা টাকা মুক্তিপণ আদায়ের জন্যে দুই বন্ধু যুক্তি করে শিশুটিকে অপহরণ করেছিল। মেরে ফেলার উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু অবুঝ শিশু, সারাক্ষণ মায়ের জন্যে কাঁদে। অতএব চটজলদি সমাধান, ঘুমের ওষুধ। মা-হারা ফুটফুটে শিশুটি মাত্র দু’দিন বেঁচে ছিল। অপহরণের তৃতীয় দিনেই আনাড়ি হাতে ঘুমের ওষুধের মাত্রা বেশি হয়ে গেল। বন্ধুটির ঘরেই মাটি খুঁড়ে লাশ চাপা দেয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
এদিকে অর্ধ-উন্মাদিনী ছেলেহারা জননী ছোট শহরের বাড়িতে বাড়িতে বুক চাপড়ে একমাত্র সন্তানকে খুঁজে ফিরছে। একসময় সবার সন্দেহ গিয়ে পড়ে ভাতিজার ওপর। তারপর খুনের রহস্য ভেদ করতে পুলিশের তেমন একটা সমস্যা হয়নি। মামলার প্রতি শুনানিতে শোকাতুরা মা এখনও আদালতে আসেন। তার একটাই দাবি, অপরাধীর সাজার দরকার নেই, শুধু আমার ছেলে ফিরিয়ে দাও। আদালতে যেদিন এই মামলা ওঠে, সেদিন মায়ের আহাজারি শুনে কেউই সেখানে চোখের পানি আটকে রাখতে পারে না। গল্প শেষ করে কারারক্ষী চলে যাওয়ার পর দীর্ঘক্ষণ স্থাণুর মতো চেয়ারে বসে থাকলাম। আসামি আমার কেউ না, ক’দিন আগে মাত্র পরিচয়। কিন্তু এমন হতাশা ও লজ্জাবোধ করছিলাম যে, মনে হয়েছে আমার কোনো আত্মীয় যেন এই ঘৃণ্য অপরাধ করে ফেলেছে। চোখ বুজলেই আদালতে আলুথালু বেশে, উদভ্রান্ত এক জননীকে কাঁদতে দেখছিলাম। দুপুরে খাওয়ায় রুচি হলো না। কালামকে শুধু এক কাপ চা দিতে বললে ও অবাক হয়ে আমার শরীর খারাপ কিনা জানতে চাইল। জবাবে অর্থহীন মাথা নেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। গতকালই মাত্র তরুণটি আমাকে অনুরোধ করেছিল মুক্তি পেলে আমি যেন মামলার তদবিরে ওর বাবাকে সাহায্য করি। জেলের এই বিচিত্র মানুষদেরই কাহিনী নিয়ে অসাধারণ কথাশিল্পী জরাসন্ধ তার লৌহকপাটের পাতার পর পাতা সাজিয়েছেন। আমার সেই ক্ষমতা নেই।
আধপেট খেয়ে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে কী লাভ হলো, স্যার? সংসারযুদ্ধে পরাজিত, দরিদ্র একজন কারারক্ষীর বেদনামাখা এই প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারিনি। তিরিশ বছর ধরে কারারক্ষীর সামান্য চাকরি করে দুই ছেলেমেয়েকে অনেক কষ্টে পড়াশোনা করিয়েছিল বরিশালের সাত্তার মিঞা (ছদ্মনাম)। ছেলে আর মেয়ের মধ্যে সে কোনো ফারাক করেনি। ছেলে এইচএসসি পাস করে বিডিআরে সৈনিকের চাকরি নিয়েছিল। মনে অসীম সুখ নিয়ে অবসরে যাওয়ার দিন গুনছিল নির্বিরোধী ভালো মানুষ সাত্তার। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি, এই একটিমাত্র দিনে সাত্তারের সব স্বপ্ন ধূলিসাত্ হয়ে গেল। পিলখানায় সেদিনের ঘৃণ্য ও বর্বর হত্যাকাণ্ডে সাত্তার মিঞার ছেলের কোনো সংস্রব না থাকলেও সেখানে উপস্থিত থাকার কারণে সে বন্দি হলো। সেই থেকে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে জেলে বন্দি থেকে বিচারের প্রতীক্ষা করছে। পিতা এক জেলে কারারক্ষী, আর পুত্র অন্য জেলে আসামি। ট্র্যাজিক নাটক, সিনেমাকেও হার মানায় জীবনের এই বাস্তবতা। ছেলের সঙ্গে বিচার শেষ হওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে উত্কণ্ঠিত পিতাও। কিন্তু অপেক্ষার পালা শেষ হয় কই?
এর মধ্যে মেয়েটি এমএ পাস করে একটা চাকরির জন্যে হন্যে হয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশে চাকরি কোথায়? বাধা তো একটি নয়, একাধিক। প্রথম বাধা স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের কাছ থেকে ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী হওয়ার সার্টিফিকেট লাগবে। মেয়ে যেহেতু কখনও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল না, তাই সেই প্রত্যয়নপত্র পেতে জায়গামত বিশাল অংকের খরচাপাতি প্রয়োজন। কোনোক্রমে প্রথম বাধা পার হতে পারলেও দ্বিতীয় আরও বৃহত্ বাধা পথ আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রাইমারি স্কুলের একজন শিক্ষকের চাকরির ঘুষের বাজারদর এখন কমপক্ষে তিন লাখ টাকা। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় এমন একজন কারারক্ষীর কাছে তিন লাখ টাকার অংক প্রায় রাজার ধনের সমপরিমাণ। ছেলের শোকে আর অনূঢ়া কন্যার দুশ্চিন্তায় সাত্তার মিঞার স্ত্রী অনেক আগেই বিছানা নিয়েছে। কায়ক্লেশে জীবনধারণ করে আছে সেই কঙ্কালসার জননী। বিডিআর বিদ্রোহের সঙ্গে এই পরিবারের আশার সব প্রদীপ নির্বাপিত হয়েছে। রাষ্ট্রের বঞ্চনা ও শাসকের নিপীড়নের শিকার এদেশের অজস্র নাগরিকের একজন হয়ে আমার সামনে এখন দাঁড়িয়ে কাশিমপুর জেলের কারারক্ষী সাত্তার। আমি নির্বাক বসে ভাবছি, সরকার পরিবর্তন হলেই কি সাত্তারের ভাগ্য পরিবর্তন হবে? তার চোখের ভাষা থেকে বুঝতে পারছি, সে আমার কাছ থেকে আশার বাণী শুনতে চাচ্ছে। কিন্তু তার একমাত্র ছেলের মুক্তি এবং মেয়ের চাকরির আশ্বাস দিতে পারি এমন ক্ষমতা আমার কই?
No comments