৬- রাজনীতিকদের গ্রেফতার নির্যাতনে পত্রিকা দু’টির সেই বাঁধভাঙা উল্লাস ভোলার মতো নয়
বাংলাদেশ সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের তাঁবেদারে পরিণত
...কমপক্ষে চৌদ্দ কোটি মুসলমান এদেশে বসবাস করলেও যেভাবে ইসলাম ধর্মকে প্রতিদিন ক্ষমতাসীনরা কালিমালিপ্ত করে চলেছে, বিশ্বে কোথাও তার তুলনা মিলবে না। বাংলাদেশকে ক্রমেই সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের তাঁবেদারে পরিণত করা হয়েছে।...
...কমপক্ষে চৌদ্দ কোটি মুসলমান এদেশে বসবাস করলেও যেভাবে ইসলাম ধর্মকে প্রতিদিন ক্ষমতাসীনরা কালিমালিপ্ত করে চলেছে, বিশ্বে কোথাও তার তুলনা মিলবে না। বাংলাদেশকে ক্রমেই সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের তাঁবেদারে পরিণত করা হয়েছে।...
পড়াশোনা আর লেখালেখি করেই দু’টি দিন পার করলাম। ঢাকার সাত নম্বর সেলের মতো এখানে প্রতিবেশী বন্দিদের সঙ্গে আড্ডা মারার কোনো সুযোগ নেই। তিন তলা ভবনের তৃতীয় তলার পূর্বদিকের দু’টি সেল নিয়ে কাশিমপুর দুই নম্বর জেলের বর্তমান ডিভিশন ওয়ার্ড। প্রথম সেলে আমার এবং দ্বিতীয়টায় দুই সেবকের থাকার ব্যবস্থা। সেলের সামনে বেশ লম্বা টানা বারান্দা। ওই বারান্দার মুখে আবার লোহার দরজা, যার সামনে চব্বিশ ঘণ্টা একজন কারারক্ষী মোতায়েন থাকে। সুতরাং, কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া অন্য ওয়ার্ডের বন্দিদের পক্ষে আমার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত্ করতে আসা দুরূহ। তাছাড়া কাশিমপুর দুই নম্বর জেলে আমিই একমাত্র ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দি হওয়ায় এখানে কথা বলার মানুষেরও অভাব। এক-এগারোর সময় বিএনপি, আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতা যখন এই জেলে থাকতেন, তখন নাকি তিন তলা ইমারতের পুরোটাই ডিভিশন ওয়ার্ড ছিল।
সাধারণ কয়েদিরা আমার ব্যাপারে কৌতূহলী হলেও এখনও সম্ভবত কাছে আসার সাহস ও সুযোগ কোনোটাই পাচ্ছে না। ফলে রিমান্ডের ১৪ দিনের পর দ্বিতীয়বার সলিটারি কনফাইনমেন্টের অভিজ্ঞতা হচ্ছে। এর মাঝে অবশ্য সুপার টিপু সুলতানসহ জেলের অধিকাংশ সিনিয়র কর্মকর্তাই দেখা করে গেছেন। আজ বিকেলে সুবেদার সাত্তার জানিয়ে গেল, কাল পুরনো ঢাকায় যেতে হবে। সিএমএম কোর্টে নাকি হাজিরা আছে। কোন মামলা, কী বৃত্তান্ত একেবারেই জানা নেই। জেলে থেকে ঊনপঞ্চাশটা মামলার হিসাব রাখার চেষ্টাও পণ্ডশ্রম। প্রতি সপ্তাহে তিন-চারদিন প্রিজন ভ্যান নামক কফিনে চড়ে কাশিমপুর থেকে সেই বাহাদুর শাহ্ পার্ক যাওয়া-আসা করতে হলে কোমরের বারোটা বাজতে খুব একটা সময় লাগবে না। নির্যাতন করতে হলে আসামিকে সবসময় রিমান্ডে না নিলেও চলে। ডিজিটাল সরকারের বুদ্ধি বলে কথা!
সরকারের নতুন কিসিমের হয়রানির নমুনা পয়লা দিনের হাজিরাতেই পেলাম। সকাল সাড়ে ৬টায় সুবেদার সাত্তার আমাকে নিতে এলো। আমি আজ আর ফজরের নামাজের পর ঘুমাইনি। দীর্ঘ পথ যেতে যাতে টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন না পড়ে, তাই সকালে শুধু এক কাপ কফি গলাধঃকরণ করেছি। প্রিজন ভ্যানের অবস্থা দেখে চোখ কপালে উঠে গেল। সবগুলো বেঞ্চই ভাঙা, কাজেই বসার কোনো ব্যবস্থা নেই। গাড়ির তলদেশের অবস্থাও তথৈবচ, লম্বা ফাটল দিয়ে নিচের রাস্তা দেখা যাচ্ছে। পুলিশ এসকর্টের প্রধান ব্যক্তি দয়াপরবশ হয়ে জেল প্রশাসনের কাছ থেকে প্লাস্টিকের পলকা চেয়ার ধার করে এনে যা হোক একটা বসার ব্যবস্থা করল। যে কোনো সময় ভেঙে যেতে পারে মনে করে ভয়ে ভয়ে বসলাম। ভ্যানের জং ধরা দুর্বল মেঝে ভেঙে চেয়ারসুদ্ধ রাস্তায় পড়ে গিয়ে অক্কা পাওয়াও অসম্ভব নয়। যা ভেবেছিলাম তা-ই। প্রিজন ভ্যানটি একটু দ্রুতগতিতে বাঁক নেয়ার সময় চেয়ার নিয়ে সশব্দে ছিটকে পড়লাম। এত জোরে আওয়াজ হলো যে, তালাবদ্ধ খুপরির বাইরে থেকে সশস্ত্র পাহারাদার জানতে চাইল ব্যথা পেয়েছি কি-না। প্রথমে মনে হলো অক্ষতই আছি, সেন্ট্রিকে সেটাই বললাম। মিনিট খানেকের মধ্যেই দেখলাম বাম হাতের কব্জির একটা অংশ থেকে বেশ রক্ত পড়ছে। অনেকটা অংশ থেঁতলে কেটে গেছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে কিছুক্ষণ চেপে ধরে থাকতেই রক্তপড়া বন্ধ হলো।
তিন ঘণ্টার যাত্রাপথে আর কোনো বিপত্তি না ঘটলেও ভ্যাপসা গরমের হাত থেকে নিস্তার পেলাম না। কোর্ট গারদে পৌঁছে তালা খোলা মাত্র সোজা নির্ধারিত সেলে গিয়ে খবরের কাগজ পেতে শুয়ে বই পড়তে শুরু করলাম। সর্বোচ্চ আধঘণ্টা সময় পার হয়েছে। অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার গারদে এসে জানালেন, মাসখানেক পরের তারিখ পাওয়া গেছে। আদালতে আমার আর কোনো কাজ নেই, ইচ্ছে করলে এখনই ফিরতি যাত্রা শুরু করতে পারি। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার রীতি-নীতি বোঝা আমার সাধ্যের বাইরে। কেবল মামলার পরবর্তী তারিখ দেয়ার জন্যে এত দূর থেকে এত আয়োজন করে আসামিকে আনার হেতু ম্যাজিস্ট্রেটরাই ভালো বলতে পারবেন। আমার পরিবর্তে আনুষঙ্গিক কাগজপত্র, যাকে আইনের ভাষায় কাস্টডি ওয়ারেন্ট বলা হয়, সেটা আনিয়েই তো সিল-ছাপ্পর মেরে তারিখ দেয়া যেত। আমি তো সরকারেরই হেফাজতে আছি। মামলার বিচারকার্য শুরু না হওয়া পর্যন্ত আমার আদালতে উপস্থিতির কোনো প্রয়োজন হওয়ার কথা নয়। যা-ই হোক, কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। দুপুর দুটো নাগাদ কাশিমপুরে পৌঁছালাম। হিসাব করে দেখি, কোর্টের গারদে মাত্র তিরিশ মিনিট থাকলেও আসা-যাওয়ায় লেগেছে পাক্কা সাড়ে ছয় ঘণ্টা। তাড়াতাড়ি গোসল শেষ করেই বিছানায় আশ্রয় নিলাম। ততক্ষণে কোমর এবং ঘাড়ে তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। এদিকে পুরনো, জং ধরা লোহায় আজ হাত কেটে যাওয়ায় টিটেনাসেরও ভয় হচ্ছে।
ঘুম ভেঙে গেছে অনেকক্ষণ। ঘুটঘুটে অন্ধকারে বসে ক’টা বেজেছে বুঝতে পারছি না। বিদ্যুত্ চলে যাওয়ায় ওপরের পাখাটা ঘুরছে না। কাশিমপুর জেলে বিদ্যুত্ আসলে যায় না, ওটা মন চাইলে মাঝে-মধ্যে আসে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বড়জোর সাত-আট ঘণ্টা বিদ্যুত্ পাওয়া যায়। ঢাকায় সাত নম্বর সেলে বিদ্যুত্ সমস্যা থাকলেও, সেখানে জেনারেটরের সংযোগ ছিল। রাতে অন্তত একটা বাতির সঙ্গে ফ্যানের বাতাসটা পাওয়া যেত। এখানে ডিভিশন ওয়ার্ডেও জেনারেটরের ব্যবস্থা নেই। রাতে বিদ্যুত্ যাওয়া মানে অন্ধকারে আকাশ-পাতাল চিন্তা করা এবং গরমে সেদ্ধ হওয়া। কার্তিক মাস শুরু হলেও এখনও গরম যায়নি। সম্ভবত আরও দিন পনেরো গরমের কষ্ট সহ্য করতে হবে। জেলের বাইরের দুনিয়ায় বিদ্যুতের অবস্থা নিশ্চয়ই এতটা সঙ্গীন নয়। সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের পছন্দের সরকার কি এতখানি অপদার্থ হতে পারে?
ক’দিন ধরে শরীরটাও যুতে নেই। রক্তচাপ সকাল-বিকাল ওঠা-নামা করছে। কাল রাতে ১৪০ বাই ৯০ দেখে অবাকই হলাম। আমি বরাবরই নিম্ন রক্তচাপের রোগী। খাওয়া-দাওয়ায় একটু অমনোযোগী হলেই এতদিন ওপরেরটা একশ’র নিচে এবং নিচেরটা ষাটে নেমে আসত। তখন আধাসেদ্ধ ডিম আর লবণ খেয়ে রক্তচাপ বাড়াতে হতো। রোজার মাসে প্রধান বিচারপতির আদালতে তর্ক-বিতর্কের একপর্যায়ে চোখে অন্ধকার দেখে পড়ে গেলে বারের ডাক্তার এসে রক্তচাপ বেশ নিচের দিকেই পেয়েছিলেন। পারভীনকে প্রেসারের সমস্যার কথা এখনও বলিনি। ঢাকা জেল থেকে চালানে আসার সময় ফয়সাল গোটাদশেক টেনোক্যাব দিয়েছিল। আজ সাপ্তাহিক দেখায় পারভীন এলে ওকে কিছু ওষুধ পাঠাতে বলতে হবে। আবার অস্ব্বস্তিও লাগছে। ভাববে, না জানি কতটা অসুস্থ হয়ে পড়েছি। বাল্যকাল থেকেই সহজে কাউকে অসুখের কথা বলার অভ্যাস আমার নেই। অবশ্য এখানে আমি নিরুপায়। জেলের ডাক্তারকে বলতে পারি। কিন্তু চরম ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রশাসনের কাছে কোনো সাহায্য চাইতেই ঘৃণা হয়। ঘণ্টাখানেক এপাশ-ওপাশ করার পর বিদ্যুত্ এলে ঘড়িতে দেখলাম রাত তিনটা। আর ঘুমিয়ে কী হবে, বরং উঠেই পড়ি। সিএমএম কোর্টে হাজিরার দিন থেকে এক বর্ণও লিখিনি। শুধু পড়েই তিন-চারদিন কাটিয়েছি। আইনের বইয়ের মধ্যে ‘কনট্রাক্ট ল’ এবং ‘কনস্টিটিউশনাল ল’ আর পছন্দের বইয়ের তালিকার মধ্যে নেলসন ম্যান্ডেলার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘লং ওয়াক টু ফ্রিডম’। কতবার যে বইটা পড়লাম, অথচ প্রতিবার নতুন মনে হয়। বিংশ শতকের সেরা মানুষটির আনন্দ-বেদনা আর সংগ্রামের অসাধারণ কাহিনী পড়লে ভীরু, কাপুরুষের মনের মধ্যেও বীরত্বের বীজ অঙ্কুরিত হয়।
অক্টোবরের ২১ তারিখে ডেইলি স্টারের ‘Dhaka as regional centre for counter-terrorism, the need to make most of it’ শিরোনামের সম্পাদকীয় পাঠ করে বাংলাদেশকে নিয়ে ইন্দো-মার্কিন ষড়যন্ত্রের স্বরূপ আরও খানিকটা খোলাসা হলো। ইংরেজি সুশীল (?) পত্রিকাটি এবং তাদের বাংলা সহযোগী ‘প্রথম আলো’ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে কোন কোন শক্তির স্বার্থরক্ষায় প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে থাকে, সে সম্পর্কে দেশের সচেতন নাগরিক মাত্রই অবহিত আছেন। উভয় পত্রিকা এবং তাদের সম্পাদক এক-এগারোর সরকার ও তত্কালীন যাবতীয় অত্যাচার-নির্যাতনসহ সংবিধান লঙ্ঘনকারী কাজ-কারবারের কট্টর সমর্থক ছিলেন। মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমান বাংলাদেশের দুই প্রধান নেত্রীর রাজনীতি থেকে বিদায়ের পক্ষে রীতিমত ওকালতি করেছেন। সে সময় রাজনীতিবিদদের গ্রেফতার-নির্যাতনে তাদের সম্পাদিত পত্রিকার বাঁধভাঙা উল্লাস ভোলার মতো নয়। কৌশলগত কারণে বর্তমান সরকারপ্রধান সেই স্মৃতি ভুলে থাকতে চাইলেও তার সহকর্মীদের মর্মযাতনা কখনও কখনও প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে। যেমন এই ক’দিন আগে মানিক মিয়া এভেনিউর একদলীয় সংসদে স্পিকারের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা প্রথম আলো সম্পাদককে এক কথায় তুলোধুনো করেছেন। মতিউর রহমানকে ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলাকারী সন্ত্রাসীদের সহযোগী আখ্যা দিয়ে সেই অপরাধে সংসদ থেকে তার বিচারের দাবিও উত্থাপিত হয়েছে। দুই আলোচ্য পত্রিকা কোনো বিষয়ে অতি উত্সাহ দেখালে দেশপ্রেমিক জনগণের হৃত্কম্প শুরু হয়। সেই বিষয়টির সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের সম্পর্ক খোঁজাটা তাই দেশের স্বার্থেই জরুরি হয়ে পড়ে। স্যামুয়েল হান্টিংটনের সভ্যতার দ্বন্দ্ব (Clash of Civilization) তত্ত্ব এবং বুশ ডকট্রিনের আলোকে বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি মুসলমান জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা থেকে সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদ কৌশলগত মৈত্রীতে আবদ্ধ হয়েছে। সেই লক্ষ্য পূরণের ধারাবাহিক পর্যায় হিসেবেই এদেশে এক-এগারোর আগমন যা পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল নির্বাচনে রূপ নিয়েছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কাউন্টার-টেরোরিজমের ছদ্মবেশে বিদেশি অনুপ্রবেশ যে ঘটানো হয়েছে, তাও এখন অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। ২০০৮ সালের নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই লিখে এসেছি যে ভারত, মার্কিন ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বাংলাদেশে যে কোনো উপায়ে একটি সেক্যুলার চিন্তা-চেতনার সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে আগ্রহী। বর্ণিত ট্রয়কার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার পর তারা এখন নিয়ন্ত্রণ পাকাপোক্ত করতে চায়। মাত্র ক’দিন আগের যুক্তরাষ্ট্র সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আফগানিস্তানে বাংলাদেশের সৈন্য প্রেরণের একটি বিতর্ক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে উসেক দিয়ে এসেছেন। এখন আবার সুশীল (?) পত্রিকায় ঢাকায় কাউন্টার-টেরোরিজম সেন্টারের পক্ষে ওকালতি পড়ছি। এগুলো সবই একই সূত্রে গাঁথা। বিশ্বব্যাপী ইসলামবিরোধী লড়াইয়ে বাংলাদেশের মতো একটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রকে ময়দানে ব্যবহারের চেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ সুসংবাদ পশ্চিমা বিশ্বের কাছে আর কিছু হতে পারে না। সাদ্দাম হোসেনের সেক্যুলার ইরাককেও একই উদ্দেশ্য সাধনে প্রায় তিন দশক ধরে ব্যবহারের পর লক্ষ্য অর্জিত হওয়া মাত্র সেই স্বৈরশাসককে সপরিবারে ছুড়ে ফেলতে পশ্চিমা মিত্ররা কোনো রকম দ্বিধা করেনি।
বাংলাদেশেও দীর্ঘদিন ধরে জনগণের মগজ ধোলাই চলছে। এই ‘মহত্’ কাজে চিহ্নিত সংবাদমাধ্যম যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছে, তার প্রশংসা না করে উপায় নেই। কমপক্ষে চৌদ্দ কোটি মুসলমান এদেশে বসবাস করলেও যেভাবে ইসলাম ধর্মকে প্রতিদিন ক্ষমতাসীনরা কালিমালিপ্ত করে চলেছে, বিশ্বে কোথাও তার তুলনা মিলবে না। জনগণের নির্লিপ্ততা এবং সম্পদের মোহকে পুঁজি করে বাংলাদেশকে ক্রমেই সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের তাঁবেদারে পরিণত করা হয়েছে। দেশের প্রধান বিরোধী দল নানা কারণে নৈতিকভাবে হীনবল হওয়ার কারণে দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত রাষ্ট্রবিরোধীরা বিনাবাধায় তাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছে। ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ এবং যারা ইসলামের নাম ব্যবহার করে রাজনীতি করেন, তারাও জনগণকে সঠিক তথ্য দিয়ে স্বাধীনতা এবং ধর্মের মূল চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে পারেননি। তারা ইসলামসম্মত জীবন বিধান ও সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের সংগ্রামের পরিবর্তে আমাদের পবিত্র ধর্মকে কেবল নামাজ-রোজার মধ্যে আবদ্ধ রেখেছেন। সম্ভবত এই শ্রেণীকে উদ্দেশ করেই মহান উর্দু কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবাল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে লিখেছিলেন—
‘ইয়ে মিছরা লিখ দিয়া কিসি শুখ্ নে
মিম্বর ঔর মেহরাব পর
নাদান সিজদে মে গির গিয়া
যব ওয়াক্তে কিয়াম আয়া\
(একজন বুদ্ধিমান মিম্বর ও মেহরাবে লিখে রেখেছে—
যখন দণ্ডায়মান হওয়ার সময় তখন
নির্বোধ সেজদায় লুটিয়ে পড়েছে)।
সবমিলিয়ে দেশের সার্বিক অবস্থা যেদিকে ধাবিত হচ্ছে তাতে বিবেকসম্পন্ন দেশপ্রেমিক জনগণের আধিপত্যবাদী শক্তি কর্তৃক রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব হরণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
সাধারণ কয়েদিরা আমার ব্যাপারে কৌতূহলী হলেও এখনও সম্ভবত কাছে আসার সাহস ও সুযোগ কোনোটাই পাচ্ছে না। ফলে রিমান্ডের ১৪ দিনের পর দ্বিতীয়বার সলিটারি কনফাইনমেন্টের অভিজ্ঞতা হচ্ছে। এর মাঝে অবশ্য সুপার টিপু সুলতানসহ জেলের অধিকাংশ সিনিয়র কর্মকর্তাই দেখা করে গেছেন। আজ বিকেলে সুবেদার সাত্তার জানিয়ে গেল, কাল পুরনো ঢাকায় যেতে হবে। সিএমএম কোর্টে নাকি হাজিরা আছে। কোন মামলা, কী বৃত্তান্ত একেবারেই জানা নেই। জেলে থেকে ঊনপঞ্চাশটা মামলার হিসাব রাখার চেষ্টাও পণ্ডশ্রম। প্রতি সপ্তাহে তিন-চারদিন প্রিজন ভ্যান নামক কফিনে চড়ে কাশিমপুর থেকে সেই বাহাদুর শাহ্ পার্ক যাওয়া-আসা করতে হলে কোমরের বারোটা বাজতে খুব একটা সময় লাগবে না। নির্যাতন করতে হলে আসামিকে সবসময় রিমান্ডে না নিলেও চলে। ডিজিটাল সরকারের বুদ্ধি বলে কথা!
সরকারের নতুন কিসিমের হয়রানির নমুনা পয়লা দিনের হাজিরাতেই পেলাম। সকাল সাড়ে ৬টায় সুবেদার সাত্তার আমাকে নিতে এলো। আমি আজ আর ফজরের নামাজের পর ঘুমাইনি। দীর্ঘ পথ যেতে যাতে টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন না পড়ে, তাই সকালে শুধু এক কাপ কফি গলাধঃকরণ করেছি। প্রিজন ভ্যানের অবস্থা দেখে চোখ কপালে উঠে গেল। সবগুলো বেঞ্চই ভাঙা, কাজেই বসার কোনো ব্যবস্থা নেই। গাড়ির তলদেশের অবস্থাও তথৈবচ, লম্বা ফাটল দিয়ে নিচের রাস্তা দেখা যাচ্ছে। পুলিশ এসকর্টের প্রধান ব্যক্তি দয়াপরবশ হয়ে জেল প্রশাসনের কাছ থেকে প্লাস্টিকের পলকা চেয়ার ধার করে এনে যা হোক একটা বসার ব্যবস্থা করল। যে কোনো সময় ভেঙে যেতে পারে মনে করে ভয়ে ভয়ে বসলাম। ভ্যানের জং ধরা দুর্বল মেঝে ভেঙে চেয়ারসুদ্ধ রাস্তায় পড়ে গিয়ে অক্কা পাওয়াও অসম্ভব নয়। যা ভেবেছিলাম তা-ই। প্রিজন ভ্যানটি একটু দ্রুতগতিতে বাঁক নেয়ার সময় চেয়ার নিয়ে সশব্দে ছিটকে পড়লাম। এত জোরে আওয়াজ হলো যে, তালাবদ্ধ খুপরির বাইরে থেকে সশস্ত্র পাহারাদার জানতে চাইল ব্যথা পেয়েছি কি-না। প্রথমে মনে হলো অক্ষতই আছি, সেন্ট্রিকে সেটাই বললাম। মিনিট খানেকের মধ্যেই দেখলাম বাম হাতের কব্জির একটা অংশ থেকে বেশ রক্ত পড়ছে। অনেকটা অংশ থেঁতলে কেটে গেছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে কিছুক্ষণ চেপে ধরে থাকতেই রক্তপড়া বন্ধ হলো।
তিন ঘণ্টার যাত্রাপথে আর কোনো বিপত্তি না ঘটলেও ভ্যাপসা গরমের হাত থেকে নিস্তার পেলাম না। কোর্ট গারদে পৌঁছে তালা খোলা মাত্র সোজা নির্ধারিত সেলে গিয়ে খবরের কাগজ পেতে শুয়ে বই পড়তে শুরু করলাম। সর্বোচ্চ আধঘণ্টা সময় পার হয়েছে। অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার গারদে এসে জানালেন, মাসখানেক পরের তারিখ পাওয়া গেছে। আদালতে আমার আর কোনো কাজ নেই, ইচ্ছে করলে এখনই ফিরতি যাত্রা শুরু করতে পারি। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার রীতি-নীতি বোঝা আমার সাধ্যের বাইরে। কেবল মামলার পরবর্তী তারিখ দেয়ার জন্যে এত দূর থেকে এত আয়োজন করে আসামিকে আনার হেতু ম্যাজিস্ট্রেটরাই ভালো বলতে পারবেন। আমার পরিবর্তে আনুষঙ্গিক কাগজপত্র, যাকে আইনের ভাষায় কাস্টডি ওয়ারেন্ট বলা হয়, সেটা আনিয়েই তো সিল-ছাপ্পর মেরে তারিখ দেয়া যেত। আমি তো সরকারেরই হেফাজতে আছি। মামলার বিচারকার্য শুরু না হওয়া পর্যন্ত আমার আদালতে উপস্থিতির কোনো প্রয়োজন হওয়ার কথা নয়। যা-ই হোক, কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। দুপুর দুটো নাগাদ কাশিমপুরে পৌঁছালাম। হিসাব করে দেখি, কোর্টের গারদে মাত্র তিরিশ মিনিট থাকলেও আসা-যাওয়ায় লেগেছে পাক্কা সাড়ে ছয় ঘণ্টা। তাড়াতাড়ি গোসল শেষ করেই বিছানায় আশ্রয় নিলাম। ততক্ষণে কোমর এবং ঘাড়ে তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। এদিকে পুরনো, জং ধরা লোহায় আজ হাত কেটে যাওয়ায় টিটেনাসেরও ভয় হচ্ছে।
ঘুম ভেঙে গেছে অনেকক্ষণ। ঘুটঘুটে অন্ধকারে বসে ক’টা বেজেছে বুঝতে পারছি না। বিদ্যুত্ চলে যাওয়ায় ওপরের পাখাটা ঘুরছে না। কাশিমপুর জেলে বিদ্যুত্ আসলে যায় না, ওটা মন চাইলে মাঝে-মধ্যে আসে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বড়জোর সাত-আট ঘণ্টা বিদ্যুত্ পাওয়া যায়। ঢাকায় সাত নম্বর সেলে বিদ্যুত্ সমস্যা থাকলেও, সেখানে জেনারেটরের সংযোগ ছিল। রাতে অন্তত একটা বাতির সঙ্গে ফ্যানের বাতাসটা পাওয়া যেত। এখানে ডিভিশন ওয়ার্ডেও জেনারেটরের ব্যবস্থা নেই। রাতে বিদ্যুত্ যাওয়া মানে অন্ধকারে আকাশ-পাতাল চিন্তা করা এবং গরমে সেদ্ধ হওয়া। কার্তিক মাস শুরু হলেও এখনও গরম যায়নি। সম্ভবত আরও দিন পনেরো গরমের কষ্ট সহ্য করতে হবে। জেলের বাইরের দুনিয়ায় বিদ্যুতের অবস্থা নিশ্চয়ই এতটা সঙ্গীন নয়। সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের পছন্দের সরকার কি এতখানি অপদার্থ হতে পারে?
ক’দিন ধরে শরীরটাও যুতে নেই। রক্তচাপ সকাল-বিকাল ওঠা-নামা করছে। কাল রাতে ১৪০ বাই ৯০ দেখে অবাকই হলাম। আমি বরাবরই নিম্ন রক্তচাপের রোগী। খাওয়া-দাওয়ায় একটু অমনোযোগী হলেই এতদিন ওপরেরটা একশ’র নিচে এবং নিচেরটা ষাটে নেমে আসত। তখন আধাসেদ্ধ ডিম আর লবণ খেয়ে রক্তচাপ বাড়াতে হতো। রোজার মাসে প্রধান বিচারপতির আদালতে তর্ক-বিতর্কের একপর্যায়ে চোখে অন্ধকার দেখে পড়ে গেলে বারের ডাক্তার এসে রক্তচাপ বেশ নিচের দিকেই পেয়েছিলেন। পারভীনকে প্রেসারের সমস্যার কথা এখনও বলিনি। ঢাকা জেল থেকে চালানে আসার সময় ফয়সাল গোটাদশেক টেনোক্যাব দিয়েছিল। আজ সাপ্তাহিক দেখায় পারভীন এলে ওকে কিছু ওষুধ পাঠাতে বলতে হবে। আবার অস্ব্বস্তিও লাগছে। ভাববে, না জানি কতটা অসুস্থ হয়ে পড়েছি। বাল্যকাল থেকেই সহজে কাউকে অসুখের কথা বলার অভ্যাস আমার নেই। অবশ্য এখানে আমি নিরুপায়। জেলের ডাক্তারকে বলতে পারি। কিন্তু চরম ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রশাসনের কাছে কোনো সাহায্য চাইতেই ঘৃণা হয়। ঘণ্টাখানেক এপাশ-ওপাশ করার পর বিদ্যুত্ এলে ঘড়িতে দেখলাম রাত তিনটা। আর ঘুমিয়ে কী হবে, বরং উঠেই পড়ি। সিএমএম কোর্টে হাজিরার দিন থেকে এক বর্ণও লিখিনি। শুধু পড়েই তিন-চারদিন কাটিয়েছি। আইনের বইয়ের মধ্যে ‘কনট্রাক্ট ল’ এবং ‘কনস্টিটিউশনাল ল’ আর পছন্দের বইয়ের তালিকার মধ্যে নেলসন ম্যান্ডেলার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘লং ওয়াক টু ফ্রিডম’। কতবার যে বইটা পড়লাম, অথচ প্রতিবার নতুন মনে হয়। বিংশ শতকের সেরা মানুষটির আনন্দ-বেদনা আর সংগ্রামের অসাধারণ কাহিনী পড়লে ভীরু, কাপুরুষের মনের মধ্যেও বীরত্বের বীজ অঙ্কুরিত হয়।
অক্টোবরের ২১ তারিখে ডেইলি স্টারের ‘Dhaka as regional centre for counter-terrorism, the need to make most of it’ শিরোনামের সম্পাদকীয় পাঠ করে বাংলাদেশকে নিয়ে ইন্দো-মার্কিন ষড়যন্ত্রের স্বরূপ আরও খানিকটা খোলাসা হলো। ইংরেজি সুশীল (?) পত্রিকাটি এবং তাদের বাংলা সহযোগী ‘প্রথম আলো’ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে কোন কোন শক্তির স্বার্থরক্ষায় প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে থাকে, সে সম্পর্কে দেশের সচেতন নাগরিক মাত্রই অবহিত আছেন। উভয় পত্রিকা এবং তাদের সম্পাদক এক-এগারোর সরকার ও তত্কালীন যাবতীয় অত্যাচার-নির্যাতনসহ সংবিধান লঙ্ঘনকারী কাজ-কারবারের কট্টর সমর্থক ছিলেন। মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমান বাংলাদেশের দুই প্রধান নেত্রীর রাজনীতি থেকে বিদায়ের পক্ষে রীতিমত ওকালতি করেছেন। সে সময় রাজনীতিবিদদের গ্রেফতার-নির্যাতনে তাদের সম্পাদিত পত্রিকার বাঁধভাঙা উল্লাস ভোলার মতো নয়। কৌশলগত কারণে বর্তমান সরকারপ্রধান সেই স্মৃতি ভুলে থাকতে চাইলেও তার সহকর্মীদের মর্মযাতনা কখনও কখনও প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে। যেমন এই ক’দিন আগে মানিক মিয়া এভেনিউর একদলীয় সংসদে স্পিকারের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা প্রথম আলো সম্পাদককে এক কথায় তুলোধুনো করেছেন। মতিউর রহমানকে ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলাকারী সন্ত্রাসীদের সহযোগী আখ্যা দিয়ে সেই অপরাধে সংসদ থেকে তার বিচারের দাবিও উত্থাপিত হয়েছে। দুই আলোচ্য পত্রিকা কোনো বিষয়ে অতি উত্সাহ দেখালে দেশপ্রেমিক জনগণের হৃত্কম্প শুরু হয়। সেই বিষয়টির সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের সম্পর্ক খোঁজাটা তাই দেশের স্বার্থেই জরুরি হয়ে পড়ে। স্যামুয়েল হান্টিংটনের সভ্যতার দ্বন্দ্ব (Clash of Civilization) তত্ত্ব এবং বুশ ডকট্রিনের আলোকে বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি মুসলমান জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা থেকে সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদ কৌশলগত মৈত্রীতে আবদ্ধ হয়েছে। সেই লক্ষ্য পূরণের ধারাবাহিক পর্যায় হিসেবেই এদেশে এক-এগারোর আগমন যা পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল নির্বাচনে রূপ নিয়েছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কাউন্টার-টেরোরিজমের ছদ্মবেশে বিদেশি অনুপ্রবেশ যে ঘটানো হয়েছে, তাও এখন অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। ২০০৮ সালের নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই লিখে এসেছি যে ভারত, মার্কিন ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বাংলাদেশে যে কোনো উপায়ে একটি সেক্যুলার চিন্তা-চেতনার সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে আগ্রহী। বর্ণিত ট্রয়কার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার পর তারা এখন নিয়ন্ত্রণ পাকাপোক্ত করতে চায়। মাত্র ক’দিন আগের যুক্তরাষ্ট্র সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আফগানিস্তানে বাংলাদেশের সৈন্য প্রেরণের একটি বিতর্ক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে উসেক দিয়ে এসেছেন। এখন আবার সুশীল (?) পত্রিকায় ঢাকায় কাউন্টার-টেরোরিজম সেন্টারের পক্ষে ওকালতি পড়ছি। এগুলো সবই একই সূত্রে গাঁথা। বিশ্বব্যাপী ইসলামবিরোধী লড়াইয়ে বাংলাদেশের মতো একটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রকে ময়দানে ব্যবহারের চেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ সুসংবাদ পশ্চিমা বিশ্বের কাছে আর কিছু হতে পারে না। সাদ্দাম হোসেনের সেক্যুলার ইরাককেও একই উদ্দেশ্য সাধনে প্রায় তিন দশক ধরে ব্যবহারের পর লক্ষ্য অর্জিত হওয়া মাত্র সেই স্বৈরশাসককে সপরিবারে ছুড়ে ফেলতে পশ্চিমা মিত্ররা কোনো রকম দ্বিধা করেনি।
বাংলাদেশেও দীর্ঘদিন ধরে জনগণের মগজ ধোলাই চলছে। এই ‘মহত্’ কাজে চিহ্নিত সংবাদমাধ্যম যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছে, তার প্রশংসা না করে উপায় নেই। কমপক্ষে চৌদ্দ কোটি মুসলমান এদেশে বসবাস করলেও যেভাবে ইসলাম ধর্মকে প্রতিদিন ক্ষমতাসীনরা কালিমালিপ্ত করে চলেছে, বিশ্বে কোথাও তার তুলনা মিলবে না। জনগণের নির্লিপ্ততা এবং সম্পদের মোহকে পুঁজি করে বাংলাদেশকে ক্রমেই সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের তাঁবেদারে পরিণত করা হয়েছে। দেশের প্রধান বিরোধী দল নানা কারণে নৈতিকভাবে হীনবল হওয়ার কারণে দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত রাষ্ট্রবিরোধীরা বিনাবাধায় তাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছে। ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ এবং যারা ইসলামের নাম ব্যবহার করে রাজনীতি করেন, তারাও জনগণকে সঠিক তথ্য দিয়ে স্বাধীনতা এবং ধর্মের মূল চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে পারেননি। তারা ইসলামসম্মত জীবন বিধান ও সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের সংগ্রামের পরিবর্তে আমাদের পবিত্র ধর্মকে কেবল নামাজ-রোজার মধ্যে আবদ্ধ রেখেছেন। সম্ভবত এই শ্রেণীকে উদ্দেশ করেই মহান উর্দু কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবাল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে লিখেছিলেন—
‘ইয়ে মিছরা লিখ দিয়া কিসি শুখ্ নে
মিম্বর ঔর মেহরাব পর
নাদান সিজদে মে গির গিয়া
যব ওয়াক্তে কিয়াম আয়া\
(একজন বুদ্ধিমান মিম্বর ও মেহরাবে লিখে রেখেছে—
যখন দণ্ডায়মান হওয়ার সময় তখন
নির্বোধ সেজদায় লুটিয়ে পড়েছে)।
সবমিলিয়ে দেশের সার্বিক অবস্থা যেদিকে ধাবিত হচ্ছে তাতে বিবেকসম্পন্ন দেশপ্রেমিক জনগণের আধিপত্যবাদী শক্তি কর্তৃক রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব হরণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
No comments