১১- সেনাবাহিনীর প্রতি অবিশ্বাসের কারণেই গঠন করা হয়েছিল রক্ষীবাহিনী
আজ ১৪ নভেম্বর। এখন রাত দু’টো বাজে। বহুক্ষণ ধরে ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টায় বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে শেষ পর্যন্ত লেখার টেবিলেই আশ্রয় নিলাম। ধূমায়িত কফিভর্তি মগ পাশে রেখে হাতে কলম তুলে নিয়েছি। মনটা আজ দুই কারণে বড়ই বিক্ষিপ্ত। দুই কারণের একটি মানবিক এবং অপরটি নিতান্তই পারিবারিক। প্রথমটার কথাই আগে বলি। দীর্ঘ আটত্রিশ বছরের সুখ-দুঃখের স্মৃতিঘেরা বাড়ি থেকে বিচার বিভাগ ও সেনাবাহিনীর সহায়তাক্রমে বেগম খালেদা জিয়াকে প্রতিহিংসাপরায়ণ সরকার শেষ পর্যন্ত বের করেই দিয়েছে।
দু’টি ছোট পুত্রসন্তান নিয়ে ওই বাড়িতে স্বামীর সঙ্গে তিনি ১৯৭২ সালে প্রবেশ করেছিলেন। তখন তার স্বামী জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ। ১৯৮১ সালের ৩০ মে বিপথগামী সেনাবাহিনীর হাতে চট্টগ্রামে নিহত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের লাশবাহী কফিনের ওপর একই বাড়িতে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন সদ্য বিধবা স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। জীবন থেমে থাকে না। সেই অন্তঃপুরবাসিনী বিধবা মহিলা পরিস্থিতির চাপে রাজনীতিতে এসে দ্বিধাবিভক্ত দলের হাল ধরেছেন। দীর্ঘ নয় বছরের স্বৈরাচারবিরোধী সফল সংগ্রাম-পরবর্তী নির্বাচনে বিজয় লাভ করে বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু পুরনো বাসা পরিবর্তন করেননি। নিজগৃহ বলতে স্বামীর স্মৃতিবিজড়িত সরকারি অনুদানে প্রাপ্ত ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটিকেই জেনে এসেছেন। ছেলেদের বিয়ে হয়েছে, নাতনিরা কোলজুড়ে এসেছে। ২০০৭ সালে মার্কিন-ভারত যৌথ প্রযোজনায় এক-এগারো বাংলাদেশের ঘাড়ে চেপেছে। মইন-মাসুদের সেনারা চোখের সামনে থেকে দুই ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে, অশক্ত পায়ে এক অসহায় জননী গাড়ির পেছন পেছন দৌড়েছেন। তারপর একদিন তিনিও গ্রেফতার হয়ে সাবজেলে গেছেন। এর মধ্যে মৃত্যুর মিছিলে মা যুক্ত হয়েছেন, তারও লাশ এসেছে শহীদ মইনুল রোডের ওই ছয় নম্বর বাড়িতেই। সংসদ এলাকার সাবজেল থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে মৃত মায়ের মুখ শেষবারের মতো দেখানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে চেনা ঠিকানায়। প্রথমবার স্বামীর কফিন জড়িয়ে ধরে কান্না আর এবার মায়ের মুখ দেখে কান্না। গতকাল বিকেলে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের (পড়ুন প্রধানমন্ত্রী) নির্দেশে র্যাব-পুলিশ এবং সাদা পোশাকের গোয়েন্দা দল স্মৃতির ভারে ন্যুব্জ সেই গৃহ থেকে বড় করুণভাবে বেগম খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদ করেছে।
অনেক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে আজকের বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গড়ে ওঠার পেছনে জেনারেল জিয়াউর রহমানের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান চরিত্র শেখ মুজিবুর রহমান তার পাকিস্তানি আমলের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে সার্বিকভাবে সেনাবাহিনীর প্রতি একপ্রকার বিতৃষ্ণাবোধ করতেন। তিনি সৈনিকদের বিশ্বাস করতেন না। স্বাধীন বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর গুরুত্ব ও ক্ষমতা খর্ব করার জন্যেই তার আমলে রক্ষীবাহিনী নামে এক সমান্তরাল বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। এক-এগারোর অন্যতম কুশীলব জেনারেল মাসুদ এই রক্ষীবাহিনীরই সৃষ্টি। ১৯৭৫ সালের সেনা অভ্যুত্থানে তত্কালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পরবর্তী ছয় বছরে আরও দেড় ডজন ক্যু প্রচেষ্টা সত্ত্বেও জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীকে মোটামুটি পুনর্গঠিত করতে পেরেছিলেন। এসবই ইতিহাসের অংশ। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সেনাবিদ্বেষের গল্পও আমার মস্তিষ্কপ্রসূত নয়। তার বিদেশি সাংবাদিক বন্ধু অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ‘লিগ্যাসি অব ব্লাড’ গ্রন্থ পাঠ করেই এ বিষয়ে জেনেছি। জানি না আজ রাতে বেগম খালেদা জিয়া কোথায় আশ্রয় নিয়েছেন। ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হলে তাকে তত্কালীন সরকার ভাড়ার টাকায় সংসার খরচ মেটানোর জন্য গুলশানে একটি অতিরিক্ত বাড়ি দিয়েছিল। জেলে আসার আগে জানতাম বাড়িটা এখনও ভাড়া দেয়াই আছে। কাজেই সেখানে সম্ভবত তিনি উঠতে পারছেন না। বর্তমান সরকার সেই বাড়িটাও আবার কবে নিয়ে নেয়, সেটা দেখারও অপেক্ষা করছি। মরহুম জিয়াউর রহমানের দুই পুত্রই বর্তমানে বিদেশে চিকিত্সাধীন। এটাও জেনারেল মইন-মাসুদেরই কীর্তি। তারেক, কোকোকে সুস্থ অবস্থায় বাড়ি থেকে নিয়ে পঙ্গু করে ফেরত দিয়েছে একসময় খালেদা জিয়ার বিশ্বাসভাজন দুই ‘মহাবীর’ সেনাপতি। মহাজোট সরকারের ক্ষমতাগ্রহণ নিষ্কণ্টক করে বিদায় নেয়ার আগে তারা বেগম খালেদা জিয়ার উভয় পুত্রের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দায়েরও করে গেছে, যাতে বাগে পেলে ক্ষমতাসীনরা তাদের জেলে পুরে নির্যাতন করতে পারে। সুতরাং ২৯ বছর আগে যে নারী স্বামী হারিয়েছেন, তিনি এক হিসেবে আজ পুত্রহারাও। তাহলে তিনি যাবেন কোথায়? হয়তো ছোট দুই ভাইয়ের মধ্যে কোনো একজনের আশ্রয়ে উঠেছেন।
২০০১ সালে আমাকে সরকারি দায়িত্ব দেয়ার আগপর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়া আমাকে চিনতেন না বললেই চলে। তিনি বিরোধীদলীয় নেত্রী থাকা অবস্থায় তার সঙ্গে আমার মাত্র একবারই সাক্ষাত্ হয়েছিল। আমি তখন বেক্সিমকো গ্রুপে চাকরি করি। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর স্মরণে আছে কি-না জানি না, তবে মিনিট পনেরোর সেই সাক্ষাতে আমরা মূলত ইউক্রেনের ‘অরেঞ্জ রেভ্যুলিউশন’ নিয়ে আলাপ করেছিলাম। ২০০১ সালের প্রথম দিকের সেই দিনটির পর সেই বছরের নভেম্বরের ৬ তারিখের আগে দ্বিতীয়বার আর তাঁর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়নি। দ্বিতীয়বারের দেখায় সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর উপস্থিতিতে কেন তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী আমাকে বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান পদে যোগদানের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেই রহস্য আজও আমার অজানা। যাই হোক, যে বাড়ি নিয়ে এত প্রতিহিংসা, সেখানে সরকারের পাঁচ বছরের মেয়াদকালে মাত্র একবারই গিয়েছিলাম। তাও মেয়াদের একেবারেই অন্তিম লগ্নে। সেদিন জাহাঙ্গীর গেটে দায়িত্ব পালনরত মিলিটারি পুলিশের কাছে প্রধানমন্ত্রীর বাসস্থানটা ঠিক কোথায় জিজ্ঞাসা করায় সে জবাব না দিয়ে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। সম্ভবত আমাকে চিনতে পেরেই তার এই বিস্ময়। ২০০৮ সালে সাবজেল থেকে বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি পাওয়ার পর অবশ্য বেশ কয়েকবার সেখানে গেছি। বিশাল জায়গা, কিন্তু নিতান্ত সাধারণ একটা পুরনো বাড়ি। সেই বাড়িটিকেই সরকারপন্থী মিডিয়া এবং ভারত-মার্কিন লবির মুখপত্র সুশীল (!) পত্রিকায় এমনভাবে চিত্রিত করা হচ্ছে যেন সেটি কোনো রাজবাড়ি। আমি শতভাগ নিশ্চিত যে, এসব পত্রিকার অগাধ বিত্তের অধিকারী মালিকদের গুলশান-বারিধারার প্রাসাদগুলোর শান-শওকতের পাশে বেগম খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি নিতান্তই দীন-হীন মনে হবে। তবে প্রচার বলে কথা! ঈদের মাত্র তিনদিন আগে একজন নারীকে তার ৩৮ বছরের বাসস্থান থেকে উচ্ছেদের অমানবিকতার নিন্দা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। এ প্রসঙ্গে এবার বাংলাদেশের ‘স্বাধীন’ বিচার বিভাগ সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করা সত্যের খাতিরে প্রয়োজন বিবেচনা করছি।
আমার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা মামলার শুনানি চলাকালীন চেম্বার জজ আদালতের এখতিয়ার প্রশ্নে প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক দাবি করেছিলেন, সাধারণত চলমান মামলায় স্থিতাবস্থা (Status quo) বজায় রাখার স্বার্থেই আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি পর্যন্ত স্থগিতাদেশ (Stay) দেয়া হয়। প্রধান বিচারপতির যুক্তি অনুযায়ী বেগম খালেদা জিয়ার বাড়ি সংক্রান্ত মামলার ক্ষেত্রেও তার স্টে (Stay) পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তিনি তা পাননি। একজন নাগরিককে তার ৩৮ বছরের বাসস্থান থেকে সুপ্রিমকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের সিদ্ধান্তের আগেই উচ্ছেদ করা কোনো বিবেচনাতেই আইনসম্মত হতে পারে না। গতকাল বেগম খালেদা জিয়ার তিন আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এবং অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন এই বিষয়টি নিয়ে প্রধান বিচারপতির শরণাপন্ন হলে তিনি নাকি আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, বেগম খালেদা জিয়াকে এখনই বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে না। প্রধান বিচারপতির আশ্বাসে বিশ্বাস করে অবশ্য বেগম খালেদা জিয়া এবং তাঁর আইনজীবীরা ঠকেছেন। আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে সরকার অত্যন্ত অসৌজন্যমূলক কায়দায় বেগম খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে ঠিকই উচ্ছেদ করেছে। এই গর্হিত অপরাধ করা সত্ত্বেও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালত কোনো সুয়োমোটো সমন পাঠানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, আজ এই বাড়ির মালিক বিরোধীদলীয় নেত্রীর পরিবর্তে অন্য যে কোনো সাধারণ নাগরিক হলে তিনি হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে প্রাথমিক স্থগিতাদেশটা অন্তত পেতেন। আমাদের পুরনো সংবিধানের (আল্লাহর ওপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা, মূলনীতি থেকে বাদ দিয়ে নতুন সংবিধান ছাপানোর কাজ এখন চলছে) ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।” বেগম খালেদা জিয়ার দুঃখজনক অভিজ্ঞতার পর এদেশে জনগণের সাংবিধানিক অধিকার নিয়েই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। এদিকে উচ্ছেদের তিনদিন আগে থেকে আওয়ামী এবং সুশীল (!) সংবাদমাধ্যমে খালেদা জিয়া স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছেন এই মর্মে অব্যাহত উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা চালানো হয়েছে। সেই প্রচারণায় এখন দেখতে পাচ্ছি আন্তঃবাহিনী মুখপাত্র আইএসপিআরও যোগ দিয়েছে। এমন একটি বিতর্কিত বিষয় থেকে সেনাবাহিনীকে দূরে রাখতে পারলেই বোধহয় দেশের জন্য মঙ্গলজনক হতো। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও প্রতিহিংসা পূরণের নোংরা খেলায় বিচার বিভাগকে ব্যবহার করার পর ক্ষমতাসীনরা দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ সেনাবাহিনীকেও জড়িয়ে ফেলে তাদের নৈতিকভাবে অধিকতর দুর্বল করার রাষ্ট্রবিরোধী অপচেষ্টায় রত হয়েছে। এক-এগারো এবং বিডিআর হত্যাকাণ্ড এমনিতেই সেনাবাহিনীর ভেতরে গভীর ক্ষত ও বেদনার সৃষ্টি করেছে। নীতিনির্ধারকদের হঠকারী কর্মকাণ্ডের ফলে সেই ক্ষত উপশমের পরিবর্তে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। সব পক্ষের মধ্যে এখনও শুভবুদ্ধির উদয় না হলে আখেরে জাতি হিসেবে আমরা ভয়ঙ্কর ক্ষতির সম্মুখীন হবো।
আমার মনোবেদনার দ্বিতীয় কারণ হলো, শেষ পর্যন্ত আমাদের সিরামিক কারখানাটা বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ দরকষাকষির অবসানে গতকাল এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি। বড় কষ্ট করে আর্টিজান সিরামিক দাঁড় করিয়েছিলাম। নির্মাণকালে পারভীনকে নিয়ে নিয়মিত রাত একটা-দু’টোয় গাজীপুর থেকে বাসায় ফিরেছি। উত্পাদনে যাওয়ার পরও প্রথমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীন ডিজিটাল গ্রুপ নিরুপদ্রবে কোম্পানি চালাতে দেয়নি। গত পাঁচ বছরে দেশের বাইরে মেলায় অংশ নিতে পারিনি। শতভাগ সততার সঙ্গে কোম্পানি চালালেও এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক অন্যায়ভাবে দিনের পর দিন জ্বালাতন করে গেছে। পারভীন যথাসম্ভব একাই সামলানোর চেষ্টা করেছে। পুরনো সম্পর্কের জোরে এই চার বছরে ইউরোপের বাজারে বেশকিছু পণ্য বিক্রিও করেছি। সিরামিক খাতে ২০০৮ সালের সাফল্যের জন্য রফতানিকারকদের কোটায় পারভীন সিআইপিও হয়েছিল। কিন্তু অমিত সম্ভাবনা যা ছিল, সরকারের বাধার কারণে তার দশ ভাগও অর্জন করতে পারিনি। আমাদের সংবিধানের ৩৬ এবং ৪০ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘চলাফেরার স্বাধীনতা’ এবং ‘পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা’ আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়নি। মাঝে মাঝে ভাবি, আমাকে যে শাসকগোষ্ঠী নাগরিকের অধিকারবঞ্চিত করেছে, তাদের কি কোনোদিন কোথাও জবাবদিহি করতে হবে না? আজ পাঠকের কাছে এই প্রশ্নটি রেখে আপাতত কলম বন্ধ করছি। দেখতে পাচ্ছি পূব আকাশে আল্লাহর ক্যানভাসে রঙের খেলা চলছে, দূর থেকে ফজরের আজানের ধ্বনিও ভেসে আসছে।
অনেক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে আজকের বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গড়ে ওঠার পেছনে জেনারেল জিয়াউর রহমানের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান চরিত্র শেখ মুজিবুর রহমান তার পাকিস্তানি আমলের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে সার্বিকভাবে সেনাবাহিনীর প্রতি একপ্রকার বিতৃষ্ণাবোধ করতেন। তিনি সৈনিকদের বিশ্বাস করতেন না। স্বাধীন বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর গুরুত্ব ও ক্ষমতা খর্ব করার জন্যেই তার আমলে রক্ষীবাহিনী নামে এক সমান্তরাল বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। এক-এগারোর অন্যতম কুশীলব জেনারেল মাসুদ এই রক্ষীবাহিনীরই সৃষ্টি। ১৯৭৫ সালের সেনা অভ্যুত্থানে তত্কালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পরবর্তী ছয় বছরে আরও দেড় ডজন ক্যু প্রচেষ্টা সত্ত্বেও জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীকে মোটামুটি পুনর্গঠিত করতে পেরেছিলেন। এসবই ইতিহাসের অংশ। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সেনাবিদ্বেষের গল্পও আমার মস্তিষ্কপ্রসূত নয়। তার বিদেশি সাংবাদিক বন্ধু অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ‘লিগ্যাসি অব ব্লাড’ গ্রন্থ পাঠ করেই এ বিষয়ে জেনেছি। জানি না আজ রাতে বেগম খালেদা জিয়া কোথায় আশ্রয় নিয়েছেন। ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হলে তাকে তত্কালীন সরকার ভাড়ার টাকায় সংসার খরচ মেটানোর জন্য গুলশানে একটি অতিরিক্ত বাড়ি দিয়েছিল। জেলে আসার আগে জানতাম বাড়িটা এখনও ভাড়া দেয়াই আছে। কাজেই সেখানে সম্ভবত তিনি উঠতে পারছেন না। বর্তমান সরকার সেই বাড়িটাও আবার কবে নিয়ে নেয়, সেটা দেখারও অপেক্ষা করছি। মরহুম জিয়াউর রহমানের দুই পুত্রই বর্তমানে বিদেশে চিকিত্সাধীন। এটাও জেনারেল মইন-মাসুদেরই কীর্তি। তারেক, কোকোকে সুস্থ অবস্থায় বাড়ি থেকে নিয়ে পঙ্গু করে ফেরত দিয়েছে একসময় খালেদা জিয়ার বিশ্বাসভাজন দুই ‘মহাবীর’ সেনাপতি। মহাজোট সরকারের ক্ষমতাগ্রহণ নিষ্কণ্টক করে বিদায় নেয়ার আগে তারা বেগম খালেদা জিয়ার উভয় পুত্রের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দায়েরও করে গেছে, যাতে বাগে পেলে ক্ষমতাসীনরা তাদের জেলে পুরে নির্যাতন করতে পারে। সুতরাং ২৯ বছর আগে যে নারী স্বামী হারিয়েছেন, তিনি এক হিসেবে আজ পুত্রহারাও। তাহলে তিনি যাবেন কোথায়? হয়তো ছোট দুই ভাইয়ের মধ্যে কোনো একজনের আশ্রয়ে উঠেছেন।
২০০১ সালে আমাকে সরকারি দায়িত্ব দেয়ার আগপর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়া আমাকে চিনতেন না বললেই চলে। তিনি বিরোধীদলীয় নেত্রী থাকা অবস্থায় তার সঙ্গে আমার মাত্র একবারই সাক্ষাত্ হয়েছিল। আমি তখন বেক্সিমকো গ্রুপে চাকরি করি। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর স্মরণে আছে কি-না জানি না, তবে মিনিট পনেরোর সেই সাক্ষাতে আমরা মূলত ইউক্রেনের ‘অরেঞ্জ রেভ্যুলিউশন’ নিয়ে আলাপ করেছিলাম। ২০০১ সালের প্রথম দিকের সেই দিনটির পর সেই বছরের নভেম্বরের ৬ তারিখের আগে দ্বিতীয়বার আর তাঁর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়নি। দ্বিতীয়বারের দেখায় সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর উপস্থিতিতে কেন তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী আমাকে বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান পদে যোগদানের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেই রহস্য আজও আমার অজানা। যাই হোক, যে বাড়ি নিয়ে এত প্রতিহিংসা, সেখানে সরকারের পাঁচ বছরের মেয়াদকালে মাত্র একবারই গিয়েছিলাম। তাও মেয়াদের একেবারেই অন্তিম লগ্নে। সেদিন জাহাঙ্গীর গেটে দায়িত্ব পালনরত মিলিটারি পুলিশের কাছে প্রধানমন্ত্রীর বাসস্থানটা ঠিক কোথায় জিজ্ঞাসা করায় সে জবাব না দিয়ে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। সম্ভবত আমাকে চিনতে পেরেই তার এই বিস্ময়। ২০০৮ সালে সাবজেল থেকে বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি পাওয়ার পর অবশ্য বেশ কয়েকবার সেখানে গেছি। বিশাল জায়গা, কিন্তু নিতান্ত সাধারণ একটা পুরনো বাড়ি। সেই বাড়িটিকেই সরকারপন্থী মিডিয়া এবং ভারত-মার্কিন লবির মুখপত্র সুশীল (!) পত্রিকায় এমনভাবে চিত্রিত করা হচ্ছে যেন সেটি কোনো রাজবাড়ি। আমি শতভাগ নিশ্চিত যে, এসব পত্রিকার অগাধ বিত্তের অধিকারী মালিকদের গুলশান-বারিধারার প্রাসাদগুলোর শান-শওকতের পাশে বেগম খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি নিতান্তই দীন-হীন মনে হবে। তবে প্রচার বলে কথা! ঈদের মাত্র তিনদিন আগে একজন নারীকে তার ৩৮ বছরের বাসস্থান থেকে উচ্ছেদের অমানবিকতার নিন্দা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। এ প্রসঙ্গে এবার বাংলাদেশের ‘স্বাধীন’ বিচার বিভাগ সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করা সত্যের খাতিরে প্রয়োজন বিবেচনা করছি।
আমার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা মামলার শুনানি চলাকালীন চেম্বার জজ আদালতের এখতিয়ার প্রশ্নে প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক দাবি করেছিলেন, সাধারণত চলমান মামলায় স্থিতাবস্থা (Status quo) বজায় রাখার স্বার্থেই আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি পর্যন্ত স্থগিতাদেশ (Stay) দেয়া হয়। প্রধান বিচারপতির যুক্তি অনুযায়ী বেগম খালেদা জিয়ার বাড়ি সংক্রান্ত মামলার ক্ষেত্রেও তার স্টে (Stay) পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তিনি তা পাননি। একজন নাগরিককে তার ৩৮ বছরের বাসস্থান থেকে সুপ্রিমকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের সিদ্ধান্তের আগেই উচ্ছেদ করা কোনো বিবেচনাতেই আইনসম্মত হতে পারে না। গতকাল বেগম খালেদা জিয়ার তিন আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এবং অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন এই বিষয়টি নিয়ে প্রধান বিচারপতির শরণাপন্ন হলে তিনি নাকি আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, বেগম খালেদা জিয়াকে এখনই বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে না। প্রধান বিচারপতির আশ্বাসে বিশ্বাস করে অবশ্য বেগম খালেদা জিয়া এবং তাঁর আইনজীবীরা ঠকেছেন। আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে সরকার অত্যন্ত অসৌজন্যমূলক কায়দায় বেগম খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে ঠিকই উচ্ছেদ করেছে। এই গর্হিত অপরাধ করা সত্ত্বেও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালত কোনো সুয়োমোটো সমন পাঠানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, আজ এই বাড়ির মালিক বিরোধীদলীয় নেত্রীর পরিবর্তে অন্য যে কোনো সাধারণ নাগরিক হলে তিনি হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে প্রাথমিক স্থগিতাদেশটা অন্তত পেতেন। আমাদের পুরনো সংবিধানের (আল্লাহর ওপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা, মূলনীতি থেকে বাদ দিয়ে নতুন সংবিধান ছাপানোর কাজ এখন চলছে) ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।” বেগম খালেদা জিয়ার দুঃখজনক অভিজ্ঞতার পর এদেশে জনগণের সাংবিধানিক অধিকার নিয়েই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। এদিকে উচ্ছেদের তিনদিন আগে থেকে আওয়ামী এবং সুশীল (!) সংবাদমাধ্যমে খালেদা জিয়া স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছেন এই মর্মে অব্যাহত উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা চালানো হয়েছে। সেই প্রচারণায় এখন দেখতে পাচ্ছি আন্তঃবাহিনী মুখপাত্র আইএসপিআরও যোগ দিয়েছে। এমন একটি বিতর্কিত বিষয় থেকে সেনাবাহিনীকে দূরে রাখতে পারলেই বোধহয় দেশের জন্য মঙ্গলজনক হতো। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও প্রতিহিংসা পূরণের নোংরা খেলায় বিচার বিভাগকে ব্যবহার করার পর ক্ষমতাসীনরা দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ সেনাবাহিনীকেও জড়িয়ে ফেলে তাদের নৈতিকভাবে অধিকতর দুর্বল করার রাষ্ট্রবিরোধী অপচেষ্টায় রত হয়েছে। এক-এগারো এবং বিডিআর হত্যাকাণ্ড এমনিতেই সেনাবাহিনীর ভেতরে গভীর ক্ষত ও বেদনার সৃষ্টি করেছে। নীতিনির্ধারকদের হঠকারী কর্মকাণ্ডের ফলে সেই ক্ষত উপশমের পরিবর্তে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। সব পক্ষের মধ্যে এখনও শুভবুদ্ধির উদয় না হলে আখেরে জাতি হিসেবে আমরা ভয়ঙ্কর ক্ষতির সম্মুখীন হবো।
আমার মনোবেদনার দ্বিতীয় কারণ হলো, শেষ পর্যন্ত আমাদের সিরামিক কারখানাটা বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ দরকষাকষির অবসানে গতকাল এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি। বড় কষ্ট করে আর্টিজান সিরামিক দাঁড় করিয়েছিলাম। নির্মাণকালে পারভীনকে নিয়ে নিয়মিত রাত একটা-দু’টোয় গাজীপুর থেকে বাসায় ফিরেছি। উত্পাদনে যাওয়ার পরও প্রথমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীন ডিজিটাল গ্রুপ নিরুপদ্রবে কোম্পানি চালাতে দেয়নি। গত পাঁচ বছরে দেশের বাইরে মেলায় অংশ নিতে পারিনি। শতভাগ সততার সঙ্গে কোম্পানি চালালেও এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক অন্যায়ভাবে দিনের পর দিন জ্বালাতন করে গেছে। পারভীন যথাসম্ভব একাই সামলানোর চেষ্টা করেছে। পুরনো সম্পর্কের জোরে এই চার বছরে ইউরোপের বাজারে বেশকিছু পণ্য বিক্রিও করেছি। সিরামিক খাতে ২০০৮ সালের সাফল্যের জন্য রফতানিকারকদের কোটায় পারভীন সিআইপিও হয়েছিল। কিন্তু অমিত সম্ভাবনা যা ছিল, সরকারের বাধার কারণে তার দশ ভাগও অর্জন করতে পারিনি। আমাদের সংবিধানের ৩৬ এবং ৪০ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘চলাফেরার স্বাধীনতা’ এবং ‘পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা’ আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়নি। মাঝে মাঝে ভাবি, আমাকে যে শাসকগোষ্ঠী নাগরিকের অধিকারবঞ্চিত করেছে, তাদের কি কোনোদিন কোথাও জবাবদিহি করতে হবে না? আজ পাঠকের কাছে এই প্রশ্নটি রেখে আপাতত কলম বন্ধ করছি। দেখতে পাচ্ছি পূব আকাশে আল্লাহর ক্যানভাসে রঙের খেলা চলছে, দূর থেকে ফজরের আজানের ধ্বনিও ভেসে আসছে।
No comments