২৬- জীবনসায়াহ্নে এসে না হয় নির্বোধের মতো আদালতকথিত বিদ্রোহের পথপ্রদর্শকই হলাম
না হয় বিদ্রোহের পথপ্রদর্শকই হলাম
মনে হলো, আমার এই নিগ্রহ, মায়ের চোখের পানি, স্ত্রীর হাহাকার একেবারে বৃথা যায়নি। সমাজের জমাটবাঁধা অন্ধকারের মধ্যে একখানি ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গও যদি জ্বালাতে পেরে থাকি, তাহলেই আমার মতো এক অকিঞ্চিত্কর ব্যক্তির জীবন সার্থক। মামলার শুনানির সময় আমার প্রতি অনেক রকম কটু বাক্য ব্যবহারের মধ্যে স্বয়ং প্রধান বিচারপতি মো. ফজলুল করিম বাংলাদেশের বিচার বিভাগ সম্পর্কে সমালোচনামূলক বক্তব্য প্রদানের ক্ষেত্রে আমাকে চধঃয ভরহফবত্ (পথপ্রদর্শক) খেতাব দিয়েছিলেন। এদেশের উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তাদের আদর্শ ও আত্মসম্মান বিকিয়ে দিয়ে হলেও ক্ষমতাবানদের সঙ্গে সমঝোতা করাটাকেই বুদ্ধিমানের কাজ বলে বিবেচনা করেন। আমি না হয় জীবনসায়াহ্নে এসে নির্বোধের মতো বিদ্রোহের পথপ্রদর্শকই হলাম।
মনে হলো, আমার এই নিগ্রহ, মায়ের চোখের পানি, স্ত্রীর হাহাকার একেবারে বৃথা যায়নি। সমাজের জমাটবাঁধা অন্ধকারের মধ্যে একখানি ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গও যদি জ্বালাতে পেরে থাকি, তাহলেই আমার মতো এক অকিঞ্চিত্কর ব্যক্তির জীবন সার্থক। মামলার শুনানির সময় আমার প্রতি অনেক রকম কটু বাক্য ব্যবহারের মধ্যে স্বয়ং প্রধান বিচারপতি মো. ফজলুল করিম বাংলাদেশের বিচার বিভাগ সম্পর্কে সমালোচনামূলক বক্তব্য প্রদানের ক্ষেত্রে আমাকে চধঃয ভরহফবত্ (পথপ্রদর্শক) খেতাব দিয়েছিলেন। এদেশের উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তাদের আদর্শ ও আত্মসম্মান বিকিয়ে দিয়ে হলেও ক্ষমতাবানদের সঙ্গে সমঝোতা করাটাকেই বুদ্ধিমানের কাজ বলে বিবেচনা করেন। আমি না হয় জীবনসায়াহ্নে এসে নির্বোধের মতো বিদ্রোহের পথপ্রদর্শকই হলাম।
কয়েদিতে পদোন্নতি নিয়ে জেলে ফিরলাম। সকালে আদালতে যাওয়ার আগেই সাত নম্বর সেলের সতীর্থদের বলে গিয়েছিলাম, সর্বোচ্চ সাজা আনতে যাচ্ছি। তবে তখন পর্যন্ত ধারণা ছিল, ছয় মাস কারাদণ্ড এবং দুই হাজার টাকা জরিমানা হবে। সুপ্রিমকোর্ট তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যা অনুযায়ী ‘inherent right’ প্রয়োগ করে জরিমানাটা দুই হাজারের পরিবর্তে এক লাখ টাকা করতে পারেন এবং অনাদায়ে এক মাস হাজতবাস বাড়িয়ে দিতে পারেন, এটা চিন্তার মধ্যে ছিল না। ফয়সাল আইন ভালোই বোঝে। আদালত অবমাননার অপরাধে সর্বোচ্চ ছয় মাস জেল খাটার বিধানকে অতিক্রম করে আমার সাত মাসের কারাদণ্ড ফয়সালও মানতে পারছিল না। আমার প্রতিবেশী এই মার্কিন নাগরিকটি তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি তেমন একটা শ্রদ্ধা পোষণ করে না। আজকের নজিরবিহীন রায় মহাজোট আমলে বাংলাদেশ স্টাইল আইনের শাসনের প্রতি তার বিরাগ যথেষ্টই বৃদ্ধি করল। আগেই বলেছি, এক মিশ্র অনুভূতি নিয়ে সুপ্রিমকোর্ট থেকে ফিরতি পথে প্রিজন ভ্যানে উঠেছিলাম। কিন্তু জেলগেট থেকে সাত নম্বর সেলে আসা পর্যন্ত এক বিচিত্র কারণে মনের মেঘ উড়ে গিয়ে ভেতরটা ঝলমলে হয়ে উঠল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের জেলজীবনের স্মৃতি রক্ষার্থে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে যে মিউজিয়ামটি নির্মিত হয়েছে, তার পাশ দিয়েই সাত নম্বর সেলে যাতায়াতের পথ। মিউজিয়াম চত্বরে শেখ মুজিবের একটি আবক্ষ ধাতব মূর্তি রয়েছে। আজ সেলে আসার পথে হঠাত্ মূর্তিটির দিকে চোখ পড়ল। জেল প্রশাসন কাপড় জড়িয়ে মূর্তিটি ঢেকে রেখেছে। কোনো বেয়াদব পাখি কোনোরকম কুকর্ম করে যাতে মূর্তির পবিত্রতা নষ্ট করতে না পারে, সেই সদিচ্ছা থেকেই সম্ভবত জেল প্রশাসন এই কর্মটি করেছে। কিন্তু সুপার-জেলার সমস্যা বাঁধিয়েছেন কাপড় নির্বাচন নিয়ে। জেলের ভাণ্ডারে ভালো কোনো কাপড় না পেয়ে মূর্তি ঢাকার জন্য কয়েদিদের পোশাক ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমে ভাবলাম, ভুল দেখছি। দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে বেশ খানিকটা সময় ধরে মনোযোগ দিয়ে দেখে নিশ্চিত হলাম, আমার দৃষ্টিশক্তি ঠিকই আছে। আপিল বিভাগ আমাকে আজ থেকে কয়েদি বানিয়ে দিলেও দুই কারণে জেল প্রশাসন ইচ্ছে করলেও আমাকে কয়েদির নির্ধারিত পোশাক পরাতে পারছে না। প্রথম কারণ সিভিল মামলায় আমার সাজা হয়েছে, এ ধরনের মামলার কয়েদিদের জেলের পোশাক পরা বাধ্যতামূলক নয়। দ্বিতীয়ত, আমি সাত নম্বর সেলে সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে থাকলেও প্রশাসনের খাতাপত্রে আমার মর্যাদা প্রথম শ্রেণীপ্রাপ্ত ডিভিশন কয়েদির। জেল কোড অনুযায়ী প্রথম শ্রেণীর কয়েদিরা ব্যক্তিগত পোশাক পরিধান করবেন। অতএব কয়েদির ডোরাকাটা পোশাক পরতে হচ্ছে না। দেশবাসী এতদিনে জেনে গেছেন, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই আমাকে বিনা অপরাধে জেলে আনা হয়েছে, আমার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত অর্ধশত মামলাও দায়ের হয়েছে। আজ আপিল বিভাগ আমাকে সর্বোচ্চেরও অধিক সাজা দেয়ায় তিনি নিশ্চয়ই পরম সন্তোষও লাভ করেছেন। অথচ কাকতালীয়ভাবে আমার সাজাপ্রাপ্তির বিশেষ দিনটিতেই জেল প্রশাসন তার মরহুম পিতার মূর্তিকেই কয়েদির পোশাক পরিয়ে রেখেছে। ‘Divine justice’-এর এই নমুনা দর্শনে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতার যে হাসি ঠোঁটের কোণে ঝুলে ছিল, সেটিকে সঙ্গে করেই আমার সেলে পা রেখেছিলাম। ফয়সালের কাছ থেকে পাওয়া এক সংবাদে খুশিটা আরও বাড়ল। জেল কোড অনুযায়ী কয়েদির দৈনিক খোরাকি হাজতির চেয়ে কুড়ি টাকা বেশি। আজ থেকে আমার দৈনিক সরকারি বরাদ্দ নাকি ১০৬ টাকা হবে। টাকা বাড়লে হয়তো খাবার-দাবারের মানও আগের চেয়ে উন্নত হবে। মনে মনে ভাবলাম, হাজতির তুলনায় কয়েদি ব্যাপারটা একেবারে মন্দ নয়।
আদালত থেকে ফিরে কাপড় বদলানোরও সময় পেলাম না, ক্যামেরা হাতে প্রশাসনের লোকজন এসে হাজির। নতুন করে কয়েদি মাহমুদুর রহমানের ছবি তুলতে হবে। জেলে আসার পরদিন অর্থাত্ জুনের তিন তারিখে বুকে হাজতির নম্বর সেঁটে হাজতির ছবি তুলতে হয়েছিল। সেই ছবিতে নাকি আর চলবে না। এবার কয়েদির নম্বর বুকে ঝুলিয়ে ছবি তোলাতে হবে। তবে জেল প্রশাসন খানিকটা দয়া দেখালো। প্রথমবার ছবি তোলাতে আমাকেই জেল হাসপাতালের সামনের আঙিনায় ক্যামেরাম্যানের খোঁজে যেতে হয়েছিল। আজ ক্যামেরাম্যান নিজেই সাত নম্বর সেলে হাজির হয়েছে। পাঠকের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, জেলে ক্যামেরাম্যানের দায়িত্ব কোনো একজন অভিজ্ঞ কয়েদিই পালন করে। ছবি তোলা শেষ হলে অন্য সেল এবং ওয়ার্ড থেকে দর্শনার্থীদের আনাগোনা শুরু হলো। সবাই এসেছে আমার সাজাপ্রাপ্তিতে সমবেদনা জানাতে। অধিকাংশের সমবেদনা আন্তরিক হলেও তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ যে আনন্দ অনুভব করছিল না, এমন কথা বলা যাবে না। উঁচু প্রাচীরের বাইরের মুক্ত জগতের মতো জেলের ভেতরেও আওয়ামী-বিএনপি স্পষ্ট বিভাজন রয়েছে।
উনিশ তারিখে আমার সাজা হওয়ার পরদিন পারভীন দেখা করতে এলো। জুলাইয়ের ২৩ তারিখে প্রথমবার দেখা করতে এসে বড় আশা করে বলেছিল, আগস্টের ভেতরে আমি মুক্তি পেলে আর এখানে আসবে না। গতকালের রায় তার সেই আশার প্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছে। অনির্দিষ্টকালের কয়েদি জীবনের আজ প্রথম দিন। আমার বিষণ্ন স্ত্রী নতুন দুঃসংবাদ শোনালো। সরকার এবার আমাদের অন্নসংস্থানে হাত দিয়েছে। উপরের নির্দেশে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর যৌথভাবে এমন হয়রানি করছে যে, পারভীনের পক্ষে আমাদের অন্ন-বস্ত্রের একমাত্র সহায় আর্টিজান সিরামিক আর বেশিদিন চালানোও বোধহয় সম্ভব হবে না। প্রতিহিংসাপরায়ণ সরকারপ্রধান নীতি-নৈতিকতা ছুড়ে ফেলে দিয়ে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে একজন সাধারণ নাগরিক এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে সর্বতোভাবে ব্যবহার করছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ফ্যাসিবাদের নৃশংসতা সীমাহীন। আপনজনদের নিরাপত্তা নিয়ে আমার দুর্ভাবনার কথা জানাতেই পারভীন বলল, জেলের ভেতরে আমি সুস্থ থাকলে সরকারের কোনো অত্যাচার-নির্যাতনকেই সে এবং আমার মা পরোয়া করেন না। আল্লাহতায়ালার অপার করুণায় আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি—একথা বলে স্ত্রীকে আশ্বস্ত করে বিদায় জানালাম। স্বাভাবিকভাবেই মনটা বড় অশান্ত হয়ে পড়ল। আর্টিজান চলবে কি চলবে না, ও নিয়ে আমার কোনো চিন্তা নেই। ঢাকা শহরে আমাদের তিনজনের একটা আশ্রয় রয়েছে, তিনবেলা আহারেরও কোনো সমস্যা নেই। এর অতিরিক্ত অর্থ-বিত্তের প্রত্যাশা দীর্ঘ পেশাগত জীবনে কখনও করিনি। জেলে বন্দি থাকার ব্যাপারটাও আমার কাছে এর মধ্যে সহনীয় হয়ে গেছে। যে কোনোদিন জেলে আসার ঝুঁকি নিয়েই তো এক/এগারো-পরবর্তী সময়ে তত্কালীন জালিম সরকারের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলাম, পরবর্তী সময়ে আমার দেশ পত্রিকার দায়িত্বও গ্রহণ করেছি। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের এই হেনস্তার বেদনা সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে।
আদালত অবমাননার দ্বিতীয় মামলার তারিখ দ্রুত এসে গেল। প্রথম মামলার সাজা ঘোষণা আর দ্বিতীয় মামলার শুনানির মধ্যে মাত্র চারদিনের ব্যবধান। জেল কর্তৃপক্ষ আমার সঙ্গে কোনো আইনজীবীকে দেখা করতে দিচ্ছে না। আগের মতো একাই প্রস্তুতি নিচ্ছি। আপিল বিভাগে এই মামলার রায় কী হবে, তা নিয়ে আমার কোনো উদ্বেগ নেই। আপন অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, মাসখানেকের মধ্যেই কারাজীবন একরকম ধাতস্থ হয়ে যায়। নির্মম সাজা অবশ্য ভোগ করে পরিবারের অসহায়, নিরপরাধ সদস্যরা। তাদের সেই কষ্ট দুর্বিষহ। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার বাস্তবতায় আমার ভরসার স্থল এখন সৃষ্টিকর্তা এবং দেশের জনগণ। দেশের সেই সাধারণ মানুষের কাছে আমার বক্তব্য পৌঁছানোর জন্যই ‘শো-কজে’র জবাবের খসড়া তৈরিতে মনোনিবেশ করেছি। প্রথম মামলার সময় কয়েক রাত টানা না ঘুমিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। সেই বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দৈনন্দিন রুটিনের পরিবর্তন ঘটিয়েছি। ইফতারের পর আর কিছু না খেয়ে এশার নামাজ পড়েই ঘুমিয়ে পড়ি। রাত দুটোয় ডিভিশন সেল থেকে সাহির নিয়ে এলে ঘুম ভাঙে। সাহির খাওয়ার আগে-পরে ভোর ছ’টা পর্যন্ত একটানা কাজ করি। তারপর গোসলের পাট চুকিয়ে সকাল সাতটায় দ্বিতীয় দফার ঘুম। শরীর ও মস্তিষ্কের ক্লান্তির ফলে দেড়-দুই ঘণ্টা ঘুম সহজেই হয়ে যায়। দুই দফায় ঘণ্টা ছয়েক ঘুম এই বয়সে যথেষ্ট। মুক্ত জীবনেও তো এক শুক্রবার ছাড়া ছয় ঘণ্টার অধিক ঘুমানোর সুযোগ হয়নি।
দ্বিতীয় মামলার জবাবের খসড়া লেখার ফাঁকে ফাঁকে সরকার সমর্থক পত্রপত্রিকা পড়ে প্রথম মামলার নজিরবিহীন রায়ের দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করছি। জেলে আসার পর থেকে প্রধানত ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারই পড়ছি। আমার মামলা নিয়ে পত্রিকাটির সংবাদ পরিবেশনের ধরনটি আমার প্রত্যাশার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আদালতে প্রদত্ত আমার কোনো জবাবই তারা ছাপানোর উপযুক্ত বিবেচনা করেননি। অপরদিকে আদালতের তিরস্কার, বিশেষত সংবাদপত্র জগতে অনভিজ্ঞতা নিয়ে লর্ডশিপদের বিদ্রূপাত্মক ও অবমাননাকর মন্তব্য পত্রিকার প্রথম পাতায় বেশ বড় করেই ছাপা হয়েছে। তবে পত্রিকাটি তাদের সম্পাদকীয়তে রায়ের সমালোচনা করেছে। এই সম্পাদকীয় লেখার উদ্দেশ্য বোঝা কঠিন নয়। আমার সাজা হওয়ায় সুশীল (?) মুখপত্রটি শ্রেণীবিদ্বেষের কারণেই অতিশয় আনন্দিত। তবে ভবিষ্যতের অজানা বৈরী পরিস্থিতিতে আদালতের এমন তরবারির আঘাতে আবার তাদের কোনো সমগোত্রীয়ের মাথা যাতে কাটা না যায়, তারই আগাম সতর্কতা হিসেবে সম্পাদকীয়তে এই আদর্শের বাণী প্রচার। তবে একই পত্রিকায় প্রকাশিত সিপিজে’র (Committee to Protect Journalists) বিবৃতি পড়ে উদ্দীপ্ত বোধ করলাম। সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় প্রতিষ্ঠিত নিউইয়র্কভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি সুপ্রিমকোর্টের রায়ের কঠোর সমালোচনা করে সাজা বাতিলের দাবি জানিয়েছে। পুরো বিষয়টিকে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য অত্যন্ত নেতিবাচক আখ্যা দিয়ে সংগঠনটির ডেপুটি ডিরেক্টর রবার্ট মেহানি (Robert Mahoney) মন্তব্য করেছেন, সাংবাদিকদের কোনো রকম ভয়ভীতি ছাড়া অবশ্যই বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে মন্তব্য করার অধিকার আছে। মনে হলো, আমার এই নিগ্রহ, মায়ের চোখের পানি, স্ত্রীর হাহাকার একেবারে বৃথা যায়নি। সমাজের জমাটবাঁধা অন্ধকারের মধ্যে একখানি ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গও যদি জ্বালাতে পেরে থাকি, তাহলেই আমার মতো এক অকিঞ্চিত্কর ব্যক্তির জীবন সার্থক। মামলার শুনানির সময় আমার প্রতি অনেক রকম কটু বাক্য ব্যবহারের মধ্যে স্বয়ং প্রধান বিচারপতি মো. ফজলুল করিম বাংলাদেশের বিচার বিভাগ সম্পর্কে সমালোচনামূলক বক্তব্য প্রদানের ক্ষেত্রে আমাকে Path finder (পথপ্রদর্শক) খেতাব দিয়েছিলেন। এদেশের উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তাদের আদর্শ ও আত্মসম্মান বিকিয়ে দিয়ে হলেও ক্ষমতাবানদের সঙ্গে সমঝোতা করাটাকেই বুদ্ধিমানের কাজ বলে বিবেচনা করেন। আমি না হয় জীবনসায়াহ্নে এসে নির্বোধের মতো বিদ্রোহের পথপ্রদর্শকই হলাম। এই হঠকারিতার জন্য সর্বোচ্চেরও অধিক সাজা দিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত আমাকে ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করতে তো চেয়েছেনই, সেই সঙ্গে অন্য নাগরিকদের মনেও তাদের সম্পর্কে ভীতি উত্পন্ন করতে চেয়েছেন। এই পরিণত বয়সে আমার স্বভাব পরিবর্তনের সমুদয় চেষ্টা বলাই বাহুল্য ব্যর্থ হবে। জালিমের কারাগার থেকে মুক্তি পেলে সত্যের পক্ষে আবারও ইনশাআল্লাহ কলম ধরব। আদালতের রায়ে সাধারণ জনগণ কতখানি ভীতসন্ত্রস্ত হয়, সেটা ভবিষ্যতেই দেখা যাবে।
দেখতে দেখতে ২৪ আগস্ট এসে গেল। আগের মতোই হাস্যকর ধরনের অতিরিক্ত নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে আমাকে সুপ্রিমকোর্টে নেয়া হলো। সরকারের দৃষ্টিতে বোধহয় এই মুহূর্তে আমার চেয়ে ভয়ঙ্কর জঙ্গি (!) বাংলাদেশে নেই। সম্ভব হলে প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডাণ্ডাবেড়ি পরানোরও নির্দেশ দিতেন। আমিও অবশ্য তাকে উত্ত্যক্ত কম করছি না। প্রতিদিন প্রিজন ভ্যান থেকে নামা এবং ওঠার সময় উপস্থিত সংবাদকর্মীদের উদ্দেশে হাসিমুখে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাই, আদালতের বারান্দা দিয়ে এত দ্রুতগতিতে হাঁটি যে সঙ্গের পুলিশ অ্যাসকর্ট সদস্যদের তাল মেলাতে প্রায় দৌড়াতে হয়। আজ আমার প্রতিবাদ আরও দৃষ্টিগ্রাহ্য করার জন্য মার্কিন মুলুকের কালো মানুষের মতো করে মুষ্টিবদ্ধ হাত উত্তোলিত করলাম। সরকার এবং আদালতের জুলুমের বিরুদ্ধে আমার প্রতিবাদ জনগণকে এর চেয়ে কঠিন ও স্পষ্ট করে বোঝানোর আর কোনো সুযোগ নেই। আদালতে ঢুকেই দেখি বন্ধুবর বাবলু অপেক্ষমাণ। আমার সাজা ঘোষণার দিন বাবলু নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেদিন আদালতে উপস্থিত থাকতে পারেনি। বাবলুর কাছ থেকে পারভীনের মামার মৃত্যুসংবাদ শুনলাম। ভদ্রলোক দীর্ঘদিন ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগছিলেন। বয়স সম্ভবত সবে ষাট স্পর্শ করেছিল। শ্বশুরকুলের সঙ্গে আমার বিশেষ সৌহার্দ্য না থাকলেও বিয়ের পর থেকে এই ভদ্রলোকের সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল। আমি গ্রেফতার হওয়ার মাসখানেক আগে লাল মামার বসুন্ধরার বাসায় তাকে দেখতেও গিয়েছিলাম। ক্যান্সারের একেবারে শেষপর্যায়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণাকাতর অবস্থায় তাকে দেখে বেশ কষ্টও পেয়েছিলাম। তখনই বোঝা যাচ্ছিল, অন্তিম সময় আসতে আর দেরি নেই। পারভীনের মামার এই মৃত্যু আকস্মিক না হলেও স্ত্রীর আপনজনের মৃত্যুশোকের সময় তার পাশে থেকে সান্ত্বনা দিতে না পারার অক্ষমতা আমাকে যথেষ্ট পীড়া দিচ্ছিল।
প্রধান বিচারপতির এজলাসে বসেই বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার মায়ের মৃত্যুর ঘটনাটি মনে পড়ে গেল। জেনারেল মইনের জরুরি আইনের সময় সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বিশেষ কারাগারে বন্দি অবস্থায় তার মা ইন্তেকাল করেছিলেন। সেই শোকের মুহূর্তে বিদেশি প্রভুর নির্দেশে পরিচালিত তত্কালীন সরকার বেগম খালেদা জিয়া এবং তার পরিবারের সঙ্গে যে অন্যায়, অমানবিক আচরণ করেছিল তার নিন্দা জানানোর ভাষা সে সময় খুঁজে পাইনি। বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থ বন্দি পুত্র তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমানকে ভিন্ন ভিন্ন থানায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয়েছিল, যাতে শেষবারের মতো আপনজনকে শ্রদ্ধা জানানোর সময়ও কোনোক্রমে মাতা-পুত্রের সাক্ষাত্ না হয়। একজন মা এবং তার দুই সন্তানকে আলাদা সময়ে ক্যান্টনমেন্টের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি জিয়ার মৃত্যুর পর মাত্র দ্বিতীয় বারের জন্য প্রকাশ্যে কান্নারত বেগম খালেদা জিয়ার ছবি টেলিভিশনে দেখেছিলাম। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য প্রায়ই জনগণের সামনে কান্নাকাটি করেন। যাই হোক, বন্দিজীবনে কোনো প্রিয়জনের মৃত্যুসংবাদ শোনার অসহনীয় কষ্টের সঙ্গে তুলনীয় কোনো যন্ত্রণা রিমান্ডে এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। বেগম খালেদা জিয়ার মতোই আওয়ামী লীগ নেতা শেখ সেলিম ও বিএনপির মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকেও বন্দি অবস্থায় মায়ের মৃত্যু সহ্য করতে হয়েছিল। দল-মত, শ্রেণী-পেশা নির্বিশেষে যেসব বন্দিকে এই যন্ত্রণা সইতে হয়েছে, তাদের সবার প্রতি আমার সহমর্মিতা রইল। মনে মনে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে পারভীনের মামার জানা-অজানা অপরাধের জন্য মার্জনা ভিক্ষা করে আদালতের কাজে মনোযোগী হলাম।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের জেলজীবনের স্মৃতি রক্ষার্থে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে যে মিউজিয়ামটি নির্মিত হয়েছে, তার পাশ দিয়েই সাত নম্বর সেলে যাতায়াতের পথ। মিউজিয়াম চত্বরে শেখ মুজিবের একটি আবক্ষ ধাতব মূর্তি রয়েছে। আজ সেলে আসার পথে হঠাত্ মূর্তিটির দিকে চোখ পড়ল। জেল প্রশাসন কাপড় জড়িয়ে মূর্তিটি ঢেকে রেখেছে। কোনো বেয়াদব পাখি কোনোরকম কুকর্ম করে যাতে মূর্তির পবিত্রতা নষ্ট করতে না পারে, সেই সদিচ্ছা থেকেই সম্ভবত জেল প্রশাসন এই কর্মটি করেছে। কিন্তু সুপার-জেলার সমস্যা বাঁধিয়েছেন কাপড় নির্বাচন নিয়ে। জেলের ভাণ্ডারে ভালো কোনো কাপড় না পেয়ে মূর্তি ঢাকার জন্য কয়েদিদের পোশাক ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমে ভাবলাম, ভুল দেখছি। দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে বেশ খানিকটা সময় ধরে মনোযোগ দিয়ে দেখে নিশ্চিত হলাম, আমার দৃষ্টিশক্তি ঠিকই আছে। আপিল বিভাগ আমাকে আজ থেকে কয়েদি বানিয়ে দিলেও দুই কারণে জেল প্রশাসন ইচ্ছে করলেও আমাকে কয়েদির নির্ধারিত পোশাক পরাতে পারছে না। প্রথম কারণ সিভিল মামলায় আমার সাজা হয়েছে, এ ধরনের মামলার কয়েদিদের জেলের পোশাক পরা বাধ্যতামূলক নয়। দ্বিতীয়ত, আমি সাত নম্বর সেলে সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে থাকলেও প্রশাসনের খাতাপত্রে আমার মর্যাদা প্রথম শ্রেণীপ্রাপ্ত ডিভিশন কয়েদির। জেল কোড অনুযায়ী প্রথম শ্রেণীর কয়েদিরা ব্যক্তিগত পোশাক পরিধান করবেন। অতএব কয়েদির ডোরাকাটা পোশাক পরতে হচ্ছে না। দেশবাসী এতদিনে জেনে গেছেন, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই আমাকে বিনা অপরাধে জেলে আনা হয়েছে, আমার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত অর্ধশত মামলাও দায়ের হয়েছে। আজ আপিল বিভাগ আমাকে সর্বোচ্চেরও অধিক সাজা দেয়ায় তিনি নিশ্চয়ই পরম সন্তোষও লাভ করেছেন। অথচ কাকতালীয়ভাবে আমার সাজাপ্রাপ্তির বিশেষ দিনটিতেই জেল প্রশাসন তার মরহুম পিতার মূর্তিকেই কয়েদির পোশাক পরিয়ে রেখেছে। ‘Divine justice’-এর এই নমুনা দর্শনে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতার যে হাসি ঠোঁটের কোণে ঝুলে ছিল, সেটিকে সঙ্গে করেই আমার সেলে পা রেখেছিলাম। ফয়সালের কাছ থেকে পাওয়া এক সংবাদে খুশিটা আরও বাড়ল। জেল কোড অনুযায়ী কয়েদির দৈনিক খোরাকি হাজতির চেয়ে কুড়ি টাকা বেশি। আজ থেকে আমার দৈনিক সরকারি বরাদ্দ নাকি ১০৬ টাকা হবে। টাকা বাড়লে হয়তো খাবার-দাবারের মানও আগের চেয়ে উন্নত হবে। মনে মনে ভাবলাম, হাজতির তুলনায় কয়েদি ব্যাপারটা একেবারে মন্দ নয়।
আদালত থেকে ফিরে কাপড় বদলানোরও সময় পেলাম না, ক্যামেরা হাতে প্রশাসনের লোকজন এসে হাজির। নতুন করে কয়েদি মাহমুদুর রহমানের ছবি তুলতে হবে। জেলে আসার পরদিন অর্থাত্ জুনের তিন তারিখে বুকে হাজতির নম্বর সেঁটে হাজতির ছবি তুলতে হয়েছিল। সেই ছবিতে নাকি আর চলবে না। এবার কয়েদির নম্বর বুকে ঝুলিয়ে ছবি তোলাতে হবে। তবে জেল প্রশাসন খানিকটা দয়া দেখালো। প্রথমবার ছবি তোলাতে আমাকেই জেল হাসপাতালের সামনের আঙিনায় ক্যামেরাম্যানের খোঁজে যেতে হয়েছিল। আজ ক্যামেরাম্যান নিজেই সাত নম্বর সেলে হাজির হয়েছে। পাঠকের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, জেলে ক্যামেরাম্যানের দায়িত্ব কোনো একজন অভিজ্ঞ কয়েদিই পালন করে। ছবি তোলা শেষ হলে অন্য সেল এবং ওয়ার্ড থেকে দর্শনার্থীদের আনাগোনা শুরু হলো। সবাই এসেছে আমার সাজাপ্রাপ্তিতে সমবেদনা জানাতে। অধিকাংশের সমবেদনা আন্তরিক হলেও তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ যে আনন্দ অনুভব করছিল না, এমন কথা বলা যাবে না। উঁচু প্রাচীরের বাইরের মুক্ত জগতের মতো জেলের ভেতরেও আওয়ামী-বিএনপি স্পষ্ট বিভাজন রয়েছে।
উনিশ তারিখে আমার সাজা হওয়ার পরদিন পারভীন দেখা করতে এলো। জুলাইয়ের ২৩ তারিখে প্রথমবার দেখা করতে এসে বড় আশা করে বলেছিল, আগস্টের ভেতরে আমি মুক্তি পেলে আর এখানে আসবে না। গতকালের রায় তার সেই আশার প্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছে। অনির্দিষ্টকালের কয়েদি জীবনের আজ প্রথম দিন। আমার বিষণ্ন স্ত্রী নতুন দুঃসংবাদ শোনালো। সরকার এবার আমাদের অন্নসংস্থানে হাত দিয়েছে। উপরের নির্দেশে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর যৌথভাবে এমন হয়রানি করছে যে, পারভীনের পক্ষে আমাদের অন্ন-বস্ত্রের একমাত্র সহায় আর্টিজান সিরামিক আর বেশিদিন চালানোও বোধহয় সম্ভব হবে না। প্রতিহিংসাপরায়ণ সরকারপ্রধান নীতি-নৈতিকতা ছুড়ে ফেলে দিয়ে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে একজন সাধারণ নাগরিক এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে সর্বতোভাবে ব্যবহার করছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ফ্যাসিবাদের নৃশংসতা সীমাহীন। আপনজনদের নিরাপত্তা নিয়ে আমার দুর্ভাবনার কথা জানাতেই পারভীন বলল, জেলের ভেতরে আমি সুস্থ থাকলে সরকারের কোনো অত্যাচার-নির্যাতনকেই সে এবং আমার মা পরোয়া করেন না। আল্লাহতায়ালার অপার করুণায় আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি—একথা বলে স্ত্রীকে আশ্বস্ত করে বিদায় জানালাম। স্বাভাবিকভাবেই মনটা বড় অশান্ত হয়ে পড়ল। আর্টিজান চলবে কি চলবে না, ও নিয়ে আমার কোনো চিন্তা নেই। ঢাকা শহরে আমাদের তিনজনের একটা আশ্রয় রয়েছে, তিনবেলা আহারেরও কোনো সমস্যা নেই। এর অতিরিক্ত অর্থ-বিত্তের প্রত্যাশা দীর্ঘ পেশাগত জীবনে কখনও করিনি। জেলে বন্দি থাকার ব্যাপারটাও আমার কাছে এর মধ্যে সহনীয় হয়ে গেছে। যে কোনোদিন জেলে আসার ঝুঁকি নিয়েই তো এক/এগারো-পরবর্তী সময়ে তত্কালীন জালিম সরকারের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলাম, পরবর্তী সময়ে আমার দেশ পত্রিকার দায়িত্বও গ্রহণ করেছি। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের এই হেনস্তার বেদনা সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে।
আদালত অবমাননার দ্বিতীয় মামলার তারিখ দ্রুত এসে গেল। প্রথম মামলার সাজা ঘোষণা আর দ্বিতীয় মামলার শুনানির মধ্যে মাত্র চারদিনের ব্যবধান। জেল কর্তৃপক্ষ আমার সঙ্গে কোনো আইনজীবীকে দেখা করতে দিচ্ছে না। আগের মতো একাই প্রস্তুতি নিচ্ছি। আপিল বিভাগে এই মামলার রায় কী হবে, তা নিয়ে আমার কোনো উদ্বেগ নেই। আপন অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, মাসখানেকের মধ্যেই কারাজীবন একরকম ধাতস্থ হয়ে যায়। নির্মম সাজা অবশ্য ভোগ করে পরিবারের অসহায়, নিরপরাধ সদস্যরা। তাদের সেই কষ্ট দুর্বিষহ। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার বাস্তবতায় আমার ভরসার স্থল এখন সৃষ্টিকর্তা এবং দেশের জনগণ। দেশের সেই সাধারণ মানুষের কাছে আমার বক্তব্য পৌঁছানোর জন্যই ‘শো-কজে’র জবাবের খসড়া তৈরিতে মনোনিবেশ করেছি। প্রথম মামলার সময় কয়েক রাত টানা না ঘুমিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। সেই বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দৈনন্দিন রুটিনের পরিবর্তন ঘটিয়েছি। ইফতারের পর আর কিছু না খেয়ে এশার নামাজ পড়েই ঘুমিয়ে পড়ি। রাত দুটোয় ডিভিশন সেল থেকে সাহির নিয়ে এলে ঘুম ভাঙে। সাহির খাওয়ার আগে-পরে ভোর ছ’টা পর্যন্ত একটানা কাজ করি। তারপর গোসলের পাট চুকিয়ে সকাল সাতটায় দ্বিতীয় দফার ঘুম। শরীর ও মস্তিষ্কের ক্লান্তির ফলে দেড়-দুই ঘণ্টা ঘুম সহজেই হয়ে যায়। দুই দফায় ঘণ্টা ছয়েক ঘুম এই বয়সে যথেষ্ট। মুক্ত জীবনেও তো এক শুক্রবার ছাড়া ছয় ঘণ্টার অধিক ঘুমানোর সুযোগ হয়নি।
দ্বিতীয় মামলার জবাবের খসড়া লেখার ফাঁকে ফাঁকে সরকার সমর্থক পত্রপত্রিকা পড়ে প্রথম মামলার নজিরবিহীন রায়ের দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করছি। জেলে আসার পর থেকে প্রধানত ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারই পড়ছি। আমার মামলা নিয়ে পত্রিকাটির সংবাদ পরিবেশনের ধরনটি আমার প্রত্যাশার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আদালতে প্রদত্ত আমার কোনো জবাবই তারা ছাপানোর উপযুক্ত বিবেচনা করেননি। অপরদিকে আদালতের তিরস্কার, বিশেষত সংবাদপত্র জগতে অনভিজ্ঞতা নিয়ে লর্ডশিপদের বিদ্রূপাত্মক ও অবমাননাকর মন্তব্য পত্রিকার প্রথম পাতায় বেশ বড় করেই ছাপা হয়েছে। তবে পত্রিকাটি তাদের সম্পাদকীয়তে রায়ের সমালোচনা করেছে। এই সম্পাদকীয় লেখার উদ্দেশ্য বোঝা কঠিন নয়। আমার সাজা হওয়ায় সুশীল (?) মুখপত্রটি শ্রেণীবিদ্বেষের কারণেই অতিশয় আনন্দিত। তবে ভবিষ্যতের অজানা বৈরী পরিস্থিতিতে আদালতের এমন তরবারির আঘাতে আবার তাদের কোনো সমগোত্রীয়ের মাথা যাতে কাটা না যায়, তারই আগাম সতর্কতা হিসেবে সম্পাদকীয়তে এই আদর্শের বাণী প্রচার। তবে একই পত্রিকায় প্রকাশিত সিপিজে’র (Committee to Protect Journalists) বিবৃতি পড়ে উদ্দীপ্ত বোধ করলাম। সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় প্রতিষ্ঠিত নিউইয়র্কভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি সুপ্রিমকোর্টের রায়ের কঠোর সমালোচনা করে সাজা বাতিলের দাবি জানিয়েছে। পুরো বিষয়টিকে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য অত্যন্ত নেতিবাচক আখ্যা দিয়ে সংগঠনটির ডেপুটি ডিরেক্টর রবার্ট মেহানি (Robert Mahoney) মন্তব্য করেছেন, সাংবাদিকদের কোনো রকম ভয়ভীতি ছাড়া অবশ্যই বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে মন্তব্য করার অধিকার আছে। মনে হলো, আমার এই নিগ্রহ, মায়ের চোখের পানি, স্ত্রীর হাহাকার একেবারে বৃথা যায়নি। সমাজের জমাটবাঁধা অন্ধকারের মধ্যে একখানি ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গও যদি জ্বালাতে পেরে থাকি, তাহলেই আমার মতো এক অকিঞ্চিত্কর ব্যক্তির জীবন সার্থক। মামলার শুনানির সময় আমার প্রতি অনেক রকম কটু বাক্য ব্যবহারের মধ্যে স্বয়ং প্রধান বিচারপতি মো. ফজলুল করিম বাংলাদেশের বিচার বিভাগ সম্পর্কে সমালোচনামূলক বক্তব্য প্রদানের ক্ষেত্রে আমাকে Path finder (পথপ্রদর্শক) খেতাব দিয়েছিলেন। এদেশের উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তাদের আদর্শ ও আত্মসম্মান বিকিয়ে দিয়ে হলেও ক্ষমতাবানদের সঙ্গে সমঝোতা করাটাকেই বুদ্ধিমানের কাজ বলে বিবেচনা করেন। আমি না হয় জীবনসায়াহ্নে এসে নির্বোধের মতো বিদ্রোহের পথপ্রদর্শকই হলাম। এই হঠকারিতার জন্য সর্বোচ্চেরও অধিক সাজা দিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত আমাকে ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করতে তো চেয়েছেনই, সেই সঙ্গে অন্য নাগরিকদের মনেও তাদের সম্পর্কে ভীতি উত্পন্ন করতে চেয়েছেন। এই পরিণত বয়সে আমার স্বভাব পরিবর্তনের সমুদয় চেষ্টা বলাই বাহুল্য ব্যর্থ হবে। জালিমের কারাগার থেকে মুক্তি পেলে সত্যের পক্ষে আবারও ইনশাআল্লাহ কলম ধরব। আদালতের রায়ে সাধারণ জনগণ কতখানি ভীতসন্ত্রস্ত হয়, সেটা ভবিষ্যতেই দেখা যাবে।
দেখতে দেখতে ২৪ আগস্ট এসে গেল। আগের মতোই হাস্যকর ধরনের অতিরিক্ত নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে আমাকে সুপ্রিমকোর্টে নেয়া হলো। সরকারের দৃষ্টিতে বোধহয় এই মুহূর্তে আমার চেয়ে ভয়ঙ্কর জঙ্গি (!) বাংলাদেশে নেই। সম্ভব হলে প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডাণ্ডাবেড়ি পরানোরও নির্দেশ দিতেন। আমিও অবশ্য তাকে উত্ত্যক্ত কম করছি না। প্রতিদিন প্রিজন ভ্যান থেকে নামা এবং ওঠার সময় উপস্থিত সংবাদকর্মীদের উদ্দেশে হাসিমুখে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাই, আদালতের বারান্দা দিয়ে এত দ্রুতগতিতে হাঁটি যে সঙ্গের পুলিশ অ্যাসকর্ট সদস্যদের তাল মেলাতে প্রায় দৌড়াতে হয়। আজ আমার প্রতিবাদ আরও দৃষ্টিগ্রাহ্য করার জন্য মার্কিন মুলুকের কালো মানুষের মতো করে মুষ্টিবদ্ধ হাত উত্তোলিত করলাম। সরকার এবং আদালতের জুলুমের বিরুদ্ধে আমার প্রতিবাদ জনগণকে এর চেয়ে কঠিন ও স্পষ্ট করে বোঝানোর আর কোনো সুযোগ নেই। আদালতে ঢুকেই দেখি বন্ধুবর বাবলু অপেক্ষমাণ। আমার সাজা ঘোষণার দিন বাবলু নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেদিন আদালতে উপস্থিত থাকতে পারেনি। বাবলুর কাছ থেকে পারভীনের মামার মৃত্যুসংবাদ শুনলাম। ভদ্রলোক দীর্ঘদিন ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগছিলেন। বয়স সম্ভবত সবে ষাট স্পর্শ করেছিল। শ্বশুরকুলের সঙ্গে আমার বিশেষ সৌহার্দ্য না থাকলেও বিয়ের পর থেকে এই ভদ্রলোকের সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল। আমি গ্রেফতার হওয়ার মাসখানেক আগে লাল মামার বসুন্ধরার বাসায় তাকে দেখতেও গিয়েছিলাম। ক্যান্সারের একেবারে শেষপর্যায়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণাকাতর অবস্থায় তাকে দেখে বেশ কষ্টও পেয়েছিলাম। তখনই বোঝা যাচ্ছিল, অন্তিম সময় আসতে আর দেরি নেই। পারভীনের মামার এই মৃত্যু আকস্মিক না হলেও স্ত্রীর আপনজনের মৃত্যুশোকের সময় তার পাশে থেকে সান্ত্বনা দিতে না পারার অক্ষমতা আমাকে যথেষ্ট পীড়া দিচ্ছিল।
প্রধান বিচারপতির এজলাসে বসেই বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার মায়ের মৃত্যুর ঘটনাটি মনে পড়ে গেল। জেনারেল মইনের জরুরি আইনের সময় সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বিশেষ কারাগারে বন্দি অবস্থায় তার মা ইন্তেকাল করেছিলেন। সেই শোকের মুহূর্তে বিদেশি প্রভুর নির্দেশে পরিচালিত তত্কালীন সরকার বেগম খালেদা জিয়া এবং তার পরিবারের সঙ্গে যে অন্যায়, অমানবিক আচরণ করেছিল তার নিন্দা জানানোর ভাষা সে সময় খুঁজে পাইনি। বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থ বন্দি পুত্র তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমানকে ভিন্ন ভিন্ন থানায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয়েছিল, যাতে শেষবারের মতো আপনজনকে শ্রদ্ধা জানানোর সময়ও কোনোক্রমে মাতা-পুত্রের সাক্ষাত্ না হয়। একজন মা এবং তার দুই সন্তানকে আলাদা সময়ে ক্যান্টনমেন্টের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি জিয়ার মৃত্যুর পর মাত্র দ্বিতীয় বারের জন্য প্রকাশ্যে কান্নারত বেগম খালেদা জিয়ার ছবি টেলিভিশনে দেখেছিলাম। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য প্রায়ই জনগণের সামনে কান্নাকাটি করেন। যাই হোক, বন্দিজীবনে কোনো প্রিয়জনের মৃত্যুসংবাদ শোনার অসহনীয় কষ্টের সঙ্গে তুলনীয় কোনো যন্ত্রণা রিমান্ডে এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। বেগম খালেদা জিয়ার মতোই আওয়ামী লীগ নেতা শেখ সেলিম ও বিএনপির মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকেও বন্দি অবস্থায় মায়ের মৃত্যু সহ্য করতে হয়েছিল। দল-মত, শ্রেণী-পেশা নির্বিশেষে যেসব বন্দিকে এই যন্ত্রণা সইতে হয়েছে, তাদের সবার প্রতি আমার সহমর্মিতা রইল। মনে মনে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে পারভীনের মামার জানা-অজানা অপরাধের জন্য মার্জনা ভিক্ষা করে আদালতের কাজে মনোযোগী হলাম।
No comments