৩৩- রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী
এরই নাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা!
যত দ্রুত সম্ভব জয়নাল ভাইয়ের চোখের সামনে থেকে সরে গিয়ে আপন সেলের অন্ধকার গহ্বরে আশ্রয় নিলাম। এরই নাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা! ধিক, এই চেতনাধারীদের। এ দেশে ভণ্ডামির কি কোনো শেষ নেই?
যত দ্রুত সম্ভব জয়নাল ভাইয়ের চোখের সামনে থেকে সরে গিয়ে আপন সেলের অন্ধকার গহ্বরে আশ্রয় নিলাম। এরই নাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা! ধিক, এই চেতনাধারীদের। এ দেশে ভণ্ডামির কি কোনো শেষ নেই?
আজ ছাব্বিশ রোজা। সাপ্তাহিক দেখায় আমার দেশ পত্রিকার উপ-সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ, ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম এবং অ্যাডভোকেট সালেহ্উদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে মাসুম উপস্থিত হলো। আমার গ্রেফতারের পর থেকেই মাসুম নামের ছাত্রদল করা ছেলেটি দিবা-রাত্র দৌড়ে বেড়াচ্ছে আমার অর্ধশত মামলার নানান তদবিরে। আজ মামলার আলোচনা দ্রুত শেষ করে আবদালের সঙ্গে পত্রিকা নিয়েই প্রধানত পরামর্শ করলাম। সুপ্রিমকোর্টে রায় আমাদের পক্ষে যাওয়ায় পত্রিকা প্রকাশে আইনগত কোনো সমস্যা না থাকলেও আমার দেশ নিদারুণ অর্থকষ্টে পড়েছে। সরকারি খাতের বিজ্ঞাপন তো আগে থেকেই সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। রাজরোষ প্রকাশ পেতেই বেসরকারি বিজ্ঞাপনদাতারাও অনেকটাই হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানেন, বিজ্ঞাপন ছাড়া পত্রিকা চালানো আর অক্সিজেন ছাড়া হিমালয় পর্বত চূড়ায় আরোহণের চেষ্টার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দেশের স্বার্থের কথা বলে যতই প্রাণপাত করা হোক না কেন, জনগণ স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে না উঠলে আদর্শ টিকিয়ে রাখতে কষ্টের আর কোনো সীমা থাকে না। পত্রিকার অন্য অংশীদাররা আমার হঠকারিতায় ভয়ানক বিরক্ত হলেও তারা লজ্জার খাতিরে মুখফুটে এখনও কিছু বলছেন না। তবে এ কথাটি পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের পক্ষে কোম্পানিকে নতুন করে কোনো ঋণ দেয়া সম্ভব নয়। তাদের বিচারবুদ্ধিকে অযৌক্তিক বলা যাবে না। নিরেট নির্বোধরাই আদর্শকে ব্যবসায়িক স্বার্থের ওপরে স্থান দেয়। বৈষয়িক বুদ্ধিহীনতার মাপকাঠিতে বাংলাদেশে আমাকে হারায়, এমন সাধ্য কার? এদিকে এক সিরামিক কারখানা আর মাথা গোঁজার একটি অ্যাপার্টমেন্ট ছাড়া আমার কিংবা পরিবারের আর কোনো সম্পদ নেই। ব্যাংকেও এমন অর্থ নেই যে কোম্পানিকে দিতে পারি। বেশ বিমর্ষচিত্তেই দেখার পালা সাঙ্গ করে নিজের সেলে ফিরলাম।
সারারাত আর ঘুম এলো না। সন্ধ্যায় রেডিওতে শোনা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের একটি বক্তব্যে মনের অস্থিরতা বেড়েছে। তিনি বললেন, আওয়ামী লীগ এখনও বাকশালের আদর্শে বিশ্বাস করে এবং এবারের মেয়াদে বাকশালেরই কয়েকটি নীতি সরকার বাস্তবায়ন করবে। গভীর রাতে দেশের সার্বিক অবস্থার সঙ্গে আমার দেশকে মিলিয়ে একটা মন্তব্য-প্রতিবেদন লেখার ইচ্ছে হলো। জানি বন্দি অবস্থায় এই লেখা ছাপা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পরক্ষণেই ভাবলাম, এখন না হোক—কোনোদিন মুক্তি পেলে আমার দেশ সম্পাদকের জেল-জীবনের গল্পের অংশ তো অন্তত লেখাটি হতে পারে! রাত জেগে বাংলাদেশের আপাত নির্লিপ্ত জনগণের কাছে আমার দেশ-এর পক্ষে এক ধরনের আবেদনই জানিয়েছি।
‘সত্যের পক্ষে দাঁড়ান’
“যুগে যুগে ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারী অপশক্তি সত্যের কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছে। ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এদেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। মাত্র ছয় মাস স্থায়ী এই বীভত্স শাসনব্যবস্থার অধীনে দেশের অধিকাংশ সাধারণ নাগরিক তখন নিপীড়িত হয়েছে। কেবল ব্যক্তিপূজা ও সরকার তোষণের জন্য চারটি দৈনিক পত্রিকা চালু রেখে দেশের সব পত্রিকা সে সময় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই ফ্যাসিবাদী শাসনকালে জাসদের গণকণ্ঠ, মওলানা ভাসানীর ‘হক কথা’ এবং এনায়েতুল্লাহ খানের হলিডে পত্রিকা অফিসে প্রশাসন এবং আওয়ামী লীগের পেটোয়া বাহিনী যৌথভাবে বারবার হামলা চালিয়েছে, ভাংচুর করেছে, এমনকি কর্মরত সাংবাদিকদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিতও করেছে। কবি আল মাহমুদ, এনায়েতুল্লাহ খান, ইরফানুল বারী এবং আফতাব আহমেদের মতো বরেণ্য সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেফতার করে বিনাবিচারে দীর্ঘদিন কারাগারে আটকে রাখা হয়েছিল। আহমদ ছফার মতো ভিন্নমাত্রিক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করার জন্য দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী পরিবারের প্রভাবশালী সদস্য তার খোঁজে সশস্ত্র ক্যাডার নিয়ে জিপে করে ঢাকা চষে বেড়িয়েছে। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে এই শহরেই দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন আহমদ ছফা। একদলীয় অপশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলাই ছিল এদের সবার অপরাধ।
তারপর তিন যুগ পার হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের বর্বরতা বদলায়নি। তবে তাদের কৌশলে পরিবর্তন এসেছে। এখন একদলীয় বাকশালের বদলে নির্বাচিত স্বৈরাচারের জামানা। পিতার মতো একসঙ্গে সব পত্রিকা নিষিদ্ধ না করে কন্যা বেছে বেছে ভিন্নমতের সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দরজায় তালা লাগাচ্ছেন। শীতল যুদ্ধের অবসানে বাংলাদেশে এক সময়ের ‘সমাজতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদ’ বর্তমানে পুঁজিবাদী ফ্যাসিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। আগের সাম্রাজ্যবাদী শত্রু আজ বাঙালি ফ্যাসিবাদের পরম মিত্র। বাংলাদেশে তাদের সুশাসনের প্রয়োজন মিটে গেছে। তথাকথিত ইসলামী জঙ্গিত্ব দমনের ছদ্মাবরণে সমাজে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোই ইঙ্গ-মার্কিন-ভারতের সমর্থনপুষ্ট সরকারের অন্যতম প্রধান এজেন্ডা। সেই এজেন্ডা বাস্তবায়িত হলেই বিদেশি প্রভুরা সন্তুষ্ট। দেশের সব স্বার্থ ইজারা দেয়া হয়েছে শক্তিধর প্রতিবেশীর পদতলে। যে কোনো মূল্যে ২০২১ পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকাই ক্ষমতাসীনদের মূল লক্ষ্য। জড়বাদী সমাজে প্রতিবাদের কণ্ঠ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অপরাধে রাত্রি দ্বিপ্রহরে শত শত দাঙ্গা পুলিশ পাঠিয়ে আমার দেশ বন্ধ করা হয়েছে। সম্পাদককে তার কার্যালয় থেকে ধরে নিয়ে রিমান্ড-নির্যাতন অন্তে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারাগারে পাঠিয়েছে গণতন্ত্রের লেবাসধারী স্বৈরাচারী সরকার। প্রশাসনিক এবং বিচারিক নির্যাতনের এক বিচিত্র যুগলবন্দি রচনা করা হয়েছে। আমার দেশ-এর তালা দু’মাস পরে অবশ্য খুলেছে। কিন্তু এই আপাত মুক্তি কি পত্রিকাটির বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দেয়? আমার বিবেচনায় দেশের লড়াকু, দেশপ্রেমিক জনগণ প্রতিরোধের ঝাণ্ডা হাতে রাজপথে না নামলে তাদের পক্ষে কথা বলার মতো কোনো গণমাধ্যমই এদেশে বাঁচবে না।
বাংলাদেশের ষোল কোটি নাগরিকের কাছে তাই সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাই। আমার দেশ স্বাধীনতার কথা বলে, মানবাধিকারের কথা বলে, জাতীয় স্বার্থের কথা বলে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফেরিওয়ালারা আমাদের মাতৃভূমিকে সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদী শক্তির কাছে ভেট দেয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে। ভীরু ও প্রতিবাদহীন সমাজে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থের কাছে রাষ্ট্রের সামষ্টিক স্বার্থের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। দেশপ্রেমবিবর্জিত বলদর্পীরা আমার দেশ-এর মতো জাতিস্বার্থের পক্ষের গণমাধ্যমকে টুঁটি চেপে মেরে ফেলতে চায়। ঔপনিবেশিক ভাবধারায় নির্মিত রাষ্ট্রযন্ত্রের সব ধরনের নির্মমতার শিকার হয়েও ফ্যাসিবাদের কাছে আমি মানসিকভাবে পরাজিত হইনি। নিজের পরিণতির পরোয়া আর করি না। তবে দেশের বড় দুঃসময়ে সত্য ও বিবেকের স্বাধীনতার যে কম্পমান শিখাটিকে ‘আমার দেশ’ ভয়াবহ প্রতিকূলতার মাঝে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে, তাকে নির্বাপিত হতে না দেয়ার আবেদন জানাই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এমনটি ঘটতে দিলে সত্যনিষ্ঠার আদর্শ পরাজিত হবে। বাংলাদেশের পক্ষের এই জোরালো কণ্ঠটি রুদ্ধ হলে জনগণ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফ্যাসিবাদের ভ্রূকুটিকে পরোয়া না করে তাই সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাই। এখন সিদ্ধান্ত গ্রহণের পালা আপনাদের।”
আমার আবেদনটি পাঠকের কাছে পৌঁছানোর কোনো উপায় নেই জানলেও মনের কথাটি প্রকাশ করতে পেরেই এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করলাম। সেই গভীর প্রশান্তিতেই ভোরবেলায় ঘুমিয়ে পড়ে একেবারে জোহরের আজানের শব্দে চোখ খুললাম।
সাত নম্বর সেলের হাজতিদের কয়েদিতে পরিণত হওয়ার পালা চলছে। তিন মাস আগে এই সেলে পা রাখার দিনে কয়েদি ছিল মাত্র দু’জন। মার্কিনি ফয়সাল এবং বাংলাদেশী ভাগ্নে মনির। বাকি এগারোজন বিচারাধীন হাজতি। গত মাসে কয়েদিতে পদোন্নতি আমাকে দিয়েই শুরু হয়। আজ কয়েদির সংখ্যা আরও একজন বেড়ে দাঁড়ালো চারে। মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) জয়নাল আবেদিন কিছুক্ষণ আগে নিম্ন আদালত থেকে সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ডের বোঝা নিয়ে কারাগারে ফিরলেন। দীর্ঘদিন ধরে তার বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র বহন করার অভিযোগে মামলা চলছিল। জয়নাল ভাইয়ের ধারণা ছিল, দুর্বল চার্জশিট এবং উদ্ধারকৃত চাপাতি ও চাইনিজ কুড়ালের সঙ্গে তার কোনো সংস্রব না থাকায় তিনি ছাড়া পেয়ে যাবেন। আজ সকালে রায় আনতে যাওয়ার সময়ও তাকে বেশ আশাবাদী মনে হচ্ছিল। বিচারাঙ্গনের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার আশঙ্কা ছিল, তিনি সাজা পাবেনই। ফয়সালকে বেশ ক’দিন আগে আমার আশঙ্কার কথাটা বলেওছিলাম। তবে জয়নাল ভাইকে কখনও হতাশ করতে মন চায়নি। কাল সন্ধ্যায় তিনি সুসংবাদ দিয়েছিলেন যে, তার বিরুদ্ধে চলমান দ্বিতীয় মামলাটি হাইকোর্টে ছয় মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। সংবাদটি দেয়ার সময় তার উজ্জ্বল চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি সহসাই মুক্তির আশা করছেন। আজ বিকেলে সাজা নিয়ে ফিরে এসে আমাদের দুঃসংবাদ শোনানোর সময় চেষ্টাকৃত উচ্ছ্বাস তার অন্তরের বেদনাকে অন্তত আমার কাছে ঢেকে রাখতে পারেননি। মাত্র ক’দিন আগেই অভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আমি নিজেই হয়েছি। জয়নাল ভাইয়ের সাজার রায় শোনার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় তার স্ত্রী আজ আদালতে কেঁদে ফেলেছিলেন। সেই কারণে আমাদের সামনে স্ত্রীর প্রতি ছদ্ম ক্ষোভ প্রকাশ তার ভালোবাসা ও উদ্বেগকেই বরং ফুটিয়ে তুলছিল। তিনি আদালতে রোরুদ্যমান স্ত্রীকে বলে এসেছেন, “বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসলামের পথে সংগ্রাম করলে জেল-জুলুম সহ্য করতেই হবে। কান্নাকাটি করলে আদালতে না থেকে তুমি বাড়ি ফিরে যাও।” এদিক দিয়ে আমি সৌভাগ্যবান ছিলাম। আমার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা চলাকালীন মা এবং স্ত্রীকে সুপ্রিমকোর্টে আসতে নিষেধ করেছিলাম এবং তারা সেই অনুরোধ রক্ষাও করেছিলেন। যাই হোক, কালকের মধ্যেই হয়তো আমার মতো জয়নাল ভাইয়ের বুকেও কয়েদির নম্বর সেঁটে ছবি তুলতে জেল প্রশাসন অস্থির হয়ে উঠবে। অপমান হজম করে মুখে কৃত্রিম হাসি ধরে রেখে মুক্তিযুদ্ধের এই সেক্টর কমান্ডারকে সেই ছবি তুলতেও হবে। নিত্যদিনের অপমানের সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার নামই জেল-জীবন। ভাগ্য সহায় হলে হাইকোর্টে আপিল চলাকালীন সময়ের জন্য জয়নাল ভাইয়ের জামিন জুটে যেতে পারে। অবশ্য অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস উত্সাহ দেখালে চেম্বারের পুলসেরাতে সেই জামিন আটকে দেয়াও কঠিন হবে না। সব মিলিয়ে তার মুক্তি যে অনেক দিন পিছিয়ে গেল, এতে আর কোনো সন্দেহ নেই। আসন্ন রাতের শেষ প্রহরে পাশের সেল থেকে ভেসে আসা মেজর (অব.) জয়নাল আবেদিনের কান্নাভেজা কণ্ঠের ফরিয়াদ অন্য রাতের চেয়ে সম্ভবত জোরে এবং দীর্ঘক্ষণ শুনতে পাব। আমার দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে, তার পথই যদি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে মহান আল্লাহতায়ালা এক সময় তার ডাকে অবশ্যই সাড়া দেবেন। তবে সেই সময় কবে আসবে, সেটাও তো আল্লাহই নির্ধারণ করবেন।
গতকাল যা ধারণা করেছিলাম, তা-ই ঘটলো। আমার গোসল তখনও শেষ হয়নি, এমন সময় দেখলাম জয়নাল ভাইয়ের সেলের সামনে জেলগেট থেকে কারারক্ষী এসে উপস্থিত। নতুন কয়েদি জয়নাল আবেদিনকে তখনই মহামহিম জেলার সাহেবকে দর্শন দিতে যেতে হবে। জেলের পরিভাষায় এই দর্শনের নাম ফাইল। সারারাত ইবাদত করে বেচারা ডাক আসার খানিকক্ষণ আগে মাত্র ঘুমিয়েছেন। উপায় নেই, জেলারের সমন বলে কথা! জয়নাল ভাই ফাইলের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ফিরে এসে জানালেন, ছবি তোলার পালা সাঙ্গ হয়েছে। কয়েদির একটা নতুন কার্ডও তার হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। আগেই বলেছি, নিম্ন আদালত মুক্তিযুদ্ধের এই বীর সেক্টর কমান্ডারকে সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে। আদালতের নির্দেশানুযায়ী সত্তরোর্ধ্ব এই বৃদ্ধ মানুষটির জন্য সর্বনিম্ন শ্রেণীর শ্রমের যে ক্যাটাগরি জেল প্রশাসন নির্ধারণ করেছে, তার নাম ‘সেবক’। জেলে সেবকের কাজ হলো অন্যান্য কয়েদি, বিশেষ করে ডিভিশন কয়েদিদের ফাই-ফরমাস খাটা। বয়সের কারণে জয়নাল ভাইকে হয়তো সেবকের কাজ করতে হবে না। কিন্তু ইচ্ছে করলেই জেল প্রশাসন একজন শিক্ষিত, সম্মানিত মানুষের উপযুক্ত কাজ যেমন, জেল গ্রন্থাগার দেখাশোনা করার দায়িত্ব প্রদান করতে পারতো। মনে হলো, সপাটে চড়টা আমার গালেই পড়লো। যত দ্রুত সম্ভব জয়নাল ভাইয়ের চোখের সামনে থেকে সরে গিয়ে আপন সেলের অন্ধকার গহ্বরে আশ্রয় নিলাম। এরই নাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা! ধিক, এই চেতনাধারীদের। এ দেশে ভণ্ডামির কি কোনো শেষ নেই? রাত পোহাবার কত দেরী, পাঞ্জেরী?
সারারাত আর ঘুম এলো না। সন্ধ্যায় রেডিওতে শোনা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের একটি বক্তব্যে মনের অস্থিরতা বেড়েছে। তিনি বললেন, আওয়ামী লীগ এখনও বাকশালের আদর্শে বিশ্বাস করে এবং এবারের মেয়াদে বাকশালেরই কয়েকটি নীতি সরকার বাস্তবায়ন করবে। গভীর রাতে দেশের সার্বিক অবস্থার সঙ্গে আমার দেশকে মিলিয়ে একটা মন্তব্য-প্রতিবেদন লেখার ইচ্ছে হলো। জানি বন্দি অবস্থায় এই লেখা ছাপা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পরক্ষণেই ভাবলাম, এখন না হোক—কোনোদিন মুক্তি পেলে আমার দেশ সম্পাদকের জেল-জীবনের গল্পের অংশ তো অন্তত লেখাটি হতে পারে! রাত জেগে বাংলাদেশের আপাত নির্লিপ্ত জনগণের কাছে আমার দেশ-এর পক্ষে এক ধরনের আবেদনই জানিয়েছি।
‘সত্যের পক্ষে দাঁড়ান’
“যুগে যুগে ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারী অপশক্তি সত্যের কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছে। ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এদেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। মাত্র ছয় মাস স্থায়ী এই বীভত্স শাসনব্যবস্থার অধীনে দেশের অধিকাংশ সাধারণ নাগরিক তখন নিপীড়িত হয়েছে। কেবল ব্যক্তিপূজা ও সরকার তোষণের জন্য চারটি দৈনিক পত্রিকা চালু রেখে দেশের সব পত্রিকা সে সময় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই ফ্যাসিবাদী শাসনকালে জাসদের গণকণ্ঠ, মওলানা ভাসানীর ‘হক কথা’ এবং এনায়েতুল্লাহ খানের হলিডে পত্রিকা অফিসে প্রশাসন এবং আওয়ামী লীগের পেটোয়া বাহিনী যৌথভাবে বারবার হামলা চালিয়েছে, ভাংচুর করেছে, এমনকি কর্মরত সাংবাদিকদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিতও করেছে। কবি আল মাহমুদ, এনায়েতুল্লাহ খান, ইরফানুল বারী এবং আফতাব আহমেদের মতো বরেণ্য সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেফতার করে বিনাবিচারে দীর্ঘদিন কারাগারে আটকে রাখা হয়েছিল। আহমদ ছফার মতো ভিন্নমাত্রিক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করার জন্য দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী পরিবারের প্রভাবশালী সদস্য তার খোঁজে সশস্ত্র ক্যাডার নিয়ে জিপে করে ঢাকা চষে বেড়িয়েছে। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে এই শহরেই দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন আহমদ ছফা। একদলীয় অপশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলাই ছিল এদের সবার অপরাধ।
তারপর তিন যুগ পার হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের বর্বরতা বদলায়নি। তবে তাদের কৌশলে পরিবর্তন এসেছে। এখন একদলীয় বাকশালের বদলে নির্বাচিত স্বৈরাচারের জামানা। পিতার মতো একসঙ্গে সব পত্রিকা নিষিদ্ধ না করে কন্যা বেছে বেছে ভিন্নমতের সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দরজায় তালা লাগাচ্ছেন। শীতল যুদ্ধের অবসানে বাংলাদেশে এক সময়ের ‘সমাজতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদ’ বর্তমানে পুঁজিবাদী ফ্যাসিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। আগের সাম্রাজ্যবাদী শত্রু আজ বাঙালি ফ্যাসিবাদের পরম মিত্র। বাংলাদেশে তাদের সুশাসনের প্রয়োজন মিটে গেছে। তথাকথিত ইসলামী জঙ্গিত্ব দমনের ছদ্মাবরণে সমাজে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোই ইঙ্গ-মার্কিন-ভারতের সমর্থনপুষ্ট সরকারের অন্যতম প্রধান এজেন্ডা। সেই এজেন্ডা বাস্তবায়িত হলেই বিদেশি প্রভুরা সন্তুষ্ট। দেশের সব স্বার্থ ইজারা দেয়া হয়েছে শক্তিধর প্রতিবেশীর পদতলে। যে কোনো মূল্যে ২০২১ পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকাই ক্ষমতাসীনদের মূল লক্ষ্য। জড়বাদী সমাজে প্রতিবাদের কণ্ঠ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অপরাধে রাত্রি দ্বিপ্রহরে শত শত দাঙ্গা পুলিশ পাঠিয়ে আমার দেশ বন্ধ করা হয়েছে। সম্পাদককে তার কার্যালয় থেকে ধরে নিয়ে রিমান্ড-নির্যাতন অন্তে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারাগারে পাঠিয়েছে গণতন্ত্রের লেবাসধারী স্বৈরাচারী সরকার। প্রশাসনিক এবং বিচারিক নির্যাতনের এক বিচিত্র যুগলবন্দি রচনা করা হয়েছে। আমার দেশ-এর তালা দু’মাস পরে অবশ্য খুলেছে। কিন্তু এই আপাত মুক্তি কি পত্রিকাটির বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দেয়? আমার বিবেচনায় দেশের লড়াকু, দেশপ্রেমিক জনগণ প্রতিরোধের ঝাণ্ডা হাতে রাজপথে না নামলে তাদের পক্ষে কথা বলার মতো কোনো গণমাধ্যমই এদেশে বাঁচবে না।
বাংলাদেশের ষোল কোটি নাগরিকের কাছে তাই সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাই। আমার দেশ স্বাধীনতার কথা বলে, মানবাধিকারের কথা বলে, জাতীয় স্বার্থের কথা বলে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফেরিওয়ালারা আমাদের মাতৃভূমিকে সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদী শক্তির কাছে ভেট দেয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে। ভীরু ও প্রতিবাদহীন সমাজে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থের কাছে রাষ্ট্রের সামষ্টিক স্বার্থের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। দেশপ্রেমবিবর্জিত বলদর্পীরা আমার দেশ-এর মতো জাতিস্বার্থের পক্ষের গণমাধ্যমকে টুঁটি চেপে মেরে ফেলতে চায়। ঔপনিবেশিক ভাবধারায় নির্মিত রাষ্ট্রযন্ত্রের সব ধরনের নির্মমতার শিকার হয়েও ফ্যাসিবাদের কাছে আমি মানসিকভাবে পরাজিত হইনি। নিজের পরিণতির পরোয়া আর করি না। তবে দেশের বড় দুঃসময়ে সত্য ও বিবেকের স্বাধীনতার যে কম্পমান শিখাটিকে ‘আমার দেশ’ ভয়াবহ প্রতিকূলতার মাঝে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে, তাকে নির্বাপিত হতে না দেয়ার আবেদন জানাই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এমনটি ঘটতে দিলে সত্যনিষ্ঠার আদর্শ পরাজিত হবে। বাংলাদেশের পক্ষের এই জোরালো কণ্ঠটি রুদ্ধ হলে জনগণ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফ্যাসিবাদের ভ্রূকুটিকে পরোয়া না করে তাই সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাই। এখন সিদ্ধান্ত গ্রহণের পালা আপনাদের।”
আমার আবেদনটি পাঠকের কাছে পৌঁছানোর কোনো উপায় নেই জানলেও মনের কথাটি প্রকাশ করতে পেরেই এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করলাম। সেই গভীর প্রশান্তিতেই ভোরবেলায় ঘুমিয়ে পড়ে একেবারে জোহরের আজানের শব্দে চোখ খুললাম।
সাত নম্বর সেলের হাজতিদের কয়েদিতে পরিণত হওয়ার পালা চলছে। তিন মাস আগে এই সেলে পা রাখার দিনে কয়েদি ছিল মাত্র দু’জন। মার্কিনি ফয়সাল এবং বাংলাদেশী ভাগ্নে মনির। বাকি এগারোজন বিচারাধীন হাজতি। গত মাসে কয়েদিতে পদোন্নতি আমাকে দিয়েই শুরু হয়। আজ কয়েদির সংখ্যা আরও একজন বেড়ে দাঁড়ালো চারে। মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) জয়নাল আবেদিন কিছুক্ষণ আগে নিম্ন আদালত থেকে সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ডের বোঝা নিয়ে কারাগারে ফিরলেন। দীর্ঘদিন ধরে তার বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র বহন করার অভিযোগে মামলা চলছিল। জয়নাল ভাইয়ের ধারণা ছিল, দুর্বল চার্জশিট এবং উদ্ধারকৃত চাপাতি ও চাইনিজ কুড়ালের সঙ্গে তার কোনো সংস্রব না থাকায় তিনি ছাড়া পেয়ে যাবেন। আজ সকালে রায় আনতে যাওয়ার সময়ও তাকে বেশ আশাবাদী মনে হচ্ছিল। বিচারাঙ্গনের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার আশঙ্কা ছিল, তিনি সাজা পাবেনই। ফয়সালকে বেশ ক’দিন আগে আমার আশঙ্কার কথাটা বলেওছিলাম। তবে জয়নাল ভাইকে কখনও হতাশ করতে মন চায়নি। কাল সন্ধ্যায় তিনি সুসংবাদ দিয়েছিলেন যে, তার বিরুদ্ধে চলমান দ্বিতীয় মামলাটি হাইকোর্টে ছয় মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। সংবাদটি দেয়ার সময় তার উজ্জ্বল চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি সহসাই মুক্তির আশা করছেন। আজ বিকেলে সাজা নিয়ে ফিরে এসে আমাদের দুঃসংবাদ শোনানোর সময় চেষ্টাকৃত উচ্ছ্বাস তার অন্তরের বেদনাকে অন্তত আমার কাছে ঢেকে রাখতে পারেননি। মাত্র ক’দিন আগেই অভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আমি নিজেই হয়েছি। জয়নাল ভাইয়ের সাজার রায় শোনার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় তার স্ত্রী আজ আদালতে কেঁদে ফেলেছিলেন। সেই কারণে আমাদের সামনে স্ত্রীর প্রতি ছদ্ম ক্ষোভ প্রকাশ তার ভালোবাসা ও উদ্বেগকেই বরং ফুটিয়ে তুলছিল। তিনি আদালতে রোরুদ্যমান স্ত্রীকে বলে এসেছেন, “বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসলামের পথে সংগ্রাম করলে জেল-জুলুম সহ্য করতেই হবে। কান্নাকাটি করলে আদালতে না থেকে তুমি বাড়ি ফিরে যাও।” এদিক দিয়ে আমি সৌভাগ্যবান ছিলাম। আমার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা চলাকালীন মা এবং স্ত্রীকে সুপ্রিমকোর্টে আসতে নিষেধ করেছিলাম এবং তারা সেই অনুরোধ রক্ষাও করেছিলেন। যাই হোক, কালকের মধ্যেই হয়তো আমার মতো জয়নাল ভাইয়ের বুকেও কয়েদির নম্বর সেঁটে ছবি তুলতে জেল প্রশাসন অস্থির হয়ে উঠবে। অপমান হজম করে মুখে কৃত্রিম হাসি ধরে রেখে মুক্তিযুদ্ধের এই সেক্টর কমান্ডারকে সেই ছবি তুলতেও হবে। নিত্যদিনের অপমানের সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার নামই জেল-জীবন। ভাগ্য সহায় হলে হাইকোর্টে আপিল চলাকালীন সময়ের জন্য জয়নাল ভাইয়ের জামিন জুটে যেতে পারে। অবশ্য অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস উত্সাহ দেখালে চেম্বারের পুলসেরাতে সেই জামিন আটকে দেয়াও কঠিন হবে না। সব মিলিয়ে তার মুক্তি যে অনেক দিন পিছিয়ে গেল, এতে আর কোনো সন্দেহ নেই। আসন্ন রাতের শেষ প্রহরে পাশের সেল থেকে ভেসে আসা মেজর (অব.) জয়নাল আবেদিনের কান্নাভেজা কণ্ঠের ফরিয়াদ অন্য রাতের চেয়ে সম্ভবত জোরে এবং দীর্ঘক্ষণ শুনতে পাব। আমার দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে, তার পথই যদি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে মহান আল্লাহতায়ালা এক সময় তার ডাকে অবশ্যই সাড়া দেবেন। তবে সেই সময় কবে আসবে, সেটাও তো আল্লাহই নির্ধারণ করবেন।
গতকাল যা ধারণা করেছিলাম, তা-ই ঘটলো। আমার গোসল তখনও শেষ হয়নি, এমন সময় দেখলাম জয়নাল ভাইয়ের সেলের সামনে জেলগেট থেকে কারারক্ষী এসে উপস্থিত। নতুন কয়েদি জয়নাল আবেদিনকে তখনই মহামহিম জেলার সাহেবকে দর্শন দিতে যেতে হবে। জেলের পরিভাষায় এই দর্শনের নাম ফাইল। সারারাত ইবাদত করে বেচারা ডাক আসার খানিকক্ষণ আগে মাত্র ঘুমিয়েছেন। উপায় নেই, জেলারের সমন বলে কথা! জয়নাল ভাই ফাইলের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ফিরে এসে জানালেন, ছবি তোলার পালা সাঙ্গ হয়েছে। কয়েদির একটা নতুন কার্ডও তার হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। আগেই বলেছি, নিম্ন আদালত মুক্তিযুদ্ধের এই বীর সেক্টর কমান্ডারকে সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে। আদালতের নির্দেশানুযায়ী সত্তরোর্ধ্ব এই বৃদ্ধ মানুষটির জন্য সর্বনিম্ন শ্রেণীর শ্রমের যে ক্যাটাগরি জেল প্রশাসন নির্ধারণ করেছে, তার নাম ‘সেবক’। জেলে সেবকের কাজ হলো অন্যান্য কয়েদি, বিশেষ করে ডিভিশন কয়েদিদের ফাই-ফরমাস খাটা। বয়সের কারণে জয়নাল ভাইকে হয়তো সেবকের কাজ করতে হবে না। কিন্তু ইচ্ছে করলেই জেল প্রশাসন একজন শিক্ষিত, সম্মানিত মানুষের উপযুক্ত কাজ যেমন, জেল গ্রন্থাগার দেখাশোনা করার দায়িত্ব প্রদান করতে পারতো। মনে হলো, সপাটে চড়টা আমার গালেই পড়লো। যত দ্রুত সম্ভব জয়নাল ভাইয়ের চোখের সামনে থেকে সরে গিয়ে আপন সেলের অন্ধকার গহ্বরে আশ্রয় নিলাম। এরই নাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা! ধিক, এই চেতনাধারীদের। এ দেশে ভণ্ডামির কি কোনো শেষ নেই? রাত পোহাবার কত দেরী, পাঞ্জেরী?
No comments